1 of 2

৩১. বিক্রমোর্বশী নাটকের অভিনয়

নবীনকুমার সিংহের উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় বিক্রমোর্বশী নাটকের অভিনয়ের প্রবল সুখ্যাতির ফলে কলকাতার ধনী সমাজে বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল। বাংলায় নাটকের অভিনয় ব্যাপারটি তো বেশ অভিনব। এর আগেও দু-চারটি জায়গায় হয়েছে বটে কিন্তু বিদ্যোৎসাহিনী সভার সভ্যরা যেন একেবারে মাৎ করে দিয়েছে। সাহেব-মেমরা পর্যন্ত এসে দেখেছে এবং ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিও প্ৰশংসায় পঞ্চমুখ। সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এই তো বেশ একটি প্রকৃষ্ট উপায়! শহরের বিভিন্ন স্থানে বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করার ধুম পড়ে গেল।

পাইকপাড়ায় রাজ ভ্রাতৃদ্বয় প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ সিংহ সঙ্গীত-নৃত্যাদি সম্পর্কে খুব উৎসাহী। তাঁরা নব্য ধরনের বিলাসী পুরুষ। নবাবী আমলের রেশ ধরে এক দল ধনী এখনো বিকৃত আনন্দে মত্ত; সুরা, বারবনিতাও কদৰ্য রস ছাড়া তাদের তৃপ্তি হয় না। নব্য ধরনের বিলাসী পুরুষরা পছন্দ করেন না। ওসব কিন্তু রুচিশীল আমোদ প্রমোদে অজস্র অর্থ ব্যয় করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত নন। দেশীয় সংস্কৃতির উদ্ধার, সমাজ ও ধর্মসংস্কার, বিদ্যালয় স্থাপন ও নারীশিক্ষার প্রসার—এইগুলিই নতুন আমোদ প্রমোদ, তার সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলা নাটকের অভিনয়। স্বদেশ ও মাতৃভাষার উন্নতি ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে এঁরা পরম্পরের মধ্যে ইংরেজিতে চিঠি চালাচালি করেন এবং এই সব বিষয়ে সাহেবদের কাছ থেকে বাহবা না পেলে বড় অধীর হয়ে পড়েন।

রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ সিংহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সুবিখ্যাত বেলগাছিয়া ভিলা ক্রয় করেছেন এবং সেখানে আওয়ার ওউন ক্লাব নামে একটি সঙ্গীত ও যন্ত্রবাদনের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। দেশের কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা সেখানে সপ্তাহে কয়েকটি সন্ধ্যা আসেন সঙ্গীত সুধালহরী আস্বাদনের জন্য। এবার তাঁরা ঠিক করলেন একটি মৌলিক বাংলা নাটকের মঞ্চাভিনয় করবেন। নিজেরাই। অকালপক্ক যুবক নবীনকুমার সিংহ নিজেই সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে। বিক্রমোর্বিশী, কিন্তু বেলগাছিয়া ভিলার ক্লাব-সভ্যদের কারুরই বাংলাজ্ঞান এমত নয় যে একটি বাংলা নাটক খাড়া করতে পারবেন, তাই তাঁরা গ্ৰহণ করলেন সম্প্রতি প্ৰসিদ্ধ নাট্যকার রামনারায়ণ তর্কীরত্নের রত্নাবলী। প্ৰবল উৎসাহে শুরু হলো মহড়া।

গৌরদাস বসাক এই আওয়ার ওউন ক্লাবের একজন সদস্য এবং তিনি অতিশয় সুপুরুষ ও সুকণ্ঠের অধিকারী বলে তাঁকেও দেওয়া হলো একটি ভূমিকা। গৌরদাসও বেশ উৎসাহ পেয়ে গেলেন। মহড়া দেখতে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি আসেন, অনেক উচ্চমাগের কথাবার্তা হয়, রামগোপাল ঘোষের মতন প্ৰবীণ পুরুষেরা নানাবিধ পরামর্শ দেন, সময়টা বড় সুন্দর কাটে।

বেশ কয়েকদিন মহড়া দেবার পর একটি প্রশ্ন উঠলো। নাটক মঞ্চস্থ করার দিন ভূরি ভুরি রাজপুরুষদের নিমন্ত্রণ করা হবে সাব্যস্ত হয়েছে আগে থেকেই। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে সাহেবরা এমন অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছেন, তাঁরা নিমন্ত্রণ পেলেও আসবেন তো? বাংলা নাটকের তো কিছুই বুঝবেন না। তাঁরা। নবীন সিংগীর বিক্রমোর্বশীতে তো সাহেবরা সাজপোশাক আর মঞ্চের চাকচিক্যই শুধু দেখেছে, নাটকের কথাবস্তু কিছুই তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। তাও সেখানে এসেছিলেন গুটি কয়েকমাত্র সাহেব।

রামগোপাল ঘোষ বললেন, একটি কাজ করলে হয়। এ নাটকের যদি একটি ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে এবং ছাপিয়ে আগে থেকেই সাহেবদের মধ্যে বিতরণ করা যায়, তা হলে সাহেব দর্শকরা নাটকের কাহিনীটিও সম্যক অবগত থাকবেন, অভিনয় অনুসরণ করতে অসুবিধে হবে না।

অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কে করবে। সেই অনুবাদ? রামগোপাল ঘোষ স্বয়ং করলেই কি সবচেয়ে ভালো হয় না?

রামগোপাল হেসে বললেন, আমি বড় জোর উগ্ৰ ভাষায় কোনো প্যামফ্লেট রচনা কত্তে পারি, নাটক কাব্যে হাত দেওয়ার স্পর্ধা করি না। ও রসে আমি বঞ্চিত।

তখন গৌরদাস বললেন, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কতা কয়ে দেকতে পারি। সে রাজি হলে এ কাজ সে ভালোই পারবে।

রাজা ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বন্ধুটির নাম কী?

গৌরদাস বললেন, তার নাম মধুসূদন দত্ত। ইংরেজি সে অতি দক্ষতার সঙ্গে লেখে, ইংরেজিতে সে অনেক পোয়েট্রি রচনা করেচে।

রাজা প্ৰতাপচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কে মধুসূদন দত্ত? কোন বাড়ির ছেলে?

এককালে রাজনারায়ণ দত্ত খুব ফেমাস লা ইয়ার ছেলেন, তাঁর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। তাঁর ছেলে এই মধু, অনেকদিন মাড্রাসে ছেল——

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, ছাত্র বয়েসে আমি এর নাম শুনিচি বটে। খুব ডাকসাইটে ছাত্র ছেলেন, কেরেস্তান হয়েছেলেন না? মাইকেল না কী যেন নতুন নাম হলো—

গৌরদাস বললেন, হ্যাঁ, তিনিই।

রামগোপাল বললেন, আমিও এর কতা শুনিচি। প্যারীর ভাই কিশোরীর বাগানবাটিতে কিচুদিন স্টে করেছেলেন। তা তিনি তো বাংলা জানেন না, পাকা সাহেব, তিনি বাংলা নাটক কী ভাবে ট্রানশ্লেট করবেন?

গৌরদাস বললেন, তিনি বাংলায় একেবারে অজ্ঞ নন। ইচ্ছে করে লোকসম্মুখে বাংলায় কনভার্স করেন না। ইদানি তিনি সংস্কৃত চৰ্চা কচ্চেন, তাই বাংলা নাটক বুঝতে তাঁর খুব একটা ডিফিকালটি হবে না বোধ করি।

প্রতাপচন্দ্র বললেন, বসাকভায়া যখন বোধ কচ্চেন যে এই ব্যক্তিই এ কাজ ভালো পারবেন, তা হলে সেমতই চেষ্টা করা যাক। বসাকভায়ার ওপরই ভার রইলো, একদিন সেই বন্ধুটিকে এই মহড়ায় নিয়ে আসুন বরং।

 

মধুর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি গৌরদাসের, এই উপলক্ষে একদিন গেলেন মধুর চিৎপুরের বাড়িতে। যে ব্যক্তি প্রথম যৌবনেই নিজেকে মহাকবি বলে ঘোষণা করেছিল, বন্ধুদের বলেছিল একদিন তারা তার জীবনী রচনা করবে, সেই মধুসূদন এখন পুলিশ আদালতের একজন সামান্য দোভাষী মাত্র। কবিতা রচনা একেবারেই পরিত্যাগ করেছে। ফিরিঙ্গি পত্নী এবং নিত্যসঙ্গী অর্থাভাব নিয়ে একেবারে জেরবার অবস্থা। পত্নী সদ্য গর্ভবতী হয়েছেন, এ গৃহে দাস-দাসী টেকে না, সংসারে পূর্ণ বিশৃঙ্খলা। অসামাজিক, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন মধুসূদন, গৌরদাস ছাড়া অন্য কোনো বন্ধুবান্ধব তাঁর কাছে আসে না। তিনিও যান না কারো কাছে! চাকুরিটি কোনোক্রমে রক্ষা করে তিনি দিনের অন্য সময় সুরাপান ও গ্রন্থপাঠে ড়ুবে থাকেন। বাকি জীবনটা এই ভাবেই কেটে যাবে। গৌরদাসকে দেখে মধুসূদন বললেন, তুমিও ব্রুটাস? তুমিও আমায় ভুলে গেলে! একবার খোঁজও নিস না, হোয়েদার আই অ্যাম ডেড অর অ্যালাইভ!

গৌরদাস আসন গ্রহণ করে বললেন, বাঃ, বেশ কতা! তুই-ও তো একবারটি আমার খোঁজ নিতে পারিস!

মধুসূদন বললেন, আমি খোঁজ কর্বো! হু উইল পো মাই গাড়ি ভাড়া? আমি গরিব কেরানী, আমি তো তোর মতন সাকসেসফুল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নই।

গৌরদাস উচ্চহাস্য করলেন। ছাত্র বয়েসে মধু কতবার গৌরদাসকে গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, এখন তাঁর মুখে এই প্রকার দারিদ্র্যের কথা শুনলে বিসদৃশ লাগে।

মধুসূদন আবার বললেন, তা ছাড়া, ডিয়ার গৌর, আমি কেরেস্তান, হুটহাট করে যখন তখন তো তোমার বাড়িতে যেতে পারি না!

গৌরদাস বললেন, এও যে নতুন কতা শুনাচি। তুই আমার বাড়িতে আগে যাসনি? সেখেনে থাকিসনি? আমার মায়ের হাতের রান্না খাসনি? তুই ক্রিশচান বলে আমাদের বাড়িতে কোনো অসুবিধে হয়েচে?

মধুসূদন হঠাৎ ব্যাকুলভাবে বললেন, ওঃ, তোর মায়ের রান্না! সেই রুটি আর ফুলকপির ঘণ্ট! সে যে অমৃত! কতদিন খাইনি! গরু-শুয়োর খেতে খেতে জিব আউলে গেল, একদিন তোর মায়ের হাতের নিরিমিষ্যি রান্না খাওয়াবি, গৌর?

—চল না, আজই চল!

—অ্যাট ওয়ান্স! চল, আই অ্যাম রেডি, তোর জননীকে সাক্ষাৎ করে আসি।

—চল, ম্যাডামকেও সঙ্গে নে। তিনি কোতায়?

—না, না, আঁরিয়েৎ যাবে না। ও রুটি ঘণ্টের মর্ম বুজবে না। তা ছাড়া শী ইজ আনওয়েল, ও ফ্যামিলি ওয়েতে আচে।

—তা হলে তুই একলাই চল।

কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোটটি পরিধান করতে গিয়েও আবার খুলে ফেললেন মধুসূদন। নিরাশভাবে বললেন, নাঃ, হবে না! আমার ঘন ঘন তেষ্টা পায়। তোর বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারবো না!

—তেষ্টা পায় মানে?

—তোর বাড়িতে গিয়ে মা জননীর সামনে কি তুই আমায় বীয়র সার্ভ করতে পার্বি? আমি তোদের এই ক্যালকাটার ফিলদি ওয়াটার পান করি না। আই ডোনট টেক ওয়াটার অ্যাট অল। আমি জলের বদলে বীয়র পান করি!

—তুই একেবারেই জল খাস না?

—এই কনটামিনেটেড ওয়াটার খেয়ে কি শেষে ওলাউটোয় মর্বো বলতে চাস? না, না, সেটি হচ্চে না!

—আশ্চর্য কাণ্ড! এই জল খেয়ে আমরা বেঁচে আচি কী করে?

—তোদের সহ্য হয়! তোদের হিন্দু পেটে গঙ্গার জলে সব শুদ্ধ হয়ে যায়! গত মাসে আমি পেট ব্যথায় ধুম ভুগলুম! বাপরে বাপ, লীবর, স্প্লীন, কিডনি যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে!

—তোর এই রোগের কতা জানতুম না তো? চিকিৎসে করিয়েচিস?

–নাঃ!

—আমার বেশ খুব ভালো একজন কোবরেজ আচেন, পেটের ব্যামোর মোক্ষম দাওয়াই দেন।

মধুসূদনের মুখমণ্ডলে যেন একটা দারুণ বিভীষিকার চিহ্ন ফুটে উঠলো। দুই ভুরু উত্তোলিত করে তিনি বললেন, কোবরেজ? হাউ হরিবল! আমি করাবো কোবরেজি চিকিচ্চে! দোজ কোয়োকস! তুই ভুলে যাসনে, গৌর, আমি তোদের একজন রাজার জাতের মানুষ, আমি আনসিবিলাইজড হতে পারি না!

—তবে তোর যা খুশী করা! কিন্তু পেটের ব্যথা পুষে রাকা মোটেই সিবিলাইজড কাজ নয়।

—ও সব কতা থাক। এতদিন ফিগিস ফ্লাওয়ার হয়ে কোতায় ছিলিস?

—আমার একটা নতুন নেশা হয়েচে। বেলগেছে।তে পাইকপাড়ার রাজাদের সঙ্গে আমরা নাটক করচি।

—নাটক? কী নাটক? কারা যেন মাৰ্চেণ্ট অব ভেনিস কচ্যে, শুনিচি বটে!

—আমাদের নাটক বাংলা।

—বাংলা? সে তো যাত্ৰা! তুই শেষ পর্যন্ত গেয়ে যাত্রায় মেতিচিস, গৌর? ছি, ছি, এই তোর নতুন নেশা!

—যাত্রা কেন হবে। ইওরোপীয় ঢঙে নাটক, স্টেজ বাঁধা হবে, পেছনে ব্যাক ড্রপ, দু পাশে প্রোসেনিয়াম, সামনে ফুট লাইট থাকবে নুকোনো হ্যাজাক বাতির। সাঁ সুসি থিয়েটারে যেমন দেকিচিস—

—জ্বালালি তুই আমায় গৌর! ওসব কতা থাক, তুই অন্য কতা বলা!

—অন্য কতা বললে তো চলবে না। আমরা তোর ঠেঙে একটু সাহায্য চাই। আমাদের নাটকটি তোকে ইংরেজিতে ট্রানশ্লেট করে দিতে হবে, ইংরেজ দর্শকদের জন্য।

—শুনিচি, যারা ভাঙ খায়, তারা অনেকে উদভট্টি কতা বলে। তুই কি আজকাল ঐসব নেশাও ধরিচিস নাকি? যদি নেশা কত্তেই হয়, আমার মতন সিবিলাইজড নেশা–

—কেন, উদভট্টি কী বললুম? ইংরেজদের খুশী করার উপযোগী ইংরেজি তোর মতন আর কে লিকতে পারবে?

—নো ডাউট, আমার থেকে ভালো ইংলিশ আর কেউ লিকতে পারে না। বাট হোয়াট ইমপাটিনেন্স! আমি ট্রানশ্লেট কবো বাংলা থেকে ইংলিশে? বড় ভাষা, গ্রেট ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে ছোট ভাষায় ট্রানশ্লেসান হয়। যেমন হয় ইংলিশ থেকে বাংলায়।

-কিন্তু মধু, এটা যে মোদের দরকারী! তুই সাহায্য না করলে—

—আমি সরি, গৌর, এ ধরনের প্রস্তাব দিয়ে তুই আমায় ইনসল্ট করিস না!

—কিন্তু আমি রাজাদের কতা দিয়িচি। তুই নাটকটা একবার অন্তত নেড়েচেড়ে দ্যাক। আমি বইটার কপি এনিচি।

-কে লিকেচে ওটি।

—রামনারায়ণ তর্করত্ন।

—তিনি আবার কিনি? কোনো টুলো পণ্ডিত নিশ্চয়!

—তুই নাটুকে রামনারায়ণের নাম শুনিসনি? কুলীনকুল সর্বস্ব লিকে খুব নাম করেচেন।

—হেঃ, হে-হে-হে-হে, হে, হে, তুই ভারি মজার কতা বলিস গৌর! একে তো এই নেটিব ল্যাঙ্গুয়েজ, তাতে লিকে আবার নাম করা! হে-হে—

—তুই যতই হাসিস মধু, নেটিভ ল্যাঙ্গোয়েজেরও কদর বাড়চে! দ্যাক, প্যারীচাঁদবাবু টেকচাঁদ ঠাকুর এই পেন নেম নিয়ে আলালের ঘরের দুলাল নামে নবেল ছাপালেন। আমাদের দেশে প্রথম নবেল, খুব বিক্রি হচ্চে সে বই।

—চাঁড়াল, মুচিরাও আজকাল দুপাত বাংলা শিকচে, তারা ও বই ছাড়া আর কী-ই বা পড়বে, কী-ই বা বুজবে!

গৌরদাস রত্নাবলী নাটকটির একটি কপি তার হাতের মোড়ক খুলে বার করে বললেন, একবার একটু পড়ে দ্যাক। শক্ত কিচু নয়। তোর পক্ষে ট্রানস্লেট করা খুব সহজ।

মধুসূদন অতি অবজ্ঞার সঙ্গে বইটি নিয়ে প্রথম পাতা খুললেন। তারপরই নাক বেঁকিয়ে বললেন, প্রোজ! একে তো বাংলা ভাষা একটি উইকলিং, তার ওপর এর প্রোজ আমার দু চক্ষের বিষ! তোমাদের প্যারীবাবুই বলো আর বিদ্যেসাগরই বলো, কারুর প্রোজই আমার এই স্টমাক ডাইজেস্ট করতে পারবে না।

বইটা গৌরদাসের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে মধুসূদন বললেন, অবনক্সাস রচনা, দু ছত্তর পড়েই বুঝিচি। প্লীজ ফরগিভ মী, গৌর, আই বিসীচ ইউ—

গৌরদাস বইটি মুড়ে রাখলেন। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুই কিশোরীচাঁদবাবুর বাগানবাড়িতে একদিন প্যারীবাবুর সামনে জাঁক করে বলিচিলি যে বাংলাতে কত ভালো লেকা যায় তা তুই লিকে দেকিয়ে দিবি! তখন ভেবেচিলুম, বাংলার প্রতি তুই মনোযোগী হবি—

তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মধুসূদন বললেন, সে নেশার ঝোঁকে কী বলিচিলুম, তুই অমনি সেটা ধরে বসে আচিস! তা ছাড়া আমার সে উৎসাহও নেই, উদ্যমও নেই!

—তুই আমাদের রিহার্সালে একদিন তো এলেও পারিস, হাপ্তায় দুদিন সন্ধেবেলা আমরা বেলগেছে ভিলায় জড়ো হই, জায়গাটিও মনোরম।

—ইভনিং-এ বাড়ির বাইরে থাকা আমার সয় না!

—তা হলে আমি উঠি, মধু। রাজারা তোকে ভালো অনারেরিয়াম দেবেন বলেচিলেন। এটা ট্রানস্লেট করলে ওঁরা তোকে পাঁচশো টাকা দিতেন।

মধুসূদন চমকিত হয়ে বললেন, কী? কী বললি? কত টাকা?

–পাঁচশো টাকা।

–শোনা গৌর, বোস, বোস, ভালো করে শুনি ব্যাপারটা। পাঁচশো টাকা? সত্যি দেবেন?

—সত্যি নয় কি রাজারা মিচে কিতা বলবেন?

—ওয়েইট এ মিনিট, ওয়েইট এ মিনিট। দ্যাট মেকস এ গ্রেট ডিফারেন্স? পাঁচশো টাকা? সে যে আমার চার মাসের মাইনে! অ্যাণ্ড আই ক্যান ফিনিস দিস ড্যাম থিং ইন ফোর ডেইজ! ওরে ব্যাপারে বাপ, পাঁচশো টাকা পেলে আমি বর্তে যাবো! পাওনাদাররা আমায় ছিঁড়ে খাচ্চে!

—তুই করবি তা হলে কাজটা?

—নিশ্চয়ই! আলবাৎ! কিন্তু গৌর, সব বাংলা যদি আমি বুঝতে না পারি?

—আমি চেষ্টা করবো বুজিয়ে দেবার। কিংবা তুই আমাদের রিহার্সালে আয়, অ্যাকটরদের মুখ থেকে কতগুলো শুনলে তোর আরও বোজবার সুবিধে হবে!

মধুসূদন জোর করে গৌরদাসকে টেনে তুলে তার দুই গণ্ডে ফটাফট শব্দে কয়েকটি চুম্বন দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, হুর-রে, হু-ররে, আঁরিয়েৎ ডিয়ার, হোয়াট এ গ্রেট নিউজ-আমি পাঁচশো টাকা আর্ন কচ্যি, আই উইল বাই ইউ এ ফ্রেঞ্চ গাউন।

উল্লাস একটু প্রশমিত হলে মধুসূদন আবার কৃতজ্ঞতার সুরে বললেন, গৌর, তুই আমার প্রকৃত সুহৃদ, ঠিক সময়টিতে তুই সাহায্য করতে আসিস, পাঁচশো টাকা-লাইক এ গ্রেট ফুল আমি এ কাজটা রিফিউজ কচ্যিলুম…

এর পরও মধুসূদনের কণ্ঠস্বর ঘন ঘন পরিবর্তিত হতে লাগলো। একবার তিনি গর্বের সুরে বললেন, কাজটা যে অতি রেচেড, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কাজ আমি কল্পে লজ্জারও কিচু নেই। অনেক গ্রেট রাইটারকেও হ্যাক রাইটিং কত্তে হয়েচে টাকার জন্য–।

তারপরই আবার ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন, আমি জানি, আমি গ্রেট রাইটার নই, আই অ্যাম নো লংগার এ রাইটার অ্যাট অল, আমি এখন আর কিছুই না, আই অ্যাম এ রেক, তাই না, গৌর?

 

খোলস ছাড়া নতুন প্রাণীর মতন অন্ধকার গুহা ছেড়ে কারুর বাইরের আলোকিত জগতে আসার মতন, লোয়ার চিৎপুর রোডের বাড়ির স্বেচ্ছা নিবাসন ছেড়ে বেলগাছিয়া ভিলার বিশিষ্ট জনসমাগমে একবার এসে পড়ার পর মধুসূদনের জীবনে একটি বেশ বড় পরিবর্তন এলো। মানসিক জড়তা কেটে গেল, ফিরে এলো তাঁর কর্মে উদ্যম, জেগে উঠলো তাঁর অহঙ্কারী সত্তাটি। সকলের মধ্যে নিজেকে শ্ৰেষ্ঠ মনে করা, কিংবা আলাপচারির সময়ে তিনিই শুধু কথা বলবেন, অন্যরা শুনবে, যৌবনের এই স্বভাবটি যেন আবার ফুটে উঠলো মধুসূদনের মধ্যে।

প্রবল উৎসাহ নিয়ে মধুসূদন নিয়মিত আসতে লাগলেন বেলগাছিয়া ভিলায় মহলা দেখতে। গৌরদাস দু-একদিন অনুপস্থিত হলেই বরং তিনি গৌরদাসকে ভর্ৎসনা করেন। রত্নাবলীর ইংরেজি অনুবাদ সাঙ্গ হয়ে গেল অবিলম্বে, রাজারা বেশ পছন্দ করলেন সেই অনুবাদ। মধুসূদন বেলগাছিয়া ভিলার থিয়েটারের দলের একজন সদস্যই হয়ে গেলেন প্ৰায়।

নাটকের মহড়া ও অভিনয়ের ব্যবস্থার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন পাইকপাড়ার দুই রাজা। নানাপ্রকার বাদ্যযন্ত্র আনা হয়েছে সুরসৃষ্টির জন্য। অভিনয়ের সার্থকতার জন্য সকলে অদম্য আগ্রহে অপেক্ষমান। কিন্তু মধুসূদন একটা কথা এখনো সকলের মুখের ওপর বার বার শুনিয়ে দিতে কসুর করেন না। এত আয়োজন, এত অর্থ ব্যয় করে এমন একটি দুর্বল নাটকের অভিনয় করা কেন? এ নাটকে না আছে কোনো গভীর ভাব, না আছে ভাষার সৌন্দৰ্য-ব্যঞ্জনা। অনেকে স্বীকার করেন যে রত্নাবলী নাটকটি প্রকৃতপক্ষে তেমন উচ্চাঙ্গের নয়। কিন্তু উপায় কী? বাংলায় আর ভালো নাটক কোথায়? মধুসূদন এক এক সময় বলে ওঠেন, ভালো নাটক থাকবে কী করে? একমাত্র আমি লিখলেই তা ভালো নাটক হবে। গৌরদাস তখন তাঁকে বিপাকে ফেলার জন্য বলেন, তুই বাংলা লিকবি, মধু? ভূদেবের মুখে শুনিচি, কিচুদিন আগে তুই একটা চাকুরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে পৃথিবী বানান লিকেচিলি, প্ৰথিবী।

মধুসূদন কারুকে কিছু না বলে একদিন সত্যিই লিখতে শুরু করে দিলেন। মহাভারতের কাহিনী ঘেঁটে শর্মিষ্ঠা-দেবযানী আখ্যান নিয়ে ফাঁদলেন নাটক। তার কয়েক পৃষ্ঠা লেখা হতেই পড়তে দিলেন গৌরদাসকে। গৌরদাস এক কথায় চমৎকৃত। এ যে নতুন ধরনের ভাষা, সম্পূর্ণ নতুন ভাব। গৌরদাস আবার সেই পৃষ্ঠা কটি পড়তে দিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দত্তক পুত্র যতীন্দ্রমোহনকে। এই যতীন্দ্রমোহন অতি সজ্জন। বিদ্বান এবং সাহিত্যরসিক। তিনিও সেই শর্মিষ্ঠা নাটকের অংশ পড়ে মুগ্ধ হলেন এবং আলাপ করতে চাইলেন মধুসূদনের সঙ্গে। বেলগাছিয়া ভিলাতেই সাক্ষাৎ হল উভয়ের এবং পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলো। কখনো যতীন্দ্রমোহন মধুসূদনকে নিয়ে যান তাঁর এমারেন্ড বাউয়ার নামক বাগানটিতে। তাঁর উৎসাহে মধুসূদনের নাটক রচনা এগিয়ে চললো। এখন ঠিক হলো যে রত্নাবলীর পর মধুসূদনের শৰ্মিষ্ঠা নাটকই মঞ্চস্থ হবে বেলগাছিয়া ভিলায়।

বাংলা কবিতা সম্পর্কে একদিন কথায় কথায় মধুসূদন বললেন, অমিত্ৰাক্ষর ছন্দেই একমাত্র বাংলায় সার্থক ও দৃঢ়সংবদ্ধ কবিতা রচিত হতে পারে। যতীন্দ্রমোহনের ধারণা, বাংলার মতন দুর্বল ভাষায় অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ সহ্য হবে না। অন্য একজন বললেন, বাংলার চেয়ে ফরাসী ভাষা অনেক বেশী সমৃদ্ধ, কিন্তু সে ভাষাতেও অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ নেই, সুতরাং বাংলায় তার প্রয়োগ তো আরও দুষ্কর। দু-একজন তো আগে চেষ্টা করেছে, পারেনি।

মধুসূদন সগর্বে বললেন, যদি কেউ পারে তো একমাত্র একজনই পারবে। আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত ভাষাতেই তো অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ আছে, বাংলায় থাকতে পারবে না কেন?

যতীন্দ্রমোহন বললেন, আপনি লিখবেন? তা হলে সেই বই মুদ্রণের ব্যয়ভার আমি বহন করবো।

কয়েকদিনের মধ্যেই মধুসূদন তিলোত্তমাসম্ভব নামে এক কাব্য রচনা শুরু করলেন এবং তার প্রথম সর্গ পড়তে দিলেন যতীন্দ্রমোহনকে। যতীন্দ্রমোহন সে রচনা পড়ে। ধন্য ধন্য করতে লাগলেন এবং সাগ্রহে সে রচনা দেখাতে লাগলেন অন্যদের। সকলেই মুগ্ধ, এ এক সত্যিকারের নতুন স্বাদের কবিতা।

প্রশংসায় মধুসূদনের সব সময়ই আত্মাভিমান বৃদ্ধি পায়। তাঁর প্রতিভার অগ্নিতে প্রশংসা যেন ঘৃত, এর অভাবে তা ঠিক মতন জ্বলতে পারে না। এতদিন পর কলকাতার উচ্চ সমাজের এক অংশে মধুসূদন ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগলেন।

রত্নাবলী মঞ্চাভিনয়ের দিন সমাসন্ন, তার আগে একদিন চূড়ান্ত মহড়া উপলক্ষে বিশিষ্ট কয়েকজন অতিথিকে আহ্বান করা হয়েছে। মধুসূদন অন্তরে খুব চঞ্চল হয়ে আছেন, কবে রত্নাবলীর পালা চুকে যাবে, তারপর তাঁর স্বরচিত নাটকের মহড়া শুরু হবে। আজ মধুসূদন বেশ সুসজ্জিত হয়ে এসেছেন এবং অল্প সুরাপান করে শরীরটিকে চাঙ্গা রেখেছেন। এক সময় তাঁর মনে হলো, পাইকপাড়ার রাজা দ্বয় আজ যেন তাঁকে তেমন সমাদর করছেন না, অন্য একজন অতিথিকে খাতির করতেই ব্যস্ত। রাজাদের সঙ্গে সেই ব্যক্তিটি বসে আছে একেবারে সামনের সারিতে, পরনে ধুতি এবং মোটা সুতোর চাদর, পায়ে চটি, মাথার সামনের অংশ কামানো। লোকটির বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি, পোশাক ও চেহারা দুই-ই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাশে বে-মানান।

মধুসূদন এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটি কে হে, গৌর?

গৌরদাস সেদিকে চেয়ে বললেন, সে কি, ঔকে চিনিস না? উনিই তো স্বনামধন্য বিদ্যাসাগর মশাই!

মধুসূদন মৃদু হাস্য করে বললেন, ও, ইনিই তিনি। সেই বিধবা-কাণ্ডারী? তা চেহারাখানা তো দেকচি আমারই মতন প্রায়, কন্দর্পকেও হার মানায়। আমি ভাবলেম বুঝি কোনো পাল্কি বেহারা ভুল করে গিয়ে ওখেনে বসে আচে।

গৌরদাস বললেন, ওঁর চোখ দুটো তো দেকিসনি, তা হলে বুঝতিস। একেবারে বীরসিংহের খাঁটি সিংহ। চ, তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

মধুসূদন বললেন, না না। আমার আর পরিচয় কর্বার দকার নেই। অমন মহাপণ্ডিতের সঙ্গে পণ্ডিতি বাংলায় আমি কতা কইতে পারবো না কো!

গৌরদাস বললেন, তুই ভুল কচ্চিস মধু। বিদ্যেসাগরমশাই ইংরেজিও খুব ভালো জানেন। একপ্রকার টানতে টানতেই গৌরদাস মধুসূদনকে নিয়ে এলেন বিদ্যাসাগরের সামনে। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি আমার বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ইনি একজন কবি এবং নাটক লিকচেন–

অভ্যেসবশত মধুসূদন করমর্দনের জন্য দক্ষিণ হস্তটি বাড়িয়ে দিলেন বিদ্যাসাগরের দিকে।

বিদ্যাসাগর বয়েসে মধুসূদনের চেয়ে মাত্র বৎসর চারেকের বড়। কিন্তু মধুসূদনের মুখমণ্ডলে একপ্রকার শিশুসুলভ চাপল্য আছে, সে তুলনায় বিদ্যাসাগরের মুখের রেখাগুলি অনেক পরিণত, চক্ষের দৃষ্টি স্থির, তাঁর আত্মাভিমান অপরের প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। তিনি এই ইংরেজি পোশাকদুরন্ত, কৃষ্ণকায় মানুষটির মুখের ওপর তাঁর আচঞ্চল দৃষ্টি স্থাপন করলেন। তিনি মধুসূদনের প্রসারিত দক্ষিণহস্ত গ্ৰহণ করলেন না। নিজের দুই করতল যুক্ত করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, নমস্কার।

আর দ্বিতীয় কোনো বাক্য বিনিময় হলো না তাঁদের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *