৩২. ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন

অনেক রাতে ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন।

ঘুম ভাঙলেই সময় জানতে ইচ্ছে করে। এ বাড়িতে কোনো ঘড়ি ছিল না। এখন ঘড়ি আছে। অপলার ছোট্ট লেডিস ঘড়ি। তাকে ডেকে কী জিজ্ঞেস করবেন কটা বাজে? নাকি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় আঁচ করবার চেষ্টা করবেন। শেষ রাত হলে––দক্ষিণ আকাশে দেখা যাবে বৃশ্চিক নক্ষত্রমণ্ডলী যার উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির নাম জ্যেষ্ঠা। বৃশ্চিকের কাছেই থাকবে ধনু নক্ষত্রমালা। যার ঠিক উপরে মঙ্গল গ্রহ। এদের অবস্থান থেকে সময় বলে দেয়া খুব অসম্ভব নয়। ওসমান সাহেব বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। মিল্কিওয়ে দেখা যাচ্ছে। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি উজ্জ্বল একটি তারা। এর নাম কী? শনি, কিন্তু এত কাছাকাছি কী শনির থাকার কথা? আকাশ সম্পর্কে এক সময় প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন গ্রহ-নক্ষত্র দেখামাত্র চিনতে পারতেন। এখন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মঙ্গল গ্রহের পাশের উজ্জ্বল বস্তুটি কী?

তিনি শোবার ঘরে ফিরে এলেন। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। টেবিলে পানির গ্লাস ও জগ। পরপর দুগ্লাস পানি খেলেন। কিন্তু তৃষ্ণা কমল না। বুক শুকিয়ে ঝাঁ ঝা করছে। ঘুমুনোর চেষ্টা করা অর্থহীন। ঘুম আসবে না, তিনি একটি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগেছেন। দুঃস্বপ্নের রেশ যতক্ষণ পুরোপুরি না কাটবে ততক্ষণ ঘুমুনো যাবে না। ওসমান সাহেব ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন একে দুঃস্বপ্ন ভাবাটা কী হচ্ছে? একজন প্রিয় এবং পরিচিত কাউকে স্বপ্ন দেখাটা দুঃস্বপ্ন হতে পারে না।

স্বপ্নে দেখেছেন মিলিকে। স্বপ্নের চেহারাগুলি কখনো খুব স্পষ্ট হয় না। মিলিকে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ফুলি মেয়েটির মত। হাত পা নাড়ার ভঙ্গি অনেকটা অপলার মতো। মিলি যেন খুব ক্লান্ত। এসেছে অনেক দূরের কোনো জায়গা থেকে। অল্পক্ষণ থেকেই তাকে চলে যেতে হবে। সে বলল, ভাইয়া তুমি আমাকে চিনতে পারছি, আমি মিলি।

হ্যাঁ চিনতে পারছি।

আমি মরে গেছি, তুমি জান তো? বিষ খেয়েছিলাম

না বিষ-টিস খাসনি। চিকিৎসা হচ্ছে তোর।

উঁহু তুমি জান না একগাদা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেললাম।

তাই না-কী?

হ্যাঁ।

এখন কেমন আছিস?

বেশি ভাল না। সারাদিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটোছুটি করতে হয়। বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকা যায় না।

তাই নাকি? জানতাম না তো। সুখে আছিস, না কষ্টে আছিস?

সুখেও না কষ্টে ও না। এখানে সব অন্য রকম। তোমাকে বোঝাতে পারব নরা। আত্মাটা আমাদের সঙ্গে থাকে না।

বলিস কী? কোথায় থাকে?

তাও জানি না। সারাক্ষণ এমন ছুটোছুটি কী জন্যে? আত্মা খুঁজে বেড়াই।

আশ্চর্য তো!

তোমার এখানে খাবার কিছু আছে? খুব ক্ষিধে পেয়েছে।

তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে খাবা-দাবার খুঁজেতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে তার মনে হল এটা স্বপ্ন। মিলি করুণ মুখে তার সামনে বসে আছে এটা একটা স্বপ্ন দৃশ্য। কাজেই ব্যস্ত হয়ে খাবার খোজা অর্থহীন। অথচ মিলি এমন করুণ ভঙ্গিতে বসে আছে যে খাবার না খুঁজেও পারা যায় না। তিনি খানিকটা গম ছাড়া কিছুই পেলেন না। তাঁর কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘােম পড়তে লাগল। এই গম দিয়ে তিনি কী করবেন? মিলি কিন্তু তার রোগা হাত বাড়িয়ে মুঠো মুঠো গম নিয়ে মুখে পুরছে। কচ কচ করে চিবোচ্ছে। ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন। এ জাতীয় একটি স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু অর্থহীন কিছুই তো ঘটে না পৃথিবীতে। এ রকম একটি স্বপ্ন দেখার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ওসমান সাহেব সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মঙ্গল গ্রহ আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আকাশ অসম্ভব পরিস্কার। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এত পরিস্কারভাবে এর আগে তিনি দেখেননি। এই ছায়াপথ ধরেই মৃত মানুষেরা পৃথিবীতে নেমে আসে। কোথায় যেন পড়েছিলেন। বিভূতিভূষণের দেবযান-এ না। অন্য কোথাও?

তিনি সিগারেট টানতে টানতে স্বপ্নটার কথা ভাবতে লাগলেন। এর একটি লৌকিক সংখ্যা বের করা উচিত। নয়ত স্বপ্নের রেশ কাটবে না। তাকে বাকি রাতটা কেটে জাগাতে হবে। কারণ স্বপ্ন দেখে তিনি ভয় পেয়েছেন। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হয়েছে। জেগে উঠে দেখেছেন বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। অথচ ভয়ের কিছুই ছিল না। স্বপ্নে। অস্বাভাবিকতা যা আছে, তার সব স্বপ্নেই থাকে। তিনি শোবার ঘর থেকে ইজিচেয়ার টেনে আনলেন বারান্দায়। শীতল হাওয়া দিচ্ছে। বসে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। এরা রোজ ইজি চেয়ারটা বারান্দা থেকে টেনে শোবার ঘরে নিয়ে যায় কেন? ইজি চেয়ারটা ফিট করতে কষ্ট হচ্ছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। খাট খািট শব্দ হচ্ছে। টগর বা অপলা জেগে উঠতে পারে। তিনি কাউকে জাগাতে চান না। এক সময় দুঃস্বপ্ন দেখলেই রানুকে ডেকে তুলতেন। রানু খুব বিরক্ত হত। মুখ বাকিয়ে বলত, তুমি একজন বয়স্ক মানুষ না? ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছ কেন? চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

স্বপ্নটা কেন দেখলাম সেটা তোমাকে বলি।

বলার দরকার কী?

তুমি না শুনলে বাকি রাতটা আমার ঘুম হবে না।

এ রকম অদ্ভুত স্বভাব কেন তোমার?

রানু ঘুম চোখে বসে থাকত। ঘন ঘন হাই তুলত। এবং তিনি অনেক সময় নিয়ে স্বপ্ন দেখার কারণ ব্যাখ্যা করতে শুরু করতেন। এক সময় ব্যাখ্যা শেষ হত। তিনি হৃষ্ট গলায় বলতেন, যুক্তিগুলি তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে তো কিছু না। তোমার পছন্দ হলেই হল। তোমার কথা শেষ হয়েছে?

হুঁ।

তাহলে ঘুমুতে আসা। নাকি তোমার জন্যে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হবে?

তিনি রানুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে যেতেন। রানু যদি বলত, গরমের সময় এত ঘেষা ঘোষি করে শুতে ভাল লাগছে না। তিনি মৃদুস্বরে বলতেন, ভয়টা পুরোপুরি কাটেনি রানু।

ওসমান সাহেব ইজিচেয়ারে বসে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপলা শোবার ঘর থেকে চেঁচাল–কে কে? অপলা নিশ্চয়ই তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়নি–ঘুমের ঘোরেই চেঁচিয়েছে। কোন সাড়া-শব্দ না পেলে চুপ করে যাবে। কিন্তু আপলা আবার বলল, কে কে?

আমি। ঘুমাও অপলা।

আপনি বারান্দায় কী করছেন?

অপলা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বিড়বিড় করে বলল, যা ভয় পেয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে আমি জেগে আছি। শুনলাম। ঘরে কী সব যেন টানাটানি করা হচ্ছে। তার পর দরজা খোলা হচ্ছে। আমি ভাবলাম চোর।

ওসমান সাহেব বললেন, কটা বাজে অপলা? অপলা অনেকক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। সময় বলতে পারল না। অন্ধকারে ডায়াল দেখা যাচ্ছে না।

বাতি না জ্বালিয়ে বলা যাবে না। আপনার কাছে দিয়াশলাই আছে?

তিনি দিয়াশলাই জ্বালালেন, তিনটা দশ। অথচ মনে হচ্ছে ভোর। অপলা বলল, আপনি এত রাতে বারান্দায় বসে আছেন কেন?

একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি, তার পর আর ঘুম আসছে না।

কী দুঃস্বপ্ন?

তিনি আগ্রহ করে স্বপ্নের কথা বললেন। অপলা মৃদু স্বরে বলল, খুব অদ্ভুত স্বপ্নটা। তিনি বললেন,

না, অদ্ভুত না। এরকম স্বপ্ন কেন দেখেছি তা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। অনেক দিন আগে একটা বই পড়েছিলাম।–দি ভেইল, সেখানে কিছু মানুষের কথা লেখা হয়েছে–যাদের আত্মা ঈশ্বর জমা রেখেছেন। তারা ব্যাকুল হয়ে স্বৰ্গ মর্ত্যে তাদের আত্মা খুঁজছে। গল্পটা খুব দাগ কেটেছিল। এই গল্পটিই স্বপ্নে একটু অন্যভাবে এসেছে।

মিলি আপা বসে বসে গম খাচ্ছেন এটা দেখলেন কেন?

ও খুব দুঃখী মেয়ে। অভাবি মেয়ে। ওরা দুঃখটা স্বপ্নে এই ভঙ্গিতে এসেছে। ওর প্রতি আমার খুব মমতা।

উনি কেমন আছেন?

জানি না।

জানিবার চেষ্টাও বোধ হয় করেননি।

তিনি জবাব দিলেন না। অপলা হাই তুলে বলল, শীত শীত লাগছে। আপনার লাগছে না?

লাগছে। কাছেই কোথাও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। শীত লাগছে সেই কারণে।

আপনি পৃথিবীর সব স্বপ্নের জবাব জানেন না কী?

না, জানি না। তবে জবাব পেতে চেষ্টা করি। অনেকেই সেটা করে না। চৈত্র মাসের রাতে হঠাৎ বাতাস এত ঠাণ্ডা হবে কেন, এই নিয়ে আমি ভাবছিলাম।

ওসমান সাহেব হাসলেন। অপলা হাসল না। কেন জানি সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ল।

ঘুমুতে যাও অপলা।

আপনি ঘুমুবেন না?

না, আমি আরো খানিকক্ষণ বসে থাকব।

বসে বসে জটিল সব প্রশ্নের উত্তর ভাববেন?

তা বলতে পার।

তিনি সিগারেট ধরালেন। অপলা মৃদুস্বরে বলল, আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, দেখি আপনি জবাব দিতে পারেন কী না।

কী প্রশ্ন?

আমি এখানে এসেছিলাম দু’দিন থাকিব ভেবে। কিন্তু আজ নিয়ে আট দিন হল এখানে আছি। ভেবে-টেবে বলুন তো কেন আছি? দয়া করে সত্যি কথাটা বলবেন।

আমি জানি না অপলা।

আপনি জানেন। খুব ভালই জানেন।

ঘুমুতে যাও অপলা।

না। আমি ঘুমুতে যাব না, আপনাকে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, অপলা কাঁদতে শুরু করেছে।

নিঃস্বাৰ্থ কান্না নয়। শব্দ করে শিশুদের মত কান্না।

এসো অপলা ঘরে যাই।

অপলা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, আমি কাল ভোরে চলে যাব। যাবার আগে জানতে চাই যে আপনি জানেন, কেন আমি এখানে এতদিন থাকলাম।

আমি জানি। জািনব না কেন? আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

বুদ্ধিমান কিন্তু হৃদয় বলে আপনার কিছু নেই। আপা ঠিকই বলেন।

ঘুমুতে যাও অপলা।

আমি যাব না। আপনি যান। আরাম করে ঘুমুন। আমি বসে থাকব। এখানে।

এ বাড়িতে কিন্তু ভূত আছে।

কেন বাজে কথা বলছেন। কেন আপনি আমাকে একটা ছোট্ট খুকি মনে করেন?

ছোট্ট খুকি মনে করি না।

টগর জেগে উঠেছে। সে ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, খালামণি, খালামণি। অপলা ভেতরে চলে গেল। ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন অপলা বেশ সহজ ভঙ্গিতেই টগরকে বাথরুম করাতে নিয়ে গেল। ছোটখাটো কথাবার্তাও বলতে লাগল। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি।

তিনি নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার কেন জানি মনে হতে লাগল টগরকে ঘুম পারিয়ে অপলা আবার আসবে। এ ঘরে। তিনি তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু অপলা এল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *