অধ্যায় ৩২. বন্ধুরা
কোনো একটি মানবমনের মধ্যে যখন ঈশ্বরের কণ্ঠ কথা বলে ওঠে, তখন তার পরিণতি যে অবশ্যই হলিউডের মহাকাব্যিক সিনেমা মাত্রার কোনো ঘটনা হতে হবে–যেমন, মিশর থেকে ইজরায়েলাইটদের অভিনিষ্ক্রমণ অথবা মক্কা থেকে মুহাম্মদের হিজরত অথবা ভিটেনবার্গে মার্টিন লুথারের ইনডালজেন্স বিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–এমন কিছু ভাবলে ভুল হবে। মাঝে মাঝে এই কণ্ঠস্বর এতই ব্যক্তিগত কোনোকিছু করতে নির্দেশ দিতে পারে যে, আসলেই বিস্ময়কর যে, সেটি কেউ স্মরণ করতে পারেন। কিন্তু তারপরও এটি ইতিহাস বদলে দিতে পারে।
ধর্মের ইতিহাসে আকর্ষণীয় চরিত্রগুলোর একজন, জর্জ ফক্সের সাথে এমনই কিছু ঘটেছিল। সেই সময়টি ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ড, যখন চার্চ এবং সমাজের ক্ষমতাবানরা কোনো কারণ ছাড়াই অহংকারে অন্ধ হয়ে বাকি সবার চেয়ে নিজেদের বেশি শ্রেষ্ঠ ভেবে অতিরঞ্জিত নানা আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন ধরনের পদবি আর তার সাথে আসা বিশেষ ধরনের পোশাক তারা ভালোবাসতেন। তাদের দাবি ছিল অধস্তনরা তাদের সামনে নতজানু হবে এবং মাথার টুপি সরিয়ে তাদের প্রতি সম্মান দেখাবে। যে পদবিগুলো তারা নিজেদের দিয়েছিলেন সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তারা যে সাধারণ জনসাধারণের চেয়ে কত উপরে অবস্থান করছেন, সেই তথ্যটি যেন সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে। ‘ইয়োর হলিনেস’, ‘ইয়োর এক্সেলেন্সি’, ‘ইয়োর গ্রেস’ ইত্যাদি। ইয়োর ম্যাজেস্টি’ ছিল একধরনের সম্বোধন, যা তাদের সবার উপর এমন একটি অবস্থানে তুলেছিল যে, সাধারণ মানুষরা তাদের পায়ের নিচে পিঁপড়ার মতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেড়াতে বাধ্য হতেন। খ্রিস্টানদের মধ্যে এই ধরনের আচরণ একই সাথে বিস্ময়কর, আবার বিস্ময়কর ছিল না। এটি বিস্ময়কর ছিল কারণ, সুস্পষ্টভাবে যিশুর শিক্ষার সাথে এটি সংগতিপূর্ণ ছিল না, যিনি তাদের বলেছিলেন, তার শিষ্যদের মধ্যে আত্মম্ভরিতার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু এটি বিস্ময়কর ছিল না কারণ, এটাই ছিল পার্থিব উপায় এবং যতই নিজেকে পবিত্র আলখেল্লায় ঢেকে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, ধর্ম সাধারণত পার্থিব পথই বেছে নেয়।
পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতাব্দীতে প্রথম যে রিফরমেশন’ আন্দোলনটি ইউরোপকে আঘাত করেছিল, মনে হয়েছিল যেন এটি হয়তো এইসব আত্মাভিমানকে চ্যালেঞ্জ করবে। এবং খানিকটা মাত্রা অবধি এটি তা করেছিল। কিন্তু যে চার্চগুলো রোমের কর্তৃত্ববাদিতা প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেগুলোই আবার খুব দ্রুত এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে অন্য ভিন্ন উপায় খুঁজে নিয়েছিল। কিছু গোষ্ঠী ছিল যারা ঠিক এই কারণেই ‘পিউরিটান’ (বা শুদ্ধিবাদী) খেতাব অর্জন করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, শুধুমাত্র তারাই সত্যিকারের খ্রিস্টান, বিশুদ্ধতম খ্রিস্টান। মানব অহংকারের দ্বারা সৃষ্ট সবধরনের শ্রেষ্ঠতার রূপের মধ্যে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠতা হচ্ছে। সবচেয়ে অসহনীয়।
আধ্যাত্মিক আর সামাজিক শ্ৰেষ্ঠতা, এইসব দাবিগুলো জর্জ ফক্সকে মুগ্ধ করতে পারেনি। ঈশ্বরের কণ্ঠস্বরটি তাকে বলেছিল, উঁচু কিংবা নীচু কাউকে সম্মান দেখানোর জন্যে তার মাথার টুপি খোলা বা বিশেষ কোনো ধরনের সমোধন ব্যবহার করার কোনো দরকার নেই। তিনি ধনী কিংবা গরিব, উচ্চ কিংবা নিম্নশ্রেণীর সদস্য, সবাইকে অনানুষ্ঠানিক (Thou, Thee) তুমি বলেই সম্বোধন করতেন। আর সমাজের সেই বিশেষ শ্রেণির শ্রেষ্ঠতাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি মাথা নত করে সম্মান দেখাতেন না বলে তারা তাকে নিয়মিত কারাগারে বন্দি করে রাখতেন, যাদের উচ্চতর পদমর্যাদা সংশ্লিষ্ট শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দিতে তার এই অস্বীকার এই মানুষগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছিলেন। একটি ঘটনায় এধরনের ধষ্টতা দেখানোর অভিযোগে তাকে যখন আদালতে হাজির করা হয়েছিল, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, একমাত্র কর্তৃপক্ষ, যার সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে কাঁপবেন, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর। এই কথা শুনে বিচারক শ্লেষাত্মকভাবে তাকে একজন ‘কোয়েকার’ (যিনি কাপেন) নামে সম্বোধন করে মামলা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ফক্সের অনুসারীরা নিজেদের নাম দিয়েছিলেন ‘সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস’, কিন্তু বিচারকের সেই তিরস্কার তাদের পরিচয়ের সাথে আটকে গিয়েছিল, এবং ‘কোয়েকার’ নামেই তারা পরিচিত হয়েছিলেন। আর সেই নামটি তারা এখনো ব্যবহার করেন।
১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের লিস্টারশায়ারে জর্জ ফক্স জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন তাঁতি, আর তিনি নিজে একজন মুচির শিক্ষানবীশ ছিলেন। আগের বহু নবীদের মতোই তারুণ্যে তিনি আত্মঅনুসন্ধান এবং বোধিলাভের জন্যে গৃহত্যাগ করেছিলেন। সেই সময়টি ধর্মীয় গোলযোগের সময় ছিল। নানা ধরনের ধর্ম-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে আধ্যাত্মিকতার বাজার ছিল কোলাহলপূর্ণ, যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব ধরনের ধর্মবিশ্বাসের স্বতন্ত্রতা দাবি করেছিলেন। এবং যদিও সবাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ ছিলেন আর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি বিষয় ছিল সাধারণ। প্রত্যেকেই দাবি করেছিলেন, খ্রিস্টীয় ধর্মের তাদের সংস্করণটি হচ্ছে ঈশ্বরের কাছে যাবার একমাত্র নিশ্চিত উপায়। আর এমন দাবির একটি নিহিত্যার্থ ছিল, ঈশ্বরকে খুঁজতে আপনার একজন দালাল লাগবে, অনেকটা ঈশ্বরের রাজসভায় থাকা কোনো বন্ধুর মতো, যিনি আপনাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
যখন তার বয়স চব্বিশ, একটি দৈববার্তা তার মনে উন্মোচিত হয়েছিল, যা তাকে দেখিয়েছিল, তিনি এমন কাউকে খুঁজে তার সময় নষ্ট করছেন, যে-কিনা। তাকে ঈশ্বরের উপস্থিতিতে পৌঁছানোর সেই দরজাটি পার করে দেবেন। তিনি তার নিজের বাইরে এমন কিছুর অনুসন্ধান করছিলেন, যখন কিনা এর উত্তরটি তার নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের চেয়েও নিকটবর্তী ছিল। কোনো মধ্যস্থতাকারীরই সাহায্য নেবার প্রয়োজন নেই, যারা কিনা ঈশ্বরের আনুষ্ঠানিক দারোয়ান হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঈশ্বরের উপস্থিতিতে নিজেকে আবিষ্কার করতে তার যেমন প্রাচীন কোনো যাজকের নির্দেশনার দরকার নেই, তেমনি নতুন কোনো যাজকের সহায়তার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের ঘরের দরজা সবসময়ই উন্মুক্ত। তাকে শুধু সেই দরজা দিয়ে হেঁটে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে।
কোনো চার্চ বা যেভাবে ফক্স চার্চকে বর্ণনা করতেন, স্টিপলহাউসের (বা চূড়াসহ দালান) প্রয়োজন নেই। যাজকদের কালো গাউন বা রঙিন পরিচ্ছদ, ক্যাথলিকদের বিস্তারিত ধর্মীয় আচার অথবা প্রটেস্টান্টদের কঠোর সরলতা ধর্মের এইসব আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো আসলে প্রার্থনাকারীদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে। একইভাবে মানুষের কোনো সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবিশ্বাস বা একটি তালিকারও দরকার নেই, যা তাদের বিশ্বাস করতেই হবে। এছাড়া অবশ্যই তাদের ধর্মীয় পুলিশেরও কোনো প্রয়োজন নেই, যারা সেগুলো সবাইকে অনুসরণ করতে বাধ্য করাবে! তাদের শুধু যা করতে হবে সেটি হচ্ছে, নীরবে পরস্পরের সাথে বসে। থাকতে হবে এবং হৃদয়ে পবিত্র আত্মার কথা বলে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ঈশ্বরের আলো ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে দীপ্যমান।
আর এই প্রস্তাবনাটি যথেষ্ট পরিমাণে বৈপ্লবিক ছিল। যদি এটি ব্যাপকভাবে মানুষের সমর্থন পেত তাহলে এটি সংগঠিত ধর্মগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত। কিন্তু আরো কিছু বিষয় ছিল, যেমন তাদের সেই অদ্ভুত সাহসী প্রস্তাবনা আর দাবিটি : সব মানুষের মর্যাদা সমান, নারী কিংবা পুরুষ, ক্রীতদাস অথবা স্বাধীন! চার্চ কিংবা রাষ্ট্র। ফক্সের এই দাবি মেনে নেবার জন্যে কেউই তখন প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তার কোয়েকার বন্ধুরা নিজেদের মতো করেই তাদের জীবন কাটাতে শুরু করেছিলেন। এর জন্য তাদের চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল। কয়েক হাজার কোয়েকার সদস্যকে তাদের বিশ্বাসের কারণে কারাবন্দি করা হয়েছিল, যাদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছিল কারাগারে।
অপ্রতিরুদ্ধ, তারা অসহায় আর গরিবদের মান উন্নয়নে যুদ্ধ করা অব্যাহত রেখেছিলেন। সেই নিষ্ঠুর যুগে, তারা জেলখানার কয়েদি আর মানসিক রোগীদের সাথে মানবিক আচরণ এবং হাসপাতালে উত্তম ব্যবস্থা করতে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তাদের সবচয়ে বড় অবদান ছিল, দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তাদের কঠোর বিরোধিতা, যা মানব-ইতিহাসে গভীর একটি প্রভাব ফেলেছিল। আর এটি শুরু হয়েছিল আমেরিকায়।
সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকেই উত্তর-আমেরিকা ইউরোপের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা এবং আরেকটি প্রতিশ্রুত দেশ খুঁজতে থাকা বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্যে একটি নিরাপদ গন্তব্য ছিল। আমেরিকার সেই নতুন বিশ্বে ব্যাপক ইউরোপীয় আগ্রাসন শুরু হয়েছিল এবং সেখানে বসতিস্থাপন করা অভিবাসীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে আগে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে ইংল্যান্ডের কোয়েকাররা ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন উইলিয়াম পেন, ১৬৮২ সালে যিনি একটি উপনিবেশ তৈরি করেছিলেন, যা পরে পেনসিলভেনিয়া নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
কিন্তু ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীরা উত্তর-আমেরিকায় তাদের খ্রিস্টধর্ম ছাড়াও আরো অনেক কিছু সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিততম অশুভ পদ্ধতি, দাসপ্রথাও তারা তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। এটি ছিল একটি প্রাচীন আর বিশ্বজনীন নিষ্ঠুরতা, কিন্তু আমেরিকায় ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়ায় এই পদ্ধতির ব্যবহার একটি বাড়তি প্রণোদনা পেয়েছিল। তাদের দখল করা এই নতুন দেশের অসহনীয় কঠোর জমিতে চাষাবাদ করতে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের প্রচুরপরিমাণে শ্রমিকের দরকার পড়েছিল, যাদের তারা পশুর মতো খাটাতে পারবেন মৃত্যুর কোলে চুলেপড়া অবধি। ক্রীতদাসরাই তাদের এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে ক্রীতদাসও ছিল লভ্য।
যে জাহাজগুলো তথাকথিত ‘মিডল প্যাসেজে’ চলাচল করেছিল, সেগুলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের আখক্ষেত এবং আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কৃষি-খামারে কাজ করার জন্যে বহু মিলিয়ন ক্রীতদাসকে আফ্রিকার পশ্চিম-উপকূল থেকে বহন করে এনেছিল। আর এই মিডল প্যাসেজের সময় পরস্পরের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা, প্রায় বাতাসহীন জাহাজের গহ্বরে বন্দি অবস্থায়, লক্ষ লক্ষ আফ্রিকাবাসী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এছাড়া যদি আবহাওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠত, ক্যাপ্টেনরা তাদের জাহাজের ভার হালকা করতেন এই শিকল বাঁধা ক্রীতদাসদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।
ক্রীতদাসদের ডুবিয়ে হত্যা করা হোক, কিন্তু জাহাজের নিরাপত্তা যেন কোনো ঝুঁকির মুখে না পড়ে। অবশ্যই এটা শেষ পদক্ষেপ ছিল। কারণ এই দাসরা তাদের জন্য মূল্যবান পণ্য ছিল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ কিংবা ক্যারোলাইনা অবধি নিয়ে গেলে তাদের বিনিময়ে অন্য পণ্য যেমন, চিনি কিংবা তুলা বাণিজ্য করা যেত। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ব্রিটিশরা মূলত এই বাণিজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এই বাণিজ্যে স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছিলেন। এবং যখন তারা স্বদেশে ফিরে আসতেন তাদের বিস্মরণপূর্ণ অবসর জীবন কাটাতে, তখন তারা বসবাসের জন্যে সুবিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করতেন, যেখানে তারা তাদের বৃদ্ধজীবন কাটিয়ে দিতেন। এরকম বহু প্রাসাদ ব্রিটিশ গ্রামাঞ্চল এখনো অলংকৃত করে রেখেছে। কিন্তু এই খ্রিস্টানরা কীভাবে এই অমানবিক আর অশুভ বাণিজ্যে তাদের অংশ নেবার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত করেছিলেন?
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, বাইবেলে ক্রীতদাসপ্রথাটি স্বাভাবিক, যেভাবে চলছে সেভাবেই গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। এটাই ছিল সেই সময়ের প্রচলিত নিয়ম। আর এটি অবশ্যই যিশুর বার্তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু আদি খ্রিস্টানদের এই বিষয়ে কিছু না-করার একটি বৈধ অজুহাত ছিল। কারণ তারা আশা করেননি যে, এই পৃথিবী, যেভাবে এটি নিজেকে সংগঠিত করে রেখেছে, খুব বেশিদিন আর টিকে থাকবে না। কারণ যিশু খুব শীঘ্রই ফিরে আসবেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য উদ্বোধন করতে, যখন স্বর্গে যেভাবে সবকিছু হয় তেমনভাবেই সবকিছু পরিচালিত হবে এই পৃথিবীতেও। আর এমন কিছু ঘটার আগ অবধি খ্রিস্টানদের পাপমুক্ত বিশুদ্ধ জীবন কাটানো এবং শেষদিনের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা উচিত। আর পৃথিবী যেমন আছে সেভাবেই তারা বিষয়গুলো অপরিবর্তিত রেখেছিলেন। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে, পল নিজেই ক্রীতদাস অনেসিমাসকে। তার মালিক ফিলেমনের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তিনি তার প্রতি সদয় আচরণ করতে অনুরোধ করেছিলেন, কারণ অনেসিমাস এখন তার মতোই যিশু-বিশ্বাসী একজন অনুসারী। কিন্তু সেখানে তাকে মুক্ত করে দেওয়া তার উচিত হবে, এমন কোনো প্রস্তাবনা কখনোই ছিল না। আর সেটি করেই বা কী লাভ হবে, যদি তারা বিশ্বাসই করে থাকেন এই সবকিছুই খুব শীঘ্রই শেষ হতে যাচ্ছে?
১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, খ্রিস্টানদের সম্ভবত মনে হয়েছিল যে, যিশু আর ফিরে আসেননি, এবং দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই তার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। পৃথিবীর শেষদিনে ঈশ্বর এসে সব ঠিক করে দেবেন, এমন আশায় অর্থহীন অপেক্ষায় কালক্ষেপণ না করে, পৃথিবীর সব অশুভ বিষয়গুলোর সমাধান করার নিশ্চয় এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। শুধু এর ব্যতিক্রম ছিল দাসপ্রথার বিষয়টি, কারণ সেখানে কিছু সমস্যা আছে। বাইবেল ঈশ্বরের সেই কণ্ঠস্বর লিপিবদ্ধ করেছিল, যা মোজেসকে বলেছিল এই বিষয়ে :
যখন তুমি একজন হিব্রুদাস ক্রয় করবে, ছয় বছর সে তোমার সেবা করবে, কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই সপ্তম বছরে তাকে মুক্তি দিতে হবে। যদি সে একা তোমার কাছে এসে থাকে, তাহলে সে একাই তোমার কাছ থেকে চলে যাবে। আর যদি সে বিবাহিত হয়, তার স্ত্রীও তার সাথে যাবে। যদি তার মালিক তাকে স্ত্রী দিয়ে থাকে, এবং সে তার জন্যে পুত্র বা কন্যার জন্ম দিয়ে থাকে। তাহলে সেই স্ত্রী আর সন্তানরা তাদের মনিবেরই থাকবে।
আর পল তার লেটার টু চার্চ ইন এফেসুস’ চিঠিতে খ্রিস্টান দাসদের তাদের পার্থিব মনিবের অনুগত হতে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘ঠিক যেমন তারা স্বয়ং যিশুর অনুগত’।
সুতরাং বাইবেলে বিষয়টি খুব সুস্পষ্ট। আর বাইবেলের কথা চ্যালেঞ্জ করার তারা কে? বেশ, ১৬৮৮ সালে পেনসিলভানিয়ার কোয়েকাররা এটি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আর যেভাবে তারা সেটি করেছিলেন, সেটি ভবিষ্যতে খ্রিস্টানরা কীভাবে বাইবেল পড়বে, তার ওপর একটি বৈপ্লবিক প্রভাব ফেলেছিল। কোয়েকাররা অভ্যন্তরীণ আলোর কর্তৃত্বে বিশ্বাস করতেন, যাকে আমরা বলতে পারি বিবেক। তারা জানতেন এই আলোই তাদের নির্দেশনা দিচ্ছে, দাসপ্রথা পুরোপুরিভাবেই অন্যায়। যদি সব মানুষের সমান মূল্য থাকে, তাহলে কাউকে অপেক্ষাকৃত কম মানুষ বা ঈশ্বরের সন্তান নয় বরং সম্পত্তি বা পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা অবশ্যই ভুল। আর যদি বাইবেল অন্য কথা বলে থাকে তাহলে বাইবেলই ভুল।
