1 of 2

৩১. মাঝরাতের পর আকাশে

মাঝরাতের পর আকাশে যদি কালো মেঘ না জমে, যদি হাওয়ারা ঝেটিয়ে নিয়ে যায় ভারী কুয়াশাদের তাহলে রাত ফুরোবার আগেই আলোর নাটক শুরু হয়ে যায় সামনে। তাপল্যাঙ যেন প্রসারিত হাতের তালুর মত। মাইলের ব্যবধান আছে কিন্তু সেই আলো বিভ্রান্তি আনে দূরত্ব সম্পর্কে। প্রথমে কালোয় নীলে মিশেল আকাশটার বুকে ফুটে ওঠে একটা আলোর বিন্দু। সেখানে নজর যেতে না যেতে তার রঙ হয় টকটকে লাল। একচোখো ডাইনির মত খানিক স্থির থেকে হঠাৎ সেটা সঙ্গী তৈরি করে নেয় তার কিছুটা দূরে। তারপর দুই থেকে তিন এমনি করে সংখ্যা বাড়ে। আর সেইসঙ্গে রঙের চেহারা বদলে যায় , লাল ক্রমশ হালকা হতে শুরু করে। তখনও অন্ধকারের পর্দাটা টাঙানো। যা ছিল বিন্দুতে সীমাবদ্ধ তা গড়িয়ে পড়ে তালুতে। লাল, পাতলা নীল একসময় কাঁচা সোনায় পরিণত হয়। সেই মুহূর্তে অন্ধকার উধাও। একশ আশি ডিগ্রিতে সূর্যদেব প্রকাশিত হবার মুহূর্তে বিন্দুগুলো এক একটা চুড়ো হয়ে যায়। মাকালু, এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্, নেৎসে, নুপটসে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অহংকার প্রায় পাশাপাশি উদ্ধত অথচ সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিকে তাকালে মায়াপুরা পর্যন্ত পরস্পরের অস্তিত্ব ভুলে যায়। চূড়োর বরফগুলো তাদের চেহারা পালটে ফেলে খুব অল্প সময়ে। যেন এক রঙে বেশিক্ষণ সাজা ওদের ধাতে নেই। বিয়ের কনের সাজ খুলে ফেলে ক্রমশ সাদাটে একটা চাদর ওদের গায়ে জড়িয়ে নেয়। রোদ ওঠে আর তারই সঙ্গে ধেয়ে আসে কুয়াশারা এবং সাদা মেঘ, ওই চূড়োর গায়ে লেগে না থাকলে যারা নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। ক্রমশ এই মেঘেদের আড়ালে আবডালে হঠাৎ উঁকি মারা ছাড়া মাকালু এভারেস্টের আর কিছু করার থাকে না। সঙ্গী হয় অন্য চূড়াগুলোও। পৃথিবীর দৃষ্টিতে কতটা কু আছে তা ঈশ্বর জানেন, মেঘগুলো যেন সবসময় ওদের আড়ালে রাখতে ব্যস্ত থাকে।

ফালুট থেকে চ্যাঙথাপু মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। ভারতবর্ষের সীমা পেরিয়ে এইটেই নেপালের প্রথম গ্রাম। ম্যাপ একথা বলছে বটে কিন্তু দুই সরকারের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ সেখানে নেই। যা কিছু ভারতীয় তা যেন ফালুটেই শেষ হয়ে গেছে। আর তিন কিলোমিটার বলতে যে স্বল্প দূরত্ব মনে আসে সেটা অতিক্রম করার সময় শরীরের কষ্টে তিরিশ মনে হওয়া বিচিত্র নয়। যারা অভ্যস্ত তাদের দক্ষতা ধর্তব্যে আনা হচ্ছে না। চ্যাঙথাপু থেকে আরও সাড়ে ছয় কিলোমিটার উত্তরে ওয়ালাং চাঙ। ওয়ালাং চাঙে যাবে বলেই ওরা পা বাড়িয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা পৌঁছে গেল তাপল্যাঙে। যে গ্রামে বিদেশী এসেছিল কবে কেউ সঠিক মনে করতে পারে না। হিমালয়ের ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া আর তাপল্যাঙে দাঁড়ানো এক ব্যাপার। সান্দাকফু থেকে যে সূর্যোদয় দেখা তাতে সব আছে কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে দেখলে যেন হিমালয়ের নিঃশ্বাস ঘাড়ে এসে লাগে। ওরা যখন এখানে পৌঁছেছিল তখন বরফ ছিল না। বছরের তিনমাস এখানকার মাটিতে হাওয়া, কপাল থাকলে রোদ লাগে। সেই তিনমাসে রডোডেনড্রন আর ক্যালেনিয়া নিচ থেকে তেরো হাজার ফুট ওপরে ফুলের উৎসব বসায়। ডুঙডুঙ আর গুড়ুক শাকের চাষ শুরু হয় যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণে। গুণ্ড্রক রোদে শুকিয়ে রাখা হয় বাকি নয় মাসের জন্যে। যা কিছু চাষবাস তা তো এই সময়েই সেরে নিতে হবে। তাপল্যাঙ এবং একই চরিত্রের গ্রামগুলোর মানুষ তাই খেটে নেয় এই তিনমাসে। প্রসারিত হাতের তালুর মত এই গ্রামের জমিতে চাষের মাটি বড় কম। অকৃপণ প্রকৃতির শক্ত মুঠো খুলে খুলে পরিবারভিত্তিক যে স্বল্প জমি তাই বারো মাসের খিদে মেটায়। গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে কিছু জঙ্গল। আর তারপরেই তুষারের পাকাপাকি চাতাল যার শেষ কোথায় কেউ জানে না এখানে। তিন মাসের প্রায় শেষপর্বে ওরা এসে হাজির হয়েছিল এখানে।

ওয়ালাং চাঙে আসতে গেলে চ্যাঙথাপু ডিঙোতেই হয়। সেটাই নিয়ম। কিন্তু পাহাড় যেমন পথ দেয়, পথ কেড়ে নেয়। মানুষটির হুঁশ আসছিল আর যাচ্ছিল। খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ আনন্দর মনে ওয়াংদে সম্পর্কে ভীতি ছিল। লোকটা যে বিশ্বস্ত তা না ভাবার কোন কারণ নেই। অথচ চুপচাপ ভোরের অন্ধকারে যেভাবে মিলিয়ে গেল তার সঙ্গে ওর চরিত্র মিলছে না। গতরাত্রে জন্তুগুলোকে গুলি করে মারা ওর কোন কারণে পছন্দ হয়নি। এখানে যারা বেড়াতে আসে তারা সঙ্গে বন্দুক আনেও না। আনন্দর অস্পষ্ট ধারণা এই দুটোই ওকে ভীত করেছে। হয়তো জন্তুটাকে মেরে ওর কোন সংস্কারে আঘাত দেওয়া হয়েছে। আর এর পরিণতিতে ওয়াংদে যদি ফালুর পুলিস ফাঁড়িতে গিয়ে জানায় বন্দুকধারীরা এই অঞ্চলে এসেছে তাহলে একটা কৌতূহল তৈরি হবেই। অতএব যতটা দ্রুত এই অঞ্চল ছাড়ানো যায় তত মঙ্গল। কিন্তু এই অসুস্থ মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে কত দ্রুত চলা স। ওরা চাইছিল যে কোন একটা লোকালয়ে পৌঁছে যেতে। সুদীপের পক্ষে বেশিক্ষণ একনাগাড়ে হাঁটাটাও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ঠিক তখনই উঠে আসতে লাগল কুয়াশারা সোঁ সোঁ করে। হিমালয়ের খাদগুলোর রহস্য নিয়ে ওরা সমস্ত পৃথিবী আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনহাত দুরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এরমধ্যে জয়িতা একবার হোঁচট খেল। আনন্দর প্রথমে মনে হয়েছিল আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত ওদের অপেক্ষা করা উচিত। কিন্তু ওয়াংদের আতটা যেহেতু তাড়া করে আসছিল তাই সে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই নিয়েছিল। আর এই করতে গিয়েই ওরা পথ ভুল করল। লোকটা হাঁটছে ঘোরের মধ্যে। আনন্দ তাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছিল গ্রামের পথ কোন দিকে? সে কথা বুঝে কিংবা না বুঝে ঘাড় নেড়েছিল। বিড়বিড় করে কিছু বলেও ছিল। এবং এই করতে গিয়ে ওরা একসময় চ্যাঙথাপুর পথ ছেড়ে আরও ডান দিকে সরে এসেছিল। পথ বলে এতক্ষণ যেটাকে মনে হচ্ছিল সেটা ইয়াকের যাওয়া আসার পথ তা ওদের বোঝা সম্ভব হয়নি। প্রায় ঘণ্টাতিনেক যাওয়ার পর প্রথম জয়িতা বসে পড়ল। এই সময়ে ওদের অনেকটা উঁচুতে উঠতে হয়েছে। পিঠের বোঝা, হাতে ওজন এবং এই লোকটিকে প্রায় টেনে আনার ধকল ওদের প্রায় ছিবড়ে করে ফেলেছিল। তখনও চোখের সামনে মানুষের বসতির চিহ্ন নেই। খাড়া পাহাড়, পায়ের তলায় স্যাতসেঁতে পাথুরে জমি আর লেডি স্লিপার এবং কুইন ভিক্টোরিয়ার সমারোহ যা এখন ঘোলাটে কুয়াশার ওড়না জড়িয়ে রয়েছে—এছাড়া আর কোন কিছু চোখে পড়ছে না।

আনন্দ ততক্ষণে ভুলটা ধরতে পেরেছিল। কিন্তু কিভাবে সেটা সংশোধন করা যায় তা তার জানা ছিল না। চ্যাঙথাপু পৌঁছাতে এত সময় লাগার কথা নয়। তিন কিলোমিটার পথ যত ধীরেই তারা আসুক আসা যাওয়ার পথ যখন একটা রয়েছে তখন মানুষের অস্তিত্বের কিছু নমুনা তো পাওয়া যাবেই। রাস্তা যত খাড়াই তোক সেসব কিছুই নজরে আসছে না। লোকটা এখন উবু হয়ে বসে আছে। কল্যাণ তাকে বারে বারে জিজ্ঞাসা করছে তার গ্রাম কোথায়? লোকটা মাঝে মাঝে চোখ খুলছে আর সেটা বন্ধ করছে। কোন কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি তার নেই। কল্যাণ উঠে দাঁড়াল। আনন্দর কাছে এগিয়ে বলল, এ ব্যাটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। অনেক মানবতা এতক্ষণ দেখিয়েছি, আর নয়। কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?

চ্যাঙথাপু। তিন কিলোমিটার রাস্তা। আনন্দ ওর পথ হারাবার আশঙ্কাটা বলতে গিয়েও পারল না। ইচ্ছেশক্তির শেষটুকু নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। খারাপ কথা শোনানোর কোন মানে হয় না। বরং পথ খুঁজতে হবে।

কল্যাণ বলল, তিন? মনে হচ্ছে তিনশো কিলোমিটার হেঁটেছি।

সুদীপ মন্তব্য করল, পাহাড়ে শুনেছি এইরকম মনে হয়।

পড়ে যাওয়ার পর জয়িতা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। সে এবার বলল, আমার মনে হয় দুজন যদি এগিয়ে গিয়ে দ্যাখে কাছাকাছি মানুষ আছে কিনা তাহলে ভাল হয়। এই মালপত্র নিয়ে আর হাঁটতে পারছি না। তাছাড়া ওই লোকটাও আর পারবে বলে মনে হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ একমত হল, জয়িতা ঠিকই বলেছে। এখানে এই পাহাড়ের আড়ালে ওরা তিনজন অপেক্ষা করুক। আনন্দ চল্ আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখি।

আনন্দরও মনে হয়েছিল প্রস্তাবটা ভাল। কিন্তু কল্যাণ আচমকা এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠল কিভাবে তা সে ঠাওর করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ওদের বিশ্রাম করতে দিয়ে সে কল্যাণকে নিয়ে এগোল। খানিকটা হেঁটে কল্যাণ বলল, এত ওপরে উঠেছি তবু পায়ের তলায় বরফ দেখছি না কেন বল্ তো? অথচ সান্দাকফুতে কাল সন্ধেবেলায় বরফ পড়েছিল।

আনন্দ মাথা নাড়ল, ওগুলো বরফ নয়। বৃষ্টির পরে পাতলা তুষার পড়েছিল। এখানে এখন আর বৃষ্টিকে ডাকিস না। তোর ঠাণ্ডা লাগছে না?

না। এই হাতটাতে তো একটুও না। যদি সমস্ত শরীরে প্লাস্টার করে আসতাম। হাসল কল্যাণ। হাঁটার সময় কল্যাণ যতটা সম্ভব লক্ষ্য রাখছিল পথের ওপর। এখানকার পাহাড়ের চেহারা সর্বত্র এক। কোন রাস্তার নিশানা নেই। সুদীপের কাছে ফিরে আসাটা গোলমেলে হয়ে যেতে পারে। মিনিট তিরিশেক পাহাড় ভাঙার পর পথ ফুরিয়ে গেল। সামনে খাড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে। এইটে অতিক্রম করা তাদের সাধ্যে কুলোবে না। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কোথায় চ্যাঙথাপু?

বুঝতে পারছি না। পথ নিশ্চয়ই একটা আছে। আনন্দ অসহায়ের মত চারপাশে তাকাল।

সত্যি বল তো, চ্যাঙথাপু বলে কোন জায়গা আছে কিনা?

মিথ্যে কথা বলে আমার কি লাভ। ম্যাপে ওই জায়গাটার নাম আমি পড়েছি।

ওরা আরও ডানদিক ধরে এগিয়ে গেল। ঘড়িতে সময় চলছে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। অসম্ভব দুর্বল মনে হচ্ছিল নিজেদের। মাথার ওপর সূর্য আছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। সামনের পাহাড়ের প্রাচীর যেন পৃথিবীর শেষপ্রান্তে চলে গিয়েছে।

প্রায় এক ঘণ্টার পর ওরা পাহাড়টাকে দু-টুকরো অবস্থায় দেখল। যেন ইংরেজি ভি অক্ষরের মত কেউ পাহাড়ের অনেকটা তুলে নিয়েছে। কল্যাণ সেদিকে এগোচ্ছিল। পাথরের ওপর পা রাখতে ভরসা হচ্ছিল না। বোঝাই যায় এইখানে অনেককাল মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। ফলে স্যাতসেঁতে শ্যাওলা পাথরগুলোর ওপর জেঁকে বসে আছে। সে কল্যাণকে নিষেধ করল। যদি চ্যাঙথাপুর লোকজন এই পথে যাওয়া আসা করত তাহলে এমনটা হত না, অর্থাৎ এইটে যাওয়ার পথই নয়।

ঠিক সেই সময় একটা পাথরের শব্দ কানে এল ওদের। যেন পাহাড় থেকে কোথাও পাথরটা গড়িয়ে পড়ল। এখন হাওয়া নেই। সাপের মত কুয়াশারা বুকে হেঁটে চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন পাখি ডাকছে না, ভেজা গাছগুলোয় পোকামাকড়ও ডাকছে না। শব্দটা যেটা পাথর গড়ানো বলে মনে হল, সেটা খুব কাছে না হলেও ওদের কানে এল। কিন্তু দুজনেই প্রথমে ওটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, এখন কি করবি? আমার মনে হয় আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যাওয়া উচিত। চ্যাথপুর রাস্তা এদিকে নয়।

ফালুটের পুলিশ-ফাড়ির কথা মনে থাকা সত্ত্বেও এর বিকল্প প্রস্তাব আনন্দর মাথায় এল না। দেখাই যাচ্ছে এগোনোর পথ বন্ধ। সে বিড়বিড় করে বলল, পথ ভুল করেছি। আর তখনই পায়ের শব্দ কানে এল। খুব দ্রুত যেন দৌড়ে গেল কেউ। সে চট করে ঘুরে দাঁড়াল। কল্যাণ চমকে বলল, কোন জন্তু মনে হচ্ছে। আওয়াজটা এদিকেই হল মনে হচ্ছে।

আনন্দরও তাই ধারণা। হিমালয়ের এই অঞ্চলে ঠিক কি কি জন্তু থাকতে পারে সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে বাঘ যে থাকবে না এটা বোঝা যায়। এত ঠাণ্ডা আর বরফে ওদের থাকতে ভাল লাগবে না। কিন্তু পায়ের শব্দটা স্পষ্ট কানে বাজছে। হঠাৎ কল্যাণ নিচু হয়ে একটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল গাছপালা লক্ষ্য করে। এবং তখনই তিনটে মানুষ বেরিয়ে এল যেন আকাশ ছুঁড়ে। আফ্রিকার অভিযানের ওপর তোলা সিনেমাগুলোতে এমন দৃশ্য দেখা যায়। এই লোকগুলোও যেন অনেকক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছিল। পাথর ছোঁড়ামাত্র আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনজনের শরীরে শক্তি আছে, শীতবস্ত্র যা আছে তাতে বোধ হয় ওদেরই চলে যায় কিন্তু প্রত্যেকের বাঁ হাতে একটি ধারালো এবং বাঁকা ছুরি। তিনজনেই ওদের দিকে দৃষ্টি রেখেছে অনড়ভাবে। আনন্দরাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই তিনটে মানুষ যে নেপালি নয় অথচ হিমালয়ের বাসিন্দা তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এদের চোখ-মুখ বেশ হিংস্র দেখাচ্ছে, ধরে থাকা ছুরির হাতে শিরাগুলো টানটান। কল্যাণ দৃশ্যটা দেখামাত্র অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিল। সে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইল এরকম আরও মানুষ ইতিমধ্যে এসে পড়েছে কি না। সেই সময় তিনজনের একজন চিৎকার করে উঠল যার একটা শব্দও ওরা বুঝতে পারল না। এদের গলার স্বর বোধ হয় জড়ানো এবং জান্তব ধ্বনি মেশানো। আনন্দ কথা বলল। যতটা সম্ভব সহজ ভঙ্গিতে সে হিন্দীতে বলল, তোমরা কারা? এভাবে ছুরি নিয়ে আমাদের সামনে এসেছ কেন?

লোক তিনটে পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর ওদের একজন সেই একই ভাষায় মুখ বিকৃত করে আকাশে ছুরি নাচিয়ে চিৎকার করে উঠল। আনন্দ বলল হিন্দীতে, আমি তোমাদের কোন কথা বুঝতে পারছি না।

তিনজন আবার নিজেদের মধ্যে কিছু বলল চাপা গলায়। তারপর একজন একটা পাথর মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ছোঁড়ার ভঙ্গি করে নেপালিতে বসল, তোমরা এটা ছুঁড়েছ। তোমরা আমাদের মারতে চেয়েছ। তোমাদের নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য খারাপ।

আনন্দ শব্দগুলোর অর্ধেক বুঝতে পারল। এরা নেপালি নয়। এবং নেপালি ভাষা ব্যবহার করছে যাতে আনন্দরা বুঝতে পারে। সে মাথা নাড়ল, আমরা জানতাম না ওখানে মানুষ আছে। আমরা তোমাদের শত্রু নই যে মারতে চাই। আমরা ভেবেছিলাম কোন অজানোয়ার ওখানে আছে।

সেই লোকটি জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের ধান্দাটা কি? এখানে এসেছ কেন? এদিকে কোন মানুষ আসে না। নিশ্চয়ই তোমরা ভাল মানুষ নও।

আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। তোমরা কি এখানে থাক?

আমরা একজনকে খুঁজছি। সেই লোকটা আমাদের গ্রামের সর্বনাশ করে পালিয়েছে। কাল থেকে সমস্ত গ্রাম তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমরা যে পথে এসেছিলে সেই পথে ফিরে যাবে। নইলে–।

হুমকিটা গায়ে মাখল না আনন্দ। এদের বোঝানো যায় তিনটে ছুরিকে একমুহূর্তেই স্তব্ধ করার মত ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু বন্দুক দেখিয়ে কোন কাজ হবে না। লোকগুলো ওদের ফিরে যাওয়ার জন্যে যেন অপেক্ষা করছে। হঠাৎ কল্যাণ বলল, আমরা যে লোকটা বয়ে নিয়ে আসছি এরা তার খোঁজ করছে না তো?

খটকা লাগল আনন্দর। লোকটা বাইরে থেকে আসছে, না ভেতর থেকে বাইরে যাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। সে হিন্দীতে বলল, তোমাদের মধ্যে কেউ আমাদের সঙ্গে আসবে?

কেন? লোকটা বোধ হয় এবার নিচু গলায় সঙ্গী দুজনকে প্রস্তাবটা নিজের ভাষায় বোঝাল।

আমরা একটা লোককে পেয়েছি। সে খুব অসুস্থ। প্রায় ফালুটের কাছাকাছি মাটিতে পড়েছিল লোকটা। আমরা ওকে যত্ন করে নিয়ে এসেছি। তোমরা এসে দেখতে পার ঠিক ওকেই খুঁজছ কিনা। আনন্দ কথাগুলো বলে কল্যাণকে ইঙ্গিতে হাঁটতে বলল। ওরা যে পেছনে আসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে এগোচ্ছিল আনন্দ। খানিকটা দূর নামার পর কল্যাণ প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, ওরা আসছে। পেছন থেকে ছুরি মারবে না তো?

ছুরি কেন মারবে? আনন্দ মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল না।

কি জানি বাবা! দেখতে যেমন, এখানে ক্যানিবালরা থাকে কিনা ঈশ্বর জানেন!

কল্যাণের কথা শেষ হওয়ামাত্র অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল আনন্দ। এভাবে সে কোনদিন প্রাণ খুলে হাসেনি। হাসিটা যেন পেটের ভেতর থেকে ছিটকে উঠছিল। কল্যাণ এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যে কোন প্রশ্ন পর্যন্ত করতে পারল না। এবং তিনজন অনুসরণকারী অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ওই শব্দ যেহেতু পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তাই আনন্দ কোনমতে নিজেকে সংবরণ করামাত্র নিচ থেকে সুদীপের চিৎকার ভেসে এল। বোধ হয় সে কারণ জিজ্ঞাসা করছে। আনন্দ বলল, তোর মাথায় এটা কি করে ঢুকল?।

তাই বলে এইরকম হাসার কোন মানে হয় না। কল্যাণকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল।

কয়েক পা হাঁটার পর আনন্দর মনে হল পেছনে পদশব্দ নেই। সে মুখ ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। কল্যাণও সেটা লক্ষ্য করে বলল, কি ব্যাপার?

আনন্দ ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। লোক তিনটে সুদীপের গলা শুনে বিভ্রান্ত হয়েছে। ওরা বোধ হয় ভয় পাচ্ছে প্রকাশ্যে যেতে। সে কল্যাণকে কথা না বলে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। আশেপাশে যে শব্দ হচ্ছে তাতে একথা স্পষ্ট অনুসরণকারীরা ফিরে যায়নি। শুধু তারা বোধ হয় প্রকাশ্যে আসার ঝুঁকি নিতে রাজী নয়।

অনেকটা সময় লাগল ওদের সুদীপের কাছে পৌঁছাতে। সুদীপ দাঁড়িয়েছিল। জয়িতা একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। সেই লোকটা শুয়ে রয়েছে চোখ বন্ধ করে। খুব দ্রুত আনন্দ সুদীপকে ঘটনাটা বলল। ওরা লোকটির চারপাশে চলে আসতেই মাথার ওপরে শব্দ হল। আনন্দ সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, তোমরা কি এই লোকটিকেই খুঁজছ?

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কাটল। তারপর ওপরের পাথরের গায়ে একটা শরীর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, হ্যাঁ। লোকটাকে খুঁজে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। তোমরা চলে যাও।

কিন্তু আমাদের আপাতত যাওয়ার জায়গা নেই। আমরা তোমাদের গ্রামে যেতে চাই।

আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। এই লোকটাকে আমি খুঁজছিলাম, পেয়ে গেছি, এবার তোমরা তোমাদের ধান্দায় যাও, ওকে নিয়ে আমরা গ্রামে ফিরে যাবো।

তোমাদের গ্রামের নাম ওয়ালাং চাও?

না। সেটা আমাদের গ্রাম থেকে চারঘণ্টার পথ। তোমরা এখান থেকে ওয়ালাং চাঙে যেতে পারবে না। যে পথ দিয়ে এসেছিলে সেদিকেই ফিরে যাও। এই লোকটা বেঁচে আছে তো?

সুদীপ জবাব দিল, আছে। আমি ওকে ওষুধ দিয়েছি।

আনন্দ বলল, আমাদের এই সঙ্গীরা হাটতে পারছে না। ওর পায়ে লেগেছে। তোমরা আমাদের আজকের রাতটা তোমাদের গ্রামে থাকতে দেবে?

তোমরা কারা জানি না। অপরিচিত মানুষকে গ্রামে থাকতে দেওয়ার নিয়ম নেই।

আমরা খারাপ মানুষ নই। তাহলে এই অসুস্থ মানুষটাকে কষ্ট করে বয়ে আনতাম না। তাছাড়া আমরা চারজনই পুরুষ নই। একজন মহিলাও আমাদের মধ্যে আছে।

লোকটা যেন বিস্মিত হয়ে বলল, মহিলা আছে তো কি হয়েছে। তাজ্জব ব্যপার!

জয়িতা কথাটা বুঝতে পেরে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, সাবাস! তুইও শেষ পর্যন্ত আমাকে ক্যাপিটাল করে সিমপ্যাথি পেতে চাইছিলি। কিন্তু ওদের কাছে ছেলেমেয়েদের কোন প্রভেদ নেই। তাই তো চাই। কথা শেষ করে সে উঠে এগিয়ে গেল। সেই পড়ে যাওয়ার সময় সম্ভবত চোট পেয়েছিল জয়িতা কারণ হাঁটার সময় বোঝা গেল সে খোড়াচ্ছে। একেবারে পাথরটার সামনে পেীছে সে লোকটাকে বলল, আমরা ফিরে যেতে পারব না। আজকের রাতটা তোমাদের গ্রামে আমরা থাকতে চাই। সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই, তোমরা আমাদের মরে যেতে বল? কি রকম মানুষ তোমরা?

ওর বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে লোকটা চট করে জবাব দিতে পারল না। সে ধীরে ধীরে আড়ালে ফিরে গেল। সুদীপ বলল, সমানে হুকুম করে যাচ্ছে লোকটা একটা ছুরি হাতে নিয়ে। এটা সহ্য করা যায় না। দেব নাকি ঠাণ্ডা করে?

আনন্দ দ্রুত বলে উঠল, না। কক্ষনো না। সহ্য কর। মনে হয় আখেরে কাজ দেবে।

সুদীপ বলল, কিন্তু এই অসুস্থ মানুষটাকে বয়ে এনে ধরিয়ে দেব? অন্যায় হবে না?

আনন্দ জবাব দিল, ও যদি সত্যি অপরাধী হয় তাহলে অন্যায় কিসের? নিশ্চয়ই একটা বিচার করবে ওরা। এখানে থাকলে তো রাত নামলেই মরে যাবে। তাতে ওর কি ভাল হবে?

লোকটা আবার উদয় হল, তোমরা ওর কাছ থেকে সরে দাঁড়াও। যে জিনিসটার খোঁজ করছি তা যদি ওর সঙ্গে থাকে তাহলে তোমাদের আমরা গ্রামে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তোমরা যদি বেইমানি কর তাহলে কাউকে আর বেঁচে ফিরতে হবে না।

আনন্দ ইঙ্গিত করতেই সবাই লোকটাকে ছেড়ে সরে এল। এত যে কথাবার্তা চলছে তা লোকটার কানে ঢুকলই না। প্রায় মৃতদেহের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে লোকটা। ওরা বেশ কিছুটা দূরত্বে চলে আসা মাত্র দুটো মানুষ লাফিয়ে নামল ওপাশের পাহাড় থেকে। প্রথম লোকটি তখনও ওপরে দাঁড়িয়ে। দুটো লোক সন্তর্পণে কাছে এসে মানুষটিকে দেখল। তারপরই একজন প্রচণ্ড ঘৃণায় এক দলা থুতু ছড়িয়ে দিল লোকটার মুখে। দ্বিতীয়জন তখন ওর জামাকাপড়ের মধ্যে হাত ঢুকিয়েছে। তন্নতন্ন করে খুঁজছে সে। তারপর নিরাশ হয়ে মুখ তুলে পাথরের ওপর দাঁড়ানো লোকটাকে কিছু বলল। লোকটা এবার কুদ্ধ ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা ওর কাছ থেকে কোন জিনিস নিয়েছ?

আনন্দ মাথা নেড়ে না বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জয়িতা তাকে থামিয়ে দিল হাত তুলে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি খুঁজছ ওর কাছে?

একটা কালো পাথরের মূর্তি। আমাদের দেবতা। যেদিন থেকে আমাদের গ্রাম জন্মেছিল সেদিন থেকেই ওই দেবতা আমাদের সঙ্গে আছেন। এই লোকটা চ্যাঙথাপুতে যায় প্রায়ই। সেখান থেকে মতলব নিয়ে এসে ওর নোংরা হাত দিয়ে আমাদের দেবতাকে চুরি করে পালিয়েছিল। তবে ও চ্যাঙথাপুতে যায়নি। কিন্তু সেই মূর্তি আমাদের চাই।

জয়িতা মাথা নাড়ল, একটু আগে আমি ওর কাছে একটা পুটলি পেয়েছি। তাতে মূর্তিটা আছে কি না আমি খুলে দেখিনি। সে এগিয়ে গেল শায়িত মানুষটির মাথার দিকে। সঙ্গে মানুষটির পাশে দাঁড়ানো লোকদুটো ছুরি দুটো শক্ত করে তুলে ধরল। সেদিকে নজর না দিয়ে জয়িতা পৌঁছে গেল যে পাথরটায় সে বসেছিল একটু আগে তার পাশে। তারপর পাথরের খাজ থেকে একটা নোংরা পুটলি বের করে চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে সেটা খুলতে লাগল। এবং সেই সঙ্গে বেরিয়ে এল ইঞ্চি-দশকের একটা পাথরের মূর্তি। তেলচুকচুকে কালো পাথরের মূর্তিটি নিখুত শিল্পকর্ম নয় এবং কোন দেবতার তা অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছিল না। মূর্তিটিকে দেখামাত্র ওপরে দাঁড়ানো লোকটি দুহাত মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ছুরি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুটো অনেকটা ঝুঁকে প্রণাম জানিয়ে উল্লসিত মুখে এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল জয়িতা, না। এই মূর্তি আমি তোমাদের হাতে দেব না। তোমরা যে সত্যি কথা বলছ তার কোন প্রমাণ নেই। ওই লোকটা দোষী কিনা তাও আমরা জানি না। এটা যখন দেবমূর্তি তখন নিশ্চয়ই এর পুরোহিত আছে। আমি তোমাদের গ্রামে পৌঁছে সেই পুরোহিতের হাতে একে তুলে দেব।

ওপরে দাঁড়ানোলোকটা চিৎকার করল, আমি মিথ্যে কথা বলছি? দিয়ে দাও মূর্তি নইলে এখনই তোমার শরীর থেকে রক্ত বের হবে।

ঠিক তখনই সুদীপ রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দিল। শব্দটা মেঘগর্জনের চেয়েও জোরালো ঠেকল। ওপরে দাঁড়ানো লোকটা ভয় পেয়ে বসে পড়ল। এগিয়ে আসা লোকদুটো ভয় পেয়ে পেছনে লাফ দিতেই অসুস্থ মানুষটির ওপর গড়িয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ মানুষটি গোঁ গোঁ করে উঠে বসার চেষ্টা করল। সুদীপ চিৎকার করল, তোমরা এতক্ষণ আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলে। কিন্তু এরকম অস্ত্র আমাদের অনেক আছে। আমি তোমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়িনি। শোন, আমরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে চাই না। ও যা বলছে সটাই ঠিক। তোমাদের কথা সত্যি প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত ওই মূর্তি আমরা দেব না।

ওপরের এবং নিচের লোকগুলো যেন পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বন্দুকের গল্প ওরা শুনেছে কিন্তু আওয়াজ এই প্রথম কানে ঢুকল ওদের। কি করবে ওরা বুঝতে পারছিল না। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আনন্দ এগিয়ে গেল, শোন, আমি তোমাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চাই। তোমরা আমাদের বন্ধু বলে মনে কর। আমি কথা দিচ্ছি গ্রামে পৌঁছেই মূর্তিটাকে আমরা দিয়ে দেব। আজকের রাতটা কাটিয়ে যদি তোমরা চাও তাহলে কাল সকালে আমরা কোথাও চলে যাব। কোন ক্ষতি তোমাদের করা হবে না। এখন এই লোকটাকে নিয়ে তোমরা গ্রামে ফিরে চল।

ওপরের লোকটা বোধ হয় পরিস্থিতি বুঝতে পারল। সে নির্দেশ দিতেই একজন ওপাশের জঙ্গলে ঢুকে দ্রুত হাতে একটা শক্ত গাছের ডাল কেটে নিয়ে এল। তারপর ওই ডালের সঙ্গে অসুস্থ মানুষটাকে বেধে নিয়ে দুজনে ডালটাকে কাঁধে তুলে নিল। আনন্দর মনে পড়ল ডায়মণ্ডহারবারের গ্রামে এভাবে মৃতদেহ ঝুলিয়ে আনতে দেখেছে সে। ওরা নিজেদের জিনিসপত্র আবার তুলে নিচ্ছিল। জয়িতা আবার পুঁটলিটা বেঁধে নিয়ে নিজের ব্যাগের দিকে এগোতে ওপরের লোকটা চিৎকার করে নিষেধ করল। খানিকটা ঘুরে নিচে নেমে এসে সে জয়িতার জিনিসপত্র অবলীলায় কাঁধে তুলে নিল। বোঝা গেল দেবমূর্তি জয়িতার সঙ্গে থাকায় এইগুলোর বোঝা সে নিজে নিল। কল্যাণ সেটা লক্ষ্য করে নিজের বোঝার একটা ছোট অংশ লোকটার দিকে এগিয়ে ধরল। একটু রুষ্ট চোখে দেখলেও শেষ পর্যন্ত সে কল্যাণকে হতাশ করল না।

সম্ভবত অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে চলার কারণেই ওরা গতি বাড়াচ্ছিল না। ফলে জয়িতার হাঁটতে সুবিধে হচ্ছিল। প্রথমে যাচ্ছে লোকদুটো, মাঝখানে ওরা, শেষে তৃতীয় লোকটি বোক নিয়ে তাদের অনুসরণ করছে।

আনন্দ লক্ষ্য করল ওরা পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছে না। যদিও সর্বত্র পাহাড়ের পাঁচিল তবু ওরা আরও ডানদিক ধরে উঠছে। সে খানিকটা পিছিয়ে এসে লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, বল ভাই তোমার নাম কি?

পালদেম। লোকটা মুখ না ফিরিয়ে জবাব দিল।

আমরা ওয়ালাং চাঙে যাব ভেবেছিলাম। তোমাদের গ্রামের নাম কি?

তাপল্যাঙ।

যে দেবতার মূর্তি আমরা দেখলাম সেটা কার? দেবতার নাম কি?

পালদেম জবাব দিল না। যেন সে কথা বলতে চাইছে না। আনন্দ আর জেদাজেদি করল না। ওরা সামনে উঠে যাচ্ছিল। কোন পথ নেই। অথচ এরা কি অনায়াসে পথ করে নিচ্ছে। সারাদিন অভুক্ত থাকায় শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সুদীপ মোটামুটি তাল রাখছে কিন্তু জয়িতা খুবই কাহিল হয়ে পড়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। আর তখনই হাওয়া বইতে শুরু করল। সেই হাওয়ার টানে ঋক বেঁধে কুয়াশারা উঠে আসছিল ওপরে। গরম পোশাক থাকা সত্ত্বেও যেন হাড়ে কাঁপুনি লাগল। কিন্তু সেই সঙ্গে এতক্ষণের বেড়ে ওঠা ক্লাভিটা যেন চাপা পড়ল। কল্যাণ বলল, জয়িতা, তুই মাঝখানে থাক। এই কুয়াশার আড়ালে তোর কাছ থেকে মূর্তিটা ছিনিয়ে নিয়ে ওরা পালাতে পারে।

কল্যাণের কথার উত্তরে কেউ কথা বলল না। এত ঠাণ্ডা সত্ত্বেও প্রত্যেকের বুক থেকে গরম নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছিল দ্রুত। আরও মিনিট পনেরো চলার পর ওরা উপত্যকাটা দেখতে পেল। এবং তখনই পালদেমের গলা শুনতে পেল, আমরা এসে গেছি। ওই বাকটা পার হলেই আমাদের গ্রাম।

হঠাৎ যেন নতুন রক্ত বইতে শুরু করল শিরায়। উদ্যমটা এসে গেল পদক্ষেপে। মিনিট পাঁচেকের পর ওরা গ্রামটাকে দেখতে পেল। যে পাহাড়টাকে ওপাশে অভেদ্য বলে মনে হয়েছিল তারই খাজে ওরা দাঁড়িয়ে দেখল নেহাতই গ্রাম, পাহাড়ি ঘরবাড়ি। পাহাড়ের গায়ে টুকরো জমিতে চাষ হয়েছে। বাড়িঘরগুলোয় স্বাচ্ছন্দ্যের চিহ্নমাত্র নেই। গ্রামের শেষেই বরফের পাহাড়। তার সাদাটে দেওয়াল এখানে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট।

ওরা নিচে নামতে না নামতে কিছু মানুষ বেরিয়ে এল উপত্যকায়। সঙ্গে সঙ্গে পালদেম চিৎকার করে কিছু বলল। সেই চিৎকারটা ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে। যারা ক্ষেতে ফসল কাটছিল, যারা অন্যত্র ব্যস্ত ছিল, তারা ছুটে আসতে লাগল এদিকে। একটা পাগলামির লক্ষণ ফুটে উঠল জনতার আচরণে। ওরা ওপরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এই গ্রামে শতিনেকের বেশি মানুষ থাকতে পারে না। আনন্দ পালদেমকে জিজ্ঞাসা করল, ওরা ওইভাবে ছুটে আসছে কেন?

দেবতার মূর্তি পাওয়া গিয়াছে বলে খুশি হয়েছে সবাই।

কিন্তু ওই খুশীর চাপে আমরা মরে যাব। তুমি এগিয়ে গিয়ে ওদের থামাও।

জিনিসপত্র রেখে পালদেম ঢালু পথ বেয়ে দুহাত তুলে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে গেল। প্রায় উম্মত্ত জনতা এবার আচমকা চুপ করে গেল। আনন্দ সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তারপরে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, এখানে পুরোহিত কে আছে?

কথাটার অর্থ কারও বোধগম্য হল না। অনেক চেষ্টার পর পালদেম মানে ধরতে পেরে চিৎকার করল, কাহুন, কাহুন!

তারপরেই ভিড় ঠেলে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন। তার পরনে লামাদের পোশাক। আনন্দ ইঙ্গিত করতেই জয়িতা ধীরে ধীরে তার সামনে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসে মূর্তিটি বের করে এগিয়ে ধরল। পরিতৃপ্ত মুখে শ্রদ্ধাসহকারে কাহুন সেটিকে গ্রহণ করতেই জনতা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।

ওরা সেই দিনের শেষ প্রহরে প্রথম পা দিয়েছিল তাপল্যাঙে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *