৩১. যে চিঠিতে জাদু জাগে

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
যে চিঠিতে জাদু জাগে

বাজি ধরতে পারি আপনি এখন কি ভাবছেন। আপনি সম্ভবত এখন ভাবছেন এই রকম কিছু : যে চিঠিতে যাদু জাগে! অসম্ভব ব্যাপার! এ রকম শুধু বিজ্ঞাপনই দেখা যায়।

অবশ্য এমন ভাবনার জন্য আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। পনেরো বছর আগে এরকম একটা বই আমার হাতে পড়লে আমিও তাই ভাবতাম।

আসুন খোলাখুলি কথা বলা যাক। ‘যে চিঠিতে যাদু জাগে’ কথাটা কি সঠিক? না, সত্যি কথা বলতে গেলে তা হয় না।

আসল সত্য হলো কথাটা বড় বেশি কম করেই বলা হয়েছে। এই পরিচ্ছদে যে সব চিঠি ছাপা হয়েছে সেগুলো দ্বিগুণ ভোজবাজি দেখিয়েছে। এটা কার আবিষ্কার জানেন? আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সেল্স ম্যানেজার কেন. আর. ডাইকের। তিনি বর্তমানে কলগেট পামলিভ কোম্পানীর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার আর অ্যাসোসিয়েশনের ন্যাশনাল অ্যাডভার্টাইজারের ডাইরেক্টর বোর্ডের সভাপতি। মিঃ ডাইক বলেন ডিলারদের কাছ থেকে খবরাখবর চেয়ে তিনি যে সব চিঠি লিখতেন তাতে শতকরা ৫ থেকে ৮ এর বেশি জবাব কিন্তু পেতেন না। তিনি আমায় বলেছেন শতকরা ১৫ ভাগ পেলেই সেটা তিনি যথেষ্ট ভাবতেন আর ২০ হলে তো সেটা অলৌকিক ভাবতে পারতেন। মিঃ ডাইকের একটা চিঠির জবাব এলো শতকরা ৪২.১২ ভাগ। তিনি এটা কিভাবে করলেন? মিঃ ডাইকের নিজের কথাতেই সেটা শুনুন : চিঠি আসা অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় মিঃ কার্নেগির সঠিক কথা বলা আর মানবিক সম্পর্ক নামের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমি যোগ দেবার পর। আমি দেখলাম আমি যেভাবে চিঠি লিখতাম সেটার সবই ভুল। পাঠক্রম অনুযায়ী চিঠি লেখার পরেই সব বদলে গেল।

চিঠিটা এখানে দিচ্ছি। এটা অন্য একজন লেখককে সামান্য উপকারের অনুরোধে খুশি হতে হয়। এই কারণে নিজের দাম সম্পর্কে তার ধারণা বাড়ে।

মিঃ জন ব্ল্যাঙ্ক,
ব্ল্যাঙ্কভিল, আরিজোনা।

প্রিয় মিঃ ব্ল্যাঙ্ক,

‘একটু অসুবিধা পড়ায় আপনি সাহায্য করতে পারেন কি না ভাবছি?..’ এই ধরনের শুরুতে ভোজবাজী ঘটে যায়। মানুষের চরিত্রই এই।

আর একটা উদাহরণ দেখুন।

আমি আর হোমার একবার ফ্রান্সের অভ্যন্তরে মোটরে চড়ে যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের পুরনো মডেলের ফোর্ড গাড়িটা থামিয়ে আমরা একদল কৃষককে কাছাকাছি বড় শহরে কিভাবে পৌঁছতে পারি জানতে চাইলাম।

প্রশ্নের ফল হলো একেবারে বিদ্যুৎ স্পর্শের মত। এই সব গ্রাম্য কৃষক মোটর গাড়ি খুব কমই দেখেছে। আমেরিকানরা যখন ফ্রান্সে গাড়ি চড়ে যাচ্ছেন তখন তারা নিশ্চয়ই লক্ষপতি। হয়তো হেনরি ফোর্ডেরই আত্মীয় হবেন! এরকমই বোধ হয় ওরা ভাবছিল। তবু ওরা এমন কিছু জানতো যা আমরা জানতাম না। তাই আমরা যখন কাছের শহরে যাওয়ার রাস্তা জানতে চাইলাম তখন তাদের গুরুত্ববোধ বাড়িয়ে দিলাম। তারা একসঙ্গে কথা বলা শুরু করল। একজন নিজেকে জাহির করার দারুণ সুযোগ পেয়ে সে অন্যদের থামিয়ে বলা আরম্ভ করল।

সুতরাং আপনি নিজে এটা একবার চেষ্টা করে দেখুন। অচেনা জায়গায় গেলে এটা করে দেখতে পারেন। এইভাবে বলতে পারেন : দয়া করে অমুক রাস্তায় কিভাবে যেতে পারি একটু দেখিয়ে দেবেন? বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একজন শত্রুকে এইভাবেই সারা জীবনের মত বন্ধু করে তোলেন। সে সময় ফ্রাঙ্কলিন মাঝবয়সী যুবক ছিলেন, তিনি তার জমানো সব টাকায় একটা ছোট ছাপাখানা খোলেন। তিনি ফিলাডেলফিয়ার জেনারেল অ্যাসেম্বলীতে কেরানি নির্বাচিত হন। এটা পাওয়ায় তিনি সরকারী ছাপার কাজ করতে পারতেন। তাতে ভালোই লাভ হতো, বেন তাই বজায় রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু একটা বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিল। অ্যাসেম্বলীর একজন বিরাট ধনী আর ক্ষমতাবান মানুষ ফ্রাঙ্কলিনকে খুবই অপছন্দ করতেন। তিনি শুধু যে তাঁকে অপছন্দই করতেন তাই নয়, খোলাখুলি সকলের সামনে নিন্দাও করতেন।

এটা খুবই মারাত্মক ব্যাপার। আতএব ফ্রাঙ্কলিন ঠিক করলেন তার শত্রুকে বশ করতেই হবে।

কিন্তু কেমন করে? এটা একটা সমস্যাই ছিলো। শত্রুকে কোন সহায়তা করে? না, তাতে তার সন্দেহ জাগতে পারে-ঘৃণা জাগাও অসম্ভব নয়। ফ্রাঙ্কলিন খুবই বুদ্ধিমান মানুষ, তাই এরকম ফাঁদে পা দিলেন না। তিনি তাই এর উল্টোই করলেন। তিনি শত্রুর কাছে কিছু সুবিধা প্রার্থনা করলেন।

ফ্রাঙ্কলিন দশ ডলার ধার চাননি। না, না, এরকম কিছুই না। ফ্রাঙ্কলিন এমন কিছু চাইলেন যাতে অন্য লোকটি খুশি হলেন-এমন কিছু ফ্রাঙ্কলিন চাইলেন যাতে তার সম্মানবোধ জেগে উঠল, এমন সুবিধা যাতে তার অহমিকা আর গুরুত্ব দুই-ই বাড়লো। এমন কিছু যাতে ফ্রাঙ্কলিনের যে শ্রদ্ধা আছে সেটা বোঝা গেল।

বাকিটা ফ্রাঙ্কলিন নিজের কথাতেই শুনুন :

যখন শুনতে পেলাম ভদ্রলোকের বিশেষ দুষ্প্রাপ্য আর ভালো বইয়ের পাঠাগার আছে, আমি তাঁকে অনুরোধ করে চিঠি লিখলাম যদি তাঁর একখানা বই আমাকে কয়েক দিনের জন্যে দেন তাহলে বাধিত হব।

তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা পাঠিয়ে দিলেন, আমিও কদিন পরে সেটা ফেরত দিই। সঙ্গে একটা চিরকুটে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতাও জানালাম।

‘এরপরে আমাদের যখন দেখা হলো তিনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে আমার সঙ্গে কথা বললেন (যা তিনি আগে কখনই করেন নি), আর ভবিষ্যতে আমাকে সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলেন। তাই এরপর আমরা দারুণ বন্ধু হয়ে উঠলাম আর সে বন্ধুত্ব তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্তই ছিল।’

বেন ফ্রাঙ্কলিন প্রায় দেড়’শ বছরেরও বেশি হলো মারা গেছেন কিন্তু তিনি যে মনস্তত্ত্ব কাজে লাগিয়েছিলেন তা আজও অম্লান। সেটা অপরকে কিছু সাহায্যের অনুরোধ।

আমার একজন ছাত্রও এইভাবে উপকার পান। আমার সেই ছাত্রের নাম অ্যালবার্ট বি অ্যামনেল। অ্যামনেল বেশ কবছর ধরে জলের পাইপ আর ঘর গরম রাখার যন্ত্রপাতি বিক্রি করতেন। তিনি ব্রুকলীনের একজন লোকের কাছে কিছুতেই তার যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে পারেন নি। ভদ্রলোকের অফিসে গেলেই তিনি ডেস্কের পিছনে বসে চুরুট খেতে খেতেই গম্ভীর স্বরে অ্যামনেলকে বলতেন, আমার আজ কিছুই দরকার নেই। আমার সময় নষ্ট করবেন না। পথ দেখুন।

এরপর অ্যামনেল নতুন কৌশল ধরলেন। তারপরে সব বদলে গিয়ে তারা পরস্পর বন্ধু হয়ে উঠলেন আর বহু ভালো ভালো অর্ডারও পেলেন।

অ্যামনেলের প্রতিষ্ঠান লং আইল্যাণ্ডের ভিলেজে একটা নতুন শাখা খোলার কথাবার্তারও বলছিলেন। এ এলাকাটা সম্পর্কে ওই প্লাম্বার ভদ্রলোকের ভালো জ্ঞান ছিল। তাই মিঃ অ্যামনেল একদিন তাঁর অফিসে গিয়ে বললেন : মিঃ সি আমি আজ আপনাকে কোন কিছু বিক্রি করতে আসিনি। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছিলাম। কয়েক মিনিট সময় দিতে পারবেন?

‘হুম্’! ভদ্রলোক চুরুটে টান মেরে বললেন, কি বলার আছে বলে ফেলুন।

‘আমাদের প্রতিষ্ঠান লং আইল্যাণ্ডে একটা শাখা খোলার ব্যবস্থা করেছে’–মিঃ অ্যামনেল বললেন। স্থানীয় মানুষদের মধ্যে এলাকাটা সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো আপনি জানেন তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি কাজটা কি বুদ্ধিমানের হবে?’

এবার নতুন ব্যাপার! কারণ ভদ্রলোক এতদিন সেলসম্যানদের বকাবকি করে নিজের গুরুত্ব দেখাতেন আর তাদের পথ দেখতে বলতেন।

কিন্তু এবার একজন সেলসম্যান তাঁর কাছে পরামর্শ চেয়ে অনুরোধ করেছে। হা বিরাট কোন প্রতিষ্ঠানের সেলসম্যান তার মতামত চাইছে।

.

‘বসুন’ চেয়ার টেনে তিনি বসলেন। এরপর লং আইল্যাণ্ডে দোকান কেনা উচিত কিনা সে সম্বন্ধে অনেক কথা বললেন। তিনি শুধু যে জায়গাটা অনুসন্ধান করলেন তাই নয় বরং ওটা কেনা আর মালপত্র সরবরাহ ইত্যাদির বিষয়েও ঢের উপদেশ দিলেন। একটা বিরাট কোম্পানীর ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বলে তাঁর গুরুত্ববোধে বেড়ে উঠল। তিনি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলেন, তিনি এরপর তাঁর পারিবারিক অশান্তির বিষয়েও অনেক কথা বললেন।

এরপর সন্ধ্যেবেলায় যখন ফিরে এলাম’, মিঃ অ্যামনেল বললেন, আমি যে বেশ ভালো মত কিছু অর্ডারই নিয়ে এলাম তাই নয় বরং চিরকালের মতই তাঁর বন্ধুত্ব অর্জন করলাম। বর্তমানে আমি তার সঙ্গে গল্ব খেলি। এই পরিবর্তন আসে তাকে কিছু সুবিধার অনুরোধ করাতেই।

মনে রাখবেন আমরা সকলেই প্রশংসা আর সুনাম চাই, আর এটা পেতে সব কিছুই করতে পারি। তবে কেউই আন্তরিকার অভাব সহ্য করে না। কেউ তোষামোদও চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *