৩১. ড্রাগ এডিক্ট টিটমেন্ট সেন্টার

হোসেন সাহেব সাজ্জাদকে ড্রাগ এডিক্ট টিটমেন্ট সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা ছিল সাজ্জাদ প্রবল আপত্তি করবে। তা সে করেনি। বাবার একটা কথাতেই রাজি হয়েছে। নিজেই আগ্রহ করে সুটকেসে কাপড় চোপড় নিয়েছে, বইপত্র নিয়েছে। ঘরে ছোট পোর্টেবল ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল না। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে বায়তুল মোকাররাম থেকে কিনিয়ে আনিয়েছে।

হোসেন সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে ছেলে চিকিৎসা কেন্দ্ৰে পাঠানোর দুঃখে এবং লজ্জায় তিনি মরে যাচ্ছেন। সাজ্জাদের চোখে চোখ রেখে কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। তিনি কথা বলছেন অন্য দিকে তাকিয়ে।

বাবা সাজ্জাদ!

জ্বি।

ড্রাগের সমস্যাটা তো বাবা মানসিক। তার জন্য তুমি লজ্জিত হয়ো না, বা দুঃখিত হয়ো না। দোষটা পুরোপুরিই আমার।

সাজ্জাদ বলল, তোমার হবে কেন?

আমি তোমাকে প্রপার গাইডেন্স দিতে পারিনি। তোমার মা পাশে ছিল না, একা একা তোমাদের মানুষ করতে গিয়ে ভুল করেছি।

তুমি কোন ভুল করনি বাবা। ভুল পুরোটাই আমার। একুশে পদকের মত শ্ৰেষ্ঠ পিতা পদক বলে কোন জাতীয় পদক থাকলে অবশ্যই তুমি সেই পদক পেতে।

হোসেন সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। মনে হচ্ছে তিনি কেঁদে ফেলবেন। অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সামলালেন। সাজ্জাদ বলল, বাবা শোন, আমার জন্যে তুমি কষ্ট পোচ্ছ এই দুঃখ আমার রাখার জায়গা নেই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি সুস্থ হয়ে ফিরব। এবং তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে আমি ড্রাগ স্পর্শ করব না। তবে তোমার মৃত্যুর পর কি হবে আমি জানি না।

তুই চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হচ্ছিস এটা কাউকে জানানোর দরকার নেই।

জানালেও কোন ক্ষতি নেই বাবা। শরীরের অসুখের কথা যেমন জানানো যায়, মনের অসুখের কথাও জানানো যায়।

দরকার কি?

তুমি জানাতে না চাইলে জানিও না।

যে সাইকিয়াটিস্ট তোর চিকিৎসা করবেন তার নাম রুবিনা। রুবিনা হক। খুব নাম করা সাইকিয়াটিস্ট।

বুঝলে কি করে নাম করা?

আমেরিকার সেন্ট পল হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস্ট বিভাগে ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি খুব ইমপ্রেসড। তোর যে সব সমস্যা তাকে খোলাখুলি বলবি। ডাক্তার এবং উকিল এদের কাছে কিছু লুকাতে নেই।

আমি কিছুই লুকাব না। উনি যা জানতে চাইবেন আমি বলব।

জানতে না চাইলে নিজে থেকে বলবি। হয়ত কোন একটা জরুরি পয়েন্ট জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেল।

ভাল সাইকিয়াটিস্ট হলে ভুলবে না। যদি ভুলে যায় তাহলে বুঝতে হবে লো ক্যালিভার সাইকিয়াটিস্ট। তখন তার প্রশ্নের জবাব না দেয়াই ভাল।

তোর বন্ধু বান্ধব যদি তোর খোঁজ করে তাহলে আমি বলব তুই কিছুদিনের জন্যে জন্যে রাঙ্গামাটি গিয়েছিস।

আচ্ছা।

ওদের কাউকে যদি তোর কিছু বলার থাকে তাহলে আমাকে বলে যা। আমি বলে দেব।

কাউকে কিছু বলতে হবে না। শুধু মজিদের বিয়ে হচ্ছে ৮ই পৌষ। বিয়েতে দামী গিফট পাঠাবে। দাওয়াতের কার্ড দিয়ে যাচ্ছি–সেখানে ঠিকানা আছে।

কি গিফট পাঠাব?

দামী একটা শাড়ি আর একসেট রবীন্দ্র রচনাবলী। মজিদ সব সময় বলতো তার টাকা হলে সে এক সেট রবীন্দ্র রচনাবলী কিনবে।

আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দেব। তবে আমার ধারণা ৮ই পৌষের আগেই তুই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবি।

আমার সে রকম মনে হয় না বাবা।

হোসেন সাহেব একাই সাজ্জাদকে চিকিৎসা কেন্দ্রে রেখে এলেন। নীতুকে সঙ্গে নিলেন না। তার মনে হল এইসব জায়গায় মেয়েদের নিয়ে যাওয়া ঠিক না। গাড়িতে ফেরার পথে তিনি খুব কাঁদলেন।

 

রুবিনা হকের বয়স চল্লিশের উপরে–তাকে দেখে তা মনে হয় না। বয়সের একমাত্র ছাপ তাঁর চুলে। কানের পাশের চুল সাদা হয়ে আছে। তিনি সেখানে রঙ দেননি। কানের পাশে চুলগুলি কালো করে তিনি যদি চোখ থেকে ভারী চশমাটা খুলে ফেলতেন তাহলে তাঁকে কিশোরীদের মত দেখাতো। তিনি তা জানেন। কিশোরী মনস্তত্ত্ববিদ রোগীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই তথ্যটিও সম্ভবত তাঁর জানা। তিনি সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছেন?

সাজ্জাদ বলল, ভাল।

মহিলার শাড়ির রঙ হালকা সবুজ। কাধে সাদা রঙের চাদর জড়িয়েছেন। তাকে এই পোষাকেও চমৎকার লাগছে। শুধু গলার স্বর হাস্পিক। মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা লেগেছে।

রুবিনা হক বললেন, আসুন আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলি।

সাজ্জাদ বলল, বলুন। সেসানটা হবে কেমন? আমি কি কাউচে শুয়ে থাকব?

না। যেভাবে চেয়ারে বসে আছেন ঠিক সেইভাবে বসে থাকবেন। চা দিতে বলব?

বলুন।

আপনি কি সিগারেট খান?

জ্বি খাই।

তাহলে সিগারেট খেতে পারেন। আমি নিজেও সিগারেট খাই। তবে বাংলাদেশের পুরুষদের সামনে না। মেয়েরা সিগারেট খাচ্ছে এই দৃশ্য এই দেশের পুরুষরা অভ্যস্ত হয় নি। তারা একটা শক খায়। আপনাকে কোন শক দিতে চাচ্ছি না।

সাজ্জাদ বলল, আমি এত অল্পতে শকড হই না। আপনি সিগারেট ধরান।

রুবিনা হক অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। টেবিলের ওপাশে ফ্লাস্যক ছিল। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন।

সাজ্জাদ সাহেব!

জ্বি।

আসুন আমরা একটা চুক্তি করি।

কি ধরণের চুক্তি।

আমার প্রশ্নের আপনি সত্যি জবাব দেবেন। সরাসরি জবাব দেবেন। ড্রাগ নিয়ে যারা অভ্যস্ত এই কাজটা তারা পারে না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি পারবেন।

আপনার এরকম মনে হবার কারণ কি?

আপনাকে রেসপনসিভ বলে মনে হচ্ছে। আপনার ভেতর দ্বিধা এবং কুষ্ঠার ভাবটা নেই। আমার কি প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করব?

করুন।

আমি কি ধরে নিতে পারি আপনি সত্যি কথা বলবেন?

হ্যাঁ ধরে নিতে পারেন?

রুবিনা হক সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে সাজ্জাদের দিকে ঝুঁকে এলেন। ভারী এবং গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কি কখনো মানুষ খুন করার কথা ভেবেছেন?

সাজ্জাদ হকচকিয়ে গেল। এই প্রশ্নের জন্যে সে তৈরী ছিল না। সে ধরে নিয়েছিল প্রশ্ন হবে ড্রাগ সম্পর্কিত। সে কি ধরণের ড্রাগ নেয়। কতবার নেয়। কবে থেকে শুরু করেছিল। এইসব। ভদ্রমহিলা সে দিকে না গিয়ে আচমকা প্রশ্ন করলেন–আপনি কি কখনো মানুষ খুন করার কথা ভেবেছেন। ইন্টারেস্টিং।

সাজ্জাদ বলল, সব মানুষই জীবনে কখনো না কখনো খুন করার কথা ভাবে।

আমি সব মানুষের কথা জানতে চাচ্ছি না। আপনার কথা জানতে চাচ্ছি। আপনি কি ভেবেছেন?

হ্যাঁ।

শুধু ভেবেছেন, না পরিকল্পনাও করেছেন?

পরিকল্পনাও করেছি।

পরিকল্পনাটা বলুন।

সাজ্জাদ হেসে ফেলল। রুবিনা হক বললেন, বুঝতে পারছি আপনার প্রাথমিক পরিকল্পনাটা খুব হাস্যকর ছিল। নিশ্চয়ই শিশু বয়সের পরিকল্পনা। বলুন শুনি। আপনার সিগারেট নিভে গেছে। সিগারেট ধরিয়ে বলুন।

আমার একজন প্রাইভেট স্যার ছিলেন–নাম এজাজ উদ্দিন। ইংরেজী পড়াতেন। স্যারের অভ্যাস ছিল সারাক্ষণ নাকের লোম ছেড়া। তিনি নাকের লোম ছিড়তেন এবং তার সামনে একটা সাদা কাগজে সেগুলি জমাতেন। আমাকে পড়ানো শেষ করে কাগজটা প্যাকেট করে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।

আপনার কাছে দৃশ্যটা ভয়ংকর কুৎসিত লগত?

জ্বি।

আপনি তাকে খুন করার পরিকল্পনা করলেন?

জ্বি।

পরিকল্পনাটা বলুন শুনি।

আমার ফুটবলের একটা পাম্পার ছিল। আমি ঠিক করলাম কেরোসিন দিয়ে সেই পাম্পার ভর্তি করব। তারপর আড়াল থেকে পাম্পারে চাপ দিয়ে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেব। তারপর একটা দেয়াশলাই জেলে কাঠিটা তার গায়ে ফেলে দেব।

আপনার বয়স তখন কত?

আমি তখন সিক্সে পড়ি।

পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি কেন?

স্যার চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন।

পরের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।

কণা নামের একটা মেয়ে আছে। আমি তার স্বামীকে খুন করার পরিকল্পনা করি।

পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।

খুব সহজ পরিকল্পনা–জটিল কিছু না। আমি খুব তীব্র কিছু বিষ জোগাড় করে কণাকে দিয়ে আসি। তাকে বলে দেই। সে যেন কোন না কোন ভাবে তার স্বামীকে খানিকটা খাইয়ে দেয়।

কণা রাজি হয়?

সে শিশিটা হাতে নিয়ে খুব হাসে। হাসি দেখে মনে হচ্ছিল সে রাজি।

সে যে রাজি না সেটা কখন বুঝলেন?

পরের বার তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি সে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।

মেয়েটিকে আপনি বিয়ে করতে চাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ।

কেন? সে খুব রূপবতী?

না, খুব রূপবতী না। চেহারায় আকর্ষণ ক্ষমতা অবশ্যি আছে।

… কেন তাকে বিয়ে করতে চান এটা নিয়ে কি কখনো ভেবেছেন?

জ্বি না।

ব্যাপারটার পেছনে কি প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করছে? আপনার মা, আপনার বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে … এই জাতীয় কিছু।

হতে পারে।

আপনার কি বন্ধু-বান্ধব আছে?

না।

না কেন?

বেশী দিন কাউকে আমার ভাল লাগে না।

কেন লাগে না।

ওদের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নশ্রেণীর মনে হয়। ওদের সঙ্গে কথা বলে আরাম পাই না।

মানুষকে চমকে দিতে আপনার ভাল লাগে?

লাগে।

আপনার শখ কি?

আমার কোন শখ নেই।

আপনার বাবার কাছে শুনেছি। মুখোশ সংগ্রহ করা আপনার হবি।

ঠিকই শুনেছেন।

মাঝে মাঝে আপনি কি মুখোশ পরে চুপচাপ বসে থাকেন?

জ্বি।

আপনি কি জানেন আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ।

জানি।

আমাদের সাইকোলজির ভাষায় এই রোগের একটা নাম আছে। আপনি নামটা জানেন?

Antisticial Psychopath।

এই বিষয়ে আপনার পড়াশোনা আছে?

জ্বি আছে। আমার প্রিয় বিষয়–কবিতা এবং সাইকোলজি।

আমাকে একটা কবিতা শুনানতো।

সাজ্জাদ চোখ বন্ধ করে গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করল,

You knew Orion always comes up sideways.
Throwing a leg up over our fence of mountains.
And rising on his hands, he locks in in me
Busy outdoorshy lantern-light with something
l should hawe di ne hy layligh. and indeed…

কার কবিতা?

রবার্ট ফ্রস্ট।

রুবাট ফ্রস্ট কি আপনার প্রিয় কবি?

না–আমার অপ্রিয় কবি।

অপ্রিয় কেন? যে সব কবিতা আপনার লেখার কথা সে সব কবিতা উনি লিখে ফেলেছেন বলে?

হ্যাঁ।

সাজ্জাদ হাসল। মহিলার বুদ্ধি তাকে চমৎকৃত করছে। এর সঙ্গে কথা বলে আরাম আছে। সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা আরাম পাওয়া যায় না। জন্মগতভাবেই তারা চাপা। এরা সহজ ভাবে কিছু বলবে না। বুদ্ধিমতি মেয়েদের বেলায় এই ব্যাপারটি আরো তীব্র। তারা পুরুষদের সঙ্গে কখনো বুদ্ধির খেলা খেলবে না। নিজের বুদ্ধি, মেধা ও মনন চাপা দিয়ে রাখবে। মেয়েরা অন্যদের কাছে নিজেদের সরল সহজ হিসেবে দেখাতে ভালবাসে।

সাজ্জাদ সাহেব।

জ্বি।

কণার হাতে বিষের শিশি দিয়েছেন, এই কথাটা আপনার বানানো? তাই না?

জ্বি বানানো–আমি কণাকে বলেছিলাম আমি তোমাকে বিষ দিয়ে যাবো। তুমি তোমার স্বামীকে খাইয়ে দিও। শুনে সে খিলখিল করে হেসেছিল। আমি তার দুদিন পরে সত্যি সত্যি বিষের কৌটা নিয়ে যাই–তখন আর তাদের পাইনি। এবার কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি।

হ্যাঁ এবার সত্যি কথা বলেছেন। আপনার মা যখন আপনার বাবাকে ছেড়ে যান। তখন আপনার বয়স কত?

ছ সাত বছর হবে। ঠিক বলতে পারছি না।

সেই সময়কার স্মৃতিতো নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?

হ্যাঁ আছে।

আপনার মা যাকে বিয়ে করেন। তিনি আপনার বাবার বন্ধু?

জ্বি।

আপনার বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি আসতেন?

হ্যাঁ।

আপনার মা কি তার সঙ্গে দরজা বন্ধ করে গল্প করতেন?

হ্যাঁ।

দরজার ফাঁক দিয়ে আপনি কি কখনো উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন ভেতরে কি হচ্ছে?

হ্যাঁ, করেছি।

যা দেখেছেন তাতে আপনার মনে প্রচণ্ড রাগ এবং ঘৃণা তৈরি হয়েছে।

আমি ছোট ছিলাম। কিছু বুঝতাম না।

তার পরেও প্রচণ্ড রাগ এবং ঘৃণা জন্মাতে পারে।

হ্যাঁ পারে।

আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার বর্তমান অবস্থার বীজ হচ্ছে শৈশব।

হতে পারে।

এখনতো আপনার বয়স হয়েছে, এখন কি আপনি আপনার মার ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারেন না? বাবা আপনার যতই প্রিয় হোন না কেন আপনার মার কাছে প্রিয় ছিলেন না। তার যে সব অভাব ছিল আপনার বাবা সে সব অভাব মিটাতে পারছিলেন না। অসুখী একজন মহিলা সুখের সন্ধান করবে–এটা কি স্বাভাবিক না?

হ্যাঁ স্বাভাবিক।

আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?

না।

আপনার কি ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবেন? আমার সঙ্গে ভাল চকলেট কেক আছে।

কেক না–অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।

বলুন কি খেতে চান?

সাজ্জাদ শীতল গলায় বলল, একটা টিকটিকি খেতে চাই। মিডিয়াম সাইজের একটা টিকটিকি।

রুবিনা হকের মুখের ভাব বদলাল না। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই ফ্রাক্স থেকে চা ঢালছেন। যেন তিনি সাজ্জাদের কথা শুনতে পান নি।

সাজ্জাদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার হাতের মুঠি বন্ধ। মনে হচ্ছে সে অনেক কষ্টে রাগ সামলাচ্ছে।

 

নীতু তার বাবাকে ডাকতে এসে দেখল তিনি জবুথবু হয়ে বসে আছেন। তার মাথা নিচু। বেশ শীত পড়েছে। কিন্তু তিনি বসে আছেন পাতলা একটা গেঞ্জি গায়ে। মাথার উপর ফ্যানটাও ফুলস্পসীডে ঘুরছে। নীতু বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?

হোসেন সাহেব বললেন, না।

তাহলে এসো। ভাত খাবে এসো।

হোসেন সাহেব বললেন, ভাত খাব নারে মা!

ভাত খাবে না কেন?

মনটা ভাল নেই।

রুটি বানিয়ে দেব?

না। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।

একদম কিছু খাবে না তা কি করে হয় বাবা? একটা কলা খাও, আর এক গ্রাস দুধ এনে দেই?

আচ্ছা দে।

নীতু কলা এবং দুধ এনে দেখল তার বাবা ফুপিয়ে যুঁপিয়ে কাঁদছেন। নীতুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ যদি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে তাহলে তাকে খুব অসহায় লাগে। নীতু বাবার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ভাইয়ার জন্য কি মনটা খারাপ লাগছে। বাবা?

না।

তাহলে কি জন্য মন খারাপ লাগছে?

হোসেন সাহেব চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমার জন্যে তোদের সবার জীবন উলট পালট হয়ে গেল এই জন্য মন খারাপ লাগছে।

তোমার জন্যে হবে কেন?

অবশ্যই আমার জন্যে। আমি তোদের ঠিকমত মানুষ করতে পারি নি। ঠিকমত মানুষ করলে এই সমস্যা হত না। তোদের দুজনের জীবনই ধ্বংস করে দিয়েছি। সব সময় আমার নিজেকেই দোষী মনে হয়।

নীতু বলল, শুধু শুধু কষ্ট পেও না বাবা! তুমি কারো জীবন নষ্ট করনি। আরেকটা কথা বাবা তুমি বার বার দুজনের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। এসব বলছ কেন? ভাইয়ার জীবন খানিকটা এলোমেলো হয়েছে–কিন্তু আমারতো কিছু হয়নি। আমি ড্রাগও ধরিনি, মাথা খারাপের মত আচরণও করছি না।

হোসেন সাহেব ধরা গলায় বললেন, তুইও করছিস। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল, দাওয়াতের চিঠি চলে গেল তখন তুই সব বাতিল করে দিলি। এটাতো মা এক ধরনের অসুস্থতা।

নীতু বাবার হাতে হাত রেখে বলল, বাবা এরকম আর হবে না। তুমি আবার আমার জন্যে একটা বিয়ে ঠিক কর, দেখবে আমি হাসি মুখে বিয়ের আসরে গিয়ে বসব।

হোসেন সাহেব বললেন, আমার নিজের শরীরটা ভাল না। কয়েকদিন পরপর বুকে ব্যথা হয়, তোদের বলি না। তোরা নাভাস হয়ে পড়বি। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। অথচ কিছুই গুছিয়ে যেতে পারলাম না। সব এলোমেলো। যত দিন যাচ্ছে ততই এলোমেলো হচ্ছে।

নীতু বলল, দুধটা খাও বাবা।

হোসেন সাহেব বাধ্য ছেলের মত দুধের গ্লাসে চুমুক দিলেন। বাবাকে দেখে নীতুর মনটা মায়ায় ভরে গেল। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে এমন কিছু করে যা দেখে তার বাবার মনটা ভাল হয়ে যায়। তিনি যেন বুঝতে পারেন তাঁর সংসারটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় নি।

নীতু বাবাকে ঘুমুতে পাঠিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে প্যাডের কাগজে লিখল,

আতাহার ভাই,
দয়া করে আপনি কি এক্ষুণি একটু আসবেন?
ইতি নীতু

নীতু চিঠি খামে বন্ধ করল না। চিঠিতে এমন কিছু লেখা নেই যে খামের ভেতর আড়াল করে পাঠাতে হবে। খুব সহজ সরল আহ্বান।

নীতু চিঠি হাতে ড্রাইভারের খোঁজে গেল। ড্রাইভারকে বলে দিল চিঠিটা যেন সে আতাহারকে দেয় শ্রবং যত রাতই হোক সে যেন আতাহারকে নিয়ে আসে। রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলেও সে যেন অপেক্ষা করে।

নীতু বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছে। যত রােতই হোক সে অপেক্ষা করবে। আতাহার যদি রাত তিনটাতেও আসে সে বসেই থাকবে। দেরীতে এলেই ভাল হয়, আতাহার ভাইকে কি বলবে তা সে গুছিয়ে নিতে পারবে। বেশি কিছু বলবে না। অল্প কয়েকটা কথা–আতাহার ভাই আমি সারাক্ষণ আপনার কথা ভাবি। আমি জানি আমার ভয়ংকর কোন অসুখ করেছে। আপনি আমার অসুখ সারিয়ে দিন।

তার মুখে এই ধরনের অদ্ভুত কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে তাকবেন তখন সে আতাহার ভাইয়ের হাত ধরে যা মনে আসে তাই বলবে। আগে থেকে কিছু ভেবে

করলেও করবে। তাকে যদি সবাই পৃথিবীর সবচে। খারাপ মেয়ে ভাবে তাতেও কিছু যায় আসে না। কিছু যায় আসে না। কিছু যায় আসে না। না–না-না।

নীতু বারান্দার বাতি নিভিয়ে রাখল। অন্ধকারই ভাল। অন্ধকারে এমন অনেক কিছু বলা যায় যা আলোতে বলা যায় না। শুধু একটাই সমস্যা অন্ধকারে সে আতাহার ভাইয়ের মুখটা দেখতে পাবে না। মুখ না দেখতে পেলেও ক্ষতি নেই–সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে। আজ রাতের জন্য সে হবে এক অন্ধ তরুণী।

ড্রাইভার রাত একটার দিকে ফিরে এসে জানালো–আতাহারকে সে খুঁজে পায়নি। সে আগে যেখানে থাকতো সেখানে নেই। এখন অন্য কোথায় যেন থাকে। কেউ বলতে পারে না কোথায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *