৩১.
বয়েড সেভেরিন কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। রান্নাঘরে বাসন-কোসন পরিষ্কার করছেন তার স্ত্রী। সকালের নাস্তাটা ভাল হয়েছে, থ্যাঙ্কস। বিয়ের পর থেকে বিগত ১৮ বছর যাবত প্রতিদিন সকালে স্ত্রীকে এই কথাটা তিনি বলে আসছেন।
‘ওয়েলকাম। আরও কফি নেবে?’ গত ১৮ বছরের মতো আজও তার স্ত্রী একই কথা বললেন।
না, অফিসে যেতে হবে। ক্লায়েন্টের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে হবে না? সেভেরিন একজন অ্যাটনী। তবে তার প্রধান পরিচয় হলো সে এখানকার পার্লামেন্টের একজন সম্মানিত সদস্য, এমপি। ২ বছর ধরে অনেক চেষ্টার পর তিনি এখানকার সরকারকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন, সলোমন আইল্যাণ্ডের উন্নতি করতে হলে পর্যটন খাতের উপর জোর দিতে হবে। পর্যটকদের জন্য সুন্দর পরিবেশ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করলেই সেটা সম্ভব। পর্যটন শিল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি দেশ বিদেশে সুনামও কুড়ানো যাবে।
এই দ্বীপের অন্যান্য শিক্ষিত বাসিন্দাদের মতো বয়েড সেভেরিনও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা শেষ করেছেন। তার জীবনে একটাই লক্ষ্য সলোমন আইল্যাণ্ডকে একটি আন্তর্জাতিক পরিচয় দেয়া।
‘বাসায় ফিরবে কখন? মনে আছে? আজ কিন্তু টবি’র জন্মদিন।’ বয়েডের স্ত্রী মনে করিয়ে দিলেন।
“আজ তো ব্যস্ত থাকব। তুমি ওর পছন্দের গিফটগুলো কিনেছ তো?’
টবি ওদের ছেলে। বয়স ৭ বছর। ২০ মিনিট আগে স্কুলে গেছে।
‘হা কিনেছি। কিন্তু তুমি সময়মতো বাসায় আসার চেষ্টা কোরো। আমি কেক বানাব।
‘আসব।’ কফির কাপ নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন এমপি। কিচেন সিঙ্কে সেটা রেখে স্ত্রীকে চুমো খেলেন। বিয়ের পর এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর আজও তার অবাক লাগে কী ভেবে তাকে বিয়ে করেছিলেন এই নারী। এরকম একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে বয়েড নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি ভাবেন। কীরকম কেক?
মচা। টবি খুব পছন্দ করে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বয়েড। ছেলেটা কত দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে। সময় কত দ্রুত চলে যায়, তাই না?
হুম। আর সেজন্যই তোমার উচিত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে ওকে সময় দেয়া।’
“ঠিকই বলেছ। আমি ছটার দিকে চলে আসব।’
“ঠিক আছে। এরচেয়ে বেশি দেরি কোরো না কিন্তু। আজ ডিনার আগেভাগে সেরে ফেলব। তারপর সব গিফটের প্যাকেট খোলা হবে।
‘ওকে। মনে থাকবে।
অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন বয়েড। মাথার চুলগুলো ধূসর হতে শুরু করেছে, অনেক চুল উঠে গেছে, বাড়তি মেদ জমেছে শরীরে। তবে একেবারে বিশ্রী যে লাগছে তা নয়। আকর্ষণীয় নন ঠিকই কিন্তু গড়পড়তা হিসেবে চলনসই শরীর তার।
দরজা বন্ধ করে গ্যারেজের দিকে বয়েড পা বাড়ালেন। হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ঘাড় ফেরালেন তিনি। একটা ম্যাচেটি এসে তার খুলি ফাটিয়ে দিল। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগেই মৃত্যু হয়েছে তার। আঘাতটা এত জোরাল ছিল যে বয়েড় কোনো চিৎকার করার ফুসরত পর্যন্ত পাননি। আততায়ী দু’জন লাশের পাশে এসে দাঁড়াল। নিশ্চিত হলো এমপি মরেছে কিনা। তারপর আরেকটা আঘাত করে চলে গেল গাছের নিচে পার্ক করা ভ্যানের দিকে। ওটার লাইসেন্স প্লেটটা কাদা দিয়ে ঢাকা।
***
অরউইন ম্যানচেস্টার সবেমাত্র অফিসে এসে পৌঁছেছে এমন সময় তার সেল ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল কলারের নাম লেখা নেই। অবশ্য এরকম কল রিসিভ করতে করতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
‘হ্যালো?
কথা বলা যাবে? গভর্নর জেনারেল গর্ডন নোলিলের কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ টের পাওয়া যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
‘অরউইন, আমরা একে অপরকে চিনি অনেকদিন হলো। আমার কাছে আপনার সত্য কথা বলা উচিত। আপনি কি এই বিদ্রোহীদের সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত? পরোক্ষ সমর্থন কিংবা তথ্য সরবরাহ… এরকম কিছু?
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল অরউইন। কান থেকে ফোন সরিয়ে যন্ত্রটার দিকে তাকাল একবার তারপর আবার কানে নিল।
‘কিছু মনে করবেন না, আমি আপনার ব্যাপারেও একই কথা ভাবছিলাম।
‘আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরউন। না, গর্ডন। তাদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ কিংবা সম্পর্ক নেই। কিন্তু আপনি কি আমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারবেন আপনিও ওদের সাথে জড়িত নন? একটু থামল ম্যানচেস্টার। ‘আচ্ছা, হঠাৎ এ-প্রশ্ন?”
‘কেন? আপনি শোনেননি?’
‘আমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। ভণিতা না করে আসল কথাটা জানাবেন, প্লিজ?
‘আজ সকালে বয়েড খুন হয়েছেন। যারা কাজটা করেছে তাদেরকে এরজন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
কী বললেন?!
ম্যানচেস্টারকে সব খুলে বললেন রোলিন্স। একটা ফোনকলের মাধ্যমে তথ্যগুলো পেয়েছেন তিনি। কথা শেষে দুজনই চুপ হয়ে গেল। কথাগুলো চুপচাপ হজম করল ম্যানচেস্টার। ওর চেহারা থেকে রক্ত সরে গেছে।
‘আপনি এসবের সাথে কোনভাবেই জড়িত নন? আবার প্রশ্ন করল ম্যানচেস্টার।
‘অরউন, কী বলতে চান?
ওদের দুজনের কথাবার্তা আর সামনে এগোল না। ফোন রেখে অনেক্ষণ অফিসের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানচেস্টার। ভাবছে। রোলিন্স লোকটা একেবার সাধু না হলেও খুনোখুনির মতো ব্যাপারে জড়াবেন বলে মনে হয় না। আর কথা শুনে মনে হলো, তিনি সত্যিকার অর্থেই ধাক্কা খেয়েছেন… খুব উদ্বিগ্নও বটে।
সবকিছু নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। অরউন ভাবতে পারেনি বিদ্রোহীরা এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। এদিকে ফোনে কথা বলে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে গভর্নর ও অরউন কেউ-ই কাউকে বিশ্বাস করে না।
পরিস্থিতি দিনকে দিন ঘোলাটে হয়ে উঠছে।
***
কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে সমুদ্র দেখছে স্যাম। সাগরের ঢেউয়ের উপর সুর্যের তীব্র আলো পড়ায় মনে হচ্ছে ঢেউ যেন আগুনে ঝলসে যাচ্ছে।
‘তুমি রেডি? স্যামের পেছন থেকে প্রশ্ন করল রেমি।
‘আমি সবসময়ই রেডি। আরেকবার পানিতে ডুব দিয়ে দেখতে চাই মন্দিরে নতুন কোনোকিছুর দেখা পাই কিনা। চাইলে তুমিও নামতে পারো আমার সাথে।
‘প্রথমে দেখতে হবে জাহাজের কী অবস্থা। খুব জরুরী না হলে আমি পানিতে নামছি না।’
‘তুমি না অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করো? তোমার মুখে এমন কথা মানায়? অ্যাডভেঞ্চারের জোশটা কোথায়?
ট্যাবলেটে। আজ নতুন একটা কেনার কথা। মনে আছে?
‘আছে। এখন খেয়ে নিই। তারপর ট্যাব কিনতে যাব। কী বলে?
‘আমি কফি খাব।
রুমের দরজা বন্ধ করে নিচের লবিতে গেল ফারগো দম্পতি। ওরা ভেবেছিল হোটেলে আর কোনো অতিথি নেই কিন্তু এখন অল্পকিছু পর্যটককে ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। দিনের বেলা যে ম্যানেজারের ডিউটি সে এগিয়ে এলো পর্যটকদের সামনে। তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে আছে।
‘শুভ সকাল। রেডিওতে বলল ম্যানেজার। স্যাম ও রেমি গিয়ে শ্রোতাদের সাথে যোগ দিল।
খবর পাওয়া যাচ্ছে, এমপি বয়েড সেভেরিনকে তার বাড়ির পাশে আজ সকাল সোয়া আটটার দিকে খুন করা হয়েছে। তাকে হনিয়ারা হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান ম্যাচেটি দিয়ে খুন করা হয়েছে তাকে। সেভেরিনের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না।
‘বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা ঘটনার দায় স্বীকার করে হুমকি দিয়েছে তাদের দাবি মেনে না নেয়া হলে সামনে এরকম ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। আপনার ইতিমধ্যে তাদের দাবি সম্পর্কে জানেন। সলোমন আইল্যাণ্ডের যাবতীয় সম্পদ স্থানীয় দ্বীপবাসীদের নিয়ন্ত্রনে হস্তান্তর করতে হবে। কোনো বিদেশি ব্যক্তি বা কোম্পানী এখানে ব্যবসা চালাতে পারবে না। সবাইকে খুব শীঘ্রই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।
‘প্রশাসন অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত হনিয়ারার রাস্তাঘাটে মার্শাল ল জারি থাকবে। এমপি সাহেবের খুনের ঘটনাকে পুঁজি করে কেউ যাতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা লুটপাট চালাতে না পারে সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখা হবে বলে সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
‘অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড শান্তিরক্ষী বাহিনি পাঠানোর প্রস্তাব দিলেও তাদেরকে দ্বীপে আসার অনুমতি দেয়া হবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবছে কর্তৃপক্ষ। তবে আজকের দিনটি এক কালো দিন হিসেবে সলোমন আইল্যান্ডের ইতিহাসে লেখা থাকবে সলোমন আইল্যাণ্ডের ইতিহাসে। এক জঘন্য ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বীপ আজকে তার একজন যোগ্য সন্তান হারিয়েছে। বিষয়টা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
রেমির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আলতো করে চাপ দিল স্যাম। ম্যানেজার গলা পরিষ্কার করে আবার বলতে শুরু করল।
সুধীমণ্ডলী, আজ থেকে আপনাদের জন্য এখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হবে। তারপরও, আমি বলব কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। আমরা কারও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।’
লবি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ এক অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ফুঁসে উঠলেন।
‘নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না মানে? তাহলে আমরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত জান নিয়ে যাব কীভাবে?
ম্যানেজার বেশ বিপাকে পড়েছে। কণ্ঠস্বর যতটুকু সম্ভব মোলায়েম রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি বলতে চাচ্ছি, দ্বীপের অবস্থা ভাল নয়। এমতাবস্থায় এই হোটেলেও যেকোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমরা আপনাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। এরমানে এই না, আমরা আপনাদের ব্যাপারে উদাসীন। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তবে কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছি না।’
তারমানে আপনার আমাদেরকে দাঙ্গার মধ্যে ঠেলে দেবেন?
“দাঙ্গা নেই তো। তবে আপনারা যদি এখানে নিরাপদবোধ না করেন তাহলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য আমরা বাড়তি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। চাইলে এয়ারপোর্টেও যেতে পারেন। তবে আবারও বলছি, নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনকি আমাদের এখানে যারা স্টাফ আছে তাদেরও নয়।
মহিলা জোরদার কিছু শুনতে চেয়েছিল কিন্তু ম্যানেজারের বক্তব্য তাকে হতাশ করেছে। পর্যটকদেরকে উদ্বিগ্ন রেখে ম্যানেজার হোটেলের পেছনের অফিসে চলে গেল। সবাই এগিয়ে গেল রিসিপশন ডেস্কে থাকা তরুণীর দিকে। তার বয়স ২৫-এর বেশি হবে না। কিন্তু তরুণী যা জবাব দিল সেটা ম্যানেজারের চেয়েও তিক্ত।
রেস্টুরেন্টে গেল স্যাম ও রেমি। একজন ওয়েটার অর্ডার নিচ্ছে। ওদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে ওয়েটার খাবার আনতে চলে গেল।
মাথা নাড়ল স্যাম।
এসবের কোনো মানে হয়? উপযুক্ত কারণ ছাড়া মানুষজন খুন হচ্ছে। এসব করে কোনো ফায়দা হবে না। মধ্যে থেকে দ্বীপটার বদনাম হয়ে বাকি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’
হতে পারে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আন্দোলনকারীদেরকে কেউ পাত্তা দেয় না। তাই এরকম ঘটনা ঘটিয়ে সবার দৃষ্টিআকর্ষণ করছে তারা।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো এগুলো তেমন গুরুত্বর ঘটনা নয়?
‘আরে না। আমি জাস্ট বলতে চাচ্ছি খুনোখুনির ঘটনা ছাড়া দ্বীপে কিন্তু আর কিছুই হয়নি।
‘আমাদের জাহাজের উপর নজর রাখা হচ্ছিল, ভুলে গেছ?’
না, মনে আছে। কিন্তু হতে পারে সেটা স্রেফ এক কৌতূহলী দ্বীপবাসিন্দার কাজ। আমাদের গাড়িতে কিন্তু কোনো আঁচড় দেয়নি সে। কোনো ক্ষতিও করেনি।
‘আচ্ছা। লবির সেই লোকটা? তার ব্যাপারে কী বলবে?
‘সে একটু বাঁকা চোখে তাকিয়েছে বলে এতটা খারাপ ভাবছ?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমি। আমাদের হোটেল রুমের তালা ভেঙ্গে ঢুকল। এটায় কী সাফাই দেবে, শুনি?
না, সাফাই দেব না। আমাদের রুমে ওভাবে ঢোকার অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য ছিল। খেয়াল করে দেখো, দ্বীপের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাই দারিদ্রতা ঘোচাতে হয়তো চুরি করতে ঢুকেছিল।
খাবার আসার পর চুপচাপ খেল ওরা। বিশাল ডাইনিং রুমে গোরস্থানের নীরবতা। খাওয়া শেষে বিল চুকিয়ে হোটেলে ফিরল ফারগো দম্পতি। হোটলের গেটে ম্যানেজার ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
‘আপনাদেরকে একটা দুঃসংবাদ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। কী বলব, কোত্থেকে কী হয়ে গেল। শহরে দাঙ্গা বেধেছে। হনিয়ারার অর্ধেক ইতিমধ্যে পুড়ছে আগুনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাচ্ছি, এখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আপনারা অন্য কোথাও ঘুরে আসুন।
স্যামের হাত ধরল রেমি। আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। সকালে আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করব। আচ্ছা, বলুন তো এখানে কোনো কম্পিউটারের দোকান আছে?
‘আছে। হাসপাতাল থেকে দেড় ব্লক দূরে। ডান পাশে। এক বিদেশি কোম্পানীর দোকান। সেজউইক। গলাকাটা দাম রাখে তবে স্টক ভাল।
‘বিদেশি কোম্পানী? তাহলেই হয়েছে। বলল স্যাম। ধন্যবাদ।’
ম্যানেজারকে হতভম্ব করে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরোল ফারগো দম্পতি। ওদের গাড়ির আওয়াজ শুনে পাকিং লটে থাকা ঘুমন্ত গার্ডের ঘুম ছুটে গেল।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দোতলা ভবন দেখাল রেমি। ওই যে, সেজউইক।
‘দোকানের সামনে তো অনেক লোক।
‘গাড়ি চালাতে থাকো। মনে হচ্ছে, গণ্ডগোল আছে। রেমি জনতার জটলা খেয়াল করে বলল।
সেজউইকের গেটে কয়েকজন ষণ্ডামার্কা স্থানীয় লোক ভাঙচুর করছে। ওখানে কয়েকজনের হাতে ম্যাচেটি, কারও হাতে কাউবার। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে লুট করতে এসেছে এরা।
‘ম্যানেজার বাড়িয়ে বলেনি দেখছি।’ বলল রেমি। সাইড মিররে সর্তক দৃষ্টি রেখেছে। সবাই লুট করতে এসেছে, তাই না?
হুম। আমি ভাবছি, পুলিশ কোথায়? এখান থেকে পুলিশ স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৬ ব্লক।
‘হয়তো তারা সকালের নাস্তা সেরে নিচ্ছে। কিংবা আরও বড় কোনো সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত।
ব্রেক চাপল স্যাম। অবস্থা খারাপ, রেমি।’
ওদের থেকে প্রায় ৬০ ফুট সামনে কয়েকশ স্থানীয় লোক একসাথে দাঁড়িয়ে মানব ব্যরিকেড তৈরি করেছে। দুটো সেডানকে ভাঙ্গচুর করে ফেলে রেখেছে রাস্তার পাশে। ওগুলোর কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাস্তায়।
গতি কমাতে বাধ্য হলো ওরা। হঠাৎ রেমি চিৎকার করে উঠল। এই সেরেছে!
একটা পাথর ছুটে এসে ওদের গাড়ির উইনশিল্ডে আঘাত করে মাকড়সার জাল তৈরি করে দিল।
.
৩২.
পা দিয়ে গ্যাস প্যাডেল ঠেসে ধরল স্যাম। ইতিমধ্যে আরেকটা পাথর এসে গাড়ির ছাদে পড়েছে। স্যাম দ্রুত গাড়িকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘোরাল। আর একটু হলেই উল্টে যেত গাড়িটা।
‘তুমি ঠিক আছে তো?’ রেমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল স্যাম।
‘হ্যাঁ, ঠিক আছি। কাঁচ ছিটকে এসে গায়ে পড়লেও কোথায় কেটে-ছিড়ে যায়নি।’ রেমি জবাব দিল। এখন আমরা কী করব?
রাস্তা থেকে সরে নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নিতে হবে।’
কাছেই হাসপাতাল। ওখানে নিশ্চয়ই গার্ড আছে?’
গাড়িকে কষে বামে ঘোরাল স্যাম। ওদের গাড়ির পিছু পিছু স্থানীয় লোকজন ছুটে আসছে। আমরা বরং শহরের একদম শেষ প্রান্তে চলে যাই। কিন্তু ওখানে যে এরকম গণ্ডগোল হচ্ছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী?
“ঠিক। ওটা করা পাগলামি হবে।’
স্যাম মাথা নাড়ল। তাহলে হাসপাতালেই যাওয়া যাক। যতক্ষণ কোনো ব্যবস্থা না নিচ্ছে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করব। পুলিশ এলে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, আশা করি।
‘কিন্তু যদি পুলিশ না আসে?
‘সেটা এক নতুন সমস্যা। এখন ওটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এই দাঙ্গাকে স্রেফ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ধরে নেয়াই ভাল। আমার মনে হচ্ছে, স্থানীয় গরীব বাসিন্দারা এমপি খুন হওয়ার ঘটনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক্স পণ্য আর কম্পিউটার হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আর কিছু নয়।’
‘তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।
হাসপাতালের গেটে পৌঁছে গেছে পারগো দম্পতি। সিকিউরিটি গার্ড ওদের গাড়িকে ভেতরে ঢুকতে দিল। তারপর তার চোখে পড়ল পেছন গাড়ির পেছন পেছন স্থানীয় বাসিন্দারা মোটর বাইক ও দৌড়ে আক্রমণাত্বক ভঙ্গিতে ছুটে আসছে, তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দিল গার্ড। স্যাম ও রেমি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেল হাসপাতালের ভেতরে, তাড়াহুড়োয় গাড়ির দরজাটাও লাগায়নি।
‘মেইনগেটে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ কোনো ব্যারিকেডের ব্যবস্থা আছে? ভীত গার্ডকে জিজ্ঞেস করল স্যাম। কিন্তু গার্ড হয়তো ইংরেজি বোঝেনি। স্যাম রুমের চারপাশে তাকাল। ইমার্জেন্সি রুম এরিয়ায় কয়েকজন রোগী অপেক্ষা করছে। একটু পর ডা. ভ্যানাকে একটা রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। ফারগো দম্পতি ও গার্ডকে দেখে সে হকচকিয়ে গেছে।
স্যাম ভ্যানাকে অল্পকথায় সব বুঝিয়ে বলল। সব শোনার পর কাজে লেগে পড়ল ভ্যানা। গার্ড ও স্টাফদেরকে অর্ডার দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় হাসপাতালের সামনে একটা ভারি স্টিলের শাটার নামানো হলো। বড় ঝড় থেকে হাসপাতালকে বাঁচানোর জন্য বানানো হয়েছিল এই শাটার।
শাটার ফেলার কয়েক মুহূর্ত পরেই ধুমাধুম আঘাত পড়তে শুরু করল ওখানে। সিকিউরিটি গার্ড, রোগী, স্টাফ সবাই হাসপাতালের পিছনের অংশে চলে গেল। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর ডা. ভ্যানা ঘোষণা করল হাসপাতাল আপাতত নিরাপদ। ফোন তুলে পুলিশকে জানিয়ে দিল হাসপাতাল আক্রমণের শিকার হয়েছে।
আপনারা ভাগ্যবান, হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। হাসপাতালের শাটারটা বেশ মজবুত। লেভেল ৫-এর হ্যারিকেন এলেও সামাল দিতে পারবে। আপনি যদি একটা গাড়ি নিয়ে ছুটে এসে শাটারে ধাক্কা দেন তবুও ওটাকে টলাতে পারবেন না। তাই বলা যায়, আপাতত আমরা নিরাপদ।
‘পুলিশ কী এসব থামাবে না?’ রেমি জানতে চাইল।
‘আশা করা যায়, থামাবে। কিন্তু সময় লাগবে। ভ্যান জবাব দিল। যা-ই হোক, রোগীরা বসে আছে। আমাকে যেতে হচ্ছে।
আবার ধড়াম করে আঘাত পড়ল শাটারের গায়ে। কিন্তু শাটার অবিচল। স্যাম গলার স্বর নিচু করে ভ্যানাকে বলল, কিছু টেবিল চেয়ার নিয়ে শাটারের কাছে রাখলে বোধহয় মন্দ হয় না। যদি শাটারটাকে ভেঙ্গে ফেলে ওগুলো ব্যারিকেড হিসেবে কাজ করবে।
ভ্যানা মাথা নাড়ল। শাটার যদি ভেঙ্গে ফেলতে পারে তাহলে এসব ছোটখাটো জিনিস দিয়ে আর কী লাভ হবে?
ডা. ভ্যানাকে এগোতে দেখে ওয়েটিং রুমের বেঞ্চে বসা থাকা এক মহিলা উঠে দাঁড়াল। ডাক্তর, আমি ম্যালাক্ষণ ধইরা আপনের লাইগ্যা বইসা আছি। আমার মাইয়াডারে খুঁইজ্জা পাইতাছি না। আমার লিলি… মাইয়াডা হারায়া গ্যাছে। কিছু একড়া করেন।
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে?’ ভ্যানা জানতে চাইল।
কাইল থিক্কা অরে পাইতাছি না। এই নিয়া এক মাসে গ্রাম থিক্কা তিন মাইয়া হারাইলো। মাইয়াড়ার অসুখ আছিল। আপনে বারবার কইয়া দিছিলেনজানি ঠিকমতো ওইষুধগুলান খায়…’।
মহিলাকে নিয়ে একটু দূরে গেল ভ্যানা। নিচু গলায় কথা বলল তার সাথে। এদিকে শাটারে এখনও আঘাত পড়ছে তবে পরিমাণটা কম। দাঙ্গাপ্রেমীরা হয়তো বুঝতে পেরেছে এখানে শক্তি খরচ করে খুব একটা লাভ হবে না। এটা হাসপাতাল, লুট করলে হয়তো কিছু ওষুধ পাওয়া যাবে। বরং ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দোকান লুট করলে বেশি লাভ হবে তারচেয়ে।
দূর থেকেই মহিলাটির কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বেশ জোর গলায় কথা বলছে। সে, কিন্তু ডাক্তর, আমার মাইয়াড়ার অসুখ আছিল। অয় কহন ফিরব না ফিরব হেইডার লিগা অপেক্ষা করন ঠিক হইব না। আমি পারমুও না। অরে খুঁজতে হইব। ম্যালা বাচ্চা গায়েব হওয়া শুরু হইছে ইদানীং। আর এইবার আমার সোনা মাইয়া লিলি হারাইলা…’
ভ্যানা মহিলাকে কী জবাব দিল সেটা শোনা গেল না। মহিলাকে নিয়ে ট্রিটমেন্ট এরিয়ায় গেল ডাক্তার।
‘তোমার কী অবস্থা?’ রেমি’র পাশে একটা বেঞ্চে বসে স্যাম প্রশ্ন করল। সব দরজা-জানাল বন্ধ থাকায় রুমের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে।
‘আমি ভাল আছি। কিন্তু এখানে স্বস্তি পাচ্ছি না।’
কপাল ভাল থাকলে এই বন্দিদশা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে।
‘আমার মনে হচ্ছে কপাল ভাল নয়।’
৫ মিনিট পর মহিলাটাকে নিয়ে রুমে এলো ভ্যানা। মহিলাকে এখন বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমনকারী ইনজেকশন দেয়া হয়েছে হয়তো। স্যাম ও রেমি’র পাশে এসে বসল ভ্যানা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আশা করছি, খুব শীঘ্রই পুলিশ চলে আসবে।’
‘দেখা যাক। আচ্ছা, উনি ঠিক আছেন তো? মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করল রেমি।
‘হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছে। মেয়েটার বয়স মাত্র ১৪। আমার মনে হয় ও পালিয়েছে। এখানকার মেয়েদের স্বভাবই এরকম। একটু বড় হলেই মনে রং লাগে। কোনো একটা ছেলের কাছে পটে যায়। স্কুল, পড়ালেখা, বাবা-মা’র শাসন তখন আর তাদের ভাল লাগে না। তারপর পালিয়ে যায় ছেলের হাত ধরে। ভ্যানা জানাল।
‘তাহলে মহিলা নিশ্চয়ই খুব আপসেট?’ বলল স্যাম।
‘তা ঠিক। তবে এই মুহূর্তে তারচেয়েও কঠিন সমস্যা আছে আমাদের সামনে। আমি বরং রেডিও চালু করে দেখি খবরে কী বলছে।’
ভ্যানা কাউন্টারের কাছে গিয়ে বড় রেডিও অন করে ভলিউম বাড়িয়ে দিল যাতে সবাই শুনতে পায়। রেডিও’র স্পিকার থেকে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
‘আমরা রিপোর্ট পেয়েছি, ডাউনটাউনে কয়েকটি ব্লক জুড়ে লুটপাট চালাচ্ছে স্থানীয় জনগণ। এ-ব্যাপারে পুলিশ চীফের মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি জানান, আইনভঙ্গকারীদেরকে যথাপোযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সে-লক্ষ্যে সব পুলিশ অফিসারকে ডাকা হয়েছে। ব্রিফিং শেষে মাঠে নামছে তারা। সন্ত্রাসরোধে পুলিশ কাউকে কোনো ছাড় দেবে না।
এছাড়া প্রশাসন থেকেও খুব শীঘ্রই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
‘অন্য এক রিপোর্ট বলছে, বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা বিভিন্ন জিনিসের লোভ দেখিয়ে দলে ভিড়াচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। দ্বীপের এই গোলযোগ রুখতে প্রধানমন্ত্রী বিদেশি নিরপত্তারক্ষীদের সাহায্য চেয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনির প্রথম সেনাদল আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যে দ্বীপে এসে পৌঁছুবে বলে জানানো হয়েছে।
খবর শুনতে শুনতে ডা. ভ্যানার মুখ কালো হয়ে গেল। তবে সংবাদ পাঠকের পরবর্তী কথাটা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল সে।
‘আমরা সৌভাগ্যবান, আজ স্টুডিওতে একজন এমপি-কে পেয়েছি। আপনারা সবাই তাকে চেনেন ও জানেন। অনেক বছর যাবত দ্বীপের একজন একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে কাজ করে আসছেন তিনি। আমাদের সবার সম্মানিত বন্ধু, নির্ভরতার মানুষ; অরউন ম্যানচেস্টার। মিস্টার অরউন, স্টুডিওতে আসার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
‘আপনাকেও ধন্যবাদ। স্টুডিওতে আসতে পেরে আমি আনন্দিত।
‘একজন এমপি হিসেবে দ্বীপের বর্তমান অবস্থার ব্যাপারে আপনার কী মতামত। শ্রোতাদের যদি জানাতেন…’
“দেখুন, সবার আগে আমি এই দ্বীপের একজন নাগরিক। তারপর আইন ব্যবসায়ী এবং সবশেষে এমপি। দ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমাদের দ্বীপের কর্মঠ বাসিন্দারা এরকম দাঙ্গা বাধিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। হয়তো তারা দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় এসব করছে তারপরও এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এরকম উগ্র জাতীয়তাবাদ সমর্থন করি না।
‘তার উপর বয়েড সেভেরিনের খুন। মানবতার চরমতম অবমাননা হয়েছে এই খুনের মাধ্যমে। কিছু কিছু ব্যাপারে বয়েড ও আমার মধ্যে মতের মিল না হলেও আমরা একে অপরকে শ্রদ্ধা করতাম। মতের মিল না হলে আলোচনার মাধ্যমে সব সমাধান করেছি। তার এরকম অকাল মৃত্যুতে আমি শোকাহত।
থামল ম্যানচেস্টার। তার কণ্ঠস্বর বেশ টানটান।
অরউন হয়তো আরও কিছু বলবে এটা ভেবে সংবাদ পাঠক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আপনারা শুনছিলেন অ্যাটর্নি ও সম্মানিত এমপি অরউন ম্যানটেস্টারের বক্তব্য। যারা এই অনুষ্ঠানটি শুনছেন তাদেরকে বলছি, আইনভঙ্গ করবেন না। সভ্য ও দায়িতুশালী নাগরিকের মতো আচরণ করুন। আমরা সলোমন আইল্যাণ্ডের বাসিন্দারা সভ্য ও বন্ধুত্বপরায়ণ, পুরো দুনিয়া যেন আমাদেরকে খারাপ না ভাবে, বিষয়টা সবাই মাথা রাখবেন।
সংবাদ শেষ করার আগে সংবাদ পাঠক জানাল দ্বীপের পরিস্থিতির ব্যাপারে সর্বশেষ খবর পাওয়া মাত্র সেটা শ্রোতাদেরকে জানানো হবে। এরপর রেডিওতে অন্যান্য সাধারণ অনুষ্ঠান শুরু হলো।
মাথা নাড়ল ভ্যানা। আমি একটা গাধী। ভেবেছিলাম অরউনের ব্যাপারে আমার ধারণা ভুল। এখন দেখছি ঠিকই ভেবেছি।
কী?’ রেমি জানতে চাইল। ম্যানচেস্টার? বুঝলাম না।’
‘আমি গতকাল অরউনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে কথা বলেছি। অরউন আমাদের সামনে যে রূপ প্রকাশ করেছে আর তার বন্ধু যা বলল দুটো চরিত্রের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। আমি কেন যেন সন্দেহ হয়েছিল এই দাঙ্গার পেছনে অরউনের হাত আছে। রেডিওতে ওর কথা শুনে নিশ্চিত হলাম। দ্বীপ থেকে বিদেশি কোম্পানীগুলো বিদেয় হলে অরউন রাতারাতি আরও ধনী বনে যাবে। জাতীয়তাবাদ অনেক বাড়তি সুবিধা দেবে ওকে। এখানকার সেরা অ্যাটর্নি অরউন ম্যানচেস্টার। অনেক লোকের সাথে চেনা-জানা আছে ওর।’
‘ডিনারে কিন্তু তাকে এরকমটা মনে হয়নি। এমনকি রেডিও’র কথাতেও সেরকম কিছু মনে হলো না। স্যাম মন্তব্য করল।
‘অরউন বাইরে এক আর ভেতরে আরেক। উকিল আর রাজনীতিবিদদের চরিত্র কেমন হয় তা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। অরউন ম্যানচেস্টারের পেশা ওই দুটোই। তাই তার চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন। দ্বীপের সবকিছু স্থানীয়দের হাতে চলে এলে প্রথম সারির একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে অরউন প্রচুর সুবিধা পাবে। নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে প্রচুর টাকাও কামাতে পারবে। ভিনদেশী নতুন কোম্পানির সাথে সমঝোতা করে তাদেরকে ব্যবসা করতে দেবে দ্বীপে, অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে ধূলো দেয়ার জন্য স্থানীয় কোনো পরিচিত মুখকে কাঠের পুতুলের মতো বসাবে সেই কোম্পানীর উঁচু পদে।
‘তারমানে আমি বিশ্বাস করছেন, অরউন এসবের সাথে জড়িত?’ রেমি প্রশ্ন করল।
‘নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। সবই আমার সন্দেহ। এবং তার পেছনে কারণও আছে। ভেবে দেখুন, দ্বীপ জুড়ে এরকম কোম্পানির দৌরাত্ব বাড়লে অর্থনৈতিক অবস্থার কেমন বেহাল দশা হতে পারে। যাবে। এখন হয়তো ৫ টা বিদেশি ছোট কোম্পানি কাজ করছে। কিন্তু জাতীয়করণের পর অরউনের হাত ধরে আরও ২০ টা কোম্পানি এসে জুটবে।
স্যাম ও রেমি একে অন্যের দিকে তাকাল। সে বিদ্রোহীদের সাথে জড়িত এর কোনো প্রমাণ আছে? নাকি সন্দেহই সব?’
উঠে দাঁড়াল ভ্যানা। অনেক বলে ফেলেছি। আর কিছু না বলাই ভাল। আচ্ছা, ভাল কথা, আপনাদের জন্য একটা ট্যাবলেটের ব্যবস্থা করে হোটেল রুমে পৌঁছে দেব। এখন একটু রোগীদের দেখভাল করতে হবে। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ট্রিটমেন্ট এরিয়ার দিকে পা বাড়াল ভ্যানা।
‘আমি আগেই বলেছিলাম ম্যানচেস্টারকে আমার কেমন যেন মনে হয়, স্যাম বলল। যদি ম্যানচেস্টার তার মনের বাসনার ব্যাপারে মিথ্যা বলে থাকে…’
‘তাহলে আমাদের আশংকাই সত্য হয়ে যাবে।’ বাক্যটা পূর্ণ করে দিল রেমি।’
‘কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। সুযোগের স্বপ্ন দেখা আর সেটাকে বাস্তবে কাজে লাগানোর মধ্যে অনেক ফারাক আছে। দ্বীপে এরকম বিদ্রোহ সষ্টি করে স্বার্থ উদ্ধার করা কম কথা নয়। আর ম্যানচেস্টারকে আমি যতদূর দেখেছি, খুনীদের সাথে তার গভীর সখ্যতা আছে বলে মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রেমি। বাইরে থেকে দেখে মানুষ চেনা মুশকিল। তাছাড়া যখন টাকার স্বার্থ চলে আসে তখন চেনা মানুষও অচেনার মতো আচরণ করে।’
শাটারে আরেকবার আঘাতের শব্দ পাওয়া গেল। রোগী দেখতে দেখতে শাটারের দিকে তাকাল ভ্যানা। ফারগো দম্পতি এগোল তার দিকে।
‘আমরা এখন কী করতে পারি?’ রেমি প্রশ্ন করল। হাসপাতালের ভেতরে আর কোনো নিরাপদ জায়গা আছে যেখানে আমরা লুকোতে পারব?’
মাথা নাড়ল ভ্যানা। না। হাসপাতালটা বেশ ছোট। তাছাড়া সব রুমে রোগী আছে। ঝড় থেকে বাঁচার জন্য শাটারের ব্যবস্থা আছে এই-ই বেশি। ভ্যানা সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
.
৩৩.
গরমে দরদর করে ঘামছে স্যাম। ওষুধের লিটারেচার নিয়ে রেমি নিজেকে বাতাস করছে। ভ্যানা পুলিশকে ফোন করার পর পেরিয়ে গেছে আধাঘন্টা। শাটারে শেষ আঘাত হয়েছে ১০ মিনিট আগে, তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ যাচ্ছে না।
স্যামের দিকে ঝুঁকল রেমি। মনে হয়, হাসপাতালের সামনে থেকে ওরা সরে গেছে।
‘আমি ভাবছি, আমাদের গাড়িটা আস্ত আছে তো? স্যাম বলল। ‘ম্যানচেস্টারের কথাটা বারবার ধোচাচ্ছে। দ্বীপের বর্তমান সরকারকে সরানোর জন্যই কি এরকম দাঙ্গার সৃষ্টি করা হয়েছে? যাতে প্রমাণিত হয় বর্তমান সরকার এই দ্বীপ পরিচালনা করতে ব্যর্থ। তারপর নির্বাচন করে নতুন সরকারকে বসানো হবে হয়তো।
স্যামের সাথে রেমি যোগ করল। এবং সেই নতুন সরকার এই দ্বীপকে একদম জাতীয়করণ করে ফেলবে। ঠিক যেমনটা বিদ্রোহীরা চাচ্ছে।
হাসপাতালের পেছনের অংশ থেকে ভ্যানা এগিয়ে এলো। তার হাতে সেলফোন। ভাল খবর। পুলিশ এসে গেছে। দাঙ্গার লোকজনকে সরিয়েও দিয়েছে হাসপাতালের সামনে থেকে। আমরা এখন নিরাপদ।’ সিকিউরিটি গেটের দিকে তাকাল ভ্যানা। দাঙ্গা এরআগে অনেক হয়েছে কিন্তু হাসপাতাল কখনও আক্রমণের শিকার হয়নি। এবারই প্রথম এমন হলো।
এরজন্য বোধহয় আমরা দায়ী। আমাদেরকে ধাওয়া করেই তো ওরা এখানে এসেছিল।’
বাজে কথা। এখানে না এসে আপনাদের আর কোনো উপায় ছিল না। বাদ দিন…’হঠাৎ ভ্যানার ফোন বেজে উঠল। ফোন নিয়ে একপাশে সরে গেল ডাক্তার। কথা শেষ করে স্যামের দিকে ফিরে বলল, “শাটার তুলতে আমাকে সাহায্য করবেন, প্লিজ?
‘অবশ্যই। চলুন।
কয়েক হাজার পাউন্ড ওজনের শাটারকে বেয়ারিং মেকানিজমের সাহায্যে তুলল ওরা। শাটার তোলার পর দেখা গেল দাঙ্গার লোকজন কেউ নেই। তবে কয়েক ডজন পুলিশ কার দাঁড়িয়ে আছে। লাল-নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেগুলো থেকে। হাসপাতালের দরজা খুলে দেয়ায় ঠাণ্ডা তাজা বাতাস এসে ঢুকল ভেতরে।
একজন অফিসার এগিয়ে এলো সামনে। উচ্চতায় বেঁটে হলেও দশাসই স্বাস্থ্য তার। এগিয়ে এসে ভ্যানাকে ছোট করে স্যালুট দিল সে।
‘সবাই ঠিক আছেন তো?’
‘হ্যাঁ। আমরা ঠিক আছি। দাঙ্গার কী হলো? জানতে চাইল ভ্যানা।
‘আমাদের গাড়ির লাইট দেখেই ওরা পালিয়েছে। তবে আপনাদেরকে একটা ভাল খবর দিতে চাই, যা দেখলাম, বিগত দিনের দাঙ্গার চেয়ে এবার দাঙ্গায় অনেক কম লোকজন অনেক জড়িত হয়েছে। অতএব, দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
স্যামের দিকে ফিরল রেমি। স্বস্তির কথা।
স্যাম ভ্যানাকে বলল, “আমাদেরকে ভেতরে আশ্রয় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। নইলে কী যে হতো…’।
ব্যাপার না। তবে এখানকার পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখবেন। আমি আপনাদের দূর্ঘটনার সংবাদ পত্রিকায় দেখতে চাই না।’
‘অবশ্যই বিবেচনায় রাখব। রেমি জবাব দিল। তারপর ঘুরল অফিসারের দিকে। আমাদের কার রেন্টাল এজেন্সি যাওয়াটা এখন নিরাপদ হবে তো?
‘এজেন্সির নাম?’
‘আইল্যাণ্ড ড্রিমস।
‘ওটা তো ছয় ব্লক পর, তাই না? আমরা ওখানকার কোনো গণ্ডগোলের রিপোর্ট এখনও পাইনি। তবে তারপরও বলব, না যাওয়াই ভাল। আপনারা ভাগ্যের জোরে একবার বেঁচে গেছেন। বারবার সেটা নাও হতে পারে।’
রেমি’র হাত ধরল স্যাম। এসো, গাড়িটা পরিষ্কার করি।
পাথরের আঘাতে ওদের টয়োটার উইন্ডশিল্ড ভেঙ্গে গেছে। কাঁচের টুকরোতে ভরে গেছে প্যাসেঞ্জার সিট আর ড্যাশবোর্ড। এসব পরিষ্কার করার জন্য ঝড় আনতে রেমি হাসপাতালে ফিরে গেল। এইফাঁকে ব্যাকপ্যাক থেকে স্যাট ফোন বের করে সেলমাকে ফোন করল স্যাম।
‘সেলমা, কী অবস্থা? ওপাশে ফোন রিসিভ হওয়ার পর স্যাম বলল।
তোমার কর্নেল কুমাসাকা’র চরিত্র তো বেশ রঙিন। মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করে মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিল সে।
‘তাই নাকি? একজন বিজ্ঞানীর জন্য বিষয়টা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার।
‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। কাহিনি আরও আছে। কুমাসাকার ব্যাপারে অনুসন্ধান করে পরস্পর বিপরীতমুখী তথ্য পাচ্ছি আমি। কোনো রেকর্ড বলছে সে পদাতিক বাহিনিতে কর্মরত ছিল আবার কোনোটা বলছে সে কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট ছিল। আবার কোথাও বলা আছে সেনাবাহিনিতে পরামর্শক হিসেবে ছিল সে।’
অদ্ভুত।
‘সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, মিত্রবাহিনি তাকে মিয়েজি কর্পোরেশন-এর একজন সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে।
‘এই কর্পোরেশনের নাম আমি এরআগে কখনও শুনিনি।
‘কেউই শোনেনি। এমনকি আমি এটার কোনো তথ্যও খুঁজে পাইনি এখনও।
‘আমি যে সেলমাকে চিনি সে তো এরকম ব্যর্থ হওয়ার পাত্রী নয়। একটু চুপ থেকে তারপর বলল স্যাম। ফোনের অপরপ্রান্তে থেকেও স্যাম টের পেল সেলমা হাসছে।
হুম। তাই আমি আরও গভীরে অনুসন্ধান চালালাম। প্রশাসনের ভেতরে আমার লোক আছে কাজে লাগালাম তাদের।
ভণিতা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে, সেলমা।
‘দ্য মিয়েজি কর্পস, একটা স্পেশাল প্রজেক্টের নাম। যে প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত জিনিসগুলোকে পরোক্ষযুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। বিগত ২০০ বছরের মধ্যে বিখ্যাত কর্পোরেশনের মধ্যে একটা হলো এই মিয়েজি কর্পস,
‘পরোক্ষযুদ্ধ?’ পুনরাবৃত্তি করল স্যাম। ১৯৪২ সালের সাথে এটার কোনো সম্পর্ক আছে? মনে হয় না।’
‘ঠিক। তবে আমি জাস্ট শূন্যস্থানগুলো পূরণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষমেশ সব গিয়ে এসপিওনাজ… আর বায়োলজিক্যাল ওয়্যারফেয়ারে গিয়ে ঠেকেছে।
বেশ কিছুক্ষণ দু’জনই চুপ করে রইল।
‘তাহলে বায়োওয়েপনের ব্যাপারে যে গুজব শোনা যায় সেটার হয়তো এবার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। নিচুস্বরে বলল স্যাম।
‘আসল সমস্যার কথা তো তোমাকে এখনও বলিইনি। সেলমা বলল।
কী সেটা?
‘আমি আবিষ্কার করেছি ৭০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর এখনও মিয়েজি কর্পস, ও কর্নেল কুমাসাকা’র-এর ফাইলগুলো ক্লাসিফায়েড। সম্পূর্ণ গোপনীয়। টপ সিক্রেট। তাই, উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্যই আমি যোগাড় করতে পারিনি। আমার যে লোক তথ্যগুলো দেয়… বরাবরই বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আচারণ করে আমার সাথে। কিন্তু এবার তার কণ্ঠে আমি শীতল আগুন টের পেয়েছি।
‘এখনও টপ সিক্রেট? কেন? এতবছর গরও গোপন করে রাখার কী মানে?
‘আমি জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, তোমার কর্নেল শুধু একজন সাধারণ কর্নেল ছিল না।’
‘একটা ডেস্ট্রয়ার পাঠিয়ে তাকে সোজা টোকিও নেয়াও ঘটনাতেই সেটা প্রমাণ হয়ে যায়। সেলমা, আমি জানি তুমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছ। তারপরও বলছি, তুমি যেভাবে পারো আমাকে এই কর্নেলের ব্যাপারে আরও তথ্য যোগাড় করে দাও।
‘আমার সাথে পিটার আর ওয়েণ্ডিও বিষয়টা নিয়ে কাজ করছে। বিস্তারিত তথ্য হাতে এলে তোমাকে ই-মেইল করে দেব।’ একটু ইতস্তত করল সেলমা। ‘আমি কি ঠিক পড়ছি? নিউজে দেখাচ্ছে গোয়ালক্যানেলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে?
‘হ্যাঁ, ঘটনা সত্য। তবে আমরা ভাল আছি।’
আবার নীরবতা। “নিরাপদে থেকো। নইলে আমার এত রিসার্চ সব জলে যাবে।
থাকব সেলমা।
রেমি ইতিমধ্যে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছে। গাড়িতে চড়ে বসল ফারগো দম্পতি। গন্তব্য: আইল্যাণ্ড ড্রিমস।
.
৩৪.
ওরা হোটেলে ফিরে দেখল পুরো হোটেল খা খা করছে। সিকিউরিটি গার্ডরা হাতের লাঠি ঘোরাচ্ছে নার্ভাস ভঙ্গিতে। গেটের দারোয়ানের আজ খুব একটা ব্যস্ততা নেই। বারবার গেট খুলতে হচ্ছে না। রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে। রুমে ঢুকে রীতিমতো চমকে গেল ফারগো দম্পতি। একটা নতুন ট্যাবলেট ওদের বিছানার উপর শোভা পাচ্ছে। ভ্যানা পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই। স্যাম ও রেমি নিজেদেরকে ফ্রেশ করার কাজে দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে দিল। তারপর অনলাইনে বসল স্যাম।
কী করব এখন? লাঞ্চ সারব নাকি ঝুঁকি নিয়ে লিওর সাথে দেখা করতে যাব?” স্যামকে প্রশ্ন করল রেমি।
লাঞ্চ করাটাই নিরাপদ হবে। আমি নিশ্চিত, আমাদেরকে ছাড়া লিও অনায়াসে ডাইভ প্রজেক্ট চালিয়ে নিতে পারবে। তোমার কী মনে হয়?
‘ঠিকই বলেছ। রেমি স্যামের কাছে বসে ওর হাতে থাকা ট্যাবলেটের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। কী দেখছ?
‘ইন্টারনেটে দেখছি এইড কর্মীদের অপহরণের ঘটনার আগে বিদ্রোহীদের কোনো কার্যকলাপের রিপোর্ট পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু নেই।’
তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে?
‘তার মানে এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে আমরা এখানে আসার পর থেকে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের সাথে মিলে গেছে সময়টা।
‘ঠিক। কিন্তু এই বিদ্রোহীদের যদি এতটা জনপ্রিয়তা থাকে স্থানীয়দের কাছে তাহলে এদের ব্যাপারে তো কারও কিছু বলার কথা? তোমার কী মনে হয়? আমার কাছে তো পুরো বিষয়টা ঘোলাটে লাগছে।’ পেছনে হেলান দিল স্যাম, সমুদ্রের দিকে তাকাল। খনিজ পদার্থের সাথে অনেক অর্থের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। সোনা তো বটেই, পেট্রোলিয়ামটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যাপার। রেমির দিকে ফিরল স্যাম। ভাগ্য ভাল, এসব নিয়ে আমাদের সাথে ওদের কোনো লেনদেন নেই। ডুবে যাওয়া ইমারত আর গুপ্তধন নিয়েই আমাদের কারবার সীমাবদ্ধ।
হুম। দুপুরে গ্রিল করা মাহি মাহি আর আমের চাটনি হলে কেমন হয়? রেমি জানতে চাইল।
‘তুমি যখন বলেছ ভাল না হয়ে পারে?
‘সবসময় এত মেয়ে পটানো কথা পাও কোথায়? বলো তো?’ স্যামকে একটু তো দিয়ে চুমো খেল রেমি।
‘তা তো জানি না। শুধু জানি, আমার ভেতরে থাকা দুষ্টু মানুষটা চায় তুমি যেন আমার কথা শোনো।
ফাজিল!
***
কচ্ছপের গতিতে খাবার সার্ভ করা হলো ওদের রুমে। দুপুর দুটো বেজে গেল লাঞ্চ শেষ হতে হতে। লাঞ্চের পর ম্যানেজারের সাথে কথা বলল ওরা। বরাবরের মতো এবারও দ্বীপের পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিল ম্যানেজার। পার্কিং লটে এসে টয়োটাতে চড়ে বসল ফারগো দম্পতি। রওনা হলো আইল্যাণ্ড ড্রিমস-এর উদ্দেশে।
রেন্ট-এ-কারের এজেন্ট গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি বিষয়টা বুঝতে পারল। স্যাম ক্ষতিপূরণ বাবদ কয়েকশ ডলার দিতেই একেবারে গদগদ হয়ে গেল এজেন্ট। এমনভাবে সরি-টরি বলতে শুরু করল যেন গাড়ির এই দশা হওয়ার জন্য সে নিজেই দায়ী! ফারগো দম্পতিকে গাঢ় নীল রঙের নিশান পাথফাইণ্ডারের কাছে নিয়ে গেল সে। নিশানের অবস্থা দেখে মনে হলো এই গাড়ি পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করে ফেলেছে। ওতে চড়ে বসল ফারগো দম্পতি।
‘গাড়ির আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে যেন গুলি বেরোচ্ছে!’ স্যাম যখন গাডির গতি বাড়াচ্ছে তখন রেমি মন্তব্য করল।
‘এই দ্বীপের জন্য এই গাড়ি-ই ঠিক আছে। দাঁত বের করে হাসল স্যাম।
হোটেলের পার্কিং লটে গাড়িটা পার্ক করার সময় স্যাট ফোন বেজে উঠল। লবিতে ঢোকার পর ফোনটা রিসিভ করল স্যাম।
‘হ্যালো?’
সেলমা ভণিতা করে কোনো সময় নষ্ট করল না। আমরা কুমাসাকার হদিস পেয়েছি। তার মেয়ে টোকিও’র সাওয়ারা-তে থাকে। মহিলার বয়স এখন ৭০-এর ঘরে। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, কোনো সন্তান নেই।
তার সাথে যোগাযোগ করেছ?
না। ভাবলাম হয়তো তুমি নিজেই যোগাযোগ করতে পছন্দ করবে।
‘আচ্ছা। তুমি জাপানিজ ভাষা কীরকম পারো?
বুলগেরিয়ান ভাষা যতটা পারি ততটা।
হুম, বুঝেছি, পারো না। তোমার কোনো বন্ধু আছে যে আমাদেরকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারবে?
‘হ্যাঁ, আছে। তুমি জাস্ট বলল আমি নিজেকে কী বলে পরিচয় দেব?
তুমি তাকে বলবে, তুমি একজন ইতিহাসবিদের সাথে যুদ্ধের সময়কার জাপানিদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজ করছ। এখন এমন একজন অফিসারের ব্যাপারে জানতে চাও যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাণ্ডে কারাভোগ করেছে। সেটা হলো ওই মহিলার বাবা। তাই এব্যাপারে আমরা তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।’ থামল স্যাম। তুমি যদি আমাদের জন্য একটা মিটিঙের ব্যবস্থা করে দিতে পারো তাহলে আমি আর রেমি জাপানে হাজির হয়ে যেতে পারি।’
‘ওকে, বস। কিন্তু এই মহিলা বোধহয় যুদ্ধের সময় একদম বাচ্চা ছিল। তার সাথে এত পথ পাড়ি দিয়ে দেখা করে মনে হয় না খুব একটা উপকার হবে।
‘আমি জানি। কিন্তু আমাদের হাতে আর কোনো সূত্র নেই যেটা ধরে সামনে এগোনো সম্ভব। তুমি জাস্ট দেখো, তাকে আমাদের সাথে দেখা করার ব্যাপারে রাজি করাতে পারো কি না।
‘ওকে। ফোন অফ করে রেখো না কিন্তু।’ সেলমা লাইন কেটে দিল।
রুমে ঢুকে বারান্দায় গেল স্যাম। ফোন করল ডারউইনে।
ডেস ফোন রিসিভ করল। বরাবরের মতো তার কণ্ঠ বেশ উৎফুল্ল। স্যাম সাহেব! কী অবস্থা আপনার? রেডিও-তে শুনলাম দ্বীপে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে?
‘ঠিকই শুনেছেন। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। তবে এখন সব শান্ত।’
‘সব ঠিক তো?
‘হ্যাঁ সব ঠিক। আচ্ছা, কাজের কী অবস্থা? কাল হয়তো আমাদেরকে দ্বীপ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে।
‘ঘুরে আসুন। নো প্রবলেম। আপনার বন্ধু লিওনিড সবকিছু বেশ সামলে নিচ্ছে। একটু ধীরে-সুস্থে কাজ করে। তবে দক্ষ লোক।
‘ও কি আপনার কাছে আছে?
‘দিচ্ছি, এক সেকেণ্ড ধরুন। কিছুক্ষণ পর লিও’র কণ্ঠ শোনা গেল।
‘লিও, কী অবস্থা?
‘চলছে।’ বরাবরের মতো তিক্ত কণ্ঠে বলল লিও। তুমি কি এরচেয়ে বড় একটা বড় নৌকার ব্যবস্থা করতে পারবে?
‘চেষ্টা করছি, বন্ধু। আচ্ছা, ভাল কথা, ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে নতুন কিছু পেলে?
না। মূল মন্দিরের শরীর থেকে আগাছা পরিষ্কার করছি। আরও উন্নত যন্ত্রপাতি এলেও অনেকদিন লাগবে সব পরিষ্কার করতে। লিও’র কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা নেই।
‘ঠিক আছে। অপেক্ষা করা যাক। সবুরে মেওয়া ফলে, কী বলে?
“হুম” আওয়াজ ভেসে এলো ওপাশ থেকে; দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিও। ‘আমাকে আরও একটু বেকায়দায় ফেলতে স্বশরীরে আসবে নাকি এখানে?
না, বন্ধু। আজ পারছি না। তবে খুব শীঘ্রই আসব।’ স্যাম একটু ইতস্তত করল। আজ সকালে এখানে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ডেস কি এখনও পাড়ের দিকে নজর রাখছেন?”
‘হ্যাঁ রাখছে। কিন্তু রিপোর্ট করার মতো কিছু নেই। শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।
ধরে নাও, তোমরা ভাগ্যবান।’ হাসপাতালে অল্পের জন্য কীভাবে ওরা প্রাণে বেঁচেছে সেই ঘটনা লিওকে খুলে বলল স্যাম।
‘তারপরও তুমি মনে করো আমরা এখানে নিরাপদ?’ স্যামের কথা শেষ হওয়ার পর বলল লিও।
হুম। বিপদের দিকে নজর রাখলে তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না। একটা বিচ্ছিন্ন জায়গায় আছে তোমরা। সবসময় সজাগ থাকা ভাল।
‘উগ্র লোকদের হাতে মুণ্ড খোয়ানোর আশংকার চেয়ে এখন দেখছে এই সি-সিকনেস অনেক ভাল। অবশ্য এখন আর আগের মতো ভুগছি না।
‘পানিতে ডাইভ দিচ্ছ তাই সি-সিকনেস কেটে যাচ্ছে। আরও ডাইভ দাও। দেখবে একদম ফুরফুরে লাগবে।’
‘ঠিক আছে, দেব। তুমি একটা বিশাল জাহাজের ব্যবস্থা করো।
বন্ধুর আবদার শুনে হেসে ফেলল স্যাম। একটু আগে সেলমার সাথে কথা হয়েছে। আশা করছি, বড় জাহাজের ব্যাপারে খবর পাব। খবর পেয়েই জানাব তোমাকে।
কথা শেষ করে স্যাম ফোনটা রেখেছে একমুহূর্ত না যেতেই রিং হলো আবার।
‘সেলমা! এত তাড়াতাড়ি!
‘আমরা এক বান্ধবী আছে। আধা জাপানিজ। ও আমাদের হয়ে মহিলার সাথে যোগাযোগ করেছিল। বলল, কোনো সমস্যা নেই। মহিলা বেশ ভাল ইংরেজি বলতে পারে। তোমরা জাপানে গেলেই তার সাথে দেখা করতে পারবে। মহিলার কোনো আপত্তি নেই।
‘আমরা টোকিও-তে যাব। ফোন করতে হবে তাকে?
“হ্যাঁ। তাকে বলেছি আমাদের পক্ষ থেকে ফোন করে জানানো হবে। তার নাম্বার দেব?
‘দাও।’
সেলমা নাম্বার দিল।
নাম্বারটা আবার বলে নিশ্চিত করল স্যাম। তারপর জাহাজ প্রসঙ্গ তুলল। ‘তুমি বড় কোনো রিসার্চ জাহাজের ব্যবস্থা করতে পেরেছ? এদিকে জাহাজ জাহাজ করে লিও আমাকে পাগল করে ফেলছে।’
হুম, আমি কাজ করছি। ২৬০ ফুটের জাহাজ পেয়েছি একটা। সবধরনের যন্ত্রপাতি আছে ওতে। এখন দর কষাকষি করছি এখন। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। সেলমা একটা দাম বলল। এই দাম বলেছি পার্টিকে। চলবে?
‘এত দাম? ওদেরকে ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলেছ তো, আমরা কিন্তু জাস্ট ভাড়া নিচ্ছি একেবারে কিনে নিচ্ছি না কিন্তু!’ মশকরা করল স্যাম।
ভালই মজা করতে পারো। আচ্ছা, এখন কি খুব ব্যস্ত তুমি?
স্যাম এই কণ্ঠ চেনে। সেলমা যখন বিশেষ কিছু জানতে পারে তখন ওর কণ্ঠস্বর এরকম হয়ে যায়। স্যামের সাথে শেয়ার করতে ওর যেন আর তখন তর সয় না।
‘না, ফ্রি আছি। বলল।
‘তোমার জাপানিজ কর্নেলের ইতিহাস আরও ঘেঁটে বুঝলাম কেন কেউ মিয়েজি কর্পোরেশন নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। তুমি “ইউনিট ৭৩১”-এর নাম শুনেছ?”
না তো।
ইউনিট ৭৩১ হলো জাপানিজ আর্মির একটা দলের নাম যারা কয়েদি ও সাধারণ নাগরিকদের উপর বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট চালাত। কোনো চেতনানাশক ওষুধ না দিয়ে নিমর্ম গবেষণা চালাত তারা। কখনও জীবন্ত মানুষ পোত আবার কখনও বরফে জমাট বাধাতে। পর্যবেক্ষণ করত জীবন্ত মানুষ এভাবে মরে যেতে কত সময় লাগে। শরীরে বিষ কিংবা তরল রাসায়নিক পদার্থ ঢুকিয়েও পরীক্ষা চালিয়েছিল তারা। এমন কোনো খারাপ কাজ নেই তারা করেনি। ইউনিট ৭৩১ এর নেতৃত্বে ছিল জাপানিজ জেনারেল শিরিও ইষি।’
‘শিরিও ইষি। অদ্ভুত জাপানি নাম শুনে হাসল স্যাম।
‘ইউনিট ৭৩১ চীনে অবস্থান করেছিল প্রায় ১০ বছর। ১৫০ টা ভবন দখলে রেখেছিল তারা। যদিও বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। পানি শোধনাগারের ছদ্মবেশ দেয়া হয়েছিল ভবনগুলোতে। বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের পাশাপাশি জীবাণু দিয়ে যুদ্ধ করার ব্যাপারে জড়িত ছিল ইউনিট ৭৩১। তারা জীবাণু ভর্তি বিশেষ বোম ফেলেছিল চীনা জনসাধারণের উপর। মারাত্বক প্লেগ ছড়িয়ে গিয়েছিল তখন। সোজা কথায়, জাপানিরা ইউনিট ৭৩১-কে নাৎসিদের মতো ব্যবহার করলেও বাইরের মুখোশটা ছিল মাদার তেরেসার মতো।’
‘এসব কেন আগে শুনিনি? তুমি যেসব যুদ্ধাপরাধের কথা বলছ এগুলো প্রায় ১০০ বছর আগে ঘটে গেছে। আমার জানা থাকার কথা ছিল এসব।
কাহিনিই তো এখানে। জাপানিরা হেরে যাওয়ার পর মিত্রবাহিনি ইউনিট ৭৩১-এ জড়িত থাকা বিজ্ঞানীদেরকে সাজা এড়িয়ে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তার ফলে যুদ্ধ পরবর্তী জাপানে শক্তিশালী ধনী বনে গেল অনেক জঘন্য ব্যক্তিরা।’
এসবের কোনো প্রমাণ আছে?”
‘প্রমাণ বলতে কী বোঝো সেটার উপর নির্ভর করছে প্রমাণ আছে কি না। জাপানিজ সরকার বলছে, ইউনিট ৭৩১-এর ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো নথি নেই।’
‘আজব।
‘সেটাই। জাপানিজ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য শাস্তির বিধান আছে। কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছবি ঘাটলে সেসবের প্রমাণও পাওয়া যাবে কিন্তু সরকার উদাসীন। ইউনিট ৭৩১-এর সাথে যেসব বাঘা বাঘা ওষুধ কোম্পানি জড়িত ছিল তাদের মালিকরা সব শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও আইনজীবি। বুঝতেও পারছে, সরকার কেন এব্যাপারে উদাসীন।
মিত্রবাহিনি কোন আক্কেলে ওই শয়তানগুলোকে সাজা এড়িয়ে পার পেতে সাহায্য করল?
‘যুদ্ধের পর আমেরিকানরা চেয়েছিল এক্সপেরিমেন্টের যাবতীয় নথি ও ফমূলা যেন সোভিয়েতদের হাতে না যায়। তাই জাপানিদেরকে সাহায্য করে বছরের পর বছর ধরে জাপানি বিজ্ঞানীদের তৈরি সব রিসার্চের নথি বাগিয়ে নিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিট ৭৩১-এ জড়িত সবাইকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা সেটা করতে দেয়নি। ১৯৮০ সালের দিকে হয়েছে এসব।
‘তোমার ধারণা সেই একই কাজ মিয়েজি কর্পোরেশনের সাথেও করা হয়েছে?”
‘সবকিছু এত গোপন করে রাখাতে তো সেটাই প্রমাণ হচ্ছে।
‘তুমি নিশ্চিত?
শতভাগ।
সেলমার সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে দিল স্যাম। এতক্ষণ যা যা শুনল সব জানাল রেমিকে। সবশুনে রেমি স্তম্ভিত।
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু সেলমা বলেছে…’
‘আমি জানি। হয়তো এসব সত্যি। আমরা এটা নিয়ে আরও একটু রিসার্চ করতে পারি। অন্তত ইউনিট ৭৩১ নিয়ে রিসার্চ করা উচিত। সেলমা বলল, প্রায় ১০০ বছর পাওয়া হওয়ার পর এখন ইউনিট ৭৩১-এর ব্যাপারে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
মাথা নাড়ল রেমি। কুমাসাকা’র মেয়ের সাথে কথা বলা দরকার আমাদের। যত তাড়াতাড়ি বলা যায় তত ভাল।
‘ওকে। তুমি ফোন করবে? নাকি আমি করব?
‘আমি করব। তুমি কথা বললে সে ভয় পেতে পারে। আর আমি সেটা চাই না।’
‘তাহলে আমি কী করব?
‘টোকিও যাওয়ার ফ্লাইট বুক করো।
“ঠিক আছে, আগে ফ্লাইট শিডিউল দেখে নেই।
.
৩৫.
টোকিও, জাপান
সারাদিন ব্যয় করে গোয়াডালক্যানেল থেকে জাপানের নারিটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছুল ফারগো দম্পতি। সোজা পথে প্লেন এলে এত সময় লাগতো না, কিন্তু প্লেনগুলোকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে আসতে হয়, তাই পুরো দিন চলে যায় জাপান পৌঁছুতে।
এখানে আসার আগে রেমি কুমাসাকা’র মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলে এসেছে। মহিলার সাথে কথা বলে মনে হয়েছে সে বেশ সাবলীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ। তবে প্রতিটা জবাব দিয়েছে খুব সতর্কভাবে।
নারিটা বিমানবন্দর থেকে সাওয়ারা’র দূরতৃটা মূল শহর টোকিও চেয়ে কম। ম্যাপের উপর চোখ বোলাল স্যাম। ট্রেনলাইন দেখা যাচ্ছে। সেলমা অবশ্য আগেই ইমেইল করে সব তথ্য দিয়ে রেখেছে, কীভাবে, কোথায় যেতে হবে। লাইনে দাঁড়ানো ট্যাক্সিগুলোর দিকে এগোল স্যাম।
‘ট্রেনে যাব না?’ রেমি প্রশ্ন করল। নাকি টিকেট কাটার সিস্টেম জানো না বলে ভয় পাচ্ছো?”
‘আমাদের হাতে সময় সীমিত। স্যাম জবাব দিল। এখন ট্রেনের খোঁজ খবর নিতে গেলে অনেক সময় চলে যাবে। তাছাড়া কোনটা লোকাল ট্রেন আর কোনটা এক্সপ্রেস ট্রেন সেটাও আমাদের জানা নেই। তাই ঝুঁকি না নিয়ে ট্যাক্সিতে যাওয়াই ভাল। এখান থেকে মাত্র ১৫ কি.মি, যেতে হবে। কঠিন কিছু নয়।’
লাইনে দাঁড়ানো প্রথম ট্যাক্সিটা এগিয়ে এলো। যাত্রী ঢোকার দরজা খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ট্যাক্সির ড্রাইভার নেমে এসে ওদের লাগেজ তুলতে সাহায্য করে আবার ডাইভিং সিটে গিয়ে বসল। একটা কাগজে পরিষ্কার করে ঠিকানা লেখা আছে। রেমি সেটা ডাইভারকে দেখাতেই ঘনঘন মাথা নাড়ল ড্রাইভার। জানাল ঠিকানাটা তার চেনা আছে। অল্প-স্বল্প ইংরেজি বলতে পারে ড্রাইভার। হলিউড সিনেমা আর ইউটিউব দেখে শিখেছে। রেমি বলল, ওদের তাড়া আছে। ড্রাইভার যেন একটু দ্রুত গাড়ি চালায়। জবাবে জাপানিজ বলল, ড্যাশবোর্ডে জিপিএস লাগানো আছে। যে রাস্তা দিয়ে যেতে সবচেয়ে কম সময় লাগবে সেই রাস্তা দিয়েই ওদেরকে নিয়ে যাবে সে।
যতক্ষণ লাগবে ভেবেছিল ওরা, ট্যাক্সি করে ঠিকানায় পৌঁছুতে তারেচে একটু বেশি সময় লাগল। প্রায় ৪৫ মিনিট লেগেছে। কাঠের তৈরি এক আবাসিক বাড়ির সামনে এসে নামল ফারগো দম্পতি। স্যাম ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিতে চাইলে ড্রাইভার জানাল, সে তাদেরকে নিয়ে ফিরবে। যতক্ষণ সময় লাগবে তার অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই। খুশি হয়ে স্যাম ওকে বখশিশ দিয়ে রেমিকে নিয়ে বাড়ির দরজার দিকে এগোল।
দরজায় নক করার আগেই খুলে গেল দরজা। কালো সোয়েটার পরিহিত এক মহিলা দরজা খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসি উপহার দিলেন। রেমিও পাল্টা হাসি দিল। স্যাম রেমি’র একটু পেছন পেছন এগোচ্ছে। আগেই কথা হয়েছে, এখানার যাবতীয় বিষয় রেমি’র নেতৃত্বে হবে।
‘আপনি কর্নেল কুমাসাকা’র মেয়ে?’ রেমি প্রশ্ন করল।
মহিলা মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ। তবে আমাকে চিয়োকো বলে ডাকলেই খুশি হব। আপনি রেমি? আপনার কণ্ঠটা ফোনে শুনেছি বোধহয়। পরিচিত লাগছে।’
‘জি, আমি রেমি। আর ইনি আমার স্বামী স্যাম।
‘আপনাকে দেখে ভাল লাগল। স্যাম একটু মাথা নুইয়ে বলল।
‘ধন্যবাদ। ভেতরে আসুন। চিয়োকো ওদেরকে নিয়ে ভেতরে গেলেন।
রেমি খেয়াল করল মহিলার বাঁ পাশের গালে বেশ কিছু কাটাছেঁড়ার দাগ আছে। দাগগুলো দেখতে বেশ পুরোনো। চিয়োকোর গালে পুরো মেকআপ করা। তারপরও দাগগুলো সম্পূর্ণভাবে ঢাকা পড়েনি।
‘আমাদের সাথে দেখা করতে রাজি হওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভেতরে ঢোকার পর বলল রেমি।
‘ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। আপনারা আসাতে আমিও খুশি হয়েছি। কিন্তু আমার বাবার ব্যাপারে আপনাদেরকে তথ্য দিয়ে কতদূর সাহায্য করতে পারব তাতে সন্দেহ আছে। বাবার সাথে আমার ওঠাবসা হয়নি বললেই চলে। এদিকে আসুন… ভেতরের রুমে গিয়ে কথা বলি।
ফারগো দম্পতি এগোল চিয়োকো’র সাথে। রেমি লক্ষ্য করল মহিলার হাতেও গালের মত কিছু ক্ষত চিহ্ন আছে।
‘আপনারা বসুন। আমি চা করেছি। নিয়ে আসি।’ বলল চিয়োকো।
স্যাম ও রেমি বসে রইল চুপচাপ। ওদের মাথার উপরে একটা ফ্যান বনবন করে ঘুরছে। একটু পর রুমে ফিরে এলেন মহিলা। হাতে একটা ট্রে। তাতে তিনটা কাপ, একটা পট আর এক প্লেট মিষ্টি।
সবাইকে চা পরিবেশন করার পর চিয়োকো রুমের একটু ছায়া ঢাকা অংশে গিয়ে বসলেন।
‘আপনার অ্যাপায়নের জন্য ধন্যবাদ।’ কথা শুরু করল রেমি।
‘এসব তো কিছুই নয়। আপনার অনেক দূর থেকে এসেছেন।
‘তা ঠিক।’ রেমি একটু থামল। আপনি বেশ ভাল ইংরেজি বলতে পারেন।
‘আমি একটা আন্তর্জাতিক কোম্পানীতে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছি। আমেরিকার সাথে লেনদেন করত কোম্পানীটা। তাই ইংরেজি শিখতে হয়েছিল। তাছাড়া যে স্কুলে পড়ালেখা করেছিলাম সেখানেও ইংরেজি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছিল তখন। যুদ্ধের পর ইংরেজি জানা লোকদের খুব কদর ছিল। তবে অনেক বছর হলো আর চর্চা করি না। আমার ইংরেজি হয়তো এখন বেশ দূর্বল হয়ে গেছে। কোনো ভুল-ভ্রান্তি করে ফেললে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে। দেখবেন। আলতো করে তার স্টাইল করা ধূসর চুলে হাত চালালেন চিয়োকো। আপনারা আমার বাবা’র উপর গবেষণা করছেন। আমি তো ভয় পাচ্ছি, না জানি এতদূরে এসেও প্রয়োজনীয় তথ্য না পেয়ে আপনাদেরকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।
‘আসলে আমরা তার জীবনের গল্পের বিভিন্ন টুকরোগুলোকে একত্রিত করতে চাচ্ছি। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাণ্ডে যুদ্ধের সময় তিনি জাপানি সেনাবাহিনির একজন উচ্চপদস্থ অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। জানা যায়, কারাভোগ করা অবস্থায় ক্যাম্পেই মৃত্যু হয়েছিল তার। কিন্তু কর্নেল কুমাসাকা’র ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি।
‘আসলে আমি নিজেও এরচেয়ে বেশি কিছু জানি না। আমার জন্ম হয় ১৯৩৯ সালে। ততদিনে দিনে যুদ্ধে চলে গেছেন। তার সাথে আমার তেমন কোনো স্মৃতি জড়িত নেই।’
কিন্তু বড় হওয়ার পর নিশ্চয়ই বাবার সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন?
চিয়োকো মাথা নাড়লেন। যুদ্ধের পর সব বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। জাপান তখন নিজেকে ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে গড়তে ব্যস্ত। কেউ অতীত নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। অবশ্য যখন কলেজে পড়তাম তখন আমি একটু খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি। কোনো রেকর্ড পাইনি বাবার নামে।
‘তার কোনো ভাই-বোন আছে? কিংবা ঘনিষ্ঠ কেউ?
হা। একটা বোন ছিল। শক্ত করে ঢোঁক গিললেন চিয়োকো। আমাকে ফুপি-ই বড় করেছিলেন। ২০ বছর আগে তিনি মারা যান। বাবার ব্যাপারে ফুপি শুধু এতটুকু বলেছিলেন, বাবা অনেক সাহসী ও সম্মানী ব্যক্তি ছিল। অনেক দেশপ্রেম ছিল তার। দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি শহীদ হয়েছেন। তাছাড়া স্বামী হিসেবেও নাকি আমার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক ভাল ছিল। আপনাদের বলা হয়নি, যুদ্ধের সময় আমার মা-ও মারা যান।
‘দুঃখিত। নরম স্বরে বলল রেমি।
‘এসব নিয়ে কথা বলতে আমার এখনও কষ্ট হয়। অথচ কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। আমার তখন বয়স মাত্র ৬ বছর। টোকিও-তে প্রতিনিয়ত বোম পড়ছে। কিন্তু একদিন শুরু হলো চূড়ান্ত তাণ্ডব। আবাসিক এলাকায় বোম ফেলে সব চুরমার করে দেয়া হলো।’ চিয়োকো একটু থেমে শ্বাস নিলেন। ‘মায়ের শরীরে আগুন লেগে গিয়েছিল। আমার কপাল ভাল ছিল প্রাণে বেঁচে গেছি। কিন্তু আমার মা রক্ষা পায়নি।
‘খুব ভয়াবহ ঘটনা।
‘শুধু ভাষায় সেই ভয়াবহতা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মাইলের পর মাইল সব ছাই হয়ে গিয়েছিল তখন। টোকিও-র ১০ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল, মারা পড়েছিল প্রায় ১ লাখ। কথা বলতে বলতে চিয়োকো যখন রেমি’র দিকে তাকাল তখন তার চোখ ভেজা। টাটকা দুঃখ এখনও দেখা যাচ্ছে চোখে। নিজের চোখে নরক দেখেছি আমি। সে দৃশ্য কোনোদিনও ভোলা সম্ভব নয়। যে একবার এরকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাবে তার পক্ষে এসবের ঘা ভুলে যাওয়া কঠিন।
‘আমি দুঃখিত চিয়োকো। ফিসফিস সান্ত্বনা দিল রেমি।
‘ওরকম যুদ্ধ আর কখনও হয়নি। ভাগ্য ভাল ছিল, তাই বেঁচে গেছি। যুদ্ধের পর এক আত্মীয়র বাসায় বড় হতে শুরু করলাম। পৃথিবীতে এক নব্য শক্তিধর দেশ হিসেবে ধীরে ধীরে জাপান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল।
একটু সময় চুপ করে রইল রেমি। তারপর বলল, “আচ্ছা, তার কোনো ছবি বা চিঠি আছে?’
যা ছিল সব আগুনে পুড়ে গেছে। আমার ফুপির কাছে পুরানো কিছু ছবি আছে অবশ্য। ওগুলো আপনাদের কতটুকু কাজে আসবে বলতে পারছি না। ওসব বাবার তরুণ বয়সের ছবি। চিয়োকো একটু ইতস্তস্ত করলেন। ‘দেখবেন?
‘ছবিগুলো দেখতে পারলে দারুণ হয়। রেমি জবাব দিল। চিয়োকো ছবি আনতে রুম থেকে বের হলেন। কয়েক মিনিট পর ফিরলেন তিনি। হাতে একটা কার্ডবক্স। স্যাম উঠে দাঁড়িয়ে তার হাত থেকে কার্ডবক্সটা নিতে সাহায্য করল।
‘আমার আর গায়ের জোর নেই আগের মতো। সময় যেন সব শক্তি চুরি করে নিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের আয়ু, আশা-ভরসা, তারুণ্য সব চলে যায়।
স্যাম ও রেমি ছোট ছোট ধাতব ফ্রেমের ছবিগুলো দেখতে শুরু করল।
‘এই ছবিগুলো সবচেয়ে ভাল। এটাতে দেখতে পাবেন আমার বাবার ছেলেবেলার ছবি। তারপর ভার্সিটি থেকে পাশ করার পরের ছবি। একটা মাত্র ছবি আছে যেখানে বাবা-মা একসাথে উপস্থিত।
ছবিটা দেখল ওরা। শক্ত-সামর্থ্য এক তরুণ তার সুন্দরী বধূকে নিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে ছবি উঠেছে। ছবিটা সাদাকালো কিন্তু তারুণ্যে উদ্ভাসিত।’ রেমি ফ্রেমটা ধরে দম বন্ধ করে বলল, আপনার মা তো দেখতে ভয়ঙ্কর সুন্দরী ছিলেন!
‘ঠিক বলেছেন। আমার ফুপিও সবসময় তার রূপের প্রশংসা করতেন। চিয়োকা অন্য একটা ফ্রেম কাঁপা হাতে তুলে নিয়ে তাকালেন রেমি’র দিকে। ‘এই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। ফুপি তুলেছিল এটা। আমেরিকার সাথে যুদ্ধের আগে আরশায়ামা-তে তোলা। ওখানকার গাছগুলোতে সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে। সে-বছর একটু দেরিতে ফুটেছিল। একদম কনকনে শীতে আরকী। তারপর একটা সময় আছে যখন গাছ থেকে সব ফুল ঝরে যায়। তখন মনে হয় যেন গোলাপী রঙের তুষার পড়ছে।
ফারগো দম্পতি ছবিটা ভাল করে লক্ষ্য করল। কুমাসাকা’র পরনে আর্মির পোশাক। ছবিতে একটা ক্লাসিক ভাব আছে। ছবিতে কুমাসাকা’র বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। স্যাম নিশ্চিত হলো যুদ্ধের আগেই কুমাসাকা কর্নেল পদে ছিলেন। জাপানের সাথে আমেরিকার ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালে।
‘আপনার বাবার চাকরি জীবন সম্পর্কে কিছু জানেন? ইউনিট ৭৩১-এ তিনি ছিলেন কিনা কিংবা মিয়েজি কর্পোরেশনের সাথে জড়িত ছিলেন কিনা? রেমি জানতে চাইল।
‘আমি এসবের নাম এরআগে কখনও শুনিনি। একটু খুলে বললে ভাল হয়।
‘এগুলো আর্মি গ্রুপ। মেডিক্যাল রিসার্চের সাথে জড়িত ছিল।’
‘মেডিক্যাল? কিন্তু আমার বাবা তো ডাক্তার ছিলেন না।
তার মাইক্রোবায়োলজি-তে ডিগ্রি ছিল।’
‘ছিল। কিন্তু অফিসার হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করেছিলেন। অর্জিত ডিগ্রিকে বাস্তব জীবনে কোনে কাজে লাগাননি। আমার ফুপির মুখে শুনেছি, তখন অনেক জাপানিরা নিজেদের পড়াশোনাকে পেশাগত কাজে না লাগিয়ে আর্মিতে যোগ দিয়েছিল।
‘আর্মিতে কর্নেল কুমাসাকা’র কাজ কী ছিল? জানেন?
ফুপি বলতেন, তিনি যোগাযোগ সেকশনে ছিলেন। সত্যি বলতে, এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না।’
স্যাম বক্সে চোখ বোলাচ্ছিল। আচ্ছা, এটা কী? একটা চামড়ার নোটবুক দেখিয়ে প্রশ্ন করল ও। নোটবুকটা অবস্থা বেশ খারাপ। আর একটু হলেই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিল।
‘ওহ। এটার কথাই বলতে চাচ্ছিলাম এখন। জেলে থাকা অবস্থায় আমার বাবা জার্নাল লিখতেন। আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। তেমন কিছু পাইনি। কারাভোগ সম্পর্কিত কয়েকটা কবিতা আছে, এইতো। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার সাথে থাকা এক কয়েদি এটা আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। তার মুখে শুনেছি, জেলখানায় ডায়েরি রাখার অনুমতি ছিল তখন তবে সেটা নিয়মিত তদারকি করা হতো উল্টাপাল্টা কিছু লেখা হচ্ছে কিনা। তাই এই নোটবুকে তথ্য পাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই।’
‘আমি কি নোটবুকটা দেখতে পারি? রেমি অনুমতি চাইল।
‘অবশ্যই। তবে পুরোটা কিন্তু কানজি ভাষায় লেখা।
চিয়োকো নোটবুকটা রেমির হাতে দিলেন। পৃষ্ঠাগুলো হলুদ হয়ে গেছে। বিজাতীয় অক্ষর লেখা সব পৃষ্ঠায়। রেমি বলল, আমরা কি এটার একটা কপি করতে পারি? নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এটাকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেব।
‘এখানে আসলে কিছু নেই। তারপরও যখন কপি করতে চাচ্ছেন, করুন। আমার আপত্তি নেই।’
আর আধঘণ্টা আলাপ করল ওরা! চিয়োকো যথেষ্ট মিশুক মহিলা। কিন্তু তার কাছে তথ্য না থাকায় ফারগো দম্পতি নতুন কিছু জানতে পারল না। কথা শেষে বের হলো ওরা।
‘চিয়োকো, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ’ বলল রেমি। আপনি আপনার মূল্যবান সময় আমাদের দিয়েছেন এবং দুঃখের স্মৃতিগুলো শেয়ার করেছেন। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
চিয়োকো তার পায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, “আমারও ভাল লেগেছে। আমি দুঃখিত, আপনাদেরকে তেমন কোনো তথ্য দিয়ে উপকার করতে পারলাম না।’
‘আপনি যথেষ্ট করেছেন। আবারও ধন্যবাদ। আসি। ট্যাক্সি বাইরে অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। তাতে চড়ে বসল ফারগো দম্পতি। রেমি ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে বলল, এখানে কোনো স্ক্যান ফটোকপির দোকান আছে?