একত্রিশ অধ্যায়– শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
কৃষি-মালিকের উৎপত্তির মত শিল্প-ধনিকের[১] উৎপত্তি এমন ক্রমিক ভাবে হয়নি। সন্দেহ নেই যে, অনেক ছোট গিলভ-মাস্টার, এবং তার চেয়েও বেশিসংখ্যক স্বাধীন ঘোট কারিগর, কিংবা এমনকি মজুরি-শ্রমিকেরাও নিজেদের রূপান্তরিত করেছিল ঘোট ছোট ধনিকে এবং (ক্রমে ক্রমে মজুরিশ্রমের শোষণ ও তৎসহ সঞ্চয়নের বিস্তার সাধন করে) পুরোদস্তুর ধনিকে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের শৈশবে, ঘটনাবলী এমনভাবে ঘটত যেমন ভাবে সেগুলি ঘটত মধ্য যুগে, যেখানে, কোন্ পলাতক ভূমিদাস হবে মনিব আর কোন্ জন হবে দাস, সে প্রশ্ন বহুলাংশে নির্ধারিত হত তাদের মধ্যে কে আগে পালিয়েছে আর কে পরে পালিয়েছে, সেই তারিখের দ্বারা। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষ দিককার বিরাট বিরাট আবিষ্কারগুলি যেসব বাণিজ্যিক প্রয়োজন সৃষ্টি করল, তা এই পদ্ধতির শম্বক গতির সঙ্গে কোনরকমেই সঙ্গতি রাখল না। কিন্তু, মধ্যযুগ দিয়ে গিয়েছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মূলধন, যা পরিণতি লাভ করে অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অর্থ নৈতিক সমাজ-সংগঠনে এবং যা, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বে, বিবেচিত হয় মূলধনের ‘quand meme’ হিসাবে-কুসীদজীবীর মূলধন এবং বণিকের মূলধন হিসাবে।
“বর্তমান সমাজের সমস্ত সম্পদ প্রথম যায় ধনিকের অধিকারে সে জমির মালিককে দেয় তার খাজনা, শ্রমিককে তার মজুরি, কর ও শুল্ক সংগ্রাহকদের তাদের পাঙ্গা এবং নিজের জন্য রাখে শ্রমের বার্ষিক উৎপন্নের একটি বৃহৎ অংশ, বস্তুতঃ পক্ষে বৃহত্তম ও নিরন্তর বর্ধমান অংশ। ধনিককে এখন বলা যেতে পারে সমাজের সমস্ত সম্পদের প্রথম মালিক, যদিও কোনো আইন তাকে দেয়নি এই সম্পত্তির উপরে তার অধিকার এই পরিবর্তনটা ঘটানো হয়েছে মূলধনের উপরে সুদ আদায় করার মাধ্যমে এবং এটা মোটেই কৌতুহলকর নয় যে ইউরোপের সমস্ত আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আইনের সাহায্যে একে বাধা দিতে—কুসীদবৃত্তির বিরুদ্ধে আইনের সাহায্যে দেশের সমস্ত সম্পদের উপরে বনিকের ক্ষমতা সম্পত্তির অধিকারে ঘটিয়ে দিল সম্পূর্ণ পরিবর্তন; এবং কোন আইনের দ্বারা বা আইনসমূহের দ্বারা এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল?”[২] লেখকের মনে রাখা উচিত ছিল, বিপ্লব আইনের দ্বারা সাধিত হয় না।
কুসীদবৃত্তি ও বাণিজ্যের দ্বারা যে অর্থ মূলধন গঠিত হল, তা শিল্প-মূলধনে রূপান্তরিত হতে পারেনি; গ্রামাঞ্চলে তাকে বাধা দিল সামন্ততান্ত্রিক সংবিধান এবং শহরাঞ্চলে তাকে বাধা দিল গিলড-সংগঠন।[৩] সামন্ততন্ত্রের অবসানের ফলে গ্রামীণ জনসংখ্যার অধিকার-হরণ ও আংশিক উচ্ছেদসাধনের সঙ্গে এই শৃংখলগুলিরও অবলুপ্তি ঘটল। নোতুন ম্যানুফ্যাকচারগুলি প্রতিষ্ঠিত হল সাগর বন্দর কিংবা অন্তর্দেশীয় সেই সব জায়গায়, যেগুলি পুরনো পৌরসংস্থা ও তার গিলসমূহের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং, ইংল্যাণ্ডে চলল এই নোতুন শিল্প-লালনকেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে যৌথ শহরগুলির তীব্র সংগ্রাম।
আমেরিকায় সোনা রুপার আবিষ্কার; আদিবাসী জনসংখ্যার উৎপাটন, ক্রীতদাসে রূপান্তরণ ও খনিগর্ভে সমাধিস্থকরণ; ইস্ট ইণ্ডিজ-এর জয় ও লুণ্ঠনের উদ্বোধন; কৃষ্ণচর্মদের বাণিজ্যিক শিকারের জন্য আফ্রিকাকে মৃগয়া-ভূমিতে পরিবর্তন এই ঘটনাবলী সূচিত করল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-যুগের রঙীন প্রভাতের আবির্ভাব। এই সরল-সুন্দর ক্রিয়াকলাপগুলিই হল আদিম সঞ্চয়নের প্রধান অনুপ্রেরক। এই সব তৎপরতার পায়ে-পায়ে এল ইউরোপীয় জাতিগুলির বাণিজ্যিক যুদ্ধ-বিগ্রহ—গোটা ভূমণ্ডলই হল রণক্ষেত্র। এর সূচনা হয় স্পেনের বিরুদ্ধে নেদারল্যাণ্ডের বিদ্রোহে, আয়তন-বৃদ্ধি হয় ইংল্যাণ্ডের জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধে এবং আজও পর্যন্ত পরিব্যাপ্তি ঘটে চীনের বিরুদ্ধে অহিফেন যুদ্ধ ইত্যাদিতে।
আদিম সঞ্চয়নের বিভিন্ন অনুপ্রেরকগুলি এখন নিজেদেরকে মোটামুটি কালক্ৰম হিসাবে ভাগ করে দেয়, বিশেষ করে, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে। ইংল্যাণ্ডে সতের শতকের শেষে সেই অনুপ্রেরকগুলি উপনীত হয় একটি সুবিন্যস্ত সন্নিবেশে—যার মধ্যে বিধৃত হয় উপনিবেশসমূহ, জাতীয় ঋণ, আধুনিক কর প্রণালী এবং সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা। এই সমস্ত পদ্ধতি অংশত নির্ভর করে পশু-শক্তির উপরে অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উপরে। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিণত করার জন্য, অতিক্রমণের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করার জন্য, গরম-ঘরে চারা তৈরীর কায়দায়, তারা সকলেই ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, সমাজের কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত শক্তি। নোতুন সমাজ-সন্ত্রায় গর্ভবতী প্রত্যেক পুরনো সমাজের ধাত্রী হল শক্তি। এটা নিজেই হল একটা অর্থ নৈতিক ক্ষমতা।
খ্রীষ্টীয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভব. হাউইট, যিনি নিজে খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “বিশ্বের প্রত্যেকটি অঞ্চল জুড়ে এবং যে-সমস্ত জাতিকে সে পদানত করতে পেরেছে তাদের প্রত্যেকটি জাতির উপরে তথাকথিত খ্ৰীষ্টীয় জাতি যেসব বর্বরতা ও বেপরোয়া অত্যাচার চালিয়েছে তার সঙ্গে, পৃথিবীর কোনো যুগে আর কোনো জাতির—তা সে যত ভয়ংকর, যত অ-সংস্কৃত, যত নির্ণয় ও নির্লজ্জই হোক না কেন, তার বর্বরতা ও অত্যাচারের তুলনা মেলেনা।”[৪] হল্যাণ্ডের ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস এবং হল্যাণ্ড ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় ধনতান্ত্রিক জাতি-সেই জাতির ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস হল “বেইমানি, ঘুষখোরি, গণহত্যা ও নীচতার এক নজীরবিহীন ইতিবৃত্ত।”[৫] জাভার জন্য গোলাম করার মতলবে মানুষ চুরি করার ব্যবস্থার চেয়ে আর কিছুই তাদের চরিত্রের এমন বৈশিষ্ট্যসূচক নয়। এই ব্যবসায়ে প্রধান দালাল ছিল চোর, দোভাষী ও বিক্রেতা; প্রধান বিক্রেতা ছিল দেশীয় রাজারা। চুরি-করা তরুণদের নিক্ষেপ করা হত সেলিবিসের অন্ধকূপগুলিতে, যে পর্যন্ত না তৈরি হত দাস-জাহাজগুলিতে রপ্তানির জন্য। একটি সরকারি রিপোর্ট বলা হয়, “নমুনা হিসাবে ম্যাকাসার নামক এই একটি শহরের কথাই বলা যাক। এটা কারাগারে আর কারাগারে ভর্তি; একটার চেয়ে আরেকটা বেশি ভয়ংকর; পরিবার-পরিজন থেকে ছিন্ন করে নিয়ে আসা, লোভ ও অত্যাচারের শিকার, শৃংখলবদ্ধ হতভাগ্যদের দ্বারা জনাকীর্ণ।” মালাক্কাকে হাত করার জন্য ওলন্দাজরা পতুগীজ শাসনকর্তাকে ঘুষ দিল। ১৬৪১ সালে সে তাদের শহরের মধ্যে ঢুকতে দিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে ছুটে গেল এবং তাকে হত্যা করল যাতে করে তার দেশদ্রোহিতার মূল্য স্বরূপ তাকে ২১,৮৭৫ পাউণ্ড দেওয়া থেকে নিজেদের সংবরণ করা যায়। যেখানেই তারা পদার্পণ করল, সেখানেই ঘটল ধ্বংস ও জনশূন্যতা। জাভার একটি প্রদেশ; নাম বাজুওয়াংগি; ১৭৫০ সালে অধিবাসী-সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ হাজার; ১৮১১ সালে তা দাঁড়াল ১৮,০০০। কী মধুর বাণিজ্য।
যে-কথা সুপরিজ্ঞাত, ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী’ ভারতে রাজনৈতিক শাসন ছাড়াও লাভ করে চা-ব্যবসায়ের, এবং সেই সঙ্গে সাধারণ ভাবে চীনা-ব্যবসায়ের ও ইউরোপের সঙ্গে মাল আদান-প্রদান পরিবহনের একচেটিয়া অধিকার। কিন্তু ভারতের উপকূলবর্তী এবং সেই সঙ্গে অন্তদ্বীপ ও অন্তর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার ছিল কোম্পানীর উর্ধতন কর্মচারীদের। লবণ, পান ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর একচেটিয়া অধিকার ছিল ঐশ্বর্যের অফুরান খনি। কর্মচারীরা নিজেরাই দাম ধার্য করত এবং দুর্ভাগা হিন্দুদের খুশিমত লুণ্ঠন করত। এই বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বয়ং বড়লাট (গভর্নর-জেনারেল) অংশ গ্রহণ করত। তার প্রিয়পাত্ররা এমন শর্তে ঠিকা (কন্টাক্ট ) পেত যে অ্যালকেমিস্টদের চেয়েও চতুর এই লোকগুলি শূন্য থেকে সোনা তৈরি করত। একদিনের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠত বিরাট বিরাট ঐশ্বর্য; এক শিলিংও আগাম না দিয়ে আদিম সঞ্চয়ন চলতে থাকল অবাধে। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিচাৰু এই রকমের হাজার হাজার ঘটনায় গিজগিজ করছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। জনৈক সুলিভান যখন এক সরকারি কাজে আফিম অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ভারতের এক অংশের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল, তখন তাকে দেওয়া হল একটি আফিমের ঠিকা। সুলিভান সেই ঠিকাটা বেচে দিল ৪০,০০০ পাউণ্ডের বিনিময়ে জনৈক বিন-এর কাছে। ঐ দিনই বিন সেটাকে বেচে দিল ৬০,০০০। পাউণ্ডে, এবং শেষ পর্যন্ত যে-ক্রেতাটি ঠিকাটি পূরণ করল, সে জানাল যে সেবিপুল পরিমাণ মুনাফা কামিয়েছে। পার্লামেন্টের সমক্ষে উপস্থাপিত একটি তালিকা থেকে দেখা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত কোম্পানী আর তার কর্মচারীরা ভারতীয়দের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল ৬০,০০,০০০ পাউণ্ড। ১৭৬৯ এবং ১৭৭০ সালের মধ্যে ইংরেজরা সেখানে সমস্ত চাল কিনে নিয়ে এবং অবিশ্বাস্য চড়া দাম ছাড়া তা বিক্রি করতে অস্বীকার করে উৎপাদন করল একটা দুর্ভিক্ষ। [৬]
আদিবাসীদের প্রতি আচরণ স্বভাবতই সবচেয়ে সাংঘাতিক আতংকজনক ছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মত বাগিচা-উপনিবেশগুলিতে, যেগুলি নির্দিষ্ট ছিল কেবল রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য, এবং মেক্সিকো ও ভারতের মত ধন-সমৃদ্ধ ও জনবহুল দেশগুলিতে, যেগুলিকে পরিণত করা হয়েছিল লুণ্ঠন-ক্ষেত্রে। কিন্তু যেগুলিকে সঠিক ভাবেই উপনিবেশ (কলোনি’ ) বলা হয়, সেগুলিতেও আদিম সঞ্চয়নের খ্ৰীষ্টীয় চরিত্র নিজেকে মিথ্যা করেনি। ১৭০৩ সালে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের সেই প্রাক্ত বিশেষজ্ঞ, বা নিউ ইংল্যাণ্ডের ‘পিউরিটানরা, তাদের সভার বিধান-বলে প্রত্যেকটি ভারতীয় খুলির উপরে এবং প্রত্যেকটি অধিকৃত লাল-চামড়ার উপরে ৪০ পাউণ্ড করে পুরষ্কার ধার্য করল; ১৭২০ সালে প্রত্যেক খুলির উপরে ১০০ পাউণ্ড; ১৭৭৪ সালে, ম্যাসাচুসেটস-বে একটি উপজাতিকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করার পরে, ধার্য হয়েছিল নিচের দামগুলি। ১২ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের একটি পুরুষের খুলি ১০০ পাউণ্ড (নোতুন টাকায়), একটি পুরুষ বন্দীর জন্য ১০৫ পাউণ্ড, নারী ও শিশু বন্দীদের জন্য ৫০ পাউণ্ড, নারী ও শিশুদের খুলির জন্য ৫০ পাউণ্ড। কয়েক দশক পরে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার প্রতিহিংসা গ্রহণ করল ধর্মাচারী তীর্থপথিক পিতৃপুরুষদের উপরে, যারা ইতিমধ্যেই পরিণত হয়েছে দেশদ্রোহীতে। ইংরেজদের প্ররোচনায় এবং ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়ে লোহিত চর্মরা তাদের হত্যা করল কুঠারাঘাতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সন্ধানী-কুকুর আর মুণ্ড শিকারকে ঘোষণা করল “তার হাতে ঈশ্বর ও প্রকৃতি-প্রদত্ত উপায় বলে।
চারা তৈরির গরম-ঘরের মত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌ-চলাচল ব্যবস্থাকে পরিণত করে তুলল। লুথারের একচেটিয়া সমিতিগুলি” (“সোসাইটিজ মনোপোলিয়া”) মূলধন কেন্দ্রীকরণের শক্তিশালী অনুপ্রেরক হিসাবে কাজ করল। নব-প্রস্ফুটিত শিল্পসমূহের জন্য উপনিবেশগুলি করে দিল বাজারের সংস্থান এবং বাজারের একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে গড়ে উঠল বর্ধিত সঞ্চয়ন। নিরাবরণ লুণ্ঠন, দাসত্ব-বন্ধন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দখলীকৃত ঐশ্বর্য পুনঃপ্রেরিত হত স্বদেশে এবং সেখানে পরিণত হত মূলধনে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে সর্বাগ্রে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলেছিল হল্যাণ্ড; ১৬৪৮ সালেই সে পৌছে গিয়েছিল তার বাণিজ্যিক মহিমার শীর্ষদেশে। তখন তার প্রায় একান্ত অধিকারের মধ্যে এসে গিয়েছিল পূর্ব-ভারতীয় ব্যবসা এবং ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশের মধ্যেকার বাণিজ্য। তার মৎস্য-ক্ষেত্র, নৌবহর, শিল্পোৎপাদন অন্য যে-কোনো দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উক্ত প্রজাতন্ত্রের মোট মূলধন সম্ভবত বাকি ইউরোপের সমস্ত মূলধনের মোট সমাবেশের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” গুলিচ একথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছেন যে, ১৬৪৮ সালের মধ্যে হল্যাণ্ডের জনগণও বাকি ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তুলনায় ছিল মাত্রাতিরিক্ত কর্মভারে ও দারিদ্র্যে এবং পাশবিক অত্যাচারে অতিরিক্ত ক্লিষ্ট।
আজকাল শিল্পগত প্রাধান্য মানে হল বাণিজ্যগত প্রাধান্য। সঠিকভাবে অভিহিত ম্যানুফ্যাকচারের আমলে ব্যাপারটা ছিল আলাদা; তখন বাণিজ্যগত প্রাধান্যই দান করত শিল্পগত আধিপত্য। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা যে তখন প্রাধান্যপুর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, তার কারণও ছিল এই। নবাগত ঈশ্বর” তখন ইউরোপের পুরাগত ঈশ্বরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে বেদি-মঞ্চে আসন পরিগ্রহণ করেন। তার পরে একদিন আচমকা এক ধাক্কা ও লাথি মেরে তাদের সকলকে এক জঞ্জালপে ছুড়ে ফেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনই হল মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
‘পাব্লিক ক্রেষ্টি অর্থাৎ জাতীয় ঋণ, যার উৎপত্তি আমরা আবিষ্কার করি জেনোয়া ও ভেনিসে সেই মধ্য যুগেই, তা ইউরোপের উপরে অধিকার কায়েম করল সাধারণ ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-আমলে। সামুদ্রিক বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক যুদ্ধ-বিগ্রহ সমেত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার জন্য কাজ করল ‘বাধ্যতা-আয়োপের আগার হিসাবে। এই ভাবে তা প্রথম শিকড় গাড়ল হল্যাণ্ডে। জাতীয় ঋণ অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরকীকরণ সে স্বৈরতান্ত্রিক, সাংবিধানিক বা প্রজাতান্ত্রিক, যা-ই হোক না কেন—তা ধনতান্ত্রিক যুগের উপরে একে দেয় নিজের মোহর। তথাকথিত জাতীয় সম্পদের একমাত্র যে অংশটি আধুনিক দেশের মোট জনসংখ্যার যৌথ অধিকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়, সেটি হল—জাতীয় ঋণ।[৭] এই জন্যেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে এল এই আধুনিক মতবাদ : যতই গভীর ভাবে একটি জাতি ঋণগ্রস্ত হয়, ততই সে হয় ধনবান। জাতীয় ঋণ পরিণত হয় মূলধনের ‘জপ-মন্ত্রে। এবং জাতীয় ঋণ-গঠনের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে, জাতীয় ঋণের প্রতি অবিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি অধর্মের স্থান গ্রহণ করে।
জাতীয় ঋণ পরিণত হয় আদিম সঞ্চয়নের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অনুপ্রেরকসমূহের মধ্যে অন্যতম অনুপ্রেরকে। যাদুকরের যাদু-দণ্ডের এক আঘাতের মত তা বন্ধ্যা অর্থকে প্রজননের ক্ষমতায় সমন্বিত করে এবং, শিল্পে, এমনকি, কুসীদ-বৃত্তিতে বিনিয়োজিত হবার সঙ্গে যে-ঝুকি ও ঝামেলা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে সেই ঝুকি ও ঝামেলার মুখে নিজেকে উন্মুক্ত করার আবশ্যকতা ব্যতিরেকেই, তাকে মূলধনে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ঋণ-দাতারা (স্টেট-ক্রেডিটরস’) আসলে কিছুই দিয়ে দেয় না, কারণ যে-অর্থ ধার দেওয়া হয় তা রূপান্তরিত হয় জাতীয় বণ্ডে, যা সহজেই ভাঙানো যায় এবং যা তাদের হাতে কাজ করতে থাকে সেই পরিমাণ নগদ টাকার মত। উপরন্তু, এই ভাবে সৃষ্ট অলস অ্যানুইটি’-ভোগীদের একটি শ্রেণী ছাড়াও সরকার ও জাতির মধ্যে মধ্যস্থতা কারী অর্থ-সংস্থানকারীদের (ফিনান্সিয়ার’-দের) উপস্থিতমত তৈরি সম্পদ ছাড়াও, এবং সেই সঙ্গে কর-আদায়ের ইজারাদার (ট্যাক্স-ফার্মার’ ), সওদাগর, ব্যক্তিগত ম্যানুফ্যাকচারার যাদের কাছে প্রত্যেকটি জাতীয় ঋণের একটা বড় অংশ আকাশ থেকে পড়া মূলধনের মত কাজ করে, তাদের ছাড়াও জাতীয় ঋণ উদ্ভব ঘটিয়েছে যৌথমূলধন কোম্পানি, সর্বপ্রকার বিনিময় সম্পত্তির লেনদেনের এবং বাটা-দান ব্যবস্থার-এক কথায় স্টক-এক্সচেঞ্জের জুয়াড়ি-বৃত্তির এবং আধুনিক ব্যাংক-তন্ত্রের।
বিভিন্ন জাতীয় নামে শোভিত বড় বড় ব্যাংকগুলি তাদের জন্মকালে ছিল কেবল ব্যক্তিগত ফটকাবাজদের সংগঠন; তারা নিজেদের স্থাপন করত সরকারের পাশাপাশি এবং যে-সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তারা পেত, তার দৌলতে সক্ষম হত তার রাষ্ট্রকে অর্থ অগ্রিম দিতে। সুতরাং এই সব ব্যাংকে উত্তরোত্তর স্টক-বৃদ্ধির তুলনায় জাতীয় ঋণের অধিকতর অভ্রান্ত পরিমাপ আর কিছু নেই; এই ব্যাংকগুলির পূর্ণ বিকাশের সূচনা হয় ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’-এর প্রতিষ্ঠা থেকে। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ শুরু করল সরকারকে ৮ শতাংশ হারে টাকা ধার দেওয়া থেকে; একই সময়ে পার্লামেন্ট তাকে ক্ষমতা দিল, ব্যাংক-নোটের আকারে জনগণকে ধার দিয়ে, ঐ একই মূলধন থেকে টাকা তৈরি করার। সে ক্ষমতা পেল ‘বিল’ ভাঙানোর জন্য, পণ্য বাবদে আগাম দেবার জন্য, মূল্যবান ধাতু ক্রয় করার জন্য এই নোট ব্যবহার করতে। কিছুকাল যেতে না যেতেই, স্বয়ং ব্যাংক কর্তৃক তৈরি করা এই ঋণগত অর্থ ( ক্রেডিট মানি’) পরিণত হল মুদ্রায় যার সাহায্যে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ রাষ্ট্রকে ধার দিত এবং, রাষ্ট্রের পক্ষে, জাতীয় ঋণের সুদ দিত। এটাই যথেষ্ট ছিল না যে ব্যাংক এক হাতে যা দিত, অন্য হাতে তার চেয়ে বেশি নিত; সে থেকে যেত এমনকি যখন সে ফেরৎ পেতে থাকত, তখনো জাতির শাশ্বত ঋণদাতা, অগ্রিম-প্রদত্ত শেষ শিলিংটি পর্যন্ত। ক্রমে ক্রমে অনিবার্য ভাবেই সে পরিণত হল দেশের ধাতব সঞ্চয়ের ভাণ্ডারে এবং সমস্ত বাণিজ্যিক ঋণের অভিকর্ষণ-কেন্দ্রে। ব্যাংক-মালিক, ফিনান্সিয়ার, অ্যানুইটি’-ভোগী দালাল, ফটকাবাজ ইত্যাদির একটা গোটা গোষ্ঠীর এই আকস্মিক অভ্যুদয়ের কি ফলাফল সম-সাময়িকদের ঘটেছিল, তা সে সময়কার লেখাজোখা থেকে প্রমাণ হয়, যেমন বলিং-ব্রোক এর লেখা। [৮]
জাতীয় ঋণের সঙ্গে উদ্ভূত হল একটা আন্তর্জাতিক ঋণ-ব্যবস্থা, যা অনেক সময়েই প্রচ্ছন্ন রাখে এই বা ঐ জাতির আদিম সঞ্চয়নের একটি উৎস। যেমন ভেনিসীয় চৌর্য-ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য ছিল ইংল্যাণ্ডের মূলধনসম্পদের একটি গোপন উৎস, যাকে ভেনিস তার অবক্ষয়ের সময়ে প্রচুর অর্থ ধার দিয়েছিল। হল্যাণ্ডে এবং ইংল্যাণ্ডের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। আঠারো শতকের গোড়ার দিকেই ওলন্দাজ ম্যানুফ্যাকচার অনেক পেছনে পড়ে গেল। শিল্প-বাণিজ্যে অগ্রগামী দেশ হিসাবে হল্যাণ্ডের যে-স্থান ছিল, তা আর রইল না। সুতরাং ১৭০১ থেকে ১৭৭৬ পর্যন্ত তার ব্যবসার অন্যতম প্রধান ধারা হল বিরাট বিরাট পরিমাণ মূলধন ধার দেওয়া, বিশেষ করে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেনকে। সেই একই জিনিস আজ চলছে ইংল্যাণ্ড আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে। জন্মের প্রমাণপত্র ছাড়া যে-বিপুল পরিমাণ মূলধন আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা। যায়, গতকাল তা ছিল শিশুদের ধনতান্ত্রিক বক্ত!
যেহেতু জাতীয় ঋণ তার অবলম্বন প্রাপ্ত হয় সরকারি রাজষের মধ্যে, যাকে অবশ্যই সুদ ইত্যাদি বাবদ বাংলরিক ব্যয় বহন করতে হবে, সেহেতু আধুনিক কর-ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে ঋণ-ব্যবস্থার আবশ্যিক পরিপূরকে। ঋণ-গ্রহণের সাহায্যে সরকার সক্ষম হয় তার অস্বাভাবিক ব্যয়গুলি এমন ভাবে নির্বাহ করতে যাতে করে করদাতারা তৎক্ষণাৎ তা অনুভব না করে, কিন্তু তার দরুন কালক্রমে অবশ্যই করবৃদ্ধি ঘটে। অন্য দিকে, একটার পরে একটা যেসব ধার পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে, তার ফলে যে কর-বৃদ্ধি ঘটে, তা সব সময়েই সরকারকে বাধ্য করে নোতুন নোতুন অস্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহের জন্য নোতুন নোতুন ধানের আশ্রয় গ্রহণ করতে। আধুনিক রাজস্ব-সংক্রান্ত নীতি, যার ভিত্তি হল জীবনধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর উপরে কর-আরোপন ( ফলতঃ সেগুলির দামের বৃদ্ধি-সাধন), এইভাবে নিজের মধ্যেই ধারণ করে ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্তির বীজ। অতিরিক্ত কর একটা আকস্মিক ঘটনা নয়, একটা আচৰিত নীতি। সুতরাং, যেখানে এই ব্যবস্থার প্রথম প্রবর্তন ঘটেছিল, সেই হল্যাণ্ডের মহান দেশপ্রেমিক ডে উইট তার নীতি-বাণীতে একে মজুরি-শ্রমিককে বিনয়ী, মিতব্যয়ী, পরিশ্রমী ও শ্রম-ভারে অতি-ভারাক্রান্ত করার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হিসাবে অভিনন্দিত করেছেন। যাই হোক, এই ব্যবস্থা চাষী কারিগর, এক কথায়, নিম্নতর মধ্য-শ্রেণীর সমস্ত অংশের যে জবরদস্তি মূলক উৎপাদন ঘটিয়ে থাকে, তার তুলনায় মজুরি শ্রমিকদের অবস্থার উপরে তা যে ধবংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আমাদের ততটা আলোড়িত করে না। এই ব্যাপারে এমনকি বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিকদের মধ্যে পর্যন্ত দ্বিমত নেই। এর উৎপাদনী উদ্দীপনা আরো উদ্দীপিত হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থার দ্বারা যা এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জাতীয় ঋণ, এবং তার আনুষঙ্গিক রাজ-ব্যবস্থা, সম্পদের মূলধনীকরণে এবং জনসমষ্টির উচ্ছেদ-সাধনে যে বৃহৎ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা থেকে কবেট, ডাবলডে প্রভৃতির মত অনেক লেখক এই ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে এটাই বুঝি আধুনিক জনসমাজগুলির দুর্দশার মৌল কারণ।
সংরক্ষণ-ব্যবস্থা ছিল ম্যানুফ্যাকচারে রত ম্যানুফ্যাকচারকারীদের হাতে একটা কৃত্রিম হাতিয়ার, যার সাহায্যে তারা স্বাধীন শ্রমিকদের উচ্ছেদ করত, উৎপাদন ও জীবনধারণের জাতীয় উপায়-উপকরণকে মূলধনীকৃত করত, মধ্যযুগীয় উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে অতিক্ৰমণকে সংক্ষেপিত করত। এই উদ্ভাবনের একাধিকার (পেটেন্ট নিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি পরস্পরকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলত, এবং, একবার উদ্বৃত্ত-মূল্য তৈয়ারকারীদের সেবাকার্যে ভর্তি হয়ে যাবার পরে, এই অভীষ্ট অনুসরণে নিজেদের আপন আপন জনগণের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে, সংরক্ষণ-শুল্কের মাধ্যমে এবং, প্রত্যক্ষ ভাবে, রপ্তানি-পরিপোষণের মাধ্যমে কেবল দক্ষিণা আদায়ই করত না, তার উপরে, তারা তাদের অধীনস্থ দেশগুলির সমস্ত শিল্পকে জোর করে নির্মূল করে দিত, যেমন ইংল্যাণ্ড করেছিল আইরিশ পশম শিল্পের ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ভূখণ্ডে, কোলবাট-এর দৃষ্টান্তের পরে, প্রক্রিয়াটা অনেক সরলীকৃত হল। আদিম শিল্প-মূলধন এখানে অংশত এসেছিল সরাসরি রাষ্ট্রীয় ধনাগার থেকে। মিরাবব
শিল্প-খনিকের উৎপত্তি সোচ্চারে প্রশ্ন করেন, “কেন, কেন যাচ্ছেন অতদূরে যুদ্ধের আগেকার স্যাল্পনির শিল্প গৌরবের উৎস সন্ধানে? সে উৎস হল সার্বভৌমদের দ্বারা গৃহীত ১৮,০০,০০,০০০ (আঠারো কোটি) পরিমাণ ঋণের সম্ভার।[৯]
ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, জাতীয় ঋণ, গুরুভার কর, সংরক্ষণ, বাণিজ্যিক যুদ্ধ ইত্যাদি যথার্থ ম্যানুফ্যাকচারার-আমলের এই সন্তানেরা আধুনিক শিল্পের শৈশবকালে সুবিপুল ভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। দ্বিতীয়টির আবির্ভাব সূচিত হয় নিপদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। রাজকীয় নৌবাহিনীর মত কারখানাগুলিও ভর্তি করা হয়েছিল তোক ফুসলানো দালালদের মারফৎ। পঞ্চদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে তার নিজের কাল পর্যন্ত জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ সাধনের ভয়াবহ ঘটনাবলীতে স্যার এফ. এম. ইডেন আনন্দে আকুল; ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং আবাদি জমি ও চারণ ভূমির মধ্যে যথোচিত অনুপাত” রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক এই প্রক্রিয়ায় তিনি আত্মতৃপ্তিতে উৎফুল; তবু কিন্তু তিনি ম্যানুফ্যাক্টরি-শোষণকে ফ্যাক্টরি-শোষণে রূপান্তর-সাধন এবং মূলধন ও শ্রমশক্তির মধ্যে “যথার্থ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শিশু-চুরি ও শিশু-গোলামি সম্পর্কে একই অর্থনৈতিক অন্তদৃষ্টি দেখাননি। তিনি বলেন, এটা হয়তো সাধারণের বিচার-বিবেচনার উপযুক্ত বিষয় বলে গণ্য হবে যে, কোনো ম্যানু ফ্যাকচারের সফল পরিচালনার জন্য কুটির ও দুঃস্থ-নিবাসগুলিতে হানা দিয়ে গরিব শিশুদের ধরে আনা, রাতের বেশির ভাগ সময় তাদের দিয়ে পালাক্রমে কাজ করানো এবং যে-বিশ্রামটুকু সকলের পক্ষেই অত্যাবশ্যক কিন্তু সবচেয়ে বেশি আবশ্যক ছোটদের জন্য, তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা প্রয়োজন কিনা; বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মানসিকতার ছেলে এবং মেয়েদের এমন ভাবে এক জায়গায় জড় করা হয় যে একজনের দৃষ্টান্ত অন্য জনে সংক্রামিত হয়ে দুশ্চবিত্রতা ও লাম্পট্যের প্রসার না ঘটিয়ে পারে কিনা, এই সব কিছু যোগ করলে ব্যক্তিগত বা জাতিগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে পারে কিনা।”[১০]
ফিডেল বলেন, “ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ার কাউন্টিগুলিতে, বিশেষ করে, শেষোক্তটিতে, নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনারি ব্যবহৃত হত বড় বড় কারখানা গুলিতে, যেগুলি নির্মাণ করা হতো সেই সব নদীর তীরে, যেখানে জল-চক্র ঘোরানো সম্ভব হয়। এই সব জায়গায় সহসা দরকার পড়ত লক্ষ লক্ষ কর্মীর-শহর থেকে অনেক অনেক দূরে; এবং তখন ল্যাংকাশায়ার অপেক্ষাকৃত উর্বর ও জনবিরল থাকার জন্য, সে শুধু চাইত যে তার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাক। ছোট ঘোট ছেলেমেয়েদের ছোট ছোট ও চটপটে আঙুলগুলির চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি; সঙ্গে সঙ্গেই একটা প্রথা গড়ে উঠল লণ্ডন, বাকিংহাম ও অন্যান্য জায়গার প্যারিশের এখতিয়ারভুক্ত দু-নিবাসগুলি থেকে শিক্ষানবিশ সংগ্রহ করার। ৭ থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সের এমন হাজার হাজার অল্পবয়সী হতভাগ্য ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর উত্তরে। রীতি ছিল এই যে, মনিব তাদের খাওয়া-পরা দেবে এবং কারখানার কাছেই একটি ‘শিক্ষানবিশ-নিবাসে থাকার জায়গা দেবে; কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য তদারক কারী নিযুক্ত করা হত, যাদের একমাত্র স্বার্থ ছিল কত বেশি করে ছেলে-মেয়েদের খাটানো যায়, কেননা তাদের বেতন ছিল তারা, কত পরিমাণ কাজ আদায় করে নিতে পারে, তার আনুপাতিক। স্বভাবতই এর পরিণামে ঘটত নিষ্ঠুরতা। অনেক ম্যানুফ্যাকচারকারী জেলাতেই, বিশেষ করে আমি যে-জেলার লোক সেই অপরাধী জেলাটিতে (ল্যাংকাশায়ারে), আমার বলতে কুণ্ঠা হচ্ছে, এই নিরীহ নিঃসহায় প্রাণী গুলির উপরে-যাদের সঁপে দেওয়া হয়েছিল মালিক-ম্যানুফ্যাকচারের হাতে, তাদের উপরে—অনুষ্ঠিত হত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুরতা; অতিরিক্ত কাজের চাপে তাদের পিষে ফেলা হত নাভিশ্বাস না ওঠা পর্যন্ত : চাবুক মারা হত, শিকল পরানো হত এবং নির্যাতন করা হত নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে নিখুত সুসংস্কৃত পদ্ধতিতে;…অনেক সময়ে চাবুক মেরে মেরে কাজ করানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের একদম উপোস করিয়ে রাখা হত
… এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হত। : সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালবর্তী ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ারের মনোরম ও কাব্যময় উপত্যকাগুলি পরিণত হল অত্যাচারের বিষন্ন বিজন প্রান্তরে। ম্যানুফ্যাকচার কারীদের মুনাফা হল বিপুল; কিন্তু তার ফলে, যে-ক্ষুধা তৃপ্ত হওয়া উচিত ছিল, তা আরো তীব্র হয়ে উঠল; আর তাই ম্যানুফ্যাকচারকারীরা এমন একটা কৌশল অবলম্বন করল যা তাদের সীমাহীন ভাবে মুনাফা এনে দেবে বলে মনে হল; তারা, যাকে বলে রাতের কাজ” তার প্রচলন করল, অর্থাৎ সারা দিন এক প্রস্ত শ্রমিককে খাটিয়ে ক্লান্ত করে দিয়ে, তারা আর এক প্রস্ত শ্রমিককে সারা রাত খাটাবার জন্য লাগিয়ে দিত; রাতের প্রস্ত যে-বিছানাগুলি সবে মাত্র ছেড়ে গিয়েছে, দিনের প্রস্ত সেই বিছানাগুলিতে গিয়ে শুয়ে পড়ত; আবার তাদের তাদের পালা শেষ করে দিয়ে রাতে প্রস্ত এসে সেই বিছানাগুলিতে শুয়ে পড়ত, যেগুলি সকাল বেলা দিনের প্রন্ত ছেড়ে গিয়েছে। ব্যাংকাশায়ারে এটা একটা চতি রীতি যে বিছানাগুলি কখনো ঠাণ্ডা হয়না।”[১১]
ম্যানুফ্যাকচার-আমলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের জনমত লজ্জা ও বিবেকের শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। ধনতান্ত্রিক সনের উপায় হিসাবে কাজ করে এমন প্রত্যেকটি অপকর্ম সম্পর্কে জাসিমূহ কুণ্ঠাহীন ভঙ্গিতে দন্ত করে বেড়াত। নমুনা হিসাবে পড়ুন কীর্তিমান এ এভারসন-এর সাদামাঠা বাণিজ্য বিবরণী’ ( ‘অ্যানালস অব কমার্স’ )। ইউট্রেক্ট-এর যে শান্তিচুক্তিতে ইংল্যান্ড আসিয়েন্টো-সন্ধির দ্বারা স্প্যানিয়ার্ডদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল আফ্রিকা ও স্প্যানিশ আমেরিকার মধ্যেও দাস-ব্যবসা চালাবার অধিকার, যা তখন পর্যন্ত পরিচালিত হত কেবল আফ্রিকা এবং ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মধ্যে সেই চুক্তিকে এখানে তূর্যনাদে ঘোষণা করা হয়েছে ইংরেজ কূটনীতির জয়জয়কার বলে। এতদ্বারা ইংল্যাণ্ড ১৭৪৩ সাল অবধি স্প্যানিশ আমেরিকাকে বাৎসরিক ৪,৮০০ জন করে নিগ্রো সরবরাহে অধিকার অর্জন করে। এর ফলে একই সঙ্গে ব্রিটেনের চোরাচালান একটা সরকারি ছদ্ম আবরণে আবৃত হয়। দাস-ব্যবসায়ের সুবাদে লিভারপুল ফুলে উঠল। এটাই হল তার আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি। এবং আজও পর্যন্ত লিভারপুল-“আভিজাত্য” হল দাশ-ব্যবসায়ের ‘পিণ্ডার’, যা—পুর্বোদ্ধত আইকিন-এর রচনার সঙ্গে (১৭৯৫) তুলনীয়—“যে-দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না লিভারপুলের ব্যবসাকে বিশেষিত করেছে এবং তাকে দ্রুত বেগে বর্তমান সমৃদ্ধির অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে সাযুজ্য লাভ কয়েছে, জাহাজ ও নাবিকদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং দেশের ম্যানুফ্যাকচারের জন্য চাহিদা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করেছে।” (পৃঃ ৩৩৯) লিভারপুল দাস-ব্যবসায়ে নিয়োগ করেছিল, ১৭৩০ সালে ১৫টি জাহাজ, ১৭৫১ সালে ৫৩টি, ১৭৬০ সালে ৭৪টি, ১৭৭০ সালে ৯৬টি এবং ১৭৯২ সালে ১৩২টি।
যখন তুলা-শিল্প ইংল্যাণ্ডে প্রবর্তন করল শিশু-ক্রীতদাসত্ব, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণা সঞ্চার করল পূর্বতন, কম-বেশি, পিতৃতান্ত্রিক ক্রীতদাসত্বের একটি বাণিজ্যিক শোষণ-ব্যবস্থায় রূপান্তর-পরিগ্রহে। বস্তুতঃ পক্ষে, ইউরোপে মজুরি-শ্রমিকদের অবগুণ্ঠিত ক্রীতদাসত্বের পাদপীঠ হিসাবে তার প্রয়োজন ছিল নোতুন জগতে বিশুদ্ধ ও সরল ক্রীতদাসত্বের। [১২]
Tante molis erat, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের “শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা করতে, শ্রমিক এবং তার শ্রমের অবস্থাবলীর মধ্যে বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে, এক মেরুতে উৎপাদন ও প্রাণ-ধারণের উপায়সমূহকে মূলধন এবং বিপরীত মেরুতে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টিকে আধুনিক সমাজের কৃত্রিম সৃষ্টি সেই মজুরি-শ্রমিকে তথা “মুক্ত মেহনতি গরিব মানুষে” রূপান্তরিত করতে।[১৩] যদি অর্থ, অজিয়ার যে কথা বলেছেন, “পৃথিবীতে আসে তার এক গালে জন্মগত রক্তচিহ্ন নিয়ে[১৪] তা হলে মূলধন আসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, প্রত্যেকটি লোমকূপ থেকে ফোটা ফোটা রক্ত ও ক্লেদ ঝরাতে ঝরাতে।”[১৫]
————
১. ‘শিল্প কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে কৃষি’-র সঙ্গে পার্থক্যসূচক হিসাবে। বর্গগত’ অণে কৃষি-মালিক’ ম্যানুফ্যাকচারকারীর মতই একজন শিল্প-খনিক।
২. “দি ন্যাচারাল অ্যাণ্ড আর্টিফিসিয়াল রাইটস অব প্রপার্টি কন্ট্রাস্টেড’, লণ্ডন, ১৮৩২, পৃঃ ১৮-৯৯। অনামী বইটির লেখকের নাম : “টমাস হজস্কিন”।
৩. এই ১৭৯৪ সালেও লীডস-এর বস্তু-প্রস্তুতকারকেরা পার্লামেন্টের কাছে এমন একটি আবেদনসহ প্রতিনিধিমণ্ডলী প্রেরণ করেন, যাতে কোন বণিক ম্যানুফ্যাকচারে পরিণত না হয় সেইরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। (ডঃ আইকিন, ঐ)
৪. উইলিয়াম হাউইট : কলোনাইজেশন অ্যাণ্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি : এ পপুলার হিষ্ট্রি অব দি ট্রিটমেন্ট অব নেটিভস বাই দি ইউরোপীয়ানস ইন অল দেয়ার কলোনিজ, ১৮৩৮, পৃঃ ৯। ক্রীতদাসদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে চালস কোং-এর ‘ব্রেইতে দ্য লা লিজিলে’-এ একটি ভাল সংকলন রয়েছে। যেখানেই বুর্জোয়া শ্রেণী বিনা-বাধায় তার নিজের ছাচ অনুযায়ী বিশ্বকে তৈরি করে নিতে পারে সেখানে সে তার নিজের অন্য এবং শ্রমিকের জন্য কি করে, তা দেখার জন্য এই বইটি বিস্তারিত ভাবে পাঠ করা উচিত।
৫. টমাস স্ট্যামফোর্ড ব্যালস, ঐ দ্বীপটির প্রাক্তন গভর: “দি হি অব জাভা, লণ্ডন, ১৮১৭।
৬. ১৮৬৬ সালে একমাত্র উড়িষ্যা প্রদেশেই ক্ষুধায় মারা যায় ১০ লক্ষাধিক হিন্দু (অর্থাৎ ভারতীয়-বাং অনুঃ)। যাই হোক, চেষ্টা হয়েছিল অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষগুলিকে যে-দামে প্রাণ-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি বিক্রি করা হয়েছিল, তা দিয়ে ভারতের রাজকোষকে সমৃদ্ধ করে তুলবার।
৭. উইলিয়ম কবেট মন্তব্য করেন, ইংল্যাণ্ডে সমস্ত পাব্লিক’ ( ‘সার্বজনিক) প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় “বাল (রাজকীয়’ ); যাই হোক, তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে রয়েছে ন্যাশনাল’ (জাতীয়) ঋণ।
৮. “Si les Tartares inonbaient l’Europe anjourd’hui, il faudrait bien des affaires pour leur faire entendre ce que c’est qu’un flnancier parmi nous.” Montesqnieu, “Esprit des lois.” t. iv., p. 33. oda Londres, 1769.
৯. মিরাবো, ঐ, পৃ ১০১।
১০. ইভেন, ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪২১।
১১. জন ফিলডেন, ‘দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিস্টেম, পৃঃ ৫৬। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থার গোড়ার দিককার কেলেংকারিগুলির জন্য দেখুন ডঃ আইকিন-এর ‘ডেস্ক্রিপশন অব দি কান্তি’ পৃ: ২১৯, এবং জিসবোন-এর ‘এনকুইরি ইনটু দি ডিউটিজ অব মেন’, দ্বিতীয় খণ্ড। যখন স্টিম-ইঞ্জিন ফ্যাক্টরিগুলিকে পল্লী-গ্রামের জলপ্রপাতগুলি থেকে শহরের মধ্যস্থলে স্থানান্তরিত করল, তখন ‘কৃচ্ছ সাধক উদ্বৃত্ত-মূল্য-প্রস্তুতকারক শিশু সামগ্রীকে পেয়ে গেল হাতের কাছে তৈরি অবস্থায়; দুঃস্থ-নিবাসগুলি থেকে গোলাম সংগ্রহ করতে বাধ্য হতে হল না। যখন স্যার আর পীল (আপাত-ন্যায্যতার মন্ত্রী মহোদয়’-এর পিতা) ১৮১৫ সালে শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিল উত্থাপন করলেন, তখন ‘বুলিয়ন-কমিটি’র নক্ষত্র এবং রিকার্ডোর অন্তরঙ্গ বন্ধু হনার কমন্স সভায় বলেন : এটা কলংকজনক যে, একজন দেউলিয়ার জিনিসপত্রের সঙ্গে শিশুদের একটা দলকে ( যদি তাকে কথাটা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। বিক্রির জন্য হাজির করা হয়েছে এবং ঐ সম্পত্তির একটা অংশ হিসাবে প্রকাশ্যেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। দু বছর আগে কোর্ট অব কিংস বেঞ্চ’-এর সমক্ষে একটা অত্যন্ত নৃশংস দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়েছিল, যাতে লণ্ডনে এক ম্যানুফ্যাকচারারের কাছে প্যারিশ কর্তৃক শিক্ষানীশির জন্য প্রেরিত কিছু সংখ্যক বালক অপর একজনের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং কয়েকজন সদাশয় ব্যক্তির দ্বারা চরম দুর্ভিক্ষ-ক্লিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। যখন তিনি একটি পালামেন্টারি কমিটিতে ছিলেন, তখন আরেকটি ঘটনা তার গোচরে আসে বেশি বছর আগে নয় এক লণ্ডন-প্যানিশ এবং একজন ল্যাংকাশায়ারম্যানুফ্যাকচারারের মধ্যে এক চুক্তি হয় যে প্রত্যেক ২০টি শিশুর সঙ্গে একটি করে জড়বুদ্ধি শিশুকে নিতে হবে।
১২. ১৭৯০ সালে ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন করে স্বাধীন লোক-পিছু ছিল ১০ জন করে ক্রীতদাস, ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ১৪ জন, ডাচ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ২৩ জন। (হেনরি ব্রাউহাম, ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কলোনিয়াল পলিসি অব দি ইউরোপীয়ান পাওয়ার্স’, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৭৪)।
১৩. যখন থেকে মজুরি-শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভাব হল তখন থেকে ইংরেজ আইনে মেহনতি গরিব’ কথাটির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কথাটা ব্যবহার করা হয়, একদিকে, অলস গরিব, ভিখারী ইত্যাদি থেকে, অন্য দিকে, সেই সব শ্রমিক যারা এখন তাদের উৎপাদন-উপায়সমূহ থেকে বঞ্চিত হয়নি, সেই পায়রা যাদের পালক এখনো তুলে নেওয়া হয়নি, তাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে। আইনের বই থেকে কথাটা চালু হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এবং কালপেপার, জে চাইল্ড প্রভৃতির কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে এল অ্যাডাম স্মিথ এবং ইডেনের হাতে। এর পরে যে-কেউ সেই জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর-বাগীশ’ এডমণ্ড বার্ক-এর সরল বিশ্বাসের বিচার করতে পারেন, যখন তিনি মেহনতি গরিব’ কথাটাকে অভিহিত করেন জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর’ বলে। এই মোসাহেবটি, যিনি একদা আমেরিকান কলোনি গুলির বেতন-ভোগী হিসাবে আমেরিকার অশান্তির সূচনাকালে ইংরেজ-অভিজাত তন্ত্রের উদারনীতিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, পরে আবার ইংরেজ অভিজাত তন্ত্রের বেতন-ভোগী হয়ে ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ভাবপ্রবণ অতীত-বিলাসীর ভূমিকা গ্রহণ করেন, আসলে হলেন একজন পুরোপুরি স্কুলচরিত্র বুর্জোয়।।
‘বাণিজ্যের নিয়মাবলী হল প্রকৃতির নিয়মাবলী; অতএব বিধাতার নিয়মাবলী। (এডমণ্ড বার্ক, থটস অ্যাণ্ড ডিটেলস অন স্কেয়্যারসিটি, পৃ ৩১, ৩২)। আশ্চর্য কি যে, বিধাতা ও প্রকৃতির নিয়মাবলীর প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে তিনি সব সময়েই নিজেকে সবচেয়ে ভাল বাজারে বিকিয়েছেন। এই বার্ক সাহেব যখন উদারনীতিক ছিলেন, সে সময়ে তাঁর এক অতি সুন্দর চিত্র পাপ্পা যায় রেভারেণ্ড টাকায়-এর লেখায়। টাকার ছিলেন একজন যাজক এবং একজন টোরি, কিন্তু, তা ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে একজন শ্রদ্ধার্থ ব্যক্তি ও সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ। যে কলংকজনক কাপুরুষতা আজ রাজত্ব করছে এবং বাণিজ্যের নিয়মাবলী’-তে অতিশয় ভক্তিভরে বিশ্বাস রাখছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হল বার্ক-এর মত লোকগুলিকে চিহ্নিত করা—যারা তাদের পরবর্তীদের থেকে সব বিষয়েই আলাদা, একমাত্র প্রতিভার বিষয়ে ছাড়া।
১৪. Marie Augier; “Du Credit Public. Paris, 1842.
১৫. ‘কোয়ার্টালি’ পত্রিকার একজন লেখক বলেছেন, মূলধন বিক্ষোভ এবং বিবোধ ছড়ায় এবং তা শংকাপ্রবণ; কথাটা খুবই সত্য; কিন্তু এটা একটা অসম্পূর্ণ বক্তব্য। মূলধন কোনো মুনাফাকে, বা ক্ষুদ্র মুনাফাকেও, পরিহার করে না, ঠিক যেমন প্রকৃতির সম্পর্কে আগে বলা হত যে সে শূন্যতাকে প্রত্যাখ্যান করে। পর্যাপ্ত মুনাফা সহ মূলধন খুবই সাহসী। শতকরা ১০ ভাগ যে কোন জায়গায় তার বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে। শতকরা ২০ ভাগ সৃষ্টি করবে ব্যগ্রতা; শতকরা ৫০ ভাগ, প্রত্যক্ষ ঔদ্ধত্য; শতকরা ১০০ ভাগ তাকে তৎপর করে তুলবে মানুষের সমস্ত আইনকে মাড়িয়ে যেতে; শতকরা ৩০ ভাগ হলে তো এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে তার কুণ্ঠা হবে, এমন কোনো ঝুকি নেই যা নিয়ে সে পিছ-পা হবে—এমনকি তাতে যদি তার মালিকের ফাসিতে ঝুলতে হয়, তা হলেও পবোয়া নেই। যদি বিক্ষোভ এবং বিরোধ মুনাফা নিয়ে আসে, তা হলে সে অবাধে দুটোতেই প্রবোচনা যোগাবে। যা বলা হয়, চোরাচালান আর দাস ব্যবসা তা প্রচুরভাবে প্রমাণ করেছে।” (টি. রে জনিং, “ট্রেস ইউনিয়ন্স অ্যাণ্ড স্ট্রাইক দেয়ার ফিলসফি অ্যান্ড ইন্টেনশন, ১৮৬, পৃ ৩৫-৩৬)।