বাঙালি নদীর কোলে মা ভবানীর দ, দয়ের মাছ তো মায়ের সেবার জন্যেই, না কী। বলিস? প্রশ্নের জবাবের জন্যে নায়েববাবু পরোয় করে না, ঐ মাছ চুরি করে বেটা মাঝি, ম্লেচ্ছ মাঝি, এ্যাঁ? মায়ের সন্তান হয়ে আমরা তা সহ্যও করি! আবার তার সঙ্গে তোদের মহা খাতির! ছি!
ধিক্কারটি নায়েবমশাই থুক করে ছেড়ে সরাসরি বৈকুণ্ঠের দিকে। বৈকুণ্ঠের জড়সড় ভাবটি এতে কাটে, সে বলল, না বাবু। এটা হলো ভবানী সন্ন্যাসীর দ। ভবানী পাঠক। যুদ্ধ করিছিলো গোরা কোম্পানির সেপাইদের সাথে। বছর বছর হামরা তেনারই পূজা করি পোড়াদহ মেলার দিন। একটু থেমে সে জানায়, ওই দয়ের কাছে তিনি দেহ রাখিছিলেন।
দেবী আর সন্ন্যাসী কি এক হলো রে পাগলা? বিরক্ত হলেও পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী গলা চড়ায় না, বরং স্বর আরো নরম করে বলে, ভবানীপুর চিনিস তো? সেরপুরের কাছে। ভবানীপুর–
চিনি বাবু। হামাগোরে জ্ঞাতিগুষ্টি–।
তা হলে তো ভালোই চিনিস। ভবানীপুরে মায়ের মন্দির। জমিদারি নাটোরের। কিন্তু মন্দির তো আর রানী ভবানীর নামে হয় নি। দক্ষযজ্ঞের সময় মা দুর্গা ক্রোধান্বিত হয়ে নিজের দেহ রাখলে মহাদেব ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। আপন পরিবারের দেহ নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে লাগলেন। তো নারায়ণ দেখলেন, মায়ের দেহে পচন ধরলে ধরিত্রীর বায়ু বিষাক্ত হয়ে যাবে। তিনি তাঁর চক্র দিয়ে মায়ের পবিত্র দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বময়। নানা স্থানে পড়লো দেহের নানা অংশ। আর মায়ের বাম কর্ণ পড়লেন কোথায়?-না, ঐ করতোয়া তীরে, ভবানীপুরে।
টাউনের সতীশ মুক্তার চোখ বুজে ঘাড় নাড়লে নায়েব পূর্ণচন্দ্র উৎসাহিত হয়ে বলে, সেই থেকে ঐ স্থানের মাহাত্ম্য, স্থানের নাম হলো ভবানীপুর। মায়ের কর্ণ এখনো সেখানই স্থাপিত, নিত্য পূজা হয়, ভক্তবৃন্দ প্রসাদ পান। কর্ণ ওখানে থাকলো আর মায়ের ভোগের নিমিত্ত মাছ রাখা হলো মানাস নদীর দয়ে। আহা, মানাস এখন মৃত, কিন্তু সেই দয়ের জল শুকায় না, বাঙালি ঐ দ কোলে করে মা ভবানীর মাছ পাহারা দেয়। আহা, ঐ জল বড়ো পবিত্র!
দশরথ, যুধিষ্ঠির ও পালপাড়ার কেষ্ট পাল তার এই ভাষ্য শুনে থ। টাউনের সতীশ মুক্তার ও সেরপুরের অনিল সান্যাল চুপচাপ সায় দেয়। কিন্তু ছটফট করে বৈকুণ্ঠ। বাবুরা এসব বলছে কী? এই এলাকার ব্যামাক মানুষ জানে, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সাহা, পাল, নমঃশূদ্র, মোসলমান সবাই জানে, এই দয়েই কোম্পানির সেপাইয়ের গুলিতে দেহরক্ষা করেন ভবানী পাঠক। সঙ্গে ছিলো তার পাঠান সেনাপতি। তো সেটা কী আর আজকের কথাঃ বৈকুণ্ঠের ঠাকুরদার ঠাকুরদা, তারও বাবা, না-কি তার ঠাকুরদা, সে তো সন্ন্যাসীর সঙ্গেই ছিলো। তা হলে?—আজ আবার মা ভবানীর কথা ওঠে কেন? বৈকুণ্ঠ আস্তে আস্তে। বলে, না বাবু, পোড়াদহ মেলার নাম তো সন্ন্যাসী ঠাকুরের নামেই। মেলার আগের দিন। মঙ্গলবার মেলার বটতলায় তাঁর বিগ্রহ রাখা হয়, সন্ন্যাসী ঠাকুর লিজে আবির্ভূত হন। মেলার দিন ভোররাতে।
মেলার কথা রাখ। পোড়াদহ মেলা আমোদ-প্রমোদের জায়গা, সাত জাতের মানুষ আসে। সেখানে তোরা যে কিসের পূজা করিস তোরাও তো ভালো করে জানিস না। তা পূজা কর, ভালোই। কিন্তু মানাসের দয়ের এতো নিকটে মায়ের পূজা হয় না, এটা কি সহ্য করা যায়? মা আমার বিশ্বমাতা, জগজ্জননী। তার অপমান আর কতো সহ্য করা যায়? মায়ের অপমানে আহত পূর্ণচন্দ্র হামলায়, মা, মা। মা গো, মা গো?
এই ব্যাকুল ডাকে মা তো মা, মায়ের বাপের পক্ষেও তিষ্ঠানো দায়। দাদামশায় বা মায়ের কিংবা দুজনেরই আবির্ভাবের আশায় ও আবির্ভাবের ভয়ে সবাই এদিক ওদিক দেখে। তাদের ভয় ও ভক্তিকে পোক্ত হবার সুযোগ দিতে নায়েবমশাই একটু থামে। তারপর নিশ্চিত হয়ে ফের মুখ খোলে, মায়ের ভোগ চুরি করলো এক মোসলা মাঝি, স্নেচ্ছের স্পর্শে দুয়ের জল অপবিত্র হলো। মায়ের আমার দয়ার শরীর, তিনি কিছু করলেন না। কিন্তু আমরা? আমরা তাঁর অধম সন্তান। আমরা কী করলাম?-না, হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। ম্লেচ্ছ বেটা আস্কারা পেয়ে গেলো। ওর ছেলে নামলো বিল : ডাকাতিতে। আরে বিল হলো জমিদারের, যাকে খুশি পত্তন দেবেন, তাতে কার কী?
কাৎলাহার বিলের মাছ তো গিরিরডাঙার মাঝিরাই ভোগ করিচ্ছিলো বাবু। দশরথ কর্মকারের এই মন্তব্যে নায়েববাবু অসন্তুষ্ট হয়, আরে আগে অনাচার হচ্ছিলো বলে সব সময় কি তাই হতে থাকবে? জমিদার যদি আইনকানুন না দেখেন, প্রজার হিতসাধনে যদি মনোযোগী না হন তো প্রজার মঙ্গল হয় কী করে? গায়ের জোরে যে যা খুশি তাই করবে, আর জমিদার কি বসে বসে ঘাস খাবে? এ্যা, ঘাস খাবে?
তৃণভোজী জমিদার এদের কারো পছন্দ নয়। নায়েবের মুখে জমিদারের প্রতাপের। বিবরণ শুনলে এদের কালোকিষ্টি শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে। নায়েব পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী তখন ছাড়ে তার প্রকৃত ক্ষোভটি, ঐ যে তমিজের বাপ, মায়ের দেহ অপবিত্র করে, নিজের ছেলেকে উস্কানি দিয়ে বিল ডাকাতি করায় আর তোমরা ঘোয়রা তার পিছে পিছে। তাদের বাড়ি যাও, শুনেছি জল পর্যন্ত খাও। তোমাদের জাত কী? মায়ের অপমানে তোমাদের রক্তে আগুন জ্বলে না?
সেরপুরে অনিল সান্যালের পাতলা ঠোঁটে ভোরের চাঁদের পানা বেদনার হাসি, গম্ভীর দীর্ঘশ্বাসে চাঁদটিকে উড়িয়ে দিলে থাকে শুধু বেদনাটি। তাই সম্বল করে সে বলে, আরে, দেশটাই ভাগ করতে বসলো। আর এ তো সামান্য নদীর দ। এসব বলে।
মা ভবানীর অসম্মানকে আপনি সামান্য বললেন? আপনার মায়ের গায়ে হাত দিলে আপনি সহ্য করবেন? আর দুর্গা হলেন বিশ্বমাতা, এঁর অপমানে তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্বলে ওঠবার কথা। সতীশ মুক্তারের ক্ষোভ জ্বলে ওঠে রুদ্র তেজে, এই করেই তো আপনারা দেশটাকে তুলে দিলেন ওদের হাতে। কংগ্রেস যদি প্রথম থেকে ধর্মরক্ষায় মন দেয় তো দেশের অবস্থা কি আজ এরকম হতে পারে? মোসলমানদের কতো আস্কারা দেওয়া হয়েছে, ভেবে দেখেছেন কখনো?
কংগ্রেসের সেরপুর থানার সহকারী যুগ্ম সম্পাদক অনিলচন্দ্র সান্যাল কৈফিয়ৎ দেয়, সতীশবাবু, সবাইকে নিয়েই তো দেশ। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে কোল দিয়ে, হৃদয়ে সবাইকে ঠাঁই দিয়েই তো মহাত্মা গান্ধি মহাত্মা হয়েছেন।
এখন তার ঠেলা সামলান। দেশের শরীর কাটার জন্যে ওরা তলোয়ার নিয়ে খাড়া। নিজের ধর্মই তো মহাত্মার হাতে পড়ে নষ্ট হতে চলেছে।
না সতীশবাবু। অনিলচন্দ্র ধর্মভাবে উদ্দীপ্ত হয়, মহাত্মা নিজের ধর্মকে খাটো করবেন কেন? হিন্দুর ধর্ম, হিন্দুর স্বার্থের বিরুদ্ধে তিনি কি কিছু করতে পারেন? তিনি নিজেই তো বলেছেন, আমি সর্বপ্রথম হিন্দু, তারপর দেশপ্রেমিক। তার আদর্শ হলো শ্রীমদভগবদ গীতা।
এইসব রাজনৈতিক আলোচনায় নায়েববাবুর দরকারি কথাটাই সেরে ফেলা যাচ্ছে। শরাফত মণ্ডল এসে পড়বে, তখন তো খোলাখুলি কথা বলা মুশকিল হয়ে পড়বে। সুতরাং সতীশ মুক্তার আর অনিল সান্যালের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা বিঘ্নিত করে নায়েববাবু প্রজাদের বলে, শোনো বাবারা, যতো নষ্টের গোড়া ঐ শালা তমিজের বাপ। বোকা বোকা ভাব করে থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকা শয়তান একটা। ঐ বেটাকে আমি পুলিসে দেবো। মাঝিপাড়ার মানুষ একটু গোলমাল করতে পারে, ভোটের জন্যে কাদেরও তেমন কিছু করতে সাহস পাবে না। ওদের আঁটো করতে হবে তোমাদেরই।
দশরথ, যুধিষ্ঠির ও কেষ্ট পাল ভয়ে এবং বৈকুণ্ঠ গিরি ভয়ে ও দুঃখে চুপ করে থাকে। তমিজের বাপের সঙ্গে চেরাগ আলির মাধ্যমে পাকুড়গাছের সরাসরি যোগাযোগের কথা। গিরিরডাঙা, নিজুগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি, পালপাড়া, রানীরপাড়া, পারানিরপাড়া, এমন কি সাবগ্রাম ছাইহাটার সব মানুষ জানে।
দশরথ আস্তে আস্তে বলে, বাবু, একটা কথা কই। তমিজের বাপের গাওত হাত না তোলাই ভালো।
কেন? নায়েববাবুর গলায় ঝঝ মেশে, শরাফত মণ্ডল যে খড়ম দিয়ে তাকে পেটালো, তাতে মণ্ডলের হাত কি খসে পড়েছে নাকি?
