1 of 2

৩১. আয়েশা বেগম নৌকায় বসে আছেন

এসডিপিও ফয়জুর রহমান সাহেবের পুত্রকন্যারা এবং তার স্ত্রী আয়েশা বেগম নৌকায় বসে আছেন।

আয়েশা বেগম রোজা রেখেছেন। স্বামীর মঙ্গলের জন্যে নফল রোজা। মাগরেবের সময় হয়ে গেছে। রোজা ভাঙতে হবে। রোজা ভাঙার কোনো প্রস্তুতি নেই। সামান্য পানিও নেই যে পানি খেয়ে রোজা ভাঙা যায়।

তিনি তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্গাপুর ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে এক সম্পন্ন বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। এসডিপিও সাহেবের স্ত্রী–সেই হিসেবে বাড়ির লোকজন তাদেরকে খুব আদর-যত্ন করছিলেন। হঠাৎ কী হয়ে গেল, বাড়ির কর্তা খসরু মিয়া (ছদ্মনাম*) আয়েশা বেগমের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমরা আপনাদের এই বাড়িতে রাখতে পারব না। বাড়ি ছাড়তে হবে।

আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন, বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব?

বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবেন–সেটা আপনি খুঁজে বের করেন। আমি নৌকা আনায়ে রেখেছি, নৌকায় উঠেন।

আমি আপনাদের অঞ্চল কিছুই চিনি না। বাচ্চাদের নিয়ে আমি যাব কোথায়? আমার বড় বড় দুটা মেয়ে আছে।

আপনি খামাখা সময় নষ্ট করতেছেন। নৌকায় উঠতে বলছি, নৌকায় উঠেন। আমরা খবর পেয়েছি, আপনার স্বামীকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। আপনার দুই ছেলেকে খুঁজতেছে। আপনাকে এখানে বাখলে আমরা সবাই মারা পড়ব।

আয়েশা বেগম বললেন, আজকের রাতটা থাকতে দিন। সকালবেলা আমি যেখানে পারি চলে যাব।

অসম্ভব। নৌকায় উঠেন। সামান্য দয়া করেন। আমরা মহাবিপদে আছি।

সবাই বিপদে আছে, এখন দয়া করাকরির কিছু নাই।

খসরু মিয়ার হুকুমে জিনিসপত্র নৌকায় তোলা হতে লাগল। আয়েশা বেগম তার ছোট মেয়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে নৌকায় উঠলেন। নৌকার মাঝি বলল, আপনারা কোথায় যাবেন? তিনি বললেন, জানি না।

 

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। নৌকা বরিশালের আঁকাবাঁকা খাল দিয়ে এগুচ্ছে। আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ আগে নৌকা থেকে হাত বাড়িয়ে খালের পানি দিয়ে রোজা ভেঙেছেন। নৌকার মাঝি খুবই অস্থির হয়ে গেছে। কোথায় যাবে কেউ বলছে না। সে কিছুক্ষণ পরপর জিজ্ঞেস করছে, পরিষ্কার করেন। কথা পরিষ্কার করেন। আপনেরা যাইবেন কই? এসডিপিও সাহেবের বড় ছেলে বলল, আমরা কোথাও যাব না। নৌকায় নৌকায় ঘুরব।

মাঝি বলল, এইটা কেমন কথা?

বড় ছেলে বলল, এইটাই আসল কথা।

মাঝি ভীত চোখে তাকাচ্ছে, কারণ এই ছেলের হাতে বন্দুক। শুধু এই ছেলের হাতেই যে বন্দুক তা-না, তোর ছোটভাইয়ের হাতেও বন্দুক।

এসডিপিও সাহেবের অস্ত্রশস্ত্রের প্রতি অন্যরকম অনুরাগ ছিল। সরকারি পিস্তল ছাড়াও তার ব্যক্তিগত একটা পিস্তল আছে। দুটা আছে পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেল! জীবনের বিরাট দুঃসময়ে এসডিপিও সাহেবের ছেলেমেয়েরা এইসব অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে বসে আছে। বরিশাল ডাকাতের দেশ। ডাকাতদের কাছে খবর চলে যাবার কথা যে একটা অসহায় পরিবার নৌকায় ঘুরছে।

নৌকা বড় একটা বাঁক পার হলো আর তখনি দেখা গেল একুশ-বাইশ বছর বয়েসি মাথায় টুপি পরা এক যুবক ছুটতে ছুটতে আসছে। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে নৌকা থামানোর জন্যে। নৌকা থামানো হলো। যুবক বলল, আপনাদের যে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, আমি সেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোরান শরিফ পড়াই। আপনাদের বিপদ দেখে আমার মন খারাপ হয়েছে। আপনারা কি আমার বাড়িতে উঠবেন? আমার ছোট্ট একটা ঘর আছে। আমি একা থাকি।

আয়েশা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, উঠব। তাঁর বড় ছেলে বলল, এই লোক যে গভীর রাতে ডাকাত খবর দিয়ে আনবে না বা আমাদের মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেবে না–তার নিশ্চয়তা কী?

আয়েশা বেগম বললেন, একটা লোক আশ্রয় দিতে চাচ্ছে, আল্লাহর নাম নিয়ে তার বাড়িতে উঠ।

সবাইকে নিয়ে রাত দশটার দিকে গভীর জঙ্গলের ভেতর এক বাড়িতে আয়েশা বেগম উঠলেন। স্বামীর মৃত্যু বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। উড়া উড়া খবর এসেছে। কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলছে না। তিনি সারা রাত তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কোরান পাঠ করলেন। তাঁর দুই ছেলে রাইফেলে গুলি ভরে পাহারায় থাকল। ভোরবেলা পাংখাপুলার রশিদ এসে উপস্থিত। তার চোখ লাল, মুখ শুকনা। রশিদকে দেখে আয়েশা বেগম বললেন, তোমার সাহেবের খবর কী? উনি কোথায়?

রশিদ চুপ করে রইল।

উনি কি বেঁচে আছেন?

রশিদ বলল, জি আম্মা। (এটা রশিদের মিথ্যা ভাষণ। সে সব জেনেই এসেছে। পরিবারটিকে গভীর বেদনার সংবাদ দিতে পারছে না।)

আয়েশা বেগম বললেন, বেঁচে আছেন, তাহলে উনি কোথায়?

পলাতক আছেন। আম্মা শুনেন, উনার কথা এখন চিন্তা করে লাভ নাই। আপনাদের বিষয়টা এখন চিন্তা করা দরকার। অনেক সন্ধান করে আপনাদের পেয়েছি। এইখানে আমি আপনাদের রাখব না। অন্য জায়গায় নিয়ে যাব।

গোয়ারেভখার পীর সাহেবের বাড়িতে নিয়া যাব। উনাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনারা নিরাপদে থাকবেন।

কখন নিয়ে যাবে?

এখন নিয়া যাব। আমি নৌকার ব্যবস্থা করতেছি। আম্মা অস্থির হয়েন না। আমি আছি। আমি আপনাদের জন্যে জীবন দিয়া দিব। আপনাদের কোনো বিপদ হইতে দিব না। নবিজির কসম, আল্লাহপাকের কসম।

রশিদ এই অসহায় পরিবারটিকে গোয়ারেভখার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। তাদের সে বাড়িতে স্থায়ী করে ফিরে গেল পিরোজপুরে। এসডিপিও সাহেবের বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসবে।

রশিদকে পিরোজপুর শহরে ঢোকার মুখেই অ্যারেক্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসডিপিও সাহেবের পরিবার কোথায় আছে সেই খবর বের করা হবে। পিরোজপুরের মিলিটারি কমান্ডের প্রধান কর্নেল আতিক (ফুটবল প্লেয়ার–পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের একজন) এসডিপিওর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তিন ছেলেমেয়েকে খুঁজছে। তাকে খবর দেয়া হয়েছে পিরোজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এ তারাও ছিল। তারা ট্রেনিং নিয়েছে।

কর্নেল আতিককে সাহায্য করছে পিরোজপুর থানার ওসি। এই ওসি সাহেব খুব সম্ভব জীবন রক্ষার জন্যেই মিলিটারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। রশিদের সঙ্গে ওসি সাহেবের নিম্নোক্ত কথাবার্তা হলো–

এসডিপিও সাহেবের ফ্যামিলি কোথায় আছে?

স্যার, আমি জানি না।

অবশ্যই তুমি জানো। আমার কাছে খবর আছে তুমি জানো। তুমি যে শুধু জানো তাই না। তুমি তাদের দেখভালও করছি।

স্যার, আমি জানি। কিন্তু বলব না।

মিলিটারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস তুমি জানো। এই খবর না দিলে কিন্তু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে।

স্যার, আমি কিছুই বলব না!

আরে ব্যাটা নিজের জীবন বাঁচা। এখন ইয়া নফসি সময়। বলে দে তারা কোথায় আছে?

আমি কোনোদিন ও বলব না।

রশিদকে সেই দিনই সন্ধ্যায় হুলারহাট লঞ্চঘাটে নিয়ে গুলি করে মেরে

ফেলা হলো।

————-
*মূল নাম ব্যবহার করছি না। এই মানুষটির নিদায়তা ও নিষ্ঠুরতার অপরাধ আমার মা ক্ষমা করেছেন। বলে অ্যামিও ক্ষমা করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *