1 of 2

৩২. বিক্রমোর্বশী নাটকের দারুণ সাফল্যের পর

বিক্রমোর্বশী নাটকের দারুণ সাফল্যের পর নবীনকুমার কিন্তু বর্ধিত উৎসাহে আরও একের পর এক নাট্য-অভিনয়ে উদ্যমী হলো না। নাটকের দিক থেকে তার মনই চলে গেল। বরং। দেশের আরও অনেক গণ্যমান্য ধনীরা নাটক নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছেন, সুতরাং সে আর সেই দলে মিশতে চায় না। তার মন নতুনতর কোনো বিষয় খুঁজতে লাগলো।

ছাপাখানা থেকে বিক্রমোর্বশী বই হয়ে এলো, নবীনকুমার এখন গ্ৰন্থকার। বইখানি উৎসর্গ করা হলো বর্ধমানের রাজা মহাতাপচাঁদকে। প্রথম দিন টাট্‌কা নতুন গন্ধমাখা বইটা হাতে নিয়ে সে এক অনাস্বাদিতপূর্ব রোমাঞ্চ বোধ করলো। বড় বিস্ময়ও লাগলো তার। এই পুস্তকটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না, সে আপনি খেয়ালে একদিন নদীবক্ষে বজরা ভ্রমণের সময় লেখনী হাতে নিয়েছিল বলেই এই পুস্তকটির জন্ম হলো। এখন এই গ্ৰন্থ চিরস্থায়ী হবে, অজানা-অচেনা মানুষেরা তার রচনা পাঠ করবে, কেউ বাহবা দেবে, কেউ করবে নাসিকা কুঞ্চন, সে এসব কিছুই দেখতে বা জানতে পারবে না। ভারি আশ্চর্য না?

নবীনকুমার ঠিক করলো, সে গ্রন্থকারই হবে, সে রচনা করে যাবে একটির পর একটি বই, দেশ-দেশান্তরে প্রসারিত হবে তার খ্যাতি। তবে আর অনুবাদ নয়, এবার সে স্বকপোলকল্পিত কাহিনী রচনা করবে। বিক্রমোর্বশী নাটক গ্রন্থটি সে বিভিন্ন খ্যাতিমান ধীমান ব্যক্তিদের কাছে প্রেরণ করলো, একটি কপি সে একদিন স্বহস্তে গিয়ে দিয়ে এলো ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর বেশ আগ্ৰহ ভরে বইটি নেড়েচেড়ে দেখলেন এবং তাকে অনেক স্নেহসূচক কথা বললেন। তার ফলে নবীনকুমারের আরও গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা বলবতী হলো। অবিলম্বেই সে শুরু করে দিল পরবতী গ্ৰন্থ রচনা।

অপরাপর লেখকদের মতন বহু চিন্তা সহকারে এবং বারবার পরিমার্জনা করে সাহিত্য নির্মাণ তার ধাতুতে নেই। সে যখন লিখতে শুরু করে তখন ঝড়ের মতন লিখে যায়, সাত আটদিনে একটি গ্রন্থ সমাপ্ত করে। এমনভাবে রচিত হলো তিন চারখানি গ্ৰন্থ। সেগুলি প্ৰকাশ করার জন্য সে নিজেই ক্ৰয় করে ফেললো একটি ছাপাখানা। অপরের ছাপাখানায় গিয়ে প্রত্যাশী হয়ে বসে থাকার ধৈর্য তার নেই। নতুন বিলাতী যন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত সেই ছাপাখানায় মুদ্রিত হবে শুধু তার নিজের রচিত গ্ৰন্থ।

কিন্তু গ্ৰন্থকার হবার গৌরবেচ্ছা তাকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারলো না। হঠাৎ এক সময় তার মনে হলো, এও যেন খুব সাধারণ পাঁচপেঁচি ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া। নবীনকুমারের শৈশবে বাংলা বই ছিল অতি দুর্লভ বস্তু, কিন্তু ইদানীং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সার্থকতা দর্শনে রাতারাতি যেন ংখ্য গ্ৰন্থকার গজিয়ে উঠেছে শিলিন্ধের মতন। কার উদরে কী ছটাক বিদ্যে আছে তার ঠিক নেই, কিন্তু অক্ষরজ্ঞান থাকলেই যে-কেউই যেন লেখক হয়ে যেতে পারে! কোনো না কোনো ধনীর কাছে কাকুতি মিনতি করে তারা গ্রন্থের মুদ্রণ-ব্যয়ভার আদায় করে। তারপর একবার গ্রন্থকার সাজলেই তাদের বগলবাদ্যে কান পাতা দায়। নবীনকুমারকে এই সব পরভৃতদের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে নাম উচ্চারণ করবে লোকে? যদিও এ কথা সত্য যে, বাংলা-ইংরেজি পত্রিকাগুলিতে তার সব কটি গ্রন্থ সম্পর্কেই দীর্ঘ প্রশংসামূলক মন্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু প্ৰশংসায় ইতিমধ্যেই নবীনকুমারের অরুচি ধরে গেছে। একটি সম্ভ্রান্ত ইংরেজী পত্রিকা তার বিক্রমোর্বশী গ্ৰন্থ সম্পর্কে লিখলে যে, এই গ্রন্থটি কার রচনা সে সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, নিশ্চয়ই এটি কোনো প্ৰবীণ পণ্ডিতের রচনাই হবে, নিশ্চয়ই সংস্কৃত কলেজের কোনো প্রাজ্ঞ শিক্ষক এটি রচনা করেছেন। সে মন্তব্য পড়ে খুব একচেট হেসেছিল নবীনকুমার। বস্তুত, বিক্রমোর্বিশী রচনার সময় তার বয়েস সদ্য সপ্তদশ বৎসর!

যাই হোক, এসব প্রশংসাও তাকে আর ধরে রাখতে পারছে না। সে বুঝতে শুরু করেছে যে, বেশির ভাগ প্ৰশংসাই স্তুতিবাদের নামান্তর মাত্র। কেউ তো তার কখনো নিন্দা করে না। তার রচনার কিয়দংশ যখন সে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সদস্যদের পড়ে শোনায়, তখন তারা একবাক্যে ধন্য ধন্য করে। নবীনকুমারের মনে সংশয় জাগে, তার রচনার মধ্যে ভুল-ভ্ৰান্তি কি কিছু নেই? সে সকলকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, আপনারা আমাকে সুপরামর্শ দিন, আমার ভাষার দোষগুলির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করুন, তার ফলে আমি নিজেকে সংশোধন করতে পারবো। কিন্তু সকলেই একবাক্যে বলে, আপনার রচনা অতি উচ্চাঙ্গের! এর মধ্য থেকে ত্রুটি বার করে কার সাধ্য! নবীনকুমার নিরাশ হয়।

একমাত্র ব্যতিক্রম হরিশ মুখুজ্যে। নবীনকুমার তার প্রত্যেকটি গ্ৰন্থই উপহার দেয় হরিশকে, তারপর এই কয়েক মাস সে হরিশের মতামত জানার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করেছে, কিন্তু হরিশ সেসব বই পড়েই দেখেননি। হরিশ বলেছেন, বেরাদর নবীন, আমার মাতাটি এখুন পাঁচ রকম সমিস্যের কতায় ঠাসা, তোমাদের ঐ নাটক-কাব্য পড়ার সময়ও আমার নেই, ধৈৰ্যও নেই। এমনকি রুচিও নেই বলতে পারো!

 

একদিন নবীনকুমার প্রায় জোর করেই হরিশকে তার রচনার কয়েকটি পৃষ্ঠা পাঠ করে শুনিয়েছিল। মধ্য পথে বাধা দিয়ে হরিশ বলেছিলেন, ব্যস, ব্যস, থামো। আমার মাতা ঝিমঝিম করে! এসব কি বিদঘুটে সংস্কৃত ভাঙ্গা বাংলা লিকোচো? যেমনভাবে মুখে কতা কও তেমনভাবে, তেমন ভাষায় লিকতে পারো না, যাতে পাঁচ-জনে বুজতে পারে? আমি বাংলা ভাষার ধার ধারি না কেন জানো? তোমাদের এই বাংলাভাষাটি বড় বুজরুগ! কতা কইবে এক ভাষায় আর লিকবে দাঁত ভাঙ্গা ভাষায়, যাতে ঠাকুর-দেবতার গন্ধ! ইংরেজীতে ওসব ছলাকলা নেই!

নবীনকুমার বলেছিল, বন্ধু, তবে অন্য সকলে আমায় প্রশংসা করে কেন? তারা কেন আমায় সর্বদা উৎসাহ দেয়?

হরিশ উত্তর দিয়েছিলেন, এটুকুও বোঝে না? তুমি একটি বেশ কচি, নধর বড় মানুষের ছেলে। তুমি দুপা হাঁটলে ঝমোঝম শব্দ হয়। তোমার টাকায় পাঁচজনে লুচি মণ্ডা মেঠাই খাচ্ছে, তোমায় কেউ অসুখী করবে। কোন সাধে? আমি গরিব বামুনের ছেলে, কোনোদিন কারুর খাইওনি, পরিওনি, কারুর ঝাড়ে বাঁশি কাটতেও যাইনি, সেইজন্য আমি সাফ সাফ কতা বলি! তোমার ঐ টুলো পণ্ডিতী বাংলা আমার পোষাবে না!

নবীনকুমার বলেছিল, কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায়ও তো এ-রকম বাংলাই লেকেন! এরকমই তো বর্তমান কালের আদর্শ!

হরিশ হাত জোড় করে বলেছিলেন, বিদ্যেসাগর মাতায় থাকুন, তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁর লেকা সম্বন্ধে কিচু বলতে চাইনে! তবে ঐ যে টেকচাঁদ ঠাকুর নাম দিয়ে প্যারীবাবু আলালের ঘরের দুলাল না কী যেন একটা লিকেচেন, তার কয়েকপাত পড়ে দেকিচি, বড় খাসা লেগেচে! পড়ামাত্তর বোজা যায়। হ্যাঁ, আর একটা কতা। বিদ্যেসাগর লিকচেন লোকশিক্ষার জন্য, তোমাদের মতন রসের হাট খুলে বসেননি।

 

যত দেখছে ততই হরিশ মুখুজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে নবীনকুমার। মানুষটি বড়ই বিচিত্র। একই মানুষের মধ্যে যেন নানান বৈচিত্র্যের সমাহার। যেমন তেজী এবং জেদী আবার তেমনই কোমল। কখনো কখনো কারুর প্রতি ক্ৰোধে উদ্দীপ্ত হয়ে অশ্রাব্য কু-কথার ফোয়ারা ছুটিয়ে দেন। আবার সেই মানুষই দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুৰ্দশার কথা শুনে অশ্রু বর্ষণ করেন। এক সময় তিনি খুবই দরিদ্র ছিলেন বটে। কিন্তু এখন তিনি যথেষ্ট অবস্থা ও সঙ্গতিসম্পন্ন, কিন্তু আজও তিনি নিজের কৈশোর-যৌবনের দারিদ্র্যের কথা অহংকারের সঙ্গে বলে বেড়ান। এইটি বিষম বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে! এ-শহরের নিয়মই এই অধিকাংশ ব্যক্তিই নিজের প্রকৃত অবস্থার কথা গোপন করে। যার যা অবস্থা, তার থেকে চালচলন অন্য রকম। যার ঘরে দিবারাত্রি ছুঁচোর কেত্তন চলছে, সেও বাইরে বেরুবার সময় কোঁচার পত্তন করে। একমাত্র হরিশ মুখুজ্যেই যেন ব্যতিক্রম। দারিদ্র্য তাঁর কাছে শ্লাঘার ব্যাপার। যা আয় করেন, ব্যয় করেন তার চেয়ে অনেক বেশী।

হরিশ মুখুজ্যের চরিত্রে আরও অনেক রকম বৈপরীত্য আছে। দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য তিনি তাঁর লেখনীকে তরবারি করে তুলছেন দিন দিন। ব্ৰাহ্ম ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি দৃঢ়ভাবে নিয়মনিষ্ঠ। সপ্তাহে অন্তত দুদিন তিনি রসাপাগলা অঞ্চল সন্নিহিত ভবানীপুরে ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনার পূর্বে বক্তৃতা করেন। হিন্দু পেট্রিয়টের পৃষ্ঠাগুলি তিনি ভরাট করেন প্রায় একাই লিখে। আবার সেই মানুষই প্রতিদিন গলায় ঢালেন সুরা রূপী অগ্নি, ঢালতেই থাকেন। যতক্ষণ পদক্ষেপ ও কথাবার্তা অসংবদ্ধ হয়ে না যায়। প্ৰায় রাত্রেই তিনি নিজ ভবনে না ফিরে যান বেশ্যালয়ে। দেশের মানুষকে ভালোবাসেন তিনি, আবার দেশের মানুষকে এত বেশী গালিগালাজও আর কেউ দেন না তাঁর মতন।

লেখার নেশাটা খানিকটা কমে গেলে হরিশের কাছে নিত্য যাতায়াত করতে লাগলো নবীনকুমার। হরিশ সারাদিন আপিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন, সন্ধ্যার পর তিনি কোনোদিন কোনো মিটিং, কোনোদিন ব্ৰাহ্মসভায় অথবা হিন্দু পেট্রিয়টের কার্যালয়ে কর্মে নিযুক্ত থাকেন। তিনি যেখানেই যান, নবীনকুমার সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। কেল্লা থেকে রাত্রি নটার তোপ দাগার পর হরিশ কর্ম থেকে নিবৃত্ত হন, তারপর কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে তির্যক আলাপ করেন, সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে সুরাপান। তারপর এক সময় কণ্ঠস্বর জড়িত হয়ে এলে হরিশ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, বেরাদর নবীন, এবার লেট আস পার্ট আওয়ার ওয়েজ, এখুন। আমি যিদিকে যাবো, তুমি তো আর সিদিকে যাবে না, ঘরের ছেলে ভালোয় ভালোয় ঘরে ফেরো! আমি এখন কোনো সুন্দরীর রূপসাগরে অবগাহন কবে, আর তার ঠোঁটের, না, তোমরা কী যেন বলো, অধীরের অধরামৃত পান করে আমি অমর হবো।

দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠকায় হরিশ এর পর আপনি বুক চাপড়ে সগর্বে বলেন, আমি কত বছর বাঁচবো জানো? তিনশো বছর! আমার এত কাজ, তার আগে ফুরুবে না!

নবীনকুমারের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তার খুব বাসনা আরও কিছুক্ষণ হরিশের সঙ্গে সময় যাপনের, কিন্তু হরিশ অবিলম্বেই এমন দাপাদাপি শুরু করবেন যে তাঁর সঙ্গে আর তাল রাখা যাবে না। তা ছাড়া তিনি যেখানে যাবেন, সেসব স্থানে যেতে নবীনকুমার ঘৃণা বোধ করে; মাঝে মধ্যে হরিশ কৌতুক ছলে মদের পাত্রটি নবীনকুমারের মুখের একেবারে সামনে এনে বলেন, খাও না বেরাদর, এক চুমুক নিয়েই দ্যাকো না। এ তোমাদের ঐ অধরামৃতের চেয়ে কিছু কম সরেশ নয়। বুদ্ধির জানলা খুলে দেয়। দারুণ বিতৃষ্ণার সঙ্গে মুখ সরিয়ে নেয় নবীনকুমার। এই সুরা বস্তুটির প্রতিও তার দারুণ ঘৃণা। এই বস্তুটি সেবনের পর কত মানুষকে সে অমানুষ হয়ে যেতে দেখেছে।

একদিন সে হরিশকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বন্ধু, তুমি তো অ্যাত ভগবানকে মানো, ব্ৰাহ্মসমাজে প্রার্থনার সময় চোক বুজে বসে থাকে, সেই তুমিই এত সুরা পান করো কেন?

হরিশ বললেন, ভগবদ ভক্তির সঙ্গে সুরাপানের কী বিরোধ? ঈশ্বর কি কারুকে বলে দিয়েছেন, এটা খাবে না, ওটা খাবে না? আমি তেমন ঈশ্বরের কতা জানি না। তোমাদের শ্ৰীকৃষ্ণও তো অর্জুন আর পাণ্ডব-পূরস্ত্রীদের নিয়ে খাণ্ডব বনে পিকনিক কত্তে গিয়ে মদ খেয়ে খুব ফুত্তি করেছেলেন! যীশু নিজে তাঁর শিষ্যদের সুরা পরিবেশন করেচেন, পড়েনি এসব? হেঃ হেঃ হেঃ!

নবীনকুমার বললো, যত লুচ্চ লম্পট মদ খেয়ে ঝুম মাতাল হয়। তারা আর তুমি সমান তা হলে?

হরিশ বললেন, অন্যদের সঙ্গে আমার তুলনা করো না! আমি প্রতিভাবান, আমি যা খুশী কর্বো! আমি জানি, মাতার ওপরে ঈশ্বর আচেন, তিনি দেকচেন! আমি কোনো ভুল কলে তিনি আমায় অন্য পথে নিয়ে যেতেন। নবীন ভায়া, আমি ঈশ্বরকে মানি কেন জানো? আমি জানি, আমার সব রকম বিপদ-আপদে তিনি আমায় রক্ষা করেন। একটা দিনের ঘটনা তোমায় বলি। তখুন আমার বয়েস কত, এই পৌয়োরো-ষোলো হবে। লোকের চিঠি চাপাটি, দলিলপত্তর লিকে দিয়ে দু-এক গণ্ডা পয়সা পাই, তা দিয়ে সংসার চলে! মাজখানে দিনকাল খুব খারাপ পড়লো, কোনো রোজগারপাতি নেই, দিন আর চলে না, দুদিন বাড়িতে চুলো জ্বলেনি। পেটে একটা দানা পড়েনি, মা শেষমেষ বললেন, যা হরু, আমাদের এই শেষ কাসার থালাটা বন্দক দিয়ে যা পাবি দুটো চাল কিনে আয়! বেরুতে যাবো, এমন সময় ঝমোঝমিয়ে বৃষ্টি! সে কী বৃষ্টি, তোমায় কী বলবো বেরাদর, যেন আকাশ একেবারে ফেটে গ্যাচে! তিন চার ঘণ্টাতেও সে বৃষ্টি থামে না। আমি না হয় সে বৃষ্টি মাতায় করেই বেরুতে পারি, কিন্তু কোনো দোকানপত্তর তো খোলা থাকবে না! বন্দকের দোকান আগেভাগেই ঝাঁপ গুটোবে। নিরুপায় হয়ে এক সময় কাঁদতে শুরু করলুম! পেটে খিদের অমন জ্বালা, কান্না আসবে না! কাঁদতে কাঁদতে বললুম, হে ভগবান, তুমিও আমায় দোকলে না? তারপরই কী হলো জানো, বেরাদর নবীন? সেই ঝড় জলের সন্ধেতেই এক বড় জমিদার আর তাঁর মোক্তার আমার বাড়ি খুঁজে এসে হাজির। তাদের এক দলিলের ইংরেজী কত্তে হবে, খুব জরুরি, পরদিন সক্কালেই আদালতে জহির করার কতা। আমি সে কাজ করে দিলুম, আর অমনি নগদানগদি দুটো টাকা পেলুম। বল, ভগবানের দয়া ছাড়া এমন হয়?

নবীনকুমার চুপ করে রইলেন।

হরিশ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জীবনে এমন হয়নি কখনো?

নবীনকুমার বললো, না।

—তুমি বয়েসে এখুনো বালক, তোমার সামনে অনেক দিন পড়ে আচে, কোনো না কোনো সময়ে হবেই, এমনিতেই ঈশ্বর তোমায় সোনার চামচ মুখে দিয়ে এ পৃথিবীতে পাট্যোচেন তো, তাই বুজতে পাচ্চো না!

—বন্ধু, আমি ব্ৰাহ্মদের সভায় অনেকবার গেচি। কখুনো অবশ্য বাপ-পিতোমোর ধর্ম ছাড়বার কতা আমার মনে আসেনি। কিন্তু একটা কতা আমি স্বীকার কবেই, যদিও মিষ্টান্ন ভোজন কিংবা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেবার জন্য তাঁদের নোলা সকসক করে তবু অন্য অনেকের চেয়ে ব্রাহ্মরা সচ্চরিত্র। তাঁরা সুরাপান কিংবা…

—রামমোহন রায় সুরাপান কত্তেন। দেবেন্দ্ৰবাবুও কত্তেন। রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ীর মতন পূজনীয় ব্যক্তিরা কে করেন না বলতে পারো?

—কিন্তু তুমি এই যে অবিদ্যার বাড়ি যাও?

—তুমি দেকচি মরালিটির এপিটোম একটি! অবিদ্যা কাদের বোলচো? স্ত্রীলোক মাত্রই এক-একটি রত্ন! তুমি জানো, প্রাচীন গ্ৰীস রোমে বড় বড় দার্শনিকরা সন্দেবোলা বারবনিতা পল্লীতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে দর্শন তত্ত্ব আলোচনা কত্তেন! সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী এবং নিষেধহীন কোনো রমণী নিকটে থাকলে পুরুষের শরীরে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়, তাতে তার বুদ্ধি ও প্রতিভা বেশী খোলে!

–বেশী রক্ত চলাচলের জন্যই শুম্ভ-নিশুম্ভ নিধন হয়েচেন বোধহয়।

—হা-হা-হা-হা! এটি বেশ বোলোচো! খাসা বোলোচো! তা ঠিক। সেইজন্যই নিভৃতে এক রমণীর কাচে একাধিক পুরুষের থাকতে নেই। থাকলেই বিবাদ, মন কষাকষি, কিংবা রক্তারক্তি। কিন্তু বারাঙ্গনাদের কাচে সব পুরুষই অনন্য, দ্যাট ইজ দি বেস্ট পার্ট অফ ইট! তারা প্রত্যেকেই তোমার, আমার। তুমিও তাদের সকলের, কোনো ভেদাভেদ নেই। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল!

এইভাবে তর্ক বিতর্ক চলে, কোনো নিষ্পত্তি হয় না। গৃহে মা ও স্ত্রীর বিবাদের ফলে কোনো শান্তি নেই, তাই হরিশ কাজের শেষে যায় কোনো নর্তকীর বাড়িতে, আর নবীনকুমার ক্ষুণ্ণমনে ফিরে আসে নিজের আলয়ে। হরিশ তাকে চুম্বকের মতন টানেন, আবার হরিশ নিজেই তাকে এক সময় ছেড়ে চলে যান বলে সে দুঃখ পায়।

 

প্রায়ই হরিশের কাছে এসে বসে থাকে রাইমোহন, হরিশ এই লোকটিকে খুব প্রশ্রয় দেন। রাইমোহনের দশা এখন একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। সর্বক্ষণ চুরচুর নেশাগ্ৰস্ত, পোশাক-পরিচ্ছদে ধুলোকাদা মাখা, চক্ষুদ্বয় ঘোলাটে, দেখলেই বোঝা যায় তার আর বেশীদিন আয়ু নেই। অবশ্য, যে লোক নিজের প্রাণের মায়া একেবারে ত্যাগ করে বসে থাকে, তার মৃত্যু সহজে আসে না। হরিশের একটি স্বভাবের কথা নবীনকুমার আগেই শুনেছিল। যে-সব রাতে তিনি নেশাগ্ৰস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরেন, তখনও তিনি একলা ফেরেন না। হয় রাস্তার কোনো ঘেয়ো কুকুর অথবা কোনো ভিখারিকে সঙ্গে নিয়ে যান এবং মাতা কিংবা পত্নীর আপত্তি শুনলেই তিনি তুমুল হল্লা করেন। এমনকি একদিন এক কুণ্ঠরোগীকেও তিনি পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্ৰায় সেই একই রকম মনোভাব নিয়ে তিনি রাইমোহনের জন্য অবারিত দ্বার রেখেছেন। রাইমোহন সুরাপানের জন্য হরিশের কাছে আসে, অনেকখানি জিভ বার করে সে হ্যাংলার মতন বলে, কই মুকুজ্যে ময়াই, একটু সেবন করান। কণ্ঠতালু পয্যন্ত যে শুক্যে গেল! কাজ ফেলে রেখে হরিশ তৎক্ষণাৎ বোতল বার করে দেন। আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন, আহা, ওর আত্মার শুক পক্ষীটি সব সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে, তাকে কষ্ট দেওয়া পাপ!

নবীনকুমারকে দেখলে রাইমোহন আর ভয় পায় না। সে যেন সব ভয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। তার কণ্ঠস্বরে পুরোনো মোসাহেবী সুরটি আর নেই, বরং মাঝে মাঝে সে বেশ খোঁচা দিয়েই কথা বলে। এক একদিন এমন হয় যে হিন্দু পেট্রিয়টের জন্য লেখা শেষ করতে হরিশের দেরি হচ্ছে, পাশে নিঃশব্দে বসে আছে নবীনকুমার। অদূরে বসে সুরাপান করে চলেছে রাইমোহন, সে কিন্তু নিঃশব্দ নয়, প্রায়ই সে গান গেয়ে ওঠে আপন মনে। হরিশ কিন্তু তাতে বিরক্তও হন না বা তাকে চুপ করতেও বলেন না। সুরার বোতলটি নিঃশেষ হয়ে গেলে রাইমোহন হরিশকে তাড়া দিয়ে বলে, কই, মুকুজ্যে ময়াই, এবার উটুন। এই দুধের বাছাটিকে এবার বাড়ি যেতে বলুন! চলুন আমরা দুজনায় মিলে তিথ্যিস্থানে যাই! কমলীর কাচে যাবেন? কমলী? সে আবার দোকান খুলেছে! শেষবেলায় বড় চমৎকারিণী হয়েচে, চলুন, আমি যে যাবো!

এক একদিন সে নবীনকুমারকে বলে, ছোটবাবু, আপনার এত বড় বংশ, আপনি তার মান রাকলেন না? আপনার পিতা উদার ছেলেন, মদ-মাগীর জন্য কম পয়সা ঢেলেচেন! ওফ! সে-জন্য কত নাম ছড়িয়েছেল তাঁর! এক ডাকে সবাই চিনতো! হ্যাঁ, বাবু বটে রামকমল সিংগী! বিংশ পঞ্চাশটা মাতালের মুখের অন্ন না জোগালে আর বড় মানুষ কিসের? তা আপনার হাতে যে বিষয় সম্পত্তি এলো, আপনি আমাদের জন্য কী কল্লেন! একদিন একটা মচ্ছবিও লাগালেন না? বেশ দু-দশ গণ্ডা বাঈ নাচবে, বিশ পঞ্চাশটা বোতল মাটিতে গড়াবে, আর আমরাও গড়াবো, তবে না মচ্ছবি! নবীনকুমার ঘৃণাভরে রাইমোহনের অধিকাংশ কথারই উত্তর দেয় না। রাইমোহনকে দেখলে বেশির ভাগ দিনই সে বিরক্ত হয়ে চলে আসে। এক একদিন অসহ্য হলে সে রাইমোহনকে প্ৰচণ্ড ধমক দেয়, রাইমোহন হা-হা করে হাসে। হরিশও যোগ দেন সেই হাস্যে।

নবীনকুমার একদিন ঠিক করে, সে আর যাবে না হরিশের কাছে। কিন্তু দুদিনের বেশী স্থির থাকতে পারে না। চতুর্দিকে অসংখ্য চাটুকার, শুধু হরিশ আর রাইমোহনই তোয়াক্কা করে না তার সামাজিক মর্যাদার। তবু ঐ দুজনের কাছেই তার যেতে ইচ্ছে হয়। দু-তিনদিন রাগ করে থাকার পর সে আবার যায়।

বিদ্যোৎসাহিনী সভার সদস্যদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে নবীনকুমারের বেশী হৃদ্যতা ছিল, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এবং যদুপতি গাঙ্গুলী। এর মধ্যে কৃষ্ণকমল কিছুদিন যাবৎ আর একেবারেই আসে না, যদুপতি আসে, কিন্তু সেও নবীনকুমারের রচনার দারুণ অনুরাগী। প্ৰায় চাটুকারেরই মতন শোনায় তার কথা, যদিও নবীনকুমার লক্ষ করেছে, যদুপতি নির্লোভ স্বভাবের মানুষ। যদুপতি প্রায়ই বলে, এসো ভাই নবীন, আমরা দেশের জন্য বেশ বড় কোনো একটা কাজ করি। কিন্তু কি যে সেই বড় কাজ, সে সম্পর্কে যদুপতির নিজেরই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। সে বড় জোর গ্রামে স্কুল খোলার কথা ভাবে।

যদুপতি হরিশকে পছন্দ করে না। হরিশের উগ্ৰ কথাবার্তা এবং প্রকাশ্যে লজ্জাহীনভাবে মদ্যপান দেখে সে শিউরে ওঠে। আগে হরিশ আসতেন নবীনকুমারের বাড়িতে বিদ্যোৎসাহিনী সভায়, এখন আর আসেন না। এখন নবীনকুমারের মতন উচ্চবংশের মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ যে হরিশের কাছে যায়, এটা যদুপতির পছন্দ হয় না। সে নবীনকুমারকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু উজ্জ্বল বাতি যেমন পতঙ্গকে আকর্ষণ করে, সেইভাবে হরিশের কাছে বারবার ছুটে যায় নবীনকুমার। হরিশের মতন এমন প্ৰজ্বলন্ত ব্যক্তিত্ব সে আর কারুর মধ্যে দেখেনি। ক্ষুরধার বুদ্ধি হরিশের, এ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তার মতন আর কেউ নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে না।

একদিন হরিশও বড় অপমান করলো নবীনকুমারকে। কোনো কারণে সেদিন তাঁর মর্জি সাফ ছিল না, সম্ভবত সারাদিন ধরেই তিনি কিছু কিছু মদ্য পান করেছিলেন; সেই কারণে নিজের লেখাও মনঃপূত হচ্ছিল না তাঁর। এক একটি পৃষ্ঠা লিখেই ছিঁড়ে ফেলছিলেন। একটু পরেই উপস্থিত হলো রাইমোহন। তখনই তার টপভুজঙ্গ অবস্থা, তার ওপর এসেই সে বোতল দাবি করলো। হরিশও বোতল এগিয়ে দিলেন বিনা বাক্য ব্যয়ে। রাইমোহন পান করতে করতে শুরু করে দিল বেসুরো-বেতালা কণ্ঠে গান। নবীনকুমার আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো, চুপ করো। বন্ধু, তুমি এ লোকটাকে সহ্য করো কী করে? এটাকে বিদায় করে দিতে পারো না!

অমনি দপ করে জ্বলে উঠলেন হরিশ। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, কেন বার করে দেবো ওকে? তুমি ওরা দুঃখ কী বুজবে! আমি ওর সব কতা বুজিচি! তুমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আদরের দুলাল, তুমি বুজবে না! তুমি সত্যিই দুধের বাছা, মনুষ্য জীবনের কিচুই জানো না! তুমি মাতালদের ঘেন্না করো। কিন্তু তোমার সাহস আছে? কোনদিন জিভে ছুঁইয়ে দেকোচো, মদ জিনিসটা কী?

নিজের বুকে চাপড় মেরে হরিশ বললেন, এই দেকচো আমার এই লোহার দরজার মতন শক্ত বুক, আমি পারি। আমি মুদ্দোফরাসিদের পাশে বসে অন্নগ্ৰহণ কক্তে পারি, ভিখারীর সঙ্গে বসে নেশাও কত্তে পারি। তোমরা দুধ ঘি খাওয়া ধনী-র দুলাল, তোমরা কিচুই পারো না। তুমি মাতালকে ঘেন্না করো, কিন্তু কোনোদিন সাহস হলো না মদ জিনিসটা কী তা চেকে দেকতে! বেরাদর, আমার অতিথিদের তুমি কক্ষনো অপমান কর্বে না।

ধুতির কোঁচাটা সযত্নে বাঁ হাতে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে নবীনকুমার বললো, আমি যাই।

হরিশ বললেন, আছ্‌চা! গুড ন্নাইট!

অপমান ও বন্ধুবিচ্ছেদের বেদনায় নবীনকুমারের মুখটি বিবৰ্ণ হয়ে গেল। কারুর কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পাওয়ার অভ্যেস তার নেই। ক্ৰোধ যেন তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ থেকে ফুড়ে বেরুতে চাইলো। একবার তার মনে হলো, এখুনি গিয়ে কয়েকটি পাইক ডেকে এনে এই লোক দুটিকে পিটিয়ে একেবারে ছাতু করে দিতে। কিন্তু পরীক্ষণেই মনে হলো, সে হবে শুধু শারীরিক শক্তির প্রকাশ। অর্থবলে হরিশ এবং রাইমোহনের মতন লোকদের জব্দ কিংবা চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া তার পক্ষে কিছুই শক্ত নয়। কিন্তু এদের কাছে সে বুদ্ধিতে কিংবা কথায় কি হেরে যাবে?

মুখ ফিরিয়ে সে কাতরভাবে বললো, বন্ধু, মদ্যপানের মধ্যেই কি খুব বীরত্ব বা সাহসের পরিচয় আছে?

হরিশ বললেন, মদ্যপান না করার মধ্যেও কোনো বীরত্ব বা সাহসের পরিচয় নেই!

নবীনকুমার কয়েক পা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বললো, দাও!

হরিশ একটুও বিস্মিত বা বিব্রত হলেন না। তৎক্ষণাৎ একটি গ্লাসে খানিকটা সুরা ঢেলে সেটি নবীনকুমারের হাতে তুলে দিলেন।

নবীনকুমার এক চুমুকে তরল পদার্থটি শেষ করে বললো, এই তো খেলাম, কী হলো?

হরিশ এবং রাইমোহন দুজনেই হেসে উঠলো উচ্চ স্বরে।

রাইমোহন বললো, এক গেলাসে তো শরীরের নোনা কাটবে গো, নোনা কাটবে!

হরিশ বললেন, ঠিক!

নবীনকুমার আবার হাত বাড়িয়ে বললো, দাও।

দ্বিতীয় গেলাসটিও সে এক নিশ্বাসে শেষ করে জিজ্ঞেস করলো, এবার?

হরিশ বললেন, দ্বিতীয় গেলাসে তো মাত্তর মুখের দুধের গন্ধ ছাড়বে। আমরা তো শিশু বয়েসে মায়ের বুকের দুধ খাই, সে গন্ধ অনেকদিন মুখে লেগে থাকে।

হাতের বোতলটি উঁচু করে তিনি বললেন, এটা কী জানো? টাট্‌কা, নতুন জিনিস এয়েচে। এতকাল তো এসকাটিলিয়ান ব্র্যাণ্ডি খেয়ে জিব খসখসে করিচি, এটা একেবারে খাস ফরাসিস দেশের, এর নাম কন্যাক। এর প্রতি ফোঁটায় রক্ত। এর চার গেলাস খেলে তবে না গা গরম হয়।

নবীনকুমার বোতলটি হরিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সরাসরি নিজের গলায় ঢালতে লাগলো সবটুকু তরল আগুন।

রাইমোহন হরিশের দিকে তাকিয়ে দারুণ কৌতুকের ভঙ্গিতে খচাং করে টিপে দিল এক চক্ষু। তার তোবড়ানো গালে ভেসে উঠলো এক ধরনের হাসি।

হরিশও হাসতে হাসতে নবীনকুমারকে বললেন, বন্ধু, আমায় মদ্য পানে দীক্ষা দিয়েচিলেন রামগোপাল ঘোষ। তোমাকেও দীক্ষা দিল আমার মতন একজন প্ৰতিভাবান, বিখ্যাত লোক। সুতরাং তোমার দুঃখ করার কিছু নেই তো।

হঠাৎ এমন বীরত্ব দেখাতে গিয়েও নবীনকুমার শেষরক্ষা করতে পারলো না। কয়েক ঢোঁক তীব্ৰ কনিয়াক গলায় যেতেই সে বিষম খেল, যতখানি সে পান করেছিল তার অনেকটাই উল্টে বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। চক্ষে এসে গেল জল।

হরিশ তার হাত থেকে বোতলটি নিয়ে নেবার চেষ্টা করতেও সে দিল না। বোতলের গলাটি শক্ত করে চেপে ধরে রইলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *