৩১. প্রথম প্লেনে চড়া

শাহানার এই প্রথম প্লেনে চড়া।

আকাশে ওড়বার মতো বিরাট একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু তার জন্যে যতটা উত্তেজিত হওয়া উচিত ততটা উত্তেজিত সে হচ্ছে না। অথচ প্রথম টেনে চড়ার উল্লাস তার এখনও মনে আছে।

প্রথম প্লেনে চড়া সেই রকমই তো হওয়া উচিত। তা না, কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। তার সবচে মন খারাপ হল প্লেনের সাইজ দেখে। এত ছোট? সত্যি-সত্যি পাখির মতো লাগছে। শাহানা বলেই ফেলল, প্লেন এত ছোট হয়?

জহির হাসতে-হাসতে বলল, ছোট কোথায়, দ্য শ ত্ৰিশ জন যাত্রী যেতে পারে। বেশ বড়ো। দূর থেকে দেখছ তো, তাই এ রকম লাগছে।

খুব দূর থেকে তারা দেখছে না। বসে আছে ডিপারচার লাউঞ্জে। কী-একটা সমস্যা হয়েছে। প্লেন ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরি হবে। সময় কাটানোর জন্যে চা-টা খাচ্ছে। যাত্রীরা।

জহির বলল, কিছু খাচ্ছ না কেন শাহানা?

ভালো লাগছে না। ঢোক গিলতে পারছি না।

সে কী! টনসিলাইটস নাকি?

জানি না। কাঠমুণ্ড না গেলে কেমন হয় বল তো? আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না।

এক বার পৌঁছে দেখ, ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে না। তোমার কি প্লেনে চড়তে ভয় লাগছে?

হুঁ।

ওটা কাটতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগবে। প্লেনত্রমণ হচ্ছে পৃথিবীতে সবচে নিরাপদ ভ্রমণ।

শাহানা বলল, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।

দুটা প্যারাসিটামল খাও। ব্যাগে আছে না? আমি পানি এনে দিচ্ছি।

শুধু পানি নয়, জহির একটা পানও নিয়ে এসেছে। মাইকে বলা হচ্ছে-ফ্লাইট নাম্বার বি জি ২০৭, কাঠমুণ্ডুগামী যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে। অদ্ভুত এক ধরনের উচ্চারণ। যেন অর্ধেক যন্ত্র এক জন মানুষ কথা বলছে। শাহানার মনে হল এই কথাগুলি সহজ স্বাভাবিকভাবে বলা যায় না?

তোমার গা তো বেশ গরম মনে হচ্ছে শাহানা।

জ্বর আসছে বোধহয়।

তোমার খুব বেশি খারাপ লাগলে না হয় বাদ দেওয়া যাক। এখন টিকিট ক্যানসেল করলে অবশ্যি পয়সাকড়ি কিছুই পাওয়া যাবে না।

শাহানা যন্ত্রের মতো বলল, ক্যানসেল করতে হবে না। চল যাই।

 

শাহানা বসেছে জানালার পাশে, এক বারও জানালা দিয়ে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। তার কেবলি ভয়, এই বুঝি সে বমি করে ফেলবে। বমি আসার আগে আগে মুখে। যেমন টকটক স্বাদ চলে আসে, সে-রকম চলে এসেছে। তার সামনের এক ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন, কী কুৎসিত কটু গন্ধ! শাহানার ইচ্ছে করছে এই টেকো লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় মারতে।

জহির বলল, খুব বেশি খারাপ লাগছে?

হুঁ।

প্ৰায় এসে গেছি। প্লেন নামতে শুরু করেছে। কান ভোঁ-ভোঁ করছে না?

হুঁ, করছে।

ঢোক গোল কমে যাবে।

ঢোক গিলতে পারছি না।

তাকাও জানালা দিয়ে। দেখ, প্লেনের চাকা নামছে। তুমি তো কিছুই দেখছিনা।

শাহানা ক্লান্ত গলায় বলল, পানি খাব।

জহির হোত ইশারায় এক জন এয়ার হোস্টেসকে ডাকল। কোনো লাভ হল না। এক্ষুণি প্লেন নামরো। ওরা তাই নিয়ে ব্যস্ত। নো ম্মোকিং সাইন বারবার জ্বলিছে। কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সমানে সিগারেট টানছে। জহির এয়ার সেইফটির উপর একটি প্রবন্ধ পড়েছিল নিউজ উইকে। সেখানে বলা হয়েছে-এশিয়া মহাদেশের বিমানযাত্রীরা বিমান ভ্রমণের আইনকানুন ভঙ্গ করে এক ধরনের মজা পায়। যে সময় সিট-বেল্ট বাঁধার কথা, সে-সময় সিট-বেল্ট খুলে ফেলে। নো ম্মোকিং সাইন দেখলেই তাদের সিগারেটের পিপাসা পেয়ে যায়। তারা সবচে পছন্দ করে বিমানের করিডরে। হাঁটতে। যেন এটা প্লেন নয়, বাস।

প্লেন বেশ বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে ভূমি স্পর্শ করল। জহির হাসিমুখে বলল, এসে গেছি শাহানা। পৌঁছেই ডাক্তার ডাকব।

 

বড়ো হোটেলের নিয়মকানুনগুলি বেশ চমৎকার। দশ মিনিটের মাথায় ডাক্তার এসে উপস্থিত। কুড়ি মিনিটের মাথায় এলেন খোদ হোটেলের ম্যানেজার। পরনে হাফপ্যান্ট, কড়া লাল রঙের স্পোর্টস শার্ট। মুখভর্তি হাসি। সে হাসিমুখে যে কথা বলল, তা শুনে জহিরের মুখ শুকিয়ে গেল। রুগিণীকে হোটেলে রাখা যাবে না। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। জহির বলল, পেশেন্টকে হোটেলে রেখে চিকিৎসা হবে না?

না।

কেন?

কারণ হোটেল কোনো হাসপাতাল নয়।

তাহলে আমি অন্য কোনো হোটেলে চেষ্টা করতে চাই, যেখানে আমাকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে দেবে।

নতুন বিয়ে?

হ্যাঁ।

হানিমুন?

হ্যাঁ, বলতে পার। লেট হানিমুন।

আমার সমস্ত সহানুভূতি তোমার জন্যে। কিন্তু আমার উপদেশ শোন। আমি যে ব্যবস্থা নিচ্ছি, তা আমাকে নিতে দাও। বিশ্বাস কর আমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। আমি যত ঠাণ্ডা মাথায় একটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে পারি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানও তা পারেন না! এ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে যাও, তাকে ভর্তি করিয়ে ফিরে এস।

জহির চুপ করে রইল। ম্যানেজার হাসিমুখে বলল, কী আমার কথায় আপসেট হচ্ছে নাকি? আমার পরামর্শ কিন্তু চমৎকার। স্ত্রীকে হাসপাতালে দিয়ে ফিরে এসে একটা হট শাওয়ার নাও, এবং দুটি বিয়ার খাও।

জহিরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শাহানা প্ৰায় অচেতন। জ্বর এক শ তিন পয়েন্ট পাঁচ। জহির শুকনো গলায় বলল, খুব বেশি খারাপ লাগছে?

শাহানা কাতর গলায় বলল, খুব খারাপ লাগছে।

 

নেপালের হাসপাতালটির অবস্থা খুবই মলিন। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন। ফিনাইলের গন্ধের বদলে কেমন একটা টক গন্ধ। একটা ডেডবডি পড়ে আছে বারান্দায়। কেউ তার মুখ ঢেকে দেবার প্রয়োজনও বোধ করে নি। নীল রঙে ড়ুমো ড়ুমো মাছি মৃত মানুষটির উপর ভিনভন করে উড়ছে। জহিরের অন্তরাত্মা পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। ডাক্তার ভদ্রলোক হেসে ইংরেজিতে বললেন, অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

তা, কিছু ঘাবড়ে গেছি তো বটেই।

বাংলাদেশের হাসপাতাগুলি কি এর চেয়ে ভালো?

হ্যাঁ, ভালো। অনেক ভালো।

আমি যখন ছিলাম, তখন কিন্তু ভালো ছিল না।

আপনি বাংলাদেশে ছিলেন?

