৩১. শয়তানের কামরায় জুয়ার আসর

খরাবী দিল কী ইস হদ্‌ হ্যয় কেহ্ য়হ্ সমঝা নহীঁ জাতা,
কেহ্ আবাদী ভী য়াঁ থী য়া-কে বীরানহ্ থা মুদ্দৎকা
(হৃদয় আমার এমন উজাড় হয়েছে যে বোঝাই যায় না—
এখানে কোনও বসতি ছিল, না কি যুগ যুগ ধরে উজাড় হয়েই আছে।।)

সেদিন আমার শয়তানের কামরায় জুয়ার আসর বেশ জমে উঠেছে। আমরা চৌসরের জুয়া খেলতুম। বেশ কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ী এসেছেন। আমার নসিব সেদিন বেশ ভালই ছিল, মান্টোভাই। কয়েকটা খেলায় জিতেছি। মনের মধ্যে মীরসাবের একটা শের ভোমরার মত গুনগুন করে যাচ্ছিল :

ইশক মাশুক, ইশক আশিক হ্যয়
ইয়ানি আপনা হি মুবতলা হয় ইশক্‌।

এমন সময় কাল্লু এসে জানাল, একটা পালকি এসেছে বাড়ির সামনে। পালকিতে কয়েকজন জেনানা। আমি ধমক দিয়ে বললুম, তা আমাকে বলতে এসেছিস কেন? বেগম সাহেবার কাছে হয়তো এসেছে। মহলসরায় নিয়ে যা।

কাল্লু চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন বোরখাপরা মহিলা কুঠুরিতে এসে হাজির। আমরা সবাই তো অবাক। কারা এরা? সঙ্গে সঙ্গে সবার বোরখা খুলে গেল। দেখি কোতোয়াল ফয়জুল হাসান, আর তার সিপাইরা। ফজলুল হাসান গর্জে উঠল, সব কো হাথকড়ি লাগাও।

আমি শান্ত হয়ে বললাম, বসুন কোতোয়ালসাব। আমি মির্জা গালিব। আমাকে তো আপনি চেনেন। এঁরা আমার দোস্ত, শাহজাহানাবাদের ইমানদার আদমি।

-তাই জুয়া খেলেন?

আমি হেসে বলি, জুয়া কোথায়? চৌসর খেলা কি অপরাধ?

-চৌসরের পেছনে জুয়া আছে আমি জানি, মির্জা। এর আগেও একবার আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আগে তো থানায় চলুন।

মালিক রাম ফয়জুল হাসানের হাত ধরে বললেন, মির্জার মতো শায়র জুয়া খেলবেন, আপনার বিশ্বাস হয়?

ফয়জুল হাসান হো-হো করে হেসে ওঠে, মির্জা জুয়া খেলেন না, এ-কথা শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে ভেবেছেন?

-খেলি তো কোতোয়ালসাব। আমি হেসে বললুম।

-দেখুন নিজের কানেই শুনুন।

-লেকিন জিন্দেগি কে সাথ।

-মির্জা, বড় বড় কথা বলে আপনি পার পাবেন না। তারপর ফয়জুল হাসান সিপাইদের দিকে তাকিয়ে বলল, সব কো হাথকড়ি লাগাও।

এবার আমার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বললুম, সাহেবরা কিন্তু আমার দোস্ত, মনে রাখবেন কোতোয়াল সাব।

-ওসব কথা আদালতে গিয়ে বলবেন।

আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, মান্টোভাই। সত্যি সত্যিই হাথকড়ি পরিয়ে শাহজাহানাবাদের রাস্তা দিয়ে আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হল। এই অপমানও প্রাপ্য ছিল এ-জীবনে? আমার সঙ্গে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেউ টাকা দিয়ে, কেউ মুরুব্বি দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে গেল। আমি সারারাত রয়ে গেলুম থানার হাজতে।

খবর পেয়ে পরদিন শইফতা সাব হাজতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার দুহাত চেপে ধরে বললেন, চিন্তা করবেন না মির্জাসাব। আমি আপনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবই।

-কী করে?

-দেখি, কী করা যায়। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

শইফতা সাবের কোন চেষ্টাই কাজে লাগল না। আমাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। কোতোয়াল ফয়জুল হাসান আমার ওপর কেন যে এমন নারাজ হল, কিছুই বুঝতে পারলুম না। নতুন ম্যাজিস্ট্রেটও আমার সম্পর্কে না -ওয়াকিফ। ম্যাজিস্ট্রেট সাব তো কোতোয়ালের ওপরে, তবু বিচারের সময় এমন ভাব দেখালেন যেন কোতোয়ালই শেষ কথা। সেশন জজ আমার। দোস্ত ছিলেন, আমার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতেন, এবার তিনিও আমাকে চিনতে পারলেন না। বিচারে সাব্যস্ত হল, আমাকে দুশো টাকা জরিমানা দিতে হবে আর সঙ্গে ছমাস সশ্রম কারাদণ্ড। জরিমানা না দিতে পারলে কয়েদখানার থাকার মেয়াদ আরও বাড়াবে আর দুশো টাকার ওপর আরও পঞ্চাশ টাকা দিলে কারাবাসের সময় আমাকে কাজ করতে হবে না। দিল্লির কাগজে এ-নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। শইফতা সাব উঁচু আদালতে শাস্তি পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানালেন। কিন্তু সেখানেও একই রায় বহাল রইল শইফতা সাবের কাছে শুনেছিলাম, এই রায় শুনে নাকি শাহজাহানাবাদে নাকি তোলপাড় শুরু হয়েছিল। আখবারেও লেখা হয়েছিল, আমার মত অভিজাত, প্রতিভাবান মানুষকে এমন সাধারণ অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া ঠিক হয় নি। সবচেয়ে বড় কথা, জাঁহাপনা বাহাদুর শাহ-আমাকে তো তিনি পছন্দ করতেন না-সাহেবদের লিখিত অনুরোধ জানিয়েছিলেন আমাকে মুক্তি দেবার জন্য। তাঁর আবেদনও নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল, মান্টোভাই।

মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলুম। নিজের ঘরেই তো বছরের পর বছর বন্দি হয়ে থেকেছি, কয়েদখানায় আর নতুন কী শাস্তি পাব? আমার মন অন্য দিক থেকে ভেঙে যাচ্ছিল। আমাকে কয়েদখানায় যেতে হবে শুনে আত্মীয়বন্ধুরা এভাবে দূরে সরে যেতে পারল? পারবেই-ই বা কেন? মীরসাবকে তো তাঁর পরিজনরাই অন্ধ কুঠুরিতে বন্দি করে রেখেছিল। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলুম লোহারুর নবাব আমিনুদ্দিন সাবের ব্যবহারে। কী দোস্তি ছিল তাঁর সঙ্গে। আর তিনি আমাকে একেবারে অস্বীকার করে বসলেন। তার ভাই জিয়াউদ্দিনও সরে দাঁড়ালেন।

রোনে সে অয় নদীম সলামাৎ নহ্ কর মুঝে,
আখির কভী তো উক্লাহ্-এ দিল বা করে কোঈ।
(একটু কেঁদে নিতে দাও, ভৎসনা কোরো না বন্ধু,
কোনও এক সময় তো হৃদয়ের ভার হালকা করবে মানুষ।)

সে-সময় আমার হাত ধরেছিলেন শুধু শইফতা সাব। ফরিস্তার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মামলার সব খরচ, জরিমানার টাকা তিনিই দিয়েছিলেন। প্রায় রোজই কয়েদখানায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।

একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি হজ করে এসেছেন। দারুও আর খান না। আমার মতো কাফেরের কাছে আসেন কেন?

-তওবা, তওবা। এ কী বলছে মির্জাসাব?

-সবাই তো আমাকে ছেড়ে গেছে। আপনি এখনও কেন আসেন?

-মির্জাসাব আপনি কতটা শরিফ, কতটা শরিয়তি পথে চলেন, এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। আমার কাছে আপনি একমাত্র কবি, যাঁকে আমি আমির খসরুর পাশে বসাতে পারি। মিঞা তানসেনের সুরসঞ্চার আর আপনার গজল, আমার কাছে একাকার হয়ে যায়।

-এ কী বলছেন আপনি? মিঞা তানসেন খোদার নূর। আমি তার পাশে কে? আপনার মনে আছে, সে যেবার মল্লার গেয়ে মিঞা বর্ষা নামিয়েছিলেন? আমি রাতে আমার শয়তানের কামরায় শুয়ে শুয়ে সেই দৃশ্য দেখি। কবেকার সেইসব দিন। আর কি কখনও এই দুনিয়াতে ফিরে আসবে?

-আসে তো।

-কোথায়?

-ওই যে আপনার শের—

হৈ খবর গর্ম উন-কে আনে কী,
আজ-হী ঘর-মেঁ বোরিয়া নহ হুয়া।

আমি তো দেখতে পাই মির্জাসাব, জোর খবর তিনি আসছেন। আল মুসব্বির। আর তাকিয়ে দেখি, আজকেই আমার ঘরে একটা মাদুরও নেই।

-আমাকে এভাবে লজ্জা দেবেন না শইফতা সাব।

-আপনি মদ খান, জুয়া খেলেন, এসব কী আমরা জানি না, মির্জাসাব! কয়েদখানায় বন্দি আছেন বলে আমি আপনার পাশ থেকে সরে যাব? আপনি কবি-শব্দ নিয়ে আপনি এখনও যা খুশি করতে পারেন -এর চেয়ে বড় কথা তো আমার কাছে কিছু নেই।

আমি হেসে বলি, আপনি হজ করে এসেছেন। আপনার এসব কথা শুনলে শরিয়তিরা পাথর ছুঁড়ে আপনাকে মেরে ফেলবে।

-আমি তাদের বলব, মহম্মদ মিরাজে গিয়েছিলেন। জন্নত-জাহান্নাম-দুই-ই দেখে এসেছেন। ভাইসব, তোমরা তাঁর পিছনে পিছনে যাও।

-এই লোকজনদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাকেই বুরাক হতে হবে শইফতা সাব।

-তাই সই। আল্লার পথেই তো যাব।

মান্টোভাই, আমি দেখলুম, সংসারের যে জেলখানা, তার চেয়ে কয়েদখানা তো খুব খারাপ নয়। চোর, ডাকাত, খুনি, পাগল-কতরকম মানুষের সঙ্গে যে আমি মিশে যেতে পারলুম। তাদের নানা কিস্সা, কতরকম কথা বলার ধরন। সাহেবদের বাড়িতে পিয়ানোয়-বেহালায় কতরকম সুরের ওঠাপড়া শুনেছিলুম, কয়েদখানার জীবন ঠিক সেইরকম। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, হারমনি-ফ্রেজারসাবের মুখেই শব্দটা প্রথম শুনেছিলুম-সেই হারমনি-ই শুনতে পেলুম জেলখানায় এসে। হাবসিয়া নামে তখন একটা না লিখেছিলুম কয়েদখানায় বসেই। হারমনি-টা ওখানে শুনতে পাবেন, মান্টোভাই।

এখানে বন্দি আমি, কবিতায় বীণায় তুলি ঝঙ্কার,
হৃদয়ের দুঃখস্রোত সুর হয়ে যায়
রক্ত থেকে ছেনে তুলি গান-বন্দি আমি
খুলে ফেলি অদৃশ্য জানলা,
গড়ে তুলি পাখিদের সরাইখানা।
কত কাজ দেবে দাও,
তোমার এই বন্দিত্বের উপহার,
শিকলে বাঁধতে পারবে কি কণ্ঠস্বর
বিলাপ যখন হয়ে ওঠে ঝরণা?
পুরনো বন্ধুরা, এখানে এসো না,
কখনও আমার দরজায় ধাক্কাও দিও না,
আমি তো আগের মতো সহজ হব না।
এখন চোরেরা আমার সঙ্গী,
আমাকেই প্রভু মেনে নেয়,
আমি বলি, বাইরে যেও না ভাই,
ওখানে কিছুমাত্র বিশ্বস্ততা নেই।

ওরা আসে, জেলের রক্ষক ও প্রহরী
যেহেতু আমি তো এসেছি।
খুলে দেয় দরজা,
জানে, আমিই এসেছি।
জেলকুঠুরির বন্ধুরা, উল্লাস করো,
আমি এসে গেছি।
কবির শব্দে তুমি খুঁজে পাবে ঘর,
দ্যাখো, আমিই এসেছি।
বন্ধুরা ফিরিয়েছে মুখ,
আত্মীয়েরা সরে গেছে দূরে,
ওগো, অচেনা মানুষ, বন্দি হৃদয়,
তোমার দিকেই বাড়িয়েছি হাত।

তিন মাস কয়েদখানায় ছিলুম, ভাইজানেরা, আমার সবার সঙ্গেই ভাব-ভালবাসা হয়ে গিয়েছিল। কতজন যে এসে শের শুনতে চাইত। জেলখানায় এসে বুঝলুম, গজল শুনতে প্রায় সকলেই ভালবাসে। কিন্তু এমন-এমন কাজ করতে হয় তাদের, শোনার সময়টুকুও পায় না। সন্ধের পর সবাই আমাকে ঘিরে বসত; সে যেন এক মুশায়েরা। শের বলার লোক তো একা আমিই। একদিন নতুন একটা শের তৈরি করে ওদের শোনালুম :

দায়েমুল-হবস ইস্-চেঁ হৈ লাখোঁ তমন্নায়ে, অসদ;
জানতে হৈঁ সীহ্-এ পুর-কো জিন্দাখানহ্ হম।
(এখানে যাবজ্জীবন বন্দি হয়ে আছে লক্ষ কামনা-বাসনা, আসাদ,
আমার রক্তাক্ত বক্ষকে কারাগার বলেই জানি।)

-মিঞা- একটা মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল। দেখি, যে লোকটা বেশির ভাগ সময় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, সে উঠে বসেছে।

ইকবাল ভাই, নিন্দ টুট গিয়া ক্যায়া? একজন বলে ওঠে।

-ঘুম তো আসে না, ভাইজান। কম্বলের ভেতরে অন্ধকারে শুয়ে থাকি, তবু ঘুম আসে না। কিন্তু মিঞা-সে আমার দিকে সোজাসুজি তাকায়-আপনি কয়েদ হয়ে আছেন বলে, আপনার দিলও কয়েদখানা হয়ে যাবে?

ইকবালের কয়েদখানায় আসার কিস্সাটা আজিব, ভাইজানেরা। বিয়ের পর অনেকদিন ওর সন্তান হচ্ছিল না। তারপরই ওর বিবি গর্ভধারণ করে। ইকবালের ছেলে হয়। ছেলের জন্মের দুবছর পর ইকবাল জানতে পারে, সে নয়, তার খানদানের অন্য কেউ ছেলেটির জন্মদাতা। ইকবাল ছেলেটিকে হত্যা করে কবর দিয়ে আসে। এরপর থেকে সে আর ঘুমোতে পারত না। একদিন নিজেই থানায় গিয়ে হাজির হয়। সব কথা কবুল করে, তারপর কয়েদখানায় চলে আসে।

এই প্রথম ইকবালের মুখ দেখলুম। যেন একটা ঝরে যাওয়া ফুল। এখনও কয়েকটা শুকনো পাপড়ি শরীরে লেগে আছে। সে হঠাৎ বলতে শুরু করল :

ভালা গর্দিশ ফলক কী চ্যয়ন দেতি হয় কিসে, ইনশা
ঘানিমৎ হ্যয় কে হম সুরত ইহাঁ দো চার বৈঠে হৈ।

আহা, কতদিন পরে ইনশা আল্লা খান ইনশার শের শুনলাম। অওধে ইনশার মতো শায়র আর কেই বা ছিলেন? কথাগুলো ভাবুন মান্টোভাই, সময়ের ঘূর্ণি, কাউকেই রেয়াত করে না, খোদা। হাফিজ, কয়েকজন দোস্ত তো এখনও বসে কথা বলতে পারছি। এর চেয়ে বড় আর কী পাওয়া যায় এই জীবনে?

আমি বললুম, ইকবাল ভাই, এইরকম কয়েকজন বন্ধুদের আমি বিশ্বাস করেছিলুম। কিন্তু আমার কয়েদখানায় আসার খবর শুনেই তারা দূরে সরে গেল।

-কেন বিশ্বাস করেছিলেন? খোদা ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করা যায়? তা হলে একটা কিস্সা শুনুন মিঞা।

সঙ্গে সঙ্গে আমার কাল্পর কথা মনে পড়ল। সবাই হই হই করে উঠল, শুনাও ইকবাল-আজ মশহুর কিস্সাকা রাত-। আর ছড়িয়ে পড়ল হাসির উথালপাথাল ঢেউ।

-সিকন্দরের জীবনে একটা ভারী গোপন কথা ছিল। কাউকে তা সিকন্দর বলতেন না।

-সিকন্দর? সমস্বরে চিৎকার ওঠে, কেয়া বাত ইকবাল ভাই।

কেউ একজন বলে ওঠে, কয়েদখানায় সিকন্দরের কিস্সা! লা জবাব ইকবাল মিঞা।

আমি হেসে বলি, সিকন্দর ছাড়া কয়েদখানায় আর কেউ আসতে পারে?

-বহুৎ খুব।

-তা, গোপন কথাটা কী, ইকবাল ভাই? আমি জিজ্ঞেস করলুম।

-সিকন্দরের কান দুটো ছিল বিরাট, যেন হাতির মতো। কেউ সে কথা জানত না। লোকে দেখে হাসবে বলে বড় টুপিতে কান ঢেকে রাখতেন। কানের কথা জানত শুধু তাঁর বুড়ো নাপিত। একদিন নাপিত এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল, তার আর কাজ কার ক্ষমতা রইল না। কিন্তু সম্রাটের জন্য তো এমন লোক খুঁজে দিতে হবে, যে কখনও গোপন কথাটা কারুর কাছে ফাঁস করবে না। সম্রাটের দরবারে বিলাল নামে একটি ছেলে কাজ করত। বুড়ো নাপিত তাকে জানত; বিলালকেই সে সিকন্দরের নাপিত হিসেবে বেছে নিল। সিকন্দর প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু বুড়ো নাপিতের কথা শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। বিলাল কাজে বহাল হল।

-তারপর? অনেকে ইকবালকে ঘিরে ধরল।

-প্রথমবার সিকন্দরের চুল কাটতে গিয়ে তো বিলালের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার দশা। মানুষের এত বড় কান? ভয়ে বিস্ময়ে তার হাত থেকে কাঁচি পড়ে গেল। সিকন্দর বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে বললেন, যা দেখেছ, তা নিজের মনেই রেখো। ও কথা আর কেউ জানতে পারলে তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব, আর গর্দান তো যাবেই, মনে রেখো। এই কথা শোনার পর থেকে বিলাল ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে গেল। সব সময়ই সে দেখতে পায়, তার কাটা মুণ্ডু এখানে-ওখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভয়ে কারো সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল সে। যদি কোনভাবে সম্রাটের কানের কথা মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে এ-ও বুঝতে পারছিল, কথাটা কাউকে না বলা অব্দি সে শান্তি পাবে না। গোপন কথাটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেলেই সে মুক্তি পাবে। কিন্তু চেনাজানা কাউকে বললেও, সে জানত, কথাটা সঙ্গে সঙ্গে সারা শহরে রটে যাবে, আর অমনি তার কাটা মুণ্ডু রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে।

-বিলাল কী করল?

-একদিন লুকিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সে কিছুটা দূরে একটা বনে গিয়ে ঢুকল। সেখানে একটা পুকুর ছিল। রাখালেরা সেই পুকুরে ভেড়াদের এনে জল খাওয়াত, পুকুরপাড়ে নিজেরাও একটু জিরিয়ে নিত।আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিলাল পুকুরের উদ্দেশ্যে বলল, উরিব্বাশ, সে কী ইয়া বড় বড় সম্রাট সিকন্দরের কান। কথাটা বলেই নিজেকে হালকা লাগল তার, যেন অনেকদিন ধরে বুকের ভেতরে আটকে থাকা একটা পাথর বেরিয়ে গেল।

-গুল,গুল। সব গুলগাপ্পা। একজন চেঁচিয়ে উঠল।

-বেওকুফ। ইকবাল বলে ওঠে।-গুলগাপ্পা ছাড়া কোথায়, কবে কিস্সা জন্মেছে শুনি? মানুষের জীবনই গুলগাপ্পায় ভরা, আর কিস্সা-সে তো মানুষেরই তৈরি করা।

