বিছানায় শুয়েও মশায় জেগেই ছিলেন। ঘুম আসে নি। তার মনটাও উদাসীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘুম আসছে না। বিপিনের মৃত্যু এবং নিশির ভাইঝির মৃত্যু তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দতুর কথা, ওই লোকটার উপর তিক্ততা, মনের কোণে কোণে ঢাকা পড়ে গেছে। পাশের বিছানায় আতর-বউ ঘুমুচ্ছে। পাশের খোলা জানালাটা দিয়ে খানিকটা রাত্রির আকাশ দেখা যাচ্ছে। শরতের গাঢ় নীল নক্ষত্রখচিত আকাশের খানিকটা অংশ। কানে আসছে ঝিল্লির অবিরাম একটানা ডাকের শব্দ। তিনিও ভাবছিলেন—মৃত্যু কী? অনিবার্য পরিণতি, দুৰ্জ্জেয় রহস্য—এসবে মন ভরে না। পুরাণের সেই পিঙ্গলকেশিনীর কাহিনীতেও মনের তৃপ্তি হয় না। অজ্ঞান মুমূর্ষ রোগী বিচিত্রভাবে বেঁচে উঠেছে, তাদের দু-একজন বিচিত্ৰ কাহিনী বলে। কেউ বলে সে যেন শূন্যলোকের মধ্য দিয়ে ভেসে যেতে যেতে ফিরে এসেছে; সে শূন্যলোক বিচিত্র। কেউ বলে—সে যেন সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। দুজনের অভিজ্ঞতা একরকম নয়। এতেও নানা প্রশ্ন জাগে মনে। মন ভরে না। একটি কিশোর ছেলের কথা মনে পড়ছে। সে যা বলে গেছে তা অদ্ভুতভাবে মনে গেঁথে রয়েছে তাঁর। অনেকদিন আগের কথা। নবগ্রামের গোবিন্দ পাঠকের ছেলে নসীরাম। মৃত্যুশয্যায় মৃত্যুর বোধ করি মিনিট পনের আগে বলেছিল। সে কী ঘাম! এমন ঘাম তিনি তার সুদীর্ঘ চিকিৎসক-জীবনে কম দেখেছেন। আবীর, ঊটড়ো মাখিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল শুশ্ৰুষাকারীরা, ফুরিয়ে গেল আবীর, শুটগুড়ো—যা আনা হয়েছিল। রোমকূপের মুখগুলি থেকে অনর্গল ঘাম বের হচ্ছিল জলাজমি থেকে জল ওঠার মত। স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু জ্ঞান ছিল ছেলেটির। তিনি দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলেন। নাড়ি তার আগে থেকেই নেই। কে তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিল—নসু, নসু, নসু–! অ নসু!
ধীরে ধীরে ক্লান্ত চোখের পাতা দুটি খানিকটা খুলে গিয়েছিল, চোখের দৃষ্টিতে সাড়া দেওয়ার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিল—অ্যাঁ?
কী কষ্ট হচ্ছে তোমার? খুব কষ্ট?
ক্লান্তির সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলেছিল–না।
—তবে?
একটু চুপ করে থেকে চোখ বুজতে বুজতে বলেছিল—মনে হচ্ছে—আমি—
–কী?
–আমি যেন অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমাদের কথা ভাল শুনতে পাচ্ছি না। তোমাদের ভাল দেখতে–
ঘাড় নেড়ে জানাতে চেষ্টা করেছিল—পাচ্ছে না দেখতে। যেন আবরণ পড়েছে এবং সে আবরণ ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে।
এর চেয়ে ভাল বিবরণ তিনি আর শোনেন নাই।
ঠিক এই সময়টিতেই কে ডাকল—মশায়!
—কে? কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের পথের দিকে তাকালেন মশায়। আলো হাতে দুজন লোক। কারা? কার কী হল?
–কে?
–আজ্ঞা আমরা পরান খাঁ সাহেবের বাড়ি থেকে আসছি।
–কী হল? বিবি তো ভাল আছে।
–আজ্ঞা না। বড় বিপদ! বিবি বিষ খেয়েছে মালুম হচ্ছে।
–বিষ খেয়েছে? কী বিপদ? ধড়মড় করে উঠলেন মশায়। আশ্চর্য! মানুষ আবার বিষও খায়, গলায় দড়িও দেয়, কাপড়ে আগুন লাগিয়ে পুড়েও মরে, জলে ঝাঁপ দেয়।
পরান খাঁ দু হাতে মাথা ধরে চুপ করে বসে ছিল। মুখখানা তার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বিবি কল্কেফুলের বীজ বেটে খেয়েছে। পরান তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, পরানেরও চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। বললে–সরকারি ডাক্তার ঠিক বলেছিল মশায়। রোগটোগ উয়ার। সব মিছা কথা; মেয়েটা নষ্ট মেয়ে। আমার মত বুড়ো ওকে ছোঁয় তাই রোগের ছলা করে পড়ে থাকত। বিষ খেয়ে গলগল করে বুলছে সব।
বাঁধা বন্য মহিষের মত গর্জে মাথা নেড়ে পরান বললে—ওই হারামি গোলাম ছামুতে পেলে বেটার গলার নলিটা আমি ছিঁড়ে নিতাম। ওই হারামির হারামি–রব্বানি। আর উয়ার মা। হারামজাদী বাঁদী। এককালে হারামজাদী আমার–
অশ্লীল কথা উচ্চারণ করলে পরান।
মশায় বললেন–এখন ওসব কথা থাক পরান। এখন ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে।
—মরে যাক, মরে যাক। কসবী শয়তানী জাহান্নামে যাক মাশয়, আপুনি শুধু শুনে যান উয়ার নিজের মুখে যে শয়তানী বিষ খেয়েছে। ওই নফর ওই হারামি রব্বানির লেগে খেয়েছে। নইলে আমাকে ফাসাবে ওই শয়তানেরা!
পরান দু হাতের মুঠোয় নিজের বাবরি চুল ছিঁড়ে দন্তহীন মুখের মাড়িতে মাড়িতে টিপে বললে—আঃ, নিজের ঘরে আমি নিজে শয়তান ঢুকায়েছি! আঃ!-সরকারি ডাক্তার ঠিক বুলেছিল।
পরানের বিবি নিজে-মুখেই সব বলছে। গোঙাচ্ছে, মধ্যে মধ্যে কথা বলছে। গোঙাতে গোঙাতেই বলছে।—পোড়া নসিব! পোড়া নসিবের সবই তো মানায়ে নিয়েছিলাম কোনো রকমে। খাঁ, রব্বানিকে তুমি ঘরে ঢুকালেই বা ক্যানে; উয়ার মাকেই বা রাখলা ক্যানে? রেখে, যা হবার হয়ে যখন গেল, তখুন তারে দূর করেই বা দিলা ক্যানে?
ঘটনাটা ঘটেছে এই :
কাল বিকেলবেলা থেকে পরানের বিবি বমি করতে আরম্ভ করেছিল। প্রথমটা ওটাকে অন্যতম গৰ্ভলক্ষণ বলেই মনে হয়েছিল সকলের। কিন্তু বার বার বমি এবং সেই বমির সঙ্গে কয়েতবেল, বনফুল, লঙ্কার খোসা ইত্যাদি উঠতে দেখে প্রশ্ন ওঠে–এসব বিবি পেলে কোথায়?
কে এনে দিলে?
বিবির তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। পরানের বিবির খাস-ঝি রব্বানির মা অত্যন্ত সমাদর এবং অনেক তরিবত করে কয়েতবেল গুড় লঙ্কা নুন মিশিয়ে চাটনি করে এনে খাইয়েছে। তার সঙ্গে কাঁচা বনকুল। এ আজ নূতন এবং একদিন নয়, এ চলছে কয়েক দিন ধরেই। কোনোদিন বাজারের মিষ্টি, কোনোদিন তেলেভাজা, কোনোদিন অন্য কিছু আসছেই। নিজের হাতে মুখে তুলে দিয়ে সাকিনা বেওয়া বিবিকে খাইয়েছে। এনে যুগিয়েছে রব্বানি। নতুন নক্সাপেড়ে শাড়িও নাকি দিয়েছে বুড়ি পরানের বিবিকে। পরানের বড় বিবি কথাটা বলেছে। সে নিজের চোখে দেখেছে রানিকে কাপড় হাতে বাড়ি ঢুকতে, নিজের মায়ের হাতে দিতে; এবং সেই কাপড় নতুন বিবির পরনেও সে দেখেছে।
পরানের বুকের মধ্যে লোহার ডাঙশ পড়েছিল। রাগের মাথায় সে প্রথমেই বড় বিবির চুলের মুঠো ধরে টেনে বলেছিল—ঝুটা বাত!
বড় বিবি আল্লার নামে কসম খেয়েছিল। বড় বিবিকে ছেড়ে দিয়ে পরান খুঁজেছিল সাকিনা। বেওয়া আর বাদীর বাচ্চা রব্বানিকে। কিন্তু তারা দুজন তখন ফেরার। খুব হইচই করতে পরান পারে নি। আশপাশ গ্রামে হিন্দু মুসলমান দুই জাতের মধ্যেই তার দুশমন আছে। আজ চারপাঁচ বছর ধরে নতুন-কেনা জমি নিয়ে তাদের সঙ্গে পাঁচ-সাতটা মামলা চল ছ। রব্বানি মাকে। নিয়ে তাদেরই কারুর বাড়িতে যে আশ্রয় নিয়েছে এতে সন্দেহ নাই। পরান বিষদাঁতভাঙা সাপের মত নিষ্ঠুর আক্ৰোশে ঘুরে আক্রমণ করেছিল নতুন বিবিকে। প্রায়-অচেতন অবস্থার মধ্যেই তার চুলের মুঠো ধরে বার বার টেনে তাকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছিল। হয়ত মেরেই ফেলত। কিন্তু নিবারণ করেছিল বড় বিবি!—করছ কী সাহেব, শ্যাষে?ে মরে যাবে। মরে গেলে যে ফাঁসিকাঠে বেঁধে টান দিবে গো! খেদায়ে দাও ওরে।
তাও পরান পারে নাই। তাকে তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেবে, হারামজাদী হাসিমুখে মাঠ পার হয়ে রব্বানির হাত ধরে তার আশ্রয়ে গিয়ে উঠবে তা হবে না। ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল। আজ সন্ধেবেলা ঘাটে যাবার জন্য মিনতি জানিয়েছিল নতুন বিবি। খুলে দিয়েছিল বড় বিবি। ঘাটে অবশ্য পাহারা ছিল। ঘাটের পাশে ছিল কলকে ফুলের গাছ। পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে কয়েকটা ফল পেড়ে অ্যাঁচলে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর কখন খেয়েছে। এখন অর্ধ-চেতন অবস্থা। মরে গেলে ক্ষতি নাই। জাহান্নামে যাক নষ্টদুষ্ট আওরত, কসবী খানকী হারামজাদী। মশায় শুধু নিজের কানে শুনে রাখুন-হারামজাদী নিজে বিষ খেয়েছে। পরানের এতে কোনো দায় নাই। সে নির্দোষ।
***
সুন্দরী তরুণী মেয়ে। বিষের ঘোরে অর্ধ-অচেতন। বিষের যন্ত্রণায় ভেতরটায় মোচড় দিচ্ছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মুখ নাক দিয়ে পেঁজলা বেরিয়ে আসছে, বুকে চাড়া দিয়ে উঠছে, যেন বুকটা শতধা বিদীর্ণ হয়ে যেতে চাইছে। চোখ দুটি অর্ধনিমীলিত, লাল, সর্বনাশের ঘোর লেগেছে। বিস্ত বেশবাস, মাথার একরাশ চুল খুলে এলিয়ে ধুলায় ধূসর হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। চারিপাশে। লোকেদের টানাটানিতে চিমটিতে মধ্যে মধ্যে জ্ঞান আসছে, তখন মুখর হয়ে উঠছে সে।
—আঃ! মরতেও আমারে দিবা না? মরণেও আমার একতিয়ার নাই? হারে নসিব! হারে নসিব!
হেসে আবার বলেপারব না মিয়া, পারব না। রব্বানি শ্যাকরা কাছে যাতি দিতে আমারে না পার, কিন্তু ইবার যে বঁধুর সাথে আসনাই করে তার হাত ধরেছি—তার হাত ছাড়াইতে তুমি। পারব নাপারবা না-পারব না। আঃ, আমারে একবার ছেড়ে দাও, খানিক ঘুমায়ে লই।
—অঃ–। আঃ–।
বলতে বলতে আবার বিষের ঘোরের একটা ঝলক ছড়িয়ে পড়ে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন। করে দেয়; ঢলে পড়ে মেয়েটি, মাথাটা হেলে পড়তে চায়।
মশায় বললেন–পরান, তুমি হাসপাতালে নিয়ে যাও বিবিকে।
–হাসপাতালে? না। আমি তো বুলেছি মশায়
–মাথা খারাপ কোরো না পরান। তোমার ভালর জন্যেই বলছি। আমি আর সে মশাই নই। পরান। যখন প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত ছিলাম তখন এরকম অনেক কেসের হাঙ্গামা আমার হুকুমে মিটে গিয়েছে। আজ সেদিন নাই। আজ আমাকে যখন ডেকেছ, আমি যখন এসেছি, দেখেছি, তখন আমাকেই খবর দিতে হবে থানায়। তা ছাড়া আমি চিকিৎসক। আমি রোগীকে বাঁচাতে আসি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরণ দেখতে আসি না।
পরান গুম হয়ে বসে রইল কয়েক মিনিট। তারপর বললে, গাড়ি জুড়ে নিয়ে আয় রে হানিফ। জলদি! আপুনি তা হলে সঙ্গে চলেন মশায়!
রাত্রি তখন দুটো। মশায় ডাকলেন ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!
প্রদ্যোত উঠে এল—কে?
–আমি জীবন দত্ত।
–আপনি এত রাত্রে?
–বিষ খেয়েছে একটি মেয়ে! কল্কেফুলের বীজ। তাকে নিয়ে এসেছি। পরান খয়ের স্ত্রী।
–আমি আসছি এক্ষুনি। ওদিকে কম্পাউন্ডার নার্সরা উঠেছে? তাদের ডেকেছেন?
–ডেকেছি।
–এক মিনিট। আসছি আমি।
ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা হাফশার্ট গায়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এল। কোনো প্রশ্ন করলে না, কোনো মন্তব্য করলে না। হাসপাতালে এসে সামনেই কম্পাউন্ডার হরিহরকে দেখে প্রশ্ন করলে, সব তৈরি করতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
হরিহর বললে, মিনিট পনের লাগবে বৈকি? পটাশ পারম্যাঙ্গানেট লোশন আমি খাইয়ে। দিয়েছি খানিকটা।
ডাক্তার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, পরান বললে–আমি চললাম ডাক্তারবাবু, মেয়েটা বাঁচলে পর পুলিশে দিবেন, না বাঁচে লাশ সদরে চালান দিবেন; সেখানে ফেড়েছুঁড়ে দেখে যা করবার করবে। সালাম!
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার বললে–আঃ, তখুনি যদি আপনার কথায় গোসা না করতাম! আপনাকেই যদি দেখাইতাম! মশায় বুড়ো লোক, সিকালের লোক, নাড়ি দেখে মরণ ডাকতে পারে। ই ধরতে পারে না। চলে গেল পরান।
প্রদ্যোত ঘরে ঢুকে গেল। মশায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই হতভাগিনী মেয়েটাকে ফেলে যেতে তার পা উঠছে না। হতভাগিনীর এতখানি ছলনা তিনি বুঝতে পারেন নি। মুক্তকণ্ঠে। স্বীকার করবেন, তা তিনি পারেন নি। তবে এটা তিনি জানতেন; বৃদ্ধ স্বামীর প্রতি তরুণীর বিরূপ মনোভাবও তাঁর অজানা নয়; কিন্তু তার এমন বিচিত্র প্রকাশের স্বরূপটি তিনি অনুমান করতে পারেন নি। পরানের অতিরিক্ত সমাদর ও পত্নীপ্রীতিকেই এর কারণ বলে ধরেছিলেন। এবং আদরিণী ভাগ্যবতী মেয়ের দুলালীপনাকে পিতা যেমন স্নেহের চক্ষে দেখেন সেই চক্ষেই দেখেছেন। তিনি ভাবছিলেন সন্তান হলেই সেই সন্তানের স্নেহে তার জীবনের অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে যাবে। তার সন্তানধারণশক্তিকেই তিনি সবলতর করবার চেষ্টা করে এসেছেন। সে চেষ্টা তার ফলবতীও হয়েছে। কিন্তু সে যে যৌবনপ্রভাবাচ্ছন্ন মনের বিচিত্র তৃষ্ণার তাড়নায় এই কুটিল পথে ফলবতী হতে পারে সে তিনি ভাবেন নি। প্রদ্যোত ডাক্তার বোধ করি ভেবেছিল। মশায় একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার প্রতি শত মমতায় যেন তিনি জড়িয়ে গেছেন। মেয়েটি কতবার তার দিকে সজল চোখে চেয়ে বলেছে, বুঝতে পারি না মশায়-বাবা! মনে হয় হেথায় অসুখ, হেথায়, হেথায়, হেথায়। সখানে গো বাবা, কুনখানে লয়। কী অসুখ তাও ঠিক ধরতে নারি। কনকনানি, বেথা, যেন বল নাই, সাড় নাই। আবার সময়ে সময়ে ছুঁলে পরেতেই যেন চিড়িক মেরে ওঠে। বলতে বলতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ত। কতদিন প্রশ্ন করেছে—মশায়-বাবা আমি বাঁচব তো?
চোখে দেখেছেন, সে কী ভয়!
সেই মেয়ে আজ বিষ খেয়েছে। মুখর হয়ে উঠেছে। বলেছে—পারবা না মিয়া, পারব না। যে বঁধুর হাত ধরেছি সে বঁধুর হাত থেকে কেড়ে নিতে পারব না।
হরিহর বেরিয়ে এল, বলল—আপনি কি বসবেন মশায়?
–হ্যাঁ বসব হরিহর। পরান তো চলে গেল। আমি পারছি না। হতভাগিনীর শেষটা না দেখে যেতে পারছি না।
দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল প্রদ্যোত ডাক্তার। কম্পাউন্ডিং রুমে গিয়ে একটা কী নিয়ে এল। হরিহর বললে—উনি থাকবেন স্যার।
—থাকবেন? বেশ তো। তা একা বাইরে বসে থাকবেন? আসুন না, ভিতরে।
মশায় হেসে বললেন–আমি বাইরেই থাকি। বেশ থাকব।
শেষ রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বসে রইলেন। আকাশে নক্ষত্রদের স্থান পরিবর্তন ঘটছে। কালপুরুষ অনেকটা সরেছে। বৃশ্চিকের বকা লেজের ডগায় ওই দেখা যাচ্ছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল পাক খাচ্ছে। ওই বশিষ্ঠের নিচে অরুন্ধতী। অরুন্ধতী যে দেখতে পায়, সামনে অন্তত আরও ছ মাস পরমায়ু নাকি নিশ্চিত। আরও দু মাস তিনি তা হলে নিশ্চয় বাঁচবেন। সে অবশ্য তিনি নাড়ি দেখেও বলতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হল—যদি তিনি বিষ খান এই মেয়েটার মত, তা হলেও কি বাঁচবেন? নাড়ি দেখে সে কথা তো বলা যায় না। অরুন্ধতী দেখে কি তা বলা যায়? অবশ্য বিষ তিনি খাবেন না, কখনই খাবেন না। অধিকাংশ লোকই খায় না। মর্মান্তিক শোকে ক্ষোভে ব্যর্থতাতেও খায় না। মরণকে মানুষের বড় ভয়। মদ খেয়ে মরে, ব্যভিচার করে। মরে, অনাচার করে মরে। বনবিহারীর মত, ওই নিশির ভাইঝির মত। বিপিনের নাম তিনি এদের সঙ্গে করবেন না। কিন্তু এরাও বিষ খেয়ে মরতে পারে না। সে এক আলাদা জাত আছে। এই মেয়েটার জাত। মেয়েদের মধ্যেই এ জাত বেশি।
নারায়ণ! নারায়ণ! গোবিন্দ হে!
হঠাৎ গভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলেন মশায়। গোবিন্দ রক্ষা করেছেন, ভূপীকে না পেলে সে এমনিভাবে বিষ খেতে পারত। হা পারত। সে এই জাতের মেয়ে ছিল।
চঞ্চল হয়ে মশায় বারান্দা থেকে নিচে নেমে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালেন। পরমানন্দ মাধব!
হাসপাতালের লম্বা ঘরটার মধ্যে থেকে মৃদু আলোর আভাস বেরিয়ে আসছে। রোগীরা ঘুমুচ্ছে। তার মধ্যে কেউ কেউ অসুখে এ-পাশ ও-পাশ করছে। আশপাশে কোয়ার্টারগুলি নিস্তব্ধ। অন্ধকারের মধ্যে ঘন কালো ছবির মত দেখাচ্ছে। পরিত্যক্ত কবরস্থানটার মাঝখানে বটগাছটার পত্রপল্লবের মধ্যে বাতাসের বেগে সস শব্দ উঠছে একটানা। হঠাৎ পায়ের তলায় পট করে একটা শব্দ উঠল; এঃ, একটা ব্যাঙ!
–কে? একটি সাদা-কাপড়পরা মূর্তি হাসপাতালের বারান্দার উপর। নারীমূর্তি একটি। মশায় জিজ্ঞাসা করলেন—কে?
মৃদুস্বরে উত্তর এল-আমি একজন নার্স। আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে? বসুন।
—নাঃ, বেশ আছি। কেমন আছে মেয়েটি?
–ভাল না।
–নারায়ণ হে! গভীর স্বরে আবার ডাকলেন মশায়। নার্সটি চলে গেল ঘরের মধ্যে।
ব্যাঙটা তার পায়ের চাপে ফেটে পিষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিচিত্র। তিনিই হলেন এই মুহূর্তে মৃত্যুর দূত। কোথায় নেই মৃত্যুঃ কিসে নেই মৃত্যু?
—মশায়!
–কে? হরিহর?
–হ্যাঁ।
–কী হল?
–আর কী? শেষ হয়ে গেল। হল না কিছু।
প্রদ্যোত ডাক্তার বেরিয়ে এল। বললে–পারলাম না কিছু করতে। দেখবেন নাকি?
–নাঃ। আমি যাই তা হলে।
–আচ্ছা! প্রদ্যোত যেন হঠাৎ প্রশ্ন করলে আপনি ওদের বাড়িতে গিয়ে তো মেয়েটিকে দেখেছিলেন। তখন কি নাড়ি দেখে জানতে পেরেছিলেন, বাঁচবে না?
—ওর হাত আমি দেখি নি ডাক্তারবাবু।
–দেখেন নি?
–না। আমি আপনার এখানেই আনবার ব্যবস্থা করেছিলাম। আপনি দেখবেন, চিকিৎসা করবেন, আধুনিক চিকিৎসা আপনাদের। আমি নাড়ি দেখি নি।