একত্রিংশ অধ্যায় – বরাহের যজ্ঞরূপত্ব কীৰ্ত্তন
ঋষিগণ বলিলেন, যজ্ঞবরাহের দেহ কি প্রকারে যজ্ঞস্বরূপ হইল? এবং সুবৃত্তাদি বরাহ-পুত্ৰত্রয় কি প্রকারে অগ্নিস্বরূপ হইলেন? ১
ভগবান, মহাত্মা বরাহ দ্বারা কি নিমিত্ত অকালে ভয়ঙ্কর জন-ক্ষয়-কর প্রলয় করাইলেন? ২
শাখা মৎস্যরূপধারণ করিয়া কি নিমিত্ত বেদ সকল রক্ষা করিলেন? কি প্রকারে পুনর্বার জগৎ সৃষ্টি হইল? ৩
কোন মহাত্মা পাতাল-মগ্না ধরাকে উদ্ধার করিলেন? হে গুরো। মহাদেব শরভদেহ কি প্রকারে ত্যাগ করিলেন। এবং তিনি দেহ ত্যাগ করিলে সেই দেহ কিরূপে পরিণত হইল? ৪
মহাত্মন্। এই সকল বিষয় আমাদিগকে বলুন। হে দ্বিজবর। আপনি এই সকল বিষয় প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন। অতএব হে মহামতে! আমরা শ্রবণণাৎসুক হইয়াছি; অনুগ্রহ করিয়া তাহা বলুন। ৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন–হে ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠগণ! তোমরা যে সকল বিষয় আমাকে প্রশ্ন করিলে, সাবধান হইয়া সৰ্ব্ববেদ-ফলদায়ী তাহার উত্তর শ্রবণ কর। ৬
যজ্ঞদ্বারা দেবগণ তুষ্ট হন, যজ্ঞই সকলের প্রতিষ্ঠাপক; যজ্ঞ ধরণীকে ধারণ করিয়াছেন। যজ্ঞই প্রজাগণকে পাপরাশি হইতে উদ্ধার করেন। ৭
অন্ন হেতু জীবগণ জীবনধারণ করিতেছে, পর্জন্য হইতে সেই অন্ন উৎপন্ন হইয়াছে, পর্জন্য পুনরায় যজ্ঞ বলে জন্মিতেছে। ৮
অতএব সকল জগৎ যজ্ঞময়; মহাদেব কর্তৃক বিদারিত বরাহদেবের দেহ হইতে সেই যজ্ঞ যে প্রকারে উৎপন্ন হইল, তাহা বিশেষরূপে বর্ণনা করিতেছি। হে দ্বিজগণ সাবধানে শ্রবণ কর। ৯
শরভ কর্তৃক বরাহদেহ বিদারিত হইলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং প্রমথগণের সহিত মহাদেব জল হইতে সেই দেহকে গ্রহণ করত আকাশে গমন করিলেন। ১০
বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া সেই দেহ ছেদন করিলেন। ১১
যেহেতু সেই দেহের সন্ধিভাগ সকল পৃথক পৃথক্ যজ্ঞরূপে পরিণত হইয়া যজ্ঞ হইল, তাহার কারণ শ্রবণ কর। ১২
ভ্রূদ্বয় এবং নাসিকাদেশের সন্ধিভাগ জ্যোতিষ্টোমনামক মহাযজ্ঞ হইল; কপোলদেশের উচ্চ স্থান হইতে কর্ণ-মূলের মধ্যস্থিত সন্ধিভাগ বহ্নিষ্টোম যজ্ঞ হইল। ১৩
চক্ষু এবং ভ্রূদ্বয়ের সন্ধিভাগ ব্রাত্যস্তোম যজ্ঞরূপে পরিণত হইল; মুখাগ্র এবং ওষ্ঠের সন্ধিভাগ পৌনৰ্ভবস্তোম যজ্ঞ হইল। ১৪
জিহ্বামূলীয় সন্ধিভাগ বৃদ্ধস্তোম এবং বৃহৎস্তোম নামক যজ্ঞদ্বয় হইল। জিহ্বাদেশের অধোদেশ হইতে অতিরাত্ৰ এবং বৈরাজযজ্ঞ হইল। ১৫
বেদাধ্যাপনই বৈদিক যজ্ঞ; পিতৃগণের উদ্দেশে তর্পণই পৈতৃক-যজ্ঞ, দেবোদ্দেশে হোমাদি করা দৈব-যজ্ঞ; ছাগাদির বলিদান ভৌতিক-যজ্ঞ; মনুষ্যগণের অতিথির অভ্যর্থনাই নৃযজ্ঞ। ১৬
প্রতিদিন স্নান তর্পণ নিত্য-যজ্ঞ। যজ্ঞবরাহের কণ্ঠসন্ধি এবং জিহ্বা হইতে এই সমস্ত যজ্ঞ ও বিধি সকল উৎপন্ন হইয়াছিল। ১৭
অশ্বমেধ মহামেধ এবং নরমেধ প্রভৃতি প্রাণিহিংসাকর যে সকল যজ্ঞ আছে, হিংসাপ্রবর্তক সেই যজ্ঞসকল–চরণ-সন্ধি হইতে জন্মিয়াছিল। ১৮
রাজসূয়, অর্থকারী বাজপেয় এবং গ্রহযজ্ঞ-সকল পৃষ্ঠসন্ধি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ১৯
প্রতিষ্ঠা, উৎসর্গ, দান শ্রাদ্ধ এবং সাবিত্রী প্রভৃতি যজ্ঞ-হৃদয়সন্ধি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ২০
উপনয়নাদি সংস্কারক যজ্ঞ এবং প্রায়শ্চিত্তবিধায়ক যজ্ঞ সকল যজ্ঞরূপী বরাহদেবের মেঢ্র-সন্ধি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ২১
রাক্ষসযজ্ঞ, সর্পযজ্ঞ, সকল প্রকার অভিচারযজ্ঞ, গোমেধ এবং বৃক্ষ-জাপ প্রভৃতি যজ্ঞ খুর হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ২২
মায়েষ্টি, পরমেষ্টি, গীষ্পতি; ভোগজ এবং অগ্নীষোমযজ্ঞ লাঙ্গুল হইতে এবং সংক্রমণাদি কৃত্য নৈমিত্তিক যজ্ঞ এবং দ্বাদশবার্ষিক যজ্ঞ লাঙ্গুলসন্ধি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ২৩-২৪
তীর্থ-প্রয়োগ, মাস সঙ্কৰ্ষণ, আর্ক এবং আথৰ্বণ নামক যজ্ঞ নাড়ীসন্ধি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। ২৫
ঋচোৎকর্ষ ক্ষেত্ৰযজ্ঞ, পঞ্চমার্গ, লিঙ্গসংস্থান এবং হেরম্বনামক যজ্ঞ জানুদেশ হইতে জন্মিয়াছিল। ২৬
হে দ্বিজবরগণ! এইরূপে যজ্ঞবরাহের দেহ হইতে অষ্টাধিক সহস্র যজ্ঞ উৎপন্ন হইল, অদ্যপি এই যজ্ঞগণই প্রজা সকলের উৎপত্তি সাধন করিতেছেন।২৭
যজ্ঞ-বরাহের পোত্র (মুখের অগ্রভাগ) হইতে স্রুক্ এবং নাসিকা হইতে স্রুব উৎপন্ন হইল। অন্য প্রকার স্রুক স্রুব যথাক্রমে পোত্র এবং নাসিকা হইতে হইল। ২৮
হে মুনিসত্তম! তাঁহার গ্রীবাদেশ হইতে প্রাগ্বংশ (হোমগৃহের পূর্বভাগস্থ গৃহ) হইয়াছিল। কর্ণরন্ধ্র হইতে ইষ্টাপূৰ্ত্ত, যজুধৰ্ম প্রভৃতি জন্মিল। ২৯
দন্তসকল হইতে যূপ এবং রোম হইতে কুশ উৎপন্ন হইল। অধ্বর্য্যু, হোতা, কাষ্ঠ-তাহার অগ্রপশ্চাৎ দক্ষিণ বামপাদ হইতে জন্মিল। ৩০-৩১
পুরোডাশ এবং চরু মস্তিষ্ক হইতে এবং নেত্রদ্বয় হইতে করীষ-প্রদীপ্ত-অগ্নির এবং খুর হইতে যজ্ঞকেতুর উৎপত্তি হইল। ৩২।
মধ্যদেশ হইতে যজ্ঞবেদী এবং মেঢ্র হইতে যজ্ঞকুণ্ড হইল। শুক্রধারায় আজ্য এবং যজ্ঞবরাহের কাম হইতে মন্ত্র সকল উৎপন্ন হইল। ৩৩
পৃষ্ঠদেশ হইতে যজ্ঞগৃহ এবং হৃৎপদ্ম হইতে যজ্ঞ জন্মিল। এবং তাহার আত্মা যজ্ঞপুরুষ হইলেন। তাহার কক্ষ হইতে মুঞ্জার উৎপত্তি হইল। ৩৪
এইরূপে যজ্ঞবরাহের দেহ হইতে ভাণ্ড হবি প্রভৃতি যজ্ঞীয় সকল দ্রব্যই উৎপন্ন হইল। ৩৫
যজ্ঞরূপে সৰ্ব্বজগৎ আপ্যায়িত করিবার নিমিত্ত যজ্ঞ-বরাহের দেহ যজ্ঞরূপে পরিণত হইল। ৩৬
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই প্রকারে যজ্ঞ সৃষ্টি করত সুবৃত্ত কনক এবং ঘোরের নিকট যতুপূর্বক আগমন করিলেন। ৩৭
তদনন্তর দেবত্রয় সুবৃত্তাদির দেহত্রয়কে একত্র করিয়া মুখবায়ু দ্বারা পরিপূর্ণ করিলেন। ৩৮
ব্ৰহ্মা সুবৃত্তের দেহে মুখবায়ু সঞ্চারিত করিলে সেই দেহ হইতে দক্ষিণাগ্নির উৎপত্তি হইল। ৩৯
কেশব কনকের শরীর মুখ বায়ুদ্বারা পূর্ণ করিলে সেই দেহ হইতে পঞ্চবৈতান-ভোজী গার্হপত্য অগ্নি উৎপন্ন হইলেন। ৪০
এই প্রকার মহাদেব, ঘোরের দেহ, মুখপবনে পরিপূর্ণ করিলে তাহা হইতে আহবনীয় অগ্নির উৎপত্তি হইল। ৪১
ত্রিজগদ্ব্যাপী এই অগ্নিত্রয়ই ত্রিভুবনের মূলীভূত কারণ। হে দ্বিজগণ! এই অগ্নিত্রয় প্রতিদিন যেস্থানে অবস্থান করেন, সমস্ত দেবগণ নিজ নিজ অনুচরের সহিত সেই স্থানে বাস করেন। ৪২
এই অগ্নিত্রয়ই কল্যাণসমূহের আধার এবং ইহারাই দেবতা-স্বরূপ। এই অগ্নিত্ৰয়ই স্নান-বিধিস্বরূপ এবং পরম পুণ্যাত্মক। ৪৩
যে দেশে এই অগ্নিত্রয় মন্ত্রাদি দ্বারা আহুত হন, সেই দেশে ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষস্বরূপ চতুৰ্বৰ্গ বিরাজ করেন। ৪৪
হে দ্বিজগণ! তোমাদের প্রশ্নসকলের উত্তর প্রদান করিলাম। ৪৫
যেরূপে যজ্ঞ-বরাহদেহ যজ্ঞ-স্বরূপ হইল এবং তাঁহার পুত্ৰত্রয় অগ্নিস্বরূপ হইলেন, এই সকল তোমাদের প্রশ্ন অনুসারে উত্তর করিলাম। ৪৬
একত্রিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৩১