১. আমার বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সুবাদে ছোটবেলায় আমি তিন চারটে স্কুলে পড়েছি। প্রতিটি স্কুলেই স্কার্ফ থেকে শুরু করে পায়ের কেডস পর্যন্ত ছিল টিপটপ। এক রঙ জামার উপর ভাঁজ করা সাদা ওড়না। বেশ স্মার্ট লাগত নিজেকে।
স্কুল কলেজ পার করে খুব বেশি বড় হয়ে যাওয়া আমি, যখন রাস্তায় দেখি ঝাঁক ঝাঁক মেয়েরা আমার বালিকা-বেলার মত স্কুলে যায় আসে–দেখে আমার মন নেচে ওঠে। ধারণা করি টিফিন পিরিয়ডে ওরা নিশ্চয় দৌড়ে যাবে মাঠে; আমাদের সময় টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই মাঠের দাড়িয়াবাধা কোট দখল করত একদল, একদল বৌচি খেলার মাঠ, একদল পুকুর পাড়, একদল গাছের ডাল।
কিন্তু প্রায়শ আমি বিস্মিত হচ্ছি, বিস্মিত হচ্ছি এই লক্ষ্য করে যে, কোনও কোনও স্কুলের মেয়েরা স্কুল-পোশাকের ওপরও একটি বড় ওড়না বা কাপড় ব্যবহার করে। শরীরের উর্ধাংশ তারা ওই বাড়তি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। অশিক্ষিত এবং অল্প শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহিলারা ইদানীং এইসব চাদর ব্যবহার করছেন–কিন্তু স্কুলের কিশোরীর গায়ে এই বাড়তি জিনিস চাপানোর উদ্দেশ্য কি এবং উপদ্রবটি কেন ? আমার প্রশ্ন শুনে একজন বুদ্ধিজীবী উত্তর দিলেন–ইসলামিক দেশ তো তাই এই ব্যবস্থা।
সেদিন ঢাকা সিটি কলেজের মেয়েদের দেখি জামাকাপড়ের ওপর গোলাপি অ্যাপ্রোন চাপানো। কেন ? তারা কি সকলে বিজ্ঞানের ছাত্রী, ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা ? জানতে পারলাম সে কারণে নয়, রাষ্ট্রধর্মের কারণে মেয়েরা পর্দার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
একজন মানুষ, সে যদি মানুষ হয় তবে সে কি বস্ত্র পরবে বা না পরবে, তা সে-ই নির্ধারণ করবে। এতকাল যে পোশাকে মেয়েরা স্কুলে গেছে, তা কিছু অশালীন পোশাক ছিল না। এখন কেন ওপরে একটি চাদর চাপানো! লাহোরের রাস্তায় এই সেদিন পাকিস্তানের মেয়েরা তাদের বাড়তি কাপড় আগুনে পুড়িয়েছে।
অশিক্ষিত মেয়েরা কাপড়ের ওপর কাপড় চাপিয়ে নিজের জড়বুদ্ধি, স্থলদর্শিতা ও অনুর্বর মস্তিষ্ক ঢেকে রাখে। ধর্ম তাকে কুৎসিত বানিয়েছে, তাই ধর্ম তাকে ঢেকেছে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল না, এই অধিকার তারা অর্জন করেছে—এই অর্জিত অধিকার নিয়ে তারা বইখাতা হাতে দল বেঁধে লেখাপড়া করতে যায়, তারা আলোর পথে বেরিয়েছে—যেহেতু এখন আলো থেকে ফিরে যাবার উপায় নেই, তারা তাদের অন্ধকার করবার জন্য চাদর টানানো হচ্ছে।
মানুষ এগোলে, সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেই যারা তাকে পেছনে টানে। ধর্মীয় চাদর বা অ্যাপ্রোন দিয়ে তারা অগ্রসর মানুষকে পেছনে টানছে। কারণ, কেন এই জিনিসটি মেয়েদের পরতে হবে, তার কারণ খুঁজতে গেলে এমন কিছু উত্তর বেরোবে, যেগুলোর পেছনে প্রশ্নও কম নয়, আর প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তরই কোনও মেয়ের পক্ষে যায় না। মানুষ শিক্ষিত হলে সাধারণত সচেতন হয়। সচেতন মানুষ যে কোনও অন্যায় ও অসুন্দরের বিপক্ষে কথা বলবার যোগ্যতা অর্জন করে। যদি মেয়েরা সচেতন হয়ে ওঠে, যদি প্রতিবাদ করে নারীর ওপর রাষ্ট্র সমাজ ও ধর্মের নানা পীড়নের বিরুদ্ধে তাই নারীকে সংযমনের নতুন কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।
ঘাসে পাথর চাপা দিয়ে রাখলে ঘাসের রং আর সবুজ থাকে না। বিবর্ণ হয়ে যায়। আর হলুদ বিবর্ণ মেয়েদের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্য বোধের আশাই করা যায় না।
মার্জিত পোশাক পরে মেয়েরা যখন স্কুল কলেজে যায়—তা যদি দৃষ্টিকটু হয়, তার চেয়ে দৃষ্টিকটু কতটুকু—যখন মসজিদে বালিকারা ইমাম দ্বারা ধর্ষিত হয়, যখন মাদ্রাসার ছাত্র দ্বারা কিশোর লাঞ্ছিত হয়, টুপি ও আলখাল্লা পরা আল্লাহর নেকবান্দা ঘরে পাঁচ বউ রেখে নিজের নাতনিকে পাটক্ষেতে ডেকে এনে ধর্ষণ করে। সারাদেশে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মহাদাপটে তাদের ব্যবসার শ্ৰীবৃদ্ধি করছে, অট্টালিকা তুলছে নানা রঙের বাণিজ্য করছে। রাষ্ট্র এবং সমাজের স্বনামধন্য বিত্তবান ব্যক্তিরা এইসব চটকদার ব্যবসা মহাসমারোহে টিকিয়ে রাখে এবং এই অশিক্ষিত, ভণ্ড, লোভী ও কামুক ব্যবসায়ীরা নারীকে ধর্মের নামে ভোগ ও বিলাসিতায় ব্যবহার করে।
এই যদি ধর্মের চর্চা দেশ জুড়ে, তবে ধর্মের এমন বোঝা নারী তার ঘাড়ে চাপাবে কেন? কোন অন্যায়ের জন্য তার স্বাধীনতা, তার রুচি ও ব্যক্তিত্ব, তার সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তা রোধ করা হবে? মানুষের প্রধান প্রয়োজন স্বাধীনতা। নারীর এই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র অবরোধ করছে। নারীর স্বাভাবিক বিকাশে ধর্ম এখন প্রধান অন্তরায়। ধর্ম মানুষকে পেছনে টানে, ধর্ম বিজ্ঞান ও প্রগতির বিপক্ষে কথা বলে। ধর্ম মানুষকে একটি অলৌকিক ভীতির ভেতরে ডুবিয়ে রাখে, ধর্ম মানুষকে হাসতে দেয় না, যেমন ইচ্ছে চলতে দেয় না। ধর্ম নারীকে অমানুষে পরিণত করে, ধর্ম নারীকে করে পুরুষের ক্রীতদাসী।
২. ‘দুনিয়ার সবকিছু ভোগের সামগ্ৰী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী নেক চরিত্রের স্ত্রী।’
‘যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম তবে নিশ্চয় সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহদের স্বামীকে সেজদা করে।’
‘তিন ব্যক্তির নামাজ বন্দেগী কিছুই কবুল হইবে না (১) যে গোলাম মনিবের নিকট হইতে । পালাইয়া গিয়াছে, সে মনিবের নিকট হাজির না হওয়া পর্যন্ত। (২) যে স্ত্রীর স্বামী তাহার উপর অসন্তুষ্ট, সে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত। (৩) নেশাখের নেশা ছাড়িয়া না দেওয়া পর্যন্ত।’
‘যদি কোনও ব্যক্তি সঙ্গম করিবার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তাহার । নিকট উপস্থিত হয়—যদিও সে উনানের উপর (রন্ধনের কাজে লিপ্ত) থাকে।’
‘যদি কোনও পুরুষের শরীর হইতে সর্বদা পূঁজ-রক্ত বাহির হইতে থাকে, আর তাহার স্ত্রী ঐ সমস্ত পুঁজ-রক্ত নিজের জিহ্বা দ্বারা চাটিয়া সাফ করিয়া দেয়, তথাপি পুরুষের হক আদায় হইবে না।’
‘যে স্ত্রীরা সর্বদা স্বামীদিগকে সন্তুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে সাজসজ্জা করে, স্বামীর হক আদায় করিতে থাকে, স্বামীর সন্তোষ তলব করে ও স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী তাহার পায়রবি করে তবে সেই স্ত্রীরা পুরুষের জুম্মা, জামাত, হজ্জ ও ওমরার তুল্য সওয়াব পাইবে।’
‘যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহ শহীদের তুল্য সওয়াব দান করিবেন।’
‘যখন কোনও স্ত্রী তাহার স্বামীকে বলিবে যে, তোমার কোনও কার্যই আমার পছন্দ হইতেছে না, তখনই তাহার ৭০ বছরের এবাদত বরবাদ হইয়া যাইবে। যদিও সে দিবসে রোজা রাখিয়া ও রাত্রে নামাজ পড়িয়া ৭০ বছরের পুণ্য কামাই করিয়াছিল।’
‘বেহেশতবাসীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিম্ন পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরও আশি হাজার দাস এবং বাহাত্তর জন স্ত্রী থাকিবে।’
‘যদি স্বামী স্ত্রীকে আদেশ করে, তবে সে জরদ পর্বত হইতে কালো পর্বতের দিকে এবং কালো পর্বত হইতে সাদা পর্বতের দিকে ধাবিত হোক, তথাপি সেই আদেশ প্রতিপালন করা তাহার কর্তব্য।’
‘যখন কোনও ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তাহার শয্যার দিকে আহ্বান করে এবং স্ত্রী সেই আহানে সাড়া না দেবার জন্য যদি স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করিয়া থাকে, তবে প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রীলোকের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করিতে থাকেন।’
‘স্বামী তাহার স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, (১) স্ত্রীকে সাজসজ্জা করিয়া তাহার নিকট আসিতে বলার পর স্ত্রী তাহা অমান্য করিলে। (২) সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামীর আহ্বান পাওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করিলে। (৩) স্ত্রী ফরজ গোসল ও নামাজ পরিত্যাগ করিলে। (৪) স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারও বাড়িতে বেড়াইতে গেলে।’
উপরের উদ্ধৃতিগুলো মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর বাণী, যা পবিত্র হাদিস হিসেবে সন্মানিত। এরপরও যে নারী ধর্মের যাবতীয় বোঝাকে তার শরীরে এবং হৃদয়ে সাদরে বরণ করে, আমি সেই নিবোধ ও নির্লজ্জ নারীকে ধিক্কার না দিয়ে পারি না।