না বাবু। বৈকুণ্ঠ নায়েববাবুর ভুল ধরে, তমিজের বাপের গাওত হাত তুলিছিলো পাকুড়গাছের মুনসি। সন্ন্যাসীর ভোগের মাছ লেওয়ার শাস্তি দিছে মুনসি।
ইস! এই টুয়েনটিয়েথ সেনচুরিতেও এমন সুপারস্টিশন থাকলে স্বরাজ দিয়েই বা কী হবে, স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলনের ফলই বা কী হবে? অনিল সান্যাল মূখদের কুসংস্কারে বড়োই হতাশ। তবে দশরথ জানায়, মণ্ডল তার সাথে খারাপ ব্যবহার করিছে, কাদের মিয়া লিজে যায়া মাফ চায়া আসিছে।
দূর। এ জাতের বিশ্বাস নেই। সতীশ মুক্তার সোজা হয়ে বসে, মাঝির ঘরে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসে কোন আক্কেলে? আরে বাবা, লেখাপড়া যতোই শিখুক আর টাকাপয়সা যতোই করুক, জাতের স্বভাব যাবে কোথায়?
তবে প্রকৃত তথ্য জানা আছে নায়েববাবুর, আরে নাঃ। কিসের মাফ চাওয়া? ভোটের ক্যানভাস করতে গিয়েছিলো মাঝিপাড়ায়। তমিজের বাপের সঙ্গেও দেখা করেছে। তমিজকে খালাস করে আনার কথা বলে এসেছে ইসমাইল। অতো সোজা? ৩৮৭ ধারায় মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। নন-বেলেবল কেস। জামিনই পাবে না। নায়েববাবু মোটেই হতাশ নয়। আজ বৈকুণ্ঠ আর কর্মকারদের ডেকে আনা হয়েছে মণ্ডলের পরামর্শেই। তবে মরা মানাসের দ থেকে সন্ন্যাসীর উৎখাতের বুদ্ধিটা নায়েববাবুর নিজের। মণ্ডলের তাতে বরং সায়ই আছে। পোড়াদহ মেলায় মুসলমানরা যেসব কীর্তি করে মণ্ডল সেসব সহ্যই করতে পারে না। ওখানে মা দুর্গাকে বরং প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মাঝিপাড়ার মানুষদের ওখান থেকে হটানো যায়। নায়েববাবুর স্বপ্ন : টাউনের ভদ্দরলোকরা তখন কেবল মেলা দেখতে আসবে না, পূজার উৎসবেও হৈ চৈ। করতে পারবে। ভূতের পূজা বাদ দিয়ে মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে যদি মা ভবানীর পূজার প্রচলন করা যায় তো আশেপাশের তো বটেই, টাউনের ভদ্দরলোকদেরও এখানে টানা যাবে। তাদের ছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকায় এই খবর ফলাও করে ছাপাবার মুবোদ কি আর নায়েববাবুর হবে? এখন বোঝা যাচ্ছে, এখানে বড়ো ঝামেলা তৈরি করে বৈকুণ্ঠ গিরি। নায়েববাবু তাকেই কড়া করে ধমক দেয়, শোন বৈকুণ্ঠ, মাঝিপাড়ায় তোর এতো দহরম মহরম কিসের রে? ওখানে যাওয়াটা ছাড়। তোদের এইসব ভূতের পূজা বন্ধ করে দিলে দেখি শালার ম্লেচ্ছ মাঝিরা পোড়াদহ মেলায় ভেড়ে কী করে।
কাছারি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যুধিষ্ঠিরের পা আর চলতে চায় না। মাঝিপাড়ার মানুষের সঙ্গে মাখামাখি করলে নায়েব তো চটেই, মণ্ডলও সহ্য করবে না। মণ্ডল ফসল তাকে যতো কমই দিক, বর্গার জন্যে এবারেও তার কাছে ধন্না না দিয়ে তার আর উপায় কী? ভোটের ডামাডোলে মাঝিপাড়ার সঙ্গে কাদেরের একটা বুঝসুঝ হতেও পারে, তমিজ বেরুতে পারলে কাদেরকে ধরে তার একটা গতি হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের দশাটা হবে কী? জমি বর্গা না পেলে জগদীশ সাহার সুদ সামলাতে জমি বেচতে হবে মণ্ডলের কাছে। জেদ ধরে জমি ধরে রাখো তো সুদ সামলাতে ভিটেমাটি, থালবাসন, বাপের হপর, কামারশালা সব দিতে হবে সাহাকে। একবার জগদীশ সাহা, একবার শরাফত মণ্ডল।—যুধিষ্ঠির দিশা পায় না, তবে ভগবানের কৃপায় এর মধ্যেই একটা বুদ্ধি তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ইসমাইল সাহেবের ভোটের ক্যানভাসে যদি কাদেরের পিছে পিছে সে ঘোরে তো তার মনটা পাওয়া যায়। বিল ডাকাতির মামলা দেওয়ার পর মণ্ডল কি আর মাঝিদের বর্গা দেবে? যুধিষ্ঠির কি কামারপাড়ার কেউ তো আর মণ্ডলের সম্পত্তিতে হাত দিতে যায় নি, সুতরাং এই সুযোগে মাঝিদের বর্গা করা জমিগুলো সে তো দিব্যি হাতিয়ে নিতে পারে। এখন কাদেরের পেছনে ছোটাছুটি করলেই হয়।
কাদেরের দোকানের সামনে, কালাম আর মুকুন্দ সাহার গদিতে মানুষ গিজগিজ করে। মুকুন্দ সাহার টিনের বেড়ায় কংগ্রেসের তেরঙা পতাকার ছড়াছড়ি। কংগ্রেসের লোকজন এসেছে টাউন থেকে। এমন কি লাঠিডাঙা কাছারি থেকে পরে রওয়ানা দিয়েও টমটমে করে এসে পড়েছে অনিলবাবু। ওখানে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাম কী? কাদেরের কর্মীদের সঙ্গে সে ভিড়ে গেলে একজন বলে, তুমি এখানে কী করো? কংগ্রেসের এক ছাত্র কর্মী তাকে টেনে আনে সাহার দোকানের দিকে, ছেলেটি বলে, তুমি ওখানে কী। করছো? আরেকজন হাসে, আরে ইসমাইল সাহেবের তো মোহামেডান কনস্টিটুয়েনসি। তোমরা ভোট দেবে সুরেনবাবুকে, সুরেন সেনগুপ্ত, আমাদের কংগ্রেসের ক্যানডিডেট।
যুধিষ্ঠির একটু দমে যায়, কাদেরের সঙ্গে ভিড়তে পারলে মণ্ডলের জমিটা পাওয়া যায়। আবার ইসমাইল সাহেব এমনিতে মানুষটা ভালো, আবার ভোটে জিতলে নাকি আধিয়ারদের ফসলের হিস্যা বাড়াবার আইনও বানাবে। সুরেনবাবুও হয়তো ভালো মানুষ, কিন্তু যুধিষ্ঠির তো তাকে চেনে না। যুধিষ্ঠিরের মাথার এসব জট সাফ করতে এগিয়ে আসে অনিল সান্যাল, মুসলিম ভোটারদের জন্যে একজন এম এল এ, আমাদের এম এল এ আরেক জন। যুধিষ্ঠির এবার বোঝে, দুই জাতের জন্যে দুইজন মেম্বর।
বিকালে মুকুন্দ সাহা বৈকুণ্ঠকে আড়ালে ডেকে বলে, নায়েববাবু তোক সকালে কী কলো রে? শরাফত মিয়া তো কালই হামাক কয়া গেলো, নায়েববাবুর খুব রাগ তোর উপরে। তা তোর বাপু মাঝিপাড়ার সাথে এতো মাখামাখি কিসের রে? তমিজের বাপ বুড়া মানুষ, তার জোয়ান বৌটার সাথে তোর এতো কথাবার্তা কিসের রে? তোরা বলে সন্ন্যাসীর বংশ, তালে ঐ মোসলমান মাঝিগোরে ঘরে এতো আসা যাওয়া কিসক রে?
হাটের ভেতরে কোলাহল, হাটের পুবে ও উত্তরে রোদের শেষ তাপে খুলে-যাওয়া শিমুল বৈকুণ্ঠ গিরির চোখের মণি ঢেকে ফেলে তুলার অশ্রু উড়িয়ে। বন্ধ চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে অন্য এক জোড়া চোখ, সেই চোখ দুটো একটু ছোটো করে ঠোট বাঁকা করে বলা কথাটা বৈকুণ্ঠের কানে বাজে চেরাগ আলির দোতারার সঙ্গতের সাথে, হামার পানি লিলে তোমার জাত যায়, তালে আম খাও তুমি ক্যাংকা করা? হামার আম। হামাক দাও, তুমি তোমার জাতখান লিয়া বাড়িত যাও। কিন্তু মুকুন্দ সাহা আজ তাকে কীসব বলে সব ওলটপালট করে দিলো। কুলসুমের বিয়ের দিন মহা হৈ চৈ করে বাতাসা আর খাগড়াই আর হাতিবান্ধার দৈ খেয়ে বৈকুণ্ঠ চলে গিয়েছিলো পোড়াদহ মাঠে সন্ন্যাসীর থানে। গাঁজায় ভালো করে দম দিয়ে বসে সে গান ধরেছিলো বিকট রবে। আজ এতোকাল পর কান ভরে সে শোনে সেই গানের কলি। গানটাই ভালোভাবে শোনার তেষ্টায় না-কি অন্য কোনো তাগিদে হাটের কোলাহল থেকে বেরিয়ে বৈকুণ্ঠ চলতে থাকে পোড়াদহ মাঠের দিকে। সন্ন্যাসীর খানের নিচে বসতেই, গাঁজায় দম না দিয়েও সে শুনতে পায় একই গান :
সন্ন্যাসী শোণিতে রাঙা মানাসের জল।
বিবাহের চেলি পরি করে ঝলমল।।
ধনে জামায়ের অনাসক্তি যৌতুক লইয়াছে ভক্তি
মৃত্তিকা বিগ্রহ তাহার সকল সম্বল।।
গান শুনতে শুনতে এবং তার সঙ্গে নিজের বেসুরো গলা মেলাতে মেলাতে ভবানী পাঠকের মহাপ্রয়াণ ও সংসারে তার বৈরাগ্য বৈকুণ্ঠের চোখে জলের জোয়ার নামালে তার নুনের ধকে তার চোখমুখজিভ খরখর করে। ভবানী তো ঢুকে পড়েছিলো মাটির বিগ্রহের মধ্যে, মাঘের শেষ বুধবারে পূজার পর বিসর্জন দিলেও তার মাটি বাঙালি নদীর রোগা স্রোত ধরে চলে যায় মরা মানাসের দয়ে। এখন নায়েববাবু ম্লেচ্ছ মাঝির ওপর রাগ করে এখানে যদি সন্ন্যাসীকে উৎখাত করে, তা হলে সন্ন্যাসী যাবে কোথায়? নায়েব এখানে প্রতিষ্ঠা করবে মা দুর্গাকে। সন্ন্যাসী কি আর অতো জাগ্রত দেবীর সঙ্গে পেরে উঠবে? কোথায় মা দুর্গা?–মহিষমর্দিনী, জগত্তারিণী মা, তুমি অম্বিকা, তুমি অন্নদা, তুমি মা চণ্ডী! তোমার বাহুতে শক্তি, সর্বাঙ্গে তোমার মানুষের ভক্তি মাখা! তুমি মা তারা, তুমি মা। কালী!—সেই জগজ্জননী মা কেবল নামের জোরে ভবানী পাঠকের স্থান দখল করার লোভে চড়ে বসেছে নায়েববাবুর ঘাড়ে। বেজাতের মানুষের পাপের দণ্ড দিতে নায়েব সন্ন্যাসীকে উৎখাত করে সেখানে বসাবে দুর্গা মা ঠাকুরণকে? তা হলে পোড়াদহের পূজার খোয়াবনামা স্থানে বেজাতের মানুষের আসাটা বন্ধ করা যাবে, টাউন থেকে এমন কি ভদ্দরলোক, বামুন কায়েতরাও সেখানে পূজা দিতে আসবে। বাঙালি নদীর কোলে বৌডোবা দয়ে মানাসের চোখের জলটুকু পর্যন্ত ঠাকুরের বেদখল হয়ে যাবে, সেটাও থাকবে মা দুর্গার দশ হাতের মুঠের মধ্যে!-তা হলে? তখন বৈকুণ্ঠের এখানে আর থাকার অধিকার থাকবে। কোথায়? সাহার কর্মচারী ছাড়া সে তখন আর কিছুই থাকবে না? সেরপুরে ঠাকুর্দার সৎ। ভায়ের ছেলেদের হাতে তার সম্পত্তি বেদখল হবার কথা কি কেবল গল্প হয়ে যাবে?—উত্তেজনায় ও দুশ্চিন্তায় এবং নিজের সম্বন্ধে অনিশ্চয়তার ফলেও বটে, বৈকুণ্ঠ ছটফট করে। তমিজের বাপের ওপর রাগ করার প্রবল চেষ্টা করেও লাভ হয় না। সে ফের। রওয়ানা হয় গোলাবাড়ি হাটের দিকে। সেখানে তমিজের বাপকে যদি পাওয়া যায়।
ভোটের দিনেও তমিজের বাপের দেখা নাই। মাঝিপাড়া ভেঙে মানুষ এসেছে। কালাম মাঝি হাজির করেছে সবাইকে। নাই খালি তমিজের বাপ। তা তার অবশ্য ভোটও নাই। তবু যারা এসেছে তাদের বেশিরভাগই ফালতু মানুষ, বছরে ছয় আনা ট্যাকসো দেওয়ার মানুষ এদিকে আর কয়জন?
তমিজের বাপের দেখা পেতে বৈকুণ্ঠের কেটে যায় আরো দেড় দেড়টি মাস। সেদিন মুকুন্দ সাহার খবর নিয়ে বৈকুণ্ঠকে যেতে হয়েছিলো গিরিরডাঙা। মণ্ডলের বড়ো ছেলে আবদুল আজিজ বিলের উত্তর সিথানেরও উত্তরে হঁটখোলা করেছে। সেখান থেকে কয়েক হাজার হঁটের বায়না দেওয়ার কথা মুকুন্দ সাহার। তা সাহা নিজেরই আসার কথা, কিন্তু গত রাতে সাহার ভাইপো মরে যাওয়ায় বেচারা আসতে পারে নি। চোখে জল নিয়েই সে বলে, তাড়াতাড়ি যা বৈকুণ্ঠ, টাইম মতো না গেলে আজিজ মিয়া আবার কোদ্দ করবি। কোস, পরশুদিন বায়নার ট্যাকা সব হামি লিজে দিয়া আসমু। কিন্তু বৈকুণ্ঠের আবার কখনো তাড়া থাকে নাকি? একটু ঘুরে ফিরে যাওয়াই তার চিরকালের খাসলত। মোষের দিঘির দক্ষিণ ঢালের ঠিক নিচে দুই বিঘা জমি এবার পত্তন নিয়েছে শরাফত মণ্ডল। হুরমতুল্লা সেখানে নিয়োজিত আউশ বোনার আয়োজনে। নতুন চষা জমিতে মই দিচ্ছিলো হুরমতুল্লা। সাত সকালে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ফুলজান বাপের। মইয়ের পেছনে পেছনে ঘুরছে। বৈকুণ্ঠ একটু দাঁড়ায়, ক্যা গো, লতুন জমিত তো চাষ ভালোই দিলা। তারপর গলা নামিয়ে বলে, তোমার জামাই আছে না? হাটের মধ্যে গান তো ভালোই বান্দিচ্ছে। আছে নাকি? ঘরত আছে?
হুরমতুল্লা জবাব দেয় না। সেটা কি কথা বলতে গেলেই কাশির দমক ওঠে বলে?–কি শ্বশুরবাড়িতে জামাই একেবারেই আসে না বলে সে শরম পায়? কেরামত আলির নতুন গান মোসলমানের রাতের আঁধার হইলো অবসান গানটা গুনগুন করতে করতে বৈকুণ্ঠ বিলের ধার দিয়ে হাঁটতে থাকে।
তমিজের বাপকে সে দেখতে পায় মণ্ডলবাড়ি থেকে ফেরার সময়। কালাম মাঝির বাড়ির সামনের উঠানে সে বসেছিলো। কালাম তাকে বোঝাচ্ছে, আরে, ইসমাইল সাহেব জবান যখন দিছে, তমিজকে খালাস করার বন্দোবস্ত তো একটা হবিই। তা। উকিলের পয়পাতি তো কিছু লাগে। আমি দুই হোত পয়সা ঢালিচ্ছি, তোমার কাছে কিছু চাইছি, কও?।
তমিজের বাপ মাথা নেড়ে না বললে কালাম মাঝি ফের বলে, তুমি কিছু না দিলে হামি আর কতো টানি, কও?
হামার আছে কী? বাড়ির পালানে ভিটাও তো মণ্ডলকে দিলাম আকালের বছর।
মণ্ডলকে তোমরা মনিব মানছো? ঘরটাও কি তাকই বেচবা?
ঘরের কথা তমিজের বাপ কখনো ভাবে না। ঘর বেচলে সে থাকবে কোথায়? কালাম মাঝি বোঝায়, ঘর তোমারই থাকবি। তোমার ঘর গেলে তোমার বৌবেটার। থাকার ব্যবস্থা তো করা লাগবি হামাকই, লয়? এ সম্বন্ধে তমিজের বাপ তার সঙ্গে একমত হলে সে বলে, আর তো কিছু লয়। হামি ট্যাকা দিয়াই যাচ্ছি, বেটা তো তোমার, তোমার দায়িত আছে না? হামার বেটা লায়েক, চাকরিবাকরি করে, হামাক লেখে, মাঝিপাড়ার ব্যামাক মানুষের জিম্মাদারি কি তুমি একলা লিছো? তাই তোমাক যা কলাম, চিন্তা ভাবনা করা দেখো।
কালাম মাঝি বাইরে বেরিয়ে গেলে বৈকুণ্ঠ হাঁটে তমিজের বাপের পাশে পাশে। কয়েক পা হেঁটেই বলে, তমিজের বাপ, কামটা তুমি ভালো করো নাই গো! তমিজের বাপ তার দিকে তাকালে সে গলা নামিয়ে বলে, ভবানীর দয়ের মাছ ধরা যে পাপ
করিছো তার দণ্ড দেওয়া লাগিচ্ছে হামাগোরে সোগলির।
তমিজের বাপের ঘোলা চোখ আরেকটু ঘোলাটে হয়, পাপ? গুনার কথা কচ্ছিস? মাছ ধরলে গুনা হবি কিসক?।
ঠাকুরের ভোগের মাছ লিয়া আসিছে পূজার দিন। লয়? ঠাকুরেক তাই এটি বুঝি আর রাখা যাচ্ছে না। লায়েববাবু কছে, সন্ন্যাসীর থানেত উগলান সাত জাতের পূজা বাদ দিবি। ইগলান কী, কও? গুনার ফল লয়?
পানির মাছ, পানিতই দিয়া আসিছি। দোষ ধরে ক্যাংকা করা?
এবার ভাবনায় পড়ে বৈকুণ্ঠ। তাই তো সকালবেলা বাঘাড়টা তো তমিজের বাপ ফেলে এসেছে কালাহার বিলে। উত্তরদিকে যাত্রা করে বাঙালির রোগা স্রোত ধরে বাঘাড় নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে ঠাকুরের দয়ে। তা হলে আর দোষ হলো কী?
উত্তরে তাকিয়ে তমিজের বাপ যেন কী দেখতে দেখতে বলে, মুনসি পাকুড়গাছ থ্যাকা ন্যামা আসিছিলো, তার সাটাসাটি শূন্যা হামি মাছ তো পানিত দিয়া দিলাম। হামার দোষ হলো কোটে?