বাংলাদেশের প্রকাশনাজগৎ ও প্রচ্ছদশিল্প
আমার দুবার নিউইয়র্কে ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ বা মোমা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। মোমা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা জাদুঘরের একটি। শ্রেষ্ঠ আধুনিক শিল্পীদের শিল্পকর্ম সেখানে স্থান পেয়েছে। বহুতলবিশিষ্ট ওই জাদুঘর ভবনের সম্ভবত দোতলায় একটি বিভাগ আছে, সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রচ্ছদশিল্প। সেগুলোও দেখেছি। বইয়ের প্রচ্ছদপটও যে শিল্পকর্ম, তা বইটির যারা পাঠক তাঁরাও সহজে খেয়াল করেন না। অবশ্য সব বইয়ের সব প্রচ্ছদই শিল্পকর্ম নয়। কোনো কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ, যা বড় শিল্পীদের আঁকা, তা নিঃসন্দেহে শিল্পকর্ম।
বাংলা বইয়ের সমালোচনা ও পুস্তক-পরিচিতি যারা লেখেন পত্র-পত্রিকায়, তাঁরা একটি কথা প্রায়ই বলেন, বইটির প্রচ্ছদপট ও অঙ্গসজ্জা আকর্ষণীয়/আকর্ষণীয় নয়। ছাপা-বাঁধাই সুন্দর/মোটামুটি। এই কথা লেখার অর্থ কী? রচনার বিষয়বস্তুই আসল। কিন্তু বই যেহেতু একটি বস্তু শুধু নয়, একটি পণ্য এবং বেচা-কেনা হয়, তাই ক্রেতাকে আকর্ষণ করতে পারে এমনভাবে পণ্যটিকে পরিবেশন করলে তার উপযোগিতা বেশি।
সৌন্দর্যবোধ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই একটি সুন্দর বস্তু হাতে নিয়ে তার আনন্দ। সে জন্য মনোরম প্রচ্ছদে শোভিত একটি বই পাঠকের মন কাড়ে। বাংলা ভাষার বইপত্রে, বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটকের বইয়ের প্রচ্ছদ উনিশ শতকে মোটেই আকর্ষণীয় ছিল না। লেটারিং বা অক্ষর সাজিয়েই প্রচ্ছদ করা হতো। কুড়ি শতকের প্রথম দিক থেকেই নোবেল-নাটকের প্রচ্ছদ শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো শুরু হয়। প্রথম দিকের গল্প-উপন্যাসের প্রচ্ছদে নারীর ছবি, কখনো নারী-পুরুষের ছবি প্রায় আশি ভাগ ক্ষেত্রে থাকতই।
উনিশ শতকের ক্ল্যাসিক লেখকদের গ্রন্থাবলি প্রায় সবই আমাদের বাড়িতে ছিল। তার মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের বইয়ের এখনকার মতো হাতে আঁকা প্রচ্ছদ দেখিনি। রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম দিকের বইতে অক্ষর বিন্যাস করেই প্রচ্ছদ করা হতো। উনিশ শ বিশের দশক থেকে প্রচ্ছদশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা প্রভৃতির প্রচ্ছদ হাতে আঁকা বটে, কিন্তু খুব যে আকর্ষণীয়, তা বলা যায় না। নজরুলের অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশনা মানসম্মত নয়। শুধু তার গুলবাগিচা বইটি তুলট কাগজে সুন্দর ছাপা।
প্রচ্ছদের প্রশ্নে বরং জসীমউদ্দীনকে ভাগ্যবান বলা যায়। তাঁর রাখালীর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন নজরুলের বন্ধু দীনেশরঞ্জন দাশ, পরবর্তী সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকেন নন্দলাল বসু। নকশী কাঁথার মাঠ, রঙিলা নায়ের মাঝি, পদ্মাপার, মাটির কান্না, গাঙের পাড়, পল্লীবন্ধু প্রভৃতি প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন জয়নুল আবেদিন। যাঁদের দেখেছি, সখিনা, সুচয়নী প্রভৃতির প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। মোস্তফা মনোয়ারসহ অন্যান্য খ্যাতিমান শিল্পী জসীমউদ্দীনের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। কোনো কোনো প্রচ্ছদকে শিল্পকর্মই বলা যায়।
পৃথিবীর মহান শিল্পীদের অনেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ অনেকের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। পাবলো পিকাসোও প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাঁর ব্যস্ততম জীবনে। প্রাচ্যের পিকাসো বলে খ্যাত ভারতের মকবুল ফিদা হুসেন প্রথম জীবনে বহু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন কিছুটা জীবিকার প্রয়োজনে। বইপত্রের প্রচ্ছদ এঁকে কিছুটা রোজগার করেছেন। খুব বড় বড় রাজনৈতিক নেতারও কিছু আনুকূল্য পেয়েছেন। কংগ্রেসের সমাজবাদী নেতা ড. রায়মোহন লোহিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদও তিনি এঁকেছেন। যেমন ভারত ভাগের ওপর লেখা লোহিয়ার গিলটি মেন অব ইন্ডিয়া’স পার্টিশন-এর অর্থবহ প্রচ্ছদ হুসেনের আঁকা।
চল্লিশের দশক পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের বইয়ের প্রচ্ছদপট আকর্ষণীয় ছিল না। এখানে দক্ষ প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন না। ১৯৪৬ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কমরেড পাবলিশার্স নামে কলকাতায় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। কমরেড পাবলিশার্স থেকেই তিনি বের করেন আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ। এর প্রচ্ছদ করেন জয়নুল আবেদিন। প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, বাঁধাই প্রভৃতি ছিল উন্নতমানের। ওয়ালীউল্লাহ নিজে ছিলেন রুচিশীল মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন নির্বাচিত সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশক হতে। তাঁর নিজের উপন্যাস লালসালু তিনি কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ করেন, তবে তা কলকাতা থেকে নয়, ঢাকা থেকে ১৯৪৮-এর শেষ দিকে। লালসালুরও প্রচ্ছদ করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। বস্তুত লালসালুই উপনিবেশ-পরবর্তী পূর্ব বাংলার প্রথম আধুনিক প্রকাশনা।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকার অনেক প্রকাশকের বইয়ের প্রচ্ছদ করেন শিল্পী কাজী আবুল কাশেম। ওই দশকেই ঢাকা আর্ট স্কুল থেকে কয়েকজন শিল্পী বেরিয়ে যান। কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরসহ অনেকেই প্রচ্ছদশিল্পে দক্ষতা দেখান। পঞ্চাশের দশকে নতুন লেখকদের বেশ কিছু চমৎকার প্রচ্ছদ-শোভিত বই প্রকাশিত হয়।
ষাটের দশকে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন আমাদের প্রধান শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ অনেক শিল্পী। তাঁদের আঁকা প্রচ্ছদ উন্নতমানের শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা যায়। শেষের দিকে কাইয়ুম চৌধুরীর লেটারিংয়ে একঘেয়েমি এসেছিল, কিন্তু তাঁর ষাট ও সত্তরের দশকের কাজ অপূর্ব। সত্তর ও আশির দশকে নতুন প্রজন্মের কয়েকজন দক্ষ প্রচ্ছদশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে।
শিশুতোষ রচনায় শিল্পীর কাজ বেশি। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে অসামান্য কাজ হতে থাকে। শিশুদের ছড়া ও গল্পের বইতে ইলাস্ট্রেশন মনোমুগ্ধকর না হলে তা শিশুদের আকর্ষণ করে না। বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের বইগুলোর অধিকাংশই সুদৃশ্য ও অলংকার-শোভিত। শিশুরা বইয়ের ছবি দেখে ছবি আঁকা শেখে। নিউইয়র্কের মোমায় আমি দেখেছি, বড় শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখে দেখে শিশুরা ছবি আঁকা শিখছে।
উভয় বাংলার বাঙালি প্রচ্ছদশিল্পীদের মধ্যে আমার নিজের অনেকটা অনধিকারী বিবেচনায় সত্যজিৎ রায়ই শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী। তবে তিনি চলচ্চিত্রে ব্যস্ত থাকায় নিজের বই ছাড়া অন্যের বইয়ের প্রচুর সচিত্রণ করার অবকাশ পাননি। তাঁর লেটারিং কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত শিশুতোষ বইগুলোর প্রচ্ছদ ও সচিত্রণ অভিনব। ঢাকা থেকে চমঙ্কার সচিত্ৰণসহ শিশুদের বই প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের রুচিশীল প্রকাশনা বইঘর থেকে প্রকাশিত হতো শিশু-কিশোর পত্রিকা টাপুর টুপুর, যার প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন দৃষ্টিনন্দন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর নিজের বই যেমন দুই তীর, চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদোর প্রচ্ছদ নিজেই আঁকেন। তিনি ছিলেন শৌখিন চিত্রশিল্পী। বিমূর্তের দিকেই তার ঝোঁক। তার তরঙ্গভঙ্গের প্রচ্ছদ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। চমৎকার কাজ।
নতুন যুগের প্রযুক্তি কম্পিউটার আসায় আমাদের প্রকাশনাশিল্প উপকৃত হয়েছে, দ্রুততম সময়ে বইয়ের মুদ্রণ সম্ভব হচ্ছে, ঝলমলে প্রচ্ছদ করাও সম্ভব হচ্ছে অতি অল্প সময়ে; কিন্তু প্রচ্ছদশিল্পে সৃষ্টিশীলতা থাকছে না। পনেরো আনা কাজ যন্ত্র করছে, শিল্পীর ভূমিকা গৌণ। ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের প্রচ্ছদশিল্প যে উচ্চতায় গিয়েছিল, সেখান থেকে উচ্চতর জায়গায় যেতে তো পারেইনি, বরং নিচে নামছে। যদিও প্রতিভাবান প্রচ্ছদশিল্পী এখনো আছেন আমাদের কয়েকজন। প্রচ্ছদশিল্পকে একুশ শতকের উপযোগী করতে হলে কম্পিউটার-নির্ভরতা নয়, আমাদের নির্ভর করতে হবে শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতার ওপর।