৩১. শুক্লযজুর্বেদ – একত্রিংশ অধ্যায়

একত্রিংশ অধ্যায়

মন্ত্রঃ– সহস্ৰশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ। স ভূমিং সর্বত শৃহত্যতিষ্ঠদশাঙ্গুলম৷৷৷৷ পুরুষ এবং সর্বং যদ্ভুতং যচ্চ ভাব্য। উমৃতত্বসেশানো যদন্নেনাতিরোহতি৷৷২৷৷ এবানস্য মহিমাতো জ্যায়শ্চ পুরুষঃ! পাদোৎস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।।৩।। ত্রিপাদূর্ধ্ব উদৈৎপুরুষঃ পাদোহস্যেহাভবৎ পুনঃ। ততো বিম্ব ব্যক্ৰাম সাশনানসনে অভি।৪৷ ততো বিরাডজায়ত বিরাজো অধি পূরুষঃ। স জাতে অত্যরিচ্যত পশ্চাদ্ভুমিমথো পুরুঃ।।৫৷৷ তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুতঃ সম্ভতং পৃষদাজ্য পশুস্তাশ্চক্রে বায়ব্যানারণ্যা গ্রামাশ্চ যে৷৷৬৷ তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুতঃ ঋচঃ সামানি জিজ্ঞিরে। ছন্দাংসি জজ্ঞিরে, তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।।৭৷ তস্মাদশ্বা অজায়ন্ত যে কে চোভয়াদতঃ। গাবো হ জজ্ঞিরে তস্মাত্তস্মাজ্জাতা অজাবয়ঃ।।৮। তং যজ্ঞং বহিষি। প্রৌক্ষন পুরুষং জাতমগ্ৰতঃ। তেন দেবা অজন্ত সাধ্যা ঋষয়শ্চ যে।।৯। যৎপুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন্। মুখং কিমস্যাসীৎ কিং বাহু কিমূরূ পাদা উচ্যেতে।।১০।। ব্রাহ্মণোহস্য মুখসামীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ। ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।১১। চন্দ্রমা মনসো জাতশ্চক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত। শ্রোত্রাঘায়ুশ্চ প্রাণশ্চ মুখাদিগ্নিরজায়ত।১২।নাভ্যা আসীদন্তরিক্ষং শীষ্ণো দৌঃ সমবর্তত। পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্ৰাথা লোক্টা অকল্পয়ন্৷১৩৷৷ যৎপুরুষেণ হবিষা দেবা যজ্ঞমতন্বত। বসন্তোৎস্যাসীদাজ্যং গ্রীষ্ম ইস্কঃ শরদ্ধবিঃ৷৷১৪। সপ্তাস্যাসন্ পরিধয়স্ত্রিঃ সপ্ত সমিধঃ কৃতাঃ। দেবা যদ্যজ্ঞং তন্বানা অবধুন্ পুরুষং পশু৷৷১৫৷৷ যজ্ঞেন যজ্ঞমযজন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্ তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত যত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তি দেবাঃ।১৬। অদ্ভ্যঃ সম্ভতঃ পৃথিব্যৈ রসাচ্চ বিশ্বকর্মণঃ সমবর্তাগ্রে। তস্য ত্বষ্টা বিদধপমেতি তন্মত্যস্য দেবত্বমাজানমগ্রে৷৷১৭৷৷ বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। তমেব বিদিত্বাতিমুত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়৷৷১৮। প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভে অন্তরজায়মানো বহুধা বি জায়তে। তস্য যোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাস্তস্মিন্ হ তস্তুর্ভুবনানি বিশ্বা।১৯৷৷ যো দেবেভ্য আতপিত যো দেবানাং পুরোহিতঃ। পূর্বে যো দেবেভ্যা জাত নম রুচায় ব্রহ্ময়ে।২০। রুচং ব্রাহ্মং জনয়ন্তো দেবা অগ্রে তদব্রুবন। যবৈং ব্রাহ্মণো বিদ্যাস্য দেবা অস বশে৷৷২১। শ্রীশ্চ তে লক্ষ্মীশ্চ পত্নাবহোরাত্রে পার্শ্বে নক্ষত্রাণি রূপমশ্বিনৌ ব্যাত্তম্ ইষ্ণন্নিষাণামুং ম ইষাণ সর্বলোকং ম ইষাণ।।২২।

[কাণ্ড–২২, মন্ত্র-২২]

.

মন্ত্ৰার্থঃ– ১।পরমাত্মা সহস্র শির, সহস্র চক্ষু ও সহস্র পাদশালী (অর্থাৎ শির, চক্ষু ও পাদ–সবই তার সংখ্যাতীত)। তিনি সকল দিকের ভূমি (অর্থাৎ জগৎপ্রপঞ্চ)-কে স্পর্শ করেও (বা প্রাপ্ত করেও) জগৎ-বিকারের দ্বারা দশ অঙ্গুলী পরিমিত হৃদয়স্থানে অন্তর্যামী পুরুষরূপে স্থিত হয়ে আছেন।

২। এই সবই সেই পুরুষ; যা হয়ে গিয়েছে (ভূত) এবং যা হবে, তা সবই তিনি। তিনি সেই অমৃতত্বেরও স্বামী (অর্থাৎ অমর দেবগণেরও স্বামী) তিনি সেই অন্নেরও স্বামী যে অন্নের দ্বারা বৃদ্ধিকে প্রাপ্ত করা হয়; (তিনি সেই জীবেরও স্বামী এবং জীবের শরীরেরও অধিপতি)।

৩। অতীত-অনাগত-বর্তমান সকল কালের ও সকল জগতের মধ্যে এই পুরুষের মহিমা এতই এবং সেই পুরুষ এর অপেক্ষাও অধিক। এই সমস্ত ভূতজাত (প্রাণী) এঁর চতুর্থ অংশ মাত্র। এঁর অবশিষ্ট তিন চতুর্থাংশই অমৃতস্বরূপ এবং তা দ্যুলোকে (অর্থাৎ দ্যোতনাত্মক) স্বপ্রকাশে অবস্থিত।

৪। তিন-চতুর্থ পুরুষ (বা ত্রিপাদ পুরুষ) উর্ধ্বে গত হয়েছেন (অর্থাৎ অধিকারী অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছেন) এবং পুনরায় এঁর চতুর্থংশ মাত্র এই ব্রহ্মাণ্ডে পঞ্চরূপে পরিণত হয়েছেন; আপন সেই পূর্ণাবস্থায় সেই পরমাত্মা আপন চতুর্থাংশের দ্বারা সর্বত্র জীব-ভোক্তাভাবে পরিব্যপ্ত, হয়েছেন।

৫। সেই পরমাত্মা পুরুষ হতে বিরাট উৎপন্ন হয়েছেন। বিরাজ হতে পুরুষ। সেই উৎপন্ন পুরুষ শিথিল-রিক্ত হয়ে গিয়েছেন (অর্থাৎ দেবতা, মনুষ্য, তির্যক ইত্যাদি হয়েছেন। তারপর তিনি ভূমি ও লোকসমূহ সৃষ্টি করেছেন।

৬। সেই সর্বহোম স্বরূপ যজ্ঞপুরুষ হতে এই খাদ্য-পেয় (আজ) পূর্ণ হয়েছে। তারপর তিনি সেই বায়ু (অর্থাৎ গতি) প্রধান গ্রাম্য অথবা আরণ্য পশুগণকেও উৎপন্ন করেছেন৷

৭। সেই সর্বহুত যজ্ঞপুরুষ হতে ঋক্‌গুলি ও সমাগান উৎপন্ন হয়েছে। গায়ত্রী প্রভৃতি ছন্দরাশি তা হতেই উৎপন্ন হয়েছে এবং যজুর্বেদও তা হতে উৎপন্ন হয়েছে।

৮। সেই যজ্ঞ হতে অশ্ব উৎপন্ন হয়েছে, সেই সাথেই যা কিছু উভদন্ত (উপর ও নীচের পাটিতে দন্তশালী) গদর্ভ ইত্যাদি উৎপন্ন হয়েছে। গেসমূহ তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তা হতেই ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হয়েছে।

৯। সৃষ্টির পূর্বে প্রথম উৎপন্ন সেই পুরুষকে যজ্ঞের নিমিত্ত দর্ভের দ্বারা প্রেক্ষিত করা হয়েছিল। যজ্ঞের সাধনরূপ সেই পুরুষের দ্বারা সাধ্য দেবগণ, প্রজাপতি প্রভৃতি এবং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ যজন করেছিলেন।

১০। ঋষিগণ যে পুরুষকে কল্পনা করেছিলেন, কি রকম কিংবা কত প্রকার সেই পুরুষ? তার মুখ কি ছিল? বাহুদ্বয় কেমন ছিল? কেমন তার জঙ্ঘাদ্বয় ছিল? এবং কেমনই বা ছিল তার পাদদ্বয়?

১১। ব্রাহ্মণগণ ছিল তার মুখমণ্ডল (বা তার মুখমণ্ডল হতে ব্রাহ্মণগণ উৎপন্ন হয়েছিল)। ক্ষত্রিয় ছিল তাঁর দুই বাহু (অর্থাৎ তার বাহুদ্বয় হতে রাজন্যগণ উৎপন্ন হয়েছিল)। তার দুটি জঙ্ ছিল বৈশ্ববৰ্গ (অর্থাৎ তার জঙ্ঘাদ্বয় হতে বৈশ্বগণ উৎপন্ন হয়েছিল)। তার পাদদ্বয় ছিল শূদ্রসমূহ (অর্থাৎ তার পাদদ্বয় হতে শূদ্রগণ উৎপন্ন হয়েছিল)। [আধুনিক কোন কোন সমালোচক এই ব্যাপারটি থেকে এইরকম সিদ্ধান্ত করেন যে, পরমব্রহ্মের মুখমণ্ডল থেকে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি ইত্যাদি বর্ণনার ছলে বর্ণাশ্রমের এই ব্যাখ্যা থেকেই নাকি প্রমাণিত হয় যে, শরীরের নিকৃষ্ট (অধস্থ) অঙ্গ থেকে উৎপন্ন শূদ্রগণ তথাকথিত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যগণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। কিন্তু একটু ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই মন্ত্রের দ্বারাই শূদ্রগণের মহত্ব প্রমাণিত হয়। এই সংসার যেন সেই পরম পুরুষের বিরাট অবয়ব। এই সংসাররূপ দেহের সকল ভারকে বহন, সেই দেহকে চালনা প্রভৃতি কর্ম একমাত্র পাদদ্বয়েই সাধিত হয়। সুতরাংশূদ্রগণ পাদদ্বয়ে সৃষ্ট হওয়ায় তাদের নিকৃষ্টতা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতাই প্রমাণিত হয়]

১২। চন্দ্রমা সেই পুরুষের মন হতে উৎপন্ন হয়েছিল। তার চক্ষু হতে সূর্যের সৃষ্টি। সেই পরম পুরুষের শ্রোত্র হতে বায়ু ও প্রাণ উৎপন্ন হয়েছিল। তার মুখবিবর হতে উৎপন্ন হয়েছিল অগ্নি৷

১৩। সেই বিরাট পুরুষের নাভি হতে অন্তরিক্ষ উৎপন্ন হয়েছিল। তার শির হতে দ্যুলোক (অর্থাৎ স্বর্গ) উৎপন্ন হয়েছিল। সেই প্রজাপতির পাদদ্বয় হতে ভূমি ও শ্রোত্র হতে দিসমূহ সৃষ্টি হয়েছিল। এইরকমেই লোকসকল কল্পিত করা হয়েছিল।

১৪৷ যখন পুরুষরূপী হবিঃ হতে দেবগণ যজ্ঞকে (বা সৃষ্টিকে) বিস্তারিত করেছিলেন, তখন বসন্ত এই যজ্ঞের ঘৃত ছিল; গ্রীষ্ম ইন্ধন এবং শরৎ ঋতু হবিঃ ছিল।

১৫৷ এই যজ্ঞের সাতটি (গায়ত্রী ছন্দ ইত্যাদি) পরিধি এবং ত্রি-সপ্ত অর্থাৎ একুশটি (অতিজগতী ইত্যাদি) সমিধ ছিল; যখন দেবগণ যজ্ঞের বিস্তার করে প্রজাপতি পুরুষকেই আলস্ত্য পশুরূপে বন্ধন করেছিল।

১৬। দেবগণ মানস যজ্ঞের দ্বারাই যজ্ঞপুরুষের যজন করেছিল। পরন্তু পূর্বকালে জগৎস্বরূপ বিকারের ধারক ধর্মগুলি প্রধানভূত হয়ে উঠেছিল। সেই মহিমাবান্ ঋষিসঙঘ যজনের দ্বারা স্বর্গ লাভ করেছিলেন, যেস্থানে পূর্ব-সাধ্য এবং দেবতাগণ বাস করে থাকেন।

১৭। জল হতে সংগৃহীত, পৃথিবীর দ্বারা পুষ্ট ও বিশ্বকর্মা যে রস হতে হিরণ্যগর্ভ পুরুষকে সর্বপ্রথম উৎপন্ন করে, ত্বষ্টা তার রূপকে নির্ধারিত করেছিল। সেই পূর্বকালে মরণধর্মাকে আজানদেবত্ব (অর্থাৎ জন্মতঃ বা মুখ্য দেবত্ব) করেছে; (অর্থাৎ সেই রসের দ্বারা ধারিত রূপসম্পন্ন হয়ে সেই হিরণ্যগর্ভ পুরুষই প্রতিদিন উদয় লাভ করে–এটাই মনুষ্যের মুখ্য দেবত্ব)

১৮। অন্ধকারের পরপারে স্থিত সেই মহান পরম পুরুষকে ও আদিত্যস্বরূপ জ্যোতির্ময়কে আমি জ্ঞাত আছি। তাঁকে জ্ঞাত হয়েই যে কেউও মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে; এর দ্বিতীয় কোন পন্থা নেই।

১৯। প্রজাপতিই গর্ভের অন্দরে উৎপন্ন হয়ে গতিময় বা বিচরণশীল হয়ে থাকেন। তার উৎপত্তি বা মূল সত্তাকে তো ব্রহ্মবিদ বুদ্ধিমান্ জনই পরিতঃ (সর্বতোভাবে) দর্শন করে থাকে৷

২০। যিনি দেবগণের নিমিত্ত প্রকাশমান, যিনি দেবগণের পুরোহিত, দেবতাগণের পূর্বে যিনি উৎপন্ন হয়েছিলেন, সেই ব্রহ্মতেজের (বা আদিত্য দেবের) উদ্দেশে সর্বদা নমস্কার করি ৷

২১। আদিত্যরূপী ব্রহ্মতেজকে উৎপন্ন করে পূর্বকালে দেবগণ তাকে বলেছিলেন যে ব্রাহ্মণ পরমাত্মাকে এই প্রকার ব্রহ্মতেজের রূপে জ্ঞাত হবে, দেবগণ তার (অর্থাৎ সেই জ্ঞানী ব্রাহ্মণের) বশীভূত হবে৷

২২। হে পরমপুরুষ (আদিত্য)! শ্ৰী এবং লক্ষ্মী (সর্বজনশ্রয়ণী সম্পদ ও সর্বজনলক্ষ্যিতা সৌন্দর্য) তোমার দুই পত্নী। অহোরাত্র তোমার দুই কক্ষ বা পার্শ্বস্থানীয়। নক্ষত্রসমূহ তোমার রূপ। অশ্বিদ্বয় তোমার বিস্তৃত মুখ। হে ভগবান্! ইচ্ছাপূৰ্ব্বক তুমি আমাকে আপনরূপে ইচ্ছা করো; (অর্থাৎ আপন করে লও)। এই পরলোককে আমার নিমিত্ত ইচ্ছা করো এবং সর্বলোককে আমার নিমিত্ত ইচ্ছা করো; (অর্থাৎ পরলোক যেন আমার ইষ্টপ্রদ হয় এবং আমি যেন সর্বালোকাত্মক হতে পারি)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *