এপ্রিল মাসের এক সকালে ভারতের মাটিতে পা দিলেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বীট্ন। সাতচল্লিশ বছর বয়েস, স্বাস্থ্যবান উন্নত দেহ, মন বিবিধ উৎসাহে ভরপুর। তিনি সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারের মানুষ, নিজেও আইন ও অঙ্ক শাস্ত্ৰে সুপণ্ডিত, অক্সফোর্ডের র্যাংলার। কাব্য সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট আগ্ৰহ। কলকাতা বন্দরে তিনি নামলেন অনেক আশা নিয়ে। বসন্তকালীন বার্তাস ও রৌদ্র ধৌত এই সুন্দর শহরটি দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ অনেক দিনের। যৌবনে লণ্ডন শহরে তিনি যখন আইনজীবী হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছেন, সেই সময় একটি অতি কৌতূহলজনক মামলায় ওকালতী করার জন্য তাঁর কাছে একটি প্রস্তাব আসে। ব্যাপারটা স্ত্রীলোকদের পুড়িয়ে মারা বিষয়ে। একদল হিন্দু আবেদন করেছিল যে স্বামীর মৃত্যুর পর সেই একই চিতায় তার জীবন্ত স্ত্রীকেও পুড়িয়ে মারার যে প্রথা ভারতে আছে, তা। আইন করে বন্ধ করা হোক। আর একদল হিন্দু আবার এই রকম আইনে তাদের ধর্ম কলঙ্কিত হবে বলে এই আইন জারির বিরুদ্ধে প্ৰিভি কোন্সিলে আপীল করতে চায়। সেই বিরুদ্ধ পক্ষীয় হিন্দুরাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। বিষয়টি জেনে প্রথমে বেশ বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন বীট্ন। জীবন্ত নারীকে পুড়িয়ে মারা হবে কি না, তা নিয়েও মতভেদ? সুট্টির কথা তিনি নানান পুত্র-পত্রিকায় পড়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল এসব রূপকথা। ইওরোপেও ডাইনী ঘোষণা করে অনেক নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, ইনকুইজিশনের বহু কদাচারের কথা তিনি জানেন, কিন্তু সে তো মধ্যযুগের কথা। এখন উনবিংশ শতাব্দী, মানব সভ্যতার এক নবজাগরণ হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্ৰযুক্তিবিদ্যার মধ্যে দেখা দিয়েছে অসীম সম্ভাবনা, চতুর্দিকে প্রবাহিত হচ্ছে মুক্ত চিন্তার বার্তাস। এর মধ্যে জ্ঞানীদের দেশ ভারতবর্ষে এতখানি কুসংস্কার আচ্ছন্ন অন্ধকার!
সেই থেকে জন বীট্ন ভারতবর্ষীয় সমাজ নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলেন। তাঁর স্বদেশে তখন নারী মুক্তির আন্দোলন চলছে, চতুর্দিকে স্থাপিত হচ্ছে নানা ধরনের লেডিজ অ্যাসোসিয়েশন, নারীরা প্রকাশ্যে সভাসমিতি করে পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার দাবি করছে। বীটন নিজেও মনে করেন যে ঈশ্বর পুরুষ ও নারী জাতিকে সমানভাবেই বুদ্ধি, হৃদয় ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি দিয়েছেন। এতকাল পুরুষ যে স্ত্রী জাতিকে নিছক ভোগের সামগ্ৰী করে রেখেছিল এবং সমাজজীবনে নারীর কোনো ভূমিকাই স্বীকার করেনি, সেটা অন্যায়। ইওরোপে নারীরা একে একে অনেক অধিকার আদায় করছে, কিন্তু বীট্ন জেনে দুঃখিত হয়েছিলেন যে ভারতে রমণীরা এখনও পদাবনত। তাদের পুড়িয়ে মারা বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও তারা সারাজীবন দগ্ধ হয়।
বীট্ন হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁরা কয়েকটি মহৎ ধারণার পরিপোষণ করেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে সুখ পান। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়েও পৃথিবীর মানুষের কিছু সুখ বৃদ্ধির চেষ্টা করেই তৃপ্তি পান এই ধরনের মানুষ। বীট্ন অকৃতদার এবং তাঁর কোনো গৃহ-বন্ধন নেই। বিলাতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে ভারতে আইন সচিব করে পাঠাতে চাইলেন, তখন সে প্রস্তাবে সাগ্রহে সম্মতি দিয়েছিলেন বীট্ন। প্রত্যক্ষভাবে ভারতবর্ষকে জানার বাসনা তাঁর এতদিনে চরিতার্থ হবে।
বীট্নের আগমনের অল্পকাল আগে লর্ড ডালহৌসি এসেছেন ভারতের বড়লাট হয়ে। ডালহৌসির আকাঙ্ক্ষা রাজ্য বিস্তারের। তা ছলে, বলে ও কৌশলে যে উপায়েই হোক। আর তাঁর আইন সচিব বীট্নের বাসনা এই যে, যে নবজাগরণের জোয়ার এসেছে ইওরোপে, তারই অনুরূপ কিছু এই প্রাচীন, সুমহান সভ্যতার দেশ ভারতবর্ষেও সঞ্চারিত হোক। এই দুই রাজপুরুষেরই অবস্থিতি হলো রাজধানী কলকাতায়।
পদাধিকার বলে বীট্ন কাউন্সিল অব এড়ুকেশনেরও সভাপতি হলেন। অৰ্থাৎ এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনিই প্ৰধান। কলকাতায় উপস্থিত হয়েই তিনি জড়িয়ে পড়লেন নানান কাজে। তিনি দেখলেন, কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে, পৃথকভাবে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার জন্য। আর যেটা সবচেয়ে উজ্জ্বল প্ৰতিষ্ঠান, যেখান থেকে ছাত্ররা পায় পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানের আলোক, সেই হিন্দু কলেজে। শুধু হিন্দু ছাত্র ছাড়া আর কারুর প্রবেশ অধিকার নেই। শুধু হিন্দু হলেই হবে না, কিছুটা অন্তত বংশকৌলীন্য না থাকলে যেকোনো ছাত্রই হিন্দু কলেজে পড়তে আসতে পারে না। এই অদ্ভুত ব্যবস্থা দেখে তাঁর খটকা লাগলো। তাছাড়া তিনি দেখলেন, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই অস্বাভাবিক। সংস্কৃত কলেজে শেখানো হয় সংস্কৃত, মাদ্রাসায় আরবী ফারসী আর হিন্দু কলেজে ইংরেজী। বাংলাদেশে বাঙালী ছাত্ররা কেউ বাংলা ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখে না। বীট্ন ভাবলেন, ইংলণ্ডের ইংরাজ যুবকরা শুধু গ্ৰীক ল্যাটিনের মাধ্যমে পড়াশুনা করছে, ইংরেজী শিখছে না, এ কি কল্পনা করা যায়?
কিছু কিছু দেশীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি দেখলেন, তারা হিন্দু কলেজের ব্যাপারে খুব গর্বিত। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর এই কলকাতায় এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে নেটিভ বালকরা গড় গড় করে ইংরেজী বলতে শেখে, শেকসপীিয়ারের কাব্য মুখস্থ রাখে এবং গৃহদেবতার উপাসনার সময়ও হোমারের কাব্য থেকে পাঠ করে। এরা বাংলা ভাষা একেবারেই শেখে না এবং ইংরেজী কৃতিত্বের জন্য গর্ববোধ করে।
বীট্নের মনে হলো, হিন্দু কলেজ যেন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, এ তো একটি ভৃত্য বানাবার কারখানা। সাম্রাজ্য বাড়ছে, সরকারী কাজকর্মও বাড়ছে, অল্প বেতনে ইংরেজ কর্মচারী পাওয়া দুষ্কর, তাই হিন্দু কলেজের পাশ করা ছাত্রদের মধ্য থেকেই এখন সরকারের নিম্ন বিভাগীয় কর্মচারী পাওয়া যাচ্ছে যথেষ্ট। কতকগুলি ভৃত্য উৎপাদনের জন্য শেকসপীিয়ার, হোমার পঠন-পাঠনের প্রয়োজন কী?
এই সব ব্যাপার দেখে বীটন ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি শিক্ষা সমাজের সভাপতি, তাঁর কাজ শিক্ষা বিস্তার, ভৃত্য উৎপাদন তো নয়। শিক্ষা মানে তো আত্ম উপলব্ধি। যে ছাত্ররা মাতৃভাষা, নিজের সংস্কৃতি ও দেশীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানলো না, তাদের আবার শিক্ষা হলো কী? বীট্ন জানেন, ইংলণ্ডে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কথাই হলো ছাত্রদের মধ্যে নিজের জাতি ও নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা অন্ধ ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা। আর ভারতবর্ষের ব্যবস্থা ঠিক বিপরীত, এখানকার ছাত্ররা শিখছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঘৃণা করতে এবং অন্ধভাবে অনুকরণ করছে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষার। এরকম ব্যবস্থায় এদের মধ্যে থেকে দৈবাৎ দু-একজন চিন্তাশীল মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগই তো দাস মনোভাবসম্পন্নই থেকে যাবে।
অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে বীট্ন বুঝতে পারলেন, এই রকম শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্ৰভুভক্ত দাস সৃষ্টি করাই ব্রিটিশ নীতি। তারা এদেশ শাসন করতে এসেছে, এ দেশের মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটানোর দায়িত্ব তাদের নয়। হিন্দু কলেজে। শুধু হিন্দু ছাত্র ভর্তি করাই অভিপ্ৰেত, মুসলমানদের এখন ইংরেজী শিক্ষা দেওয়া উচিত হবে না। মুসলমানরা ঘুমন্ত সিংহ, ওদের এখন না জাগানোই ভালো।
ইংলণ্ডে থেকে বীট্ন এসব কিছুই বুঝতে পারেননি। ইংলণ্ডের জনসাধারণের ধারণা, অধঃপতিত ভারতীয়দের উদ্ধার কার্যেই ব্রিটিশ জাতি সেখানে নিযুক্ত। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করতে, তবু ভারতবর্ষ শাসন করার গুরু দায়িত্বও তাদের নিতে হয়েছে বাধ্য হয়ে, কারণ ভারতীয়রা রাজ্য শাসনের রীতিনীতি সব ভুলে গেছে, তারা শুধু পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ করে। কলকাতায় এসে বীট্ন বুঝলেন স্বদেশে এবং উপনিবেশে ব্রিটিশ নীতি দুরকম। ইংলণ্ডের পণ্য ভারতে আসে বিনা শুল্কে, আর ভারতীয় পণ্য ইংলণ্ডে গেলে তার ওপর চড়া হারে শুল্ক বসে। যাতে আস্তে আস্তে ভারতীয় পণ্যের বাজার ইংলেণ্ডে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতের শাসনভার তো নিয়েছে এই উদ্দেশ্যেই। ভারতীয়রা আস্তে আস্তে শিল্প উৎপাদন একেবারেই ভুলে যাবে, জীবন ধারণের জন্য যা কিছু দ্রব্যের জন্য তারা হয়ে উঠবে পুরোপুরি ইংলণ্ডের শিল্প উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল।
বীট্ন অবাক হয়ে ভাবলেন, দেশীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত ভেবে আত্মাভিমান দেখান, তাঁরাও এই তিক্ত সত্যগুলি বুঝতে পারছেন না কেন? নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। এরা বুঝতে পারছেন না, তার কারণ এরাও যথার্থ শিক্ষিত নন, এদের কোনো আত্ম-উপলব্ধি হয়নি।
বীট্ন বুঝলেন, তাঁর একার পক্ষে এই সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবু তিনি নিরুদ্যমী হয়ে বসে থাকবার মতন মানুষ নন। কয়েকটি মহান আদর্শকে অবলম্বন করেই যাঁরা জীবন কাটান, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকেন না। আমরা যাকে বলি বাস্তবজ্ঞান, সেই জিনিস তাঁদের যথেষ্ট কম থাকে। বীট্ন তাঁর কার্যকলাপ শুরু করেই একসঙ্গে এ দেশীয় ব্যক্তিদের এবং তাঁর স্বদেশবাসী ইংরাজদের ক্রুদ্ধ করে দিলেন।
কৈলাশচন্দ্ৰ বসু নামে হিন্দু কলেজের একজন শিক্ষক খৃষ্ট ধর্ম গ্ৰহণ করলেন। অমনি কলেজের অভিভাবক সভার হিন্দু সদস্যরা রুষ্ট হয়ে বললেন, কৈলাশচন্দ্ৰকে চাকরি থেকে অপসারিত করতে হবে। বীট্ন বিস্মিত হলেন। ধর্মান্তরিত হওয়াই কি একজন শিক্ষকের অযোগ্যতার পরিচায়ক? কলেজে তো অনেক ইওরোপীয় শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা ধর্মে খৃষ্টান, তাহলে একজন বাঙালী যদি খৃষ্টান হয়, তবে সে কেন শিক্ষকতা করতে পারবে না? হিন্দু সদস্যরা উত্তরে বললেন, এতে ছাত্রদের সামনে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। বীট্ন নতুন এসেছেন, সব কিছু ভালো করে বুঝে উঠবার আগেই কৈলাশচন্দ্র বসু, অপসারিত হয়ে গেলেন।
কিছুদিন বাদে গুরুচরণ সিংহ নামে একটি ছাত্র খৃষ্টান হলো। দেশে খৃষ্টান হবার ধুম পড়ে গেছে, ইংরেজী শিক্ষায় আলোকপ্ৰাপ্ত যুবকদের ধারণা, খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলেই তারা রাজার জাতে উন্নীত হবে।
হিন্দু কলেজের নিয়ম অনুযায়ী গুরুচরণ সিংহ আর ছাত্র থাকতে পারবে না। সেখানে। হিন্দু ছাড়া কারুর পাঠের অধিকার নেই সেখানে। কয়েক বছর আগে রাজনারায়ণ দত্তের পুত্ৰ মধুসূদনও খৃষ্টান হবার পর এই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এবার বীট্ন দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন।
হিন্দু কলেজ পুরোপুরি সরকারের এক্তিয়ারে নয়। কয়েক বছর ধরে ইংরেজ সরকার এই কলেজকে কিছু আর্থিক সাহায্য করছেন। কিন্তু কলেজটি স্থাপিত হয়েছিল বেসরকারী উদ্যোগে এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দানে। সেই সব ব্যক্তিরা কিংবা তাঁদের পারিবারিক প্রতিনিধিরা এখনো রয়েছেন। কলেজ পরিচালনা সংস্থার সদস্য। তাঁদের নেতৃত্ব দেন রাজা রাধাকান্ত দেব, রক্ষণশীলতার প্রধান ও সুদৃঢ়তম দুর্গটি তিনিই রক্ষা করে চলেছেন।
হিন্দু সদস্যরা ভাবলেন, পাদ্রীদের মতন বীট্নও বুঝি এদেশে খৃষ্ট ধর্মের বন্যা বইয়ে দিতে চান। সুতরাং রাধাকান্ত দেব প্রমুখ দৃঢ় প্রতিরোধে নামলেন। যদিও বীট্ন ধর্ম বিষয়ে খুব উৎসাহী নন, অখুষ্টান মাত্রই নরকে পতিত হবে, এমন বিশ্বাস তাঁর নেই, ধর্ম গ্রহণ বা বর্জনকে তিনি মানুষের ব্যক্তিগত রুচি হিসেবেই গ্রহণ করেন। শুধু হিন্দুরাই ছাত্র হবার অধিকারী, হিন্দু কলেজের এই মূল নিয়মটিকেই তিনি বর্জন করতে চান। তিনি প্রতিপক্ষের সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। হুগলীর কলেজ কিংবা প্রিন্স গোলাম মহম্মদ প্রতিষ্ঠিত রসাপাগলা গ্রামের ইংরেজী স্কুলে তো খৃষ্টান, মুসলমান ও হিন্দু ছাত্ররা একসঙ্গে পাঠ নেয়। সে সব স্থলে তো কোনো বৈষম্য নেই। মুসলমান-খুষ্টানরা হিন্দুদের সঙ্গে একযোগে শিক্ষাভ্যাস করতে অনাগ্ৰহী নয়, শুধু হিন্দুরাই কেন দূরে সরে থাকবে?
এ তর্ক মাঝপথে রইলো। গুরুচরণ সিংহ নামের ছাত্রটি নিজে থেকেই কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় তখুনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলো না। কিন্তু রাধাকান্ত দেবের দল বীট্নের ওপর চটে রইলেন।
বীট্ন এরপর চটিয়ে দিলেন ছাত্রদের। ইংরেজী সাহিত্য ও ইতিহাসের অতি জনপ্রিয় অধ্যাপক ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন অন্যান্য কয়েক জায়গা ঘুরে সম্প্রতি হিন্দু কলেজেরই অধ্যক্ষ হয়েছেন। ক্যাপ্টেন সাহেব শিক্ষক হিসেবে অতি সুযোগ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর নারীঘটিত দুর্বলতার কথা নিয়ে কানাকানি চলছিল সর্বত্র। তাছাড়া যথাসময়ে কলেজে আসাও তাঁর ঠিক ধাতে পোষায় না। এক একদিন কলেজ শুরু হবার অনেক পরে তিনি ঈষৎ স্বলিতপদে কলেজে আসেন, তখনও তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তিমাভ। এই অসংযমী ও সময়জ্ঞানহীন অধ্যক্ষকে বীট্ন সুনজরে দেখলেন না। ছাত্রদের কাছে এরকম অধ্যক্ষ আদর্শস্থানীয় হওয়া উচিত নয়। তিনি রিচার্ডসনের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন,অহংকারী রিচার্ডসন তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলেনপদত্যাগপত্র এবং বীট্ন তা গ্ৰহণ করতে দ্বিধা করলেন না একটুও। এর ফলে ছাত্র মহলে শোরগোল পড়ে গেল, অভিভাবকরাও সভা ডেকে বীট্নের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন। ছাত্ররা ঠিক করলো বিশাল আকারে সম্বর্ধনা দেবে তাঁদের প্রিয় অধ্যাপককে, বীট্ন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে জানালেন যে কোনো বিদায়ী সরকারী কর্মচারীকেও সম্বর্ধনা জানানো আইনবিরুদ্ধ। ছাত্ররা একযোগে সংবাদপত্রে লিখলো বীট্নের এই ধরনের কঠোর হস্তক্ষেপ বিষয়ে। সারা দেশে বীট্নের নিন্দা রটে গেল।
বীট্নের এর পরের উদ্যোগটিতে হাঙ্গামা হলো অনেক বেশী। শিক্ষা বিষয়ের মতন, বীট্ন দেখলেন, এ দেশে আইন ব্যবস্থার মধ্যেও অনেক বৈষম্য রয়েছে। ইওরোপীয়রা কতকগুলি বিশেষ সুযোগসুবিধা পায় ও তার অপব্যবহার করে। মফস্বলে ইওরোপীয়রা ভারতীয়দের উপর যত অত্যাচারই করুক তার কোনো প্ৰতিবিধান নেই। মফস্বলের কোনো আদালতে ইওরোপীয়দের কোনো ফৌজদারী মামলার বিচার হয় না। বহু ইংরেজ ও অন্যান্য ইওরোপীয়রা ছড়িয়ে আছে গ্রামে-গঞ্জে, কয়েক রকমের ব্যবসা তারা একচেটিয়া করে নিচ্ছে, রেশম, চিনি এবং নীল উৎপাদনের জন্য তারা কুঠী স্থাপন করে সেখানে নিজস্ব রাজত্ব চালায়। সেখানে কোনো আইনের শাসন নেই, শ্বেতাঙ্গরা স্থানীয় লোকদের মারধোর করে, বাড়িতে আগুন লাগায় ও যুবতী স্ত্রীদের সবলে ধরে নিয়ে যায়। সরকারের দেশী কর্মচারীরা এদের কোনো কাজে বাধা দিতে গেলেও এদের কাছে অপমানিত হয়, অনেক সময় প্রহৃতও হয়।
আইন সচিব হিসেবে বীট্ন এসব সহ্য করতে রাজি নন। তিনি যে আইন শিক্ষা করেছেন, তার মূল কথাই হলো, আইনের চক্ষে সবাই সমান। আমেরিকায় স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ফরাসী বিপ্লবের পর সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা ইওরোপের বিদগ্ধ মানুষের কাছে স্বীকৃত হয়েছে। বীট্ন সেরকমই একজন মানুষ, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য দু রকম আইনের ব্যবস্থা তিনি মেনে নিতে প্ৰস্তুত নন। তিনি ইওরোপীয়দের বিশেষ অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি বাতিল করে দিয়ে নতুন আইনের খসড়া প্ৰণয়ন করলেন।
অমনি গর্জে উঠলো বেসরকারী ইংরেজ সমাজ। এইসব ইংরেজদের হাতে বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকাও রয়েছে। সেই সব কাগজে উঠলো প্রতিবাদের ঝড়। তারা বীট্নের এই নতুন আইনের নাম দিল ব্ল্যাক অ্যাকট বা কালা কানুন। প্রায় এক যুগ আগে মেকলে সাহেবও এই রকম আইন প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন এবং সর্বাংশে সার্থক হতে পারেননি। বীট্ন একেবারে বদ্ধপরিকর। সংবাদপত্রে তাঁকে নিয়ে যতই গালাগালি কুৎসা চলুক, তিনি পশ্চাৎপদ হবেন না। তবে তিনি লক্ষ্য করলেন নেটিভদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর পক্ষ সমর্থন করতে এগিয়ে আসছেন। রামগোপাল ঘোষ নামে এক ব্যক্তি ইংরেজীতে একটি পুস্তিকা প্ৰকাশ করেছেন তাঁর স্বপক্ষে।
তবু শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন বীট্ন। লর্ড ডালহৌসি দেশীয় রাজন্যবর্গের বিষয় সম্পত্তি কেড়ে নেবার পরিকল্পনাতেই তখন ব্যস্ত, তিনি তুচ্ছ আদর্শগত কারণে ইংরেজ সম্প্রদায়কে চটাতে চান না। মোটেই। সরকার বীট্নের নতুন আইনের খসড়া বাতিল করে দিল। উল্লাসের কলরোল পড়ে গেল ইংরেজ সমাজে, বীট্ন সেদিন একা বসে রইলেন নিজের কক্ষে। হিন্দু কলেজেও তিনি সব সম্প্রদায়ের ছাত্রদের প্রবেশ অধিকার দিতে পারেননি, আইনের বিচারের ক্ষেত্রেও তিনি শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের সমান সুযোগ দিতে পারলেন না চেষ্টা করেও।
এরই মধ্যে একদিন সকালে তাঁর খানসামা এসে খবর দিল যে একজন দেশী বাবু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। বীট্ন বাবুটিকে ভিতরে নিয়ে আসার অনুমতি দিলেন।
কোট প্যাণ্টে সুসজ্জিত একজন সুপুরুষ বাঙালী এসে ঢুকলেন ঘরে, তাঁর হাতে একখানি বই। ইনি হিন্দু কলেজের ভূতপূর্ব ছাত্র গৌরদাস বসাক।
বিশুদ্ধ ইংরেজীতে গৌরদাস বললেন, মিঃ বেথুন, আমি যে আপনার অমূল্য সময় ব্যয় করাইতে আসিলাম, সেজন্য মার্জনা করিবেন কী?
বীট্ন একটু হাসলেন। তাঁর নামের বানান দেখে নেটিভরা প্ৰায় সকলেই তাঁকে বেথুন বলে সম্বোধন করে। তিনি প্ৰথম প্ৰথম সংশোধন করে দিতেন, এখন আর করেন না। বানানটি অন্য রকম, সকলকে বোঝানো সম্ভব নয়।
তিনি একটি কেদারা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ভদ্ৰ মহোদয়, আসন গ্ৰহণ করুন, তাহার পর আপনার বক্তবা শুনিব।
গৌরদাস বললেন, মহাশয়, আমার বক্তব্য অতি সামান্য। আমার এক বন্ধু একটি কবিতা পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন। আপনি স্বয়ং বিদ্বান ও সাহিত্য অনুরাগী, সেই বিবিচেনায় আপনাকে সেই পুস্তকের এক কপি উপহার দিতে আসিয়াছি, যদি অনুগ্রহ করিয়া তাহা গ্ৰহণ করেন।
বীট্ন জিজ্ঞেস করলেন, কবিতা পুস্তকটি আপনার রচনা নহে?
গৌরদাস বললেন, না মহাশয়, ইহা আমার এক আবাল্য সুহৃদের। তিনি মাদ্রাজে থাকেন। তিনি এক্ষণে কলিকাতায় উপস্থিত থাকিলে অবশ্যই স্বয়ং আসিয়া আপনার সমীপে কেতাবটি পেশ করিতেন। তাঁহার অনুরোধের আমি…
—বাঙলা কবিতা পুস্তক? দুঃখের বিষয়, আমি বাঙলা পড়িতে জানি না।
—না মহাশয়, ইহা ইংরেজীতে রচিত। ইহাতে অতিশয় উচ্চাঙ্গের সব কবিতা গ্রস্থিত হইয়াছে। বীট্ন হাত বাড়িয়ে বইখানি নিলেন। বইখানি সুন্দর করে বাঁধানো, ভিতরে তাঁর নামের নীচে কবির স্বাক্ষর। কবির নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বইটির নাম ক্যাপটিভ লেভী।
বীট্ন পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলেন রচনার নিদর্শন।
গৌরদাস বিনীতভাবে বললেন, আমার এই সুহৃদটি অতি অল্প বয়স হইতেই ইংরাজীতে কাব্য রচনা করিয়া বহুজনকে চমৎকৃত করিয়াছে। ক্রমে সে মিলটন বায়রনের সমগোত্রীয় হইয়া উঠিবে, এই আমাদের বিশ্বাস।
বীট্ন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইটি মুড়লেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বান্ধবটি বাঙালাভাষী হইয়াও বাঙালাতে কাব্য রচনা না করিয়া ইংরাজীতে কাব্য রচিলেন কেন? কোনো কবি মাতৃভাষা ছাড়িয়া অপর ভাষা অবলম্বনে কাব্য রচনা করে, এমন তো কখনো শুনি নাই।
গৌরদাস বললেন, মহাশয়, এই কবি মাইকেল এম এস ডট ইংরেজদের মতনই ইংরাজী ভাষায় দক্ষ। বহু ইংরাজই একথা স্বীকার পাইয়াছেন।
—আমিও না হয় তাহা স্বীকার করিলাম। অনেক ইংরাজও অত্যুত্তম ফরাসীভাষা জানে, কিন্তু তাহারা ফরাসী ভাষাতে কবিতা রচনা করে না। বাঙালাবাসীদের পক্ষে বাঙালাতে কিছু রচনা করার বাধা কোথায়?
—মহাশয়, বাঙালা ভাষা সাহিত্য রচনার উপযোগী নয়। ইহা অতি কদৰ্য ও ইতর লোকের ব্যবহার্য। এই ভাষার দ্বারা কোনো মহৎ ভাব প্রকাশ সম্ভব না। আমার সুহৃদটিকে আমি নিজেও কয়েকবার বাঙলায় কিছু রচিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছি, কিন্তু সে বাঙলা সম্পর্কে এই রূপ মত প্ৰকাশ করে।
বীট্ন ভ্রূকুঞ্চিত করলেন। তিনি আগেও লক্ষ করেছেন, বাঙালীরাই বেশী বাঙলা ভাষার নিন্দা করে। বাঙলা ভাষা যদি উচ্চাঙ্গের নাও হয়, তবু সেজন্য বাঙালীদের কোনো দুঃখবোধ নেই। এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়?
তাঁর মনে পড়লো কিছুদিন আগে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখেছিলেন কৃতী ছাত্ররা তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য নানান ইংরেজী কবিতা পাঠ করে শোনালো। বীট্ন তখন মঞ্চে উপবিষ্ট কয়েকজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, ইহারা কি কেহ কোনো বাঙলা কবিতা জানে না? ইংলেণ্ডের কোনো সভায় একটিও ইংরাজী পদ্য পাঠ করা হইল না, ইহা অকল্পনীয়। আপনাদের বাঙালা দেশের সভায় ইহা কী করিয়া সম্ভব হয়?
সেই ভদ্রমণ্ডলীও তখন একবাক্যে বলেছিলেন, মহাশয়, ইহারা বাঙলা শিখিবে কি? বাঙালাতে শিখিবার কোনো বস্তু নাই। বাঙালাতে যা রচিত হয়, তা সবই কুরুচিপূৰ্ণ।
বীট্ন একটু রেগে গিয়ে বলেছিলেন, পাঁচশত বৎসর আগে আমাদের ইংলণ্ডেও ইংরাজী ভাষা খুবই অমার্জিত ও বর্বর ছিল। তাহা বলিয়া কি আমরা পর ভাষা গ্ৰহণ করিয়াছি? আপনাদের মতন ব্যক্তিরা উদ্যোগ করিলে তবেই না বাঙালা ভাষার উন্নতি বিধান ঘটিবে। বাঙালাতে যদি মহৎ ভাবের গ্রন্থ নাই, তবে বিভিন্ন ইওরোপীয় ভাষা হইতে উত্তম উত্তম রচনাদি বাঙালায় অনুবাদিত করাইতেছেন না কেন? বাঙালা ভাষায় সেই সব অনুবাদ পড়িয়া ছাত্রদের রুচি উন্নত হইবে, তৎপরে তাহারা উচ্চমানের রচনা বাঙালাতে লিখিতে শিখিবে।
গৌরদাসের মুখের ওপর সরাসরি দৃষ্টি স্থাপন করে বীট্ন বললেন, মহাশয়, আমি যতটুকু বুঝি তাহাতে বলিতে পারি যে একজন উচ্চাভিলাষী প্রতিভাবান তরুণের পক্ষে এমন সুবৰ্ণ সুযোগ তো আর হয় না! বাঙালা ভাষা যদি এখনও অপরিণতই থাকে, তবে কাহার না লোভ হইবে সেই ভাষাকে পরিমার্জনা করিয়া দেশের মানুষের কাছে প্রথম মহৎ কোনো রচনা উপহার দেওয়ার? যে ভাষায় বহু সংখ্যক লেখক অনেক উত্তম গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছেন, সে ভাষায় খ্যাতি অর্জন করা সুকঠিন। কিন্তু যে ভূমি আজও আকৰ্ষিত, সেখানে তো অতি সহজেই সোনার ফসল ফলানো যাইতে পারে।
গৌরদাস বসাকের এসব কথাগুলি তেমন পছন্দ হলো না। তিনি ভেবেছিলেন, মিঃ বেথুনের মতন একজন মাননীয় ইংরাজের কাছ থেকে একটি প্রশংসাপত্ৰ আদায় করে মধুর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এ সাহেব যে উল্টো রকমের কথা বলে!
গৌরদাস উঠে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে বললেন, মিঃ বেথুন, আপনার উপদেশ আমি নিশ্চিত আমার বন্ধুকে জানাইব।
গৌরদাস চলে যাবার পর বীট্ন আবার দেখতে লাগলেন। বইখানি। কিছু অংশ পাঠ করলেন মনঃসংযোগ করে। তিনি হতাশ হলেন। কতখানি ইংরেজী ভাষার চাচা করেছে। এই কবি, তার প্রাণপণ প্ৰমাণ দেবার চেষ্টা আছে। এই বইখানির মধ্যে। কিন্তু এতে কাব্যের নামগন্ধও নেই। এই ব্যক্তির পক্ষে ইংরাজী ভাষার কবিদের মধ্যে স্থান গ্ৰহণ করা যেন প্ৰায় এক মুণ্ডহীন ধড়ের দিবাস্বপ্ন। এ দেশের ধারণা অনুযায়ী এ ব্যক্তি শিক্ষিত, কিন্তু বীট্নের মতে, যতই ইংরেজী শিক্ষা করুক, তবু এই রকম ব্যক্তি শিক্ষাহীন, কারণ এদের আত্ম-উপলব্ধি হয়নি।