হ্যাঁ। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছি! আমাদের দেশে মেডিকেল কলেজ নেই। ডাক্তারি পড়তে হলে আমাদের বাইরে যেতে হয়।

রোগী ভর্তির ব্যাপারটি অতি দ্রুত শেষ হল। শাহানাকে নিয়ে যাওয়া হল কেবিনে। জহির বলল, আমি কি ঐ কেবিনে রাতটা কাটাতে পারি?

না, পারেননা।

হাসপাতালে কোথাও অপেক্ষা করতে পারি?

তা নিশ্চয়ই পারেন। আমার এই ঘরেই বসতে পারেন। তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? আপনার কষ্ট হবে। প্রচণ্ড মশা।

না, আমার কষ্ট হবে না।

আপনার রাতের খাওয়া কি হয়েছে?

না, হয় নি।

আমি কিছুক্ষণ পর পাশের একটি হোটেলে খেতে যাব। পাশেই একটা

ভালো হোটেল আছে। ইচ্ছে করলে আপনি আসতে পারেন।

জহির বলল, তার আগে জানতে চাই, আমার স্ত্রীর চিকিৎসা কি শুরু হয়েছে।

এখনও শুরু হয় নি, হবে। থ্রোট কালচার করা হচ্ছে। হানিমুনে এসেছেন, তাই না?

হ্যাঁ, তাই।

আপনার মনে ভয় ঢুকে গেছে যে, হয়তো—বা আপনাকে একা ফিরতে श्टद। एठाप्ले •ा? པ༣,

হ্যাঁ।

ভয় পাবেন না, খুবই সামান্য ব্যাপার।

ডাক্তার ডান হাতে জহিরের কৗধ স্পর্শ করলেন। জহিরের মনে যে ভয়-ভয় ভাব ছিল তা পুরোপুরি কেটে গেল। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল-সারারাত এখানে বসে মশার কামড় খাওয়ার কোনো মানে হয় না। হোটেলে ফিরে একটা শাওয়ার নেওয়া যেতে পারে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্যি যাওয়া হল না। জহির রাতটা হাসপাতালেই কাটিয়ে দিল। চায়ের একটি হোটেলের খোঁজ ডাক্তার সাহেবই করে দিলেন। প্রচুর দুধ ও গরম মশলা দেয়া অদ্ভুত ধরনের চা। ঝাঁজাল খানিকটা তেতো ধরনের স্বাদ। খেতে ভালোই লাগে।

শাহানাকে দেখতে গেল। সকাল ন টায়। জ্বর কমে গেছে। তবে এক রাতেই কেমন রোগা লাগছে শাহানাকে। গালের হাড় বেরিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। জহির বলল, কী অবস্থা? ャ

শাহানা হাসল।

এখন কি একটু ভালো লাগছে?

লাগছে।

একটু ভালো, না। অনেক ভালো?

অনেক ভালো।

তাহলে একটু হাস, আমি দেখি।

শাহানা হাসল। জহির পাশেই চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আমি সারা রাত হাসপাতালেই ছিলাম।

জানি।

কীভাবে জানলে? কেউ বলেছে?

না, কেউ বলে নি। আমার মনে হয়েছে।

এখন আমি চলে যাব, আবার বিকেলে আসব।

আচ্ছা।

তোমার জন্যে কিছু ভিউকার্ড নিয়ে এসেছি। শরীরটা যদি ভালো লাগে, তাহলে কার্ডগুলিতে নাম-ঠিকানা লিখে রেখ, বিকেলে আমি পোস্ট করে দেব।

আচ্ছা!

অসুখের কথা কিছু লেখার দরকার নেই। সবাই চিন্তা করবে। অবশ্যি অসুখ তেমন কিছু হয়ও নি। থ্রোট ইনফেকশন। ডাক্তার সাহেব বললেন, পরশুর মধ্যে রিলিজ করে দিতে পারবেন। পরশু পর্যন্ত একটু কষ্ট কর।

আমার কষ্ট হচ্ছে না।

তোমার এখান থেকে হিমালয় দেখা যায়। উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকাও। হিমালয় দেখবো।

আমার হিমালয় দেখতে ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা না করলেও দেখ। এস, তোমাকে হাত ধরে দাঁড় করাই-ঐ যে চূড়াটা দেখছি না, ওর নাম অন্নপূর্ণা। সুন্দর না?

হ্যাঁ, সুন্দর।

তুমি সুস্থ হয়ে উঠলেই তোমাকে পোখরা বলে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। আমার মতে পোখরা হচ্ছে পৃথিবীর সবচে সুন্দর জায়গা।

শাহানা হাই তুলল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল।

তোমার ঘুম পাচ্ছে শাহানা?

হ্যাঁ, পাচ্ছে।

তাহলে ঘুমাও। ইন্টারেস্টিং একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল। তাই না?

হ্যাঁ।

ঢাকায় গিয়ে গল্প করতে পারবে। তুমি ঘুমাও, আমি পাশে বসে আছি।

তোমাকে বসতে হবে না, তুমিও বিশ্রাম কর। রাত জেগে যা বিশ্ৰী দেখাচ্ছে তোমাকে।

খুব বিশ্ৰী?

হ্যাঁ, খুব বিশ্ৰী।

শাহানা মিষ্টি করে হাসল। হাসপাতালের ধবধবে সাদা বেড়ে কী সুন্দর লাগছে তাকে। মুখের উপর তেরছা করে রোদের আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে এটি স্বপ্নে দেখা একটি ছবি। বন্দী রাজকন্যা ওয়ে আছে। এক্ষুণি জেগে উঠবে।

 

সমস্তটা দিন জহির ঘুমিয়ে কাটাল। দুপুরে উঠে দুটি স্যাণ্ডউইচ মুখে দিয়ে আবার ঘুম। সেই ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বেচারি শাহানা। অপেক্ষা করে আছে নিশ্চয়ই। খুবই অন্যায় হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ঘুমিয়ে পড়াটা উচিত হয় নি। সন্ধ্যার পর এরা ফিমেল ওয়ার্ডে পুরুষদের যেতে দেয় না। নিয়মটি হয়ত বিদেশিদের জন্যে। কারণ কাল বেশ কিছু পুরুষদের ঢুকতে দেখেছে। এরা সবাই যে হাসপাতালের কর্মচারী, তাও মনে হয় নি!

 

গতকালের ডাক্তার ভদ্রলোককে পাওয়া গেলে একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু কাল সেই ভদ্রলোকের নাম জানা হয় নি। আজ হয়তো তার ডিউটি নেই। পরপর দু রাত নাইট ডিউটি না-থাকারই কথা। আজ হয়তো আছে বদমেজাজী কোন ডাক্তার, যে কোনো কথাই বলবে না।

আগের ডাক্তারকেই পাওয়া গেল। তিনি রুগিণীর কাছে যাবার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। কয়েক দিন আগে ফিমেল ওয়ার্ড নিয়ে লেখা নানান কেচ্ছা-কাহিনী কোনো এক কাগজে ছাপা হয়েছে, তারপর থেকে এই কড়াকড়ি। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি বসুন, আমি খবর এনে দিচ্ছি। তবে আপনার স্ত্রী বেশ সুস্থ, এইটুকু বলতে পারি। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনি বসুন। আমি আসছি।

ভদ্রলোক মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফিরে এলেন। হাসিমুখে বললেন, কাল সন্ধ্যায় আপনার স্ত্রীকে রিলিজ করে দেওয়া যেতে পারে। জ্বর রেমিশন হয়েছে।

থ্যাংক ইউ।

এই ভিউকার্ডগুলি তিনি দিলেন। আপনাকে পোস্ট করতে বলেছেন।

চারটা ভিউকার্ড। প্রতিটিতেই কয়েক লাইনের চিঠি। নীলুর জন্যে একটি, শারমিনের জন্যে একটি। বাবা ও মার জন্যে একটি এবং চতুর্থটি আনিসের জন্যে। জহির বিস্মিত হয়ে আনিসের ভিউকার্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে গোটা গোটা হরফে লেখা—আনিস ভাই, আমার খুব অসুখ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *