৩১-৩৫. রাত কাবার হয়ে

৩১.

রাত কাবার হয়ে দিনটাও চলে গেল। আরও একটা দিন আরও একটা রাত পেরিয়ে গেল।

কিন্তু কোথায় সেই নাক থ্যাবড়া জাপানী। কোথায় জাপানী বোমা?

তাই বলে স্বচক্ষে জাপানী দেখবার জন্য তো আর কেউ অপেক্ষা করবে না! গোটা তালতলি গ্রাম জনশূন্য।

কিন্তু, তালতলির বাজার মানুষের ভিড়ে, বেচাকেনার ধুমে জমজমাট। কত কুলি মজুর কাজ করে চলেছে আশে পাশের রাস্তায়, সামরিক ঘাঁটিতে। কন্ট্রাকটার, ওভারসিয়ার, বিল বাবু, গুদাম বাবু–সাহেব আর বাবুর অন্ত নেই। একটু দূরেই রয়েছে মিলিটারী ছাউনি। চায়ের স্টলগুলো দিনরাত্রি সরগরম। চায়ের পেয়ালা চামুচের টুংটাং, বাংলা হিন্দি ইংরেজি মাদ্রাজি। বিচিত্র বোল-তালতলির হাওয়ায় নতুন সঙ্গীত।

আর দিনরাত শুধু গাড়ির চলাচল। ছোট বড় মাঝারি কত রকমের গাড়ি। ঘর্ঘর গর্জন। পেট্রোলের গন্ধ। ধোঁয়া ধুলো। মাথার উপরে বোমারু বিমানের কর্কশ চিৎকার। এই বুঝি তালতলির নতুন সঙ্গীতের আধুনিক আবহ।

ওই নতুন সড়ক, ওই গাড়ির মিছিল যেন বিশাল পৃথিবীরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ এনে পৌঁছে দিয়েছে এই তালতলির বাজারে।

রকমারী ভাষা এসে যেমন কানে বাজে তেমনি চোখে থেমে থাকে মানুষগুলোর বিচিত্র রং ঢং চেহারা নমুনায়। কারো রং সাদা, কদুর বুকের মতো। কারো বা পাকা কলার মতো স্বর্ণাভ। কেউ বা বট ফলের মতো লাল। আর এক দল মিসমিসে কালো, যেন হাড়ির তলা। কেউ বাঁদরমুখো। কেউ শিয়ালমুখো। কেউ বা ছবির মুখের মতোই সুন্দর। কিন্তু এক মুহূর্ত স্থিরতা নেই কারো। ফৌজি কাফেলা, দিন নেই, রাত নেই, চলছে তো চলছেই। ছাউনির পর ছাউনি পড়ছে। উঠে যাচ্ছে সব ছাউনি। আবার বসছে নতুন ছাউনি।

উন্মত্ত, তীব্র এক গতি। সে গতির মুখে বিভ্রান্ত তালতলির হাট। ক্ষুদ্র ডোবাটির মাঝে হঠাৎ যেন সমুদ্র এসে পড়েছে। বদ্ধ জল আজ তরঙ্গ উতরোল। মিঠা পানিতে লেগেছে লোনা স্বাদ। শুধু তালতলি নয়, পূর্ব বঙ্গের বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে বুঝি এই তরঙ্গের আঘাত, মিঠে পানিতে এই লোনা স্বাদ।

সব কিছু যে তছনছ হল, তার বিনিময়ে এটুকুই বুঝি লাভ। ধ্বংসে সৃষ্টিতে তিক্ততায় মধুরতায় আশ্চর্য যে মানবজাতি, সীমান্ত বাংলা হয়তো জানল না তার বেদনা, কিন্তু দেখল ওদের দুচোখ মেলে। আর তাদের নৃশংসতা তাদের ব্যাধির ছাপ আপন অঙ্গে তুলে নিল, আপন মুখের অন্ন ওদের হাতে তুলে দিয়ে সারা পৃথিবীর সাথে তার এই প্রথম পরিচয়কে অক্ষয় করে রাখল।

তালতলির হাট তাই আজ বিশ্বের মেলা। সেই বিশ্ব মেলার কয়েকটি মাসেই বাকুলিয়ার মালু যেন ডিঙ্গিয়ে গেল কয়েকটি জীবন একটি শতাব্দী।

এদিকে দুনিয়ার কোলাহল, ওদিকে খাঁ খাঁ করছে স্কুল ঘর। পিটিয়ে পুটিয়ে যে দু চার গণ্ডা ছাত্রকে স্কুলে এনে হাজির করত সেকান্দর মাস্টার তারাও আজ অনুপস্থিত। পিয়নটাও পালিয়েছে। শূন্য স্কুল ঘরটিতে একলাই খুট খুট করছে সেকান্দর মাস্টার। এ ক্লাস সে ক্লাস ঘুর ঘুর করছে। বগলে তার হাজিরা বই।

হেডমাস্টারের ঘরে বসে বুড়ো মিত্তির। গত বিশ বছর ধরেই স্কুলের সেক্রেটারী তিনি। হেডমাস্টার ইস্তেফা দিয়ে চলে যাওয়ার পর ছাত্র শূন্য স্কুলের এই দায়িত্বটাও নিয়মিত নিষ্ঠায় পালন করে চলেছেন। সেকান্দরকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন : আর কেন সেকান্দর, চল এবার আমরাও কেটে পড়ি।

যেন মিত্তির মশায়েরই জবাবে হাজিরা বইগুলো টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারে সেকান্দর মাস্টার। গোঁৎ গোঁৎ করে বেরিয়ে যায়।

সামনেই পড়ে বাকুলিয়ার ট্যান্ডল বাড়ির ছোট ছেলেটি। বছর আটেক বয়স হবে হয়তো। বিনে ফিসে, বিনে মাইনায় ছেলেটাকে সেকান্দর ভর্তি করিয়ে নিয়েছিল স্কুলে। বইপত্রও নিজের পয়সায় কিনে দিয়েছিল মাস্টার। কিন্তু আজ স্কুলে বইগুলো রেখেই ছেলেটা কোথায় যেন পালিয়ে গেছিল।

কোথায় ছিলি সারাদিন? সেকান্দরের আচমকা রূঢ় স্বরে বুঝি কেঁদে দেয় ছেলেটি। মিনমিনিয়ে যা বলল তার অর্থ : রমজানের নতুন ম্যানেজার ওকে ডাকল। ও চলে গেল। ট্রাঙ্ক রোডে যে মেরামত হচ্ছে সেখানে এক চাক দু চাক করে মাটি ফেলল ছেলেটি, দিনের শেষে নগদ একটি টাকা পেল।

এখন বাড়ি যাবে। বইগুলো ফেলে গেছিল। বইয়ের জন্য এসেছে ও। ছেলেটির গালে পটাপট কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল সেকান্দর। হেঁটে চলল বাজারের দিকে।

বুঝি এই প্রথম মাস্টার সাহেবের রাগ দেখে হাসি পায় মালুর। সালাম দিয়ে পাশে পাশে চলে মাস্টারের।

বিড় বিড় করে কী যেন বকে চলেছে মাস্টার। শুধু একটি কথাই কানে এল মালুর–শুয়রের বাচ্চা রমজান।

বুঝি চরম প্রতিশোধ নিয়েছে রমজান। দূরে অলক্ষে থেকে ও অবিরাম নির্যাতনের তীর ছুঁড়ে চলেছে। আর পলে পলে সে তীরের বিষে জর্জর সেকান্দর মাস্টার।

দোকানের কাছে এসে থেমে যায় সেকান্দর। দোকানের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখে, মালু চলেছে পাশেই।

মিঞা বৌ তোকে আজই একবার যেতে বলেছে। কী নাকি জরুরি দরকার। কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না সেকান্দর। ফড়ফড় শব্দে ছাতাটা মেলে দ্রুত পা চালাল বাকুলিয়ার দিকে।

কম আশ্চর্য হবার কথা নয়। রাবুদের সূত্রে ফেলু মিঞার বৌকে মামী বলেই ডাকত মালু। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দুটো কথা বা একটা ফরমাশ কোনোদিন তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে মালু, এমন কোনো ঘটনা মনে করতে পারল না মালু। অথচ আজ তাকেই ডেকে পাঠিয়েছে। আকাশ পাতাল ভেবেও এ ডাকের কোনো হেতু খুঁজে পায় না মালু।

৩২.

আ-চষা দখিন ক্ষেত। অভিমানে মাটি যেন গুমরে মরছে। বড় বড় ফাটল পথে বুঝি সে অভিমানেরই বিস্ফোরণ। পায়ের তলায় শক্ত মাটি, ধপ ধপ আওয়াজটা কেন যেন শুকনো হাড়ের কান্নার মতো মনে হয় মালুর। দখিনের ক্ষেতে আবার কবে হেসে উঠবে সবুজ ধানের ঘোড়! যেতে যেতে সে কথাটাই বুঝি ভাবে মালু।

বড় খালের পুলটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় মালুকে। রাস্তা দিয়ে লম্বা একটি কনভয় চলেছে। সবকিছু ওলট পালট করা এই যুদ্ধ স্বচ্ছতোয়া বড় খালটিকেও রেহাই দেয়নি। তলার মাটি যেন ঘুঁটিয়ে তুলে এনেছে স্রোতের উপর। বড় খালে এমন ঘোলা পাখি কখনো দেখেনি মালু।

.

মিঞা পুকুরের কোণে সেই গাব গাছের তলায় দাঁড়ান মানুষটাকে দূর থেকেও চিনতে কষ্ট হয় না মালুর। পোশাকে একটুও বদলায়নি ফেলু মিঞা, পরনে সেই রঙিন সিল্কের বর্মি লুঙ্গি, গায়ে মলমলের পাঞ্জাবী। বুক পকেটে তেমনি ভাঁজ করা রুমাল। ছড়ির বাঁটের উপর হাত দুটো যেন বিশ্রাম নিচ্ছে।

কিন্তু, অমন একনিষ্ঠ দৃষ্টির ব্যাকুলতায় দখিন ক্ষেতের ফাটল চেরা বুকে কী খুঁজছে ফেলু মিঞা?

সুমুখ দিয়েই পাড়ে উঠে এল মালু। মিঞা যেন নজরই করল না। ততক্ষণে রিক্ততার হাহাকার ভরা দখিন ক্ষেত ছেড়ে ফেলু মিঞার দৃষ্টি কী এক উদাসীনতায় ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূরে, তালতলির তালসারির মাথায় স্তব্ধ হয়ে থাকা দিগ্বলয়ের দিকে।

আলিবর্দির বাংলা বুঝি ফিরে এল না ফেলু মিঞার জীবনে। মোগল পাঠানের রক্ত সেই যে পানসে হয়ে গেছে, শরাবী তেজে গরম হয়ে উঠল না সে রক্ত। শেষ দানেও হেরে গেছে ফেলু মিঞা। বৌর গায়ের শেষ সোনাটিও ছিনিয়ে নিয়ে যে তালুকগুলো পুনরুদ্ধার করেছিল ফেলু মিঞা সে সব তালুক প্রজাহীন, জনহীন কবরখানা। জমিগুলো সমর দফতরের হুকুম-দখলে।

ব্যর্থ ফেলু মিঞা। শস্যহীন ওই দখিন ক্ষেতের মতোই বুঝি ফাটল-চেরা, দীর্ঘশ্বাস ভরা ফেলু মিঞার বুকের ভেতরটা। হয়ত তাই দখিন ক্ষেতের সাথে আজ তার নতুন মিতালী। বুঝি মিঞা-বৌর সেই গয়না বেচা টাকায় ফেঁপে উঠেছে রামদয়ালের কারবার, লাল হয়ে উঠেছে রামদয়াল। ধূর্ত রামদয়ালের কূট বুদ্ধিটা অনেক দেরিতে ধরা পড়ল ফেলু মিঞার চোখে। রমজানের বেইমানীটাও।

দখল করা জমির ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে যুদ্ধ-দফতর। এই অঞ্চলের সে সব লেনদেনের মাধ্যম রমজান। এক কানি জমির ক্ষতিপূরণ পেয়ে হয়ত তিন কানি জমির ক্ষতিপূরণের রসিদে টিপসই দিচ্ছে অজ্ঞ কৃষক। এক ঘরের টাকা নিয়ে পাঁচ ঘরের টাকা বুঝে পেয়েছে বলে লিখে দিচ্ছে রমজানের হাতে। তবু কিছু নগদ টাকা তো পাচ্ছে তারা? ভাগ্যিস ছিল রমজান নইলে ওই ফৌজী দফতরের ধারে কাছেও কী ঘেষতে পারত ওরা?

সেই রমজান পুরাতন মুনিবকেও ভোলেনি। ও এসেছিল। কসম খেয়েছিল। অন্যের বেলায় যাই করুক না কেন, জন্মাবধি যার নিমক খেয়েছে তাঁর হক পয়সার এক পয়সাও এধার ওধার করবে না ও। আল্লার বরকতে রুজি তার কম নয়।  

চোপরাও বেইমান! টাকার কী আমার কমতি আছে? রেগে গেছিল ফেলু মিঞা, খেদিয়ে দিয়েছিল রমজানকে।

সন্ধ্যা নাবছে আবছায়া। মগরেবের আজান দেবে বলে ওজু করছে হাফেজ সাহেব। মসজিদটার কাছে এসে পেছন ফিরে দেখল মালু। গাব গাছের তলায় নিশ্চল মূর্তির মতো এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেলু মিঞা।

এসেছিস মালু? আয় জলদি দুটো খেয়ে নে। জোয়ারের সময় এল বলে। কোনো কিছু বলবার বুঝবার আগেই মিঞা-বৌ হাত ধরে ওকে নিয়ে এল রসুই ঘরে। পিঁড়িতে বসিয়ে এগিয়ে দিল ভাতের থাল।

দুটো সুটকেশ আর ছোট্ট একটা বিছানা বেঁধে তৈরি মিঞা-বৌ। কোথায় যাবে মিঞা-বৌ? আগামাথা হদিস পায় না মালু। জিজ্ঞেস করতেও কেমন যেন বাধে মালুর।

হাত ধুয়ে মালু বেরিয়ে আসতেই বলল মিঞা-বৌ, চল।

কোথায় চলবে তার নেই কোনো ঠিকানা। তবু সুটকেস দুটো হাতে তুলে নেয় মালু।

সুমুখে মিঞা-বৌ। বগলে তার ছোট বিছানাটা, মাঝখানে মালু। পেছনে মিঞা-বৌর বাঁদী সেই বিশ বছর আগে বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে যাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল মিঞা-বৌ। বাঁদীর হাতে পানদান আর খাবার ভর্তি একটি টিফিন ক্যারিয়ার। অন্ধকারের আড়াল নিয়ে বাড়ির পিছনের সুপারী বাগিচার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। আগাগোড়া যেন একটা রহস্য, ওই আবছা আঁধারটার মতোই দুর্ভেদ্য। ওরা কী পালিয়ে যাচ্ছে? ছোট্ট বিছানাটা কিছুতেই মিঞা-বৌর হাতে থাকতে চাইছে না। বার বার খসে পড়ছে, খুলে গেছে চিকন রসির বাঁধনটা। হোক না ওইটুকু বোঝা, পারবে কেন মিঞা-বৌ সামলাতে? জীবনে যে এক ঘটি পানি তুলে আনেনি পুকুর থেকে, টিব কলে দেয়নি একটুখানি চাপ তার পক্ষে একটি কম্বল, একটি বালিশ, একটি চাদরের বোঝা, সে তো বিরাট বোঝা।

আর বুঝি চুপ থাকতে পারে না মালু। লম্বা কদমে এগিয়ে এসে বলল, মামী, আমরা চলেছি কোথায়?

বড় খালে সাম্পান বাঁধা আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার মনে করল না মিঞা বৌ।

দখিনের ক্ষেতে নেবে ওরা পাশাপাশিই চলে। ডান হাতের সুটকেসটা মাটিতে রেখে মালু এক রকম ছোঁ মেরেই মিঞা-বৌর হাত থেকে বিছানাটা নিয়ে নেয় নিজের বগলে। সুটকেসটা হাতে নিয়ে আবার চলতে থাকে। তবু হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে মিঞা-বৌর। স্যান্ডেলের স্ট্রাপটা ছিঁড়ে গেছে। বাঁদীর হাতে উঠেছে স্যান্ডেল জোড়া। এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো ফাটা মাটির কামড়ে বুঝি ক্ষত বিক্ষত শরীফজাদির নরম পা। বার বার হোঁচট খেয়ে টলে পড়ছে। কী এক দোজখের আগুন যেন পিছু তাড়া করেছে, তাই মরিয়া হয়ে ছুটছে অন্তঃপুরবাসিনী হালিমা বিবি। মরিয়া হয়ে ছুটছে ওরা অন্ধকারে।

মালুর চোখে এ যেন একটা অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় দৃশ্য। মিঞা খানদানের কোনো বৌ পাল্কী ছাড়া আন্দরমহলের বাইরে পা দিয়েছে? সেই মিঞা বাড়িরই মিঞা-বৌ পালাচ্ছে? কথাটা ভাবতে গিয়েও মালুর গাটা কাঁটা দিয়ে যায়।

চেনা মাঝি, মিঞাদেরই রাইয়ত। ওরা উঠতেই ছেড়ে দিল সাম্পান। ছইয়ের ভেতর বিছানা পেতে দিল বাঁদী। শুয়ে পড়ল মিঞা-বৌ।

গলুইয়ের উপর বসে জলো হাওয়ার পরশ নেয় মালু।

কালো ঢেউয়ের বুকে দোল খেয়ে খেয়ে সাম্পান চলে। ছলাৎ ছলাৎ সাম্পানের পিঠে আছড়ে পড়া পানি লাফিয়ে ওঠে। কণা কণা ভেঙে পড়ে মালুর গায়ে।

ছপ ছপ ঝপ ঝপ বৈঠা পড়ছে আর সাম্পানের সেই পরিচিত ধ্বনির তরঙ্গটা মিষ্টি এক ডাকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দূর দূরান্তে-ক্যাককুর ক্যাককুর।

নৌকার চেয়ে সাম্পানটা অনেক সুন্দর, অনেক আরামের, যেন আজই প্রথম মনে পড়ল মালুর। স্বচ্ছন্দ মরালগতি সাম্পানের। মনোরম তার ভঙ্গি। লগির উটকো ঠেলায় নৌকোর মতো কেঁপে দুলে টক্কর খেয়ে চলে না। তর তর করে চলে সাম্পান গর্বিত গ্রীবা রাজহংসের মতো। উঠে বসেছে মিঞা-বৌ। ছইয়ের ভেতর থেকে মুখটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

মামী, ফেলু মামার কষ্ট হবে না? কে তার যত্ন আত্তি করবে? উনি তো বড় আয়েশী মানুষ। হঠাৎ শুধাল মালু।

তারা-জ্বলা রাতের ফিকে আঁধারে যেন চকমকির মতো দপ করে জ্বলে উঠল মিঞা বৌ। এক রাশ কথা যেন আঁচ পাওয়া বারুদের মতোই উঠে এল তার মুখ দিয়ে।

ফেলু মিঞার জন্য আবার ভাবনা? সে কী মানুষ? জানোয়ার। নইলে অমন করে কষ্ট দেয় বৌকে? যুদ্ধের ডামাডোল লাগতেই ছেলেমেয়েগুলোকে মিঞা-বৌ পাঠিয়ে দিয়েছিল ওদের মামার বাড়ি। নইলে ওগুলো হয় মানুষখেকোদের হাতে পড়ত, নয়ত উপপাসে মরত। মিঞা-বৌ অনেক সয়েছে, এখন মরতে রাজি নয়। শ্বশুর বাড়ি থেকে কত তাড়া এসেছে–যুদ্ধের হট্টগোল ছেড়ে নিরাপদে এসে থাক। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি উঠে আসতে সায় দেয় না ফেলু মিঞার খানদানী রক্ত। খেসারতের টাকাটা এনে নিরাপদ অঞ্চলে একটা বাড়ি, তাও করবে না ফেলু মিঞা। ভাইদের কাছেও যাবে না। সবই তার জিদ। বেশ পড়ে থাকুক ফেলু মিঞা তার জিদ নিয়ে। মিঞাবৌ চলল কুমিল্লা, তার বাপের বাড়ি। ছেলেগুলোকে তো মানুষ করতে হবে। দালানের খসে পড়া চুনবালি খেয়ে অনায়াসেই বাঁচতে পারবে ফেলু মিঞা। এসব লোক কী কখনো মরে? মরে না। বৌদের কষ্ট দেবার জন্যই বেঁচে থাকে এরা।

অন্তঃপুরের বধূ যেন খুঁজে পেয়েছে তার মুখ। সে মুখে লাগাম নেই আজ। কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়ে সবচেয়ে বেশি অবাক মানে মালু। গাব গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই নিশ্চল মূর্তিটাই কখন টেনে নিয়েছে ওর মনের সবটুকু সহানুভূতি। মনের পট থেকে মালু কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না ফেলু মিঞার সেই উদাস চোখের সবখোয়ানো দৃষ্টিটা।

সাম্পান চলে মরাল গতি। ক্যাঁককুর ক্যাঁককুর, তার গানের ডাকে ভেঙে যায় রাতের ঘুম। খালে পানির বুকে তারার চিকিমিকি।

৩৩.

কুমিল্লা স্টেশনের টিকেট ঘরটার সুমুখে দাঁড়িয়ে কেন যেন মনে হল মালুর কলকাতার বড় কাছাকাছি এসে পড়েছে ও। কলকাতাটা যেন কুমিল্লার পাশেই। এত কাছাকাছি এসেও কলকাতা যাবে না মালু?

তক্ষুণি মনটা বেঁধে ফেলল মালু। গান নেই, রানুদিরা নেই, তালতলিতে ফিরে যাবার অর্থ হয় না কোনো। তা ছাড়া কলকাতায় তো ওকে যেতেই হবে গানের জন্য। যেন এক ঝলক রোমাঞ্চিত বাতাস নেচে যায় মালুকে ঘিরে।

কিন্তু টিকেটের দাম শুনেই বুকটা ওর পানি হয়ে যায়। কুল্লে তিনটি টাকা মাত্র সম্বল। বাপের বাড়িতে পেট ভরিয়ে খাইয়ে ওকে বিদায় দেবার সময় টাকা তিনটি ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিল মিঞা-বৌ। মালুর ফিরে যাবার ভাড়া আর কিছু নাশতা পানির পয়সা, এ টাকায় তো আর কলকাতায় যাওয়া যাবে না?

একটার পর একটা ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। সৈন্য বোঝাই ট্রেন। ক্বচিৎ যাত্রীবাহী গাড়ি। স্টেশনের ভিড় থেকে একটু আলাদা হয়ে নানা কথা ভাবে মালু আর পস্তায়।

দুটি বছর কাজ করল রামদয়ালের দোকানে। মাসে বড়জোর তিনটে টাকা মালু খরচ করেছে। বাকী সব টাকাই তো ও জমা রেখেছে রামদয়ালের তহবিলে। আফসোস হয় মালুর, অন্তত পাঁচটি টাকাও যদি আপদ-বিপদের জন্য-রাখত সঙ্গে, তা হলে আজ এমন ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পস্তাতে হত না।

আবার একটা ট্রেন এল। ভক ভক করে ধোঁয়া ছাড়ল। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। গাড়িটার শেষের দিকে গদী আটা রং করা সুন্দর সুন্দর কামরা।

সেই কামরার একটি দরজা খুলে গেল। মালু দেখল জমকালো পোশাক পরা একটি মেয়ে প্রসাধনীর বিচিত্র চটকোলা মুখ বাড়িয়ে হাসছে। হাত ইশারায় কাকে যেন ডাকছে ও। মেয়েটির পাশে একটি লাল মুখ সাহেব। মালুর মনে হল ওকেই যেন ডাকছে মেয়েটি। বুঝি ভুলই করছে মালু নিশ্চয়ই আশ-পাশের অন্য কেউ মেয়েটির ইশারার লক্ষ্য। সামনে পেছনে ডানে বামে চেয়ে দেখল মালু। পেছনে খাকি পোশাক একটি লাল মুখ কোমরে হাত রেখে পাইপ টানছে। মালু নিশ্চিন্ত হল ওই সাহেবটাকেই ডাকছে মেয়েটি।

মেয়েটি নেবে এল। মালুর সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

হুরমতি?

এই জনারণ্যে বাঘ পড়লেও বুঝি এতটা চমকে উঠত না মালু।

ঠোঁটে রং লেপেছে হুরমতি। কাউফলের কোয়ার মতো রসমেদুর টুক-টুকে লাল ঠোঁট। চোখের নিচে গালের টোলে হাল্কা পোঁচের গোলাপী আভা। নিটোল দেহের উদ্ধত ভাঁজে সিল্কের পাতলা শাড়ির বাঁধনটা যেন নিলাজ আমন্ত্রণ। কাঁধের কিনার ঘেঁষে পিঠ ছুঁয়ে আঁচলটা ওর নেবে এসেছে মাটি অবধি। আঁচলের লতাপাতা আঁকা প্রান্তটা লুটোচ্ছে ধুলোয়। জুতো পরেছে হুরমতি। গোড়ালি তার এক বিঘতেরও উঁচু। অমন জুতো মালু দেখেনি আগে। সব মিলিয়ে বাকুলিয়ার হুরমতি সুন্দরী আজ বিশ্বের অপরূপা।

কিরে ভূত দেখলি নাকি? শুধাল হুরমতি।

ভূত দেখলেও কী আর অমন তাজ্জব বনত মালু?

বাহ। কোঁচা ঝুলিয়ে দিব্যি বাবু সেজে চলেছিস কই? মালুকে নিরুত্তর দেখে আবারও শুধায় হুরমতি। মালুকে কথা বলানোর জন্যই সুন্দর হাতের দুটো আঙ্গুল দিয়ে মালুর চিবুকটা ছুঁয়ে দেয় হুরমতি। স্টেশন ভর্তি লোকের সুমুখে এ কী কাণ্ড হুরমতির। কলকাতা যাচ্ছি, কোনো রকমে উচ্চারণ করে মালু।

ও, সে জন্যই এমন বাবুর মতো সেজেছিস? কই মালপত্র কোথায় তোর? হঠাৎ হুইসেল বাজে। অস্থির হয়ে উঠে গোরাটা। গাড়ি থেকে দু কদম এগিয়ে এসে কফ জমা গলায় চেঁচিয়ে চলে ও–হুরমাট হুরমাট।

চট করে হাতের ব্যাগটা খুলে ফেলল হুরমতি। একখানি দশ টাকার নোট মালুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল : যাচ্ছিস বিদেশে, সঙ্গে রাখ, কাজে লাগবে। সাহেবটার হাত ধরে গাড়িতে উঠে যায় হুরমতি। উঠতে উঠতে বলে : রাবু আপা আরিফা আপাকে সালাম দিবি। খালাম্মাকে কদমবুচি। তুই ভালো থাকবি। বাকী কথাগুলো চাপা পড়ে যায় রেল গাড়ির চাকার নিচে।

চলতি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখখানি বাড়িয়ে রাখল হুরমতি। ছলছলিয়ে উঠল ওর চোখ জোড়া। দু ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল। বাতাসের গায়ে মিলিয়ে গেল।

চমকে উঠে নিজেকেই যেন শুধাল মালু : জল কেন হুরমতির চোখে?

৩৪.

নে ধর, বন্ধুর নায়ে নীল বাদাম।

মালু ধরে এবং গেয়ে চলে। গাইতে গাইতে এক সময় শেষ লাইনেও এসে পড়ে।

অশোক ততক্ষণে তবলার গায়ে হাতুড়ি পিটতে লেগেছে। হঠাৎ তবলা ছেড়ে বেহালার ছড়টা গভীর মনোযোগে নিরীক্ষণ করছে। ধর বলে যে গানটা ধরিয়ে দিয়েছে মালুকে সেদিকে খেয়ালই নেই তার।

এমনই স্বভাব অশোকের। ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে চলা। নির্দিষ্ট পেশা নেই তার। নেশাও নেই। গান বাজনা নিয়ে মেতেছে তো মেতেই রইল। কিন্তু সে আর কদ্দিন। বড়জোর ছয় মাস। তারপর হয়ত লেগে গেল, দোকানের কাজে। দুপুরুষের পারিবারিক ব্যবসা। মাঝে মাঝে হাজিরা দিলেই চলে। কিন্তু না, অশোক যখন মেতেছে তখন দিন নেই রাত নেই শুধু দোকান আর দোকান। ভূতের মতো খাটবে। সবাইকে তটস্থ করে ছাড়বে। তারপর যেই অশোক সেই অশোক। দোকানের ত্রিসীমানায় কেউ দেখবে না ওকে, দেখবে হয়ত কোনো স্বদেশি মিছিলে বজ্রমুষ্টি উঁচিয়ে স্লোগান হাঁকছে।

হঠাৎ একদিন হয়ত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল অশোক। বেঁধে নিল ছোট-খাট একটা বোঁচকা। চাবিটা মালুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল : ওই দেরাজে টাকা আছে। আমি চললাম।

অশোক চলে গেল নবদ্বীপ অথবা কৈম্বাটোরে। এমনি করেই চলছে। বছর ঘুরে বছর আসে। আবার বছর ঘুরে যায়।

 কিন্তু এ রকম উড়নচণ্ডী লোকের সাথে কদিন থাকবে মালু? কেমন করে থাকবে? একটু থিতি নেই, না মনে, না কাজে। যেন আহলাদী খোকা নতুন নতুন খেলনা, নতুন জামা কাপড়, দেখলেই অমনি পুরানোটা ফেলে ছুটল নতুনটার পেছনে।

অভাব যার নেই আর নেই বড় কিছুর তাগাদা, এ বিলাস তাকেই পোষায়। কিন্তু মালু তো হাঁপিয়ে উঠেছে অশোকের মেসে।

শিয়ালদা থেকে নেবে বৌবাজার স্ট্রীটের মুখস্থ করা ঠিকানাটা খুঁজে বার করতে বেগ পায়নি মালু। সন্দেহ ছিল, ভয় ছিল, না জানি ওকে কী ভাবে নেবে অশোক।

কী রে এ্যাদ্দিন পরে তোর কলকাতা আসার কথাটা খেয়াল হল বুঝি। মালুর সমস্ত আশঙ্কা অমূলক করে ওর কাঁধে হাত রেখেছিল অশোক। সিঁড়ির গোড়ায় সেজেগুঁজে দাঁড়িয়েছিল অশোক। বেরুচ্ছিল কোথায়। কিছু খুচরো পয়সা আর ঘরের চাবিটা মালুর হাতে দিয়ে বলেছিল : বোমার ডরে চাকর বামুন ভেগেছে। নিচের হোটেলেই খেয়ে নিবি। পাশের ঘর দুটো আমার। বই আছে, ভালো লাগলে পড়বি, নতুবা ঘুমোবি।

মাঝ সিঁড়ি থেকেই আবার লম্বা লম্বা লাফে উঠে আসে অশোক। ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেয়। দেয়ালেরও কান আছে, বুঝি সে কথাটা মনে করেই মালুর মুখের কাছে মুখ এনে বলল : মেসটা কিন্তু হিন্দু মেস। তোকে হিন্দু পরিচয়ে থাকতে হবে। বুঝলি? ড্যাব ড্যাবা চোখ করে মালু। বাকুলিয়া গ্রামের সৈয়দ বাড়ির মুনশীজীর ছেলে আবদুল মালেক ওরফে মালু, কে না চেনে ওকে। এ কী বাহাত্তুরে কথা, কলকাতা শহরে এসে ওকে হিন্দু সাজতে হবে?

কয়েকটা বাজে লোক আছে এখানে। গোঁড়া আর মুসলিম বিদ্বেষী তাই। ব্যাপারটা মালুকে আর একটু স্পষ্ট করে সমঝিয়ে দিল অশোক।

আশ্চর্য হয়েও ব্যাপারটায় একটা কৌতুকের গন্ধ পায় মালু। অভিনয় করতে কখনো খারাপ লাগে না ওর। ও বলল, বেশ তো।

জাত? শুধাল অশোক।

জাত বৈদ্য। নাম মলিন কুমার দাশগুপ্ত ওরফে মালু। পিতা মৃত শ্রীবিজন কুমার দাশগুপ্ত। গড় গড় করে বলে যায় মালু। যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

বেশ বেশ। মালুর উপস্থিত বুদ্ধিতে খুশি হয়ে সিঁড়ি ধরে নেবে গেছিল অশোক।

প্রথম ঘরটা অশোকের শোবার ঘর। মামুলি বিছানা। মামুলি কয়েকখানি কাউচ। কিন্তু দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে তাজ্জব বনেছিল মালু। সেই তালতলির ক্লাবের মতো দুনিয়ার যত বাদ্যযন্ত্র, কোনোটার গায়ে গিলাপ, কোনোটা নাঙ্গা গায়ে মসৃণ সুন্দর। সতরঞ্চি পাতা মেঝের অর্ধেকটাই ওদের দখলে। আর দেয়ালের গায়ে গায়ে কাঁচ ঢাকা তাক। তাকে তাকে বই। অজস্র বই। এত বই এক সাথে কখনো দেখেনি মালু।

ওই ঘরটায় থাকবি তুই, বলেছিল অশোক।

ওই ঘরে? ওই বাদ্যযন্ত্রগুলোর সাথে একই সতরঞ্চিতে? মালু বুঝি বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুশি ওর ধরছিল না। যখন খুশি তুলে নাও একটি যন্ত্র। বুলিয়ে দাও হৃদয় নিঙড়ান একটি স্পর্শ। ওরা কথা কয়ে উঠবে। তোমার অব্যক্ত যত কথা নানা সুরে নানা ঝংকারে জানিয়ে দেবে মানুষের পৃথিবীটাকে। তোমার মনের কান্নায় কেঁদে উঠবে ওরা। তোমার খুশির ছোঁয়ায় নেচে উঠবে ওরা। অথবা টেনে নাও হারমোনিয়ামটা। আপন মনে গান ধর।

নাঃ হারমোনিয়ামটা এবার ছুঁবেই না মালু। প্রথম এই যন্ত্রটার প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা ছিল মালুর। অথচ অশোক, রানু, তালতলির ছেলে-মেয়েরা ওই যন্ত্র না হলে নাকি গাইতেই পারে না ওরা। আর ওদের দেখা-দেখি তালতলির দু বছরে মালুরও কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে, গানের সুর ভাঁজতে হলেই হারমোনিয়ামটা টেনে নেয় ও। এবার সেই বদ অভ্যাসটা কাটিয়ে উঠবে, মনে মনে সেদিন ঠিক করেছিল মালু।

আর ওই বইগুলো? সেও এক বিস্ময়। তুমি শুয়ে থাকবে, অথবা বসে, চারিদিকে তোমাকে ঘিরে বই আর বই। অভিজ্ঞতাটা কেমন, প্রত্যক্ষভাবে জানবার জন্য অধীর হয়েছিল মালু। ওই বইয়ের জগৎটাও দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়েছিল মালুকে।

সেই চেনা জীবন। বড় খালের ধারে ধারে আবাল্য-পরিচিত দুনিয়াটা অকস্মাৎ সেই চেনা জানার দুনিয়াটাকে পেছনে ফেলে মালু যেন নতুন জগতে ঠাঁই পেল। এখানে ক্রুরতা নেই। নিষ্ঠুরতা নেই। এখানে যুদ্ধ নেই। এখানে রমজান নেই, রামদয়াল নেই। এখানে ভালো লাগার জনদের স্মৃতির ছোঁয়ায় মন আর্দ্র হয় না, অকারণে কান্না পায় না। এখানে রাবু নেই, রানু নেই। এখানে শুধু গান, এখানে শুধু সুর। এখানে অনেক বই। আর মালু স্বয়ং। এ জগৎটা সম্পূর্ণ ভাবেই ওর আপনার। এ জগতের সে-ই একমাত্র অধীশ্বর।

মধুর এক অস্থিরতা, মিষ্টি এক উত্তেজনা। প্রথম রাতটা তো ভালো করে ঘুমোতেই পারেনি মালু।

যুদ্ধের বাকী বছর গুলো এ ঘরটাতেই কেটে গেল মালুর।

গানের আনন্দে, বাদ্যের বোলে, জাপানী বোমার ভয়াক্রান্ত কোলকাতার অন্ধকারে। আর সাধ্যমতো বই পড়ে। স্কুলে পড়া বিদ্যার পরিধিটাকে নিজের চেষ্টায় যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে নিয়ে।

কিন্তু আজ? ওই ঘরের রুদ্ধ হাওয়ায় মালুর যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনের ভিতর কী যেন গুমরে মরছে সারাক্ষণ। কী এক যন্ত্রণা ওর বুকের ভেতর বাসা বেঁধে অস্থির করে তুলেছে ওকে! কোথাও ছুটে যেতে চায় মালু। কিন্তু কোথায়? সে তো জানা নেই ওর।

এই মেসে আসার কয়েক মাস পরই অশোকের রান্নার দায়িত্বটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল মালু।

ভীষণ আপত্তি করেছিল অশোক।

মালু বলেছিল, হাতে পায়ে একটু মেহেন্নত না করলে শরীরটা আমার বিশ্রী লাগে অশোকদা। তা ছাড়া আপনিই বা হোটেলে খাবেন কেন?

আসলে শরীরের চেয়ে মনটাই বুঝি ওর বিশ্রী লাগছিল বিনা শ্রমে অন্যের ভাত গিলতে।

বুঝেছি। কিছু করে খেতে চাস তুই। বেশ তো। হেসেছিল অশোক। একটি একটি করে ঘরের সবগুলো কাজই মালুর হাতে এসে পড়েছিল। ঘর ঝাড়া, ঘর মোছা। বাজার করা, রান্না করা। লন্ড্রীর হিসেব রাখা, জিনিসপত্র জামা কাপড় গুছিয়ে রাখা।

তুই তো দেখি ছোটখাট একটা সংসার গড়ে তুললিরে। খুশির সুরেই বলতো অশোক।

এ সব কাজ করেও অঢেল সময় থাকতো মালুর হাতে। সে সময়টা গান বাজনায় আর বই পড়ে কেটে যেত।

মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসর বসাতে অশোক। গানের চেয়ে হয়তো হৈ-চৈ টাই হত বেশি। কিন্তু কখনো কখনো রীতিমতো ওস্তাদ গাইয়ে জুটে যেত। সে সব দিন অদ্ভুত ভালো লাগতো মালুর।

এর মাঝে বার তিন উধাও হয়েছিল অশোক। একবার এর্নাকুলামে। একবার সিকিমে। আর একবার উদয়পুরে। চার ছয় মাস করে একেবারে লাপাত্তা হয়ে থাকতো অশোক। মালু তখন নিজেই রাজা।

সবচেয়ে বিপদে পড়তো মালু বইয়ের তাকগুলোর সুমুখে দাঁড়িয়ে। কাঁচ রুদ্ধ বইয়ের জগৎটা যেন সারাক্ষণ হাতছানি দিয়ে ডাকতো ওকে। ওর মনে পড়ে যেত স্কুল দিনের কথা। কেন যে পড়াটা হল না ওর ভাবতে গিয়ে বদ নসিবটাকেই দোষতে হত ওর। কিন্তু নসিবের উপর সব দোষ চাপিয়ে মনটা মালুর স্বস্তি পেত না।

মনে পড়তো মৃতা মায়ের অভিসম্পাত। আলেমের ঘরেই জালেমের পয়দাস সেই প্রবাদ বচনটির উদ্ধৃতি দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন মা, পড়াশোনা হবে না মালুর। আশ্চর্য! মায়ের অভিসম্পাতটাই যেন খেটে গেল। মূর্খই রয়ে গেল মালু।

দুরু দুরু কাঁপত মালুর বুকটা। ভীরু ভীরু হাতে কাঁচটা সরিয়ে একটি কী দুটি বই বের করে নিত ও। কত রকমারি কিতাব। গল্প উপন্যাস ইতিহাস। ইংরেজি বাংলা। অনেক জায়গা বুঝত না মালু। বইয়ের মেলার মধ্যে বাস করে না-পড়াটা কেমন অপরাধ বলে মনে হত ওর।

গান বাজনা আর রান্না। তার সাথে বই পড়াটাও কেমন যেন ভালো লেগে গেল মালুর।

প্রায় জনশূন্য কলকাতা। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায় মিলিটারী কনভয়, সৈনিকের কুচকাওয়াজ, সামরিক গাড়িগুলোর কানফাটা গর্জন। রাতের আঁধার চিরে সাইরেনের কর্কশ চিৎকার।

পুস্তক আর গানের দেয়াল ফুঁড়ে এ সব চিৎকার পৌঁছত না মালুর ঘরে। ও যেন এক গৃহাবদ্ধ সাধনাচারী। পৃথিবীর কোলাহল বৃথাই দেয়ালে আছড়ে পড়ত। উল্টো আঘাত খেয়ে ফিরে যেত।

কিন্তু, এ কী স্বভাব অশোকের। বই কিনেছে, এখনো কেনে, কিন্তু, ভুলেও কোনোদিন ছোঁয় না সে বই।

শুধু সুর কেন, সঙ্গীত কেন–যা কিছু বড় আর মহৎ, সবই দীর্ঘ সাধনার ধন। তনুমন একসাথে করে তোকে গলা সাধতে হবে, দিনের পর দিন বছরের পর বছর। ভুলে যেতে হবে অন্য সব কিছু ডুবে যেতে হবে সঙ্গীতের রাজ্যে।

আজো মালুর কানে রিন রিন করে বাজে অশোকের উপদেশগুলো। অক্ষরে অক্ষরে সে উপদেশ পালন করে আসছে মালু। কিন্তু, এমন চমৎকার উপদেশটা নিজের জীবনে কেন কার্যকরী করে না অশোকদা? অথচ কী সুন্দর তার গলা, কত গভীর তার সুর জ্ঞান।

একান্ত বেয়াদবি মনে করেই প্রশ্নটা অশোককে কখনো শুধায়নি মালু। আজ আর শুধাবার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এই খামখেয়ালী মানুষটির অদৃশ্য বন্ধন ছিঁড়ে ও নিজেই আজ ছুটে যাবার ব্যাকুলতায় অস্থির।

৩৫.

যুদ্ধ থেমে গেছে। বিশ্রী বাফেল ওয়ালগুলো ভাঙা শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে আলোর ঢাকনি। আবার আলো ঝলমল লোকারণ্য এই মহানগরী।

সকালভর এতটুকু ফুরসুত পায়নি মালু। সূর্য উঠবার সাথে সাথেই বাবুদের চিড়ে-দই খাইয়ে ছুটেছে বাজারে। বাজার সেরে এসে দেখে, যে হাঁড়িটায় ডাল চড়িয়ে গেছিল সেটা ধুঁয়ো উগরোচ্ছে।

বেরুবার সময় জ্বলন্ত কয়লার উপর কিছু কয়লাগুঁড়া ছিটিয়ে দিতে ভুলে গেছিল মালু। গনগনে আগুনে ডালগুলো সব পুড়ে একটা কালো পাতের মতো হাঁড়ির তলায় চেপ্টে রয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী সরিয়ে চোখ মুখ ডলতে ডলতে এক কাণ্ডই করে বসল মালু। সাত তাড়াতাড়ি খালি হাতেই পাতিলের কানিটা তুলে ধরে ও। ধপ করে পড়ে যায় পাতিলটা। ছাঁত করে ওঠে আঙ্গুলের চামড়া। চড় চড় করে দুহাতের দশটা আঙ্গুলের চামড়া যেন উঠে এল। সে অবস্থাতেই তরকারি কূটে বাটনা বাটতে লেগে যায় মালু। ওদিকে পোড়া গন্ধে নাক পুড়িয়ে ক্রুদ্ধ মেস বাসীরা বাক্যবাণ ছুঁড়তে লেগেছে। কবে থেকে বলছি বিদেয় করে দাও ছোঁড়াটাকে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম ওর জ্বালায়। তা অশোক কী আর কানে তোলে? যতীন বাবুর গলাটাই সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।

গর গর করে কেঁপে যায় মালুর তেঁতে উঠা শরীর। ভারী বয়ে গেছে। সে কী রাঁধুনী, না কী বাটনা বাটতে এসেছে এত দূরের কলকাতায়!

যতীন বাবু, অবনী বাবু, ওরা পাঁচজন। সেই প্রথম এসেই এই মেসে ওদের দেখেছিল মালু। হোটেলেই খেত ওরা। কিন্তু কেমন করে যেন ওরা ভজিয়ে ভুজিয়ে ওরই সাথে খাবার ব্যবস্থা করেছিল। মালুর মতামতটা জিজ্ঞেস করেনি অশোক। তবু খুশি হয়েই তো ওদের পাকশাক দিন ধরে করে আসছে মালু।

মাইনের কথা অবশ্য ওরা তুলেছিল। মালুই বলেছিল দরকার নেই, যা দেবার অশোকদাই তো দেয় আমায়।

কিন্তু, ওই যে কথায় বলে বসতে দিলে শুতে চায়। তাই হয়েছে যতীন বাবুদের অবস্থাটা। যুদ্ধের সময় কোথায় ছিল ওই মেজাজ? দাদা ভাই পিঠ চাপড়ানি, মালুকে তখন কত খাতির, কত তোয়াজ। সেই দুর্দিনের উপকারটা আজ বেমালুম ভুলে গেছে ওরা।

শালা বেইমান আর বলে কাকে! আপন মনেই বিড় বিড় করে মালু। পোড়া আঙ্গুলগুলো জ্বলছে। কিছু ন্যাকড়া কুড়িয়ে আঙ্গুলগুলো প্যাঁচিয়ে নিল মালু।

খেতে বসে তেলে বেগুনে হল যতীন বাবু। এ্যাঁ ইলিশ মাছে পেঁয়াজ? বাবার জন্মে কেউ শুনেছে, না দেখেছে? ডাল কই? র‍্যাশনের এই কটকটে চালের ভাত ডাল ছাড়া গেলা যায়?

মনে মনে হেসে বুঝি কুটি পাটি খায় মালু। আঙ্গুল দিয়ে অবাধ্য ঠোঁট দুটোকে চেপে ধরে ও। বাছাধন, এতটি বছর যে ইলিশে পেঁয়াজ খেলে সে কী বোমার ভয়েই লক্ষ করনি এ্যাদ্দিন?

ইস্, দেখ শালার কাণ্ড। ঘ্যাট রেঁধেছে না ওর মুণ্ড। ডাঁটাগুলো একেবারেই কাঁচা, কচ কচ করছে। কুমড়োগুলোও যদি সেদ্ধ হত–ওহে গাঙ্গুলী দেখতে একটা ভালো চাকর। এতবড় যুদ্ধের ফাঁড়াটা কেটে গেল এবার দেখছি এ ব্যাটার জুলুমেই অক্কা পেতে হবে। না খেয়ে উঠে যায় যতীন বাবু। কেমন জব্দ। কী এক নির্দয় খুশিতে পোড়া আঙ্গুলের জ্বালাটাও তখনকার মতো ভুলে যায় মালু।

আজকের মধ্যেই ঠেঙ্গিয়ে বের করছি তোকে। কোঁচাটা গুছিয়ে অফিসের পথে রাস্তার দিকে ছুটতে ছুটতে জানিয়ে যায় যতীন বাবু।

হুঁ। খুব জানা আছে মালুর। ওই লম্ফঝম্ফই সার। আশি টাকার কেরানী বিনে মাইনের চাকরের হাতে কাঁচা কচুও গিলতে পারে। দিনে অশোকের ফেরার কথা ছিল না। কিন্তু রাতেও ফিরল না অশোক। অনেকক্ষণ খাবার পাহারা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মালু।

অশোক ফিরল পরদিন সকালে, যখন রোববারের কলতলায় কেরানী বাবুদের কাপড় কাঁচার ধুম লেগেছে। সঙ্গে ওর গণ্ডা দেড়েক বন্ধু। ওদের নিয়ে বুঝি আসর বসবে আজ।

ওদের চা দিয়েই বাজারে চলে গেল মালু।

বাজার থেকে ফিরে আবার চায়ের ফরমাশ পেল মালু।

আসর ওদের গুলজার। ওরা শিক্ষানবিস। তাই কোনো শৃঙ্খলার বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবলা সারেঙ্গী তানপুরা, যার যেটা পছন্দ কোলে নিয়ে বসে গেছে। মহড়া দিচ্ছে সদ্য শোনা কোনো যন্ত্র সঙ্গীতের। নিচে তখন ঝুপ ঝাপ মেস বাবুদের সমবেত গোসলের শব্দ, আর হৈ হাঁক। মালুর মনে হল সেই শব্দ কোলাহলের সাথে পাল্লা দিয়েই অশোকের বাদ্যযন্ত্রগুলো সুরের কলহ জুড়েছে।

পোড়া আঙ্গুলের জ্বালাটা এখন একটু কমেছে মালুর। কিন্তু, ফোসকা পড়ে গেছে কয়েকটা আঙ্গুলে। তবু যত্নের সাথেই রান্না করল মালু।

রোববার। হপ্তায় ওই একটি দিনই বাবুদের একটু ভালো খাওয়া, অর্থাৎ, অন্যদিনের চাইতে একটু বড় মাছের টুকরো, মুগ ডালে মাছের মুড়ো, একটি ভাজি, একটি তরকারি। তা ছাড়া অশোক, অশোকের বন্ধুরাও খাবে। ওদের জন্য আলাদা করে কিছু মাছও ভেজে নিল মালু।

রান্নার পাট তুলে স্নান করে নিল মালু। গাঙ্গুলী মশায়কে খাইয়ে দিল। উনি চলেছেন শহরতলীতে আত্মীয় দর্শনে। অন্যদের তাড়া নেই।

যতীন বাবু এখনও ফেরেনি। খাবার আসন সাজিয়ে একটি বই নিয়ে বসল মালু। দু চার পাতা পড়তে না পড়তেই বুঝি ঝিমুনি এসে গেল ওর। হঠাৎ একটা শোরগোল উঠল। ঝিমুনিটা ভেঙে গেল মালুর। বই বন্ধ করে মাছি তাড়ায় ও। আর উৎকীর্ণ হয়। দরজার দিক থেকে ভেসে আসছে যতীন বাবুর উত্তেজিত গলা।

তক্ষুণি আমার সন্দেহ হয়েছিল। যে হারে পেঁয়াজ খায়, ব্যাটা মুসলমান না হয়েই যায় না। কেউ তো গ্রাহ্য করলে না আমার কথা। এখন? এখন জাত ধর্ম সব খোয়ালে তো?

বড় মেসবাড়ি। বাসিন্দার সংখ্যা কম নয়। রান্না হয় পাঁচটা আলাদা পাকে। হট্টগোল শুনে পিল পিল করে বেরিয়ে আসে সবাই। এক তলার বারান্দা আর খোলা উঠোনে রীতিমতো ভিড় জমে যায়।

নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ প্রৌঢ় তারিণী বাবু। মেসে থাকলেও স্বপাকে তার আহার। খবরটা শুনে বেজায় মুষড়ে পড়েছেন তিনি। যতই দূরে দূরে থাকুক না কেন, তবু এক মেস তো? ছোঁয়াছুঁয়ি যে হয়ে যায়নি কে বলবে? এ্যাঁ, এই কাণ্ড, যেন বিলাপের সুর তারিণী বাবুর।

কেমন ধারা হিঁদু গো তোমরা? বাড়িতে একটা জলজ্যান্ত মুছলমান রয়েছে, এ্যদ্দিন টের পাওনি? বারান্দার ভিড় থেকে কে যেন বলল। আপনি ছিলেন কোথায়? উঠোনের ভিড় থেকে উঠে আসে দুরন্ত জবাব। বাজে বকবেন না মশায়। অমন বাঁকা জবাব পেয়ে প্রথম জন বুঝি চটেই যায়। দ্বিতীয় জন নাছোড়বান্দা। ত্বরিতে পাল্টা জবাব পাঠিয়ে দিলেন তিনিঃ খুব এখন হিঁদুর দরদী সেজেছেন মশায়। ওদিকে মুসলমানের হোটেলে ঢুকে যে মুরগি খেয়ে আসেন সেটা কিছু না, না?

প্রথম বা দ্বিতীয় জন ভিড়ের জন্য কেউ কারো মুখ দেখছেন না। শুধু স্বর চিনে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে চলেছেন। হয়ত আড়াল ছেড়ে সুমুখেই এগিয়ে আসতেন তারা, কিন্তু উত্তেজনাটা ততক্ষণে অন্য দিকে গড়িয়ে গেছে।

যতীনের নেতৃত্বে আস্তিন গুটিয়েছে দু তিনজন। আস্তিন গুটিয়ে পাক ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে ওরা।

ছ্যাঁত করে ওঠে মালুর বুকটা। ওরা কী মারতে চায় ওকে? ওর গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। কিন্তু মুহূর্তেই যেন জেগে ওঠে ওর পৌরুষ সত্তাটা। ধর শালার নেড়েটাকে, একটু হাত সুখ করে নিই। কে যেন বলল। না হে জীবন। ও সব মারধোরে যেও না। বাংলায় এখন লীগ মিনিস্ট্রি খেয়াল আছে? ওপরের বারান্দা থেকে নেবে আসে প্রবীণ বাসিন্দার হুঁশিয়ার কণ্ঠ।

বহুরূপী বাছাধন। লুকিয়ে লুকিয়ে আর কতদিন আমাদের জাত মারবে। দয়া করে এবার বিদেয় হও তো। ক্রোধ আর বিদ্বেষের বিকৃতি যতীন বাবুর কথায়, মুখের চেহারায়।

কিন্তু, কোথায় মালু? পাক ঘরে যে ওর টিকির চিহ্নও নেই।

এ্যাঁ, পালিয়েছে? এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাল কখন?

আরে মশায়, চোখ কী আপনাদের সজাগ ছিল? আপনারা তো এ ওর মুণ্ডপাত করছিলেন। কে যেন বলল।

শালা ভারি বজ্জাত তো!

না-না, এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালায়নি। ভালো করে দেখ। চল কলতলার দিকটা দেখি তো? পাঞ্জাবীর আস্তিন দুটো আরো কয়েক ইঞ্চি গুটিয়ে কলতলার দিকে ছুটে আসে যতীন বাবু।

না। এখানে নেই।

ভাড়ার ঘর?

না।

পায়খানা?

সেখানেও নেই।

আরে ওই ঘরটা দেখতো? দরজাটা যেন বন্ধ ঠেকছে?

যতীন বাবুর দল হুড়মুড়ি খেয়ে পড়ে দরজাটার সুমুখে।

এক কালে গোসলখানা ছিল ঘরটা। বর্তমানে হাবিজাবি মালে ভর্তি। ধপাধপ কয়েকটি লাথি পড়ে দরজাটার গায়। দুর্বল দরজা ক্যাঁক ক্যাঁক আর্তনাদ তুলে কেঁপে যায়। ঝুর ঝুর ঝরে পড়ে কিছু চুন বালি। ধস করে পড়ে এক চাঙ্গড় পলেস্তারা।

দরজা ভাঙার জন্য নিঃশব্দে অপেক্ষা করে মালু।

অদ্ভুতই বটে। নড়বড়ে দরজাটা ভাংতে ভাংতেও একেবারে ভেঙে পড়ে না। প্রচণ্ড আঘাতের মুখে টলতে টলতেও দাঁড়িয়ে থাকছে। বুঝি একটু ভাববার অবসর দিচ্ছে মালুকে।

কিন্তু, অমন কাপুরুষের মতো পালাচ্ছেই বা কেন মালু? কেন দরজায় খিল এঁটেছে? নষ্ট করছে ওদের ধর্ম আচার, ভুল পরিচয় দিয়েছে? বেশ তো, বিচার করুক না ওরা। নতুবা পথ করে দিক ও বেরিয়ে যাবে। যদি মারে? স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের অন্ধকারে মুঠো দুটো শক্ত হয়ে আসে মালুর। সিনাটা সিধা করে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ও।

আহা, অশোককে একবার ডাক না। ওর লোক, যা করবার সেই করুক। একটা চিকন গলা বুঝি সুবুদ্ধির সন্ধান দেয় ওদের।

লাথালাথিটা মুলতুবি রেখে ওরা উঠে যায় দোতলায়, অশোকের ঘরের দিকে।

নিছক একটা সন্দেহ নয়। নিজ কানে শুনে এসেছে যতীন বাবু। সাক্ষী রমেন চক্রবর্তী। অশোকের কামরার পরের পরেরটায় একেবারে দক্ষিণের সিটে থাকেন যে রমেন চক্রবর্তী, তিনিই। তিনিও ছিলেন যতীন বাবুর সাথে।

সেই যে রাকীবুদ্দিন ভদ্রলোক অশোকের আসরে হামেশাই যাঁকে দেখা যায়? তিনিই তো ফাঁস করে দিয়েছেন আসল কথা। শিয়ালদর মোড়ে দেখা তাঁর সাথে। যতীন বাবুকে দেখেই বললেন : ভালোই হল আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল। যাচ্ছিলাম আপনাদের মেসের দিকেই।

কী ব্যাপার বলুন তো? শুধাল যতীন বাবু।

মালেককে মেহেরবানী করে বলবেন, আজই যেন দেখা করে আমার সাথে। আমার হোটেলে।

যতীন বাবু তো আকাশ থেকে পড়লেন। চেনা তো দূরের কথা, ও রকম একটা নাম এই প্রথম শুনলেন তিনি।

আরে মশায়, মালেক–আবদুল মালেক ডাক নাম মালু। আপনাদের মেসে অশোকের ঘরেই তো থাকে ছেলেটি। খাসা একখানি গলা, গায় চমৎকার। যতীন বাবু চিনছেন না দেখে ভালো করেই চিনিয়ে দিলেন রাকীব সাহেব। মালু এবং মালেকে যে কী দুস্তর ব্যবধান সেটা বোধ হয় জানেন না তিনি। সব শুনে অশোক থ মেরে রইল। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুই যেন বলার নেই তার।

নিজে না হয় জাত ধৰ্মো মান না বাপু, তাই বলে মোছলমানের ছেলেকে এনে মেসে জায়গা দেবে? এতগুলো লোককে ওই ম্লেচ্ছটার পাক খাওয়ালে? ছি : রামো : তারিণী বাবু বুঝি এখুনি বমি করবেন।

নিরুত্তর অশোক। গোটা মেসটাই মারমুখো। গোটা মেসটাই কৈফিয়ত চাইছে ওর কাছে। এত দৃষ্টির ধিক্কার আর কৈফিয়ত তলবের মুখে ও অসহায়।

হাবিজাবি মালের ডিপো ওই স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরটার ভেতর একটি সেকেন্ড যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলে। মালু ভেবে পায় না, কেন নেবে আসছে না অশোক। কেন এই নরক যাতনা থেকে মুক্তি দিচ্ছে না ওকে।

সেই যে লুকিয়েছে মালু, আট কী দশটা মিনিট কেটে গেল। আর এই কয়টি মিনিটেই যেন একটা যুগ পেরিয়ে এল মালু। অশোকদা ভালো। অশোকদা চমৎকার। কিন্তু সব ভালো লোকগুলোই কেন যেন ভীরু হয়। ভালো লোক অশোকদাও ভীরু। কী এক সংকল্পের দৃঢ়তায় কঠিন হয়ে আসে মালুর মুখের পেশী। ঢুস করে হুড়কো পড়ার শব্দ হল। খুলে গেল দরজটা। হতবাক হয়ে রইল লোকগুলো।

ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল মালু।

ওরা চেয়ে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *