দরিয়াবিবি আগে আশপাশের দুএকটি ভিটা ছাড়া আর কারো বাড়ি যাইত না। তার নিজেরও লজ্জা করিত। তা ছাড়া ছিল আজহারের ভয়। এমনি শান্ত মানুষ, কিন্তু বেশরিয়তী দেখিলে আর রক্ষা ছিল না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাংসারিক প্রয়োজনে দরিয়াবিবিকে। অন্য পাড়ায় যাইতে হয়।
আমিরন চাচির বাড়ি পাড়ার এক টেরে। পথে এত ঝোঁপ-জঙ্গল। আর এই সড়ক প্রায় নির্জন থাকে। কারণ লোক-চলাচল কম। দরিয়াবিবির পর্যন্ত ভয় হয়। তাই সঙ্গে আমজাদকে লইত। নঈমা মা ছাড়া ঘরে থাকে না। সেও প্রায়ই সঙ্গে যায়। আমজাদের এই পথে হাঁটিতে খুব আরাম লাগে। সে এইজন্যে মাঝে মাঝে আমিরন চাচির বাড়ি চল বলিয়া দরিয়াবিবির কাছে বায়না ধরে।
চাচির বাড়ির আরো আকর্ষণ ছিল। আমিরন চাচি ঘরে ছেলেদের জন্য মোয়া, নাড় ১৭৬
কিছু-না কিছু সব সময় মজুদ রাখে। আর আম্বিয়া মেয়েটি বড় প্রাণবন্ত। সেখানে গেলে মেয়েদের গল্পের অবসরে বেশ কিছুক্ষণ খেলা করা যায়।
আমজাদ সেদিন জিদ ধরিয়া দরিয়াবিবিকে চাচির বাড়ি লইয়া গেল। হাতে বিশেষ কাজ নাই। দরিয়াবিবির কোনো আপত্তি ছিল না। সেখানে গেলে মন কিছু হালকা হয়।
আমিরন চাচি গরুকে এই মাত্র জাব দিয়া হাত ধুইতেছিল। হঠাৎ দরিয়াবিবি ও ছেলেদের দেখিয়া স্মিতহাস্যে সাদর অভ্যর্থনা জানাইল, এসো বুবু এসো। আরে, আজ আমজাদ চাচা, নঈমা খালা সুদ্ধ এসেছ। ও আম্বিয়া, বেরিয়ে আয়।
ডাক দেওয়ার আগেই মেয়ে হাজির।
আম্বিয়া আর একটু ডাগর হইয়াছে। চাঞ্চল্য আদৌ কমে নাই। সে আমজাদের দুই। হাত ধরিয়া বলিল, আমু ভাই, চল ঘুঘুর বাসা দেখে আসি। তালগাছের পাশে একটা করঞ্জা গাছের কোটরে বাসা বানিয়াছে।
চল।
আর কার তোয়াক্কা। আম্বিয়ার পিছু পিছু আমজাদও দৌড়াইতে লাগিল। পিছন হইতে আমিরন চাচি চিৎকার দিয়া ডাকিল, তোরা বেশি ঝোঁপের ভিতর যাসনি, বড় সাপের জুলুম বেড়েছে। কিন্তু তার কথা কে শোনে?
আমিরন চাচি পান সাজিয়া দিল। দরিয়াবিবির সাধারণত পান খাওয়ার অভ্যাস নাই। তবে চাচির দান প্রত্যাখ্যান করে না।
আমিরন চাচি জিজ্ঞাসা করিল, আজ কি রান্না হল?
রান্না সেরে এসেছি।
আমিরন চাচি যেন প্রশ্নের জবাব পাইয়াছে। তাই অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল।
আমার দেওরটা আসলে লোক খারাপ ছিল না।
আমিরন চাচির কথার মধ্যে দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আবার জুলুম ধরেছে নাকি?
অভ্যেস আর সহজে যায়! সেদিন খামাখা আমার ঝাড়ের দুখানা বাঁশ কেটে নিল। নিক, ওর ছেলের কবরে লাগবে। আমিরন চাচির গলা হইতে যেন এক ঝলক আগুন বাহির হইল।
দরিয়াবিবিও ঘৃণা প্রকাশ করিল, বেওয়া মানুষ, তাকে দুগাছি এনে দেওয়া দূরে থাক, তারই চুরি, এসব সইবে না।
ওদের সয়। পরের মেরে মেরে বড় হচ্ছে। এদিকে লেফাফা ঠিক আছে। আজকাল আবার মসজিদের মুয়াজ্জিনগিরি করে।
নঈমার চোখ দিয়া পানি পড়ে। সে দৌড়াদৌড়ি আর ভালোবাসে না। চাচি দুটি মোয়া দিয়াছিল। সে তা চিবাইতে ব্যস্ত। বোধহয় গলায় বাঁধিয়াছিল, তাই চাচির নিকট পানি চাহিল।
কথায় ছেদ পড়িল। দরিয়াবিবি তখন চাচির উঠানের চারিদিকে চাহিয়া থাকে। এখানে আসিলে সত্যি, বুকে জোর পাওয়া যায়। বিধবা মানুষ। অথচ সংসার বেশ চালাইয়া যাইতেছে। উঠানটি নিখুঁত পরিষ্কার থাকে। আশপাশে সজি আনাজের গাছ। গত বছর চাচি একটি লেবু গাছ লাগাইয়াছিল। তা-ও পত্র-সম্ভারে বাড়িয়া উঠিয়াছিল। সংসার বড় নয়, এইজন্যই আমিরন সামাল দিতে পারে। দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল।
আমিরন চাচি পানির গ্লাস নঈমার হাতে দিল।
ওর জন্য আবার গ্লাস দিয়েছ, এখনই ভাঙবে। দরিয়াবিবি সাবধান করিল।
আমিরন চাচি আপত্তি জানাইল, আমি ধরে আছি। ঘরে কিইবা আছে বুবু। এই গ্লাসটা, তোমার ভাই তখন বেচে হরিশপুরের মেলা থেকে এনেছিল।
আমার ঘরেও সব ভেঙেছে। পুরাতন কাঁচের দুচারটে জিনিস আছে, তুলে রেখেছি। কেউ মানুষ জন এলে বের করতে হয়। দরিয়াবিবি সায় দিল।
আমিরন চাচির সময় কম। বিকালে গরু বাছুরের খবরদারীতে বহু সময় যায়। শাজসজির গাছ আছে আশপাশে; পানি না দিলে চলে না। চাচি তাই দ্রুত কথা বলিতেছিল। আজ মোনাদির কি আজহারের প্রসঙ্গ আমিরন চাচি মুখ দিয়া বাহির করিল না, পাছে দরিয়াবিবি কষ্ট পায় বা হঠাৎ কেঁচো খুঁড়িতে সাপ বাহির হয়।
কিন্তু কথা প্রসঙ্গে এই সাপই ছোবল তুলিল।
আমিরন চাচি বলিতেছিল, বুবু, একা মানুষ হলে আমি কি ভয় পেতাম। তেমন ডরানেওয়ালী মায়ে পয়দা করেনি। কিন্তু ঐ যে-এক গলার কাঁটা রয়েছে।
দরিয়াবিবি কথাটা ঠাহর করিতে পারিল না সহজে। গলার কাঁটা। বিস্ময় প্রকাশ করিয়া সে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।
আমিরন চাচি হাসিয়া উঠিল। তুমি আমার গলার কাঁটা দেখনি? বলিয়া আবার হাসিতে লাগিল। দরিয়াবিবি খামাখা হাসে, আর সত্যিই চাচির কণ্ঠনালীর দিকে তাকায়।
আমিরন চাচি হাসে আর বলে, তুমি ডাক্তার হেকিম হলে আমার কাঁটা দেখতে পেতে।
আমাকে আগে বল নি, বুবু! দরিয়াবিবির বিস্ময়ের অবধি নাই। আমিরন চাচি আরো হাসিতে থাকে। আর বিশেষ বেলা নাই। তাই বলিল, দাঁড়াও বুবু, গলার কাঁটা দেখাচ্ছি। অ আম্বিয়া, অ আম্বিয়া। শেষের দিকে চাচি চিৎকার জুড়িল।
নিকটেই ছিল, আমজাদ ও আম্বিয়া আসিয়া উপস্থিত। ঐ আমার গলার কাঁটা, চাচি আম্বিয়ার দিকে আঙুল বাড়াইল।
কি মা? আম্বিয়া খেলা ছাড়িয়া আসিয়াছে। এখানে দাঁড়াইতে রাজি নয়।
যা, খেল গে।
ছেলেমেয়ে দুটি আবার দৌড়াইয়া পালাইল। তখন দরিয়াবিবি হাসিতে হাসিতে বলে, তুমি লোককে এমন বোকা বানাতে পারো।
গলার কাঁটা নয়? একা হলে ঝাড়া হাত পা যা খুশি করতাম। যেমন ইচ্ছে থাকতাম। বুবু, এখন কত কথা ভাবতে হয়। মাঝে মাঝে রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবনায় নিদ ধরে না। চাচির মুখের উপর দিয়া ছায়া খেলিয়া গেল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া দরিয়াবিবি বলিল, বুবু, আমার কতগুলো দ্যাখো। সব তো বেঁচে নেই। এইগুলো তো আমার পায়ের বেড়ি। কবছরে কি যেন হয়ে গেলাম।
তবু ওদের ছাড়া ঘর মানায় না। হাসুবৌটার দশা দ্যাখো। সোয়ামির চোখের বালি, শাউড়ীর কাঁটা। একটা ছেলেপুলে নেই।
ও বেশ আছে। যার নেই, তার এক ধান্দা। যার আছে তার শতেক ধান্দা।
হক কথা বুবু।
আমার মুনিটা এখানে থাকলে, আমি কোনো কিছুতেই ভয় পেতাম না।
আমিরন চাচি এই প্রসঙ্গ এড়াইতে চায়। কিন্তু দরিয়াবিবি রেহাই দিল না।
মুনি থাকলে, আমি আম্বিয়াকে ঘরে নিয়ে যেতাম। কি তোমার কাছেই থাকত। তোমার আর কেউ নেই–একটা ছেলে সংসারে বাড়ত।
আমিরন চাচি যেন চাঁদের স্বপ্নে বিভোর। বলিল, বুবু, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ক। আহ্ আমার কি সে কপাল হবে। তুমি রাজি হলেও, খাঁ ভাই? তোমার উঁচু খাঁ বংশ।
তালপুকুর ঘটি ডোবে না। বেশ ব্যঙ্গসুরে দরিয়াবিবি বলিল, আমার ছেলের বিয়ে দিলে কে কী বলবে? সে তো আর মোনাদিরের বাপ নয়।
আমিরন চাচি বড় খুশি হয়। কিন্তু মিথ্যা কল্পনা, তা উপলব্ধি করেও।
কিন্তু ছেলেটা চলে গেল–
দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ হইয়া পড়িল। আমিরন চাচি তাড়াতাড়ি ছেলেদের ডাকিয়া নাড় খাওয়াইল। সেই হট্টগোলে সহজ আবহাওয়া ফিরিয়া আসে। সন্ধ্যা হইতে আর দেরি নাই। দরিয়াবিবি কাজের মর্যাদা জানে। চাচিকে সে ছুটি দিল।
পৃথিবী কত বড়। পাল্কি-জানালার ফাঁক দিয়া কতটুকু আর দেখা যায়। ঝোপে ঝোপে এই সড়ক পথে হাঁটিবার সময় আমজাদের মতো দরিয়াবিবিও অদ্ভুত আস্বাদ পায়।
গা-ঢাকা সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। জঙ্গলে জঙ্গলে তখন জোনাকিরা প্রদীপ কাড়াকাড়ি শুরু করিয়াছিল।
.
৩২.
চন্দ্র একরাশ তাড়ি গিলিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। ভিটার কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল, তার ঘাড়ে একটি আধপোড়া চেলা কাঠ। শ্মশান হইতে চন্দ্র তুলিয়া লইয়াছিল, তা আর বুঝিতে দেরি হয় না।
দুপুর বেলা মাঠে কেউ থাকে না। এতক্ষণ আপনমনে চন্দ্র গান করিতেছিল। কিন্তু বাড়ির কাছে হঠাৎ গান বন্ধ হইয়া গেল। গায়ক পর মুহূর্তে যোদ্ধা সাজিয়াছে। কোটাল পোড়া চেলা কাঠখানি বাই-বাই শব্দে ঘুরাইতেছে আর মুখে হট-যাও, হট যাও রব।
চন্দ্রমণি, তার ছেলেরা আর কোটালের স্ত্রী হঠাৎ হিন্দি চিৎকার শুনিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। প্রথমে বিস্ময়, তারপর সকলে তামাশা দেখিতে লাগিল। চন্দ্রমণির দুই ছেলে মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিয়া খুন। কোটালের স্ত্রী কিন্তু খুব চটিয়াছিল। তাড়ি তো চন্দ্র কোটালের কাছে জল। আপত্তি সেখানে নয়। এই অবেলায় মড়াকাঠ কাঁধের উপর! এমন অলুক্ষণে কাণ্ড কোটাল-স্ত্রীর সহ্যের বাহিরে।
সেও চিৎকার করিয়া বলিল, তুমি এসো ঘরে, তোমার হট-যাও আমি বের করব। চন্দ্রমণির চোখ ভ্রাতৃজায়ার দিকে। ছি ছি, দাদার যত বয়স বাড়ছে, তত ঢিটেমি বাড়ছে।
তুমি ঐ কাঠ নিয়ে ভিটের উপর একবার ওঠো দেখি। কোটাল-গিন্নী শাসাইতে লাগিল।
চন্দ্র হঠাৎ চেলাকাঠ ঘুরানো থামাইল, তারপর চিৎকার করিয়া শুধাইল, কিয়া হুয়া।
কিয়া হুয়া? তোমার হুক্কাহুয়া বের করব, একবার ওঠো দেখি। কোটাল আবার যোদ্ধার হুঙ্কারে চেলাকাঠ ঘুরাইতে লাগিল। কিন্তু ভিটার নিকটে কয়েকটা চারা করঞ্জা গাছের কাছে আসিয়া থামিল। যোগীন তখন মামার উদ্দেশে ডাক দিল, মামা, উপুরে এসো না, মামী মারবে।
চুপ বেটা। আমি জমিদার হ্যাঁয়, হ্যামকো কোন রোকেগা। কাঁধে গদা লইয়া ভীমের মতো চন্দ্র সটান খাড়া হইল। বাবরী চুল বাতাসে এলোমেলো। চক্ষু দুটো নেশার ছলকে গোল ভাটার মতো। যোগীর ছোট ভাই তো রীতিমতো ভয় পাইয়া মার আঁচলে আশ্রয় লইল।
ভিটার উপরে কোটাল-পত্নী কোমরে কাপড় জড়াইয়া হুংকার ছাড়িল, মড়াকাঠ ফেলে ভালো মানুষের মতো আবার নদীতে স্নান করে এসো। না হলে স্ত্রীর বদ্ধমুষ্টি, চন্দ্র ভালোরূপে ঠাহর করিল।
হট-যাও, হাম জমিদার হ্যাঁয়। তারপর কোটাল সমস্ত মাঠের দিকে আঙুল অর্ধবৃত্তাকারে বাড়াইয়া বলিল, হট যাও, সমস্ত জমি আমার হ্যাঁয়। ইয়ার্কি পায়া হায়– রোকদেগা।
একবার ভিটের উপর উঠে দ্যাখো। কোটাল পত্নী ভ্যাংচাইয়া বলিল।
কোটাল জবাব না দিয়া চেলাকাঠখানির সাহায্যে ধাই ধাই চারা গাছগুলি পিটাইতে লাগিল আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার–এইসব আমার প্রজা আছে-বাত নেই শোন্তা? কিছুক্ষণ এই তরুপ্রজা ঠ্যাঙ্গানো চলিল। ভিটার উপরে সকলে তখন বেদম হাসিতে শুরু করিয়াছে।কোটালের বীরোচিত শৌর্যের উৎসাহ আরো বাড়িয়া যায়।
গিন্নী চিৎকার দিল, এই পাগল পাগল।
পাগল! যোদ্ধা মুগুর উঁচাইয়া থামিল। প্রথমে ব্যঙ্গের হাসি, পরে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছাড়িল, পাগল! জমিদার শালা পাগল?
পাগল, পাগল।
ছেলেরা চিৎকার দিয়া হাসিল, পাগল, পাগল!
সব মার ডালেগা–বলিয়া মুগুর-বিশারদ আবার কল্পিত প্রজাদের শায়েস্তা করিতে লাগিল। নেশা বেজায় চড়িয়াছিল।
প্রতিপক্ষ তখন হাসিয়া লুটাইবার উপক্রম। সুযোগ বুঝিয়া চন্দ্র ভিটার দিকে এক পা অগ্রসর হইল। তখন গিন্নী একটা চেলাকাঠ লইয়া দাঁড়াইল।
চন্দ্র চিৎকার দিয়া বলিল, পাগল না হলে মানুষ ঠ্যাঙায়? সব মার ডালো।
আবার মুগুরবাজি চলিল।
খিলখিল নারী হাস্যে তখন অবেলার রঙ আরো ঘন হয়।
কতক্ষণ এমন চলিত কে জানে? এই সময় আমজাদ ভিটার পথে উপস্থিত হইল। দরিয়াবিবির জরুরি আদেশেই সে এই দিকে আসিয়াছিল। ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। কাকার নূতন কীর্তি। কিন্তু সে রণদেহি মূর্তি দেখিয়া বেশ ভয় পাইয়াছিল। মার আদেশ হাতে করিয়াই ফিরিয়া যাইবে কিনা ভাবিতেছিল। হঠাৎ যোদ্ধার নজর সেদিকে গেল।
প্রজারা নিস্তার পাইল। মুগুর উঁচাইয়া মহাবীর আমজাদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমজাদের ভয়ে মুখ শুকাইয়া যায়। সে সাহসের উপর ভর দিয়া বলিয়া ফেলিল, কাকা আপনাকে মা ডাকছে। খুব দরকার।
যোদ্ধার কানে যেন কথাটা গেল না। গজেন্দ্র-গমন ও স্কন্ধ-শোভিত গদা অবিচল থাকে।
কিন্তু চন্দ্র ভয়ের ফুরসৎ দিল না। হঠাৎ গদা ফেলিয়া সে আমজাদকে কাঁধে তুলিয়া লইল। ছেলেবেলা বেশ মজা লাগিত! এখন আমজাদ কিশোর, তার বড় লজ্জা করে। কাকা, আমাকে নামিয়ে দাও। সে মিনতি জানাইল। কিন্তু নেশাখোর নিজের খেয়ালে বিভোর। কবিগানের সর্দার তখন গান ও নৃত্য জুড়িয়া দিয়াছে।
চাচা এল অবেলায়।
এখন কোথায়
কি পাই?
খেতে দেওয়া দায়।
হাঁস রয়েছে পুকুর পাড়ে
মুরগি আর ডিম না পাড়ে
ঝোপে-ঝাড়ে বন-বাদাড়ে
শেয়ালছানাও নাই।
চন্দ্র হঠাৎ মাথা ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া উঠিল, তওবা, মুসলমানের ছেলে। তারপর ওয়াকশব্দে থুথু ফেলিল। গানের নূতন কলি শুরু হয়।
ভাইপো তুমি কর না ভাবনা
আমি ওসব কিছুই খাব না।
ঘরে আছে মুটকী চাচী
তারে কর না জবাই ॥
আহা চাচা, আক্কেল বটে
বলিহারি, বলিহারি যাই
॥
চন্দ্র খাঁ-পাড়ার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ভিটার উপর হাসির মওজ ছুটিল। পড়ন্ত বেলা। দিকে দিকে রঙ লাগিয়াছে। ঝাঁকুনি খাওয়া গান মাঠে মাঠে রেশ রাখিয়া যায়।
ঘরে আছে মুটুকী চাচী
তারে কর না জবাই।
সলজ্জ, তবু আমজাদ কাঁধের উপর হাসিতে লাগিল।
.
৩৩.
বছর ঘুরিয়া গেল।
সূর্য-প্রদক্ষিণ শুধু স্থাবর-জঙ্গমের সহগামী নয়। সংসারের বিচিত্র প্রক্ষেপও সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়। সচ্ছলতা-অনটন, হাসি-কান্না বিচিত্র ছন্দ তার দাগ রাখিয়া যায়।
এই আবর্ত দরিয়াবিবিকে টানিয়া লইয়া গেল ক্রমশ দিশাহারা পথে। এক ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হইয়াছিল স্বামী আর নিরুদ্দিষ্ট প্রবাসী নয়। আজহার ফিরিয়া আসিয়াছিল মাত্র তিন সপ্তাহের মেয়াদ লইয়া। এক বছরে কত কি-না করিয়াছে। রাজমিস্ত্রী তার আদিম পেশা, ইটের পাঁজার সর্দারী, মসজিদের সহকারী আর মনোহারীর দোকান–তার আর এক মরীচিকা-মাখা শখ। নূতন মোড় ফেরার স্বপ্নে সে ফিরিয়া আসিয়াছিল। বাড়ি ফেরার আগে সে একটি দোকান পাতিয়াছিল। তার নিরীহ শান্ত মনেও তখন অস্থিরতার ছোঁয়াচ। নিজের দিকে সে নিজে চাহিতে শিখিয়াছিল। নামাজে মন থাকে না। জায়নামাজের পাটির উপর কখনো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে সেজদা দিতে গিয়া। কেন এমন হয়? কোটাল চন্দ্র তো বিধর্মী। তার চেয়েও দুঃখী। কিন্তু সে আনন্দের অধিকারী। জীবনের ঝাপ্টা তার পাখনাকে পঙ্গু করিতে পারে নাই। অথচ-সে! বুকের ভিতর বাঁচা ও সংসার গোছানোর হাজার তৃষ্ণা লইয়া কলে-পড়া মূষিকের মতো পরিত্রাণের আশায় দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করিতেছে। সকলের রুজি-দেনেওয়ালা আল্লার উপর তার বিশ্বাস কতটুকু? আজহার ক্লান্ত অবসর সময়ে নিজের কাছে এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজিত। শেষদিনে হঠাৎ দাম লইয়া এক খরিদ্দারের সঙ্গে ঝগড়াই করিয়া বসিল। পরদিন দোকান বিক্রয় হইয়া গেল। আবার গ্রামেই সে ফিরিয়া যাইবে। চন্দ্রের কাছে জিজ্ঞাসা করিবে, বাঁচার আনন্দ সে কোথা হইতে পায়? রহিম বখশ, হাতেম খাদের চন্দ্র ঘৃণা করে। এই ঘৃণার মধ্যে কী আনন্দ আছে? ঘৃণা তো হিংসা। এমন পাঁকের মধ্যে পদ্মফুল ফোটে? আর যা-ই করুক, চন্দ্রের সঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ সে মিলাইয়া দিবে। সে তাড়ি খাক, নাচুক বা গান করুক, তা দেখার আবশ্যক নাই আজহারের। আজহার বুকে নূতন জোর পাইয়াছিল। মাঠের মাটির সঙ্গে সে কেন প্রবঞ্চনা করিবে না আর। জীবনের বোঝাঁপড়া হোক আবার। চন্দ্রের সঙ্গ আজহারকে উতোল করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু গ্রামে সে তো একা আসিল না। জেলা-জেলার ঘোরার ফলে বাঁকুড়ার দুরন্ত ম্যালেরিয়া আগেই দেহে বাসা বাঁধিয়াছিল। মাঝে মাঝে ভুগিতে হইত। পথেই নূতন প্রতিক্রিয়া শুরু। শেষ অঙ্ক মহেশডাঙায় অভিনীত হইল মাত্র।
নিরীহ ঈমানদার মানুষ– এইজন্য সমশ্রেণীর বন্ধুদের নিকট হইতে এই কয়েকদিন আজহার সহানুভূতি কম পায় নাই। চন্দ্র কোটাল প্রায়ই বসিয়া থাকিত বণ্টার পর ঘণ্টা। বাক্যালাপ হইত নামমাত্র। তবু তার উপস্থিতির কামাই ছিল না। রোগ ক্রমশ বাড়িতে থাকিলে এক মন্দিরের ঠাকুরের কাছ হইতে চন্দ্র গাছের শিকড় আনিয়া আজহারের হাতে বাঁধিয়া দিল। অন্য সময় কত আপত্তি করিত, হয়ত দুইজনের মধ্যে চটাচটি হইয়া যাইত। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী আজহার আর এক মানুষ। চন্দ্রের নিকট নিজেকে সঁপিয়া দিতেই তো সে গ্রামে আসিয়াছিল। এই বাড়িতে আসিলে চন্দ্রের ছোঁয়াচ হাসি কাহাকে না স্পর্শ করিত। কিন্তু চন্দ্রও আজকাল ভয়ানক গম্ভীর। একদিন দম-ভর তাড়ি খাইয়া আসিয়াও সে চুপচাপ বসিয়াছিল। কারো প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় নাই। তারপর আপন মনেই বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছিল। এই সংসারের ভবিষ্যৎ যেন এখনই তার সম্মুখে জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতো খাড়া। সহানুভূতি, এমনকি ইয়াকুবের কাছেও, সীমাতীত ভাবে পাওয়া গেল। সে পাঁচ মাইল দূর হইতে পাল্কি করিয়া পাস করা ডাক্তার আনিল। তখন শেষ অবস্থা। ডাক্তার কোনো আশা দিতে পারিল না।
দরিয়াবিবির একদা-তেজ যেন উবিয়া গিয়াছিল। অবশ্য গৃহস্থালীর কাজ ও সেবার কোনো ত্রুটি ছিল না। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রোগীর বিছানার পাশে আসিয়া বসিয়া থাকিত। কিন্তু আজহার নির্বিকার। নিজের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার কোনো সচেতনতা ছিল না। দরিয়াবিবির দিকে একবার চোখ তুলিয়া চাহিয়াও দেখিত না সে। পাষাণের মতো নিঃসাড় খোলা দুই চোখ আর দেখার কাজে লাগে না যেন এখন তা চিরন্তন হাতিয়ার। দরিয়াবিবি কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করিলে হাঁ-না-রবে তার পরিসমাপ্তি হইত মাত্র। এই নীরবতা দরিয়াবিবিকে ভয়ানক চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। স্বামীর কাছে নঈমা বা আমজাদকে ঘন ঘন পাঠাইত। কথা হইত শুধু নঈমার সঙ্গে। সে-ই যেন শুধু তার সব কথা বুঝিতে পারে। দরিয়াবিবি পিতা ও কন্যার কথোপকথনকালে উপস্থিত হইত। আজহার তখন নীরব। দরিয়াবিবি পাশে বসিয়া উঠিয়া আসিত ও অলক্ষ্যে চোখের পানি মুছিত। কত দায়িত্ব পিছনে পড়িয়া থাকিল, এই চিন্তা কি একবারও তোমার মনে জাগে না? দরিয়াবিবি ভাবিত, সে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবে। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিত না।
আজহারের গলায় কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হইতেছিল। আজকাল সারারাত্রি পিদিম জ্বলে। দরিয়াবিবি উঠিয়া তখন জিজ্ঞাসা করিল, কষ্ট হচ্ছে?
না। তারপর আজহার দরিয়াবিবির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমুর মা, আমি। কথা থামিয়া গেল।
দরিয়াবিবি তখন জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে কিছু বলবে?
মাথা নাড়িয়া আজহার সম্মতি জানাইল ও পলকহীন চোখে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইল।
অধীর দরিয়াবিবি সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে শুধাইল, কিছু বলবে?
আজহার কোনো কথা বলিল না। শীর্ণ হাতখানি দরিয়াবিবির হাতের দিকে বাড়ানোর পথে আবার মুষ্ঠিবদ্ধ করিয়া লইল। চোখ তেমনই পলকহীন। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো প্রতিধ্বনি ছিল না এই নীরবতার মুখোমুখি। এখনি এই ঠোঁট হইতে কথা ঝরিবে। দরিয়াবিবি আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল। কিন্তু আর কোনো কথা বলা হইল না। জীবন-যোদ্ধা পৃথিবীর কাছ হইতে ইত্যবসরে ছাড়পত্র পাইয়াছিল। শুধু চোখ দুটি তখনো সজীব। দরিয়াবিবি তাহা বুঝিতে পারে নাই। মৃত স্বামীর চোখের দিকে দৃষ্টি পাতিয়া সে চাহিয়া রহিল, চাহিয়া রহিল।
.
৩৪.
আমিরন চাচি যুক্তি দিয়াছিল, আরো হাঁস-মুরগি, বকরী-খাসি পোষো। বুবু। কোনো রকমে দিন চলবেই। তোমার ভাই মারা যেতে আমিও চোখে আন্ধার দেখেছিলাম। এখন বুক বাঁধতে হবে, ভাবনা করলে তো দিন যাবে না।
দরিয়াবিবি কথায় সায় দিয়াছিল। কিন্তু তার পক্ষে বাধা অনেক। সে পর্দানশীনা। কাছে মাঠ নাই। আমজাদ লেখাপড়া আগেই ছাড়িয়া দিয়াছিল। গরু-বাছুর মাঠে লইয়া যাইতে নিমরাজি। ইলেমের এমনই প্রভাব। আজহারকে সে খুব ভয় করিত, তাই মুখের উপর কোনো জবাব দেওয়ার সাহস পাইত না। এখন সে বেপরোয়া। চাষাবাদ তার ভালো লাগে না। চন্দ্র কাকার সঙ্গে প্রথম বছর চাষাবাদে গায়ে-গতরে খাঁটিয়াছিল। কিন্তু ধান বেশি হইল না। মাটির জন্য দরদ ছিল না। নিড়েন ঠিকমতো দেওয়া হয় নাই। পর বৎসর চন্দ্র কোটাল তাই তিন বিঘা জমি বিক্রয় করিয়া দিতে বলিল। গ্রহীতা ইয়াকুব। দেড় বিঘা জমি ছিল, আমজাদের জন্য তাহাও বিক্রয় হইয়া গেল। চন্দ্র কাকার সংস্পর্শে তার ভালো লাগে না। এত মেহনত আমজাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দরিয়াবিবি রাগ করিলেও পুত্রের উপর ক্ষোভ ছিল না। তের বছর বয়সের পক্ষে চাষাবাদ যেন ঠাট্টার ব্যাপার।
আমিরন চাচির সংসার ছোট। কিন্তু দরিয়াবিবির সংসারে এতগুলি পেট চালানো সহজ নয়। প্রথম দিকে সহানুভূতি কারো কম ছিল না। কিন্তু তারও সীমা আছে। বেচারা চন্দ্র নিজেই অস্থির। সে চাষ করে, মাছ ধরে, গান করে। কিন্তু সব সময় রোজগার হয় না। তবু তার আন্তরিকতা অকৃত্রিম। নিজে না আসিলেও বোনকে পাঠাইয়া খোঁজ-খবর লয়। এলোকেশী খালি হাতে আসে না। কোনোদিন মাছ, মাঠের ফসল, অন্তত একফালি কুমড়া হাতে সে লৌকিকতা রক্ষা করে।
চারিদিকে ভাঙন। নঈমার চোখে আজকাল খুব পিচুটি জমে। চোখে ভালো দেখে হয়ত অন্ধ হইয়া যাইবে।
ইয়াকুব মাঝে মাঝে চিরাচরিত আড়ম্বরে আসে। মাঝে মাঝে টাকাও সাহায্য করে। দরিয়াবিবি কর্জ চাহিতে লজ্জা পায় না। কিন্তু এইভাবে দিন কতদূর গড়াইতে পারে। আগে ঘরে দুধ ছিল। এখন গাইটা অল্প দুধ দেয়, তা-ও বিক্রয় করিতে হয়। শমী-র মুখে দুধ ওঠে না। তিন বছরের মেয়ে ভাত ধরিয়াছে বড়দের মতো। তার মাঝে মাঝে পেটের অসুখ করে, সহজে সারে না। শুধু শরীরের কাঠামোর জোরে টিকিয়া আছে।
দুঃখের পেয়ালা পূর্ণ করিবার জন্য এমনই দুর্দিনে মোনাদিরের পত্র আসিল। সে লিখিয়াছে :
মা, আমার সালাম জানিবেন। বহুদিন বহু জায়গায় ঘুরিয়া
আমি এখন স্কুলে পড়িতেছি। পাঁচটা টাকা যদি মাস-মাস আমার জন্য পাঠান, কোনো রকমে আমার দিন চলিতে পারে।
আপনাদের অসুবিধা হইলে
পাঠাইবেন না। আমার
দিন এক রকমে চলিয়া যাইবে। আমু, নঈমাদের জন্য
আমার স্নেহ।
ইতি
আপনার স্নেহের
মুনি
একটি ইনভেলাপে পত্ৰ আসিয়াছিল। আমজাদ পড়িয়া শোনাইল। দরিয়াবিবি যুগপত আনন্দ ও নিরাশায় খামখানি হাতের মুঠায় ধরিয়া ভাবিতে লাগিল। তিন-চার বৎসর। অতিবাহিত। কত বড় হইয়াছে মুনি! একটি দীর্ঘশ্বাসে দরিয়াবিবি এই চিন্তা সমাহিত করিল। পাঁচটি টাকা সাত রাজার ধন নয়। তবু সে-কথাই আগে ভাবিতে হয়।
আমজাদ পাশে বসিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, মা, মুনি ভাইকে টাকা পাঠাবে না?
পাঠাব। পাঠাতে পারবি?
তা আর পারব না! তুমি টাকা দিও, মনি অর্ডার করে আসব। পোস্টাপিস আছে পাশের গায়ে।
দরিয়াবিবির ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি দেখা দিল। আমজাদ এখনো কত অবোধ।
কিছুক্ষণ আগে আমজাদ সংবাদ আনিয়াছিল, এবার জমির ধান ইয়াকুব নৌকায় বোঝাই দিয়া লইয়া গিয়াছে। এতদিন জমি বিক্রয় হইয়াছিল। কিন্তু ধান, বর্গা পরিশোধের পর অর্ধেক পাওয়া যাইত। ইয়াকুবের করুণা! এবার তাও বন্ধ। জমি কিনিয়াছে, ফসল লইয়া যাইবে– বৈচিত্র্য কিছু নাই। তবু দরিয়াবিবি ক্ষোভে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। পুত্রের কাছে সংবাদ পাইয়া আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন সে মনে করে নাই।
মুনির পত্র হাতে ইয়াকুবের কথাই প্রথমে স্মরণ হইল ও হঠাৎ অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, পাঁচটা টাকা। আমজাদ তাহা শুনিতে পাইল না।
দুদিন পর ইয়াকুব এখানে পৌঁছিলে, দরিয়াবিবি তার শরণাপন্ন হইল।
ভাই, আমার একটা আরজ আজ তোমাকে রাখতে হবে।
আপনার আরজ। বলুন-বলুন। ইয়াকুব ভয়ানক আগ্রহ দেখাইয়া বলিল, আপনি এত চুপচাপ থাকেন।
ভাই, চুপচাপ কি সাধে থাকি। দেখছ না, কত সুখে আছি।
আপনার দুঃখ কি। আপনার মুখের হাসির দাম লাখ টাকা।
অন্য সময় এমন গায়ে-পড়া প্রশংসা দরিয়াবিবি বেয়াদবীর শামিল মনে করিত। আজ তা গায়ে মাখিয়া লইল। ইয়াকুব কিন্তু কথাটা বলিয়াই দরিয়াবিবির দিকে আড়চোখে তাকাইল।
লাখ টাকা নয়, পাঁচ টাকার আরজ।
মোটে। ইয়াকুব ঠোঁট কুঁচকাইল।
হ্যাঁ।
মোটে?
হ্যাঁ, কিন্তু মাস-মাস দিতে হবে।
কাউকে দেবেন?
হ্যাঁ।
কাকে?
তা কোনোদিন জানতে চেয়ো না।
আপনার যা হুকুম। ইয়াকুব হাসিয়া ঘাড় নোয়াইল ও কহিল, আপনি বলেন, আর কি দরকার। আপনি একদম পাথরের মতো কি-না, মুখে কিছু বলেন না। আজ ধান নিয়ে গেলাম। কই, কিছু তো বললেন না?
তোমার জমির ধান তুমি নিয়ে গেছ। কি আবার বলতে হবে? দরিয়াবিবির কণ্ঠে মোলায়েম ব্যঙ্গের সুর।
কেন বলবেন না? আপনারা আমার আপনজন। জমি কিনেছি বলে ধানও নিয়ে যাব?
নিশ্চয় নিয়ে যাবে।
আপনজনেরা এমন নিষ্ঠুর হয় না।
নিষ্ঠুর আবার কি?
নিশ্চয়। জিজ্ঞেস করতে তো পারতেন, কেন ধান নিয়ে গেলাম। থাক সে কথা। এখন আমাকে বলতে হয়। ঘরে আমার দুটি গোস্তের ঢিবি আছে। ইয়াকুব একগাল হাসি মুখ হইতে খালাস করিয়া বলিল, তাদের চোখ টাটায়। জমি কিনেছি অথচ ঘরে ধান যায় না। এবার তাই নিয়ে গেলাম। এই নিন ধানের টাকা।
ইয়াকুব পকেট হইতে পঁচিশ টাকা বাহির করিল।
এখন বাজার-দর আড়াই টাকা! দশ মণ ধান হয়েছিল। দরিয়াবিবি ইয়াকুবের দিকে তাকাইল। কৃতজ্ঞতার এমন দৃষ্টি কেহ কোনোদিন দরিয়াবিবির চোখে দেখে নাই।
ইয়াকুব মানিব্যাগ হইতে আবার পাঁচ টাকার একটি নোট বাহির করিল।
এই নিন। আমি মাসে মাসে এই টাকাটাও দেব।
দরিয়াবিবি হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল।
ভাবী, আমাকে আপনজন মনে করবেন।
দরিয়াবিবি তার কোনো জবাব দিল না। ইয়াকুবের দিকে সোজাসুজি তাকাইল মাত্র। সে ভয়ে চোখ নামাইয়া লইল।
ইয়াকুবের হালচাল রাত্রে শুইয়া দরিয়াবিবি তোলপাড় করিতে লাগিল। বালিশের নিচে নোটখানি এখনো চাপা। অন্ধকারে হাতড়াইয়া দরিয়াবিবি নোটখানি নিজের চোখের উপর চাপিয়া ধরিল। ভয়ানক কান্না পাইয়াছিল তার।
চোখের পানি শুষিয়া লইতে এমন কাগজেরই যেন দরিয়াবিবির প্রয়োজন বেশি।
.
৩৫.
পোস্টাপিস হইতে আমজাদ একটি খাম কিনিয়া আনিয়াছিল।
দরিয়াবিবি বলিল, একটা চিঠি লিখে দে, আমু। তোর মুনি ভাই যেন তাড়াতাড়ি আসে। আমজাদ পত্র লিখিতে বসিল। এমন সময় হাসুবৌ হাজির হইল।
দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে, হাসুবৌ, আর যে এদিকে এলে না? দশ-বারো দিন হল।
সন্তর্পিত হাসুবৌ চারদিকে চাহিয়া লইল, যেন তার আওয়াজ বেশিদূর না পৌঁছায়; অথবা কেউ আছে কি-না। পরে ফিসফিস শব্দে বলিল, শাউড়ীর মেজাজ জানো না, বুবু? এদিকে এলেই চটে। আর ছেলে হয়নি। আর খোটা ধরে শুরু করবে হাজার কাল্লাম।
কখন আসি, বুবু।
সাকের ভাই কোথায়?
তার ভাবনাতেও অস্থির ছিলাম। আবার কোন জমিদারের জমি দখলে গিয়েছিল।
মানা করতে পারো না?
মানা শোনে কৈ? এবার পায়ে চোট লেগেছে। চুন-হলুদ করে দিলাম কাল। আজ ভালো আছে। সাত আট দিন গিয়েছিল। এই জন্যেও ভেবে ভেবে অস্থির। ছাই, মন ভালো না থাকলে কি কোথাও বেরুতে ইচ্ছে করে?
হাসুবৌ দরিয়াবিবির দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাইল।
সহানুভূতি জানাইল দরিয়াবিবি, তা ঠিক। মন ভালো না থাকলে খাট-পালঙ্কে শুয়েও সুখ নেই। অতঃপর আমজাদের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, আমু, আর অন্য কোনো কথা লিখিস নে। শুধু আমার কথা লেখ। আর আমরা ভালো আছি।
আমজাদ পেন্সিল চালাইতে চালাইতে জবাব দিল, আচ্ছা মা।
হাসুবৌ জিজ্ঞাসা করিল, কাকে চিঠি দিচ্ছ বুবু?
আমার মুনিকে।
মুনির খবর পেয়েছ?
হ্যাঁ।
সোবহান আল্লা। আমু চাচা, আমার দোয়া লিখে দিও। হাসুবৌ বড় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। পরে বলিল, কি সুন্দর ছেলে। অমন না হলে মায়ের কোল জুড়ায়!
আমার বুক জ্বলতেই রইল, হাসুবৌ। দরিয়াবিবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল।
বুবু, তোমার ধন তোমার বুকেই ফিরে আসবে। দেখ, আমার কথা নিশ্চয় সত্যি হবে। আমার মন বলছে।
সোনা-কপালী, তোমার মুখে কাটা যাই। তা যদি হয়, আমি এই অকূলেও কূল পাই।
ঠিক তোমার হক্কের ধন ফিরে আসবে।
পনেরো বছর বয়স। এখন কত বড় হয়েছে। আজ কবছর চোখের দেখা দেখতে পাইনি।
দরিয়াবিবির কাতরদৃষ্টি হাসুবৌকে স্পর্শ করিল। দুইজনে একে অপরের দিকে তাকায়।
আমজাদের লেখা শেষ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
তবে আবার কি লিখবি?
লিখে দেব– আব্বা ইন্তেকাল করেছে।
ধমক দিয়া উঠিল দরিয়াবিবি, না, ওসব লিখতে হবে না।
আচ্ছা।
শান্ত আমজাদ যেন ঠাণ্ডা হইয়া গেছে, এমন উচ্চারণের ভঙ্গি।
হাসুবৌ উঠিয়া বলিল, এখন যাই বুবু। আমু চাচা, আমাকে একটু এগিয়ে দাও।
আমজাদ খুব রাজি। সে হাসুবৌর অনুসরণ করিল।
ভিটার নিচে সড়কের উপর দুই জনে দাঁড়াইল। গোধূলির ছায়ায় চারদিক বিষণ্ণ। হাসুবৌর গা এমন ঝোপে-ঝাড়ে সত্যি ছমছম করে। মহেশডাঙা জঙ্গল বলিলেই চলে। নিচের পথের সাদা-সাদা রেখা আবছা। দুপাশে ঝি ঝি ডাকা অনেকক্ষণ শুরু হইয়াছে। আমজাদের পিছনে হাসুবৌ।
কিয়দূর অগ্রসর হইলে বৌ আমজাদের হাত ধরিয়া বলিল, চাচা, আমার দোয়া লিখে দিয়েছো?
দিয়েছি, হাসু চাচি।
সত্য? কিরা দিচ্ছি আমার গা-ছুঁয়ে বল।
আমজাদ হাসুবৌর কাঁধ ছুঁইয়া বলিল, দিয়েছি, দিয়েছি, দিয়েছি, তিন সত্যি।
হাসুবৌ খুব খুশি হইয়া বলিল, কাল এসো চাচা, তোমার জন্য ক্ষীর বানিয়ে রাখব।
আচ্ছা, আসব।
আর মুনির চিঠি এলে খবর দিও, দেরি করো না চাচা।
হাসুবৌর অনুরোধ ভঙ্গি বড় অদ্ভুত দেখায়।
এবার তুমি যাও। এখন আমি বাড়ি যেতে পারব। পথে সাপ দেখে যাস, বাপ।
আমজাদের নিজেরই ভয় লাগিতেছে এবার। জবাব দেওয়ার জন্য সে আর বিলম্ব করিল না। তার সবচেয়ে বেশি ভয় সাপের।