৩১. চোখ খুলল হায়দার

একত্রিশ

চোখ খুলল হায়দার। এখনও ভোর হয়নি। কিন্তু আকাশে লালের ছোপ লেগেছে। জানলা থেকে মুখ সরিয়ে সে তক্তপোশের দিকে তাকাল। আকাশলাল ঘুমাচ্ছে পাশ ফিরে। একদম সুস্থ মানুষের মতো ঘুমাবার ধরন। দেখতে দেখতে পাঁচ দিন হয়ে গেল এখানে। এই পাহাড়ি উপত্যকার ছোট্ট গ্রামটিতে মানুষজন কম, তাদের কৌতূহলও বেশি নয়। ভ্যানটাকে নিয়ে দলের অন্যেরা চলে গেছে আরও উত্তরে। এই বাড়িটা যার সেই বুড়ো বড় ভাল মানুষ। লোকটা ঘুমাচ্ছে পাশের ঘরে। বিপ্লবের শুরুতেই ওর দুই ছেলে প্রাণ হারিয়েছিল শহরে কিন্তু তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ করেনি একবারও। খাবার দাবার ও-ই এনে দিচ্ছে।

জানলার পাশে ইজিচেয়ার পেতে আধশোওয়া হয়ে হায়দারের দিনগুলো কাটছিল। এখানে বসার প্রধান কারণ জানলা দিয়ে অনেকটা দূর দেখা যায়। পুলিশ যদি খবর পেয়ে আসে তাহলে অন্তত মিনিট পাঁচেক সময় পাওয়া যাবে। পালাতে না পারলে লড়ে মরার সুযোগ পাবে। তাই ঘুম এবং জাগরণের মধ্যে পাঁচটা দিন কেটে গেল। এই কটা দিন পৃথিবী থেকে সে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এ ঘরে টিভি নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ছোট রেডিও আছে একখানা। তা-ই বাজিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করেছে কিন্তু নতুন কিছু জানতে পারেনি। ত্রিভুবন ঠিকঠাক সীমান্ত পার হতে পারল কিনা সেই চিন্তাও হচ্ছে। দুই ডাক্তারকে সীমান্তের ওপাশে পৌঁছে না দিতে পারলে সব কিছু ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সে চলে আসার আগে নির্দেশ দিয়ে এসেছিল সমস্ত অ্যাকশন বন্ধ রাখতে। কদিন সব চুপচাপ থাকবে এমন কথা হয়েছে।

হায়দার আকাশলালের দিকে তাকাল। গতকাল মানুষটা অনেক স্বাভাবিক আচরণ করেছে। কথা বলেনি কিন্তু উঠে বসে ছিল। হায়দার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘খারাপ লাগছে?’

মাথা নেড়ে না বলেছিল। ‘খিদে পাচ্ছে?’ একইভাবে হ্যাঁ বলেছিল। হাঁটিয়ে পাশের টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার সময় হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল। ওষুধের ঘোর চলছে এখনও। হায়দার আর কথা বাড়ায়নি।

ভোর হচ্ছে। একটু একটু করে আলো ফুটছে। ডুবে যাওয়ার আগে শুকতারার দপদপানি বেড়ে গিয়েছে। সব কিছু যদি ঠিকঠাক চলে তাহলে মাসখানেকের মধ্যে শহরে ফিরে যেতে হবে। ভার্গিসকে এর মধ্যেই সাসপেন্ড করা হবে। বোর্ড মিনিস্টারের ওপরেও আস্থা রাখতে পারবে না। টালমাটাল ব্যাপারটা চূড়ান্ত অবস্থায় যাওয়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তবে তার আগে সবাইকে সংগঠিত করা প্রয়োজন। ম্যাডামের কাছে কৃতজ্ঞতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার আকাশলাল তাকে কখনও এসব কথা জানায়নি। মেলার মাঠে যাওয়ার আগে শুধু তাকে বলেছিল প্রয়োজন হলে ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। চমকে উঠেছিল হায়দার। ‘ম্যাডাম?’

‘হ্যাঁ। অবাক হোয়ো না। রাজনীতি করতে হলে অবাক হতে নেই।’

‘কিন্তু ম্যাডাম তো আমাদের প্রতিপক্ষ।’

‘হ্যাঁ। তবে ম্যাডামের প্রতিপক্ষ হল বোর্ড। কিন্তু সেটা তিনি ওদের জানতে দিতে চান না। আমরা বোর্ডের ধ্বংস চাই শুধু এই কারণেই ম্যাডামের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব করতে পারি।’

‘বন্ধুত্ব!’

‘হ্যাঁ, রাজনৈতিক বন্ধুত্ব।’

ব্যাপারটাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও আকাশলালের তথাকথিত মৃত্যুর পরে ম্যাডামের নির্দেশ এসেছিল। নির্দেশই বলা উচিত। উত্তরের জন্যে ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করেননি। এই যে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা তাও ভদ্রমহিলার পরামর্শে। এবং এই সব পরামর্শ এখনও তাদের বিপদে ফেলেনি। চোখ বন্ধ করল হায়দার। তার ঘুম পাচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে। রাতে যে অনিশ্চয়তা থাকে দিনে সেটা কমে যায়। ঘুমিয়ে পড়ল হায়দার।

পাশ ফিরতেই মাথার বাঁ দিকে সামান্য অস্বস্তি শুরু হয়েই মিলিয়ে গেল। চোখ খুলল সে। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। সে চোখ খুলে শুয়ে ছিল কিন্তু প্রথমে কিছুই দেখছিল না। এবং তারপরেই সে তলপেটে চাপ অনুভব করল। গতকাল থেকে সে এইরকম হলেই টয়লেটে যাচ্ছে। তার আগেও বিছানাতে করতে হত না। একটা লোক তাকে খুব সাহায্য করছে। যে মানুষ সাহায্য করে তার মুখ এবং ব্যবহার থেকে সেটা বোঝা যায়।

সে এবার মুখ ফেরাল। মাথার ওপরে কাঠের সিলিং। বিছানাটাও ঠিক পরিষ্কার নয়। এই ঘরে তেমন আসবাব নেই। অথচ কিরকম আসবাব থাকলে ‘তেমন’ ঠিক হত তাও সে বুঝতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে তেমন নেই। ধীরে ধীরে মাথা তুলল সে। আধাবসা অবস্থায় সে লোকটিকে দেখতে পেল। জানলার পাশে একটা লম্বা চেয়ার পেতে আরামসে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় না শুয়ে ওই রকম ঘুম কেন? হঠাৎ তার মনে হল লোকটা তাকে পাহারা দিচ্ছে না তো। সেটা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু ওই লোকটা এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে কোনওরকম শত্রুতা করেনি বরং তার কষ্ট কমানোর চেষ্টা করেছে। লোকটার মুখের দিকে ভাল করে তাকাতেই মনে হল কার সঙ্গে যেন খুব মিল আছে। কার সঙ্গে? কিছুতেই সে নামটা মনে করতে পারল না। আর এই চেষ্টা করতেই মাথাটা যেন ভোঁ ভোঁ করে উঠল। চোখ বন্ধ করল সে। তারপর ধীরে ধীরে খাট থেকে নামল। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই টলে উঠল সে। সেটা সামলে ধীরে ধীরে টয়লেটের মধ্যে ঢুকে গেল।

শরীর হালকা হবার পর ও মুখ তুলতেই অদ্ভুত একজনকে দেখতে পেল। দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব কাহিল হওয়া চোখ। সে মুখ ফেরাতেই লোকটা মুখ ফেরাল। ওর মুখের বাকি অংশ ব্যান্ডেজের আড়ালে রয়েছে। নিজের মুখে হাত দিতে সামনের লোকটাও তাই করল। হঠাৎ তার মাথায় খেয়ালটা এল। সামনের দেওয়ালে একটা সস্তা আয়না টাঙানো রয়েছে। সেখানে তারই মুখ ফুটে উঠেছে। মুখে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন? সে ঈষৎ চাপ দিল, কিন্তু তেমন ব্যথা লাগল না। তার কি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল? মাথার ওপরটাতেও কোনও চুল নেই কেন? এত বীভৎস দেখাচ্ছে যে নিজের দিকে তাকাতে তার বিতৃষ্ণা লাগল।

ধীরে ধীরে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এল সে। লোকটা এখনও ঘুমাচ্ছে। লোকটা কে? বিছানায় ফিরে এসে শুয়ে পড়তেই মনে হল কী আরাম। এইটুকু হাঁটতেই যেন সে ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করল। লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে। এবং তখনই সে খেয়াল করল আর কোনও চেনা মুখ সে মনে করতে পারছে না। শুধু মুখ নয়, নামও। তার কোনও পরিচিত মানুষের মুখ এবং নাম মনে আসছে না। কেমন শীত শীত করতে লাগল তার। পৃথিবীতে সে কি একা? তার কেউ নেই?

এই সময় দরজায় শব্দ হতেই সে বুঝতে পারল লোকটা যে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল, লাফিয়ে উঠল। চোখ অল্প খুলতেই সে দেখতে পেল লোকটা হাতে কিছু ধরে রয়েছে। চাপা গলায় ওকে বলতে শুনল সে, ‘কে? কে ওখানে?’

বাইরে থেকে গলা ভেসে এল, ‘আমি। ঘুম ভাঙল?’

পায়ের আওয়াজ হল। অর্থাৎ চেনা লোক বুঝতে পেরে লোকটা দরজা খুলতে গেল। সে আবার চোখ বন্ধ করল। তার মনে হল সে এখন কোথায় আছে তা জানতে হলে চুপ করে থেকে ওদের কথা শুনতে হবে। আচ্ছা, ঘুমের ভান করে থাকলে কেমন হয়? দরজা খোলার শব্দ হল। একটা সরু গলা কানে এল, ‘বস এখন কেমন আছে? ঘুম হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। খুব ভাল ঘুমিয়েছে। দরজাটা বন্ধ করে দাও বুড়ো।’

‘আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন হায়দার সাহেব। আমার গ্রামের কেউ জিন্দেগিতে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। এই যে আপনারা পাঁচদিন এখানে আছেন কেউ বিরক্ত করেছে? কাছেই আসেনি। বরং সবাই লক্ষ রেখেছে বইরের কোনও ঝামেলা যেন না আসে।’

‘আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’

‘এইসব কথা বলবেন না। বস্ মরে গিয়েছে খবর পেয়ে কী কষ্ট না পেয়েছিলাম। তখন কি জানি ওসব পুলিশকে ভাঁওতা দেবার জন্যে। লোকে কিন্তু এখনও জানে বস্ মরে গেছে।’

‘তুমি আবার গল্প করতে যেয়ো না।’

‘মাথা খারাপ! নিজের কবর নিজে যে খোঁড়ে আমি তার দলে নেই।’ লোকটা এগিয়ে এল কাছে। তারপর জিভ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করল, ‘ইস, কি চেহারা ছিল, কি হয়ে গেছে!’

‘একটু চা খাওয়া যাবে?’

‘চা? হ্যাঁ। আসছে।’

‘আমি তোমাকে বলেছি অন্য কাউকে এখানে পাঠাবে না।’

‘এই যাঃ। খেয়াল ছিল না। মেয়েটা বলল চা নিয়ে যাচ্ছি আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম।’

‘মেয়ে? মেয়ে আবার কোথায় পেলে?’

‘আমি পাব কেন? আমার ভাইয়ের মেয়ে। খুব ভাল কিন্তু একটু বদমায়েসও। আচ্ছা, বস্-এর মুখ থেকে এসব কবে খোলা হবে?’

‘ডাক্তার বলেছে সাতদিন পরে।’

‘মুখে কি হয়েছে? কদিন থেকে জিজ্ঞাসা করব বলে ভাবছিলাম। মাথায় চোট লাগলে মুখে ব্যান্ডেজ করা হবে কেন?’ মানুষটা যেন ঝুঁকে দেখছিল।

‘মুখেও চোট লেগেছে।’

‘আমাদের গ্রামে অবশ্য ভয় নেই তবে ওরা এখানেও বস্-এর পোস্টার ঝুলিয়েছিল। আমরা অবশ্য সেই পোস্টার ছিড়ে ফেলেছিলাম। সেই যে গো, মৃত বা জীবিত আকাশলালকে—।’ বুড়োর গলা থেমে গেল দরজায় শব্দ হতে। বাইরে থেকে কেউ বলল, ‘চা।’ এই গলা পুরুষের নয়। সে শুনল বুড়ো বলছে, ‘দিয়ে যা। দিয়েই চলে যাবি।’

‘বাব্বা। আমি যেন চোর ডাকাত। তাড়াতে পারলে বাঁচে।’ ঘরের মধ্যে মেয়েদের গলা শোনা গেল, ‘একজন তো এখনও শুয়ে আছে। খুব মারপিট করেছিল, না?’

‘তুই এখান থেকে যাবি?’

মেয়েটি হেসে বেরিয়ে গেল। বুড়ো বলল, ‘বসকে তুলতে হবে?’

‘আমি ডাকছি। তুমি মেয়েটিকে এখানে আসতে দিয়ে ঠিক করোনি বুড়ো। এইসব গল্প আর পাঁচজনের কাছে করবে ও।’

‘মেরে মুখ ভেঙে দেব না?’ বুড়ো বলল।

সে কাঁধে স্পর্শ পেল। খুব আস্তে কেউ তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। চোখ না খুলে পারল না সে। মুখের সামনে পাহারাদার লোকটা। একে যেন কি নামে ডেকেছিল বুড়ো? হায়দার। হ্যাঁ, হায়দার। নামটা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হায়দার বলল, ‘গুড মর্নিং। কেমন লাগছে?’

মাথা নেড়ে ভাল বলল সে। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে লোকটার সঙ্গে তার ভাল পরিচয় ছিল।

আবছা আবছা কিছু কিন্তু ঠিক জুড়ছে না সেগুলো।

‘উঠতে পারবেন? চা এসে গেছে।’

ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। তার মনে হল কিছু খাওয়া দরকার। খিদে পাচ্ছে খুব।

‘টয়লেট যেতে পারবেন?’

প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সে বুড়োর দিকে তাকাল। না, একেও সে কখনও দেখেনি। এ কোথায় রয়েছে সে? হায়দার ওর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতেই চোখ গেল সেদিকে। কোনও কিছুই যে তার মনে পড়ছে না এমন নয়। কিন্তু মনে পড়ে যাওয়ার মুখেই কেউ যেন দ্রুত জল ঘোলা করে দিচ্ছে। কোনও ছবি ঠিকঠাক তৈরি হচ্ছে না তাই।

অর্ধেক খাওয়ার পর ইচ্ছেটা চলে গেল। মনে হল পেট ভরে গেছে। এখন শুয়ে পড়লেই আরাম। সে সেই চেষ্টা করলে হায়দার বাধা দিল, ‘না, না, আপনি টয়লেট থেকে ঘুরে আসুন আমি ততক্ষণে বিছানাটা চেঞ্জ করে দিচ্ছি। উঠে পড়ুন।’

বুড়ো এগিয়ে এল। ওর হাত ধরে খাট থেকে নামাল। টয়লেটের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আপত্তি করল। টয়লেটে যাবে না। বুড়ো ওকে জানলার পাশে নিয়ে আসতেই সে ইজিচেয়ারে বসে পড়ল। শরীর এগিয়ে নিয়ে বাইরে তাকাল। নীল আকাশে আলোর আভা! আঃ, কী সুন্দর? মন ভরে গেল।

‘বস্। আমাকে চিনতে পারছ?

সে মুখ ঘোরাল। বৃদ্ধ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে অদ্ভুত অভিব্যক্তি।

না সে চেনে না। কোনও দিন দেখেনি। কিন্তু এ-কথাটা যে বলা যাবে না তা সে বুঝতে পারল। অতএব তাকে হাসতে হল। সেই হাসি দেখে লোকটি খুব খুশি হল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘আমি জানতাম বস্-এর স্মৃতিশক্তি আমাদের অনেকের চেয়ে ভাল। অতদিন আগে দেখা হয়েছে অথচ ঠিক মনে আছে। আপনার জন্যে খুব চিন্তায় ছিলাম বস্। আপনি চলে গেলে এই দেশে আর কোনও নেতা থাকত না।’

তার মানে আমি নেতা! সে মনে মনে বলল।

হায়দার এগিয়ে এল, ‘আমাদের যেখানে আশ্রয় নিতে হয়েছে সেখানে কোনও ডাক্তার নেই। তবু আমি শহর থেকে একজনকে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি। আপনার শরীরে এখন কি কি অসুবিধে হচ্ছে?’

‘বুঝতে পারছি না। খুব দুর্বল লাগছে আর মাথা ঘুরছে।’ সে কথা বলল। বলতে গিয়ে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করল সে।

‘দুর্বল তো হবেনই। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে ধকল গিয়েছে! আমরা তো আপনার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। যে অপারেশন আপনার ওপর করা হয়েছে তা পৃথিবীতে আগে কখনও হয়নি। আপনি তো সবই জানেন।’ হায়দার ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছিল।

অপারেশন? কি অপারেশন? আবছা আবছা কিছু মনে পড়ছে তার। কি সেগুলো? সে মাথা নাড়ল।

‘আপনাকে খবরগুলো জানানো দরকার। আপনার হার্ট অ্যাটাক হবার পর আপনি তো এখন পর্যন্ত কিছু জানেন না। ডেডিভ সুড়ঙ্গ থেকে বের হতে পারেনি। আপনাকে ভার্গিস কবর দিয়েছিল সেই রাত্রেই। আমরা খুব দ্রুত আপনাকে সুড়ঙ্গ পথে বের করে নিয়ে আসি। অ্যাম্বুলেন্সে করে লেডি প্রধানের বাড়ি নিয়ে যাই।’ একের পর এক ঘটনাগুলো বলে যেতে লাগল হায়দার। তারপর থেমে গেল, ‘আপনি শুনেছেন, ভেডিভ নেই।’

মাথা নাড়ল সে। ‘হ্যাঁ, শুনলাম।’

ও।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বাকিটা বলতে লাগল হায়দার। আকাশলালের এমন নির্লিপ্ত আচরণ তার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। লোকটা কি সুস্থ? ওর কি মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ করছে? কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল তার। কথা শেষ হওয়ামাত্র সে হাত তুলল, ‘আমি একটু বিশ্রাম চাই, আমাকে একা থাকতে দাও।’

হায়দার বলল, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। বুড়ো, চলো বাইরে যাই।’

বৃদ্ধ দ্রুত বেরিয়ে যেতেই হায়দার চাপা গলায় বলল, ‘এখানকার কারও সামনে আপনার মুখের ব্যান্ডেজ খোলা ঠিক হবে না। লোকে আপনার আগের মুখটা মনে রেখেছে। প্লাস্টিক সার্জারির পর কি দাঁড়িয়েছে তা বেশি লোককে না জানানোই ভাল।’ হায়দার বেরিয়ে গেল ছোট রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে।

সে নিজের মুখে হাত দিল। অর্থাৎ তার মুখেও অপারেশন করা হয়েছে। সে নেতা। তার নাম আকাশলাল? কিসের নেতা? কী করেছিল সে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে গিয়ে মাথার যন্ত্রণাটা ফিরে এল। চোখ বন্ধ করে থাকল সে।

পাহাড়ি গ্রামটা বেশ ছোট। বুড়োকে পাহারায় থাকতে বলে হায়দার এগিয়ে গেল খাদের দিকটায়। এখানে সব ভাল শুধু রেডিও চালালেই মানুষ কাছে এসে শোনার চেষ্টা করে। সমস্ত পৃথিবীতে যেখানে টিভি অ্যান্টেনা ছেয়ে গেছে, এখানে রেডিওর জন্যেও কিছু লোক কৌতূহলী। কাছেপিঠে মানুষ নেই দেখে হায়দার নব ঘোরাল। ভ্যানটার ফিরে আসার কথা দিন কয়েক বাদে। তার মানে আগামী কাল। ওই ভ্যানে ওয়ারলেস সেট রয়েছে। কিছু আধুনিক অস্ত্র আছে। ওটা চলে এলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হবে না। রেডিওতে নানান শব্দ হচ্ছিল। অনেকগুলো স্টেশন একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সে শহরটাকে ধরতে পারল। দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। শালা। তারপরেই মনে হল শুনতে খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে সে খুব কাছাকাছি রয়েছে। শত্রুর সান্নিধ্যেও নিজেকে একা বলে মনে হয় না। গান শেষ হল। এরপর খবর শুরু হল। এই পাঠকের গলা নতুন মনে হল। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও সুদৃঢ় করার জন্যে বৈদেশিক ঋণ আসছে। শহর থেকে উগ্রপন্থীদের নির্মূল করা হয়েছে। মৃত আকাশলালের লাশ উদ্ধার করতে অক্ষম হওয়ায় পুলিশ কমিশনার ভার্গিসকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্র থাপা নতুন পুলিশ কমিশনার হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। পূর্বতন কমিশনার ভার্গিসের দেশসেবার কথা মনে রেখে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, তবে তিনি সবরকম সরকারি সুযোগ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারপরের খবরগুলো নেহাতই জোলো। ভার্গিস আর নেই এই খবরটা হায়দার কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অমন প্রতাপশালী কুখ্যাত পুলিশ অফিসারকে বোর্ড সরিয়ে দিতে পারল? ওরা ভুল করল। থাপা একটি গোবেচারা অফিসার। ভার্গিসের ক্ষমতার এক দশমাংশ ওর নেই। ভার্গিসের চলে যাওয়া মানে বিপ্লবের পথ আরও পরিষ্কার করা। আকাশলাল প্রায়ই বলত ভার্গিসের পরে যে লোকটা আসবে আমাদের উচিত তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। একসময় মনে হয়েছিল সোম সেই লোক। এখন জানা গেল থাপা পুলিশ কমিশনার হয়েছে। থাপার সঙ্গে কোন যোগাযোগ তৈরি করতে কি পেরেছিল আকাশলাল?

‘গান শুনব?’ আদুরে গলায় চমকে তাকাল হায়দার। বুড়োর ভাইঝি। হ্যাঁ, শরীর বটে! বুকের ভেতর টিপটিপ করে উঠল হায়দারের। সে বলল, ‘এই যা, ভাগ।’

‘এমা! আমি কি কুকুর যে ওই ভাবে কথা বলছ!’ মেয়েটা হাসল, ‘তুমি দিনরাত ওই ব্যান্ডেজে মোড়া লোকটাকে পাহারা দাও কেন বলো তো?’

‘তোর কি?’

‘লোকটার কি হয়েছে গো? অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল এতদিন?’

‘বুড়োকে জিজ্ঞাসা কর। সে-ই বলবে।’

‘ওম্মা! তুমি একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পার না? আমি কি দেখতে খারাপ! জানো, আমার জন্যে চার পাঁচ ক্রোশ দূরের গ্রামের ছোকরারা এখানে ঘুরে বেড়ায়। আমি পাত্তা দিলে এতদিনে দশ বারোটা বাচ্চা হয়ে যেত।’

কথাটা শশানামাত্র অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল হায়দার। এরকম কথা জীবনে শোনেনি সে। মেয়েটা বোকা বোকা চোখে চেয়ে দেখে বলল, ‘পাগল।’ বলে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। হাসি থামিয়ে ওর যাওয়া দেখল হায়দার। না, সত্যি বয়স হয়ে যাচ্ছে। নিজের জন্যে ভাবার সময় পায়নি কতকাল। মেয়েমানুষের কথা চিন্তা করেনি কতকাল! বিপ্লব শেষ হয়ে গেলে দেশে শান্তি ফিরে এলে চিন্তা করা যাবে এমন ভাবতে ভাবতে হয়তো দিন চলে যাবে। তার যদি কোনও বদ ইচ্ছে থাকত তাহলে এই মেয়েটাকে ঠকিয়ে—। না, মাথা নাড়ল সে।

বুড়োকে চলে যেতে বলে ঘরে ঢুকল হায়দার। বুড়ো জানে আকাশলাল এই ঘরে আছে, সে মারা যায়নি। কিন্তু ওর সামনে ব্যান্ডেজ খোলা যাবে না। আকাশলালের পরিবর্তিত মুখ সে ছাড়া কেউ জানবে না। বুড়োও যেন ওকে দেখে চিনতে না পারে। হায়দার দেখল আকাশলাল ঘুমাচ্ছে। নার্স তাকে যে-সমস্ত ওষুধ খাওয়াতে বলেছিল তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে দরজা বন্ধ করতে আকাশলালকে চোখ খুলতে দেখল।

হায়দার বলল, ‘একটা সুসংবাদ আছে। ভার্গিসকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

‘ভার্গিস?’ বুঝতে পারল না সে।

‘আমাদের কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার। এখন রাস্তার লোক, কমনম্যান! ওর জায়গায় যাকে ওরা প্রমোশন দিয়েছে সে-ব্যাটা এক নম্বরের হাঁদা।’

‘কে?’

‘থাপা। বীরেন্দ্র থাপা। তার মানে এখানে পুলিশ আর কখনও আসবে না।’

‘কেন?’

‘থাপার ক্ষমতা হবে না এত দূর ভাবার। ভার্গিস ভাবতে পারত।’

‘আমার খিদে পেয়েছে।’

‘বিস্কুট খাবেন! আপেলও আছে।’

‘বিস্কুট? ঠিক আছে।’

বস্তুটি দেখে চিনতে পারল সে। আপেলটাকেও। এগুলো চিনতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু ভার্গিস নামটাকে অচেনা মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবগুলো খেয়ে নিল সে।

হায়দার বলল, “আজ রাত্রে আপনার ব্যান্ডেজ খুলব।’

‘কেন?’

‘খুলতে তো হবেই। ওটা খোলার পর আপনি আর আকাশলাল থাকবেন না। কি নাম নেওয়া যায়? চন্দ্রকান্ত। সুন্দর নাম। কি বলেন?’

‘ঠিক আছে।’

‘কাল ভ্যান এলে আমরা শহরে যাব। কাল থেকে আপনি সবার সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারবেন কিন্তু কেউ আপনাকে চিনতে পারবে না।’

‘কেন? চিনতে পারবে না কেন?’

ঝট্ করে হায়দারের চোখে সন্দেহ জ্বলে উঠল। সে হাসার চেষ্টা করল, ‘আপনি আমাকেও পরীক্ষা করার চেষ্টা করছেন? আপনার মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে যাতে কেউ আপনাকে দেখে চিনতে না পারে। পুলিশ বোকা বনে যাবে।’

সে হাসল। ওই হাসিটা দেখে হায়দারের মন শান্ত হল। হ্যাঁ, তাকে পরীক্ষা করছিল লোকটা। শুধু কথাটা যেন বড় কম বলছে এই যা।

সারাটা দিন শুয়ে শুয়ে সে অনেক ভাবল। তার নাম আকাশলাল। সে নেতা। তার একটা দল আছে। পুলিশ বোধহয় তাকে খুঁজছে। নইলে বোকা বনে যাওয়ার কথা বলবে কেন হায়দার?’

সন্ধের পর একটু শুয়ে ছিল হায়দার। এখানে রাতের খাবার বিকেল বিকেল এসে যায়। একটু দেরি করেনি, খেয়ে নিয়ে গা এলিয়ে ছিল ইজিচেয়ারে।

খাওয়া দাওয়ার পর টয়লেটে ঢুকে ব্যান্ডেজে হাত দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজের বাঁধন খুলতে লাগল। একটু একটু করে পাতলা হয়ে যাচ্ছিল সেটা। শেষ বাঁধন সরে যেতেই প্যাড দেখতে পেল। প্যাডের নীচে মোটা তুলো। সেগুলো চামড়ায় আটকে আছে। আয়নায় নিজের মুখ দেখল সে। মুখভর্তি সাদা সাদা চাপ তুলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *