চারদিকে আগুনের শিখার ভেতরে কী করে ঢুকে পড়ে কেরামত আলি আর বেরুতে পারে না। আগুনের আভায় একটা মুখ চেনা চেনা ঠেকে; বলতে কি সেদিকে তাকিয়েছিলো বলেই সে আগুনের মধ্যে আটকে পড়ে; নইলে পালাবার সুযোগ হয়তো ঠিকই পাওয়া যেতো। মুখটা কার গো? লম্বাটে কালো মুখে আগুনের আঁচ, তার চোখে আগুনের শিখা দাউদাউ করে। আগুন লাগলো কি ওই চোখ থেকেই? মুখটাকে ঠাহর করার আগেই কেরামতের ঘুম ভাঙে আলিম মাস্টারের ডাকে, গফুর তোমাক সকাল সকাল যাবার কয়া গেলো। আজ বলে পারানিপাড়ার ইস্কুলের ফিল্ডে সভা।
সভার কথায় কেরামত ভাবনায় পড়ে। সেখানে তার পাকিস্তানের গান গাইবার কথা। কিন্তু কোনো শোলোকই তো মাথায় আসে না। সারাটা দিন তার কাটে ইসমাইলের ভোটের লোকজনের সঙ্গে, রাত হলে শুয়ে থাকে আলিম মাস্টারের পাশে। ভোটের হৈ চৈ তার মন্দ লাগে না, অনেক রাত্রি পর্যন্ত গোলাবাড়ি হাটে হট্টগোল, তার মধ্যেও ঝুঁদ হয়ে থাকা যায়। কিন্তু আলিম মাস্টারের পাশে শুতেই তার ঘুম পায়, ঘুমালেই আজকাল খালি দেখে আগুন লাগার খোয়াব। আগুনছিটানো চোখজোড়া প্রথমে মনে হয়েছিলো ফুলজানের, ঐ ঘেগি মাগী ছাড়া তাকে ওভাবে পোড়াতে আসবে আর কে? কিন্তু তার মুখ কি অমন লম্বাটে? না-কি তার ওই মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। কিছুতেই? রাত্রে শোবার আগে আলিম মাস্টার পর্যন্ত বলে, কেরামত পাকিস্তানের গান তোমার লেখাই লাগবি। ইসমাইল সাহেবের তদবিরেই তুমি পুলিসের হাত থাকা বচিছছা। হয় তার ফরমায়েশ মতো গান বান্দো, না হলে জয়পুর পাঁচবিবির ঘাটা ধরো। তেভাগার গান তো তোমার মেলা লেখা আছে। লীগের ছেড়াগুলান যাই বলুক, আধিয়াররা ব্যামাক পিঠটান দিছে, এটা বিশ্বাস হয় না বাপু।
কিন্তু শোলোক বাঁধতে গেলেই লম্বাটে একটা মুখ থেকে আগুনের আঁচ এসে লাগে তার মাথায়, হয়তো সেই মুখটা ভালো করে দেখার আশাতেই ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে, সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আলিম মাস্টারের ডাকে বিছানা থেকে উঠে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলে মাথায় আসে পয়ারের দুটি লাইন,
ভারতবর্ষে কায়েম করো আজাদ পাকিস্তান।
মোসলমানের সকল দুঃখের হইবে অবসান।।
কিন্তু জুতের গান হয় না। এর পরের লাইনগুলোর মিল পাওয়া যায় তো কথা পুরুষ্টু হয় না, কথা যদি মনমতো হয় তো মিল খুঁজে পাওয়া দায়। তা হলে কি তাকে চেরাগ আলি ফকিরের মতো ভরসা করতে হবে পাওনা-গানের ওপর? আরে দূর! ফকিরালি গান দিয়ে কি আর মিটিং জমানো যায়? তবে তার সাগরেদি মেনে নিলে হয়তো কেরামতের গলায় গান চলে আসতো আপনাআপনি। না, তাই বা হয় কী করে? তমিজের বাপ তো তার খাস মানুষ। সে যে কী জানে আর না জানে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না। এই যে মাঝিদের জুম্মাঘরে আবোর মানুষটা মিনমিন করে যে কী বললো, শরাফত মণ্ডল। তাকে মারধোর করেছে কি-না, কীভাবে অপমান করলো, শরাফতের খড়মের মধ্যে সে লোহার পান্টি দেখে কীভাবে, কিছু বোঝা গেলো? তমিজের বাপের সেইসব মারফতি না আজগুবি বুলি কেরামত নিজের ইচ্ছামতো বাঁকাচোরা করে পেশ করলো বলেই না। মাঝিরা এমন চেতে উঠলো! ঘুমের মধ্যে হোঁচট না খেয়েও হাঁটা ছাড়া চেরাগ আলি আর কোন বিদ্যাটা তাকে দিয়ে গেছে? মাঝিপাড়ার মানুষ কি শুধু এ জন্যেই তমিজের বাপকে এতো মান্যিগন্যি করে? চেরাগ আলি তার ছেঁড়াখোঁড়া বইটা রেখে গেছে। তমিজের বাপের হেফাজতে, তবে কি লোকটা তার সব তেজ পায় ঐ বই থেকে? জয়পুরে তো চেরাগ আলি বারবার বলেছে, লেখাপড়া করার সুযোগ তার কখনো ঘটে নি। এমনি বিনয়ে তার মাথাটা সবসময় নুয়ে থাকলে কী হয়, লেখাপড়া না জানার দাপটে বুড়া অহঙ্কারে টইটুম্বর হয়ে থাকতো, তার মূর্খতা ঘোষণা করতে সে একেবারে পটু, তোমরা বাপু নেকাপড়া জানা মানুষ, নিজেরা গান লেখো, গানের বই ছাপো। হামার তো বাপু সেই মুরাদ আল্লা দেয় নাই। হামার ইগলান পাওনা-গান, দাদা পরদাদার দোয়ায় আর ওস্তাদের দয়ায় বুকের মধ্যে কাঁপে, হামি দোতারাত হাত দিলেই গলা দিয়া বারায়া আসে। ক্যাংকা কর্যা আসে সিটা কবার পারি না বাপু। ফকির কতো কায়দাই জানতো, অনেক লোকের সামনে গান করতে করতে হঠাৎ থেমে একটু দম নিয়ে বলতো, পরের কথাগুলো বানাও তো বাপু। কেরামত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে থাকলে ফকির বলতো, পারবা না। হামিও কি পারি? কেরামত এখন নিশ্চিত তার সব রহস্য গোপন করা আছে ঐ বইয়ের মধ্যে। লেখাপড়া না জানার জন্যে এতো যে দাপট মারতো, তবে ঐ বইটা কি তার বাল হেঁড়ার জন্যে?
ভর দুপুরবেলা তমিজের বাড়ির সামনে গিয়ে কেরামত আস্তে করে ডাকে, তমিজের বাপ, ও তমিজের বাপ, বাড়িত আছে নাকি গো?
ভেতর থেকে সাড়া দেয় কুলসুম, বাড়িত নাই।
হামাক না আসবার কলো। কেরামতের গলাটা কাঁপে, এক্ষুনি তো তাকে সে দেখে এলো গোলাবাড়ি হাটে। ভোটের আর একদিন বাকি, মাঝিপাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে কালাম মাঝি ক্যানভাস করে বেড়াচ্ছে, তাদের খাওয়াদাওয়া পানবিড়ির খরচ সব কালাম মাঝির। এসব খবর কুলসুমের সব জানা, কালাম মাঝি ভাত খিলাচ্ছে। ভোট হলে বলে তার বেটা খালাস পাবি, সেই খুশিত বুড়া বাড়িত আসে আত হলে।
হুঁ, তাক তো হাটোত দেখলাম। মিথ্যা কথা বলে ধরা পড়ার ভয়ে কেরামত কৈফিয়ৎ দেয়, তা মনে হলো, এতোক্ষণ কি আর বাড়িত আসে নাই।
এখন আর আসবি না। বাড়িত কেউ নাই তো।
তুমি তো আছো। বলেই ভয় পেয়ে কেরামত বলে, তমিজের বাপ কলো, হামার বাড়িত আজ চারটা ভাত খায়া যায়য়া।
ভাত খাবেন? বলে কুলসুম দরজা খুলে দিয়ে নিজে চলে যায় উঠানে। উঠান থেকে দেখা যায়, লোকটার মুখ খিদায় শুকনা। মাথায় বড়ো করে ঘোমটা দিয়ে কুলসুম। নিজের ভাতটা সবই একটা সানকিতে ঢেলে দেয়, বলে, খেসারির ডাল আছিলো কালকার। ঐ দিয়াই খাওয়া লাগবি।
কেরামত ভাত খায় আর আড়চোখে বসে থাকা কুলসুমকে দেখে। তার মুখে রোদ লেগে তার কালো মুখে তাপ বেড়ে উঠছে তা আন্দাজ করতে পারে সে এখান থেকেই। এই তাপ বাড়তে বাড়তেই তো আগুন জ্বলে উঠবে। তাই না? আজকাল রোজ দেখা স্বপ্নের মুখটা তো ভালো করে ঠাহর করা যায় না, এর সঙ্গে কি তার কোনো মিল আছে। নাকি? তার খাওয়া হতে থাকে আস্তে আস্তে, সে কেবল দরজার ওপারে ভেতরের বারান্দায় বসে থাকা কুলসুমের একদিকের গাল দেখে। একটা শোলোক যেন মাথায় তার একটু একটু খোঁচা দিচ্ছে। কেরামত তার নজর সরায় না, তার ভয়, নিজের চোখটাকে একটু এদিক ওদিক করতে দিলেই কালো মুখটা হারিয়ে যেতে পারে। খোয়াবে। আগুন জ্বলে দুনিয়া আসমানে।—এই তো শোলোক তো তার আসছে। কিন্তু না, এতে তার কথা বেরিয়ে আসছে না। না গো। শোলোক বুঝি তার জীবনে আর লেখা হবে না। ভাত খেয়ে খিদে তার মেটে, কিন্তু হঠাৎ করে মাথাটা ব্যাথায় টনটন করে। বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে দেখে, দুপুরের রোদের আঁচে চৈত্রের শিমুল জ্বলছে দাউদাউ করে। দুপুরের তাপে শিমুল ফুল থেকে রক্ত ফোটে আর ফেটে পড়ে সাদা তুলা হয়ে।
ফের ভাতের সানকিতে মন দিলে নতুন একটা চরণ আসে তার মাথায়, আগুনের। এতো রূপ নাই কোনোখানে। না, ঠিক হচ্ছে না। খাওয়া হয়ে গেলে সানকিতেই হাত ধুতে ধুতে কেরামত মরিয়া হয়ে বলে, তোমার দাদার বইখান একবার দেখবার চাইছিলাম।
দরজাত বসেন। হামি বই বার করি।
ঘরের বাইরে দরজার চৌকাঠে বসে কেরামত ফের চৈত্রের দুপুর দেখে। খোয়াবে আগুন জ্বলে দুনিয়া আসমানে, এর পরের লাইনটি জুত করে মনে করার জন্যে মুখে মুখে। সে নানান কথা বিড়বিড় করে, ভেতরে মাচায় খসখস আওয়াজ শুনে তার বুক ছমছম করে, ফকির কি এসে হাজির হলো নাকি? ঐ মাচা থেকেই তো সে একদিন বেশ লম্বা গান করলো একটা। আবার তার খুশিও লাগে ফকিরের ছায়া একবার যদি তাকে ছোয়, তা হলে হয়তো গান তার গলায় আসবে আপনাআপনি। কিন্তু ভয়ে ভয়ে ও একটু আশায় আশায় আবছা অন্ধকার ঘরে ভাবে, না, ফকির আসবে কোত্থেকে? মাচার ওপর কুলসুম। নাকের কাছে তার দাদার বই নিয়ে প্রাণপণে সে ওটার গন্ধ শুকছে। কেরামতের গলা শুকিয়ে যায়, গন্ধে গন্ধে কুলসুম কি বইয়ের সব কথা শুষে নিচ্ছে? গন্ধে গন্ধে সব টেনে আত্মসাত করে তার হাতে তুলে দেবে বইয়ের একটা ছিবড়ে? বইয়ের সব অক্ষর শুকে সাদা পাতা দেখিয়ে কুলসুম কি চেরাগ আলির নিরক্ষতা প্রমাণ করে ছাড়বে?
বইটা নিয়ে মাচা থেকে কুলসুম নামলে কেরামত তার দিকে হাত বাড়ায়। বই তার হাতে দিতে দিতে কুলসুম বলে, বই দেখ্যা দিয়া যান।
কেরামত হঠাৎ বুকে বল পেয়ে বলে, যদি না দেই?
না, এই বই এটি থাকবি। ঐ বই দিয়া আপনে কী করবেন?
বইয়ের পাতা ওলটায় আর কেরামত আলি দেখে, কোনোখানে কোনো শোলোকই নাই। খাকি রঙের কাগজে বইয়ের মলাট সেলাই করা, সেখানে কার কাঁচা হাতের লেখা, খাবনামা ফালনামা ও তাবির। এসব খাবনামা তো কিনতেই পাওয়া যায়। তবে এটার ভেতরে ছাপা কোনো পাতা নাই। অর্ধেকের বেশি পাতা জুড়ে চৌকোণা চৌকোণা দাগ, সেইসব বর্গক্ষেত্র আবার ভাগ করা হয়েছে ছোটো ছোটো ঘরে। একেকটি ঘরে একেকটি আরবি অক্ষর। নাপাক শরীরে আরবি লেখা ছুঁয়ে ফেলায় কেরামতের একটু একটু ভয় করে, কিন্তু এখন অজু করতে গেলে বইটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সে আস্তে আস্তে পাতা ওল্টায়, জীর্ণ পাতা, ধরতে হয় সাবধানে, একটু এদিক ওদিক হলেই পাতা ছিড়ে যাবে। এরপর গোটা গোটা বাঙলা অক্ষরে নানারকমের খোয়াবের বিবরণ। কোন খোয়াব দেখলে কী হতে পারে, এর ফলাফল কী, খোয়াবের তাবির সব বুঝিয়ে বলা। মুনসি কি এখান থেকেই মানুষকে সব খোয়াবের বৃত্তান্ত বলে দিতো? কিন্তু বইয়ের। কোথাও কোনো শোলোক লেখা নাই। তা কেরামত তো খাবনামা অনেক দেখেছে, শান্তাহারে এক লোক কেরামতের কবিতার বই বেচতো, সে আবার খাবনামা, মকসুদুল মোমেনিন, বেহেশতের জেওর—এসব বইও বেচতো। ওসব অবশ্য ছাপানো বই, সবই কলকাতায় ছাপা। তা এই বইটা কি কেবল হাতের লেখা বলেই এতো দামি? না-কি। মুনসির শোলোকের ইশারা সব দেওয়া রয়েছে ঐ আরবি অক্ষরগুলোর ভেতরে? ঐ চৌকোণা রেখাগুলো দেখে আর কেরামত মুনসির পাওনা-গানের ইশারা খোজে হন্যে হয়ে। কিন্তু সমস্ত মনোযোগের ওপর তার মাথায় দপদপ করে জ্বলে কুলসুমের মুখ। বইয়ের দিকে তাকিয়েই সে বোঝে কয়েকদিন ধরে তার খোয়বে আগুনলাগা ঘরে যে মুখটি দেখা যাচ্ছে সেটা হলো কুলসুমের মুখ। কুলসুমের চোখ থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে তার ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে দাউদাউ করে। চারকোণা রেখার বর্গক্ষেত্র দেখতে দেখতে কেরামতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, খোয়াবে আগুন জ্বলে দুনিয়া আসমানে। আল্লা সেই রূপ রাখিয়াছে এইখানে কিন্তু শোলোক কেরামতের মনমতো হয় না, সে অস্থির হয়ে বইয়ের পাতা ওলটাতেই জীর্ণ পাতার একটু ছিড়ে গেলে কুলসুম চট করে তার মাথার ওপর ঝুঁকে পড়ে, বই ছিড়িচ্ছেন কিসক? দাও হামার হাতে দাও। কিন্তু কেরামতের মাথা এখন জ্বলছে দপদপ করে, জুতমতো শোলোক না পেলে এখন সে বাঁচবে না। খোয়াবের আগুন এসে ধরে যাচ্ছে তার মাথার ঝাঁকড়া চুলে, তাপে সে। ছটফট করে। মনমতো না হলেও ঐ দুটো লাইনই সে বিড়বিড় করে আওড়ায়।কিন্তু হলো না। হচ্ছে না।
তার বিড়বিড় ধ্বনি শুনে কুলসুম তাকায় ঘরের মাচার দিকে। কুলসুম ফিসফিস করে বলে, বই দেন। দাদা আসিচ্ছে, দাদা বই উটকাবি। কিন্তু বইয়ের জন্যে সে আর হাত বাড়ায় না, বরং হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কেরামতের দিকে। কেরামত বিড়বিড় করে, আগুনে জ্বলিল মুখ দেখিয়াছি কোথা। খোয়বের সেই মুখ রহে এই হেথা। কিন্তু হয় না। শোলোক তার গানে খটখট করে, তেলের মতো গড়িয়ে পড়ে না। কুলসুম বলে, এই শোলোক তো দাদা কোনোদিন কয় নাই। কুটি পালেন আপনে?
বারবার বিড়বিড় করেও কেরামত মনমতো শোলোক আর পায় না। কুলসুম তার অসন্তুষ্ট আবৃত্তি শোনে আর কেঁপে কেঁপে ওঠে, কাঁপতে কাপতেই বলে, দাদা এই শোলোক তো কোনোদিন কয় নাই গো। মনে হয় মরার পরে এটা পাছে। দাদার লতুন পাওনা-গান, মরণের পরে দাদা তোমাক শোলোক দিলো? কুলসুম বড়ো ধান্দায় পড়ে, তমিজের বাপের সঙ্গে সঙ্গে কেরামত আলিও কি চেরাগ আলির সাগরেদ হয়ে গেলো? এই বইয়ে কি তবে কেরামতের অধিকার রয়েছে। এখন সে কী করবে? কেরামতকে বই দিয়ে দেওয়ার জন্যে চেরাগ আলি কি ইশারা পাঠিয়ে দিলো? এখন সে করে কী?
তবে কুলসুমের এই সমস্যার সমাধান করে দেয় কেরামত নিজেই, মনমতো শোলোক আসছে না দেখে এমনিতেই সে বলতে গেলে কাতর, এর ওপর আবার তার। শোলোক-সন্ধানে অন্য কাউকে কৃতিত্ব দেওয়া, একটু রাগ করেই কেরামত বলে, আরে তোমার দাদা এটা পাবি কুটি গো? শোলোক বান্দিলাম হামি। তোমাক দেখ্যা খুশি হলাম, শোলোক বান্দিলাম।
ও, এটা তা হলে কেরামতের পাওনা-গান নয়, এমন কি চেরাগ আলির মারফতেও সে এটা পায় নি। এ আবার কেমন ধারার মানুষ গো, যে কি-না নিজের মুখে ফাস করে দেয়, সে নিজেই শোলোক বাঁধে। তার দাদা চেরাগ আলি, যখন তখন তার মুখে এ শোলোক এসেছে গায়েবি জায়গা থেকে, সেই জায়গার খোঁজ জানতো একমাত্র চেরাগ আলি নিজে। আর তারই খোজে উত্তর সিথানে পাকুড়তলায় রাতবিরেতে ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছে তমিজের বাপ। আর কোথাকার কোন কেরামত আলি, তার দাদার বইয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা পেয়ে যা বলে তাই আবার চালায় নিজের বাধা শোলোক বলে।। কুলসুম খুব ঝুঁকে প্রায় ছোঁ মেরে বইটি তুলে নেয় কেরামতের কোল থেকে।
কুলসুমের রাগের তাপ লাগে কেরামতের মুখে, তার ঝাঝ লাগে তার চোখে। তার কাতর মাথা ব্যথায় নুয়ে আসে। বই নিয়ে মাচায় উঠে কুলসুম তার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলে তপ্ত চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। ঐ আগুনের শিখা লাগে কেরামতের শরীরে এবং দেখতে দেখতে সব তাপ জমা হয় তার মাথায়। ঘরের চালের ফুটো দিয়ে রোদের রোগা একটা রেখা এসে কুলসুমের মুখে সত্যি সত্যি আগুনের আভা জ্বালিয়ে দিলে কেরামত বোঝে, সে আসলে স্বপ্ন দেখছে। কোন স্বপ্ন-না, কয়েকদিন থেকে দেখা স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটছে আজ তমিজের বাপের ঘরে। কিন্তু আজকের স্বপ্নের নতুন উপসর্গ প্রচণ্ড মাথাব্যথা। ভেতরে মগজ তার অাগুনের তাপে গলে গলে পড়ছে। ভয়ে, ব্যথায়, কষ্টে, উদ্বেগে ও উৎকণ্ঠায় তার গোটা থাই কাপে প্রবল বেগে।।
কেরামত আলি তার উথাল পাতাল মাথাটা নিচু করতেই মগজ সব তোলপাড় করে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এই দুটি লাইন :
এ জেবনে রূপ যদি দেখিয়াছি কোথা।
খোয়াবে আগুন মুখ নাহিক অন্যথায়।।