-শালা হারামখোরের কথা না শুনে কিস্সাটা তো বলো ইকবাল ভাই। আরেকজন গলা চড়িয়ে বলে।

-বেশ কয়েকমাস চলে গেল। বিলালের ভয়ডর তখন কেটে গেছে; সিকন্দরও নতুন নাপিতকে নিয়ে খোশমেজাজে। কিন্তু এক আশ্চর্য ব্যাপার ততদিনে ঘটে গেছে। সেই পুকুরে কিছু নললতা জন্মেছিল। এক রাখাল একদিন একটা নললতা তুলে তার গায়ে ফুটো করে বাঁশির মতো বাজাতে শুরু করল। বাঁশির আওয়াজ শুনে তার তো চক্ষু চড়কগাছ। সেই আওয়াজের মধ্যে কে যেন বলে চলেছে, উরিব্বাশ, সে কী ইয়া বড় বড় সম্রাট সিকন্দরের কান।

-তারপর?

-একদিন সেই বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সিকন্দরও সেই বাঁশির সুর শুনতে পেলেন। আওয়াজ অনুসরণ করে তিনি রাখালদের ডেরায় পৌঁছলেন। যে বাঁশি বাজাচ্ছিল, তাঁকে গ্রেফতার করে দরবারে নিয়ে এলেন। জেরায় রাখাল সব কথা খুলে বলল। অসম্ভব, সম্রাট গর্জে উঠলেন। সিকন্দর এবার বিলালকে ডেকে পাঠালেন। বিলাল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, হুজুর, আমি তো কানের কথা কাউকে বলিনি। শুধু পুকুরকে বলেছিলাম।

-পুকুরকে? সম্রাটের চোখ কপালে উঠল।

-হুজুর, কথাটা আমি আর বইতে পারছিলাম না। অন্য কাউকে তো বলা যাবে না, তাই পুকুরকে গিয়ে বলেছিলাম।

-তারপর?

-সিকন্দর সেই পুকুর থেকে আরও একটা নললতা তুলে আনতে বললেন। রাখালটি সেই নলতা থেকে বাঁশি বানাল। সেই বাঁশি থেকেও একই কথা শোনা গেল, উরিব্বাশ, সে কী। ইয়া বড় বড় সম্রাট সিকন্দরের কান। শুনে সিকন্দর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর সিপাইদের বললেন, রাখালকে ছেড়ে দাও। আর বিলালের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, চাইলে তুমি এখনও আমার নাপিত থাকতে পারো।

-তারপর?

-সিকন্দর শহরের সেরা লিপিচিত্রকরকে ডেকে পাঠালেন। সোনার কালিতে সে লিখে নিয়ে গেল কয়েকটা কথা; সিকন্দর তা বাঁধিয়ে রাখলেন নিজের শোবার ঘরে যাতে রোজসকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পান।

-কী কথা?

-নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করো না। এমনকি পুকুরও বিশ্বাসঘাতকতা করে।

সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল।

ইকবাল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী বুঝলেন মিঞা?

-তুমি যা বলতে চেয়েছ বুঝেছি। তবে এই কিস্যার মধ্যে আরও একটা লুকনো কথা আছে।

-কী মিঞা?

-জাঁহাপনারও কিছু লুকনো থাকে না। খোদা একদিন না একদিন সবার পর্দা ফাঁস করে দেন। সব ক্ষমতা একদিন এভাবেই হাস্যকর মনে ওঠে, তাই না ইকবাল ভাই?

-জি। একথাটা তো আমি ভেবে দেখিনি।

-সবাই নিজের মর্জি মোতাবেক ভাবে। তাই তো দুনিয়ার খেলাটি টিকে আছে। খোদার দয়ায়, কয়েদখানাকেও আমি একসময় খেলাঘর বানিয়ে তুলতে পেরেছিলুম, মান্টোভাই। আর কয়েদখানা থেকে বেরোনোর পর নসিব আমার দিকে তাকিয়ে প্রথম হাসল। মাত্র কয়েক বছরের জন্য। তাও তো জীবনেরই দান। এই দানের অর্থ জানেন তো, মান্টোভাই? খোদা আপনিই যা দিয়েছেন, আর জুয়ার দান চেলে আমি যেটুকু কেড়ে নিয়েছি। শুধু আয়নায় আসন্ন মৃত্যুর ছায়া এসে লেগে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *