৩১. জবাদের ঘোড়ার গাড়ির পেছনে

জবাদের ঘোড়ার গাড়ির পেছনে চলতে চলতে সেদিনকার সব ঘটনা মনে পড়তে লাগলো ভূতনাথের। সত্যি সেদিন খুব নেশা হয়েছিল। একবার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়েছিল ভূতনাথের। কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়েও যেন গলা দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরোবে না। কিন্তু ভালো করে চোখ মেলে চাইতেই যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। সামনে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে একটা দশা সই মানুষ! মানুষটার গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠতে হয়েছে। মরা মানুষ! এখানে এমন করে মরলে কি করে লোকটা। পালাতে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল ভূতনাথ। মরা মানুষটা যেন হঠাৎ তাকে চোখ দিয়ে ডাকছে।

–এদিকে আয়, আয় এদিকে, ভয় নেই আমি বদরিকাবাবু।

–বদরিকাবাবু! এতক্ষণে চেনা গেল। সেই তুলোর জামা গায়ে। মোটা-সোটা দীর্ঘ চেহারা। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আবার হাসছেও সঙ্গে সঙ্গে।

বদরিকাবাবু বললে–আমি মরে গিয়েছি।

—কী করে মরলেন?

—ঘড়িতে দম দিতে গিয়ে পড়ে গেলাম উল্টে–ঘড়িও বন্ধ হয়ে গেল, আমার টাক-ঘড়িটাও ভেঙে গিয়েছে, আমারও দম আটকে গিয়েছে।

ভূতনাথ যেন জিজ্ঞেস করলে—মারা গিয়েছেন তো কথা কইছেন কী করে?

—মারা গিয়ে যে ইতিহাস হয়ে গিয়েছি, আমার আর কোনো দুঃখু নেই। ঘড়ি আর চলবে না। বড়বাড়ির ঘড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মোটরগাড়ি এসেছিল সেটা চলে গিয়েছে। এখন বাবুর কয়লার খনি কিনছে। জমিদারী বেচে দিলে—এবার কলির পাঁচ পো, কলি জানিস তো কে? ক্রোধের ঔরসে হিংসের গর্ভে কলির জন্ম। বলে হো হো করে হাসতে লাগলো বদরিকাবাবু। দেখতে দেখতে বদরিকাবাবুর চোখ দুটো জ্বলতে লাগলো। আগুনের ফুলকির মতো। সাদা আর সবুজ আলে সে চোখে। আর তারপর হঠাৎ রং বদলে গেল সে চোখের। লাল হয়ে এল দৃষ্টি। টকটকে লাল। শেষে যেন দুটো স্থির বিন্দুর মতো। লাল বিন্দু দুটো আস্তে আস্তে যেন দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশঃ।

অন্ধকার পরিবেশ। তার মধ্যে সেই লাল দুটি বিন্দু দেখে প্রথমে ভয় হলো ভূতনাথের মনে। তারপর সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেন মনে হলো কারা যেন কথা বলছে। জবার গলা। সুবিনয়বাবুর গলা। সুপবিত্রর গলা। একি, বার-শিমলে এসে গিয়েছে! এতক্ষণে খেয়াল হলো ভূতনাথের যে, সে জবাদের ঘোড়ার গাড়ির পেছন-পেছন বার-শিমলের দিকে চলতে চলতে কদিন আগের ঘটনাগুলোই ভেবেছে শুধু।

জবার গলা কানে এল—হাঁ করে দেখছেন কি ভূতনাথবাবুজিনিষ পত্তর নামাতে হবে না?

সুয়িনয়বাবুও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে তুলতে হবে।

ভূতনাথ এবার এগিয়ে গিয়ে বললে—আমি ধরছি, চলুন।

সুবিনয়বাবু বিছানায় বসে বললেন—এ-বাড়ি করেছিলাম প্রথম ওকালতির আয় থেকে। অনেকদিন পরে আবার এখানে আসছি, অথচ মনে হয় যেন সব সেদিনের কথা। যেবার কেশববাবু সাধনকানন’ খুললেন, সেইবার এই বাড়ি ছাড়ি আমি। কেশববাবুর মতো আমরাও ক’জন মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে সংসার পরিচালনা করতাম, কয়েকবছর ওঁর দেখাদেখি নিজের হাতে রান্না, বাসন মাজা করেছি, মাটির পাত্রে জল খেয়েছি। শেষকালে ‘ভারত-সভার প্রতিষ্ঠা হলো—সে-সভা হওয়ারও একটা ইতিহাস আছে ভূতনাথবাবু। আনন্দমোহন বসু বললেন—আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কোনো সভা-সমিতি নেই, তা ঠিক করলাম তাই-ই হবেআমাদের আপিস হলো তিরেনব্বই নম্বর হ্যারিসন রোডে–এলবার্ট হল-এ এক মিটিংও হয়ে গেল—আর আমাদের দেখাদেখি শিশিরবাবু, ওই অমৃতবাজারের শিশিরবাবুও করলেন ‘ইণ্ডিয়া লিগ’।

হঠাৎ জবা ঘরে ঢুকলো-বাবা, আপনি আবার গল্প করছেন?–না মা, পুরোনো কথা সব মনে পড়ছিল কিনা, তাই–তা পবিত্র কোথায়?

জবা বললে—সুপবিত্র তো সারাদিনই খাটছে, তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম আমি কিন্তু ভূতনাথবাবুকে ছেড়ে দিতে হবে বাবা, ওর এখনও অনেক কাজ বাকি—নতুন বাড়িতে এসে

-তা যাও না, ওকে নিয়ে যাও। আমি পরে গল্প করবো–তোমার কাজটাই তো আগে মা।

অনেক দিনের পুরোনো বাড়ি। নতুন করে এখানে বাস করবেন বলে আবার সব গোছানো হয়েছে। কিন্তু মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসের সে বাড়ির সঙ্গে যেন এর তুলনা হয় না। মাঝখানের একটা ঘর উপাসনার জন্যে রাখা হয়েছে। মাঝখানে শুধু একটা বেদী। কাঠের চৌকির ওপর আর তার চারপাশে শতরঞ্চি পাতা। দেয়ালে জবার মায়ের আর বাবার ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হলো। আর তার ওপরে রাজা-রাণীর ছবি। জবার মায়ের কার্পেটের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো লেখাটাও’গড সেভ দি কিং। ভাঁড়ার ঘরটাই জবার নিজস্ব। রামহরি ভট্টাচার্যের আমলের কিছু কিছু পেতলের বাসন—ঘড়া, কলসী, থালা। বাড়ির লাগোয়া রান্নাঘর। এক একটা জিনিষ নিজে বয়ে নিয়ে এসে সাজিয়ে দিলে ভূতনাথ। এই বাড়িতে বিয়ের পর জবার আর সুপবিত্রের সংসার পাততে হবে।

সুবিনয়বাবুর অবর্তমানে সুপবিত্র এইখানে এসে উঠবে। কাজ শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল ভূতনাথের।

জবা বললে—অনেক রাত করে দিলাম আপনার-একলা যেতে পারবেন তো?

ভূতনাথ বললে—যাবার আগে একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করবো জবা?

-বলুন।

-তুমি বিশ্বাস করো, ননীলালকে আমি পাঠাঁই নি, আমি শুধু বলেছিলাম ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।

—আমি জানি, কিন্তু টাকার কথাটা ও জানলে কি করে?

-সেটা আমিই বলেছি, ওর ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে অনেক সুদ পাওয়া যাবে, তাই বলেছিলাম—আর আমাকে ও চাকরিও করে দেবে বলেছে। সব জায়গায় দেখেছি ওর খুব খাতির, বড়বাড়ির বাবুরা পর্যন্ত, পাথুরেঘাটার হাবুল দত্ত, ছুটুকবাবুর শ্বশুর তিনিও তো ওর সঙ্গে ব্যবসা করেন, গাড়ি কিনেছে, এই বয়সেই জুট মিলের কত শেয়ার কিনেছে, কয়লার খনি করেছে, সায়েবরা পর্যন্ত ওকে টাকা দেয় বিশ্বাস করে, ওকে যদি তারা খারাপ লোকই জানতে তো এমন হয় কী করে! কলকাতায় ওর কী প্রভাব-প্রতিপত্তি জানো তুমি?

—সব জানি ভূতনাথবাবু, সব জানি, আপনাকে আর ননীলালকে আমায় চিনিয়ে দিতে হবে না।

-তা হলে আমার অপরাধটা পেলে কোথায়?

জবা বললে—ওকে যদি আর কখনও এ-বাড়িতে আনেন তো এ-বাড়িতে আপনারও প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ওকে যে সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিই নি, সে শুধু আপনার জন্যে। আমি যখম কলকাতায় প্রথন এলাম, আমাকে পড়াতে মেমসাহেব, ছিলাম বলরামপুরে গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণের ঘরে, হলাম একেবারে রাতারাতি মেমসাহেব, কিন্তু আমার সামাজিক শিক্ষাদিক্ষার সব গোড়া পত্তন যে সেখানেই হয়ে গিয়েছিল, তা ছাড়া বাবা আমাকে শিখিয়েছেন কাকে বলে মানুষ হওয়া, আমি ননীলালের কথায় ভুলিনি।

—কিন্তু এখন তো দেখছি টাকারই সম্মান দেয় লোকে—কত হাজার টাকা ও চাদা দিয়েছে জানো চারদিকে?

জবা হাসলো। বললে—আপনার রাত হচ্ছে, আপনি বাড়ি যান। একথা বলতে আরম্ভ করলে আর শেষ হবে না—মাঝে-মাঝে এসে দেখা করে যাবেন। নতুন বাড়িতে, নতুন পাড়ায় এসেছি সামনে সুপবিত্রর পরীক্ষা, ও হয় তো সব সময় আসতেও পারবে না।

ভূতনাথ তখনও দাঁড়িয়ে রইল। শুধু বললে—আমাকে আসতে বলা মানে কিন্তু কাঙালকে শাকের ক্ষেত দেখানো।

-আসবেন, যখন ইচ্ছে হবে, চলে আসবেন, বাবার স্বাস্থ্য খারাপ, আর তা ছাড়া বিয়ের সব কাজের ভার তো আপনাকেই নিতে হবে, সুপবিত্রও একলা সব পারবে না, আর আমিও না— হয় তো এমনি করে কষ্ট দেবো, খাটিয়ে নেবে রোজ।

—এমন খাটুনি খাটতে আমার কষ্ট নেই জবা।

জবা হাসলো। বললে—শেষে হয় তো একদিন আর দেখাই করবেন না ভয়ে। তারপর যখন একদিন আপনারও সংসার হবে, বিয়ে হবে তখন মনেও পড়বে না আর।

ভূতনাথ কী ভাবলো। তারপর বললে—আমার তো ওই দোষ, ভুলতে পারি না কাউকে ভুলতে পারলে তো বেঁচে যেতাম। যারা আমাকে ভুলে গিয়েছে তাদেরও মন থেকে দূর করতে পারি না।

–কিন্তু মনে রাখবেন, মনে রাখার দায়িত্বটা যেখানে একজনেরই, সেখানেই সম্পর্কটা চিরস্থায়ী হয়।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু সে দায়িত্বটা দুজনের হলে কত চমৎকার হতো!

—তেমন ভাগ্য সংসারে ক’জনের হয়? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমিও বুঝি সেই হতভাগ্যদের মধ্যে একজন?

জবা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বললে—আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দেবো না—কিন্তু রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনার বাড়ি যেতে অসুবিধে হবে না তো?

ভূতনাথ এবার উঠলো। বললে—এবার আমি খুশি মনে বাড়ি যাবো জবা, কারণ আমার প্রশ্নের জবাব আমি পেয়ে গিয়েছি।

–ছাই জবাব পেয়েছেন—বলে জবা হাসতে লাগলো।

ভূতনাথ পেছন ফিরে দাঁড়ালে আবার। বললে—তবে কি ভুল হলো আমার?

জবা বললে—না, দেখছি আপনার বাড়ি যাবার ইচ্ছে নেই মোটে।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু না শুনে যে যেতে পারছি না।

—আপনি অদ্ভুত মানুষ তো, সারাদিন এত খাটালুম, তবু আপনার ঘুম পায় না—দেখুন তো, এতক্ষণ বোধ হয় সুপবিত্র খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

-কিন্তু আমি তো অত ভাগ্যবান নই।

—যান, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করুন, আমি চললুম—আমার অনেক কাজ বাকি এখনও।

এর পর ভূতনাথ চলেই এসেছিল সেদিন। রাত্রে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুম আসেনি তার। বাইরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিঝুম নিস্তব্ধ ঘর। মাঝরাতে শুধু গেট খোলার ঘড়ঘড় শব্দে বোঝা গিয়েছিল মেজবাবু ফিরেছে। ঘোড়া দুটো বার দুই ডেকে উঠেছিল। লোকজনের কথাবার্তা। গেট বন্ধ করার আওয়াজ। তারপর আস্তাবল বাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। দক্ষিণের পুকুরের দিকে একটা কী পাখী খানিকক্ষণের জন্যে “একটানা ডেকে-ডেকে উড়ে গেল কোথায়। আর কোনো শব্দ নেই। তারপর থেকে অপরূপ এক স্তব্ধতা। সে স্তব্ধতারও বুঝি এক মানে আছে। এই স্তব্ধতার মধ্যে ভূতনাথের নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। প্রথমে মনে পড়ে রাধার কথা। রাধা একদিন বলেছিল—অমন করে নজর দিও না বলছি ভূতনাথদা।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—কেন, নজর দিলে কী হয়?

রাধা বলেছিল—নজর দেওয়া বুঝি ভালো, আর আমি যদি নজর দিই?

ভূতনাথ বলেছিল—দে না, নজর দে, কোথায় নজর দিবি দে।

খানিকক্ষণ কী ভেবে রাধা বলেছিল—এখন তো নজর দেবে, তোমার বউ আসুক, তখন নজর দেবে।

তা সে নজর দেবার আর সুযোগ পায় নি রাধা। পেটে ছেলে নিয়ে মারা গেল একদিন। তারপর আন্না। আন্নাও কত হাসি খুশি ছিল। যেখানে থাকতে সব সময়ে হেসেগল্প করে জমিয়ে রাখতো। ব্রজরাখালের বিয়ের দিন বাসরঘরে আন্না কী হাসিই না হেসেছিল। সেই আন্না! সেই আন্নার সঙ্গেই বোধ হয় দেখা হয়ে গিয়েছিল সেদিন। বড় অপ্রত্যাশিত সে দেখা! ভালো করে স্পষ্ট দেখা যায় নি, কথাও হয় নি কিছু। কিন্তু আন্নাকে দেখেও যেন কষ্ট হয়েছিল খুব ভূতনাথের।

কালীঘাটের দিকে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। পোষ-কালী দেখতে বহুদিনের সাধ ছিল তার। ধর্মতলার ওদিকটা হাঁটতে হাঁটতে লম্বা রাস্তা ধরে যাওয়া।

বাঁ পাশে কিছুদূর সাহেব-মেমদের বাড়ি আর দোকান। আর ডানদিকটায় কেবল মাঠ। মাঝে-মাঝে গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়া। ফিরিওয়ালা বসে বসে আক কেটে বিক্রি করছে। দাড়িগোঁফ, মাথার চুল কামিয়ে দিচ্ছে নাপিতরা। দলে দলে সব লোক হেঁটে চলেছে কালীঘাটে কিম্বা দর্শন করে ফিরে আসছে। কালীবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই একজনকে দেখে মনে হয়েছিল–আন্না না!

বার-বার চেয়ে দেখেছিল ভূতনাথ। ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা। থান কাপড় পরনে। কোলে একটা এক বছরের মেয়ে, সঙ্গে আরো চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে। সবাই ছোট ছোট। বয়েসে দু’এক বছরের তফাৎ সব। সঙ্গে সধবা শাশুড়ী বোধ হয়। জ্বল জ্বল করছে সিঁদুর সিঁথিতে। পাকা চুলের ওপর সিঁদুর পরেছেন শাশুড়ী। আন্না বোধ হয় নাকে নথও পরতে সধবা অবস্থায়। নাকে এখনও ফুটোর দাগটা স্পষ্ট। বার-বার কেমন যেন মনে হয়েছিল-ও আন্নাই, আর কেউ নয়। তারপর এক সময় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল আন্না। কিন্তু ফিরে আসবার পথে আবার সেই দলটার সঙ্গে দেখা।

চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে আন্নার হেঁটে চলেছে চৌরঙ্গীর পাশের মেটে রাস্তা ধরে। সঙ্গে একজন কে পুরুয় মানুষ আছে। আগে-আগে চলেছে। এক একবার পেছনে ফিরে ডাকে— একটু পা চালাও-পা চালিয়ে এসো না—মশাই-এর বাড়ি কোথায়?

ভূতনাথ চেয়ে দেখলে ভদ্রলোকটি তাকেই প্রশ্ন করছে। বললে আমার বাড়ি ফতেপুর-নদে জেলায়।

—মশাই-এর নাম?

–ভূতনার চক্রবর্তী।

ভদ্রলোক বললে বেশ ভালোই, আমরাও নদে জেলার লোক –ওগো পা চালিয়ে এসো, রেল পাবো না—তা কী করা হয়?

ভূতনাথ একে-একে নিজের সবিস্তার পরিচয় দিয়ে গেল। দলটি তখন কাছে এসে পড়েছে।

ভদ্রলোক বললে—হ্যাঁ গো, আমার বৌমার বাপের বাড়ি ফতেপুরে, না?

ভূতনাথ এক ফাঁকে চেয়ে দেখলে বিধবা মেয়েটি যেন লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিলে। তবু সম্পূর্ণ ঢাক বার আগে যেন একটু দেখা গেল চোখটা। ভূতনাথের দিকেই চেয়ে আছে!

–অ বৌমা, একটু জোরে হাঁটো বাছা, রেল ছেড়ে দিলেই চিত্তির–

যেটুকু দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল, তা-ও দমন করে নিলো ভূতনাথ। দলটা তখন জোরে জোরে পা চালিয়ে চলেছে। ভূতনাথ ইচ্ছে করেই পেছনে চলতে লাগলো। হয় তত আন্নাই হবে! আন্না যদি হয়, একবার পেছন ফিরে দেখবে নিশ্চয়ই। কিন্তু অনেকক্ষণ এক দৃষ্টে চেয়েছিল ভূতনাথ। বিধবা মেয়েটি একবারও আর পেছন ফিরলো না। ছোট মেয়েকে কোলে করে আস্তে আস্তে ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আসলে হয় তো ও আন্না নয়! কিম্বা হয় তো আন্নাই। কে জানে!

আর হরিদাসী! হরিদাসীর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয় নি জীবনে। তা জীবনে সকলের সঙ্গে দেখা কি হয়! এক একজন লোক জীবনে এক রাত্রের অতিথি হয়ে আসে, তারপর ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়। এই হয় তো নিয়ম এ-সংসারে।

মনে আছে চোরকুঠুরির ভেতর শুয়ে শুয়ে কেবল এইসব চিন্তাতেই অনেক রাত পর্যন্ত কেটেছিল। তারপর বুঝি শেষ রাত্রের দিকে ঘুম এসেছে। সকাল হতেই আবার সেই ছক-বাঁধা জীবন। দাসু জমাদারের উঠোন ঝাঁট দেওয়ার শব্দ। মেজবাবুর গাড়ি বোয়া-মোছা। ঘোড়ার ডলাই-মলাই আর আস্তাবল বাড়ির মাথায় হয় ব্রিজ সিং, নয় তো নাথু সিং-এর ডন-কুস্তির হুম-হাম শব্দ। ভূতনাথের কিন্তু কোনো কাজ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *