৩১
সেদিন জলকাদায় বৃষ্টিতে গাঁ-গঞ্জের কাঁচা-পাকা রাস্তায় এবং ক্ষেতে খামারে অনেক ঘুরতে হল কৃষ্ণজীবনকে। কারণটা হল নিরুদ্দেশ রামজীবন।
সে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই কান্নার আওয়াজ পেয়েছিল। বাবা আর মা তাকে দেখে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল বটে, কিন্তু মুখে তেমন হাসিখুশি ভাবটা ছিল না। এটা হওয়ার কথা নয়। পথে আসতে আসতে সে পটলের কাছেই শুনে নিয়েছিল ঘটনাটা।
রাঙাকে ডেকে বলল, কেঁদো না বউমা। রেমো কি মাঝে মাঝে এরকম চলে-টলে যায় নাকি?
রাঙা মাথা নিচু করে বলে, গেলে আমাকে অন্তত বলে যায়। কাল কিছু বলেনি। বটতলায় ওর কিছু খারাপ বন্ধু আছে। মাঝে মাঝে এসে খুঁজে যায়। তাদেরই ভয়। মেরে-টেরে ফেলবে কিনা কে জানে?
যে লোকটা খুন হয়েছে সে রেমো নয়, নিশ্চিন্তে থাকো। ভেবো না, আমি খুঁজতে বেরোচ্ছি।
আপনি এতটা পথ এলেন, এখনই বেরোবেন কি? আগে একটু চা করে দিই।
আমি চা বিশেষ খাই না। তবে বৃষ্টির দিন, দাও একটু।
রাঙা দৌড়ে গেল। মুড়ি মেখে চা করে নিয়ে এল। বলল, দুপুরে কী খাবেন বলুন! একটু পোস্ত করি?
কৃষ্ণজীবন হাসল, খাওয়ার সময় হবে কিনা কে জানে! রেমো কোথায় কোথায় যেতে পারে একটা ধারণা দাও তো!
আমাদের কিছু বলে না তো। বটতলার বন্ধুরা জানে হয়তো। কিন্তু তারা যা লোক, কে জিজ্ঞেস করতে যাবে তাদের?
বন্ধুদের নাম জানো?
না, শুধু একজনের নাম শুনেছি, পঞ্চা।
পটল জ্যাঠার কাছ ঘেঁষেই আছে। সঙ্গে গোপাল। পটলের চোখে বিস্ময়ের ঘোর। এই তার জ্যাঠা! তার মস্ত জ্যাঠা! সে পঞ্চা নামটা শুনেই বলল, ওদের আমি চিনি জ্যাঠা। গণেশ, পঞ্চা, চিত্ত, রতন।
বামাচরণ বা শ্যামলী এতক্ষণ ঘর থেকে বেরোয়নি। তারা যে এ বাড়িতে আছে তাই মনে হচ্ছিল না কৃষ্ণজীবনের। হঠাৎ দরজা খুলে বামাচরণ বেরিয়ে এল। পরনে বাইরের পোশাক প্যান্ট আর জামা। মুখে একটু বিগলিত হাসি। জন্মে যা কখনও করেনি আজ হঠাৎ তাই করল বামাচরণ। দাওয়ায় উঠে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে বসল কৃষ্ণজীবনকে।
কৃষ্ণজীবন একটু হাসল, কেমন আছিস রে বামা?
ওই আছি আর কি! তুই ভাল তো দাদা? বাড়ির খবর-টবর সব ভাল?
কৃষ্ণজীবন একটা অস্ফুট হ্যাঁ বলে তার চেয়ে তিন বছরের ছোটো ভাইকে দেখছিল। বামার গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। গাঁয়ের লোক অবশ্য নিয়মিত দাড়ি কামায় না। কিন্তু বামাচরণের মুখে বেশ বয়সের ছাপও পড়েছে, মাথার চুল বিরল হয়ে টাক প্রায় বেরিয়ে পড়েছে। চুল যা আছে তার বেশির ভাগই পাকা। জামা প্যান্ট যেমন ময়লা তেমনি ভাঁজহীন, চেহারা-ছবিতে ভদ্রলোকের ছাপটাই নেই। কৃষ্ণজীবনের ভারি কষ্ট হল দেখে। কেন যে শ্রীহীন হয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছে এরা। বাইরের লোক তাকে আর বামাচরণকে পাশাপাশি দেখলে বিশ্বাসই করবে না যে, বামাচরণ কৃষ্ণজীবনের চেয়ে বয়সে ছোট। কিংবা সম্পর্কে ভাই।
সংসারে যে চাপা আড়াআড়ি তা বুঝতে কষ্ট হল না কৃষ্ণজীবনের। আড়াআড়ি না থাকলে এতক্ষণে বামাচরণের উচিত ছিল রামজীবনের খোঁজে বেরিয়ে পড়া। আড়াআড়িই শুধু নয়, হয়তো ভাগাভাগিও। এ সংসারের সঙ্গে বন্ধন কি ছিন্ন হয়েছে কৃষ্ণজীবনের? সে যে কোনও খোঁজই রাখে না।
বামাচরণের বউ শ্যামলীও এসে প্রণাম করে ঘোমটা টেনে দাঁড়াল। একে সে মুখ চেনে, এক-আধবার দেখেছে।
কেমন আছো বউমা?
ভাল দাদা।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। না, এরা ভাল নেই। একদম ভাল নেই।
প্লাস্টিকের প্যাকেটটা তুলে নিল কৃষ্ণজীবন। সে শাড়ি ভাল চেনে না। দোকানে গিয়ে বাঁশবনে ডোমকানা অবস্থা হয়েছিল তার। মস্ত দোকান, সেলসম্যান শাড়ির পর শাড়ি খুলে দেখাতে দেখাতে পাহাড় করে ফেলেছিল প্রায়। সে অবশেষে সেলসম্যানেরই সাহায্য চাইল অসহায়ভাবে। বহুকাল সে মাকে, বাবাকে, বোনদের, ভাইয়ের বউদের কিছুই দেয়নি। কাজেই মায়ের জন্য গরদ, বাবার জন্য খুব ভাল ধুতি আর বাফতার পাঞ্জাবির কাপড়, বোন আর ভাইয়ের বউদের জন্য পিওর সিল্ক কিনে এনেছে। ভাইপোদের কথা খেয়াল ছিল না। ওদের জন্য টাকা দিলেই হবে।
শাড়ি ধুতি গরদে মলিন বাড়িটা যেন ঝলমল করে উঠল। এমনকি দুশ্চিন্তায় সিঁটিয়ে থাকা রাঙার মুখে অবধি চওড়া হাসি দেখতে পেল কৃষ্ণজীবন। নির্বিকার বিষ্ণুপদ অবধি ধুতিটা পরখ করে দেখল খুব। বাড়িতে একটা হিল্লোল বয়ে গেল।
শাড়ি বুকে নিয়ে টিপ টিপ প্রণাম করল দুই বউ।
সরো আর বীণার শাড়িদুটো কী হবে মা? কৃষ্ণজীবন জিজ্ঞেস করে।
নয়নতারা বলে, রেখে যা। রেমো দিয়ে আসবেখন। বনগাঁয়ে অনেক লোক যায়। আর সরোর বর তো আসে-টাসে। ভাবিস না।
বামাচরণ খুশির গলায় বলল, ও আমিই পৌঁছে দিতে পারব।
কৃষ্ণজীবন মুড়ি আর চা খেয়ে উঠল। বলল, এখনও বেলা বিশেষ হয়নি। রেমোকে যদি কাছেপিঠে পেয়ে যাই তো নিয়ে আসছি। দেরি হলে তোমরা খেয়ে নিও।
রাঙা বলে উঠল, আপনি পটলকে সঙ্গে নিয়ে যান দাদা। ও চেনে সব।
পটল এক পায়ে খাড়া। জ্যাঠার সঙ্গ তার কাছে এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। জ্যাঠার সঙ্গে কথা কইলেই নাকি কত কী শেখা যায়।
বটতলা অবধি অবশ্য তেমন কথা হল না। জ্যাঠা হাঁটে যেন স্টিম ইঞ্জিনের মতো জোরে। তাল রাখতে পটলকে ছুটতে হচ্ছিল।
জ্যাঠা, তুমি কি ওইসব লোকের সঙ্গে কথা কইবে?
না বলে উপায় কি?
ওদের সবাই ভয় খায় কিন্তু।
কেন, কী করে ওরা?
খুন জখম করে, জুয়া খেলে, মদ খায়।
বাবাকে বারণ করতে পারিস না?
ও বাবা! যা মারবে তা হলে!
খুব মারে নাকি?
বম বম করে পেটায়! কিন্তু গোপাল তো দোষ করে না। গোপালকে কেন পেটায় বলো তো।
সত্যিই তো! ও তো বোবা মানুষ।
এমনিতে মারে না। কিন্তু মদ খেলে যেন খুন চাপে।
তুই এত রোগা হয়েছিস কেন?
আমি তো রোগাই।
বড্ড রোগা। স্বাস্থ্য ভাল করে ফেলতে পারিস না?
কিছুতেই হয় না। আমার অমনি চিমসে চেহারা, মা বলে!
বটতলা এখন বেশ জমজমাট জায়গা। দোকান-পাট, বাসের আড্ডা। এমন ছিল না। শীতলা মন্দিরটা ছিল। একটা বটগাছের তলায় হাট বসত সপ্তাহে দু’দিন। কত ফাঁকা ছিল। জঙ্গল ছিল।
আর কাউকে নয়, পঞ্চাকেই পাওয়া গেল চায়ের দোকানে। কালো বেঁটেমততা, দাড়িওলা একটা ছেলে। রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে একটা বেঞ্চে ঝুঁকে বসে আছে।
পটল চাপা গলায় বলে উঠল, জ্যাঠা, ওই পঞ্চা!
কৃষ্ণজীবন বলল, আয় তা হলে, ওকেই জিজ্ঞেস করি।
আশ্চর্যের বিষয় এই, কৃষ্ণজীবন কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পঞ্চা টপ করে উঠে দাঁড়াল। মুখে বিগলিত হাসি, দাদা, কবে এলেন?
আজই সকালে।
অনেকদিন আসেননি বিষ্ণুপুরে!
না।
ভাল আছেন তো?
পটল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পঞ্চা হল এ অঞ্চলের ভয়ের লোক। কাউকে আমল দেয় না। জ্যাঠার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যেন গুরুদেব।
কৃষ্ণজীবন অবাক হল না। সে একে না চিনলেও এ গাঁয়ের সবাই তাকে চিনবে এটাই স্বাভাবিক। সে ছিল এ গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল-করা ছেলে। আজও তার কথা বলাবলি হয়। বিদ্যা সকলের থাকে না, কিন্তু বিদ্বানকে খাতির করে না এমন পাষণ্ডের সংখ্যা—ঈশ্বরের দয়ায়—এখনও কম।
একটা দুটো কথা বলে কৃষ্ণজীবন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, রেমোটার খবর কিছু জানো? সে কাল থেকে বাড়ি ফেরেনি।
রামজীবন! কেন, সে তো কাল পিপুলপাতি গেছে।
পিপুলপাতি? এ দিকে বাড়িতে সবাই ভাবছে।
কী কাণ্ড দেখুন তো। খবর দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কার কাছ থেকে যেন টাকা আনতে যাওয়ার কথা বলছিল।
নাম বলেনি?
না। তবে পিপুলপাতি মাঝে মাঝে যায়।
এখন তো বাস পাবো না, না?
সকালের দিকে দুটো দক্ষিণে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা ফিরল একটু আগে। স্টেশনে যাবে, তারপর আবার ফিরবে। বর্ষার জন্য আরও তিনটে বাস বসে গেছে বলে এই অবস্থা।
বাসটা কখন ফিরবে?
ধরুন তা ঘণ্টাখানেক তো বটেই। বেশীও হতে পারে।
কৃষ্ণজীবন ঘড়ি দেখে নিল। সাড়ে দশটা বাজছে। হেঁটে গেলে সে চল্লিশ মিনিটে পিপুলপাতি পৌঁছে যাবে। অবশ্য গাঁয়ের লোকের দূরত্বের মাপ সম্পর্কে তার বিশ্বাস নেই। এ দেশের গাঁয়ের লোকের দুটি জিনিসের খুব অভাব। সময় আর দূরত্বের আন্দাজ।
পঞ্চা জিজ্ঞেস করল, যাবেন নাকি?
যাবো। ওর বউ খুব ভাবছে।
এসে যাবে ঠিক।
তবু একটু ঘুরেই আসি।
তা হলে এই মাঠ সোজাসুজি যান। রাস্তা আছে। পথ অনেক কম হবে। পাকা রাস্তায় গেলে সময় লেগে যাবে।
কৃষ্ণজীবনের আপত্তি হল না। সে পটলকে জিজ্ঞেস করল, যাবি?
মা তো তোমার সঙ্গে যেতেই বলেছে।
আসি হে পঞ্চা।
আসুন দাদা। আমার সঙ্গে দেখা হলে খবর দিয়ে দেবোখন যে আপনি এসেছেন।
তারপর খেতখামার আর কাদামাটির মধ্যে নেমে পড়ল কৃষ্ণজীবন।
বিষ্ণুপুর তোর কেমন লাগে রে পটল?
ভাল লাগে জ্যাঠা। খুব ভাল লাগে।
কেন ভাল লাগে বল তো! পটল ভাবিত হয়। কেন ভাল লাগে? সত্যিই তো! সে তো জানে বিষ্ণুপুরে তেমন কিছু নেই। এ নাকি গরিবদের জায়গা। কিন্তু তার তবু ভাল লাগে যে।
পটল বলল, এমনিতেই বেশ ভাল লাগে। মা আছে, ঠাকুমা আছে, গোপাল আছে, ইস্কুল আছে।
কলকাতায় ক’বার গেছিস?
দু-তিনবার হবে। তোমার বাড়িতেও তো গেছি জ্যাঠা, তোমার মনে নেই?
আমার সব মনে থাকে। সাততলার বারান্দায় রেলিং-এর ওপর উঠতে গিয়েছিলি বলে বকুনি দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ গো! কী উঁচুতে তোমরা থাকো! ইচ্ছে করলে তো তোমরা উড়ন্ত ঘুড়ি ধরে ফেলতে পারো, না?
তা পারি।
ধরো না?
না। আমার কি আর তোর বয়স আছে?
আচ্ছা, ভূমিকম্প হলে বাড়িটা পড়ে যাবে না তো!
পড়তেও পারে। বিষ্ণুপুর ছেড়ে তোর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না?
খুব করে। যদি তোমার মতো লেখাপড়া শিখতে পারি তবে তো! শিখতে পারলে বিলেত যাবো।
এই যে বললি বিষ্ণুপুরকে ভালবাসিস, তা হলে বাইরে যাবি কেন?
এখানে কিছু নেই যে! কলেজ অবধি নেই।
একদিন হবে। গাঁয়ের দুঃখ কী জানিস? যারা ভাল কিছু করে তারা আর গাঁয়ে থাকে না। সবাই বলে, গাঁয়ে কিছু নেই।
তোমার কি বিষ্ণুপুর ভাল লাগে জ্যাঠা?
খুব লাগে। গাঁয়ে কিছু নেই, এ কথা ভাববি কেন? গাঁয়েই তো ভগবানের সম্পদ ছড়িয়ে আছে। গাছ আছে, মাটি আছে, মস্ত আকাশ আছে। আমি তো ভাবি, একদিন কলকাতা ছেড়ে গাঁয়ে চলে আসবো।
আসবে? বিস্মিত পটলের চোখ বিস্ফারিত হয়।
খুব ইচ্ছে করে।
তা হলে কী মজাই না হবে! তুমি এলে আর ছোট জ্যাঠায় আর বাবায় ঝগড়া হবে না, বাবাও মদ খেয়ে গোপালকে মারবে না, আমি তোমার কাছে কত কী শিখতে পারবো।
তুই আম্বেদকরের নাম শুনেছিস?
না তো! কে?
একজন পণ্ডিত লোক ছিল। সে বলেছে, আগে আমাদের গাঁগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বনির্ভর। মানে জানিস?
জানি।
ঠিক জানিস তো, নাকি ভয়ে বলছিস?
জানি জ্যাঠা। বইতে আছে।
ভাল। আগে আমাদের গ্রামগুলোতেই সব থাকত, কামার, কুমোর, তাঁতি, জোলা, জেলে, চাষা, কবিরাজ, সব।
গল্পের গন্ধ পেয়ে পটল বলল, হুঁ।
তারপর ইংরেজ এল, রাস্তাঘাট করল, আর বড় বড় কল বসাতে লাগল। গ্রামগুলো জুড়ে ছিল গোটা দেশটার অর্থনীতির সঙ্গে। কী হল তাতে জানিস?
না তো!
বড় বড় কলে কাপড় বোনা হতে লাগল, জিনিস তৈরী হতে লাগল, বিলেত থেকেও আসতে লাগল। তাতে কামারের ব্যবসা মার খেল, তাঁতি মাথায় হাত দিয়ে বসল। যে ছোট্ট গ্রামখানা একদিন ডগমগ করত তা হারিয়ে গেল বিরাট দেশের অর্থনীতির সঙ্গে একাকার হয়ে। তোর কি বুঝতে শক্ত লাগছে?
না। একটু একটু বুঝতে পারছি।
এখন একটুই বুঝে রাখ। বড় হয়ে ভাল করে বুঝবি। এই যে বিষ্ণুপুর, একে তো তুই ভালবাসিস!
খুব বাসি জ্যাঠা।
কী করলে বিষ্ণুপুরের ভাল হয় তা জানিস?
না তো!
ভাববি। খুব ভাববি। তোকে ভারতবর্ষ নিয়ে ভাবতে হবে না। শুধু বিষ্ণুপুরের যদি ভাল করতে পারিস তা হলেই হবে। ভাববি বিষ্ণুপুরের দারিদ্র ঘোচাবো, এখানে তাঁত বসাবো, কামারশালা বসাবো, বিষ্ণুপুরের মানুষের তৈরি জিনিসই শুধু বিষ্ণুপুরের মানুষ ব্যবহার করবে।
এখন যে সব মনোহারি জিনিস কলকাতা থেকে আসে!
আসবে। কিছু তো আসবেই। কিন্তু যা গাঁয়েই হয় তা বাইরে থেকে আনবি কেন?
তাতে ভাল হবে জ্যাঠা?
তাতেই ভাল হবে। কিন্তু হবে কিনা তা কে জানে! কিন্তু একবার যদি গাঁয়ের মানুষ সবাই মিলে ভাবে আর কাজে নেমে পড়ে তা হলে বেশ হত। পরের মুখ চেয়ে থাকতে হত না।
আম্বেদকর কি এই কথা বলেছেন?
বড় হয়ে পড়িস। বুঝবি। হ্যাঁ, আম্বেদকর বলেছেন। আরও সব বড় বড় লোক এখন বলছেন।
কী বলছেন জ্যাঠা?
বড় বড় কলকারখানা কমিয়ে দিতে। ধর যদি জাহাজও তৈরি করতে চাস তা হলে তার নানা অংশ তৈরি করার ভার দিয়ে দিলি ছোট ছোট সব কামারশালায়, ছোট ছোট কারিগরদের হাতে। সব যখন তৈরি হল তখন একটা জায়গায় এনে সেগুলো জুড়ে দিলি, এভাবে কত বড় কাজ হয়। কিন্তু এ দেশে তো সেরকম হল না। ইংরেজরা যন্ত্র আনল, আমরা আরও বড় যন্ত্র বানাতে লাগলাম। যন্ত্রে যন্ত্রে দুনিয়াটা ভরে গেল। বাতাস বিষিয়ে গেল। তেল ফুরিয়ে গেল, তোদের জন্য আর পৃথিবীটা তেমন সুন্দর রইল না। তুই বুঝতে পারছিস না, না?
পারছি জ্যাঠা। তুমি বলো না!
বিষ্ণুপুর খুব সুন্দর একটা গ্রাম। এটাকে খুব ভালবাসিস।
বাসিই তো জ্যাঠা।
শুধু ভালবাসলে হয় না। যাকে ভালবাসিস তার ভালর জন্য কিছু করতেও হয়। করবি?
করব জ্যাঠা। তুমি বলে দিও কি করতে হবে।
বলব। আমি সবাইকে শেখাতে চাই। সবাইকে বলতে চাই। কেউ শোনে না।
আমি শুনব।
পিপুলপাতিতে পৌঁছতে পাক্কা একটি ঘণ্টা লাগল তাদের।
ছোট গ্রাম। খোঁজখবর করতেই একজন চাষী বলল, রামজীবন? হ্যাঁ চিনি। ওই তো বিধুবাবুর বাড়িতে যাতায়াত। ওই সাদা পাকা বাড়ি।
বিধুবাবুর বাড়িতেই খোঁজ পাওয়া গেল। রামজীবন কাল রাতে থেকে গিয়েছিল। খুব জলঝড় হচ্ছিল বলে ফিরতে পারেনি। একটু আগে বেরিয়ে গেছে।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল কৃষ্ণজীবন।
পটল!
কী জ্যাঠা?
হেঁটেই ফিরে যাই চল।
চলো না। আমি খুব হাঁটতে পারি।
সাইকেল চালাতে পারিস?
পটল সাইকেলের কথায় টগবগ করে ওঠে। আমি তো সাইকেলের রেস করি। বিষ্ণুপুরে কেউ আমার সঙ্গে পারে না।
সেই পুরনো সাইকেলটা?
হ্যাঁ। বড্ড পুরনো। ঝাঁ-কুরকুর শব্দ হয়।
তোর নতুন সাইকেল কিনতে ইচ্ছে করে।
করে তো।
তা হলে একটা কিনে নিস। আমি টাকা দিয়ে যাবো।
ইস্। না জ্যাঠা, তোমাকে দিতে হবে না।
লজ্জা পেলি নাকি?
পটল একগাল হেসে মাথা নামিয়ে বলে, তুমি কত দিলে সবাইকে, কত টাকা খরচ হয়ে গেল!
তোর বুঝি খুব টাকার হিসেব?
আমরা গরিব যে বড্ড।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃষ্ণজীবন বলে, তাও তুই ভাল আছিস। আমার মতো কষ্ট করতে হয়নি।
আমি শুনেছি জ্যাঠা, তুমি না খেয়ে স্কুলে যেতে।
রোজ নয়, মাঝে মাঝে। কষ্ট করা খুব ভাল। মানুষ কষ্ট করতে যত না চায় তত বেশী কষ্ট পায়। আমি একসময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পেতাম না বলেই আজও ভাতে অমৃতের স্বাদ পাই। যারা রোজ ভালমন্দ খেয়ে বড় হয় তারা খাবারের স্বাদই পায় না। কথাটা বুঝলি?
তোমার কথা আমি সব বুঝতে পারি জ্যাঠা।
খুব ভাল। তুই ভাল ছেলে। পরীক্ষায় কিরকম নম্বর পাস?
মোটামুটি।
অঙ্কে?
পঞ্চাশ ষাট।
দূর বোকা। অঙ্কে পাবি নব্বই থেকে একশ। তবে না!
কেউ শেখায় না যে!
কারও দরকার নেই। শুধু ভাববি, আমি পারব। পারব পারব ভাবতে ভাবতে, বিশ্বাস করতে করতে পেরেও যাবি।
তুমি তাই করতে?
তাই তো। তবে যা পড়বি ভালবেসে পড়বি। যেন নিজের জন্য নয়, অন্যকে শেখানোর জন্য পড়ছিস। তাতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
জলে কাদায়, আঘাটা দিয়ে, নানা অচেনা পথে বিপথে এই যে ঘুরে বেড়াল কৃষ্ণজীবন এটা যেন তার ম্রিয়মাণ জীবনে সঞ্চার করে দিতে লাগল প্রাণশক্তি। সে একদিন ফিরে আসবেই প্রকৃতির কোলে।
তারা যখন ফিরল তখন দুপুর। রামজীবন ফিরে এসেছে। তবু বাড়িটা কেমন যেন হাসিখুশি নয়।
ক্লান্ত কৃষ্ণজীবন উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে মোড়ায় বসল। নয়নতারা একটা হাতপাখা নিয়ে কাছে বসে বাতাস করতে লাগল।
কত কী এনেছিস বাবা! এককাঁড়ি টাকা খরচ হল তো!
তাতে কি মা? কিছু তো দিই না।
দেওয়া তো আছেই। বেঁচে বর্তে থাক, তাতেই আমার হবে।
রেমোকে দেখছি না। কোথায় গেল?
আছে বাবা, দেখবি। আজকের দিনটা মায়ের কাছে থেকে যা না! মায়ে পোয়ে একসঙ্গে একটু গল্প করব। কেমন সাহেব-সাহেব চেহারা হয়ে গেছে তোর। চিনতে পারি না।
সাহেব-সাহেব! কী যে বলো মা!
সত্যি রে। অনেক ফর্সা আর কেমন যেন। আগে যেমন লালমুখো সাহেবদেব দেখতাম তেমনই।
রান্নাঘর থেকে খুব রান্নাবান্নার শব্দ আসছে। আয়োজন হচ্ছে বড় করেই বোধ হয়।
চানটা করে আয় বাবা।
পুকুরে যাবো।
না না, ও পুকুরের জল বড্ড পচে গেছে। কুয়োর জল তুলে দেবেখন পটল।
ঠিক এই সময়ে হঠাৎ ওপাশের ঘর থেকে রামজীবন বেরিয়ে এল। তারপর আর্তনাদ করে উঠল, দাদা!
কৃষ্ণজীবন রামজীবনের দিকে চেয়ে একটু হাসল, আয়।
রামজীবন দাওয়া থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ছুটে এল। তারপর দড়াম করে পড়ল কৃষ্ণজীবনের পায়ে।
দাদা রে!
বলে পায়ে মাথা ঘষে কাঁদতে লাগল রামজীবন।
কৃষ্ণজীবন তুলতে গেল তাকে। শক্ত হাতেও পারল না।
করছিস কী রেমো?
আমাকে ক্ষমা কর দাদা। আমি কুলাঙ্গার। আমি মহাপাপী। আমি অচ্ছুৎ।
রামজীবন একবার মুখ তুলল। সত্যিকারের চোখের জলে তার মুখ ভেসে যাচ্ছে। তবে সেই চোখের জলের কতটা দাম তা কে বলবে? তার মুখ থেকে কাঁচা মদের গন্ধ আসছে ভকভক করে।
কৃষ্ণজীবন এইবার বোধ করল তার দীর্ঘ পথ যাওয়া আসার ব্যর্থ পরিশ্রম। আর ক্লান্তি। রামজীবন সম্পূর্ণ মাতাল।