জাহানারা অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?
মামুন হাসিমুখে বলল, কোন ব্যাপার না। এমনি এসেছি। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম এসেছি। যখন দেখে যাই কেমন আছেন।
ভালই আছি।
করছেন কি?
দেখতেই পাচ্ছেন ফাইল নিয়ে বসে আছে।
জাহানারার ঠোঁট বিরক্তিতে বেঁকে গেল। মামুন অবাক হয়ে মুনার সঙ্গে জাহানারার অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পেল। মুনাও মাঝে মাঝে বিরক্তিতে ঠোঁট বাকাত। ঠিক এই ভঙ্গিতে বাকাত। মামুন বলল, লোন স্যাংশন হয়ে গেছে সেই খবরটাও দিতে এলাম।
পুরনো খবর আগেই একবার দিয়েছেন।
ও আচ্ছা।
মামুন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তার উঠে যাওয়া উচিত। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না। বসে থাকতে ভাল লাগছে।
আপনি বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন?
না।
এখনো খুঁজছেন? না খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছেন?
খুঁজছি। আপনি কী চা খাবেন?
জি খাব।
জাহানারা নিজে উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এল। মামুন লক্ষ্য করল শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে বিসকিট দেবার কথাও বলছে। এবং ফিরে এসে বসেছে হাসিমুখে। আগের বিরক্তির লেশমাত্র নেই।
আপনি কি এখনো শশানে বেড়াতে যান?
না। যাই না। আপনার কথার পর ভয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
বিকালে কি করেন-ঘরেই বসে থাকেন?
হুঁ। বসে থাকা ছাড়া আর কি করব। গল্পের বই পড়ি। আপনার কাছে গল্পের বই আছে?
আছে। কাল নিয়ে আসব। অনেক আছে।
বলেই মামুন একটু চমকাল। কারণ গল্পের বই তার কাছে নেই। খুঁজলে-টুজলে এক-আধটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অনেক বই আছে এটা পুরো মিথ্যা। এত বড় একটা মিথ্যা কথা সে কেন বলল। এই মেয়েটার আচার-আচরণ অনেকটা মুনার মতো সেই কারণেই কী?
জাহানারা বলল, কালই আপনাকে বই নিয়ে আসতে হবে না। পরের বার যখন এদিকে আসবেন নিয়ে আসবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনার কাজকর্ম কেমন এগুচ্ছে?
কোন কাজকর্মের কথা বলছেন?
ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন যে কাজকর্মের জন্যে। আমাদের তো রিপোর্ট করতে হবে।
কাজ চলছে পুরোদমে। জিনিসপত্র আনতে ঢাকা যাব।
জাহানারা কৌতূহলী হয়ে তাকাল।
কবে যাবেন?
এখনও ঠিক করিনি শিগগিরই যাব। আপনার কোন খবর থাকলে দিবেন। আমি পৌঁছে দেব।
কাকে পৌঁছে দেবেন?
আপনার মাকে। তারা তো ঢাকাতেই থাকেন। তাই না?
আমার কোন খবর নেই।
কোন জিনিসপত্র দিতে চাইলে দিতে পারেন। কোন রকম সংকোচ করবেন না। এখানে মোক্তার পাটি বলে এক রকম পাটি পাওয়া যায়। মোক্তা গাছের ছাল দিয়ে তৈরি ভাল জিনিস। আমি যোগাড় করে দেব।
আপনাকে কিছু জোগাড় করতে হবে না। আমি কোন কিছু পাঠাতে চাই না।
আপনার বদলির কী হয়েছে?
হয়নি কিছু।
হেড অফিসে দরখাস্ত করেছিলেন যে তার কী হল?
জানি না। কিছু হয়নি নিশ্চয়ই। হলে কি আর এখানে পড়ে থাকতাম? নিন। চা খান।
চা খাবার পরও মামুন ঘণ্টা খানিক বসে রইল। সে বুঝতে পারছিল জাহানারা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। জাহানারা একবার বলেই ফেলল, চলে যান কেন শুধু শুধু বসে আছেন? এই যাচ্ছি বলেও মামুন বসে রইল। জাহানারা চশমা পরে মাথা নিচু করে কাজ করছে। চশমা নাকের ডগার দিকে অনেকটা নেমে এসেছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। এই মেয়েটির চোখ দু’টি সুন্দর। কিন্তু চশমার জন্যে সুন্দর চোখ আড়ালে পড়ে থাকে। যে ভদ্রলোক এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে। সে হয়ত বুঝতেও পারবে না তার স্ত্রীর চোখ কত সুন্দর।
আজ তাহলে ফাই?
আরেক কাপ চা খেতে চাইলে খেতে পারেন।
মামুন উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। ইতস্তত করে বলল, আরেক কাপ চা অবশ্যি খাওয়া যায়। জাহানারা হেসে ফেলল।
হাসছেন কেন?
এমনি হাসছি। আপনি আরাম করে বসুন। আমি চায়ের কথা বলে আসি।
মামুন ঠিক আরাম করে বসতে পারল না। ম্যানেজার তার ঘর থেকে আড়াচোখে বারবার তাকাচ্ছে। তার চোখে-মুখে এই বিরক্তির কারণটি কী? একজন মহিলা কর্মচারীর সামনে বসে কাজের ক্ষতি করছে এইটিই কী বিরক্তির কারণ?
গল্পের বই খুঁজতে গিয়ে মামুন বাড়ি চষে ফেলল, কিছুই নেই। পুরনো কিছু মাসিক পত্রিকা পাওয়া গেল নাম-সোনার দেশ, উইপোকা সে সব ঝাঝড়া করে ফেলেছে। মার ঘরে পাওযা গেল। হয়রত আলীর জীবনী এবং তপসী রাবেয়া। হয়রত আলীকে ইউপোকা কাবু করতে পারেনি। কিন্তু তাপসী রাবেয়াকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। মামুন নিশ্চয়ই হয়রত আলীর জীবনী নিয়ে জাহানারার কাছে যেতে পারে না। অথচ সে বলে এসেছে অনেক বই আছে। এখন যদি গিয়ে বলে কোনো বই নেই তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে। বানিয়ে কিছু-একটা বললে কেমন হয়?
চোখ কপালে তুলে বলতে পারে, আর বলবেন না। সব বই উধাও। কয়েক দিন ছিলাম না। এখানে বাড়ি সাফ করে দিয়েছে। ধর্মের কয়েকটা বই ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? এই অজ জায়গায় লোকজনদের এতটা সাহিত্য প্রীতি থাকার কথা নয়। কিছু বই আনিয়ে নিলে কেমন হয়?
মুনাদের বাড়ি ভর্তি বই। বকুলের বই পড়ার সখ। মুনাকে কতবার দেখেছে বই কিনছে। সেই সব বই বকুল নিশ্চয়ই শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যায়নি।
মামুন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চিঠি লিখতে বসল। অনেক দিন পর মুনাকে লিখছে। কেমন যেন সংকোচ লাগছে লিখতে। আগে কত সহজে লিখিত–প্ৰিয় মুনা। কিন্তু এখন প্রিয় শব্দটি পর মনে হল শব্দটা মানাচ্ছে না। কিন্তু শুধু মুনা দিয়ে চিঠি শুরু করতে ইচ্ছা করছে না। দু’এক লাইনে চিঠি শেষ করবে ঠিক করেও দীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলল।
প্রিয় মুনা,
একটি বিশেষ প্রয়োজনে লিখছি। চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি আমাকে গোটা দশেক ভাল গল্পউপন্যাস ভিপি করে পাঠিয়ে দিবে। তোমার অফিসের কোন বেয়ারাকে বললেই সে ভিপি করে দেবে। আমার অত্যন্ত প্রয়োজন। একা থাকি তো কিছুই করার নেই। সন্ধ্যার পর মনে হয়। ভূতের বাড়িতে বাস করছি। রাত দশটা পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমুতে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলে বাচিতাম। তা আসে না। কোনো কোনো দিন বারোটা পর্যন্ত বেজে যায়। গ্রাম দেশে রাত বারোটা ভয়াবহ ব্যাপার। মনে হয় অন্য কোন ভুবনে বাস করছি। গল্পের বই থাকলে সময়টা কাটবে।
মুনা একটু আগে যে কথাটা লিখেছি সেটা ঠিক না। বইগুলি আমার জন্যে নয়। জাহানারা নামের এক মেয়ের জন্য। তোমাকে আমি এক সময় বলেছিলাম যে আমি কোনো দিন তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। তবু শুরুতে বলে ফেলেছি। কেন বললাম? কারণ আমার মনের মধ্যে একটা ভয় ছিল তুমি কি না কি মনে কর। যদিও আমি জানি তোমার মধ্যে এইসব ক্ষুদ্র ঈর্ষার কোন ব্যাপার নেই।
এইবার জাহানারার কথা বলি। কৃষি ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার। এখানে একা একা থাকে। তোমার সাথে মিল আছে। তার মধ্যে কঠিন একটা ভাব আছে। যখন বিরক্ত হয় তোমার মতো ঠোঁট বাকিয়ে দেয়। তুমি নিশ্চয়ই ভাবিছ মেয়েটিকে নিয়ে এত কথা লিখছি কেন? লিখছি কারণ লেখার কিছু নেই। অথচ আমার ইচ্ছা করছে বিরাট একটা চিঠি লিখতে।
মুনা আমি খুব একা হয়ে পড়েছি। রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার সময় খুব মন খারাপ হয়। তুমি ঐ ব্যাপারটা নিজের মনে গেথে রেখে নিজে কষ্ট পাচ্ছি, আমাকে ও কষ্ট দিচ্ছি। আমি কতবার তোমাকে বলব আমি ফেরেশতা নই। আর তাছাড়া ফেরেশতারাও মাঝে-মধ্যে ভুল করে। করে না? তুমি কি বলতে পারবে যে এ জীবনে তুমি কোনো ভুল করনি। না তুমি বলতে পারবে না।
আচ্ছা মুনা…
এ পর্যন্ত লিখে মামুন চিঠিটা গোড়া থেকে পড়ল এবং মনে হল চিঠিটা খুব বাজেভাবে লেখা হয়েছে। এই চিঠি পাঠানোর কোনো মানে হয় না। সে চিঠি টুকরো টুকরো করে ফেলল।
জাহানারা অফিসে নেই। ম্যানেজার সাহেব বললেন, উনি আসেননি। আপনার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন। মামুন বলল, উনার জন্যে একটা বই এনেছিলাম।
আমার কাছে দিয়ে যান পৌঁছে দেব।
উনি আসেননি কেন?
শরীর ভাল নেই। গাল ফুলেছে। বোধ হয় মামস।
বলেন কি? তাহলে তো দেখতে যেতে হয়।
ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। মামুন বলল, বেচারী বিদেশে অসুখে পড়েছে স্থানীয় মানুষ হিসেবে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে, কী বলেন?
ম্যানেজার সাহেব কিছুই বললেন না।
ডাক্তার দেখছে তো?
হ্যাঁ দেখছে।
মামসের একটা ভাল কবিরাজি চিকিৎসা আছে। ধুধুল পাতার রস, বটগাছের শিকড় এবং মধু এই তিনটা একত্রে মিশিয়ে পুলটিস করে দিতে হয়। আমার একবার মামস হয়েছিল। দেওয়া মাত্র আরাম হয়েছে।
তাহলে যান। আপনার ওষুধ দিয়ে আসুন। আমার বাসা তো চেনেন। চেনেন না?
হ্যাঁ চিনি।
জাহানারা মামুনকে দেখে মোটেই অবাক হল না! যেন সে জানত সে আসবে। মামুন বলল, আপনাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে দুগালে দু’টি কমলা লেবু ঢুকিয়ে বসে আছেন। তাকানো যাচ্ছে না।
কই আপনি তো দিব্যি তাকিয়ে আছেন।
বই এনেছি আপনার জন্যে।
কি বই?
হযরত আলীর জীবনী।
জাহানারা তাকিয়ে রইল। মামুন হাসিমুখে বলল, ঐ দিন আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। বাড়িতে কোনো বই নেই। আমি ঢাকা থেকে নিয়ে আসব।
আপনি বসুন।
মামুন বসল। ছোট্ট একটা ঘর। সুন্দর করে সাজানো। বুক শেলফ ভর্তি বই। জাহানারার হাতেও একটা বই। সে বইয়ের পাতা মুড়তে মুড়তে বলল, বেশিক্ষণ থাকবেন না। আপনারও হবে।
হলে হবে। নো প্রবলেম। খাওয়া-দাওয়া কী করছেন?
বার্লি খাচ্ছি। সলিড কিছু গিলতে পারি না। আপনি কী চা খাবেন?
চা দেবে কে?
কে দেবে সেটা আমি দেখব। আপনি খাবেন কি না বলুন।
খাব।
জাহানারা উঠে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল চা নিয়ে।
এত তাড়াতাড়ি কিভাবে করলেন?
আমি করিনি। ভাবী করে দিয়েছেন। আপনি চা খেতে খেতে একটি সত্যি কথা বলবেন?
বলুন কি জানতে চান?
আপনি কেন আসেন আমার কাছে?
মামুন কিছু বলতে পারল না। চায়ে চুমুক দিতে লাগল। জাহানীরা শাড়ি দিয়ে ফোলা গাল ঢেকে চুপচাপ বসে আছে। তার বসার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে সে প্রশ্নের জবাব চায়।
বলুন কেন আসেন?
আমি আজ উঠি?
উঠবেন তো বটেই। সারাদিন আমার ঘরে বসে থাকার জন্যে আপনি নিশ্চয়ই আসেননি? কেন আপনি আমার কাছে বারবার আসেন একটা বলে চলে যান।
মুনার সঙ্গে আপনার চেহারার খুব মিল আছে। আচার-আচরণও দুজনের এক রকম। দুজনের প্রকৃতিই খুব কঠিন। আপনার সাথে যখন কথা বলি তখন মনে হয় মুনার সঙ্গেই কথা বলছি। এই জন্যেই আসি।
মুনা কে?
ওর সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা।
বিয়েটা কবে?
ওসব চুকে-বুকে গেছে। বিয়ে হচ্ছে না।
কেন, উনার কী অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছে?
না তা হয়নি। ও সে রকম মেয়ে নয়।
এর পরের বার আমি যখন ঢাকা যাব তখন আমাকে উনার ঠিকানা দেবেন। আমি উনাকে বুঝিয়ে বলব।
আপনার ওকালতির কোনো দরকার নেই। আচ্ছা আমি উঠি।
মামুন উঠে দাঁড়াল। জাহানারা বলল, প্লিজ আপনি-একটু বসুন। আমার কথায় রাগ করে এ ভাবে চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
মামুন বসল। দীর্ঘ সময় দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না।