৩১. দি থার্ড টাস্ক

৩১. দি থার্ড টাস্ক

ডাম্বলডোর তাহলে জানে ইউ নো ই আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে, রন চাপা গলায় বলল।

হ্যারি, ডালডোরের ঘর থেকে ফিরে এসে পেনসিভে কী কী দেখেছে, ডাম্বলডোরের সাথে তার আলোচনার সকল বিষয়, রন আর হারমিয়নকে শুধু নয় সিরিয়সকেও প্যাঁচা পাঠিয়ে জানিয়েছে।

অনেক রাত পর্যন্ত কমনরুমে বসে ওরা গল্প করল; কিন্তু হ্যারির চিন্তা দূর হল। ডাম্বলডোর কেন তার মাথার রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা পেনসিভে রেখে তার চিন্তা লাঘব করেন। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা জমা হলে সেগুলো বের করার কেন প্রয়োজন এটাই ডাম্বলডোর বোঝাতে চেয়েছিলেন।

রন কমনরুমের আগুনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। হ্যারির মনে হল রন যেন শীতে কাঁপছে। কাঁপছে কেন, ঘরটা তো বেশ গরম।

রন বলল, মানে এই দাঁড়াল যে, তিনি স্নেইপকে বিশ্বাস করেন, তার ওপর আস্থা আছে। ও অতীতে একজন ডেথইটার (রক্ত চোষা) জেনেও!

–হ্যাঁ, তাইতো মনে হয়, হ্যারি বলল।

হারমিওন তাদের কথাবার্তার এই দশ মিনিটের মধ্যে একটা কথাও বলেনি। ও কপালে হতে রেখে হাঁটুর দিকে তাকিয়ে বসেছিল। ওকে দেখে হ্যারির মনে হল পেনসিভ ব্যবহার করেছে।

–রিটা স্কীটার; হারমিওন এতক্ষণে মুখ খুললো। রন বলল, আরে তুমি এখনও ওই রিটা স্কীটারকে নিয়ে আছ! মোটেই না, ওর সম্বন্ধে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। হারমিওন মুখ না তুলে এমনভাবে বলল, যেন ওর হাঁটুকে বলছে। আমি তার একটা কথা ভাবছি, মনে আছে থ্রি ক্রমস্টিকে সে বলেছিল, তোমাদেরও মনে থাকতে পারে; একথাটা বলেছিল না?…আমি লাডো বেগম্যান সম্বন্ধে যা জানি… শুনলে তোমাদের মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে। স্কীটার আদালতে উপস্থিত ছিল রিপোর্টও করেছিল। ও নাকি জানে বেগম্যান ডেথইটারদের কাছে খবরাখবর পাঠিয়েছে, আর মনে আছে উইঙ্কীর কথা… মি, বেগম্যান অতি খারাপ এক জাদুকর ও ছাড়া পাওয়াতে ক্রাউচ অত্যন্ত ক্ষেপে গিয়েছিল।

শুনেছি, কিন্তু বেগম্যান তো কোনোকিছু ভেবে ইনফরমেশন দেননি–দিয়েছেন কী?

হারমিওন কাঁধ নাচাল।

ফাজ মনে করেন মাদাম ম্যাক্সিম ক্রাউচকে আক্রমণ করেছিলেন? রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল।

হ্যারি বলল, ক্রাউচ বক্সটেনের ক্যারেজের কাছ থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলেন বলেই সন্দেহটা করছেন।

রন বলল, আমাদের কিন্তু সে কথা মাথায় আসেনি। একটা কথা খুব ভাল করে মনে রাখবে মাদাম ম্যাক্সিমের শরীরে দানবের রক্ত আছে; কিন্তু সেটা স্বীকার করতে তিনি চান না।

হারমিওন বলল, অবশ্যই করেন না। মনে আছে রিটা যখন হ্যাগ্রিডের মায়ের ইতিবৃত্ত লিখেছিল, তখন তার অবস্থা কি হয়েছিল, ফাজকেও দেখ, ঝট করে তার সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন–ওর দেহেও দানবের রক্ত আছে। কে ওইরকম কুসংস্কারের ধার ধারে? যদি আমি হতাম, নির্দ্বিধায় বলতাম আমার বড় বড় হাড় আছে।

হারমিওন হাতঘড়িতে কটা বেজেছে দেখল।

আমাদের তো কোনও ক্লাস ওয়ার্কের কাজ করা হয়নি, কালকেই তো ইমপেন্ডিমেন্ট জিন (বাধা বিপত্তির) এর ক্লাস। হ্যারি এবার তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, মনে হয় খুবই ক্লান্ত।

ডরমেটরিতে গিয়ে হ্যারি নেভিলের বিছানার দিকে তাকাল। ডাম্বলডোরকে ও কথা দিয়েছে নেভিলের বাবা-মা সম্বন্ধে কোনও কথা কাউকে বলবে না। রন হারমিওনকেও ও বলেনি। ও ভাবল একটা ছেলের মনে কতটা দুঃখ পেতে পারে যদি তার বাবা-মা তাকে দেখেও চিনতে না পারেন। ওর বাবা-মা নেই বলে মানুষের কাছে সহানুভূতি পায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নেভিলের আরো বেশি সহানুভূতি সকলের কাছ থেকে পাওয়া উচিত। যারা মি. আর মিসেস লংবটমকে অত্যাচার করেছে তাদের প্রতি ওর ঘৃণা আর আক্রোশ উপছে পড়ল। ক্রাউচের ছেলের কথাও মনে হল। চোখের সামনে ভাসছে তার কান্না আর ডেমেন্টরদের পৈশাচিক ব্যবহার… ছোট একটা ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ও তাড়ম্বরে কাঁদছে… বাবা ক্রাউচ অতি নিষ্ঠুর… ছেলেটির কথা, ও রুগ্নশীর্ণ মায়ের জ্বালা একবারও মনে হয়নি। শুনেছে ছেলেটি এক বছর আগে কারাগৃহে মারা গেছে।

ভোল্ডেমর্ট! মশারীর চাঁদোয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবল শয়তান ভোল্ডেমর্ট ওদের সুখের সংসারটা ছিন্নভিন্ন করেছে।

***

রন আর হারমিওনের পরীক্ষার পড়া রিভাইস করা শেষ হবে তৃতীয় টাস্ক শুরু হবার দিন। কিন্তু ওরা পরীক্ষার পড়ার ব্যস্ততা সত্ত্বেও যথাসম্ভব হ্যারির মনোবল বাড়াতে ও অন্যান্য ব্যাপারে অনবরত সাহায্য করে চলেছে।

বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হবার সাতদিন আগে তৃতীয় টাস্ক হবে, তার জন্য সকলেই উদ্বিগ্ন। জুন মাস থেকেই সকল ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। হ্যারি সময় পেলেই বাধাবিঘ্ন অতিক্রমের অনুশীলন করে। আগের দুটি টাস্কের চাইতে তৃতীয় টাস্ক অনেক সোজা মনে হয়।… যদিও বিপদ এখানে বেশি। মুডি ঠিকই বলেছেন, হ্যারিকে হিংস্র জন্ত আর মন্ত্রমুগ্ধ বাধা পার করার পথ বের করতে হবে। ওর মনে হয় শেষ টাস্কের অসুবিধাগুলো অতিক্রমের উপায় বের করার যথেষ্ট সময় আছে।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, হ্যারিকে লাঞ্চের সময় ওর ট্রান্সফিগারেশনের শূন্য ঘরটা ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন।

 হ্যারি খুব তাড়াতাড়ি ইমপেডিমেন্ট জিঙ্ক (বাধা অতিক্রম করার জাদুমন্ত্র), বিডাক্টর (পথের ওপর সলিড বস্তু পড়ে থাকলে তা চূর্ণ করা), চতুর্মুখী স্পেল। (হারমিওন শিখিয়েছে, যাতে ওর দণ্ড উত্তরের দিকনির্দেশ দেয়… তাহলে বুঝতে পারবে ঠিক পথে চলেছে কিনা সেই ঝোপের মধ্যে); তাহলেও শিল্ড চার্ম এখনও রপ্ত করতে পারেনি। (ছোটখাট কার্স/অভিশাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য অস্থায়ী অদৃশ্য দেওয়াল সৃষ্টি করা)।

 হারমিওন বলল, এখনও পর্যন্ত তুমি ভালই করছ, হারমিওন ওর লিস্টের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানকার কয়েকটি স্পেল তো খুব কাজে লাগবে।

রন তখন মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে ম্যালফয় ওখানে কি করছে!

হ্যারি, হারমিওন রনের পাশে দাঁড়িয়ে ঘরের জানালা দিয়ে দেখল ম্যালফয়, ক্র্যাবে আর গোয়েল একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্র্যাবে আর গোয়েল এধার–ওধার তাকিয়ে বোকার মতো হাসছে। ম্যালফয় ওর হাতটা মুখের কাছে এনে কথা বলছে।

হ্যারি কৌতূহলী হয়ে বলল, নিশ্চয়ই ওয়াকিটকিতে কথা বলছে।

–করতে পারে না, হারমিওন বলল।–তুমি জান ওইসব ব্যবহার করা হোগাটে মানা আছে। অন্যদিকে মন দিও না শিভচার্মটা আর একবার কর।

***

সিরিয়স নিয়ম করে হ্যারিকে রোজ প্যাঁচা মারফত চিঠি দিচ্ছেন। হারমিওনের মতো তিনিও চান হ্যারি অন্য বিষয়ে মন না দিয়ে শেষ টাস্ক ভাল করে করুক। তাছাড়া মনে রাখতে বলেছেন–হোগার্টের চার দেয়ালের বাইরে যা ঘটছে তাতে হ্যারির কোন দায়দায়িত্ব নেই।

ভোল্ডেমর্ট যদি আবার শক্তি সঞ্চয় করে [সিরিয়স লিখেছেন] আমার প্রথম উপদেশ তুমি তোমার সর্বাত্র নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে ধ্যান দেবে। তুমি যখন ডাম্বলডোরের ছত্রছায়ায় রয়েছ ও তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাহলেও কোন ঝুঁকি নেবে না। সেই বাধাবিপত্তি যাতে তুমি নির্বিঘ্নে অতিক্রম করতে পার সেদিকে মনোযোগ দেবে। তারপর অন্য ব্যাপারে ভাবনা–চিতা করা যাবে।

জুন চব্বিশ যত এগিয়ে আসে, হ্যারির ততই কেমন একটা ভয় হতে শুরু হয়। তাহলেও সেই ভয় প্রথম ও দ্বিতীয় টাস্কের মতো নার্ভ শিথিল করার মতো নয়। একটা ব্যাপারে ও সুনিশ্চিত যে নিজেকে মোটামুটি ভাল ভাবে তৈরি করেছে। আর, একটা বিষয়ে এটাই শেষ বাধা। ভাল–মন্দ যাই হোক টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে। দারুণ একটা বোঝা থেকে মুক্তি পাচ্ছে সন্দেহ নেই।

***

তৃতীয় সপ্তাহের সকালে গ্রিফিন্ডর টেবিলে প্রাতঃরাশের সময় দারুণ হট্টগোল। হ্যারির কাছে সিরিয়সের শুভ কামনার কার্ড নিয়ে প্যাঁচা ফিরে এসেছে। ছোট একটা হলুদ পার্চমেন্ট তার ওপর ছোট বাজে খবর ছাপা। তাহলেও হ্যারির খুব ভাল লেগেছে। লক্ষ্মীপ্যাঁচা সময়মত হারমিওনের জন্য ডেইলিফেটের কপি নিয়ে এসেছে। ও প্রথম পাতাটা খুলে সামনে রেখে মুখ থেকে পামকিন রস ওয়াক করে ফেলেদিল।  

–কী ব্যাপার? হ্যারি রন ওর দিকে তাকিয়ে বলল।

–কিছু না, কাগজটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল। কিন্তু রন ওটাকে কেড়ে নিল।

ও শিরোনাম পড়ল কোনও পথ নেই, আজ নয়, সেই বুড়ো গরুটা।

হ্যারি বলল, কী ব্যাপার? রিটা স্কীটার আবার কিছু লিখেছে?

না, রন কথাটা বলে কাগজটা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করল।

 হ্যারি বলল, লুকালে কি হবে, নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে কিছু লিখেছে। তাই না?

একদম না, রন ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিয়ে অতি সাধারণ কন্ঠে বলল।

কিন্তু হ্যারি কাগজটা পড়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে ঠিক সেই সময় ডাকো ম্যালফয় স্লিদারিন টেবিল থেকে চিৎকার করে বলে উঠল।

হে পটার! পটার! কেমন আছে তোমার মাথা ঠিক আছে তো? নিশ্চয়ই এখন তুমি আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হবে না?

 ম্যালফয়ের হাতে ডেইলি প্ৰফেটের একটা কপি। স্লিদারিনরা সকলেই হ্যারির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য লাফিয়ে উঠল।

হ্যারি, রনকে বলল, দাও, কি লিখেছে আমাকে পড়তে দাও।

রন অনিচ্ছাসহকারে কাগজটা হ্যারির দিকে এগিয়ে দিল। হ্যারি পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ওর ছবিটা দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। ছবির তলায় শিরোনাম দিয়ে লেখা–

হ্যারি পটার বিক্ষুব্ধ ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে

রিটা স্কিটার জানাচ্ছেন, যে ছেলেটি পরাজিত করেছে হি হ মাস্ট নট বি নেইমড–কে, বর্তমানে মানসিক দিক থেকে অস্থির ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হ্যারি পটারের অত ব্যবহার সম্পর্কে যেসব খবর যা আমাদের কাছে আসছে, ট্রাই–উইজার্ড প্রতিযোগিতায় তার যোগদান সমীচীন হবে কি না সে সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে। অথবা ওর হোগার্ট স্কুলে থাকাটাও।
ডেইলি প্রফেট জেনেছে পটার প্রায়ই স্কুলে জ্ঞান হারায় এবং ওর কপালের কাটা দাগে জ্বালা–যন্ত্রণার কথা বলে (ইউ নো হু… ওকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে আঘাতের চিহ্ন)। গত সোমবার ওদের যখন ভবিষ্যৎ কথনের ক্লাস চলছিল, ডেইলি ফেটের সংবাদদাতার চোখে পড়ে যে, পটার ক্লাস থেকে একদিন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়ে, এবং সে জানায়, মাথায় যন্ত্রণার জন্য ক্লাসে থাকা ওর সম্ভব নয়।
সেন্ট মুংগোস হাসপাতালের উচ্চপদস্থ চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাথা ব্যাথা হতে পারে, কারণ পটারের মস্তিষ্ক ক্ষতি হয় ইউ–নো–হুর আক্রমণে। চিকিৎসকরা তার ওই কাটা দাগে যন্ত্রণা হয় বারবার অভিযোগ করাকে আবার তার মানসিক ক্ৰটি বলে মনে করেন।
একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে–ও হয়তো ভান করছে–ওর প্রতি আলাদাভাবে নজর দেবার একটা ছুতো ছাড়া এটা আর কিছু নয়।
ডেইলি প্রফেট, যদিও, হ্যারি পটার সম্পর্কে অভাবনীয় তথ্য উদঘাটন করলেও হোগার্ট স্কুলের হেড মাস্টার ডাম্বলডোর পটারের কাজকর্ম অতি সাবধনতার সঙ্গে সকলের কাছ থেকে গোপন করে চলেছেন।
পটার পার্সেলটাংগ (সাপের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারে, হোপার্টের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ড্র্যাকো ম্যালফয় এই বিষয়টি এই সংবাদদাতাকে জানায় এবং সন্দেহ করে যে, বছর দুই আগে ছাত্রদের ওপর যে হাঙ্গামা হয়েছিল, অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস–পটার তার সঙ্গে জড়িত। তারা পটারকে তারা জুয়েলিং ক্লাবে সামান্য কারণে মেজাজ বিগড়োতে দেখেছে, একটি ছেলের গায়ে সাপ ছুঁড়ে দিতে দেখেছে। যাই হোক অজ্ঞাত কারণে সেইসব কাজ গোপন করা হয়েছে। ওর বন্ধু অনেক, এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেকে সাময়িকভাবে নেকড়ে বাঘে রূপান্তরিত করার শক্তিসম্পন্ন লোক আর দানবও। ক্ষমতার লালসায় ও অনেক কিছু করতে পারে।
সাপদের সঙ্গে কথা বলার জন্য পার্সেলটাংগ প্রয়োজন হয়-এটা ডার্ক আর্টের অন্তর্ভূক্ত। তবে এ কথা সবাই অবগত আছেন যে, এ যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত পার্সেলটাংগ বানিয়ে হচ্ছেন ইউ নো হু। ডার্কফোর্স ডিফেন্স লিগের অন্যতম এক সদস্য (নাম গোপন রাখতে চান) বলেছেন যদি কোন জাদুকর পার্সেলটাংগ বলতে পারেন তাদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যারা পার্সেলটাংগ (সাপের সঙ্গে কথা) বলতে পারে তাদের আমার অত্যন্ত সন্দেহভাজন মানুষ বলে মনে হয়। কারণ কাল জাদুর (ডার্ক ম্যাজিক) জন্য সাপের প্রয়োজন হয়। এবং তারা ঐতিহাসিকভাবে যারা অশুভ কাজ করে তাদের সঙ্গে জড়িত। মনে রাখতে হবে, যারা নেকড়ে মানব ও দানবের বন্ধু হয় তারা হিংস্রযুগ পছন্দ করে।
অ্যালবাস ডাম্বলডোর অবশ্যই বিবেচনা করবেন ওইরকম প্রকৃতির ছেলেকে ট্রাই–উজার্ড টুর্নামেন্টে প্রতিযোগিতা করতে দেয়া উচিত কি না। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন পটার হয়ত টুর্নামেন্ট জেতার জন্য বেপরোয়াভাবে তৃতীয় টাস্কে কাল জাদু ব্যবহার করতে পারে। আজ সন্ধ্যায় তৃতীয় টাস্ক শুরু হবে।

রিটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে–তাই না? হ্যারি মৃদু হেসে বলল। কাগজটা মুড়ে রাখল।

ও দেখল স্লিদারিন টেবিল থেকে ম্যালফয়, ক্রে আর গোয়েলে কপালে আঙুল টিপতে টিপতে বিশ্রিভাবে হাসছে। হাসিটা ওদের বিষাক্ত সাপের মতো।

রন বলল, ও কি করে জানল ভবিষ্যৎ কথন ক্লাসে তোমার কাটা দাগে ব্যথা করেছিল? হয় সে ঘরে ছিল, নয়তো কারও কাছ থেকে জেনেছে।

জানালা খোলা ছিল, আমি ভালভাবে নিশ্বাস নেবার জন্য হাট করে খুলে দিয়েছিলাম, হ্যারি বলল।

হারমিওন বলল, তুমি তো নর্থটাওয়ারের ওপরে ছিলে, তোমার গলার শব্দ কেমন করে মাঠে পৌঁছল?

হ্যারি বলল, মনে হচ্ছে তুমি গোয়েন্দাগিরি সম্বন্ধে গবেষণা করছে। তুমিই বল, কেমন করে ও জানল!

চেষ্টা করছি জানতে। হারমিওন বলল; কিন্তু আমি… কিন্তু।… দাঁড়াও ও কেমন করে হোগার্টে ঢুকে খবর কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমি ধরছি।

কথাটা বলে হারমিওন লাইব্রেরিতে চলে গেল।

ট্রাইউইজার্ড চ্যাম্পিয়ন হিসেবে হ্যারিকে টার্ম শেষের বাৎসরিক পরীক্ষা দিতে হবে না। তাও হ্যারি ক্লাসে আসে… তৃতীয় টাস্কের… নতুন কোনও জাদুমন্ত্র/সম্মোহন শিখতে পায় তারই প্রচেষ্টা করে। রনের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করছিল প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। গ্রিফিন্ডর টেবিলের কাছে এসে বললেন, চ্যাম্পিয়নরা ব্রেকফাস্টের পরে হলের বাইরে চেম্বারে সমবেত হচ্ছে…।

কিন্তু আজ রাতেই তো টাস্ক, কথাটা বলার সময় হাত হ্যারির হাত থেকে স্ক্র্যাম্বল এগটা মাটিতে পড়ে গেল। ওতো সময়টা ভুল করেনি?

আমি জানি পটার। চ্যাম্পিয়নদের পরিবারের সদস্যদের শেষ টাস্ক দেখার জন্য নেমন্তন্ন করা হয়েছে। তাদের আপ্যায়ন করা তোমাদের সুযোগ এই আর কি।

কথাটা বলে বলে মিস ম্যাকগোনাগল চলে গেলেন। হ্যারি দাঁড়িয়ে রইল।

 হ্যারি রনকে বলল, আশা করি ডার্মলেদের নেমন্তন্ন করা হয়নি।

–জানি না তাদের নেমন্ত্ৰন্ন করা হয়েছে কি না, রন বলল। হ্যারি, বিনসের ক্লাসে আমি চললাম। পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে।

হ্যারি ব্রেকফাস্ট শেষ করে বসে রইল। গ্রেট হল বলতে গেলে শূন্য। ও দেখল ফ্লেউর ডেলাকৌর র‍্যাভেন ক্ল টেবিল ছেড়ে উঠে সেডরিকের পাশে বসল। একটু পর ক্রাম এসে ওদের কাছে বসল। তারপর ওরা চেম্বারে চলে গেল হ্যারি সেখানে বসেছিল সেখানেই বসে রইল। ওর চেম্বারে যাবার একটুও আগ্রহ নেই। ও তো একাই, ওর তো কেউ নেই। ডার্সলে পরিবারকে ও নিজেদের লোক মনে করে না। আর তো কেউ আসবে না ওকে দেখতে! দেখতে আসবে না কেমন করে মৃত্যু হাতের মুঠোতে রেখে টাস্ক করছে। তারচেয়ে লাইব্রেরিতে বসে নতুন নতুন জাদুমন্ত্র, সম্মোহন শেখা ভাল। ঠিক সেই সময় পাশের চেম্বারের দরজা দিয়ে ফ্রেডরিক টু মারল।

–হ্যারি তুমি বসে আছ কেন? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

থতমত খেয়ে হ্যারি উঠে দাঁড়াল। ডার্সলেরা সম্ভবত আসেনি, আসবে কি? ওরা হল পেরিয়ে দরজা খুলে চেম্বারে ঢুকল।

সেডরিকের মা-বাবা দরজার পাশে বসেছেন। ক্লাসের এক কোণে বসে বাবা মার সঙ্গে বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা বলে চলেছে। দেখল ওর নাক অনেকটা ওর বাবার মতো। অন্য এক ধারে ফ্লেউর ওর মায়ের সঙ্গে ফরাসি ভাষায় আলাপ আলোচনা করছে। ওর ঘোট বোন গ্যাবরিয়েলী মায়ের হাত ধরে পাশে বসে রয়েছে। হ্যারিকে দেখে ফ্লেউর হাত তুলল, হ্যারিও হাত তুলল। তারপর দেখল মিসেস উইসলি আর বিল ফায়ার প্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

–দারুণ খুশি হয়েছি। মিসেস উইসলি হ্যারির দিকে এগিয়ে এলেন। হ্যারিও হেসে এগিয়ে গেল। মিসেস উইসলি হ্যারির কপালে চুম্বন করে বললেন, তোমার খেলা দেখতে চলে এলাম হ্যারি।

–ভাল আছ তো? হাসতে হাসতে হ্যারির সঙ্গে করমর্দন করে বলল।–চার্লি আসতে চেয়েছিল, কিন্তু সময় পেলো না। ও বলেছে তোমার হর্নটেলের সঙ্গে লড়াই দুর্দান্ত হয়েছিল।… বিশ্বাস করা যায় না।

হ্যারি দেখল ডেলাকৌর ওর মার পেছন থেকে বিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। হ্যারির মনে হল ফ্লেউরের বড় চুল, কানে দুল আর সাপের বিষ দাঁত তেমন অপছন্দের নয়।

হ্যারি মিসেস উইসলিকে বলল, খুব ভাল লাগছে আমি ডার্সলেদের কথা ভাবছিলাম।

মিসেস উইসলি ঠোঁট চেটে বললেন–ই। হ্যারির সামনে কখনও ডার্মলেদের সমালোচনা করতে পছন্দ করেন না। কিন্তু হ্যারির কথা শুনে চোখ দুটো জ্বলে উঠল।

 বিল বলল, পুরনো দিনের স্কুলে এসে খুব ভাল লাগছে (ফ্যাট লেডির বন্ধু ভায়োলেট ছবির ফ্রেম থেকে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল), এখানে পাঁচ বছর পরে এলাম সেই পাগল নাইট ছবি এখনও আছে? স্যার ক্যাডোগনের কথা বলছি।

–ও হ্যাঁ আছে, হ্যারি বলল। গত বছর ও স্যার ক্যাডোগনকে দেখেছে।

–ফ্যাট লেডি? বিল জিজ্ঞেস করে।

মিসেস উইসলি বললেন, আমার সময়ও সে ছিল। একদিন রাত্রি চারটের সময় ডরমেটরিতে ফেরার জন্য আমাকে দারুণ বকাবকি করে ছিলেন।

বিল মিসেস উইসলিকে ঠাট্টা করে বলল, রাত চারটে পর্যন্ত ডরমেটরির বাইরে ছিলেন কেন? কি করছিলেন?

মিসেস উইসলি হাসলেন, চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল।

–তোমার বাবা আর আমি রাতে বাগানে হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছিলাম, সেই সময় এপেলিয়ন প্রিংগলে ছিল কেয়ারটেকার, সে দেখে ফেলে তাকে–নিশ্চই তোমার বাবার তা মনে আছে।

বিল বলল, হ্যারি, চল আমরা একটু ঘুরে আসি।

হ্যারি বলল, ঠিক আছে চল। ওরা গ্রেট হলের দরজার দিকে চলল।

ওরা আমোস ডিগরিব পাশ দিয়ে যাবার সময় ও ওদের দেখল–ও হ্যারি তুমি? তারপর ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, বাজি রেখে বলতে পারি তুমি একটু ভয় পাচ্ছ। মনে আছে তো সেডরিক তোমার চেয়ে পয়েন্টে এগিয়ে আছে?

হ্যারির চোখ দুটো জ্বলে উঠল–কী বললে?

–আরে ওর কথায় কান দিও না, হ্যারিকে নিচু গলায় সেডরিক বলল। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, রিটা কীটারের ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্ট আর্টিকেলটা পড়ার পর আরও রেগে আছে, তুমি একমাত্র হোগার্ট চ্যাম্পিয়ন। একটু পড়ে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

–তাও ওকে শুধরে দেওনি, ডিগরি খুব জোরে জোরে বলল যাতে হ্যারি শুনতে পায়। হ্যারি তখন বিল আর উইসলিকে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য দরজার কাছে গেছে।… সেড এবারেও তুমি বেশি পয়েন্ট পাবে… আরও একবার ওকে হারাতে হবে… পারবে না?

সেদিন আকাশ পরিষ্কার, সকাল থেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। হ্যারি বিল আর মিসেস উইসলিকে ঘুরে ঘুরে বক্সটেনের মস্তবড় ক্যারেজ লেকে ভাসমান ডারমস্ট্রংগের জাহাজ দেখাল। মিসেস উইসলির বড় বড় উইলো গাছ খুব ভাল লাগল। তার স্কুল ছাড়ার পর গাছগুলো পোঁতা হয়েছিল। হ্যাগ্রিডের আগে বনরক্ষক ছিলেন, ওগ… তার কথা বললেন। সব পুরনো দিনের গল্প। হ্যারির শুনতে খুব ভাল লাগছিল।

হ্যারি বলল, পার্সি কেমন আছে।

বিল বলল, খুব একটা ভাল নয়।

মিসেস উইসলি বললেন, ও খুব হতাশ বিচলিত হয়ে আছে। চারদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন। মিনিস্ট্রি মি. ক্রাউচের অন্তর্ধান সম্বন্ধে চুপচাপ… কাউকে কিছু জানতে দিতে চাইছে না। মি. ক্রাউচ যে সমস্ত ওকে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন সে সম্বন্ধে পার্সিকে নানা প্রশ্ন করা হচ্ছে। ওদের ধারণা লেখাগুলো ক্রাউচের নয়। এই সব নানা কারণে পার্সি খুব চাপের মধ্যে রয়েছে। আজকে ক্রাউচের জায়গায় ওকে পাঁচ নম্বর জাজ করছেন, সেটাও একটা কারণে। ওর জায়গায় কর্নেলিয়স ফাজকে বলেছে।

অনেক পুরনো স্মৃতি নিয়ে, অনেক ঘুরে হ্যারি, বিল আর মিসেস উইসলি ক্যাসেলে লাঞ্চের জন্য ফিরল।

রন মা আর বিলকে দেখে আটখান। ভাবতেই পারেনি যেন মা আসবেন। ওরা সবাই গ্রিফিন্ডর টেবিলে বসল। বিলকে বলল, তুমি কেন এসেছ?

 মিসেস উইসলি বললেন, কেন আবার, আমরা হ্যারির লাস্ট টাস্ক দেখতে এসেছি। খুব ভাল লাগছে। যাকগে তোমার পরীক্ষার তৈরি কেমন হয়েছে?

খুব ভাল, খুব ভাল, রন বলল। বিদ্রোহী সব গবলিনদের নাম মনে আসছে–তো আমি নিজে কিছু নাম দিয়েছি। ঠিক আছে। তারপরই টেবিলে করনিস পেস্ট্রি দেখে একগাদা মুখে পুরেছিল। মিসেস উইসলি রাগ করে ওর দিকে তাকালেন, তোমাকে সকলে বলবে বদরদ দ্যা রিয়ার্ডেড অ্যান্ড উগ মানে জংলী! ম্যানার্স জানে না। খাবার দেখলেই গবাগব মুখে পুরে দাও।

একটু পর ফ্রেড, জর্জ আর জিনি এসে যোগ দিল। হ্যারির মনে হল যেন ও হোগার্টে নেই দ্যা বারোতে বসে রয়েছে। ভুলেও সন্ধ্যা বেলা তৃতীয় টাস্কের কথা মনে হলো না। লাঞ্চ অর্ধেক হয়ে গেছে তখন হারমিওন এল।

হারমিওন মিসেস উইসলির দিকে তাকাল। মাথায় এসেছে বিটা কীটারের ব্রেন ওয়েভের কথা। কাউকেও জানাবে না।

মিসেস উইসলি ওকে দেখে বললেন, হ্যালো হারমিওন। আগের মতো আপ্লুত নয়।

হারমিওন বলল, হ্যালো। ওর মুখের হাসি মিসেস উইসলির কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে গেল।

হ্যারি মিসেস উইসলি আর হারমিওনের মুখ দেখে বলল, মিসেস উইসলি, রিটা স্কীটারের রাবিশ লেখা উইচ উইকলিতে পড়ে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেননি। কারণ হারমিওন আমার গার্লফ্রেড নয়।

ওহ! মিসেস উইসলি বললেন, না অবশ্যই আমি বিশ্বাস করিনি!

তারপরেই হারমিওনের সঙ্গে গল্পেতে মেতে উঠলেন।

ওরা বিকেলের একটু আগে ক্যাসেলের চারপাশে ঘুরে বেড়াল। তারপর সন্ধ্যায় বিশেষ ভোজের (ফিস্টের) জন্য গ্রেটহলে ফিরে এল। লুডো বেগম্যান, কর্নেলিয়স ফাজ স্টাফ টেবিলে এসে বসলেন। বেগম্যানকে দেখে মনে হয় খুব খুশি; কিন্তু কর্নেলিয়স ফাজ (মাদাম ম্যাক্সিমের পাশে বসেছিলেন) মুখ দেখে মনে হল গম্ভীর। গম্ভীর, কারও সঙ্গে একটা কথা না বলে প্লেটের খাবারের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে খেতে লাগলেন।

অনেক বেশি ও নানা রকম খাবার। হ্যারির একটুও খেতে ইচ্ছে করল না। বারবার আসন্ন হ্যারিকেড টাস্কের কথা মনে হচ্ছে। হাত–পা কাঁপছে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মন্ত্রমুগ্ধ হলের চাঁদোয়া একটু একটু করে নীলাভ থেকে ধূসর হয়ে গেলে ডাম্বলডোর স্টাফ টেবিলে বসেছিলেন উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে হলের হট্টগোল, কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল।

ভদ্ৰ মহোদয় ও মহিলাগণ, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ট্রাইউইজার্ড তৃতীয় টাস্ক শুরু হবে। আপনাদের আমি কিডিচ খেলার মাঠে উপস্থিত থাকার জন্য সাদর আমন্ত্রণ করছি। আমি চ্যাম্পিয়নদেরও অনুরোধ করছি তারা যেন মি. বেগম্যানের সঙ্গে স্টেডিয়ামে যায়।

হ্যারি দাঁড়াল। সব গ্রিফিন্ডরের ছাত্রছাত্রীরা ওকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন ও গুড উইশ জানাল। উইসলি, হারমিওন, সেডরিক, ভিক্টর কাম ও ফ্লেউরের সঙ্গে হ্যারি গ্রেটহল থেকে বেরিয়ে গেল।

মি. বেগম্যান হ্যারির পাশাপাশি হাঁটছিলেন। বললেন, ঘাবড়িও না। নিজের ওপর আস্থা রাখবে।

হ্যারি অবশ্য সামান্য নার্ভাস। বলল, আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি বললেও হ্যারি নার্ভাস। যেতে যেতে যে সমস্ত বাধাবিঘ্ন কাটাবার সম্মোহন আর জাদুমন্ত্র শিখেছে সেগুলো মনে করতে করতে চলল। ও জানে সেগুলো ঠিকমত প্রয়োগ করলে হেরে যাবে না।

ওরা সবাই কিডিচ পিচের দিকে হেঁটে হেঁটে গেল। মাঠটা চেনাই যায় না। মাঠের চারধারে কম করে কুড়ি ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ডানদিকে সামান্য ফাঁক, সেখান দিয়ে গোলকধাঁধায় যেতে হবে। সেই ফাঁকের পরই দারুণ অন্ধকার ও গা ছমছম করা এক পরিবেশ।

পাঁচ মিনিটে স্টেডিয়ামের স্ট্যান্ড দর্শকদের ভিড়ে এক চুলও ফাঁক রইলো না। আকাশে–বাতাসে শুধু হইচই, ছাত্রছাত্রীদের খটাখট পদ শব্দ আর হাস্যরোল। আকাশে মেঘ নেই, নীল আকাশ ধ্রুবতারা দেখা দিয়েছে। হ্যাগ্রিড, প্রফেসর মুডি, প্রফেসর ম্যাকগোনাগাল আর প্রফেসর ফ্লিটউইক হেঁটে হেঁটে স্টেডিয়ামে ঢুকে চার চ্যাম্পিয়ন আর বেগম্যানের সামনে দাঁড়ালেন। ওদের মাথায় হ্যাট। হাটে, বড় বড় লাল দীপ্তমান তারকা। শুধু হ্যাগ্রিডের টুপিতে নয়। কাঁধে ওর মোলেসিকনের ওয়েস্ট কোট।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগল চ্যাম্পিয়নদের বললেন, আমরা গোলকধাঁধা বাইরে ঘুরব সতর্ক থাকব, তোমরা অসুবিধায় পড়লে, আটকা পড়লে আমাদের জানাবে। আকাশে লাল ফুলিঙ্গ ছাড়লে আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ এসে তোমাদের নিরাপদে নিয়ে যাবে, বুঝতে পেরেছ?

চ্যাম্পিয়নরা সম্মতি জানাল মাথা নেড়ে।

ব্যস এবার তোমরা তোমাদের কাজে যাও, ম্যাকগোনাগল চারজন পেট্রোলরদের বললেন।

যখন চারজন চ্যাম্পিয়ন বিভিন্ন দিকে গিয়ে গোলক ধাঁধায় যাবার জন্য প্রস্তুত হল তখন বেগম্যান হাতের দণ্ডটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন মনোরম বলার সাথে তার কথা জাদু প্রবাহে সারা স্টেডিয়াম, স্ট্যান্ড গমগম করে উঠল। হ্যাগ্রিড হ্যারিকে উৎসাহ জানিয়ে গেলেন, উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ ট্রাই উইজার্ড টুর্নামেন্টের তৃতীয় ও শেষটাস্ক এইবার শুরু হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় টাস্কে চার প্রতিযোগী কে কত পেয়েছে আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি। হ্যারি পটার ও সেডরিক পঁচাশি পয়েন্ট, ওরা যুগ্মভাবে এখনও প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। ওরা দুজনেই হোগার্ট স্কুলের ছাত্র! দর্শকদের অভিনন্দন আর চিয়ার্সে সারা স্টেডিয়াম শুধু নয় অরণ্যের গাছপালা নড়ে উঠল। নিষিদ্ধ অরণ্যের পাখিরা অন্ধকারেই আকাশে উড়তে শুরু করল। ভিক্টর ক্রাম, ডারমস্ট্রংগ স্কুলের ছাত্র আশি পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তৃতীয় স্থান মিস ফ্লেউর ডেলাকৌর বক্সটেন একাডেমির ছাত্রী। হর্ষধ্বনি আর হাততালি সমবেত গান যেন থামতে চায় না!

মিসেস উইসলি যখন ডেলাকৌরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন ঠিক সময় হ্যারির চোখ পড়ে রন, হারমিওন, বিল, মিসেস উইসলির দিকে গেল। হ্যারি হাত নাড়াতে তারাও হাত নেড়ে ওকে উৎসাহিত করলেন।

–তো হ্যারি, সেডরিক… আমি হুইসেল বাজাচ্ছি থ্রি–টু–ওয়ান। ওয়ান শোনার সাথে সাথে তোমরা তোমাদের নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে গোলক ধাঁধায় ঢুকে যাবে। বেগম্যান হুইসেল বাজিয়ে ওয়ান বলতেই ওরা গোলক ধাঁধায় ঢুকে গেল। বিরাট গোলক ধাঁধা রাস্তার দুপাশে তাদের ছায়া ফেলে অন্ধকার করে রেখেছে। ওর গোলক ধাঁধায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের গোলমাল, চিৎকার আর ওদের কানে এলো না। হ্যারি ভেতরে ঢুকে মনে হলো আবারও জলের তলদেশে এসেছে। ও পকেট থেকে জাদুদণ্ড বের করে বলল, লুমস।

হ্যারি শুনতে পেল পেছন থেকে একই জাদুমন্ত্র বলল সেডরিক। প্রায় পঞ্চাশ গজ এগোবার পর কাঁটাতার দিয়ে ভাগ করা একটা সন্ধিস্থলের সামনে দাঁড়াল। দুপথ দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দুজনকে যেতে হবে। যাবার আগে দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকাল।

নিজের পথে পা দিয়ে হ্যারি সেডরিককে বলল, ক্রাম আবার দেখা হবে। সেডরিক ডানদিকের পথে ঢুকল।

হ্যারি দ্বিতীয়বার বেগম্যানের হুইসেল শুনতে পেল। ক্রাম তাহলে গোলকধাঁধায় ঢুকেছে। হ্যারি চলার গতি বাড়িয়ে দিল। যে পথটা ও বেছে নিল সেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ও ডানদিকে বাঁক নিল। দণ্ডটা উঁচু করে যতদূর সম্ভব সামনের পথ দেখতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।

বেগম্যানের তৃতীয় হুইসেল হ্যারি শুনতে পেল ভাসা ভাসা ভাবে। চারজন চ্যাম্পিয়ন এখন গোলকধাঁধার অন্দরে প্রবেশ করেছে।

হ্যারি পেছনে তাকাল। এখনও ওর মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছে। এই মনোভাব থেকে ও মুক্ত হতে পারে না। হাঁটছে ও.. আর প্রতিটি মুহূর্তে আর পদক্ষেপে মনে হয় গোলকধাঁধায় অন্ধকার থেকে অন্ধকার থেকে অন্ধকারতর হয়ে চলেছে। ওপরে আকাশের আরও নীল হয়ে যাচ্ছে। তারপর দ্বিতীয় কাঁটাতারের বেড়ায় পৌঁছল।

ও হাতের দণ্ডকে আদেশ করল পয়েন্ট সি। হাতের তালুকে শুইয়ে রেখে বলল।

জাদুদণ্ড আবার প্রলম্বিত হল, ডানধারের দৃঢ় বেড়াঝোপের দিকে দিক নির্ণয় করল। উত্তর দিক, ও আগেই জানে ওকে উত্তর–পশ্চিমে ঝোপ গোলকধাঁধার কেন্দ্রে যেতে হবে। সহজ পথ হবে কাঁটাতারের বা ধার ধরা… তারপর যত তাড়াতাড়ি পারে দক্ষিণের পথ ধরা।

ডানধারে ঘুরে দেখল সেই পথটা শূন্য। রাস্তাটায় কোনও বাধা নেই। কেন নেই তা বুঝতে পারলো না; কিন্তু বাধামুক্ত থাকার জন্য ও একটু ঘাবড়ে গেল। কিন্তু কিছু তো সামনে থাকা উচিত! ওর মনে হল গোলকধাঁধার পথ ওকে এক নিরাপত্তার ভুয়ো আশ্বাস দিয়ে যেন টেনে নিয়ে চলছে। তারপর ও পেছনে ডানদিকে কারও চলাফেরার পদশব্দ শুনতে পেল। হ্যারি ওর দণ্ডটা এগিয়ে ধরল আক্রমণের মোকাবিলা করতে।… কিন্তু ওর দণ্ডের রশ্মি সেডরিকের ওপর পড়ল। ও তখন দক্ষিণের দিক থেকে একটা পথ ধরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসছে। ওর মুখ দেখে মনে হল দারুণ এক ভয়ে উত্তেজনায় থরথর করছে। ওর রোবসের হাতা থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে। ও বলল, জটা প্রকাণ্ড, বিরাট আকারের হ্যাগ্রিডের রাস্ট এন্ডেড স্ক্রিউট। আমি কোনওরকমে পালিয়ে এসেছি। ও কথাটা বলে মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে অন্য একটা পথ ধরে একরকম ঝাঁপিয়ে চলে গেল। অনেকগুলো উিটদের থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে হ্যারি জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। তারপর এক কোণে ঘুরতেই ও দেখল

একটা ডেমেন্টটর ওর দিকে এগিয়ে আসছে। লম্বা প্রায় বার ফুট মুখ বোরখায় ঢাকা, দুর্গন্ধময় চর্মরোগগ্রস্ত হাত দুটো সামনে প্রসারিত। চোখ তার বন্ধ, তাই হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। হ্যারি ফোঁস ফোঁস শব্দের নিশ্বাস শুনতে পেল, মনে হল তীব্র সাঁড়াশির মতো ওকে একটু একটু করে চেপে ধরতে আসছে কি করবে, কোথায় পালাবে ভেবে পায় না।

ও ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, যতটা পারে। মনপ্রাণ দিয়ে ভাবতে লাগল কেমন করে গোলকধাঁধা থেকে মুক্ত হয়ে আবার রন হারমিওনের সঙ্গে হাসি–মজা করবে। দণ্ড ধরা হাতটা তুলে খুব জোরে বলল, এক্সপেক্টটো পেট্রোনাম।

হ্যারির ম্যাজিক দণ্ড মুখ থেকে এক্সপেতে পেত্রানাম বলার সঙ্গে সঙ্গে রূপালী হরিণের মুণ্ডু বেরিয়ে এসে লাফাতে লাফাতে ডেমন্টরের দিকে এগিয়ে গেল, ডেমেন্টর পিছু হটতে গিয়ে রোবসের শেষ প্রান্তের কাপড়ে জড়িয়ে পড়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল। হ্যারি এর আগে কোন ডেমেন্টরকে হোঁচট খেতে দেখেনি।

দাঁড়াও, হ্যারি আদেশের সুরে বলল, রূপোর রেখা ধরে এগোতে এগোতে বলল, তুমি একটি নরকের কীট! রিডিকুলাস।

তারপর বড় রকম কড় কড় শব্দ করে হরিণটা ফেটে গিয়ে একরাশ ধোয়ার সৃষ্টি করল, রূপোর হরিণ অদৃশ্য হয়ে গেল। হ্যারির মনে হল হরিণটা থাকলে ভাল হত, তাহলে ওর সাহচর্য পেত।

বায়ে… ডানদিকে… আবার বাঁয়ে… দুবারই দেখল ও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার চতুর্মুখী জাদুমন্ত্র বলল, এখন দেখল ও চলেছে পূর্বদিকে। ও পেছন ফিরল, ডানদিকে ঘুরল… দেখল ওর সামনে সোনালী রঙের কুয়াশা।

হ্যারি খুব সাবধানতার সঙ্গে এগোল, সেই কুয়াশার দিকে দণ্ডের রশিটা বাড়িয়ে রাখল। ভাবতে লাগল কেমন করে সামনে দুর্ভেদ্য কুয়াশাটা সরানো যায়।

ও বলল, রিডাকটো।

জাদুমন্ত্র সোজা কুয়াশাকে আঘাত করল; কিন্তু কুয়াশা যেমন ছিল তেমনই রইল। ওর মনে পড়ে গেল রিডাকটোর কার্স কোনও কঠিন পদার্থের জন্য নয়, ওর জানা উচিত ছিল। হ্যারি ভাবল, ও যদি সোনালী কুয়াশা ভেদ করে যায় তাহলে কী হবে? কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না হ্যারি। হঠাৎ কে যেন ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠল তখন। মনে হলো ফ্লেউরের কণ্ঠস্বর।

কি করবে না করবে ভেবে না পেয়ে চিৎকারে ডাকল, ফ্লেউর!

ওর ডাকের কোনও সাড়াশব্দ নেই ফ্লেউরের কাছ থেকে। ওর কী কিছু হয়েছে? মনে হল সামান্য দূর থেকে ফ্লেউর চিৎকার করেছে। তারপরই হ্যারি বুক ভরা নিশ্বাস নিয়ে মায়াভরা কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেদিক থেকে চিৎকার এসেছে সেইদিকে ছুটল।

পৃথিবীটা যেন উল্টে গেছে। ওর মাথা নিচে, পা ওপরে। নাক থেকে চশমাটা প্রায় পুলে ঝুলে পড়েছে, তারপরই অনন্ত আকাশে পড়ে যাবে। ও দুহাতে চশমাটা ধরে ঠিক করে নাকে লাগল। পৃথিবীর মাটিটা এখনও উপরে ঝুলে আছে। ওর মাথার তলায় নক্ষত্রখচিত আকাশ। ও ভাবল যদি একটু নড়ে তাহলে পৃথিবী থেকে পড়ে যাবে।

চিন্তা কর। ও নিজেকে নিজে বলল। উল্টো হয়ে ঝুলে থাকার জন্য ওর শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় এসে জমা হয়েছে, চিন্তা কর।

কিন্তু আকাশ ও মাটিকে ফের সোজা করার জাদুমন্ত্র তো ও জানে না। হ্যারি কী সাহস করে পা নাড়িয়ে দেখবে নাকি কী হয়! মাথা থেকে রক্ত যেন কানের কাছে এসে দপদপ করতে লাগল। ওর সামনে এখন দুটি পথ চেষ্টা করা ও এগিয়ে যাওয়া, অথবা লাল রশ্মি পাঠিয়ে নিজেকে উদ্ধার করার সংকেত পাঠানো। কিন্তু তা যদি করে তাহলে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ যাবে।

ও চোখ বন্ধ করল। যেন অসীম আকাশ না দেখা যায়, এবং ডান পা ঘাসের ওপর থেকে সরালো। হঠাৎ পৃথিবীটা যেন যেমন ছিল তেমনই হয়ে গেল। ও মাটিতে আছড়ে পড়ল। হাঁটু দুটো মাটিতে লেগে টনটন করতে লাগল। ও খুব বড় দেখে একটা নিশ্বাস নিল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগল। পেছন ফিরে দেখল ও সোনালী কুয়াশা ভেদ করে এসেছে। চাঁদের আলো পড়ে কুয়াশা ঝিকমিক করছে।

ও দুটো পথের সংযোগস্থলে দাঁড়ালো। ফ্লেউরের কোনও হদিস পায় কিনা তাই দেখতে লাগল। ও কি ঠিক আছে? ও ধার থেকে কোন লাল রশি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে ওর কোন বিপদ হয়নি, ঠিক আছে। যদি তা না হয় তাহলে কী ওর জাদুদণ্ড খুইয়ে বসেছে? ও খুব অস্তস্তিকর মনে ডানদিকের রাস্তায় গেল। চারজন চ্যাম্পিয়ন থেকে একজন হটে যাবে কথাটা যেন ও ভাবতে পারে না।

কাপটা হয়ত খুব কাছেই আছে, তাই বোধহয় ফ্লেউর আর দৌড়োচ্ছে না। তাহলে নিজেও তো আর বেশি দূরে নেই। যদি ও সত্যই জেতে তাহলে? উইজার্ড হলেও আরও অনেক প্রতিযোগিতায় ও প্রথম হয়েছে। হঠাৎ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক দৃশ্য! ও যেন ট্রাইউইজার্ড কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর সামনে অগণিত দর্শক, তারা হাততালি দিচ্ছে।

দশ মিনিট ধরে হেঁটে চলেছে। কোনও বাধাবিঘ্ন নেই, কিন্তু এখানে এই পথের শেষ। এগিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। শেষ পর্যন্ত ও একটা নতুন পথ দেখতে পেল। সেটা ধরে ও জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। হাঁটার সময় ওর হাতের জাদুদণ্ডের বাতি কাঁপতে থাকে। সামনে ওর ছায়াটা হেজ গাছের বেড়ার ওপর আঁকাবাঁকা হয়ে পড়তে থাকে। তারপর একই ইউটার্ন নিতেই সামনে দেখল একটা লেজের কাছে প্রবল ঝড়ের একটা ক্রিউট (ব্লাস্ট এন্ডেড ক্রিউট)!

সেডরিক একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যই স্ক্রিউট বড় নয় শুধু, ভয়ঙ্করও। কম করে দশ ফিট লম্বা, দেখতে দৈত্যের মতো কাঁকড়া বিছে। মোটা মোটা ছুঁচের মতো গায়ে বাঁকা বাঁকা কাঁটা। গায়ের চকচকে মোটা চামড়া হ্যারি হাতের দণ্ডের আলো পড়ে ঝলসাতে লাগল।

স্টুপিফাই!

সময়মত হ্যারি ওকে স্পেল না করলে কি হত বলা যায় না। হ্যারির জাদুমন্ত্র ওর গায়ে লেগে ছিটকে ফিরে এল। মাথার কাছটা পুড়ে গেছে, তারই পোড়া গন্ধ নাকে লাগল। আগুনে মাথার ওপরটা ঝলসে গেছে। ফ্রিউট ওর লেজ দিয়ে প্রবলভাবে আগুন ছড়াতে ছড়াতে হ্যারিকে তাড়া করল।

ইমপেডিমেন্টা! হ্যারি উচ্চস্বরে বলল। জাদুমন্ত্র ওটার গায়ে লেগেই ছিটকে ফিরে এল। হ্যারি দুচার পা পিছিয়ে এসে আবার বলল। ইমপেডিমেন্টা!

হ্যারি তখন ওর থেকে মাত্র এক ইঞ্চি তফাতে। স্পেলটা শুনেই ক্রিউট অবশ হয়ে গেল। হ্যারি কায়দা করে ওর গায়ে যেখানে শক্ত চামড়া নেই সেখানে স্পেলটা ছুঁড়তে পেরেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বিপরীত দিকে হ্যারি দৌড়াতে লাগল–কারণ ইমপেডিমেন্টা ক্ষণস্থায়ী সমোহন। যেকোনও মুহূর্তে ক্রিউট আবার দাঁড়িয়ে উঠতে পারে।

বাঁ–দিকের রাস্তাটা ও ধরল, সেটাও একটু হাঁটার পর বন্ধ, দক্ষিণে একই অবস্থা। কেমন করে ও গোলকধাঁধা থেকে বেরোবে। অজানা আশঙ্কায় ও বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটতে থাকে। আবারও চতুর্মুখী জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করল, এক পা পিছিয়ে এল, উত্তর–পশ্চিমে যাবার জন্য নতুন একটা রাস্তা ধরল।

নতুন রাস্তা ধরে ও বেশ জোরে জোরে হাঁটতে লাগল, কয়েক মিনিট মাত্র, তখন মনে হল সেই পথের পাশে ওর সমান্তরালভাবে কেউ হাঁটছে। সেই রাস্তাটারও শেষ বন্ধ।

হঠাৎ সেডরিকের গলা শুনতে পেল। আরে এখানে তুমি কি করছ? এখান থেকে যাবার পথ কোথায় সেটা জান?

তারপর হ্যারি শুনতে পেল ক্রামের গলা।

ক্রুসিও!

হঠাৎ, সমস্ত আকাশ–বাতাস সেডরিকের চিৎকারে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।

আতঙ্কিত, হ্যারি পূর্ণ বেগে দৌড়াতে লাগল–সেডরিক কোথায় খুঁজতে হবে। যখন কাউকে ও দেখতে পেলো না, তখন সে রিডাক্টর কার্স আবার প্রয়োগ করতে চেষ্টা করল। ওটাও কার্যকরী হল না। না হলেও ঘন ঝোপে একটা ছোট গর্ত হয়ে গেল। হ্যারি গর্তের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দমাদম লাথি মেরে চলল। ওটা ওকে ভাঙতেই হবে… অনেক কষ্টে সে ভেতরে ঢোকার মতো গর্ত করে ফেলল। ভেতরে ঢুকে এগোতে গিয়ে কাটা গাছে ওর বোবস ছিঁড়ে গেল, তারপর ডানদিকে তাকিয়ে দেখল সেডরিক মাটিতে পরে হাত–পা ছুঁড়ছে, ক্রাম ওর ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

হ্যারি ভেঙ্গে না পড়ে নিজেকে শক্ত করল। ক্রামের দিকে জাদুদণ্ড প্রসারিত করতেই ক্রাম তার দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়াল।

হ্যারি চিৎকার করে বলল, স্টুপিফাই!

ওর মন্ত্র সোজা ক্রামের পিঠে আঘাত করল। ক্রাম ওর পথে ধপ করে পড়ে গেল, ঘাসে মুখ রেখে শুয়ে পড়ল। চেতনা হারিয়েছে। হ্যারি তারপর সেডরিকের কাছে গেল। সেডরিক তখন অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে। মুখ দুহাতে ঢেকে হাঁপাচ্ছে।

হ্যারি, সেডরিকের কাঁধে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তুমি ভাল আছ তো?

সেডরিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, ও আমাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরেছিল, আমি পেছন তাকাতেই সে আমার গায়ে জাদুদণ্ড ছোঁয়াল।

তারপর সেডিরিক কোনও রকমে দাঁড়াল। তখনও সামান্য কাঁপছে। ওরা দুজন বেহুশ ক্রামের দিকে তাকাল। হ্যারি বলল, সত্যি এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি ওকে ভাল ভেবেছিলাম, হ্যারি ভুলুণ্ঠিত ক্রামের দিকে তাকাল।

সেডরিক বলল, আমিও করেছিলাম।

তুমি একটু আগে কী ফ্লেউরের গলা শুনতে পেয়েছ?

পেয়েছিলাম… তোমার কি মনে হয় ক্রাম ওকে আমার মতো…! সেডরিক বলল।

–ঠিক বুঝতে পারছি না, হ্যারি খুব চাপা গলায় বলল।

সেডরিক বলল, ওকে কী আমরা এই অবস্থায় এখানে রেখে যাব?

হ্যারি বলল, সেটা ঠিক হবে না। তারচেয়ে আমরা লাল স্পার্ক ছাড়ি… যারা ট্ৰেলিং–মানে যারা আমাদের রক্ষার জন্য বাইরে মোতায়েন আছে, লাল আলো দেখে এখানে এসে ওকে নিয়ে যাবে। ফেলে রেখে গেলে নির্ঘাত উিট ওকে খেয়ে ফেলবে।

তাই হোক, এটা ওর প্রাপ্য, সেডরিক মুখ বেঁকিয়ে বলল। কথাটা বলে সেডরিক ওর জাদুদণ্ডটা আকাশের দিকে তুলতেই বৃষ্টির মতো লাল ফুলিঙ্গ বেরোতে লাগল। ঠিক ক্রামের অচৈতন্য শরীরের ওপরে। লাল আলো দেখে ওকে ঠিক খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না।

ওরা দুজনে চুপচাপ কিছুক্ষণ গাঢ় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সেডরিক বলল, আমাদের এবার এখান থেকে যাওয়া উচিত, কি বল?

কী বললে? হ্যারি বলল। ও হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।

অদ্ভুত এক পরিস্থিতি! সামান্য সময়ের জন্য ওরা ক্রামের কাজকর্মের জন্য এক হয়েছিল। আসলে তো ওরা প্রতিযোগী! তাই ওরা আলাদা আলাদা পথ বেছে নিল। হ্যারি বাঁ–দিকে, সেডরিক ডানদিকে। সেডরিকের পদশব্দ মিলিয়ে গেল।

হ্যারি চার পয়েন্ট জাদুমন্ত্র ব্যবহার করতে করতে এগোতে লাগল। সঠিক পথে যাচ্ছে কি না সে সম্বন্ধে সতর্ক রইল। কাপের কাছে সবার আগে পৌঁছানোর মানসিক তীব্রতা আরও যেন বেড়ে গেল। ক্রাম যা করেছে ও তা যেন ভাবতে পারছে না। আনফরগিভেবল কার্স (ক্ষমাহীন কার্স) কোনও ভালমানুষের ওপর প্রয়োগ করার শাস্তি আজীবন আজকাবানে বন্দি হয়ে থাকা, সেকথা হ্যারি জানে। মুডি ওকে বহুবার এই কথা বলে সাবধান করে দিয়েছেন। ভাবতে পারছে না, ট্রাইউইজার্ড কাপ পাওয়ার জন্য এতবড় ঝুঁকি নেওয়ার ওর কী প্রয়োজন? কথাগুলো ভাবার সময় নেই। ও দ্রুত লক্ষ্যস্থলের দিকে ছুটল।

মাঝে মধ্যে গোলকধাঁধায় ওর পথ ঠিক হয় না। আটকে যায়। যেখানে ছিল সেখানেই ফিরে আসে। তাহলে থেমে থাকলে চলবে না। তারপর ও একটা লম্বা রাস্তার ওপর দাঁড়াল। আবার ও নিস্তব্ধ জগতের বাইরে এল। কোনও কিছু স্থির নয়, নড়াচড়া করছে। চলতে চলতে ওর হাতের দণ্ডের আলো অদ্ভুত এক জম্ভর ওপর পড়ল, অনেকটা ওর মনস্টার বুক অব মনস্টারসে বইতে ছবি দেখেছে।

জন্তুটা স্ফিনিক্স রূপকথার দানবী বিশেষ: মাথা মানবীর মতো ও (ধাঁধা জিজ্ঞেস করত কাউকে সামনে দিয়ে যেতে দেখলে সঠিক উত্তর দিতে না পারলে তাদের হত্যা করত) বিরাট সিংহের মতো দেহ, মোটা মোটা থাবা, হলুদ রংয়ের লম্বা লেজ… শেষ প্রান্তে বাদামী থোকা থোকা লোম। মাথাটা অবশ্য মেয়েদের মতো। সেই স্ক্রিনিক্স ওর টানা বাদামী রংয়ের চোখে হ্যারিকে দেখল। হ্যারি ওকে কাবু করার জন্য ওর জাদুদণ্ড তুলল, ইতস্তত করতে লাগল। জটি লাফিয়ে ওঠার জন্য গুটিসুটি মারছে না, কিন্তু পথ আটকে বসে রয়েছে।

তারপর সেই ফিনিক্স কর্কশ স্বরে বলল, তুমি উদ্দেশ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। তাড়াতাড়ি আমাকে ডিঙিয়ে যাও।

তো… তো তুমি দয়া করে একটু সরে না বসলে আমি তো যেতে পারবো না, হ্যারি জানে ও সরবে না তবু বলতে হয় বলে বলল।

যাবার জায়গাটা আরও সঙ্কুচিত করে বলল, মোটেই না, যতক্ষণ না তুমি আমার ধাঁধার উত্তর দিতে পারছো আমি এক চুলও সরবো না। প্রথম প্রশ্ন কী হবে আন্দাজ করতো? ঠিক বললে পথ ছাড়বো, ভূল বললে আমি তোমাকে তাড়া করব। আর যদি চুপ করে থাক তাহলে তোমাকে আমার ওপর দিয়ে যেতে দেব; কিন্তু আমার গায়ে যেন একটুও আঁচড় না লাগে বুঝলে?

হ্যারির স্ফিনিক্সের শর্ত শুনে পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল। এইসব উত্তর–টুর দেয়ার ব্যাপারে হারমিওন উপযুক্ত। ও কিছু পারে না। তবু দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে! যদি স্ক্রিনিক্সের ধাঁধা খুব কঠিন হয় তাহলে ও চুপ করে থাকবে, ওকে কোনরকম আঘাত–টাঘাত না করে অন্য পথ খুঁজবে, কাপ যেখানে আছে সেখানে যেতে।

বেশ, ঠিক আছে। তাহলে তোমার ধাঁধা শুনতে পারি কী? স্ক্রিনিক্স ওর পেছনের পা দুটি গুটিয়ে আরাম করে বসল। তারপর হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল:

এমন এক লোকের কথা ভাব যার শুধু বেশ ছদ্মবেশ,
সব কিছুই গোপন রাখে, মিথ্যে ছাড়া নেইকো তার শেষ।
তারপর বলতো, অভাব সেটার কোন কথাটি বেশ,
মাঝের মধ্যে মাঝে, না শেষের মধ্যে শেষ?
শেষে বল, প্রায়ই শোনা কথাটির ধ্বনি; খুঁজে বেড়াও?
তারে তুমি পাওনা কেন মনি?
এখন তাদের সঙ্গে নিয়ে গাঁথ মালা
কোন প্রাণীকে চাওনা তুমি গালে দিতে চুমি?

হ্যারি বোকার মতো তাকাল।

অনুগ্রহ আরএকবার ধাঁধাটা বলবে? একটু ধীরে। ফিনিক্স চোখ মটকে হাসল, কবিতাটি আবার বলল।

সব ইঙ্গিত এক করলে একটা জম্ভ হয়–তাকে চুম্বন করতে চাই না? হ্যারি প্রশ্ন করল।

স্ফিনিক্স রহস্যপূর্ণ ভাবে হাসল। হাসি দেখে হ্যারির মনে হল ধাঁধার জবাব ঠিক বলেছে। অনেক অনেক জন্তুদের কথা ভাবল। তাদের মধ্যে কোন্ প্রাণীকে ও চুম্বন করতে চায় না। ফ্রিউটের কথা মনে পড়ল, কিন্তু মনের ভেতর কে যেন সজাগ করে দিল, সেটা ধাঁধার জবাব নয়। ওকে ধাঁধার জবাব নিজেই বের করতে হবে।

একজন মানুষ ছদ্মবেশে, হ্যারি ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল–যে মিথ্যে বলে, ও তাহলে তো সে–কি একজন ভেক–ধরা লোক। না, ওটা আমার অনুমান নয়! এক একজন গুপ্তচর! না, ওটা আমার অনুমান নয়! এ একজন গুপ্তচর? আমি ফিরে আসছি সেই ব্যাপারে। তুমি কি আমাকে পরের সমাধানে সূত্র বলবে, অনুগ্রহ করে?

ফিনিক্স কবিতার পরের ছত্র আবার বলল।

হ্যারি এবার বলল–না আমার মাঝের মধ্যে মাঝে না–আমি বুঝতে পারছি, আমাকে কি শেষ ছত্রটি আবার বলবেন?

শেষ চারটি পংক্তি স্ফিনিক্স বলল।

একটা ধ্বনি প্রায়ই শোনা যায়, একটি শব্দ কঠিনভাবে খুঁজতে, হ্যারি বলল।–, ওহ তাহলে সেটা, ওহ বাদ দাও, ওহ ওটাই একটা ধ্বনি!

ফিনিক্স হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসল।

স্পাই… স্পাই…, স্ক্রিনিক্সের কাছে ঘুরতে ঘুরতে বলল। একটা প্রাণী যাকে আমি চুম্বন করতে চাইল না… মাকড়সা?

এইবার ফিনিক্স খুব জোরে জোরে হাসল। সামনের দুটো পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর সামান্য জায়গা করে দিল যাতে হ্যারি স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পারে।

ওর মনে হতে লাগল আর বেশি দূর নয়, প্রায় এসে গেছে। ওর হাতের জাদুদণ্ড তাই যেন বলছে, যদি পথে আর কোনও ভয়ংকর জন্তু বা অন্যকিছুর সামনাসামনি না হতে হয় তাহলে তার আশা আছে।

সামনে খোলা রাস্তা। কোনটা দিয়ে যাবে সেটা তার ইচ্ছে। ও হাতের জাদুদণ্ড বলল, নির্দেশ দাও।

জাদুদণ্ড থরথর করে উঠে ওকে দক্ষিণ দিকে পথ নির্দেশ দিল। হ্যারি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে সেই পথ ধরল। দূরে আলো দেখতে পেল।

প্রায় হাজার গজ দূরে ট্রাইউইজার্ড কাপ একটা বেদিতে বসান। আলো পড়ে কাপটা ঝলমল করছে। একটা কালো ছায়া ওর আগে আগে দৌড়াচ্ছে, হ্যারি তার দৌড় থামিয়ে দেখল।

তাহলে কি সেডরিক ওর আগে বেদির কাছে পৌঁছেছে? সেডরিক প্রাণপণ শক্তিতে দৌড়াচ্ছে। হ্যারি জানে যত জোরেই দৌড়াক না কেন ওর পক্ষে সেডরিককে হারানো সম্ভব নয়। সেডরিক ওর চেয়ে অনেক লম্বা, পা দুটো লম্বা লম্বা।

তারপর হ্যারি দেখল ওর বাঁ–ধারের ঝোপের ওপর বিশাল একটু কিছু নড়ছে। ও যে রাস্তাটায় সেখানে বেশ জোরে নেমে আসছে, সেডরিক ওকে দেখতে পায়নি। ওর দৃষ্টি তখন কাপের দিকে। হঠাৎ সেই বিশাল জটার দিকে চোখ না পড়ার জন্য সেডরিকের ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল।

–সেডরিক! হ্যারি চিৎকার করে বলল, বাঁ–দিকে, বাঁ–দিকে তাকাও।

কিন্তু সেডরিক হ্যারির কথা কানে যাবার আগেই বিশাল জটার সঙ্গে ধাক্কা খেল। ধাক্কা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকে জাদুদণ্ডটা ছিটকে পড়ল। সেই বিশাল জটা এক অদ্ভুত মাকড়সা। ও সেডরিকের দিকে এগোতে লাগল। এগোতে এগোতে প্রায় ওর ওপরে এসে পড়ল। স্টুপিফাই! হ্যারি গর্জন করে মন্ত্র উচ্চারণ করল। মন্ত্রটা সরাসরি সেই বিশালকায় মাকড়সার চুলওয়ালা কাল দেহের ওপর পড়ল। হ্যারি মন্ত্র ছাড়াও একটা পাথর ওর গায়ে ছুঁড়ে মারল। মাকড়সাটা গা ঝাড়া দিল, ঘুরপাক খেতে খেতে সেডরিককে ছেড়ে হ্যারির দিকে এগোতে লাগল।

স্টুপিফাই। ইমপেভিমেন্টা। স্টুপিফাই!

কিন্তু হ্যারির মন্ত্রতে মাকড়সটার কিছুই হল না। ও বহাল তবিয়তে হ্যারির দিকে এগোতে লাগল। মন্ত্র ও পাথর ছোঁড়ার জন্য মাকড়সাটা যেন আরও রেগে গেছে। হ্যারি ওর জ্বলজ্বলে আটটা চোখের দিকে তাকাল। মাকড়সাটার পায়ে ধারালো সাড়াশির মতো নখ।

মাকড়াসাটা ওর সামনের দিকের একটা পা দিয়ে হ্যারিকে ওপরে তুলল। ধারাল নখ দিয়ে যেন ও হ্যারিকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে, কিন্তু পরমুহূর্তে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল–হ্যারি শুনতে পেল সেডরিকের জাদুমন্ত্র এক্সপেলি আর্মাস। মন্ত্রটা কাজ দিয়েছে। কিন্তু ওর ব্যথা লাগা পা আরও দশ ফিট ওপর থেকে ছিটকে পড়ার জন্য আরও বেশি ব্যথা করতে লাগল।

মাকড়সাটা আরও নিষ্ক্রিয় করার জন্য হ্যারি মাকড়াসাটার থলথলে পেটের দিকে দণ্ডটা এগিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, স্টুপিফাই। একই সঙ্গে দুটি জাদুমন্ত্রে বিশালকায়া বীভৎস মাকড়সা মৃতের মতো পড়ে রইল। তারপর ঝোপের ভেতর চলে গেল।

হ্যারির তখনও আতঙ্ক কাটেনি। সারাদেহে ব্যথা। কানে এল, হ্যারি তুমি আঘাত পেয়েছো? জটা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তো?

–না। হ্যারি ওকে শোনাবার জন্য গলা ফাটিয়ে বলল। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল পা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। আরও দেখল ওর রোবস (আলখেল্লা) ছিঁড়ে গেছে, ধূলিধূসরিত আর মাকড়সার বড় বড় লোম লেগে রয়েছে। ও দাঁড়াবার চেষ্টা করল; কিন্তু পারলো না। পা–দুটো ঠক ঠক করে কাঁপছে। ও ঝোপে হেলান দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে দেখতে পেল সেডরিক কাপ থেকে মাত্র এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে। কাপটা আরও বেশি উজ্জল ও চকচক করছে।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সেডরিক, কাপটা তুমি নাও, তুমি তো সবার আগে রয়েছ।

কিন্তু সেডরিক এক চুলও নড়লো না। যেখানে ছিল সেখানেই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। চোখ তার আহত হ্যারির দিকে। তারপর সেডরিক তাকাল কাপের দিকে। হ্যারি দেখল সেডরিকের চোখ দুটো কাপ পাবার আশায় জ্বলজ্বল করছে। ওর মুখে পড়েছে সোনালী আলো। সেডরিক আবার দেখল হ্যারিকে। হ্যারি অবসন্ন, ক্লান্ত, তখনও ঝোপে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সেডরিক লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, হ্যারি তুমি দৌড়াও। কাপ তোমারই প্রাপ্য, তুমি ছুটে যেতে চেষ্টা কর। তুমি জিতেছ হ্যারি। দুদুবার তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ… এটাই বড় কথা বন্ধু।

হ্যারি বিরক্ত হয়ে বলল, তা হয় না, হতে পারে না।

হ্যারির পা দিয়ে রক্ত ঝরছে, সারা দেহে অবর্ণনীয় ব্যথা, মাকড়সার বিষাক্ত লোম গায়ে পড়ে চুলকুনি সারা গায়ে। হ্যারির মতো সেডরিকও সেই বিশাল, ভয়ঙ্কর মাকড়সাকে জাদুমন্ত্রে তাড়িয়েছে। সেডরিকের মনে পড়ে গেল কিডিচ খেলার সময় চোকে বল নিতে বলেছিল। যে প্রথমে কাপ ছোঁবে সে বেশি পয়েন্ট পাবে। তুমি, তুমি সেডরিক, দৌড়াও, সময় নষ্ট করো না। আমি তোমায় বলছি সেডরিক এই রক্তাক্ত যন্ত্রণাদায়ক পা নিয়ে আর আমি ছুটতে পারছিনে।

সেডরিক জাদুতে আহত হওয়া মাকড়সাটিকে আড়চোখে দেখে হ্যারির কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে বলল, হতেই পারে না।

হ্যারি বিরক্তি সহকারে বলল, মহৎ হবার চেষ্টা করবে না, আমি বলছি তুমি গিয়ে কাপটা নাও, তারপর আমরা গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে যাব।

সেডরিক দেখল হ্যারি ভাল করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।

সেডরিক বলল, তুমি যদি হ্যারি আমাকে ড্রাগনের কথা না বলতে তাহলে প্রথম টাস্কে আমি হেরে যেতাম।

হ্যারি বলল, তুমি আমাকে সোনার ডিমের কু দিয়েছিল শোধ হয়ে গেছে। ও আলখেল্লা দিয়ে পায়ের রক্ত মুছতে লাগল।

সেডরিক বলল, সেকেন্ড টাস্কে তোমার সকলের চেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া উচিত ছিল। কেউ যা করেনি তুমি তা করেছে। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সকলকে হোস্টেজের হাত থেকে বাঁচিয়ে সবার শেষে জলের তলা থেকে উঠে এসেছিলে। আমি তা পারিনি।

–আমি মৎস্যকন্যার গান গভীরভাবে বুঝেছিলাম।

যাও, যাও সেডরিক কাপটা নিয়ে এস।

–না, সেডরিক দাঁড়িয়ে রইল।

মাকড়শাটা কুকুতে চোখে মন্ত্রে সম্মোহিত হয়ে মাটিতে ওর কদর্য বীভৎস পা ছড়িয়ে হ্যারির পা জড়িয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। সেডরিক মাকড়সাকে ডিঙিয়ে হ্যারির পাশে দাঁড়াল। হ্যারি ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, ও এক বর্ণও মিথ্যা বলছে না। সবকিছু মন থেকে বলছে, শতবর্ষ ব্যাপী হাফলপাফের ছাত্রছাত্রী যা পায়নি, তা অর্জন করার সুযোগ পেয়েও সেডরিক বন্ধু প্রতিযোগীর দিকে তাকিয়ে তুচ্ছ করছে।

সেডরিক আর একটিও কথা না শুনে বলল, তুমি যেমন করে পার যাও। হ্যারি দেখল ওর মুখে দৃঢ়তার ছাপ উপেক্ষা করে চলে না ওর সিদ্ধান্ত।

হ্যারি সেডরিকের পেছন থেকে কাপটাকে সতৃপ্তি নয়নে দেখল। হঠাৎ যেন মনে হল ও কাপটা হাতে নিয়ে গোলকধাঁধা থেকে নেমে আসছে, দর্শক–ছাত্রছাত্রী শিক্ষকরা ওকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে। মুখটা হ্যারির জয়ে আনন্দে যেন ফেটে পড়ছে। এত সুস্পষ্ট আগে ওর চোখে পড়েনি। তারপর সেই মনের ছবি একটু একটু করে আড়াল হয়ে যায়। দেখল–ও সেডরিকের জেদি, একগুয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

হ্যারি বলল, একইসঙ্গে দুজনে।

কী বললে?

–আমরা একইসঙ্গে দু জনেই কাপটা নেবো। সেটা হবে আমাদের স্কুল হোগার্টের জয়। আমরা যুগ্মভাবে জয়ী হব।

সেডরিক হ্যারির দিকে তাকালো। গুটানো হাত খুলে ফেলো।–তুমি, তুমি নিশ্চিত হয়ে বলছো?

হ্যাঁ, হ্যারি বলল। হ্যাঁ, আমরা পরস্পরকে সাহায্য করেছি, করিনি? আমরা একই সময় এখানে এসেছি, দুজনে একইসঙ্গে নেয়া যাক।

এক মুহূর্ত! সেডরিক তাকাল, ও যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে। তারপর ও হাসল।

–চল, চল দেরি করবে না। এদিকে এস।

ও হ্যারির কাঁধটা ধরল। সে বেদিতে কাপটা রাখা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা হ্যারিকে সেখানে নিয়ে গেল। বেদির কাছে পৌঁছে ওরা একইসঙ্গে ঝকঝকে কাপের হ্যান্ডেলে হাত ছোঁয়াল।

তিন গুনবো, ঠিক আছে, হ্যারি বলল, এক–দুই–তিন।

ও আর সেডরিক রুদ্ধশ্বাসে ঝাপের একটা হাতল ধরল।

হাত ছোঁয়াবার সাথে সাথেই হ্যারির নাভিস্থলের পেছনে একটা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করল। ও হাতটা ট্রাইউইজার্ড কাপের হ্যান্ডেল থেকে সরাবার সময় পেলো না। কে যেন ওকে টেনে ধরে রইল, ঝড়ো হাওয়া, শন শন তার শব্দ, অনেকটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ও আর সেডরিক আকাশে ভেসে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *