১৯৪৫ সনের এপ্রিল মাস। রুশ সৈন্যরা এগিয়ে আসছে বার্লিনের দিকে। তাদের দলপতি মার্শাল জর্জি ঝুকভ’। তার প্রধান দুই সহকারীর একজন জেনারেল আইভান কোনোভ। অন্যজন জেনারেল ভাসিল চুইকভ। তাদের সৈন্যসংখ্যা ২৫ লাখ। ট্রাকের ওপর বসানো কাতুশা রকেটের সংখ্যা ৩ হাজার ২৫৫, ট্যাংকের ংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। দূরপাল্লার কামান আছে ৪১ হাজার। বুকভের বাহিনীকে সাহায্যকারী বিমানের সংখ্যা ৭ হাজার। চলে এসেছে বার্লিনের কাছাকাছি। এরা যে-কোনো সময় বার্লিনে ঢুকে পড়বে। তাদের দূরপাল্লার কামানের আওয়াজ বার্লিনবাসী সারাক্ষণ শুনছে। হিটলার নিজেও শুনছেন। তিনি সেই শব্দ শুনতে শুনতে বললেন, যে-কোনো মূল্যে বার্লিন রক্ষা করতে হবে। রুশরা বার্লিনে ঢুকে পড়লে একদিক দিয়ে ভালো হবে, ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা এটা পছন্দ করবে না। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করবে।
রাজধানীর কমান্ডান্ট মেজর জেনারেল হেলমুট রোম্যান। তিনি হিটলারের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারছিলেন। হিটলার বললেন, আমার বিমানবাহিনী কোথায়?
হেলমুট বললেন, বিমান আকাশে উড়তে পারছে না। জ্বালানি নেই। হিটলার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, জ্বালানি নেই কেন? জেনারেল গথার্ড হেইনরিচকে টেলিফোনে ধর। সে বলুক বিমানবাহিনীর জন্যে জ্বালানি কেন নেই। জেনারেল হেইনরিচকে টেলিফোনে ধরা গেল না। জেনারেল উইলহেম। মোনবিককে পাওয়া গেল।
জেনারেল মোনকি বললেন, আপনি যাতে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে পারেন তার জন্যে আমি বিশেষ ব্যবস্থায় দুটি বিমান প্ৰস্তুত রেখেছি।
হতভম্ব হিটলার বললেন, আমি পালিয়ে যাব?
জার্মান জাতিকে রক্ষার জন্যে আপনার বেঁচে থাকা জরুরি।
হিটলার কঠিন গলায় বললেন, আমাকে পালিয়ে যেতে হবে? আমাকে রক্ষা করার জন্যে অমর জেনারেলরা কোথায়?
জেনারেলের বক্তব্য শোনা গেল না, কারণ কাতুশা রকেট, যার আরেক নাম স্টালিন অরগান্স, বৃষ্টির মতো বার্লিনে আসতে শুরু করেছে।
২০ এপ্রিল হিটলারের জন্মদিন। হিটলার তাঁর বান্ধবীকে পাশে নিয়ে বাঙ্কারে বসে ছিলেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল আলফ্রেড জোডল। তিনি শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, জার্মান জাতি তার শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমাণ করবে। অবশ্যই আমরা বার্লিন রক্ষা করব। হিটলার শ্যাস্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিয়মমাফিক গ্লাস ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, আজ কি অন্যদিনের চেয়ে বেশি গোলাবর্ষণ হচ্ছে?
ইভা ব্ৰাউন বললেন, যুদ্ধের আলাপ কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ থাকুক। আসুন আমরা আনন্দময় কোনোকিছু নিয়ে আলাপ করি।
কেউ কোনো জবাব দিল না। হিটলার ইভা ব্ৰাউনের দিকে সামান্য ঝুকে এসে বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
ইভা ব্ৰাউন বললেন, হঠাৎ বিয়ের কথা আসছে কেন?
হিটলার বললেন, আমার ধারণা আমরা পরাজিত হতে যাচ্ছি। যদি সত্যি তাই ঘটে আমি আত্মসমৰ্পণ করব না। নিজেকে হত্যা করব। আমার মৃত্যুর পর ইতিহাসে লেখা হবে। আমার একজন রক্ষিতা ছিল, তা আমি চাই না।
হিটলার দ্বিতীয় দফায় শ্যাস্পেন নিলেন। টোস্ট করলেন তার বান্ধবীর সঙ্গে। নরম গলায় বললেন, আমার সুখ এবং দুঃখের চিরসঙ্গী ইভা ব্ৰাউন।
হিটলার এবং ইভা ব্ৰাউন মাটির অনেক গভীরে বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের বান্ধবপুরের একজন (হাদিস উদ্দিন) বাঙ্কারের মতোই একটি জায়গায় বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছে। হরিচরণের মাটির নিচের গুপ্তঘর। যে ঘরে যাবার একটাই পথ, সিন্দুকের ভেতর দিয়ে। হাদিস উদ্দিনের গুপ্তঘরে সময় কাটানোর পেছনে কারণ আছে। সে নানান জিনিসপত্র গুপ্তঘরে রাখছে। এর মধ্যে রেশমি রুমালে মোড়া একান্নটা স্বর্ণমুদ্রাও আছে। হাদিস উদ্দিন যতবারই গুপ্তঘরে যায় স্বর্ণমুদ্রা গুনে দেখে। দুভাবে গুনে। প্রথমে এক থেকে একান্ন, তারপর শুরু হয় উল্টোদিকে গুনা। ৫১-৫০-৪৯-৪৮…
গুপ্তঘর সে ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। সেখানে পাটি বিছানো আছে। বালিশ আছে। কলসিভর্তি পানি আছে। মোমবাতি, দেয়াশলাই আছে। একটা টর্চাও আছে। হাদিস উদ্দিন পাটিতে শুয়ে গুনগুন করে মাঝে মধ্যে গান গায়। গান তার নিজের রচনা। সুরও তার নিজের। বদ্ধঘরের কারণে গানের শব্দ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে। হাদিস উদ্দিনের বড় ভালো লাগে।
ভরদুপুর। গুপ্তঘর অন্ধকার। পাটিতে শুয়ে হাদিস উদ্দিন নিচুগলায় গান করছে–
ও আমার সোনার মোহররে
মোহররে মোহররে মোহররে
তোর মনে দুঃখ? দুঃখ? দুঃখ?
আমার মনে সুখ।
ও আমার সোনার মোহররে
মোহররে মোহররে মোহররে…
অনেকবার করে ফিরে আসছে। হাদিস উদ্দিনের মনে হচ্ছে ‘ঘরভর্তি মানুষ একসঙ্গে ‘মোহররে’ বলে গান করছে।
এই সময় হঠাৎ করে বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দের মতো শব্দ হলো। রিনারিনে গলায় কে যেন হাসল। হাদিস উদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘর অন্ধকার, তবে সিন্দুকের খোলা ডালা দিয়ে কিছু আলো আসছে। গুপ্তঘরের ভেতরটা আবছা! আবছা চোখে আসে। হাদিস উদ্দিনের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা সে কী দেখছে? ঘরের এক কোণে দেয়ালের দিকে মুখ করে দশ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে বসে আছে। নিজের মনে খেলছে। এমন কি হতে পারে কোনো বিচিত্র উপায়ে মীরা নেমে এসেছে? না, তা কখনোই না। মেয়েটা মীরার চেয়ে অনেক বড়।
হদিস উদ্দিন বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহপাক রক্ষা কর। তুমি গরিব বান্দাকে রক্ষা করা। ইয়া রহমানু ইয়া রহিমু ইয়া মালিকু। হাদিস উদ্দিন চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করেই মনে হলো বিরাট বোকামি হয়েছে। তার মৃত্যু হবে চোখবন্ধ অবস্থায়। সে যে মারা গেছে। এই খবরটাও কেউ পাবে না। কে আসবে গুপ্তঘরে খোঁজ নিতে? হাদিস উদ্দিন চোখ মেলল। মেয়েটা এখনো আছে, তবে সে দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে। হাদিস উদ্দিন মেয়েটাকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। গোল মুখ, কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক। চোখ জ্বলজ্বল করছে।
হাদিস উদ্দিন বলল, এই। এই।
মেয়েটা ফিরেও তাকাল না। হাতে কী নিয়ে যেন খেলছে। সুতার মতো কিছু। মেয়েটার হাতে কয়েক গোছা করে চুড়িও আছে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে।
হাদিস উদ্দিন দেয়াশলাই হাতে নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে দেয়াশলাই জ্বালাল। মোমবাতি ধরাল। এখন আর মেয়েটা নেই। তবে সুতাগুলি আছে। লাল নীল কিছু সুতা। হাদিস উদ্দিন গুপ্তঘর থেকে উঠে এলো। কানে ধরে প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে কখনো গুপ্তঘরে নামবে না। বিনা কারণে প্ৰাণ দিয়ে লাভ কী?
আতরের শ্বশুরবাড়িতে ভুত হাম্বর খুব যন্ত্রণা করছে। গত অমাবশ্যায় তাকে দেয়া গজার মাছ সে খায় নি। বাঁশঝাড় উলটাপালট করে এক কাণ্ড করেছে। তার সমস্যা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সে পুকুরে ঢ়িল মারছে। টিনের চালে চিল মারছে। ছোটখাটো ঢ়িল না। চাষাক্ষেত থেকে তুলে আনা মাটির বড় বড় চাঙ্গড়। গভীর রাতে ছোট বাচ্চাদের মতো ওয়াও ওয়াও কান্নার শব্দ করছে।
আমিনা বেগম বললেন, ঘটনা বুঝেছি।
আতর ভীত গলায় বলল, কী বুঝেছেন?
তোমার সন্তান হবে। এই কারণে হাম্বরের মিজাজ খারাপ। এখন তুমি আমাকে বলো, সন্তান কি হবে?
আতর মাথা নিচু করে থাকল, কিছু বলল না।
আমিনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, এত বড় ঘটনা আমারে তুমি জানাবা না? শাহনেয়াজ জানে?
না।
আমিনা বেগম বললেন, হাম্বর যে ভাব ধরেছে তোমারে এখানে রাখা বিপদজনক। তোমারে বাপের বাড়ি পাঠায়া দিতেছি। সন্তানের চল্লিশ দিন না হওয়া পর্যন্ত বাপের বাড়িতে থাকবা। তারপর আসবা।
আতর বলল, আমি এইখানে থাকব। কোনোখানে যাব না।
বৌমা, তুমি তো কোনো বিবেচনার কথা বললা না।
আতর বলল, আমি এইখানেই থাকব। বাপের বাড়িতে যাব না। হাম্বর যদি আমারে মেরেও ফেলে আমি যাব না।
আমিনা বেগম বিরাট দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বাড়িবন্ধন নতুন করে দিলেন। হামিদাকে কঠিন নির্দেশ দিলেন- সব সময় আতরের হাত বা শাড়ির অংশ ধরে থাকতে হবে। আতর যখন গোসলখানায় যাবে বা বাথরুমে যাবে তখনো এই অবস্থা। রাতে তার ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে আমিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি ছেলের বৌকে নিয়ে খাটে শুচ্ছেন। মেঝেতে ঘুমাচ্ছে দু’জন দাসী। ঘরের চারকোনায় সারারাত চারটা হারিকেন জ্বলে। খাটের নিচে মাটির সরায় থাকে কয়লার আগুন।
নতুন জীবনযাপন আতরের ভালো লাগছে। কী অদ্ভুত অনুভূতি! তার শরীরের ভেতর একজন কেউ বড় হচ্ছে। একদিন সে পৃথিবীর আলো দেখবে। আতরকে ডাকবে ‘মা’। হামাগুড়ি দিয়ে একা একা বারান্দা থেকে উঠানে নেমে যাবে। উঠানে শুকাতে দেয়া ধান মুখে দিয়ে কাঁদবে। আতর তাকে কোলে নিয়ে বলবে, ‘আমার বাবা গরু। আমার বাবা ধান খাওয়া গরু।’
আতরের পেটের সন্তান ছেলে না মেয়ে জানার জন্যে আমিনা বেগম গণক আনিয়েছেন। শ্ৰীপুরের বিখ্যাত গণক কাশেম মিয়া। এই গণকের গনা অভ্রান্ত। তিনি কাঁঠাল পাতা দিয়ে গনা গুনেন। একটা কাঁঠাল পাতায় খেজুর কাঁটা দিয়ে ছেলে লিখে কাঁসার বদনায় রাখা হয়। তুলারাশির দুইজন তর্জনী দিয়ে বদনার কানা শূন্যে তুলে ধরেন। কাশেম মিয়া মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলে যদি বদনা আপনা আপনি ঘুরতে থাকে তাহলে ছেলে। আর বদনা। যদি স্থির থাকে তাহলে মেয়ে। তিনবার পরীক্ষা হলো। তিনবারই পাওয়া গেল মেয়ে। আমিনা বেগম হতাশ গলায় বললেন, হায় হায়, কী সর্বনাশ!
আতরের শ্বশুর আব্দুল গনি সাহেবের মনটাও খুব খারাপ হয়েছে। তারপরেও তিনি মনের দুঃখ চাপতে চাপতে বলেছেন, সংসারে প্রথম সন্তান কন্যা হওয়া ভাগ্যের কথা। রসুলে করিম নিজে বলেছেন।
গণক কাশেম মিয়ার ভাগ্য খারাপ। গণনায় মেয়ে পাওয়া গেলে বখশিশ, তেমন পাওয়া যায় না। দুঃসংবাদ দেবার পর আবার বখশিশ, কী? মেয়ে আসা মানে তো দুঃসংবাদই।
শুধু কবি শাহনেয়াজকে ‘মেয়ে আসছে। সংবাদে অত্যন্ত উৎফুল্ল মনে হলো। ছেলেদের সুন্দর নাম নাই বললেই হয়। সেই তুলনায় মেয়েদের কত বাহারি নাম আছে! মেয়ের নাম দিয়ে অন্তমিল দেবার শব্দও অনেক থাকে। কবি শাহনেয়াজ দুই নম্বরি এক হাতিমার্কা খাতায় মেয়েদের নাম লেখা শুরু করেছে।
আঁখি
নাম সুন্দর। তবে চন্দ্ৰবিন্দু খারাপ লাগছে! চন্দ্ৰবিন্দু বাদ দিয়ে ‘নয়ন’ রাখা যেতে পারে। নয়ন থেকে নয়না। আবার নয়নতারাও খারাপ না। ডাবল অর্থ। চোখের মণি এবং নয়নতারা ফুল। এক থেকে দশের ভেতর নম্বর দেয়া হলে যা দাঁড়ায়।
আঁখি ৫
নয়না ৬
নয়নতারা ৭
ধবলিমা
কন্যার গাত্রবর্ণ যদি ধবলা হয় তাহলে এই নাম সুন্দর। ধবলিমার বদলে সিতিমা দেয়া যেতে পারে। সিতিমা’র অর্থ ধবল। দ্বৈত অর্থবাহক আরেকটি নাম আছে। সফেদা। একই সঙ্গে শুভ্র এবং ফল। এক থেকে দশের ভেতরে নম্বর নিম্নরূপ
ধবলিমা ৭
সিতিমা ৫
সফেদা ৬
[কবি শাহনেয়াজের সত্যি সত্যি একটা কন্যাসন্তান হয়। কবি নামের খাতা নিয়ে কন্যার সামনে উপস্থিত হবার পর আব্দুল গনি তাকে ধমক দিয়ে বলেন, নামের খাতা নিয়া দূর হ। আমি এর নাম দিলাম তোজ্জলী খানম। শাহনেয়াজকে মাথা নিচু করে তাই মেনে নিতে হয়।]
আব্দুল গনি তাঁর বাড়ি হাম্বরমুক্ত রাখার জন্যে একজন পাশ করা ভালো মাওলানা লজিং মাস্টার হিসাবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাওলানা চব্বিশ ঘণ্টা এই বাড়িতেই থাকবেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে নামাজ পড়বেন। ভূতপ্ৰেতরা না-কি আজানের শব্দকে অত্যন্ত ভয় পায়। মাওলানা পাওয়া যাচ্ছে না।
ধনু শেখের নতুন করে বানিয়ে দেয়া জামে মসজিদে আজ অনেকদিন পর আছরের আজান হলো। আজান দিলেন নতুন ইমাম নিয়ামত হোসেন। নিয়ামত হোসেন ধনু শেখের লঞ্চ কোম্পানির টিকেট মাস্টার। তাঁর পড়াশোনা মাদ্রাসা লাইনে। উলা পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাশ করতে পারেন নি। টিকেট মাস্টারের দায়িত্বের অতিরিক্ত মসজিদের ইমামতির দায়িত্বও তিনি পালন করবেন। নিয়ামত হোসেন মহিষের মতো বলশালী একজন মানুষ। হুঙ্কার দিয়ে কথা বলেন। তবে বন্ধুরী হিসাবে ভালো।
প্ৰথম দিনেই নামাজের শেষে বেহেশতের বর্ণনা দিয়ে তিনি সবার চিত্ত চাঞ্চল্য তৈরি করলেন।
ফল ফুরুট খেতে চান? বেহেশতের ফল ফুরুটের কেরামত শুনবেন? তাহলে শুনেন, বেহেশতের বেদানার একটা দানা মুখে দিবেন, সত্ত্বর বছর লাগবে তার রস খেয়ে শেষ করতে… ।
ইমাম করিম প্রথম দিনের নামাজে সামিল হতে এসেছিল। তাকে মসজিদে ঢুকতে দেয়া হয় নি। তার গা দিয়ে দুৰ্গন্ধ বের হচ্ছে। সারা শরীর নোংরায় মাখামাখি। লুঙ্গি বারবার খুলে পড়ে যাচ্ছে।
ইমাম করিম হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, নামাজ পড়তে দেয় না কোন বান্দির পুত! আমি কিন্তু মসজিদ জ্বলায়ে দিব। খুন খারাবি করব। আমি পাগল মানুষ। খুন খারাবি করলে আমার কিছু হবে না।
ইমাম করিমকে দূরের কোনো গঞ্জে ফেলে আসা হবে- এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তার পাগলামি যেভাবে বাড়ছে তাতে এর কোনো বিকল্প নাই। বান্ধবপুরের বেশ কিছু মানুষকে সে হয় মেরেছে নয় তাড়া করে পুকুরে ফেলেছে। একদিন বের হয়েছিল রামদা নিয়ে। এমন বিপদজনক পাগল গ্রামে রাখা ঠিক না।
আগামী হাটবারে ইমাম করিমকে লঞ্চে করে নিয়ে যাওয়া হবে। কোনো এক লঞ্চঘাটে নামিয়ে দেয়া হবে এরকম ঠিক হয়েছে। ইমাম করিম ব্যাপারটা জানে। তার যে খুব আপত্তি তাও না। সে মোটামুটি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছে। একদিন গেল। লাবুসের কাছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি বয়সে আমার ছোট। যদি বয়সে ছোট না হইতা আমি পায়ে ধরে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতাম। বিরাট অপরাধ করেছি। তোমারে খুন করার জন্যে লোক ঠিক করেছিলাম। ওই হারামজাদা কাজটা করে নাই। হারামজাদা যদি কাজটা করত। আমার এই দশা হয় না। আমি স্ত্রী নিয়া সুখে থাকতাম। কেন সুখে থাকতাম বুঝায়ে বলব?
লাবুস বলল, বলুন।
ইমাম করিম বলল, একশ’ টাকার মামলা। তোমারে খুন করলে একশ’ টাকা ওই হারামজাদা নিত। আমার স্ত্রীর হাতে টাকা পড়ত না। ঝগড়া ফ্যাসাদের কারণে তালাক হইত না। বুঝেছ?
লাবুস চুপ করে রইল। করিম বলল, তুমি কি আমাকে ক্ষমা দিয়েছ?
লাবুস বলল, জি দিয়েছি।
এরা বুধবারে আমাকে লঞ্চে করে নিয়ে যাবে। কোনোখানে ছেড়ে দিয়ে আসবে। আধা ন্যাংটা তো যেতে পারি না। বিলো যেতে পারি কি-না?
এইভাবে যাওয়া ঠিক হবে না।
আমাকে নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি কিনে দেওয়া কি তোমার পক্ষে সম্ভব?
সম্ভব।
সুন্দর একটা ফেজ টুপি কিনে দিও।
जा5হা gन्द।
একজোড়া কাবলি স্যান্ডেল।
আপনি যা চাচ্ছেন সবই দিব।
তুমি লোক অত্যন্ত ভালো। আগে বুঝতে পারি নাই। না বুঝে ভুল করেছি।
লাবুস বলল, আমরা সবাই ভুল করি। না বুঝে করি, বুঝে করি।
ইমাম বলল, ভুলের জন্যে তওবা করলে আমি ক্ষমা পাব। কিন্তু তওবা করব न।
লাবুস বলল, কেন তওবা করবেন না?
ইমাম বলল, আমি ভুলের শাস্তি পেতে চাই।
অনেক শান্তি তো পেয়েছেন। আর কত?
ইমাম বলল, আরো অনেক বাকি আছে। আচ্ছা লারুস, আমার আরেকটা আবদার আছে। বলব?
বলুন।
আমি যাব বুধবারে। লঞ্চ ছাড়বে তিনটায়। দুপুরে তোমার এখানে ভাত খাওয়া কি সম্ভব? খাওয়াদাওয়া করে লঞ্চে উঠলাম। পরে খাওয়া আর জুটে কি-না কে জানে। খাওয়াবা ভাত?
লাবুস বলল, অবশ্যই খাবেন।
করিম বলল, পাবদা মাছের সালুন দিয়া ভাত খাওয়ার ইচ্ছা। শরিফা একবার রোধেছিল। স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। ভাটি অঞ্চলের পাবদা মাছ।
লাবুস বলল, ভাটি অঞ্চলের বড় পাবদা মাছ আমি জোগাড় করব।
করিম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, লাবুস, তোমার অনেক মেহেরবানি।
রঙিলা বাড়িতে শরিফা একটি চিঠি পেয়েছে। চিঠি নিয়ে এসেছে লাবুসের লোক। চিঠিতে লেখা
মা,
আমি আপনার এক সন্তান লাবুস। আমার খুবই ইচ্ছা বুধবার দুপুরে আপনার হাতে রান্না পাবদা মাছ খাই। এটা কি সম্ভব যে আপনি আমার বাড়িতে এসে রান্না করবেন?
ইতি
আপনার পুত্ৰ
লাবুস।
বুধবার দুপুরে ইমাম করিম একা খেতে বসেছেন। মাওলানা ইদরিস কী কারণে যেন রোজা রেখেছেন। লাবুস একবেলা খায়। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা এক মহিলা করিমের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। করিমের গায়ে নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি। মাথায় ফেজ টুপি। করিম নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। একবার শুধু বলল, রান্না ভালো হয়েছে। আল্লাহপাকের দরবারে সুখাদ্যের জন্যে শুকরিয়া। বোরকা পরা মহিলা কিছুই বললেন না।
লঞ্চঘাটে করিমকে বিদায় দিতে অনেকেই এসেছে। পালকিতে করে বোরকাপরা সেই মহিলাও এসেছেন। যে দু’জন করিমকে নিয়ে যাবে, অচেনা ঘাটে ছেড়ে দিয়ে আসবে, করিম তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনাদের যেতে হবে না। আমি দূরের কোনো ঘাটে নেমে যাব। ফিরে আসব না। আপনাদের অনেক ত্যক্ত করেছি। আর করব না। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাই।
করিমের সঙ্গের চরনদার দু’জন নেমে গেল। লঞ্চ ছাড়ার ঠিক আগে আগে পালকি থেকে বোরকাপরা মহিলা নেমে সিড়ি বেয়ে লঞ্চে উঠে গেল এবং দাঁড়াল ইমাম করিমের পাশে।
ইমাম করিম বললেন, ভালো আছ শরিফা?
শরিফা জবাব দিল না। সে মুখ থেকে বোরকার ঢাকনা তুলে দিয়েছে।
শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে বান্ধবপুরের রঙিলা বাড়ি। আর কোনোদিন সে এখানে ফিরবে না।
অনেক রাতে আতরকে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। তার কাছে দু’জন মেহমান এসেছে। মেহমান দু’জনকে কেউ চিনতে পারছে না। একজন মাওলানা তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। আতর মেহমানদের দেখে হতভম্ব। ইমাম করিম এবং শরিফা।
আতর বলল, নতুন মা। তুমি?
শরিফা বলল, মাগো, আমার কোথাও যাবার জায়গা নাই। আজ রাতটা কি তুমি আমাদের থাকতে দিবা?
আতর কিছু না বলে ছুটে গেল তার স্বামীর কাছে। হড়বড় করে বলল, আমার এক দুঃখী মা এসেছেন। আপনি তাকে সমাদর করে এই বাড়িতে তুলবেন— এটা আমার অনুরোধ। শাহনেয়াজ সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। শরিফাকে কদমবুসি করে বলল, মাগো! আমি আপনার এক অধম পুত্র। মা, অতি আশ্চর্য যোগাযোগ। এই মুহুর্তে পয়ারছন্দে একটা কবিতা লিখছিলাম। কবিতার নাম ‘মাগো’। আপনি আপনার অধম কবিপুত্রের বাড়িতে বাকি জীবন থাকবেন এটা আমার আবদার।
[অপদাৰ্থ কবি শাহনেয়াজ শরিফাকে বাকি জীবন অতি আদরে নিজের বাড়িতে রেখেছে। প্রতিবার খাবার সময় নিজে উপস্থিত থেকেছে। অতি আদরে অতি যত্নে নিজে খাবার তুলে দিয়েছে। হঠাৎ করে এই মহিলার প্রতি শাহনেয়াজের এত ভক্তির কারণ স্পষ্ট না। জগৎ রহস্যময়। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে।]
ইমাম করিম আতরের বাড়িতে সংসার শুরু করলেন। তার প্রধান কাজ হলো, আজান দিয়ে ভূত হাম্বরকে দূরে রাখা। তাঁর মাথা কখনোই পুরোপুরি সারে না। প্রায়ই দেখা যায় তিনি বাড়িকে ঘিরে অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চক্কর দিচ্ছেন। আতরের শ্বশুরবাড়ির সবার ধারণা, ভূত হাম্বরের কারণে ভালোমানুষ ইমাম সাহেবের এই সমস্যা হচ্ছে। হাম্বর কোনো সহজ জিনিস না। তবে ইমাম করিমও সহজ পাত্র না। বলা যায়, সমানে সমান। ইমামের আসার পর হাম্বরের উপদ্রব কিছু কমেছে। টিনের চালে তার হাঁটাহাঁটি বন্ধ হয়েছে বলেই মনে হয়।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ ঘাটশিলা থেকে বান্ধবপুর উপস্থিত হলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল বান্ধবপুরের তিনবটের মাথা পানির সময় দেখতে হয়। পানিতে অঞ্চল ড়ুবে যায়, বটের মাথা বের হয়ে থাকে। পাখিদের মেলা বসে। সবই হরিয়াল পাখি।
লঞ্চঘাটে নেমে বিভূতি বাবু ভালো ঝামেলায় পড়লেন। যার কাছে তিনি যাবেন কেউ তাকে চেনে না। নামও আগে কখনো শোনে নি। যাকে জিজ্ঞাস করেন সে-ই বলে ইন্নাস নামে কেউ এই অঞ্চলে থাকে না। মাওলানা ইদরিস নাম তিনি ভুলে গেছেন।
ইন্নাস করেন কী?
কী করেন জানি না। কলিকাতা গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি যমুনার আত্মীয়। যমুনা রায়।
মুসলমান ইন্নাস, হিন্দুর আত্মীয়? এইসব কী বলেন? উনার চেহারা কেমন?
বিভূতি বাবু চেহারার যথাসাধ্য বর্ণনা দিলেন। কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তবে তিনবটের মাথা নামের একটা জায়গা আছে। দূরদেশ থেকে একজন শুধুমাত্র তিনবটের মাথা দেখতে এসেছে- এটাও কারো হিসাবে মিলছে না।
আপনি আসছেন তিনবটের মাথা দেখতে?
হুঁ।
আর কিছু না? শুধু বটগাছ দেখবেন?
এর বাইরেও দেখার মতো কিছু থাকলে দেখব। শুনেছি বড় জঙ্গল আছে। বনজঙ্গল দেখতে আমার ভালো লাগে।
বর্ষাকালে বনজঙ্গল কী দেখবেন? সাপে কাটব। জোঁকে ধরবে।
বনের ভেতর দিয়ে শুনেছি। একটা বড় খাল গিয়েছে। নৌকা নিয়ে খালের ভেতর ঘুরব। খাল আছে না?
আছে। খাল আছে। নৌকাও আছে।
তাহলে সমস্যা কী?
সমস্যা কিছু নাই।
বিভূতিভূষণ বললেন, ইন্নাস সাহেবের খোঁজটা শুধু যদি বের করতে পারি।
এই নামে কেউ আমাদের অঞ্চলে নাই। কোনোদিন ছিলও না। আপনারে কেউ ধোঁকা দিয়েছে।
উনি ধোঁকা দেয়ার মানুষ না। সুফি মানুষ। দরবেশ।
আমাদের অঞ্চলে কোনো পীর দরবেশও নাই। সবই সাধারণ।
বিভূতি বাবু কী করবেন বুঝতে পারলেন না। লঞ্চে কোনো খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় নেমেছেন। সেই ক্ষুধা চরমে পৌঁছেছে। বান্ধবপুরে ভাতের হোটেল আছে, তবে হোটেলগুলি খোলে দুই হাটের দিনে। আজ হাটবার না। মুদির দোকান থেকে চিড়া এবং পাটালি গুড় কিনে খেলেন। লঞ্চে করে ফেরত যাবেন সেই উপায় নেই। ফিরতি লঞ্চ পরদিন দুপুরে। তাছাড়া এতদূর এসে তিনবটের মাথা না দেখে ফেরত যাবার অর্থ হয় না। রাত কাটাবার জন্যে একটা আশ্রয় দরকার। ধর্মশালা জাতীয় কিছু আছে কি-না খোঁজ করতে হবে। থাকার কথা না। বান্ধবপুর সম্পন্ন অঞ্চল না। অনেক খুঁজে পেতে একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল, সেখানে গুড়ের লাল চা ভাঁড়ে করে বিক্রি করে।
চায়ের দোকানির পরামর্শে বিভূতি বাবু ধনু শেখের বাংলাঘরে উপস্থিত হলেন। ধনু শেখকে তার সমস্যার কথা বললেন। ধনু শেখ বিরক্ত হয়ে বললেন, নাম ঠিকানা ছাড়া চলে আসছেন? আপনি তো বিরাট ‘বুরবাক’। করেন কী?
শিক্ষকতা করি। স্কুল মাস্টার।
বুরবাকের মতো বুদ্ধি শিক্ষকদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
রাতটা কাটাবার মতো একটা জায়গা পাওয়া গেলে বাধিত হতাম।
ধনু শেখ বললেন, রঙিলা বাড়িতে চলে যান। আরামে থাকবেন, সেবা পাবেন। সেবার প্রয়োজন সকলের। আমার এখানে রাখতে পারতাম, তা সম্ভব না। আমার কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। কুষ্ঠ রোগীর বাড়িতে থাকা ঠিক না। এখন বিদায় হন।
বিভূতি বাবু শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা করলেন। রাত কাটাবেন নৌকায়। নৌকার মাঝি চাল ফুটিয়ে ভাত রেধে দিবে। নদীর ওপর ডাল দিয়ে ভাত খেতে ভালো লাগবে।
এই নৌকা নিয়ে তিনি বিকালের মধ্যেই খালে ঢুকলেন। খাল দিয়ে নৌকা যাবে, তিনি বনভূমির সৌন্দর্য দেখবেন। তার মতে বঙ্গদেশের প্রতিটি বনভূমির চরিত্র এক হলেও প্রতিটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্য ধরতে পারার মধ্যে আনন্দ আছে। নৌকার মাঝির নাম হাশেম। হাশেম। তার আরোহীর কর্মকাণ্ডে অবাক হচ্ছে। কোনো কাজ ছাড়া একটা লোক খালে খালে ঘুরছে। বনজঙ্গল দেখার কী আছে? লোকটার হাতে খাতা-কলম। সে মাঝে-মাঝে নৌকা থামাতে বলে। নৌকা থামলেই গুটি গুটি করে কী যেন লেখে।
ঔপন্যাসিক লিখছিলেন—
বাতাবি লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনী ফুল নয়, রক্তপলাশ বা শিমুল নয়, কী একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগণ্য জংলি কাটা গাছের ফুল। আমার কাছে কিন্তু তাহাই কাননভরা বনভরা বসন্তের কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল।…
আপনার নাম কি বিভূতিভূষণ?
বিভূতি বাবু চমকে তাকালেন। খালের পাড়ে অতি রূপবান এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহুর্তের জন্যে তাঁর মনে এক ধরনের ভ্রান্তি উপস্থিত হলো। মনে হলো বনের দেবতা। হঠাৎ দেখা দিয়েছেন। হঠাৎ করে একজন কেউ ‘আপনার নাম কি বিভূতিভূষণ’ বলে জঙ্গলে উদয় হওয়ার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে।
আজ্ঞে আমি বিভূতিভূষণ।
আমার নাম লাবুস, আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
বিভূতি বাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি কীভাবে জানেন যে আমি খালের ভেতর নৌকা করে যাচ্ছি?
লাবুস বলল, আমি আপনাকে পেয়েছি। এটাই বড় কথা। কীভাবে পেয়েছি এটা বড় কথা না।
লাবুস নৌকায় উঠে এলো। বিভূতিভূষণ বললেন, আপনি কি আমার কোনো রচনা পড়েছেন?
লবুস বলল, না। এখানে আমরা বইপত্র পাই না। হরিচরণ বাবু প্রবাসী পত্রিকা রাখতেন। সেখানে আপনার উপন্যাসের ছোট্ট একটা অংশ পড়েছি।
নাম মনে আছে?
না। শুনেছি আপনি সুখাদ্য পছন্দ করেন। রাতে কী খেতে চান?
যা খেতে চাইব। তাই খাওয়াবেন?
অবশ্যই।
বনমোরাগের ঝোল খাওয়াতে পারবেন?
না।
মহাশোল মাছ। দোপেয়াজির মতো রান্না।
এটাও পারব না। মহাশোল পাহাড়ি মাছ, এখানে পাওয়া যায় না।
বকফুলের বড়া খাওয়াতে পারবেন?
পারব। আমার বাড়িতেই বকফুল গাছ। প্রচুর ফুল ফুটেছে।
সজনের গাছ আছে?
আছে।
সজনের ঝোল করতে বলবেন। আমার পছন্দের জিনিস।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিভূতি বাবু খাতা-কলম নিয়ে নৌকার ছাইয়ের ভেতরে চলে গেছেন। লাবুস বাইরে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। তাকে দেখাচ্ছে মূর্তির মতো। তার দৃষ্টি খালের পানির স্রোতের দিকে। একঝাক বক হঠাৎ তার মাথার ওপর দিয়ে কককক শব্দ করে উড়ে গেল। অন্য যে-কেউ চমকে বকগুলির দিকে তাকাতো। লাবুস তাকালো না।
লাবুসের বাড়িতে যে আদর এবং যত্ন লেখকের জন্যে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। রাতের খাবারের বিপুল আয়োজন। যেখানে তিনি খেতে বসেছেন তার কাছেই তোলা উনুন আনা হয়েছে। সেখানে তেল ফুটছে। বেসনে ড়ুবিয়ে বকফুল ভেজে লেখকের পাতে দেয়া হচ্ছে। বাটির পর বাটি আসছে। বিভূতি বাবু বললেন, আমার মতো অভাজনের জন্যে এত আয়োজন!
মাওলানা ইদরিস বললেন, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহপাকের জন্যে। তিনি আপনার রিজিকের এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
বিভূতি বাবু বললেন, রেঁধেছে কে?
হাদিস উদ্দিন বলল, আমি রান্না করেছি জনাব।
বিভূতি বাবু বললেন, তোমার দুটা হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা দরকার। আমার একটা উপন্যাসের নাম ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। সেই হোটেলের পাঁচক বামুন হাজারির চেয়েও তোমার রান্না ভালো।
হাদিস উদিনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। সে তার জীবনে রান্নার এরকম প্রশংসা শোনে নি। ছোটকৰ্তা লাবুস এমন মানুষ যাকে লবণ ছাড়া তরকারি রেঁধে দিলেও হাসিমুখে খেয়ে উঠবে, কিছু বলবে না। মাওলানা ইদরিসেরও একই অবস্থা, বেগুনপোড়া চটকে দিলে তাই মুখে নিয়ে বলবে–শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ।
শ্রাবণ মাসের ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বিভূতি বাবু পান মুখে দিয়ে বিছানায় শুতে গিয়েছেন। হাদিস উদ্দিন হুঙ্কা নিয়ে গেছে। তিনি হুঙ্কায় টান দিচ্ছেন। হাদিস উদ্দিন বলল, জনাব! আপনার পায়ে একটু তেল দিয়ে দেই? পরিশ্রম করে এসেছেন। আরাম পাবেন।
বিভূতি বাবু বললেন, দাও। সেবা যখন নিচ্ছি। ভালোমতোই নেই।
সকালে আপনাকে ছিটা পিঠা খাওয়াব। হাঁসের মাংস আর ছিটা পিঠা।
আচ্ছা।
হাঁসের মাংস দিয়ে ছিটা পিঠা খাওয়ার পরে আপনি বলবেন, হাদিস উদ্দিনের শুধু হাত না, তার পাও দুটাও দানা দিয়া বান্ধীয়া দাও। আচ্ছা জনাব, হাজারি বলে বাবুর্চির কথা বললেন, তার দেশের বাড়ি কই?
ওটা কল্পনার এক চরিত্র। এরকম কেউ নেই।
বিভূতি বাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, একটা মেয়ে দেখলাম, কোঁকড়া চুল, গোল মুখ, মেয়েটা কে? দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখছিল। আমি তাকাতেই চট করে সরে গেল।
হাদিস উদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, চোখে ধান্ধা দেখছেন। এই রকম মেয়ে কেউ নাই।
আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম।
হাদিস উদ্দিন বলল, আমিও আপনার মতো ধান্ধা দেখি। ছোটকৰ্তারে নিয়া একটা ধান্ধা দেখি।
কী দেখ?
পুসকুনির পড়ে উনি যখন বইসা থাকেন তখন দেখি একজন না, মানুষ দুইজন।
একই মানুষ দুজন?
জে। পেট গরম থাকলে মানুষ ধান্ধা দেখে। মনে হয় আমার পেট গরম ছিল।
শেষরাতে বৃষ্টি থেমে গেল। মেঘ কেটে চাঁদ ভেসে উঠল। বৃষ্টিধোয়া অপূর্ব জোছনা। বিভূতি বাবুর ঘুম ভেঙেছে। তিনি জোছনা দেখার জন্যে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, পুকুরের শ্বেতপাথরের ঘাটে দু’জন লাবুস বসে আছে। দু’জনই তাকিয়ে আছে দূরের বনভূমির দিকে।
একদিন থাকার জন্যে এসে তিনদিন থাকলেন। তিনবটের মাথা দেখে খুব আনন্দ পেলেন। কয়েকবার বললেন, আহারে, কী দৃশ্য! এই বলেই ভগবতগীতার একটা শ্লোক আবৃত্তি করলেন—
ন জায়তে মিয়তে বা কদাচি
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শ্বাশতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
মাওলানা ইদরিসের ছবি আঁকা কর্মকাণ্ডেও বিস্মিত হলেন। কী অনায়াসে কী সুন্দর ছবিই না বৃদ্ধ মানুষটা আঁকছে! ছবি নিয়ে তাঁর লজ্জারও সীমা নেই। তাঁর ধারণা তিনি বিরাট পাপ করছেন। বিভূতি বাবু অনেক চেষ্টা করলেন অদ্ভুত এই মানুষটার ভুল ভাঙাতে। লাভ হলো না। ঘাটশিলায় ফিরে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখলেন লাবুসকে।
পো. অ. গোপালনগর
গ্ৰাম : বারাকপুর
যশোহর
প্রীতিভাজনেষু,
নমস্কার। অতিব আনন্দ নিয়ে আপনার অতিথি হয়েছিলাম। যদিও নিজেকে কখনো অতিথি মনে হয় নাই। তিনবটের মাথা দেখে তৃপ্তি পেয়েছি। মাঝে মাঝে অতি সাধারণ দৃশ্য অজ্ঞাত কারণে অসাধারণ মনে হয়। তিনবটের মাথা সেরকম একটি স্থান। কলকাকলিতে মুখরিত পাখির ঝাক এক বটগাছ থেকে আরেক বটগাছে উড়াউড়ি করছে, এই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসছে।
আমি আপনাকে আমার একটি উপন্যাস পাঠালাম। নাম দৃষ্টি প্ৰদীপ। উপন্যাসটি পড়লে আনন্দ পাবেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম জিতু। সে অদৃশ্য দৃশ্য দেখে। মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়। আমার কেন জানি মনে হয় আপনি জিতুর মতো একজন।
আরেকটি বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। আমার ধারণা আপনার বাড়িতে একটি বিদেহী শিশুকন্যার উপস্থিতি আছে। অতৃপ্ত আত্মারা প্রায়ই পৃথিবীর মায়ায় আটকে যায়। তাদের জন্যে বিষয়টি কষ্টের। আপনি কিশোরী মেয়েটির মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। এই আশা করছি। প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করুন।
ইতি
শ্ৰী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতি বাবুর চিঠির তারিখ ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সন। ওই দিনে জাপানের হিরোশিমা শহরে একটা বোমা পড়ে। বোমাটির নাম ‘লিটল বয়’। পৃথিবীতে প্রথম আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ষাট হাজার মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে। কয়েক ঘণ্টা পর মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার।
যে বিমানটি আণবিক বোমা নিয়ে যাচ্ছিল তার নাম এনোলা গে। বৈমানিকের নাম পল টিবেটিস। পল টিবেটিসের মায়ের নামেই বিমানটির নাম রাখা হয়েছিল। মাত্র একদিন আগে, ৫ আগষ্ট ১৯৪৫।
বোমা বিস্ফোরিত হবার পর পল টিবেটিস পেছনে ফিরে দেখলেন, ভয়াবহ এবং ভয়ঙ্কর এক ব্যাঙের ছাতা আকাশের দিকে উঠছে। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, হায় ঈশ্বর, আমরা এটা কী করেছি!
আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর পর বহু দূরের একজন মানুষ, বান্ধবপুরের লাবুস অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনোরকম কারণ ছাড়াই তার শরীর কলসে যায়। মাথার চুল পড়ে যায়। সে গোঙানির মতো শব্দ করতে থাকে।
মনে হচ্ছিল সেও আণবিক বোমায় ঝলসে যাওয়া মানুষদের একজন। সতীশ কবিরাজ তাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, বিনা কারণে শরীর পুড়ে গেছে। এটা কী বলেন?
লাবুস ক্ষীণ গলায় বলল, আগুনের একটা ঝালকানি দেখেছি, আর কিছু না।
সতীশ কবিরাজ বললেন, আগুন কই যে আগুনের ঝালকানি দেখবেন?
মাওলানা ইদরিসের ধারণা হয়, তার পাপে লাবুসের এই সমস্যা হয়েছে। তিনি একই বাড়িতে থেকে ছবির পর ছবি আঁকছেন, এরকম তো হবেই।
এক সন্ধ্যাবেলা তিনি তাঁর সব ছবি ছিঁড়ে ফেলে আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।