৩১. গাযওয়ায়ে মুরাইসী’র পরের সামরিক অভিযানসমূহ

গাযওয়ায়ে মুরাইসী’র পরের সামরিক অভিযানসমূহ

১. দিয়ার বনু কালব অভিযান দুমাতুল জানদাল ক্ষেত্রে (سَرِيَّةُ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ بْنِ عَوْفٍ إِلٰى دِيَارِ بَنِيْ كَلْبٍ بِدَوْمَةِ الْجَنْدَلِ):

৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এ অভিযান প্রেরিত হয়। রাসূলে কারীম (ﷺ) দলনেতাকে সামনে বসিয়ে স্বীয় মুবারক হাতে তাঁর পাগড়ি বেঁধে দিয়ে অভিযানে উত্তম পন্থা অবলম্বনের জন্য পরামর্শ দান করেন। তিনি এ ব’লে তাঁকে উপদেশ প্রদান করেন যে, ‏(‏إِنْ أَطَاعُوْكَ فَتَزَوَّجْ اِبْنَةَ مُلْكِهِمْ‏) ‘যদি তারা তোমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় তাহলে তুমি তাদের সম্রাটের মেয়েকে বিয়ে করে নেবে। আব্দুর রহমান বিন আওফ গন্তব্য স্থলে পৌঁছার পর একাদিক্রমে তিন দিন যাবত ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন, ইসলামী জীবনধারার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যগুলো এবং মুসলিমগণের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা মুসলিম হয়ে যায়। অতঃপর আব্দুর রহমান বিন আওফ তুমাজির বিনতে আসবাগকে বিয়ে করেন। ইনিই ছিলেন আব্দুর রহমানের পুত্র আবূ সালামাহর মাতা। এ মহিলার পিতা স্বজাতির নেতা এবং বাদশাহ ছিলেন।

২. ফাদাক অঞ্চলে দিয়ারে বনু সা‘দ অভিযান (سَرِيَّةُ عَلِىِّ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ إِلٰى بَنِيْ سَعْدِ بْنِ بَكْرٍ بِفَدَك):

৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে আলী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানের কারণ ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিশেষ সূত্রে অবগত হয়েছিলেন যে বনু সা‘দ গোত্রের একটি দল ইহুদীদের সাহায্য করার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। এর প্রতিকারার্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে দু’ শত মর্দে মুজাহিদের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। এরা রাত্রিতে ভ্রমণ করতেন এবং দিবাভাগে আত্মগোপন করে থাকতেন। অবশেষে শত্রুপক্ষের একজন গোয়েন্দা তাঁদের হাতে ধরা পড়ে। সে স্বীকার করল যে খায়বারের খেজুরের বিনিময়ে তারা সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে এ সংবাদও সংগৃহীত হল যে, বনু সা‘দ গোত্রের লোকেরা কোন্ জায়গায় অবস্থান করছে। প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে মুসলিম বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে পাঁচশত উট ও দু’ হাজার ছাগল হস্তগত করেন। তবে শিশু ও মহিলাসহ বনু সা‘দ গোত্রের লোকেরা পলায়ন করে তাঁদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়। তাদের নেতা ছিল অবার বিন আলীম।

৩. ওয়াদিল কুরা অভিযান (سَرِيَّةُ أَبِيْ بَكْرِ الصِّدِّيْقِ أَوْ زَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ إِلٰى وَادِيْ الْقُرٰي):

এ অভিযান প্রেরণ করা হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর রমযান মাসে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) কিংবা যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হত্যার জন্য বনু ফাযারা গোত্রের একটি শাখা শঠতা ও চক্রান্তমূলক এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের এ জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক মুজাহিদ বাহিনীসহ আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সালামাহন বিন আকওয়ার বিবরণ সূত্রে জানা যায়, তিনি বলেছেন যে, ‘এ অভিযানে আমিও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ফজরের সালাত আদায় করার পর তাঁর নির্দেশক্রমে আমরা শত্রুপক্ষের উপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে ঝর্ণার উপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলাম। অধিকার প্রতিষ্ঠার পর শত্রুপক্ষের কিছু সংখ্যক লোককে হত্যা করা হল। এদের অন্য একটি দলের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। এদের সঙ্গে মহিলা এবং শিশুও ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল যে, লোকজন আসার পূর্বে এরা পর্বতের উপর পৌঁছে না যায়। এ জন্য দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে তাদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলাম এবং তাদের ও পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি তীর নিক্ষেপ করলাম। তীর দেখে তার থেমে গেল। এ দলের মধ্যে ছিল উম্মু ক্বিরফাহ নাম্নী এক মহিলা যিনি পুরাতন চর্ম নির্মিত পোশাক পরিহিতা ছিলেন। তার সঙ্গে ছিল তার এক কন্যা। এ কন্যাটি আরবের সুন্দরী মহিলাদের দলভুক্ত ছিল। আমি তাদেরকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট নিয়ে এলাম। অতঃপর এ কন্যাটিকে আমার নিকট সমর্পণ করা হল। কিন্তু সে যে পোশাকে ছিল সে পোশাকেই রইল। এর মধ্যে তার পোশাক পরিবর্তন করা হয় নি।’ পরে রাসূলে কারীম (ﷺ) এ মহিলাকে সালামাহ বিন আকওয়ার নিকট থেকে চেয়ে নিয়ে মক্কায় প্রেরণ করেন এবং বিনিময়ে কিছু সংখ্যক মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করিয়ে নেন।[1]

উম্মু ক্বিরফাহ ছিল একজন শয়তান মহিলা। নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার জন্য সে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং এতদুদ্দেশ্যে স্বীয় পরিবার থেকে ত্রিশটি সওয়ারীর ব্যবস্থা করেছিল। তার এ ষড়যন্ত্র ও দুষ্কর্মের প্রতিফলস্বরূপ ত্রিশ জন সওয়ারীকেই হত্যা করা হয়েছিল।

৪. উরানিয়্যীন অভিযান (سَرِيَّةُ كُرْزِ بْنِ جَابِرِ الْفَهْرِيْ إِلٰى الْعُرَنِيِّيْنَ):

৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে কুরয বিন জাবির ফিহরী (রাঃ)-এর[2] নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানের পটভূমি হচ্ছে, উকাল এবং উরাইনাহর কতগুলো লোক মদীনায় আগমন ক’রে ইসলাম গ্রহণ করে সেখানে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাঁদের স্বস্থ্যের জন্য অনুকূল না হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কতগুলো উটসহ তাদের চারণ ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেন এবং স্বাস্থ্যোদ্ধারের উদ্দেশ্যে উটের দুধ ও প্রস্রাব পান করার পরামর্শ দেন। অতঃপর লোকগুলো যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখন একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রাখালকে হত্যা করে উটগুলো খেদিয়ে নিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করল। এভাবে ইসলাম গ্রহণের পর পুনরায় তারা কুফুরী অবলম্বন করল। উল্লেখিত কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের খোঁজ করার জন্য কুরয বিন যাবের ফাহরীকে বিশ জন সাহাবাসহ প্রেরণ করেন। এ বাহিনী প্রেরণের সময় নাবী কারীম (ﷺ) এ প্রার্থনা করেছিলেন,

‏(‏اللّٰهُمَّ أَعَمِّ عَلَيْهِمْ الطَّرِيْقَ، وَاجْعَلْهَا عَلَيْهِمْ أَضْيَقُ مِنْ مَسَكٍ‏)‏

‘হে আল্লাহ! উরানিয়্যানদের পথ অন্ধকার করে দাও এবং কঙ্কণ চাইতেও বেশী খাটো করে দাও। প্রিয় নাবী (ﷺ)-এর প্রার্থনা মঞ্জুর করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের পথ অন্ধাকার করে দেন। এর ফলশ্রুতিতে তারা অভিযাত্রী দলের হাতে ধরা পড়ে যায়। মুসলিম রাখালদের সঙ্গে তারা যে শঠতামূলক আচরণ করেছিল তার প্রতিফল ও প্রতিশোধস্বরূপ তাদের হাত পা কেটে দেয়া হল, চোখে দাগ দেয়া হল এবং হাররাহ নামক স্থানের এক প্রান্তে তাদের ছেড়ে দেয়া হল। সেখানে তারা মাটি অনুসন্ধান করতে করতে স্বীয় মন্দ কাজের শাস্তি পর্যন্ত পৌঁছে গেল।[3] তাদের এ ঘটনা সহীহুল বুখারী এবং অন্যান্য কিতাবে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে।[4]

চরিতকারগণ এরপর আরও একটি অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন। এ অভিযান প্রেরিত হয়েছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাসে ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ) এবং সালামাহ বিন আবি সালাম (রাঃ) এ দু’জনের সমন্বয়ে। এ অভিযান সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে বলা হয়েছে যে আবূ সুফইয়ানকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ‘আমর ইবনু উমাইয়া মক্কায় গমন করেছিলেন। এর কারণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আবূ সুফইয়ান একজন বেদুঈনকে মদীনায় পাঠিয়েছিল। তবে এ উভয় পক্ষের কোন পক্ষই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয় নি।

এ প্রসঙ্গে চরিতকারগণ আরও বলেছেন যে, এ সফর কালেই ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী তিন জন কাফেরকে হত্যা করেছিলেন এবং খুবাইব (রাঃ)-এর লাশ উঠিয়ে এনেছিলেন। অথচ খুবাইবের শাহাদত বরণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাযীর কয়েক দিন কিংবা কয়েকমাস পর এবং তা সংঘটিত হয়েছিল ৪র্থ হিজরীর সফর মাসে। এ কারণে এটা আমার সঠিক বোধগম্য হচ্ছে না যে, তাহলে কি এ দুটি ভিন্ন ভিন্ন সফরের ঘটনা ছিল? কিন্তু চরিতকারগণ এ দুটি ব্যাপারকে একই সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়ে কেমন যেন একটা গোলমাল করে ফেলেছেন। অথবা এমনটিও হতে পারে যে, ব্যাপার দুটি একই সফরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল কিন্তু চরিতকারগণ ভুলক্রমে ৪র্থ হিজরীর পরিবর্তে ৬ষ্ঠ হিজরীর উল্লেখ করেছেন। আল্লামা মানসুরপুরী (রঃ) এ ঘটনাকে যুদ্ধোদ্দ্যম কিংবা অভিযান হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

এগুলোই হচ্ছে ঐ সকল অভিযান বা যুদ্ধ যা আহযাব ও বনু কুরাইযাহ যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল। ঐ সকল অভিযানে বড় আকারের তেমন কোন ঘটনা সংঘটিত হয় নি, এ সবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ ভাবের ছোটখাট ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। অতএব ঐ সকল অভিযানকে যুদ্ধ না বলে অগ্রগামী সৈনিক প্রহরী দল ‘টহলদারী বাহিনী’, তথ্যানুসন্ধানীদল ইত্যাদি বলাই শ্রেয়, এ সব অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল মূর্খ বেদুঈন এবং শত্রুদের অন্তরে ভয় ভীতির সঞ্চার করা। পরবর্তী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আহযাব যুদ্ধের পর অবস্থা ক্রমেই মুসলিমগণের অনুকূলে আসতে থাকে। এর ফলে শত্রুদের মনোবল ও উদ্যম ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ইসলামী দাওয়াতকে স্তব্ধ করে দেয়া কিংবা এর মর্যাদাকে ভুলুণ্ঠিত করে দেয়ার যে দুঃস্বপ্ন তারা দেখত তার ছিটে ফোঁটাও তাদের মনে অবশিষ্ট রইল না। পরিস্থিতি যে ক্রমেই মুসলিমগণের অনুকূলে যাচ্ছিল তা অধিকন্তু সুস্পষ্ট হয়ে উঠল হুদায়বিয়াহর চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তির সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আরব মুশরিকগণ কর্তৃক ইসলামী শক্তিকে স্বীকৃতি প্রদান এবং একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে আরব মুশরিকগণ কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার অবসান।

[1] সহীহুল মুসলিম ২য় খন্ড ৮ পৃ: বলা হয়েছে এ অভিযান ৭ম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।

[2] কুরয বিন জাবির ফিহরী (রাঃ) ছিলেন সে ব্যক্তি যিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে সফওয়ান যুদ্ধে মদীনার চতুষ্পদ জন্তুর পালের উপর আকস্মিক ভাবে হামলা চালিয়ে ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা বিজয়ের সময় শাহাদত বরণ করেন।

[3] যাদুল মা‘আদা ২য় খন্ড ১২২ পৃঃ, কিছূ অতিরিক্তসহ।

[4] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬২ ও অন্যান্য কিতাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *