আতাহার কাল রাত থেকে পথে পথে ঘুরছে। নিজের ঘরে ফেরে নি। ফরহাদকে প্লেনে তুলে দিয়ে তার মনটা এত খারাপ হল যে ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করল না। মনে প্ৰচণ্ড কষ্ট নিয়ে কেউ ঘরে ফিরে না। সন্ধ্যাবেলা সব পাখি ঘরে ফিরে। কারণ পাখিদের মনে কষ্ট নেই। মানুষের মনে নানান ধরনের কষ্ট। তাই বুঝি সব মানুষ ঘরে ফেরে না।
ফরহাদ এয়ারপোর্টে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। তার গায়ে কমপ্লিট স্যুট। গলায় লালের উপর কাল ফুলের টাই। পায়ে চকচকে নতুন জুতা। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
ফরহাদ বলল, একা একা আমেরিকা যেতে ভয় লাগছে।
ভয়ের কি আছেরে গাধা। নিউ ইয়র্কে নামবি। আপা এয়ারপোর্ট থেকে তোকে নিয়ে যাবে।
যদি না আসে?
আসবে না কেন? আসবেতো বটেই, না এলে এয়ারপোর্টে নেমে টেলিফোন করে দিবি।
ভাইয়া, তুমি আমেরিকা যাবে না?
যাব, তুষারপাত দেখার জন্যে বেড়াতে যাব। দেশ ছেড়ে যাব না। আমি হচ্ছি এই দেশের একজন কবি। কবিরা দেশের আত্মা! দেশ ছেড়ে আত্মা যাবে কি ভাবে? আমি কি করে যাই।
তুমি সারা জীবন পথে পথে ঘুরবে? এর বাড়িতে খাবে, ওর বাড়িতে ঘুমাবে।
তা না। কিছু দিনের মধ্য একটা চাকরি জোগার করব। তারপর যথা সময়ে বিয়ে টিয়ে করে গৃহপালিত হয়ে যাব।
তোমাকে চাকরি কে দেবে?
ময়না ভাই। খুব ওস্তাদ লোক–অনেক কানেকশন। তার সঙ্গে মোটামুটি কথাও হয়েছে। উনি চাকরির ব্যবস্থা করলেই শুভ বিবাহ। তোকে কার্ড পাঠিয়ে দেব। চলে আসবি।
কাকে বিয়ে করবে?
এখনো ঠিক করিনি। খুব সম্ভব নীতুকে। সমস্যা একটাই, মেয়েটা আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না।
দু চোখে দেখতে পারে না এমন একটা মেয়েকে তোমার বিয়ে করার দরকার কি?
এখন দেখতে পারে না–তবে আমার ধারণা আমার সঙ্গে ভালমত মিশলে আমাকে সে পছন্দই করবে। মানুষ হিসেবে আমি কি খারাপ?
ভাইয়া, তুমি অসাধারণ।
এরকম কাঁদতে কাঁদতে কথা বলছিস কেন? চোখ মুছে স্বাভাবিকভাবে কথা বল। চোখের পানিতে তোর টাই ভিজে গেছে। টাইয়ের রঙ কাচা হলে রঙ ওঠে যাবে। সবাই তোকে দেখছে। প্লেন লেট আছে। চা খাবি? আয় চা খাই।
চল।
দু ভাই চা খেতে দুকল। আতাহার মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল যে মিলি ঠাকুরগাঁ থেকে আসতে পারে নি। মিলির শাশুড়ি অসুস্থ, মরনাপন্ন। মিলি বিদায়ের সময় উপস্থিত থাকলে এক হাঁটু চোখের পানিতে এয়ারপোর্ট ড়ুবে যেত।
আতাহার বলল, ফরহাদ তুই এরকম অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাঁটছিস কেন?
জুতাগুলি খুব টাইট হয়েছে।
টাইট হলে জুতা ফেলে দে। আমার স্যান্ডেল পরে চলে যা।
সত্যি স্যান্ডেল পরে যাব?
হ্যাঁ যা।
সবাই তাকিয়ে থাকবে। সুট পরেছি, পায়ে স্যান্ডেল।
তাহলে থাক।
রেস্টুরেন্টে ফরহাদ সারাক্ষণই একহাতে তার ভাইয়ের হাত ধরে থাকল। সেই হাত ছাড়ল শুধু ইমিগ্রেশন এরিয়ায় ঢোকার আগে।
আতাহার বলল, দাঁড়িয়ে থাকিস না–ঢুকে যা।
আমার প্লেন না ছাড়া পর্যন্ত ভাইয়া তুমি কিন্তু এয়ারপোর্ট ছেড়ে যাবে না।
না, যাব না। তুই রুমাল দিয়ে চোখটা ভালমত মোছ।
ফরহাদ রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তাতে চোখের পানির কেন উনিশ বিশ হল না। টপ টপ করে চোখের পানি পড়ছেই।
আতাহার বৃটিশ এয়ার ওয়াজের বিমান আকাশে না উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। বিমান আকাশে মিলিয়ে যাবার পর মনে হল–বাসায় ফিরেই বা কি হবে। একটা রাত এয়ারপেট কাটিয়ে দেয়া যায় না? অবশ্যই যায়। এয়ারপোর্টে চায়ের দোকান আছে। সে দোকান নিশ্চয়ই সারারাত খোলা থাকে। দোকানের সামনে কোন একটা চেয়ারে বসে মানুষের মনের একটা জটিল রহস্য নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। রহস্যটা হচ্ছে–ফরহাদ চলে যাওয়ায় তার এত খারাপ লাগছে কেন? তার মা মারা গেছে, বাবা মারা গেছে–কিন্তু সে এতটা কষ্টতো পায়নি। তার ভাই, যার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়–তার জন্যে এতটা খারাপ লাগার মানে কি? এত জটিল কেন মানুষের মন?
এয়ারপোর্টে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। হেঁটে হেঁটে ঢাকার দিকে রওনা হলে কেমন হয়? একসময় না একসময় ঢাকায় নিশ্চয় পৌছে যাবে। আর পৌঁছতে না পারলেও ক্ষতি নেই–মানুষের যাত্রা কখনো শেষ হয় না। সে চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। মৃত্যুর পরেও সে যাত্রা শেষ হয় না–তখন শুরু হয় অন্য এক মাত্রা।
হাঁটতে শুরু করে আতাহারের মনে হল সে আসলে ঢাকায় যেতে চাচ্ছে না। মন টানছে না। অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। সেই অন্য কোথাওটা আসলে কোথায় তা তার জানা নেই।
গণি সাহেব আতাহারকে দেখে আঁৎকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে তোমার?
আতাহার বলল, কিছু হয়নিতো।
তোমাকে লাগছে। মরা মানুষের মত। ইজ এনিথিং রং?
জ্বি না।
আসছ কোত্থেকে?
এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছিতো মনে এজন্যই ক্লান্ত লাগছে।
এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে আসার দরকার কি? অর্থহীন পাগলামী তোমরা কেন করা? ক্রিয়েটিভিটি এবং পাগলামীকে তোমরা সমার্থক করে ফেলেছি। এটা ঠিক না। আতাহার। ক্রিয়েটিভিটি এবং পাগলামী দুটা দুজিনিস। এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে কেন এলে এটা আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি?
আতাহার কিছু বলল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আবার উঠে চলে যেতেও ইচ্ছা করছে না।
আতাহার!
জ্বি।
তোমার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। শীত সংখ্যায় তোমার চারটা কবিতা এক সঙ্গে যাচ্ছে। শীত সংখ্যা বের হলে তোমাকে চমকে দেব বলে আগে খবর দেইনি। এখন তোমার অবস্থা দেখে আগে ভাগেই বললাম। কবিতাগুলি ভাল হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। দু এক জায়গায় ছন্দ ভুল আছে। মাত্রা এদিক ওদিক করলে ঠিক হয়ে যায়–তবে আমি হাত দেইনি।
হাত দেননি কেন?
একদিন যদি খুব বিখ্যাত কেউ হয়ে যাও তখন তোমার কবিতায় হাত দেয়ার জন্যে দেশের লোক আমার উপর রাগ করবে। এই ভয়েই হাত দেইনি।
আতাহারের মন গভীর আনন্দে আচ্ছন্ন হবার কথা। তা হচ্ছে না। বড় ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে এই চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল লাগত। মাথার দু পাশের শিরা দীপ দাপ করছে। জ্বর হবার আগে কি এ রকম হয়? অনেক দিন তার অসুখ বিসুখ হয় না। অসুখের আগের শারীরিক ব্যাপারগুলি সে জানে না।
আতাহার!
জ্বি।
বাসায় চলে যাও। টেক রেস্ট। ইয়াং ম্যান, শরীরের দিকে লক্ষ্য রেখো। রবীন্দ্রনাথ শরীর ঠিক রাখার জন্যে আশি বছর বয়সেও চিরতার পানি খেতেন। হালকা ব্যায়াম করতেন। রিমেম্বাবরি দ্যটি। টাকা লাগবে? নাও, পঞ্চাশটা টাকা রেখে দাও।
আতাহার হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। তার কোন অস্বস্থি বা লজ্জাবোধ হল না। গণি সাহেব বললেন–কোন দিন যদি অতি বিখ্যাত হও তাহলে এই সব খুটি নাটি মনে রাখবে। জীবনী লেখার সময় অবশ্যই আমার কথা লিখবো। লিখবো–প্রথম জীবন বড় অর্থ কষ্টে কেটেছে। সে সময় সুবর্ণ সম্পাদক জনাব আব্দুল গণি আমাকে বিভিন্ন সময়ে অর্থ সাহায্য করেছেন। হা হা হা।
আতাহার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল–আপনি নিজে কি জানেন, মানুষ হিসেবে আপনি প্রথম শ্রেণীর।
গণি সাহেব বললেন, না জানি না। তোমার কাছে প্রথম শুনলাম। মানুষ হিসেবে আমি প্রথম শ্রেণীর না। তোমার কাছে মনে হচ্ছে, কারণ তোমাকে উপরে ওঠার জন্যে আমি সাহায্য করেছি। সিঁড়ি কেটে দিচ্ছি। সিঁড়ি সবার জন্যেই কাটা হয়। সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে না। তোমার বন্ধু মজিদ পারল না। লাফিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই হুমকি খেয়ে পড়ে গেল। সাজ্জাদও পারল না। শুনেছি ও কোন এক চিকিৎসা কেন্দ্ৰে আছে। কথাটা কি সত্যি?
জ্বি।
একদিন আমাকে নিয়ে যেও, ওকে দেখে আসব।
জি, নিয়ে যাব।
ও এখন কেমন আছে?
ভাল না। নানান রকম জটিলতা দেখা দিয়েছে।
গণি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্ববাস ফেললেন।
আতাহার রাস্তায় নামল। হাঁটিতে গিয়ে লক্ষ্য করল সে ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। বাইরের রোদ তীব্ৰ মনে হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। পানির পিপাসাও হচ্ছে। সে আবদুল্লাহ সাহেবের লৌহ বিতানে ঢুকাল ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানির জন্যে। পানি খুব ঠাণ্ডা হতে হবে। খুব ঠাণ্ডা।
আবদুল্লাহ দরাজ গলায় বললেন, এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল। আসুন আসুন। আপনাকে এমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে কেন?
আতাহার বলল, বুঝতে পারছি না কেন?
আবদুল্লাহ ঝুঁকে এসে বললেন, আমার গল্পটা কি আজ শুনবেন? আজ আপনাকে শুনাতে পারি।
আতাহার প্রায় বলেই ফেলছিল–কিসের গলাপ? শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলালো। মনে পড়ল আবদুল্লাহ তার প্রেমের গল্প শুনাতে চেয়েছিলেন। আতাহার প্রেমের গল্প শোনার জন্যে কোন আগ্রহ অনুভব করছে না। বাঙালীর সব প্রেমের গলপাই জলো ধরনের হয়। চিঠি লেখালেখি, হাত ধরাধরি, তারপর এক সময় বাবা-মা জাতীর কারো হাতে ধরা পড়ে যাওয়া। গৃহত্যাগ এবং আবারো গৃহে প্রত্যাবর্তন। শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে মধুর মিলন। বিশ ভাগ–টাজেডি। নায়কনায়িকা কিছুদিন বিরহ ব্যথায় কাতর–তারপর আবার স্ব অবস্থানে প্রত্যাবর্তন। আবার নতুন কারো সঙ্গে চিঠি চালাচালি।
লৌহ বিতানের মালিক এই সাধারণ ফর্মুলার বাইরে যাবেন এটা মনে করার কোন কারণ নেই।
আবদুল্লাহ বললেন, আমি ধরে নিয়েছিলাম। আপনি ভুলে গিয়েছেন।
ভুলি নি।
আজ তাহলে প্রেমের গল্পটা শুনবেন?
জ্বি। আজ রজনীতে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা। ভাই, গল্প শুরু করার আগে খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাব। গ্লাস যত বড় হয় তত ভাল। আমার টেন্টেলাসের মত জল তৃষ্ণা পেয়েছে।
আপনার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না শরীর খারাপ না।
আমার তো মনে হচ্ছে–আপনার গায়ে জ্বর। বেশ ভাল জ্বর। মুখ লাল হয়ে আছে। দেখি, মাথাটা এগিয়ে আনুনতো, জ্বর দেখি।
আতাহার তার মাথা এগিয়ে দিল। আবদুল্লাহ সাহেব জ্বর দেখলেন। তার মুখে কোন ভাবান্তর হল না। তিনি তার জরাগ্রস্ত বুড়ে কর্মচারীকে বিছানা করতে বললেন। আরো কি সব বললেন আতাহারের মাথায় কিছুই ঢুকল না। সব কিছুই তার কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যে তীব্র পানির তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল সেই তৃষ্ণা নেই। শরীর কেমন যেন হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে কোন পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে সে মাটিতে পড়বে না। আকাশে উড়তে থাকবে।
আতাহার সাহেব!
জ্বি।
শুয়ে পড়ুন।
শুয়ে পড়বা কেন? আপনার গল্প শুনব না?
আপনার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। জ্বর এত বেশি যে থার্মোমিটার দিয়ে দেখতেও ভয় লাগছে। যান, শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি।
গল্প শুনব না?
শুনবেন। শুনবেন, গল্প অবশ্যই শুনবেন। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। আপনাকে না শুনালে কাকে শুনাব? গল্পের একটা অংশ বলব আমি আরেকটা অংশ বলবে আমার স্ত্রী। আমি আপনাকে আমার স্ত্রীর নাম বলেছিলাম, আপনার কি মনে আছে?
জ্বি না।
আপনার জ্বর খুব বেশি। জ্বর কমলে অবশ্যই মনে পড়বে। যান, শুয়ে পড়ুন। আমি হাত ধরে আপনাকে শুইয়ে দিতে পারলে ভাল হত। সেটা সম্ভব না। আমি বরং আমার স্ত্রীকে ডাকি। আমি কি আপনাকে বলেছি আমার স্ত্রীর ধারণা আপনি একজন অভিনেতা?
জ্বি না।
আমি বলেছি–আপনার মনে নেই। যাই হোক, জ্বরটা কমলেই মনে পড়বে। আমার ধারণা ডাক্তার আপনাকে চৌবাচ্চায় ড়ুবিয়ে রাখতে বলবে।
আতাহার তাকিয়ে আছে। আবদুল্লাহর চোখ মুখ কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। পানির তৃষ্ণা ফিরে এসেছে–কিন্তু আবদুল্লাহ নামের লোকটা তাকে পানি দিচ্ছে না। সেও গণি সাহেবের মত নানান কথা বলছে। অধিকাংশই অর্থহীন কথা। আতাহার ঘোরের ভেতর তলিয়ে গেল।
অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ে আতাহারের মুখের উপর ঝুঁকে আছে। মেয়েটি সম্পূর্ণ অচেনা। কিন্তু সে খুব চেনা চোখে আতাহারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে চাপা হাসি। মেয়েটির মাথা ভর্তি চুল। শাড়ির রঙ কমলা। কমলা রঙের শাড়ির ফাঁক দিয়ে কাল চুল বের হয়ে এসেছে। বাহ, রঙের কি সুন্দর কম্পিবনেশন।
আতাহার বলল, কে?
আমি নীতু।
আতাহার হতাশ গলায় বলল, ও আচ্ছা, নীতু।
সে জানে তার শরীর খুবই খারাপ। তার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। তাই বলে সে নীতুকে চিনবে না? তার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে?
রূপবতী মহিলাটি বলল, আপনাকে আমরা একটা খুব ভাল ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আমি কোন চিন্তা করছি না।
আপনার জ্বর কত জানেন? একশ পাঁচ।
আতাহার মনে করার চেষ্টা করল থার্মোমিটারে কত দাগ পর্যন্ত থাকে। একশ দশ? মনে পড়ছে না।
আমরা চিন্তা করছি। আমরা ভয়ংকর চিন্তায় পড়ে গেছি!
চিন্তা করবেন না।
আপনার আত্মীয় স্বজনের ঠিকানা দিন। তাদের খবর দেই।
তাদের খবর দেয়ার দরকার নেই।
অবশ্যই দরকার আছে। আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার শরীর কতটা খারাপ। নীতুর টেলিফোন নাম্বার দিন। উনাকে আসতে বলি।
আতাহারের মাথা আবারো এলোমেলো হয়ে গেলো। এই মেয়েটি বলছে সে নীতু আবার সে নীতুর টেলিফোন নাম্বার চাচ্ছে। জ্বর একশ পাঁচ হলে কি সব কিছু এমন হয়? কথাবার্তা অর্থহীন লাগে?
আতাহার সাহেব!
জ্বি।
নীতুর টেলিফোন নাম্বার কি আপনার মনে আছে?
জ্বি।
নাম্বারটা বলুন।
আতাহার অনেক চেষ্টা করেও নাম্বারটা মনে করতে পারল না। তার যা মনে পড়ল তা হচ্ছে সে একটা লিফটে করে উঠছে। সেই লিফটে একটা মেয়ে উঠেছে। মেয়েটার নাম বেহুলা। লিফটাটা হচ্ছে বেহুলার লোহার বাসর। আতাহার বিড় বিড় করে বলল,–
কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা।
লোহার তৈরি ছোট্ট একটা ঘর।
ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে …
তরুণী বললেন, কি বলছেন আপনি?
আতাহার ক্লান্ত গলায় বলল, কিছু বলছি না।
নীতুর ঠিকানাটা কি বলবেন? ওদের বাসাটা কোথায়?
আতাহার বাসার ঠিকানা জানে না। রোড নাম্বার কত, বাড়ির নাম্বার কত কিছুই না। শুধু বাড়িটা চেনে।
আচ্ছা, আপনি শুয়ে থাকুন। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আমি চিন্তা করছি নাতো।
আতাহার চিন্তা করছে না। তার খানিকটা হাসি পাচ্ছে। হাসি পাবার কারণটাও অদ্ভূত। সে চোখের সামনে একজনকে দেখছে যে উঠবোস করছে। ডন বৈঠক দিচ্ছে। দাড়িওয়ালা একজন লোক–রবীন্দ্রনাথ না-কি? রবীন্দ্রনাথ ডন-বৈঠক দেবেন। কেন? গণি সাহেব বলছিলেন আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ একসারসাইজ করতেন। সেই কারণেই কি সে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে?
আতাহার হঠাৎ লক্ষ্য করল তার নিঃশ্ববাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বেশ কষ্ট হচ্ছে। সে মারা যাচ্ছে নাতো?
অপূর্ব রূপবতী এক রমনী ঝুঁকে আছে তার দিকে। রমনীর মুখ একই সঙ্গে চেনা এবং অচেনা। কোথায় যেন তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। জায়গাটা মনে পড়ছে না। হাসপাতালে নাতো? আচ্ছা, এই তরুণীর নাম কি হোসনা?
রমনী বলল, এ্যস্কুলেন্স আনতে গেছে। এ্যবুলেন্স এলেই আপনাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাব। আপনি চিন্তা করবেন না।
আতাহার ক্লান্ত গলায় বলল, চিন্তা করছি না।
আপনি তাকিয়ে থাকবেন না। চোখ বন্ধ করুন। আমি আপনার মাথায় হাত वृलिदृश निश्छि।
আপনি কে?
আমি আপনার বন্ধু আবদুল্লাহ সাহেবের স্ত্রী।
ও।
আপনার নাম কি হোসনা?
জি-না। আমার নাম নীতু।
আতাহার চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করা মাত্র সে চলে গেলো প্রবল ঘোরের এক জগতে।
সেই রহস্যময় জগতে তার মাথায় একটা কবিতা তৈরি হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার সে কবিতা তৈরির ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে। পরিশ্বকার দেখতে পাচ্ছে এইতো প্রথম শব্দটা চলে এসেছে, হালকাভাবে ভাসছে। নাচের ভঙ্গিতে শব্দটা ঘুরছে–কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। শব্দটা। শব্দটার গায়ে নানান বর্ণের পোষাক। শব্দটা ঘুরছে আর তার পোষাকের রঙ পাল্টে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার।
আতাহার আবার চোখ মেলল। রূপবতী মেয়েটা এখনো তার উপর ঝুঁকে আছে। ঘরে আরো লোকজন আছে। দিন না। রাত্রি তা বোঝা যাচ্ছে না। ঘরে বাতি জ্বলছে। এই বাড়িতে সে দিনে ঢুকেছিল–এখন রাত্রি। তার মানে কি? রূপবতী মেয়েটির নাম কি? লীলাবতী? তাকেতো লীলাবতীর মতই লাগছে। না ইনি লীলাবতী না। ইনার নাম নীতু। ইনি আবদুল্লাহ সাহেবের স্ত্রী। এদের দুজনের খুব সুন্দর একটা প্রেমের গল্প আছে। গল্পটা তার শোনার কথা। শোনা হয় নি। খুব রূপবতীদের প্রেমের গল্পগুলি ভয়ংকর টাইপের হয়। ইনারটা কি ভয়ংকর?
মেয়েটি বলল, আপনার শরীর কি এখন একটু ভাল লাগছে?
না। ভাল লাছে না। খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে। আমি মারা যাব।
মেয়েটি গভীর মমতায় আতাহারের মাথায় হাত রাখল। মেয়েটির হাত খুব ঠাণ্ডা। বেশ ঠাণ্ডা। কপালটা কেমন যেন করছে। তাকে একটা কথা বলা দরকার। আতাহার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, যদি মরে যাই তাহলে আপনি কি একটা কাজ করতে পারবেন?
বলুন কি কাজ?
নীতুকে একটা কথা বলবেন। ওকে বলবেন আমি যে দিনের পর দিন সাজ্জাদের পেছনে ঘুরতাম, ওদের বাড়িতে যেতাম, সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাশতা খাবার জন্যে চলে যেতাম, সেটা শুধুমাত্র ওকে দেখার জন্যে। অন্য কিছু না।
মেয়েটি হাসল। বাহ, মেয়েটার হাসিটাতো সুন্দর। আতাহার বলল, আমি যদি বেঁচে যাই তাহলে ওকে কিছু বলার দরকার নেই। আপনার কি মনে থাকবে?
থাকবে। আপনি নীতুর টেলিফোন নাম্বারটা মনে করার চেষ্টা করুন।
আতাহার টেলিফোন নাম্বার মনে করার চেষ্টা করছে। মনে পড়ছে না। কবিতার একটা লাইন উঠে আসছে–আহ কি অপূর্ব পংক্তিমালা।
One of the best.
Akjon Lekhok jokhon tar lekha diye pathok er onuvoti ke Nara dite pare setai Lekhok er sarthokota jeta Humayun Ahmed korte parecilen