বাইবেলে দাসপ্রথা যুক্তিযুক্ত করার বিষয়টির প্রতিবাদ করা ছাড়াও কোয়েকাররা আরো অনেককিছুই করেছিলেন। দাসপ্রথাকে বিলোপ করার প্রচেষ্টায় তাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল ততটুকই তারা করেছিলেন। তারা এটি পেনসিলভানিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, এছাড়া একটি গোপন পথ বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড’ সংগঠিত করেছিলেন, যা দক্ষিণ থেকে পালিয়ে আসা ক্রীতদাসদের উত্তর বা কানাডায় স্বাধীনভাবে বাস করার সুযোগ খুঁজতে সহায়তা করেছিল। তথাকথিত খ্রিস্টীয় সমাজে দাসপ্রথার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোয়েকারদের তীব্র বিরোধিতা এবং প্রতিবাদে তাল মেলাতে বাকি পৃথিবীর অনেক দিন সময় লেগেছিল। পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এবং ত্রিশ বছর পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর, এটি আমেরিকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।
কিন্তু এই জঘন্য দাসপ্রথার বিলোপ সূচনা করা ছাড়াও কোয়েকাররা আরো অনেক কিছু করেছিলেন। তারা অগভীর আর শিশুসুলভ উপায়ে বাইবেল পাঠ করার পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছিলেন। বাইবেলের শিক্ষার বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের বিবেকের সিদ্ধান্তের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার মাধ্যমে তারা অস্পৃশ্য কোনো স্বর্গীয়। প্রতিমা নয় বরং অন্য যে-কোনো একটি বইয়ের মতো বাইবেল পাঠ করার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। কোনটি সঠিক’ আর বাইবেল কোনটিকে বলছে ‘সঠিক’–এই দুটির মধ্যে পার্থক্য কী তারা জানতেন। আর যেহেতু তারা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর নিজেই তাদের এই পার্থক্য সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন, এটি প্রমাণ করে যে, এমনকি বাইবেলের বিষয়ে ঈশ্বরেরও কিছু আপত্তি আছে! আর যদি বাইবেলে দাসপ্রথার ব্যাপারে ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কি এটি ছয়দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করার ব্যাপারে ভুল হতে পারে না? হয়তো বহু শতাব্দী ধরে আমরা এই বইটিকে ভুলভাবে পড়ছি। হয়তো নতুন করে এটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। আরো আরো বুদ্ধিমত্তার সাথে এটি আমাদের পড়তে হবে। হয়তো বাইবেলের কিছু নির্দেশনা আর বিচারিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নিজেদের বিবেকের নির্দেশনাগুলো আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়।
আর এইসব নানা উপায়ে কোয়েকাররা সেই ধাক্কাটি দিয়েছিলেন, যাকে আমরা বলি ধর্মশাস্ত্রের ‘ঐতিহাসিক-সমালোচনামূলক পাঠ। আবশ্যিকভাবে এটি বাইবেলের ওপর থেকে ঈশ্বরের প্রভাবটিকে বাতিল করছে না, কিন্তু এটি স্বর্গীয়। থেকে মানবিক উপাদানগুলোকে পৃথক করতে চেষ্টা করেছে। দাসপ্রথা একটি মানবিক আবিষ্কার। আপনার প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসুন, এটি স্বর্গীয় নির্দেশ! বেশ, তাহলে বিষয়টি ভেবে দেখুন, এই নির্দেশনার আলোকে কোন্টি সত্য হবে?
‘দ্য সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস’ হয়তো পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর একটি হতে পারে, কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল অনেক বিশাল। এটি এখনো খ্রিস্টধর্মের বিবেক হিসাবে তার নিজের অবস্থানটি ধরে রেখেছে। এটি আমেরিকায় খ্রিস্টধর্মের নতুন আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আহ্বানকারী একটি সংস্করণ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম সেখানে পৌঁছাবার আগেই আমেরিকায় নিজস্ব একটি আধ্যাত্মিকতা ছিল। সেটি পরীক্ষা করে দেখার এবার সময় এসেছে।