রামচন্দ্র মামলার নাম করে সদরে গিয়েছিলো। সে যখন ফিরলো তখন সন্ধ্যা হয়েছে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সে লক্ষ্য করলো ভান্মতি গুনগুন করে গান করছে। ঘর্ঘর করে একটা জাঁতার শব্দও উঠছে। ভিতরের বারান্দায় এসে সে দেখতে পেলো ভান্মতি গান করতে করতে ডাল ভাঙছে। রান্নাঘরে রান্নার শব্দ হচ্ছে।
ভান্মতি তাড়াতাড়ি উঠে এসে দাঁড়ালো কাছে, বললো, আমার জন্যি কী আনছেন, বাবা?
আনছি, আনছি। রামচন্দ্র তার গামছার পুঁটুলি খুলে একখানা রঙিন শাড়ি বার করলো।
কেউ কেউ আছে যারা গ্রহণ করার আন্তরিকতায় যে কোনো দানকে মহার্ঘ করে দিতে পারে। এ বিষয়ে ভান্মতির নাম করা যায়। রামচন্দ্রর মনে হলো সার্থক হয়েছে বাড়ি ফেরা।
স্ত্রী সনকা এলো। ভান্মতি গেলো হাত-পা ধোবার জল আনতে।
রামচন্দ্র বললো, তোমার জন্যও একটু আনছি।
চুপ করো, মিয়ে শুনবি। বলে সনকা শাড়িখানা হাতে নিয়ে গলা নিচু করে বললো, এ যে বাবু কাপড়।
হোক তা।
কিন্তু আসল কথা রামচন্দ্র ভাঙলো খেতে বসে। সে ভান্মতিকে বললো, একদিন তুমি কইছিলে জমিজমা লিখে-পড়ে দিলে তাড়ায়ে দেয়।
তা দেয়।
তাই বলে লেখাপড়া না করলিও তো মানুষের চলে না। এমন লেখা লিখছি যাতে তাড়ায়ে দিবেরও পারবে না, অথচ লেখাও যোলো আনা হইছে।
তুমি তাইলে এজন্যি সদরে গিছলা? বললো সনকা।
ভালো কাজ চুপেচাপে করতি হয়। কাগজখান দিবো, যত্ন করে রাখবা। এর নাম উইল। পোকায় যেন না কাটে, জলে যেন না ভেজে।
উইলের তাৎপর্য না বুঝলেও সনকা এবং ভান্মতি রামচন্দ্রর আনন্দের অংশ গ্রহণ করলো।
রামচন্দ্র বললো, বুঝলা না, ভানু, আমাক তাড়ায়ে দেওয়া দূরের কথা, যতদিন বাঁচে আছি আমার কাছেই তোমাদের থাকা লাগবি, তবে পাবা সম্পত্তি। উকিল লিখবের জন্যি বিশ টাকা নিছে।
রামচন্দ্র সদর থেকে যেসব জিনিস এনেছিলো তার মধ্যে একখানা নতুন মহাভারত ছিলো। পরদিন সন্ধ্যার আগে বইখানা নিয়ে রামচন্দ্র কেষ্টদাসের বাড়িতে গেলো।
বই দেখেই কেষ্টদাস আনন্দিত হয়েছিলো, সে যখন শুনলো বইখানা তার ব্যবহারের জন্যই এনেছে তখন সে কী করবে খুঁজে পেলো না।
অপ্রতিভের মতো মুখ করে সে বললো, পড়বো?
আপনার ইচ্ছা হয় পড়েন।
তার চায়ে আপনের কথা কন, শুনি।
রামচন্দ্রও নিজের কৌশলটুকু বর্ণনা করার জন্য উন্মুখ ছিলো। সে তার জমি জিরাত কী করে উইল করেছে, কী করে সেই কাগজের প্যাঁচে মুঙ্লা এবং ভান্মতিকে জড়িয়ে ফেলেছে, তার এই অল্পবয়সী উকিলের কত বুদ্ধি, কীরকম হেসে হেসে সে কথা বলে, সদরে কাপড় চোপড়ের আজকাল কত দাম, এসব বর্ণনা করে অবশেষে বললো, কন, এখন ওরা আপন হলো কিনা?