৩২
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে, এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানি জান্তা তার সামরিক বাহিনীকে ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টারসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংসতা, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, কামান দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া ছাত্রাবাস, ছাত্রাবাস থেকে বের করে এনে কাতারবন্দি করে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা, যেন তারা পিঁপড়ার সারি, আর তুমি অ্যারোসল স্প্রে করে মারলে শত শত পিঁপড়াকে, গণকবর খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া সেইসব লাশ, এখনও মারা না যাওয়া কোনো গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মাটিচাপা পড়ে তলিয়ে যাওয়ার আগে মা বলে কেঁদে ওঠা শেষ চিৎকার, শিক্ষক-আবাসে ঢুকে নাম ধরে ডেকে ডেকে হত্যা করা শিক্ষকদের, তার শিশুসন্তানের সামনে, তার স্ত্রীর সামনে, কামানের তোপ দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা সংবাদপত্র অফিস আর খুন করে ফেলা সাংবাদিকদের, আর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া জনবসতি, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে মা আর তার স্তনবৃন্তে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিশু, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ, তার মুখ থেকে এখনও শেষ হয়নি বিপদতাড়ানিয়া আজানের আল্লাহু আকবার ধ্বনি, মাংস পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস, আর সে-মাংস মানুষের, আর ভীতসন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, পুলিশ ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা বাঙালি পুলিশদের, ইপিআর ব্যারাকে হামলা চালিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুলি করে মারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘেরাও করে ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নির্বিচারে পাখি মারার মতো করে হত্যা করা, লাশে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, যেন হঠাৎ মাছের মড়ক লাগায় নদীতল ছেয়ে গেছে মরা মাছে, না, কোথাও পানি দেখা যাচ্ছে না, লাশ আর লাশ, আর সেসব মাছ নয়, মানুষ, ঢাকার সবগুলো পুলিশ স্টেশনে টেবিলের ওপরে উপুড় হয়ে আছে বাঙালি ডিউটি অফিসারের গুলি খাওয়া মৃতদেহ, দমকল বাহিনীর অফিসে ইউনিফরর্ম পরা দমকলকর্মীরা শুয়ে আছে, বসে আছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে দেয়ালে আটকে আছে লাশ হয়ে, ঢাকার সবগুলো বাজারে আগুন দেওয়া-পাতার পর পাতা শুধু এই পৈশাচিকতার, এই আগুনের, লাশের, হত্যার, আর্তনাদের আর মানুষ মারার আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়া সৈনিকের অট্টহাসির, আর মদের গেলাস নিয়ে মাতাল কন্ঠে সাবাস সাবাস আরো খুন আরো আগুন আরো রেইপ বলে জেনারেলদের চিৎকারে ফেটে পড়ার বর্ণনা লেখা যাবে, শত পৃষ্ঠা, সহস্র পৃষ্ঠা, নিযুত পৃষ্ঠা, তবু বর্ণনা শেষ হবে না, তবু ওই বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র আর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না ৷ কেই-বা সব দেখেছে একবারে, যে দেখেছে রাজারবাগে হামলা, তার কাছে ওই তো নরক, যে দেখেছে ইপিআরে হামলা, এক জীবনে সে আর কোনো দিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, যে অধ্যাপক ভিডিও করেছেন জগন্নাথ হলের মাঠে সারিবদ্ধ ছাত্রদের গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য, তিনিও তো ঘটনার সামান্য অংশই চিত্রায়িত করতে পেরেছেন মাত্র, যে সায়মন ড্রিঙ্ক বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার এড়িয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের রান্নাঘর দিয়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ পাঠিয়েছিলেন ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ, সাম উইটনেস অ্যাকাউন্টস, হাউ ড্যাক্কা পেইড ফর ইউনাইটেড পাকিস্তান’, তিনি নরকের বর্ণনার সামান্যই দিতে পেরেছিলেন ৷