দ্বাত্রিংশ অধ্যায় – মনু-কপিল-সংবাদ–প্রলয় কীর্তন
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–হে মহাত্মগণ! ভগবান বরাহদেহ-দ্বারা অকালে সৰ্বজনক্ষয়কারী প্রলয় করিলেন কেন, তাহা শ্রবণ কর। ১
ভগবান, মৎস্যরূপ ধারণ করত বেদ সকল রক্ষা করিলেন, মহাপাপনাশী সেই বৃত্তান্ত বলিব। ২।
পূর্বে সিদ্ধ ঈশ্বর বিষ্ণু মহামুনি কপিল সাক্ষাৎ হরির স্বরূপ এবং সিদ্ধগণের মধ্যে প্রধান। ৩
ভগবান, জগতে এক সিদ্ধ পুত্রের উৎপত্তি ইচ্ছা করিলে তাহার দেহ হইতে সিদ্ধ কপিল উৎপন্ন হন। ৪
মহামুনি কপিল একদিন স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে ব্রহ্মার পুত্র স্বায়ম্ভুব মনুকে বলিয়াছিলেন। ৫
কপিল বলিলেন,–হে ব্ৰহ্মপুত্র মহামতে মনুশ্রেষ্ঠ স্বায়ম্ভুব! তোমার নিকট আমি একটি বিষয়ের প্রার্থনা করিতেছি, আমার প্রার্থিত বিষয় সম্প্রদান কর। ৬
তুমি এই সকল জগৎ সৃষ্টি করত পরিপালন করিতেছ, অতএব তুমি জগতের পতি। ৭
স্বর্গ-মর্ত্য এবং পাতলবাসী দেব, মনুষ্য প্রভৃতি সকল জন্তুর তুমিই প্রভু, বর-দাতা এবং সৰ্বকালীন রক্ষক। ৮
তুমি ধাতা বিধাতা এবং সৰ্বেশ্বরেশ্বর; তোমাতেই নিরন্তর সকল ত্রিভুবন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ৯
যেস্থানে তপস্যা করিলে কাৰ্য্য এবং কারণের সহিত ত্রিজগৎপ্রপঞ্চ আমার নিকট স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইবে। ১০
নির্জন ত্রিভুবনেও দুর্লভ পাপনাশক পবিত্র, এবং শুদ্ধজ্ঞানের স্ফুর্তিকারক এতাদৃশ কোন স্থান আমাকে নির্দেশ করিয়া দাও। ১১
আমি সৰ্ব্বভূতের প্রত্যক্ষদ্রষ্টা হইয়া জ্ঞানরূপ দীপালোকে জগজ্জনকে উদ্ধার করিব। ১২
অজ্ঞানরূপ জলনিধিতে নিমগ্ন ত্রিভুবনবাসি-জনগণকে জ্ঞানরূপ প্লব আশ্রয় করাইয়া উদ্ধার করিব। ১৩।
হে জগদীশ্বর। তুমি আমাদের নাথ পূজ্য এবং পালক, অতএব এই বিষয় উপপাদনের যুক্তি বল। ১৪
স্বায়ম্ভুব মনু এই প্রকার মহাত্মা কপিলের বাক্য শ্রবণ করত নিম্নতাত্মা ব্রতাবলম্বী কপিলকে এই বাক্য বলিলেন। ১৫
মনু বলিলেন,–যদ্যপি তুমি জ্ঞানদীপ নির্মাণ করত জগতের হিতকামনায় তপস্যা করিতে ইচ্ছা করিয়াছ, তাহা হইলে স্থানের কি প্রয়োজন? ১৬
হে দ্বিজ! পূর্বে ব্রহ্মা অত্যাশ্চর্য্য তপস্যা করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি আমার নিকট বা অন্য কাহারও নিকট স্থানের নিমিত্ত প্রার্থনা করেন নাই। ১৭
মহাদেব বিষয়াভিলাষ পরিত্যাগপূর্বক দৈবপরিমাণে দশ সহস্র বৎসরকাল পৰ্যন্ত তপস্যা করিয়াছিলেন কিন্তু তিনি স্থান অভিলাষ করেন নাই। ১৮
হে মহামুনে। দেবেন্দ্র, অগ্নি, শমন, নৈর্ঋত, বরুণ, বায়ু, কুবের ইহারা দিক্পাল হইবার নিমিত্ত কঠোর তপস্যা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহারাও স্থানার্থে কাহারও নিকট প্রার্থনা করেন নাই। ১৯-২০
হে কপিল! এই বিস্তৃত ধরামণ্ডলে দেবগৃহ, তীর্থক্ষেত্র, নদী এবং অনেক অনেক মাহাত্ম্যান্বিত স্থান আছে। ২১
তাহার মধ্যে মনোমত কোন স্থানকে আশ্রয় করিয়া তপস্যা করিলে তপস্যা কি সিদ্ধ হইবে না? ২২
আমার নিকট স্থান প্রার্থনা করা কেবল তোমার আত্মশ্লাঘা সূচনা করা মাত্র; তপস্বিগণের আত্মশ্লাঘা করা একান্ত অনুচিত। ২৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;- সিদ্ধপ্রধান কপিল স্বায়ম্ভুব মনুর এই বাক্য শ্রবণ করত ক্রোধপূর্বক বলিলেন,–তোমার জগতে আধিপত্য দেখিয়া তপস্যার নিমিত্ত মনোমত স্থান প্রার্থনা করায় তুমি আমার অবমাননা করিলে এই নিষ্ঠুর বাক্যে বোধ হইতেছে, তুমি ত্রিভুবনের আধিপত্য লাভ করিয়া গর্বিত হইয়াছ। ২৪-২৬
তোমার নিকট স্থান প্রার্থনা করিয়া আমি আত্মশ্লাঘী হইয়াছি, অদ্য এই প্রকার অসহ্য বাক্য শ্রবণ করিয়া ক্ষান্ত হইতেছি না, শীঘ্রই নিজ দুষ্কর্মের ফল অনুভব করিবে। ২৭
দেব, দানব এবং মানব প্রভৃতির সহিত এই ত্রিভুবন শীঘ্রই নষ্ট, বিনষ্ট এবং বিধ্বস্ত হইবে। ২৮
যিনি এই পৃথিবী উদ্ধার করিয়াছেন, যিনি পৃথিবী স্থাপন করিয়াছেন, যিনি এই পৃথিবী নাশ করিবেন এবং যিনি পালন করিতেছেন, তাঁহারা সকলেই স্থাবর-জঙ্গমের সহিত এই জগৎ নাশ করুন। ২৯
হে স্বায়ম্ভুব। শীঘ্রই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালত্মক হতহত বিধ্বস্ত দেব গন্ধৰ্ব্ব এবং মনুষ্যপূর্ণ ত্ৰিজগৎকে জলময় দর্শন করিবে। ৩০
মুনিশ্রেষ্ঠ তপোনিধি কপিল, এই বাক্য বলিয়া সেই স্থান হইতে পিতামহ ব্ৰহ্মার সমীপে গমন করিলেন। ৩১
মনু, কপিল মুনির কঠোর বাক্য শ্রবণ করিয়া বিষণ্নবদনে ভবিতব্যতার বলবত্তা বিবেচনায় মহর্ষি কপিলকে আর কিছু বলিলেন না। ৩২
তদনন্তর বুদ্ধিমান স্বায়ম্ভুব মনু, জগৎহিতের নিমিত্ত গরুড়ধ্বজ গোবিন্দের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় তপস্যা করিতে কৃতনিশ্চয় হইলেন। ৩৩
যে স্থান হইতে পতিতপাবনী গঙ্গা বহির্গত হইয়াছেন, জগৎকর্তা স্বায়ম্ভুব মনু, বদরিকাশ্রমে গমন করিলেন। মনু সেই স্থানে গমন করত পুণ্যা পাপনাশিনী সৰ্বকালীন-ফল-শালিনী কোমল এবং সরস-মঞ্জরী-সমন্বিতা শীতলচ্ছায়া দ্বারা সন্তাপ-নিবারিণী শুষ্কপত্র-রহিতা বদরিকা দর্শন করিলেন। ৩৪-৩৬
বদরিকার শাখাগ্র এবং মূল প্রভৃতি অবয়ব গঙ্গার প্রবাহে সিক্ত হইতেছে। নানাপ্রকারে মুনি-ঋষিগণ আগমন করত তথায় তাঁহার তপস্যা করিতেছেন। ৩৭
সেই স্থান সকল প্রকারে মঙ্গলজনক, নানাপ্রকার মৃগগণ ইচ্ছামত সুখে ক্রীড়া করিতেছে। সরোবর সকল, প্রফুল্ল-কমল-সমূহের শোভায় উপশোভিত হইয়াছে, রমণীয় সেই সরোবর দীপ্তিপরিপূর্ণ হইয়াছিল। ৩৮
লোকভাবন মনু, পরম সমাধি অবলম্বন করিয়া নিয়তাহারে সেই স্থানে তপস্যা করিতে যত্ন করিলেন। ৩৯
মনু জগতের কারণ সকলের কল্যাণস্বরূপ জগৎসমূহের নাথ, নবীন মেঘ এবং কজ্জলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী, কমলনয়ন, পীতাম্বর শোভিত গরুড়ারূঢ়, জগন্ময়, লোকনাথ, ব্যক্ত এবং অব্যক্ত-স্বরূপী জগৎকারণ, সহস্রাক্ষ, সহস্ৰশীর্ষ, সৰ্বব্যাপী, আধার, অজ এবং বিভুস্বরূপ পরমপুরুষ নানায়ণকে “শুদ্ধ জ্ঞানস্বভাব হিরণ্যগর্ভ অব্যক্তরূপী প্রধান-পুরুষ বাসুদেবকে প্রণবোচ্চারণপূর্বক নমস্কার করি”–সৰ্ব্বদেবময় এই পরম মন্ত্র জপ করত আরাধনা করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর জগন্নাথ কেশব স্বায়ম্ভুব মনুর উক্ত মন্ত্র জপপূর্বক আরাধনায় শীঘ্রই প্রসন্ন হইলেন। ৪০-৪৫
তদনন্তর, জনার্দন, দুৰ্ব্বাদলের ন্যায় শ্যামবর্ণ কর্পূরকণা-সদৃশ, উজ্জ্বল-নেত্ৰদ্বয়-শোভিত ক্ষুদ্র মৎস্যরূপ ধারণ করত তপস্যাপর স্বায়ম্ভুব মনুর সমীপে উপনীত হইলেন এবং ভয়ে রুদ্ধকণ্ঠ হইয়া, কারুণ্য-যুক্ত মহাত্মা সায়ম্ভুব মনুকে বলিলেন,–মহাত্মা তপোনিধে! বৃহৎ বৃহৎ মৎস্যগণ আমার সহিত প্রতিদিন যুদ্ধ করিয়া আমাকে ভোজনের উপক্রম করে; অতএব ভয়ান্বিত-আমাকে রক্ষা কর। ৪৬-৪৮
হে মহাভাগ! প্রতিদিন মৎস্যগণ আমাকে ভোজন করিবার নিমিত্ত ধাবমান হয়; আমি ভীত হইয়া আত্মরক্ষা করিতে পারি না। অদ্য পুনর্বার সেই বৃহৎ মৎস্যগণ আমার পশ্চাৎ ধাবমান হইয়াছে। আমিও পলায়ন করিতে অসমর্থ হইয়া জীবনরক্ষা অভিলাষে-হে মহাত্মন! আপনার শরণ লইলাম, আপনার যদ্যপি আমার প্রতি দয়া হয়, তাহা হইলে এই এই শঙ্কট হইতে আমাকে রক্ষা করুন। আমি ভয়-চকিত-চিত্ত; এখন আমি চঞ্চল বৃক্ষচ্ছায়া এবং তরঙ্গসকল দর্শন করিয়া মৎস্যদের ভয় আশঙ্কা করিতেছি। ৪৯-৫৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–তদনন্তর স্বায়ম্ভুব মনু ক্ষুদ্র মৎস্যের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করত অনুকম্পাপুরঃসর বলিলেন;–আমি তোমাকে রক্ষা করিব। ৫৪।
তদনন্তর স্বায়ম্ভুব মনু হস্তমধ্যে জলগ্রহণ করত সেই জলে ক্ষুদ্র মৎস্যটিকে স্থাপন করিয়া তাহার স্বচ্ছন্দক্রীড়া দর্শন করিতে লাগিলেন। ৫৫
তদনন্তর মনু এইরূপে কিছুকাল তাহার বিস্তৃত ক্রীড়া দর্শন করত দয়াবান্ হইয়া জলপূর্ণ অলিঞ্জরে (জ্বালায়) মনোহর সেই মৎস্যকে স্থাপন করিলেন। ৫৬
অনন্তর সেই মৎস্য সেই অলিঞ্জরে অবস্থান করত প্রতিদিন বৃদ্ধি পাইয়া অল্পকালের মধ্যে সামান্য রোহিত মৎস্যস্বরূপ হইল। ৫৭
মহাত্মা স্বায়ম্ভুব মনু প্রতিদিন দশঘট করিয়া জল সেই অলিঞ্জরে নিক্ষেপ করিয়া তাহাকে পরিপালন করিতে লাগিলেন এবং সেই মৎস্যও মনুর আশ্রমে অলির মধ্যে মনুদত্ত জলাদি দ্বারা লোমশ বৃহৎ মৎস্য হইল। ৫৮
দ্বাত্রিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৩২