পাশবিক ভাষা
দাবি আদায়ের জন্যে ঘেরাও এখন একটা জনপ্রিয় পদ্ধতি। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে পশুরাও যে এ কৌশল শিখে ফেলেছে, সেটা জানা ছিলো না। সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম ভালো মানুষের মতো। কোনোদিকে তাকাইনি। কারো সঙ্গে তর্কে যাইনি। এমন কি, অনিচ্ছায়ও কাউকে ধাক্কা দিইনি। রীতিমতো ভদ্রলোক। তারই মধ্যে আমাকে হঠাৎ ঘিরে ধরলো একদল পশু। আমার চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো: আমি খুব ভীতু। পালিয়ে বাঁচার শিক্ষায় বিশ্বাসী। তাই প্রথমেই দৌড় দেওয়ার কথা মনে হলো। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম পশুরা যে-দুৰ্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে, তাতে পালানো অসম্ভব। তাই মুখে সাহসের হাসি ফুটিয়ে পশুদের জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”
চারদিক থেকে হুহুঙ্কার শোনার জন্যে তৈরি হলাম। কিন্তু মানুষের মতো সবাই মিলে তারা এক সঙ্গে হৈচৈ করে উঠলো না। তাদের মধ্য থেকে–বুঝতেই পারছেন কে হতে পারে!:–হ্যাঁ, শেয়াল পণ্ডিত! সে এগিয়ে এসে কথা শুরু করলো আমার সঙ্গে। যেভাবে সে কথা বললো তাতে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। একদম মানুষের মতো নয়!–তার বক্তব্য সে পেশ করলো বিনয়ের সঙ্গে, ভদ্র ভাষায়, অনুচ্চ কণ্ঠে এবং যুক্তি দিয়ে। সে বললো, মানুষ যেভাবে উঠতে বসতে নিরীহ পশুদের চরিত্রহানি করছে, তাতে তারা আর স্থির থাকতে পারছে না। এর প্রতিকার চায় তারা। মানুষের মধ্য সবাই যে ভালো নয়, তারা তা জানে। কিন্তু খারাপ লোকেদের নিন্দা করতে গিয়ে মানুষরা পশুদের সঙ্গে তাদের কেন তুলনা করে–এটা তারা একেবারেই বুঝতে অক্ষম। কিছু বলার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেলো। বুঝতে পারলাম আগের দিন চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশুদের দেখে নিশ্চয় এ কথা আমি অবচেতন মনে ভেবে থাকবো। রাতের বেলা সেটাই স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিলো আমার কাছে।
কেউ অকল্পনীয় অনাচার অথবা নির্যাতন করলে, নিন্দা করে আমরা বলি পাশবিক। অনেক সময় পশু বা জানোয়ার বলেও গাল দিই। কদিন আগে মাদ্রাসার এক শিক্ষকের অত্যাচারের একটি কাহিনী পড়লাম এক দৈনিক পত্রিকায়। দশ বছরের একটি বালিকাকে এক শোরও বেশি বেত্ৰাঘাত করে এই হুজুর বীরত্বের অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন। পত্রিকা এই খবরের শিরোনাম দিয়েছে: পাশবিক। মাদ্রাসার এই শিক্ষক–যাকে অনায়াসে বলতে পারি শিক্ষককুলের কলঙ্ক— ঐ পত্রিকার মতে তিনি পশুর মতো আচরণ করেছেন। কিন্তু খবরটা পড়ার পর হুজুরের কীর্তি বর্ণনার জন্যে ঐ শব্দটাকে মোটেই প্ৰযোজ্য বলে মনে হলো না। কারণ কোনো পশু মানুষের সঙ্গে এমন অমানুষের মতো আচরণ করে না।
পশু শব্দটার বিশেষণ হলো পাশবিক। তার মানে পশুর মতো অথবা পশুর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। সব পশু কি খারাপ নাকি? ধরা যাক, একটা গরু? খারাপ? কিন্তু পাশবিক শব্দটি যেভাবে আমরা ব্যবহার করি, তাতে পশুদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষই প্ৰকাশ পায়–বর্ণবিদ্বেষের মতো। পাশবিক কথাটার কদৰ্থ করি আমরা। আমরা পশুর ভালো গুণগুলি বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল খারাপ দিকটাই বোঝাই এ শব্দ দিয়ে। এটাকে আর যা-ই বলি, মানবিক সুবিচার বলতে পারিনে। কারণ আমাদের পরিচিত অনেক পশুই আমাদের ক্ষতি করা তো দূরের কথা, আমাদের খুবই উপকার করে। তা ছাড়া, কোনো পশু কি সত্যি সত্যি মাদ্রাসার ঐ হুজুরের মতো এমন নিষ্ঠুর? মানুষের সঙ্গে দূরের কথা, কোনো পশু কি অন্য একটা পশুর সঙ্গেও এমন নিৰ্মম আচরণ করে? যদি করার কোনো প্রমাণ না-থাকে, তা হলে বড়ো জোর বলা যেতে পারে হুজুরের ব্যবহার অমানুষের মতো। কিন্তু এর মধ্যে পশুকে টেনে এনে পশুদের হেয় করার কোনো যুক্তি আছে?
যে-পশুদের আমরা ঘনিষ্ঠভাবে জানি যেমন, কুকুর, বেড়াল, গরু, ছাগল, গাধা, ঘোড়া, হাতি, বানর–নিঃসন্দেহে তারা এই হুজুরের মতো দয়াহীন অথবা হিংস্র নয়। সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে গরু, ছাগল, ঘোড়া, কুকুর ইত্যাদি মানুষের যে অশেষ উপকার করে কোনো মানুষ তা অন্য মানুষের জন্যে সাধারণত করে না। ধরুন, উট। নিজেই নিজের খাদ্য জোগাড় করে খায়। তারপর মানুষদের পিঠে করে মরুভূমি পাড়ি দেয়। যেমন, গাধা। গাধার মতো ভারবাহী এবং প্ৰভুভক্ত জীব অতি বিরল। কিন্তু নির্বোধ এবং নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে আমরা গাধা বলে গাল দিই।–এটা মানুষের কেমন ন্যায়বিচারের নমুনা ঠিক বোঝা যায় না। তেমনি, যে-খচ্চর সারাদিন আমাদের আবর্জনা টেনেটেনে ক্লান্ত হয়, সেই খচ্চরকেও আমরা টেনে আনি আমাদেরই ভাই-বেরাদারদের ছোটো করার জন্যে। অতি বদমায়েশ ব্যক্তি হলে কেবল খচ্চর বলে তৃপ্তি পাইনে, বলি: তিলে খচ্চর। যে-শুয়োর আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত রেখে নিজের অতি সুস্বাদু মাংস মানুষের ভক্ষণের জন্যে রেখে যায়, সেই শুয়োর বলে গাল দিলে সেটা যে-কোনো মানুষেরই গায়ে খুব লাগে। আর, শুয়োরের বাচ্চা বললে তো কথাই নেই। বাচ্চারা স্বভাবতই সরল, নিরীহ এবং নিষ্পাপ— আচ্ছা, ভেবে দেখুন জন্তুর নামের সঙ্গে বাচ্চা কথাটা জুড়ে দিয়ে গালটাকে আরও তীব্র করে তোলা কি ঠিক?
সবচেয়ে দৃষ্টিকটু দৃষ্টান্ত গরুরী। গরু মানুষের সবচেয়ে উপকারী জন্তু— নিঃসন্দেহে। গরুর দুধ গরুকে বঞ্চিত করে মানুষ খায়। এবং সে দুধ যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিকর। দুধ থেকে মুখরোচক কতো খাবার তৈরি হয়! গরু দিয়ে চাষ করি। গরুর গাড়িতে চড়ি। যে-গরুর দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছি, সেই গরু বুড়ো হলে নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করে তার মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। একে নির্ভেজাল নেমকহারামি না-হলেও অন্তত দুধ-হারামি না-বলে আর কী বলা যায়! এমন কি, এ হলো কৃতঘ্নতা! নয় কি? তারপরও মানুষকে পশুর থেকে শ্রেষ্ঠ বলি কী করে? চক্ষুলজ্জা বলে কি কোনো বস্তু নেই আমাদের?
আমার ধারণা পশুদের প্রতি এ আমাদের এক রকমের পাশবিক মনোভাব। পাশবিক না-হোক অমানবিক নিঃসন্দেহে। তাই এই নির্যাতিত এবং শোষিত পশুদের যতো দেখি ততোই তাদের প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি জেগে ওঠে। যেমন, কুকুর। তার প্রভুভক্তির কোনো তুলনাই চলে না। অন্য কিছুর সঙ্গে। তা সত্ত্বেও একজন অতি বিশ্বস্ত মানুষকে যদি বলি, তুমি ভাই কুকুরের মতো, তাতে সে খুশি না-হয়ে প্রচণ্ড রাগ করবে। সম্পর্ক রাখবে কিনা, সন্দেহ হয়! কারণ কুকুর বললে কাউকে নিতান্তই ঘূণার সঙ্গে হেয় করা হয়। কেউ একটা কথা মেনে না-নিয়ে ক্ষুদ্ধভাবে বারবার প্রতিবাদ করলে কুকুরের মতো ঘেউঘেউ করছে বলে তার নিন্দা করা হয়। আর কুকুরের অথবা কুত্তার বাচ্চা বললে একটা খুনোখুনিও হয়ে যেতে পারে। অথচ প্ৰভুভক্তির মাপে একজন মানুষ কখনোই সারময়-সন্তানদের মতো আন্তরিক হতে পারে না। মানুষ বরং প্রভুর প্রতি বেইমানী করে হরহামেশা। মীর জাফর অথবা মুশতাকের মতো লোকের কোনো অভাব নেই মনুষ্যকুলে। বস্তুত, মানুষ এমন অকৃতজ্ঞ এবং প্রভূবিনাশী যে, আমার ধারণা, কোনো কুকুরকে মানুষের সঙ্গে তুলনা করে গাল দিলে সে কুকুর ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহত্যা করবে। নিদেন পক্ষে, অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে তারস্বরে প্রতিবাদ করবে। মানুষের মতো কুকুর! ছি, ছি, কুকুর-কুলাঙ্গার!
আরও একবার গরুর কথা ভাবুন। বুদ্ধিহীন হলে আমরা তাকে বোকা বলি। নির্বোধ হলে মূৰ্থ বলি। তবে তার চেয়েও নির্বোধ হলে সেই মানুষকে গরু অথবা বলদ বলে গাল দিই। তাতেও মন না-ভরলে তখন বলি গোমূর্খ। তা ছাড়া, একেবারে আত্মত্যাগী মানুষকে প্রশংসা না-করে বরং কলুর বদল বলে গাল দিই। এ ছাড়া, গবুচন্দ্র, গবেট ইত্যাদি বলেও আমরা মূর্থ মানুষদের বর্ণনা দিয়ে বেচারা গরুদের অপমান করি। গোয়ার এবং মূর্থ হলে তাকে অনেক সময় আমরা বলি ষাঁড়। মাথায় মগজের অভাব রয়েছে–এই অপমানজনক উক্তি করতে চাইলে আমরা সেই মগজকে গোবরের সঙ্গে তুলনা করি। বিশেষ করে ষাড়ের গোবর বললে আরও ছোটো করা হয়। কী অন্যায়, ভেবে দেখুন!; গোবর থেকে চমৎকার সার তৈরি হয়। গোবর দিয়ে তৈরি হয় জ্বালানিও। এমন কি, কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা গোবর খেয়ে অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে। সেই বহু গুণান্বিত গোবরের এমন অবমূল্যায়ন–একে ন্যায্য বলে মনে করা শক্ত।
আরও দু-একটা জন্তুর কথা ভেবে দেখা যাক! মানুষের মধ্যে যারা দুষ্ট, তাদের আমরা বাঁদর বলে গাল দিই। চেহারা কুৎসিত হলে তাকেও আমরা বান্দরের সঙ্গে তুলনা করে থাকি (আমার বন্ধুরা যেমন পেছনে আমাকে বলে থাকেন)!! অতি অগ্রহণীয় ব্যক্তিকে উলুক বলে গাল দি। নিতান্ত নিরীহ বোদরকে এভাবে ছোটো করার কোনো অর্থ হয় না।
বাঙালিদের চোখে মেয়েদের গোল মুখ অর্থাৎ চাঁদবদন হলো সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা। (কোন মানদণ্ডে— একমাত্র মূর্খরাই তা বলতে পারেন।) তাই কারো মুখ একটু লম্বা হলে অমনি তাকে ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করি। বাঙালি পুরুষদের দারুণ আকর্ষণ মেয়েদের কালো চোখের প্রতি। (বিধাতা জানেন কেনা!)। তাই নিতান্ত বাজে এবং কটা চোখ হলে সেই নারীকে সামনে না-হলেও অন্তত পেছনে বিড়ালাক্ষী বলে বিদ্রুপ করি। অতি মুর্থ হলে তাকে আমরা হস্তিমূৰ্থি বলে গাল দিই। অথচ হাতির পিঠে চড়ে আমরা মহারাজা না-হলেও, অন্তত জমিদার হিশেবে গর্ব করি। মুরুব্বির জোরে কেউ লাফালে অর্থাৎ তেজ দেখালে তাকে ভেড়ার সঙ্গে তুলনা করি। এমন কি, কাপুরুষ বোঝাতেও ভেড়া বলি। অতি তুচ্ছ বোঝাতে হলে বলি: বেড়াল-কুকুরের মতো। কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং নির্বোধি বলে কাউকে গাল দিতে চাইলে তাকে ছাগলের সঙ্গেও তুলনা করি। রাম-ছাগল অথবা গাধা বললে ততোধিক নির্বোধ বোঝানো হয়। পাঁচজনের সঙ্গে একত্রে চললে আমরা নিন্দা করে তাকে গডডালিকায় গা ভাসানো বলি। মোট কথা, মানুষের যে-কোনো খারাপ দিক জ্যান্ত করে বোঝানোর জন্যে আমরা তাদের তুলনা করি উপকারী বা নিরীহ জন্তুদের সঙ্গে।
কিন্তু বাঙালি শক্তের ভক্ত। তাই উপকারী জন্তুদের নিন্দা করলেও, যেসব জন্তু হালুম করে তাদের ওপর আক্রমণ করে–যেমন বাঘ এবং সিংহ, তাদের প্রতি বাঙালিদের প্রচুর ভক্তি লক্ষ্য করা যায়। যেমন, সাহসী এবং দৃঢ় চরিত্রের লোক হলে তাকে বলা হয়, বাঘের মতো। অথবা বাঘা। বাঘা যতীন যেমন। তার চেয়েও এক কাঠি সরেস হলে, তাকে তুলনা করা হয় সিংহের সঙ্গে। এই দুই শক্তিশালী এবং নরঘাতী পশুর প্রতি তাদের ভক্তি এতো প্রবল যে, এদের নামের সঙ্গে বাচ্চা কথাটা জুড়ে দিলে সেই ব্যক্তির আরও বেশি গৌরব প্রকাশ পায়–যেমন বাঘের বাচ্চা, সিংহের বাচ্চা, সিংহশাবক। শিয়াল হালুম করে আক্রমণ করে না। আবার মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকারও করে না। তাই শিয়াল কথাটা প্ৰায় নিউট্রাল। শিয়াল বলে গাল দিলে কাউকে প্রশংসা করা যায় না ঠিকই, কিন্তু খুব ছোটোও করা হয় না। কেউ বেশি চালাক অথবা কূটবুদ্ধির অধিকারী বোঝাতে হলে আমরা তাকে শিয়ালের সঙ্গে তুলনা করি। শেয়াল পণ্ডিত অথবা শেয়ালের মতো ধূর্ত বলে বর্ণনা দিই। হালুম করে আক্রমণ না-করলেও ফোস করে আক্রমণ করে সাপ । সাপ একটা ব্যতিক্রম। সাপকে মানুষ খুবই ভয় করে বটে, কিন্তু সাপের সঙ্গে তুলনা দিয়ে কোনো মানুষকে প্রশংসা করার রীতি নেই। বরং কেউ অপ্ৰত্যাশিতভাবে রাগ করে উঠলে বলি ফোস করে ওঠা। তেমনি অত্যন্ত খারাপ শক্রিকে বলি কালকূট। দুমুখো সাপও মানুষের চরিত্রজ্ঞাপক।
মোট কথা, বাংলা ভাষা যেমন অযৌক্তিকভাবে নারীদের ছোটো করে দেখে, নিরীহ পশুদেরও দেখে তেমনি ছোটো চোখে। বিবেকবান ব্যক্তিদের উচিত সবাই মিলে এর একটা প্ৰতিকার করা। এ ব্যাপারে সহায়তা ও সহযোগিতা করার জন্যে পশুক্লেশ নিবারণী সভাগুলোর কাছে আবেদন করা উচিত। সেটা যতো দ্রুত হয়, ততোই পশুদের জন্যে ভালো। আমরাও বিবেককে তা হলে সাফ রাখতে পারি।
(যুগান্তর, ২০০৬)