ডেপুটিদের জিম্মাদারি
আমি আপনাদের সেটেলমেন্ট অফিসারদের জিম্মাদারির কথা বলছিলাম এবার একটু নজর ফেরাই ডেপুটিদের দিকে। বন্দোবস্ত চালু করার পিছনে এদের জিম্মাদারিও কিছু কম ছিল না। রাজস্ব নিয়ে কোনও সওয়াল উঠলে কানুন মোতাবেক তার সুরাহা করা ছিল এদের কাজ। ফয়সালা কী হল তা জানিয়ে দিতে হত সেটেলমেন্ট অফিসারকে। একই কাজ আবার করতে হত সেটেলমেন্ট অফিসারদের। কমিশনার অব রেভিনিউকে করতে হত জবাবদিহি। যে সব ডেপুটিকে বন্দোবস্তের কাজে বহাল করা হয় তাদের বেশির ভাগই ছিল এ দেশের লোক। কায়স্থ (kayesht) বা মুসলমান। এই জাঁহাবাজদের নিয়ে শোনা যেত অনেক কিস্সা। কারও কারও বিরুদ্ধে তো নালিশও রুজু হয়েছে। হুজুরেরা কিন্তু সেই নালিশে আমল দিতেন না। “যারা এত ভাল করে দায়িত্ব সামাল দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ শোনার সময় নেই আমাদের!” বা “সরকারি অফিসাররা যখন নিজের কাজ করে তখন তাদের গালিগালাজ শুনতেই হয়, বাদ যায় না মিথ্যা অপবাদ।” এই বলে খতম হত মামলা। হুজুরদের কাছে ছাড় মেলায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠত তারা। ধরে নিত আইন কানুন থোড়াই কেয়ার। এই জনাবরা তাদের কাজ সামলাতে না পারলেও বলা হত না যে তারা নালায়েক। তনখা বেড়েই চলত; মনে করা হত তাদের তরক্কি হলে আরও এলেমের সঙ্গে কাজ করবে। যে কাজ করলে কোনও ফিরিঙ্গি অফিসারের বদনাম হয় সেই একই কাজ করে এদের মিলত ইনাম। মোহর লাগত তাদের বেলাগাম কারবারে।
কী মজার কথা দেখুন, যাদের জমিদাররা খোদ বলছে নালায়েক তাদেরই খুঁজে এনে দেওয়া হত জিম্মাদারি। আপনারা সওয়াল করতে পারেন, ইনসাফ চাইলে সবুর করতে হয়। আমি বলব আলবাত করতে হয়, কিন্তু দেখাটা জরুরি যে ইনসাফ যেন পাল্টে বেইনসাফ না হয়ে যায়। তামাম উত্তর পশ্চিম সুবায় পরগনাগুলো যাদের দখলে ছিল তারা নিজেদের বলত রাজা। নমুনা হিসাবে পেশ করা যাক শাজাহানপুর জেলার কোঠার আর পাওয়ান (Koothar and Powaeen)-দের কথা। এই দুটো তালুক জবরদস্তি তলোয়ারের জোরে দখল করা হয়েছিল। আংরেজ হুকুমত কায়েম হওয়ার আগে তালুকের মালিকানা নিয়ে কারও কোনও শিরদর্দ ছিল না। মালিকরা তাদের মর্জি মাফিক কাজ-কারবার চালাত। রায়তরা ছিল মসিলের১ শিকার। এলাকার সরকারের কাছে দরবার করলে জবাব মিলত, আপসে মেটাও না হলে মুকদ্দমা করো। জমির আসল মালিকের হাত থেকে পুরো পেশকারিটাই ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সরকারি হিসাব মোতাবেক তাকে শুধু মালিকানার একটা ভাগ ঠেকানো হত। বেনারস সুবার মামলায় পাট্টা ছিল একটু তাজ্জব রকম। আমি যে গোড়ায় নারাজ জমিদারের কথা বলছিলাম এবার দেখবেন কেন তারা নারাজ।
তাজ্জব রকমের পাট্টায় বলা ছিল: জনাব জোনাটিন ডানকিন বাহাদুর (Janab Jonatheen Dunkeen Buhadoor) যে মশহুর দশসালা বন্দোবস্ত বেনারস সরকারের জন্য চালু করলেন সেখানে সরকারের রাজস্ব ইস্তিমারি (istimraree) বা লাগাতার বন্দোবস্ত মোতাবেক হবে না। জমিদার বা আর কেউ তাদের দেওয়া শর্তে চুক্তি করতে পারে। ১৭৯৫ সনে লাগাতার বন্দোবস্ত কায়েম হলে ওই মহলগুলোতে চালু হল চাষ। তবে চাষের মামলায় সরকার কোনও দখলদারি করল না আর জমিগুলোর কে আসল হকদার সেই সওয়ালও ঝুলে রইল। ঠিক হল মাশুল হবে মোকার্ররি; তবে ডানকিন বাহাদুর এটাও জানিয়ে দিলেন, দেওয়ানি আদালতে যদি কেউ জমিদারির হক প্রমাণ করতে পারে তা হলে তকরারি জমিদারদের বদলে তার অধিকার কায়েম হবে। কোনও কোনও তরফ দেওয়ানি আদালতে নিজেদের হক প্রমাণ করে জমির দখল ফিরে পেল, তবে বেশির ভাগ রায়ত আর তার ওয়ারিশরা ১৭৬৫ সন থেকে কোনও তকরার ছাড়াই নিজের দখল কায়েম রাখতে পেরেছিল। আখেরে ১৮৪০-৪১ সনে হল আবার করে বন্দোবস্তের রদবদল। লোকেদের খেয়ালে পুরনো রায়তরাই ঠিক ছিল। কারণ ৪৫ বছর ধরে তাদের দখলই কায়েম। এর ভিতর কেউ তাদের জমি নিয়ে কোনও সওয়াল করেনি। চুক্তি মোতাবেক এতদিন তারা সব দাবি-দাওয়া মিটিয়ে এসেছে। এবার যদি তারা নিজেদের জমিদার বলে ভাবতে শুরু করে তা হলে ভুলটা কোথায়? কিন্তু সরকার তাদের সেই সওয়াল মানতে নারাজ। সেটেলমেন্ট অফিসারদের তাই হুকুম করা হল, তলাশ করো পুরনো জমিদার বা তার ওয়ারিশদের। খোঁজ মিললে তাদের সঙ্গেই করা হবে বন্দোবস্ত।
ইনশাল্লা! বিতা হুয়া পচাশ সাল! ডানকিন বাহাদুর যবে বন্দোবস্ত চালু করেন তখন যারা জিন্দা ছিল এখন তাদের এন্তেকাল হয়েছে। সরকারের কাজ হল এখন তাদের ওয়ারিশ খোঁজা। খবর চাউর হতে খাড়া হাজারও উমেদার। কোনও একজন প্রমাণ করে ছাড়ল তার কোনও জমিদার পরদাদা বানিয়ে ছিল আমের বাগিচা তাই গাছগুলোর হক এখন তার। আবার কেউ বলতে বসল ঢিবির উপর যে পুরনো ঘুরি (guhree) কেল্লার খণ্ডহর নজরে আসে তার আসল মালিক তার পরদাদা। উমেদার নম্বর তিন এলান করল সড়কের ধারে যে বেহাল ইঁদারাটা দেখা যাচ্ছে সেটা বানিয়েছিল তার কোনও আজা (ajah) বা মুরিস আলা (Moorish alah)। সফেদ দাড়িওয়ালা গ্রামবাসী চাঁদির সিক্কার রবরবায় শুরু করল তাদের হয়ে তরফদারি। কানুনগো আবার দাখিল করল একটা খাস্তা দস্তাবেজ বা পুলিন্দা (polindah) যার থেকে সাফ জাহির হয় আংরেজ সিয়াসত কায়েম হওয়ার আগেই কারও কারও জমিদারি ছিল। যারা এখন হক কায়েম করতে চাইছে তাদের ভিতর একজন যে আলবাত জমিদারের ওয়ারিশ তাই নিয়ে কানুনগোর কোনও সন্দেহ নেই। কিস্সা লম্বা না করে স্রেফ এটা বললেই চলে, পচাশ সাল যাদের হক কায়েম ছিল তাদের অনেককেই এবার উৎখাত করে নতুনদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা হল।
এই আজব কারবার দেখে চমকে গেল লোকেরা। মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে বসল, ক্যায়া করে হুকুম হাকিম কা হ্যায়! (kea kurreh hookoom Hakim ka haee!) কোনও গুনজাইস নেই যে আমাদের হুকুমত এখানে কামাল করে দিয়েছিল। জমিদারদের হক প্রমাণ করতে বললে তারা কেউ তা পারল না। তাই সব জমি চলে গেল সরকারের দখলে। এত দিনের মুস্তিগির (moostigir) হওয়ায় সরকার আবার করে রায়তদের হাতেই ছেড়ে দিল জমির জিম্মাদারি। তবে আমি যেমন বললাম কাজটা তত সহজে হয়নি। জমির দখল নিয়ে ছিল নানা ধোঁয়াশা। তাই দেখা যেত মাঝে মাঝেই ডেপুটির হুকুম পালটে দিচ্ছে সেটেলমেন্ট অফিসারেরা আবার সেটেলমেন্ট অফিসারদেরটা উলটে দিচ্ছে কমিশনার। কমিশনারের হুকুম যে বহাল থাকছে তাও না, বোর্ড হয়তো নাকচ করে দিচ্ছে সেই হুকুম। তাই উলটো সিধা আর কিছুতেই খতম হত না।
চেষ্টা ছিল কী করে ডেপুটিদের বয়ান আরও লম্বা করা যায় যাতে রুবাকারি পড়তে পড়তে আর শুনতে শুনতে ইউরোপীয়রা বেদম হয়ে পড়ে। আমার তো মনে হয় সবারই জানা যে একজন কেরানি কী কায়দায় কোনও মামলা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লম্বা করতে পারে যা দু’-এক লব্জেই খতম করা যায়। ডেপুটিদের পেশ করা কয়েকটা মামলার শুনানি থাকলে তো হুকুমদারেরা বেজার হয়ে পড়তেন। চেষ্টা থাকত কী করে জলদি ছাড় পাওয়া যাবে।
পাট্টাদারি (putteedaree) দস্তাবেজ তৈরি, মালিকানার দখলদারদের নাম ফরমানোর মতো কাজে ছিল বহুত ফয়দা। তাই এই কাজ হত দায়সারা ভাবে তাড়াহুড়ো করে। লোকেরাও ছিল নাখুশ। মালিকানায় কোনও হক নেই তবু দেখা যেত তাদের নামই কায়দা মাফিক খতিয়ানে ঢুকে গেছে। পুদারুত সিং তো এই কারবার করেই মালামাল হয়ে ওঠে। একবার দেওয়ানি আদালতে পুদারুত মামলা রুজু করল ‘এ’-র খিলাফ। তার দাবি, সেই হচ্ছে দানিয়ালপুর (Danealpoor) গ্রামের চার ভাগের তিন ভাগ বা বারো আনা হিস্সার মালিক। সময় মাফিক একটা নোটিশ ধরানো হল ‘এ’-র হাতে। জবাবে ‘এ’ জানাল, দানিয়ালপুর তার হেপাজতে নেই আর পুদারুতের দাবি নিয়েও সে কিছু বলতে পারবে না। তবে তাকে হয়রান করার জন্য মামলাটা সে লড়তে চায়। এটা জানার পর পুদারুত তাকে সমঝে (sumjhaoed) দিল আর দর কষাকষি খতম হলে হাতে গুঁজে দিল একশোটা টাকা। ঠিক হল ‘এ’ একটা একবালদাওয়া রুজু করবে। ‘এ’-কে বলা হল, তার তো কোনও লোকসান হচ্ছে না কারণ লড়াইটা তো আসলে হবে আমির আলির বিরুদ্ধে। যদি দানিয়ালপুরের দখল হাসিল করা যায় তা হলে তাকে বেফয়দা সেই পাট্টাদারির চৌয়ানি হিস্সা ছেড়ে দেবে। ‘এ’-তো টোপটা গিলে নিল আর পুদারুত চুপচাপ ইন্তেজার করতে লাগল কবে মিলবে মওকা। দানিয়ালপুরের দখল নিয়ে সরাসরি আমির আলির খিলাফ লড়তে যাওয়ার মতো বেয়াকুব ছিল না পুদারুত সিং। তা হলে যে কাম ফতেহ হবে না তা ভালই মামুল ছিল তার। তাই আবার করে যখন বন্দোবস্ত যাচাই পরখ চালু হল সে দাবি করল বারো আনা হিস্সা। ‘এ’-র সঙ্গে তার সমঝোতা হয়েছিল। দানিয়ালপুর নিয়ে যে একবালদাওয়া রুজু হয় দেওয়ানি আদালতে এবার সেটাই হয়ে দাঁড়াল তার সাবুদ। আদালত সওয়াল জবাব শোনার পর তার হাতে ছেড়ে দিল মালিকানা।
১. মসিল: উৎপীড়ন