আজ ছুটির দিন, অতীন ঠিক করেই ফেলেছে যে আজ সারাদিন সে বাড়ি থেকে বেরুবে না। এমন কি ঘর থেকে বেরুবারও কোনো দরকার নেই। কোথায় যাবে সে? এক একদিন বাইরের কোনো দৃশ্য না দেখলে নিজের ঘরটাই পৃথিবী হয়ে যায়। এক একটা দিন তো নিজেকেও দেখা দরকার। অন্য মানুষজনের মধ্যে থাকলে নিজের দিকে চোখই পড়ে না।
ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ সে বিছানা ছেড়ে উঠলো না। নিচে গেলে খবরের কাগজ আনা যায়, ইউনিভার্সিটির একটা দৈনিক পত্রিকা বিনা পয়সায় পায় অতীন। কিন্তু একদিন কাগজ না পড়লে কী আসবে যাবে? ডাক পিওন এসে যায় বেশ সকালে, এখানকার সব বিদেশী ছাত্রেরই ঘুম ভাঙার পর ছুটে গিয়ে চিঠির বাক্সটা খুলে দেখা একটা নেশা। রোজ কিছু না কিছু চিঠি থাকবেই, তার মধ্যে অধিকাংশই বিজ্ঞাপন, তার মধ্যে আবার নানারকম উপহারও থাকে, ব্লেড, টুথ পেস্ট, পুঁচকে পুঁচকে শিশিতে পারফিউম, একদিন সে একটা মাঝারি সাইজের বোতলের রান্নার তেলও পেয়েছিল। এই সপ্তাহেই অতীন দেশ থেকে মায়ের চিঠি পেয়েছে, আজ আর কোনো দরকারি চিঠি পাবার আশা নেই।
সাড়ে নটার সময় অতীন উঠলো। তার শরীরে কোনো পোশাক নেই। রাত্তিরে এই অবস্থাতেই সে একটা চাঁদর ঢাকা দিয়ে শোয়। ঘর থেকে বেরুতে না হলে শুধু শুধু গায়ে জামা কাপড় চাপাবারই বা কী মানে হয়? দুদিন ধরে বেশ পচা গরম পড়েছে। এ দেশে ঘর গরম করার ব্যবস্থা আছে, ঘর ঠাণ্ডা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সাহেবদের দেশেও যে এত গরম পড়ে তা অতীন আগে অনুভব করেনি। নিউ ইয়র্ক কিংবা লন্ডনেও সে গ্রীষ্মকালে গরম পেয়েছে, কিন্তু এতটা নয়, বস্টনের মতন বন্দর-শহরে যখন হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন রীতিমতন চিটচিটে গরম লাগে।
দ্রুত ব্রেক ফাস্ট সেরে নিয়েই অতীন পড়ার বই হাতে নিল। পাগলের মতন পড়াশুনো শুরু করেছে সে, ঠিক কলকাতায় পরীক্ষার আগেকার দিনগুলোর মতন। সে কলকাতার কথা, বন্ধুবান্ধবদের কথা একবারও ভাববে না, অলি কিংবা শর্মিলার কথা মনেও আনবে না। তাকে পড়াশুনো শেষ করে এদেশ থেকে পালাতে হবে। আমেরিকা ছাড়ার আগে সে বস্টন থেকে অন্তত দূরে চলে যাবে।
সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় অতীন হাতে একটা বই নিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে। দৌড়োচ্ছে। বিছানায় শুয়ে কিংবা টেবিলে বসে তার পড়ায় ঠিক মন লাগে না। দৌড়ে দৌড়ে পড়বার একটা সুবিধে, তাতে পড়াও হয়, খানিকটা ব্যায়ামও হয়।
মাঝে মাঝে থামতে হয় অবশ্য। জুডির তৈরি এগ খেয়ে তার সর্দিটা অনেকটা কমেছে বটে কিন্তু ঘঙঘঙ কাশিটা একেবারে যায়নি। সে জন্য সে সিগারেট খাওয়া কমিয়েছে কিন্তু কোনো ওষুধ খাবে না প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে।
এক সময় তার সারা শরীর ঘামে জবজবে হয়ে গেল। ব্যায়াম হয়েছে ভালোই, পড়াশুনোও মন্দ চলছে না। এখন মিনিট দশেক রিসেস নেওয়া যায়। তেষ্টাও পেয়েছে খুব। ঘরে গোটা ছয়েক বীয়ারের ক্যান আছে, এ বাড়ির একটি পাঞ্জাবী ছেলে নিজের ঘর ছেড়ে চলে যাবার সময় তার একটা মিনি ফ্রিজ পনেরো ডলারে বিক্রি করে গেছে অতীনকে। অতীন বীয়ার নিল না, কফির জন্য জল চড়ালো। গতকালই সে মাইনে পেয়ে অনেক কিছু বাজার করে এনেছে, কিন্তু সে স্কচ বা বার্বনের মতন হার্ড ড্রিংকস কিছু কেনেনি, এক এক বীয়ার ক্যান যে এনেছে তাও ঘরে কোনো অতিথি এলে তাকে অফার করবার জন্য। অতীন এখন প্রতিটি ডাইম ও নিকেল জমাতে চায়। সিদ্ধার্থর কাছে এখনো তার কিছু ধার আছে। মাস গেলে তার বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ মাইনের অর্ধেকের বেশী খরচ হয়ে যায়। হঠাৎ প্লেনে চেপে এ দেশ থেকে পালানোও তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তো আসলে নিবাসিত, কবে তার মেয়াদ শেষ হবে?
ঘামে ভেজা শরীর নিয়েই অতীন ধপাস করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। চাঁদরটা অনেকদিন কাঁচা হয়নি। শর্মিলা এসে দেখলে প্রথমেই একটানে চাঁদরটা খুলে ফেলে দিত। এই চাঁদরটাও শর্মিলারই কেনা। শর্মিলা এ ঘরে আর কোনোদিন আসবে না।
শর্মিলাকে নিশ্চয়ই কেউ অলির কথা বলে দিয়েছে। ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল শর্মিলার? তাছাড়া আর তো কোনো ব্যাখ্যা নেই। অলির ওপর অবিচার করেছে অতীন, সে ব্যাপারটা তার নিজের মুখেই বলা উচিত ছিল শর্মিলাকে। তা সে পারেনি, সেই জন্য সে শাস্তি পেয়েছে। তার জীবনে এখন অলিও নেই, শর্মিলাও নেই। না, অলিকেও সে কিছুতেই মিথ্যে কথা বলতে পারবে না। যাক, তার আর কারুকেই দরকার নেই।
মাঝে মাঝে একটা সাঙ্ঘাতিক নৈরাশ্য যেন দৈত্যের মতন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কী হলো এই জীবনে? একটার পর একটা ভুল। তাহলে কি আর বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়? অথচ, আশ্চর্য, মৃত্যু তাকে ছোঁয় না। এই যে সেদিন তার সাইকেলের সঙ্গে একটা গাড়ির ধাক্কা লাগলো, তবু তার শরীরে একটা আঁচড়ও পড়লো না? এইসব দুর্ঘটনায় যখন-তখন লোক মারা। যায়।
গায়ের ঘামটা শুকোচ্ছে না, একটা জানলা খুলতে হবে, যদি হাওয়া আসে একটু। কফি বানিয়ে, কাপটা হাতে নিয়ে একদিকের পদার পাশে দাঁড়িয়ে অতীন জানলার একটা পাল্লা খুলে দিল। তার কোমর পর্যন্ত দেখা যাবে না। বাইরে একেবারে তলোয়ারের মতন রোদ। এখান থেকে একটি বাড়ির বাগান সোজাসুজি চোখে পড়ে। এই রোদের মধ্যেও বাগানে একটা ডেক-চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছে একটি যুবতী মেয়ে। গায়ের চামড়া টান করার কী সাঙ্ঘাতিক চেষ্টা। শুধু একটা জাঙ্গিয়া পরা, কিছু একটা ক্রিম মেখেছে সারা গায়ে, মেয়েটিকে দেখাচ্ছে কোনো অয়েল পেইন্টিং-এর মতন।
অতীন মেয়েটিকে দেখছে না, এমনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নৈরাশ্যের দৈত্যটা ছাড়ছে। না তাকে। খালি মনে হচ্ছে, কী হলো, এ জীবনে কী হলো? দেশের সমাজব্যবস্থা পাল্টাবার জন্য পারিবারিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে শুধুমাত্র একটা মানুষ খুন করে পালাতে হলো তাকে? না, না, মাঠের মধ্যে ঐ লোকটাকে অতীন মারেনি। যে-মৃত্যু সবসময় অতীনকে রক্ষা। করে, সেই মৃত্যুই অতীনের হাত দিয়ে ওকে শেষ করে দিয়েছে। নইলে, জীবনে কক্ষনো রিভলভার ছোঁড়েনি অতীন, তবু তার গুলি লোকটার গায়ে লাগলো! অবশ্য তারপরেও অতীন একটা লোহার ডাণ্ডা দিয়ে লোকটাকে পিটিয়েছিল, তখন সে ভেবেছিল, মানিকদা শেষ! একজন বিপ্লবী হয়ে সে তার প্রতিশোধ নেবে না? মানিকদা একটা চিঠি লিখলেন না, এতদিনের মধ্যে, এমন কি কৌশিক, তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কৌশিক, সেও কি ভুলে গেছে অতীনকে?
বাগানের সেই যুবতীটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে বোঝা গেল, তার উধ্বাঙ্গেও কোনো বক্ষবন্ধনী নেই। সে চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে গেল একটা ন্যাসপাতি গাছের নিচে। আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ তাকে দেখছে কি না, তাতে তার কোনো লুক্ষেপই নেই। এরা শরীর দেখাতে ভালোবাসে। অতীন এবার লক্ষ না করে পারলো না যে মেয়েটির সারা শরীরের তুলনায় সুগোল স্তনদুটি বেশী ফর্সা, ব্রেসিয়ারের পরিষ্কার দাগ।
সঙ্গে সঙ্গে তার দরজায় খট খট শব্দ হলো। প্রচণ্ড অপরাধবোধে কেঁপে উঠলো অতীন। যেন সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে দিল সে। কিন্তু নিজের এই অবস্থায় দরজাই বা খোলে কী করে?
জাঙ্গিয়াটা পায়ে গলাতে গলাতে সে জিজ্ঞেস করলো, হু ইজ ইট?
বাইরে থেকে শোনা গেল, আমি সোমেন। আপনার টেলিফোন।
–একটু ধরতে বলুন, প্লীজ। আমি এক্ষুনি আসছি!
এই সময় কে তাকে টেলিফোন করবে? পয়সা সস্তা হয় বলে সিদ্ধার্থ করে রাত দশটার। পর। কাল সন্ধেবেলা জুড়ি একবার ফোন করেছিল, অতীন দু’দিন সন্ধেবেলা ল্যাবে নিজের কাজ করতে যায়নি, সেইজন্য সে অতীনের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছিল। জুডি একদিন তাকে রান্না করে খাইয়েছে। অতীনের উচিত তাকেও একদিন ডেকে খাওয়ানো। এদেশে সবসময় একটা অদৃশ্য বিনিময় প্রথা চলে।
প্যান্টের মধ্যে একটা শার্ট গলিয়ে নিয়ে বেল্টটা বাঁধতে বাঁধতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। অতীন। লিভিংরুমে একা মুখ চুন করে বসে আছে আবিদ হোসেন। কদিন ধরেই ওর মন খুব খারাপ। দেশ থেকে কোনো চিঠি পাচ্ছে না, টেলিফোনেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
ফোনটা তুলে, ওদিকের কণ্ঠস্বর শুনে অতীনের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা জলের স্রোত নেমে এলো। শর্মিলা? সত্যি শর্মিলা?
শর্মিলার গলায় কোনো আবেগ নেই, সে শান্তভাবে বললো, সরি, বাবলু, তোমায় বিরক্ত করলুম। তুমি কি ব্যস্ত ছিলে? ২৪৮
অতীনও নিস্পৃহ গলায় বললো, সেরকম কিছু না। শর্মিলা বললো, আমি একটা চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি আমায় একটু হেল্প করতে পারবে?
অতীন বললো, চাবি? কিসের চাবি?
–আমি তো প্রায়ই চাবি হারিয়ে ফেলি, এই চাবিটা অনেকদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না, মানে, আমার কলেজের ফাইল ক্যাবিনেটের চাবি, অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে, খুলতে পারছি না। বলে এত অসুবিধে হচ্ছে–
–সেজন্য আমি কী করতে পারি?
–চাবিটা কি বাই এনি চান্স তোমার ঘরে কখনো ফেলে এসেছি? তুমি কি ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং করার সময় কোনো চাবি পেয়েছো?
শর্মিলার সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর অতীন একদিনও ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালায়নি। কিন্তু ফ্লোরে কোনো চাবি পড়ে থাকলে কি সে দেখতে পেত না?
–না, কোনো চাবি পাইনি!
–তোমার ওয়ার্ডরোবে আমি মাঝে মাঝে আমার হ্যান্ডব্যাগটা ঝুলিয়ে ১.খতুম। ওখানে যদি পড়ে গিয়ে থাকে, যদি একটু খুঁজে দ্যাখো …
–ঠিক আছে, দেখবো খুঁজে…
–বাবলু, কাল ক্যাবিনেটটা খোল৷ খুবই দরকার, আমার প্রফেসার একটা কাজের ভার দিয়েছিলেন, সেটা যদি কাল সাবমিট না করি…আমি ফোনটা ধরে আছি, তুমি একটু ওয়ার্ডরোবটা খুঁজে দেখে এসে বলবে প্লীজ?
–আচ্ছা ধরো, দেখে আসছি!
সে রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই আবিদ হোসেন গোমড়া মুখে বললো, আমি অপারেটরকে একটা কল বুক করেছি, এনি মোমেন্ট এসে যেতে পারে।
অতীন বললো, কানেকশন পেয়ে গেলে ওরা ইন্টারসেপট করবে, তখন আপনি লাইন নিয়ে নেবেন।
দৌড়ে সে উঠে গেল ওপরে। তার মুখটা তেতো লাগছে। শর্মিলা তার সঙ্গে শুধু একটা চাবি নিয়ে কথা বলে গেল? যেন একটা চাবি খুঁজে পাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে তার অতীনের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহই নেই। তার গলায় অতিরিক্ত ভদ্রতার কৃত্রিম সুর।
ওয়ার্ডরোবে কোনো চাবি পড়ে নেই জেনেও অতীন ভালো করেই খুঁজে দেখলো। শর্মিলা এখানে তার হ্যান্ডব্যাগটা ঝুলিয়ে রাখতো ঠিকই। একদিন বৃষ্টি ভিজে এসে শর্মিলা তার শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ সব খুলে রুম হিটারে শুকোতে দিয়ে অতীনের প্যান্ট-শার্ট পরে নিয়েছিল।
সে সব যেন গত জন্মের কথা।
ফিরে এসে অতীন এবার বেশ কঠিন গলাতেই বললো, আমার ঘরে তোমার চাবি কিংবা
অন্য কোনো কিছুই পড়ে নেই!
শর্মিলা বললো, এক্সট্রিমলি সরি টু বদার ইউ, বাবলু! কিছুতেই চাবিটা পাচ্ছি না, আই যাস্ট টুক আ চান্স! থ্যাঙ্কস অল দা সেইম! তোমার কাশি হয়েছে?
–কে বললো, না তো!
–দু একবার কাশছিলে। শরীরের যত্ন নিও।
–থ্যাঙ্কস ফর দা অ্যাডভাইস!
অতীন নিজেই রেখে দিল ফোনটা। তারপর আবিদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললো, এখনও লাইন পাননি? বসে থাকুন, আশা ছাড়বেন না। গুড লাক!
অতীন ঠিক করলো, নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার পড়তে পড়তে সে জানলাটা খোলাই রাখবে। পাশের বাড়ির সবুজ বাগানে একজন প্রায় নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখতে দোষ কী? দেখলে তো ভালোই লাগে। জুড়িকেও সে দু’একদিনের মধ্যেই নেমন্তন্ন করে তার ঘরে এনে বেঁধে খাওয়াবে। এতে দোষ কী আছে? জুড়ি মেয়েটি মোটেই-সাধারণ অ্যামেরিকান মেয়েদের মত নয়!
তবু ওপরে ওঠবার আগে সে সোমেনের দরজার কাছে দাঁড়ালো। এদেশে থাকতে থাকতে একটা ধন্যবাদ-কালচারে অভ্যস্ত হতেই হয়। থ্যাঙ্কস আর থ্যাঙ্ক ইউ সবসময় ঝুলিয়ে রাখতে হয় ঠোঁটে। একটি অত্যন্ত বিষাক্ত টেলিফোন-ডাক হলেও সোমেন ওপরে গিয়ে অতীনকে এই টেলিফোনের খবর দিয়ে এসেছে, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ না জানানো অত্যন্ত অভদ্রতা।
দরজাটা ভেজানেনা, ভেতরে গীটার বাজিয়ে গান চলছে। মনে হচ্ছে, সোমেন ছাড়াও ঘরে আরও কেউ আছে। সোমেনের এক অ্যামেরিকান বান্ধবী আসে মাঝে মাঝে। অতীন দরজায় মৃদু টোকা দিল।
সোমেনের বদলে অর্ধেক দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে একটি সুদর্শন যুবক বললো, ইয়েস? কাম অন ইন!
অতীন বললো, আমি সোমেনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই!
অপরিচিত যুবকটি সরে গেল, সোমেন দরজার কাছে আসতেই অতীন বললো, আই যাস্ট ওয়ান্টেড টু থ্যাঙ্ক ইউ!
সোমেন অতীনের হাত ধরে টেনে বললো, আরে মশাই, ভেতরে আসুন না! এখানে আড্ডা হচ্ছে। আমার এক বন্ধু সদ্য লন্ডন থেকে এসেছে।
অতীনের আপত্তি সত্ত্বেও সোমেন ছাড়লো না, অতীনকে ভেতরে নিয়ে গেল। ঘরটি সিগারেটের ধোঁয়ায় ভর্তি। কিন্তু গন্ধটা সিগারেটের তামাকের নয়, অন্য কিছুর। সেই অপরিচিত যুবকটি ছাড়াও সোমেনের বান্ধবী লিন্ডা রয়েছে, তার ঢুলু ঢুলু চোখ দেখেই বোঝা যায়, সে গাঁজা টেনেছে। এর আগে দু’একদিন কথা বলেই অতীন বুঝেছে, এই লিন্ডা নামের মেয়েটি একটি প্রাক্তনী হিপিনী এবং এখনও ভারত-উন্মাদিনী। এর কাছে ভারতবর্ষ মানে। গাঁজা-চরস-সাধু-সন্ন্যাসী-অতীন্দ্রিয় দর্শন এবং মোক্ষ সাধনা। অর্থাৎ দু’ হাজার বছর আগেকার ভারতবর্ষ।
সোমেন বললো, লিন্ডাকে তো তুমি চেনোই, আর এ আমার বাল্যবন্ধু, লন্ডন থেকে পরশুই। এ দেশে পা দিয়ে দেশটাকে ধন্য করেছে, এর নাম বাপ্পা, সরি, বাপ্পা ওর ডাক নাম, ভালো নাম জ্যোতি রায়, ও অবশ্য নিজেকে বলে জিওটি রে! খুব সাহেব তো! আর এ আমার নেবার। সরি, হাউসহোল্ড মেট অ্যান্ড গ্রেট স্কলার অতীন মজুমদার! আ রিয়াল নখশ্যালাইট লীডার ফ্রম বেঙ্গল!
অতীন বুঝতে পারলো, সোমেনও আজ তার বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে গাঁজা সেবন করেছে। অন্য সময় সে অতীনকে আপনি বলে, এখন বললো তুমি। নকশালাইট লীডার বললো কেন? সোমেনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কোনোদিনই আলোচনা হয়নি। সবাই সবকিছু জেনে যায় কী করে?
লিন্ডা বললো, কাট ইঁট আউট! লেটস হিয়ার দা সঙ!
স্প্যানীশ গীটারটা তুলে নিয়ে বাজাতে বাজাতে সোমেন ধরলো একটা খাঁটি বাংলা গান : রঙ্গিলা ভাসুর গো, তুমি কেন দাওর হইলা না! ও রঙ্গিলা ভাসুর গো…
লিন্ডা সেই গানে তাল দিচ্ছে মহা উৎসাহে এবং গলা মেলাবার চেষ্টা করছে। অতীনের একটা ব্যাপার ভালো লাগলো, লিন্ডার বাংলা উচ্চারণ খুব খারাপ নয়, সোমেনের কাছ থেকে সে অনেকটা শিখেছে। সোমেনের নবাগত বিলিতি বন্ধু অবশ্য এই গান খুব একটা উপভোগ করছে বলে মনে হয় না!
সোমেনের পরের গান : ডাইল রান্ধো রে কাঁচা মরিচ দিয়া, গুরুর কাছে লওগা মন্তর বিরলে বসিয়া, ও মন ডাইল রান্ধো রে!
গানের মাঝে মাঝে সোমেন লিন্ডাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে অর্থ। হঠাৎ সে জ্যোতি রায়ের দিকে ফিরে বললো, আমার এই সাহেব বন্ধুটাও কিন্তু অনেক বাংলা কথার মানে বোঝে না! কী রে ব্যাটা, তুই কাঁচা মরিচ কারে কয় বোঝোস?
জ্যোতি রায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ব্রডলি দা মিনিং! বাট হোয়াট ইজ কাঁচা মরিচ!
–গ্রীন চিলি! কাঁচা লঙ্কা! শালা, তুই-ও তো বাঙালের বাচ্চা, তুই কাঁচা মরিচ চিনিস না? কাঁচা মরিচ ছাড়া ডাল রান্নাই হয় না।
জ্যোতি রায় বললো, মাই ফাদার ওয়াজ আ বাঙাল অলরাইট, বাট আই হার্ডলি রিমেমবার ভিজিটিং দ্যাট পার্ট অফ আওয়ার কান্ট্রি!
লিন্ডা বললো, লেটুস হীয়ার অ্যানাদার সঙ! ডাইল র্যান্ডে রে, কাসা মরিচ ডিয়া…লাভলি, লাভলি।
তারপরেই সে অতীনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, হোয়াট হ্যাঁপনড় টু দ্যাট গাই? হি সিম টু বী বোরড় টু ডেথ!
অতীন বস্তুত গান শুনছিল না, এ ঘরের কোনো ব্যাপারে মনোযোগও দিতে পারেনি, সে পালাবার সুযোগ খুঁজছিল। তার কিছুই ভালো লাগছে না।
সে সচেতন হয়ে, মুখে কষ্ট করে হাসি ফুটিয়ে বললো, না, সোমেনবাবু, গান করুন, গান করুন, গানের মাঝখানে এত কথা ভালো লাগছে না।
সোমেন বললো, তুমি এত গোমড়া মুখ করে আছো কেন ভাই? কী হয়েছে? তুমি এখানে বসে আছে। অথচ তুমি যেন এখানে নেই। তাহলে শোনো। এবারে তোমাকে নিয়ে একটা গান গাইছি!
গীটারে খানিকটা টুং টাং করে সে গাইলো, তুই লালপাহাড়ীর দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা, হেথায় তুরে মানাইছে না গো! ইক্কেবারে মানাইছে না গো!
গাইতে গাইতে এগিয়ে এসে সে অতীনের থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বললো, হেথায় তুরে মানাইছে না গো! ইক্কেবারে মানাইছে না গো! তুই লালপাহাড়ীর দেশে যা…
সোমেনের এই গানটি গেথে গেল অতীনের মাথায়। খানিক পরে ওপরে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে সে ঝরঝর করে কাঁদলো, কাঁদতে কাঁদতে নিজেই ঐ গানটা গাইতে লাগলো। বারবার!
সোমেনের ঘরে লিন্ডার সনির্বন্ধ অনুরোধেও অতীন গাঁজাভরা সিগারেটে টান দিতে রাজি হয়নি, কিন্তু সোমেনের পেড়াপীড়িতে কিছু খাবার খেতে হয়েছে। সোমেনের বন্ধু জ্যোতি রায় খুব সাহেব হলেও মাছ খেতে ভালোবাসে। বিলেতে ভালো মাছ পাওয়া যায় না, অ্যামেরিকায়। মাছ অঢেল। সোমেন রান্না করেছে এ দেশের ইলিশ অর্থাৎ শ্যাড মাছ! সে মাছ অতীনের মুখে রোচেনি, সে দু এক টুকরো ভেঙে খেলেও বাকিটা ফেলে দিয়েছে গোপনে। ইলিশ শুনলেই তার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা ইলিশ মাছ ভালোবাসেন খুব। এক একদিন রাত্তিরবেলা ইলিশ মাছ নিয়ে আসতেন অনেক উৎসাহ করে, মা রাগারাগি করতেন, অতীনও দু একবার। খেতে চায়নি, বাবা দুঃখ পেয়েছেন। তখন কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন সে-সবের উপলব্ধি হয়। শেষের দিকে বাবা পয়সার অভাবে তেলাপিয়া মাছ কিনতেন।
একটা স্মৃতি থেকে অন্য স্মৃতি। এ বাড়িতে একটা বারোয়ারি রেফ্রিজারেটর থাকা সত্ত্বেও অতীন নিজের ঘরের জন্য আর একটা শস্তার ফ্রিজ কিনেছে। কিন্তু তাদের কলকাতার বাড়িতে আজও ফ্রিজ নেই। কতবার সে ভেবেছে, একটা ফ্রিজ কেনার জন্য মাকে টাকা পাঠাবে। কলকাতায় একটা ফ্রিজের দাম কত, চার পাঁচশো ডলার হবে নিশ্চয়ই? অত টাকা অতীন কোথায় পাবে? সে নিজেই এখনও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। দেশে সবাই মনে করে, অ্যামেরিকায় যা-ই যায়, তারাই লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে!…দাদা বলেছিল, চাকরি করে। সে মাকে একটা অল ওয়েভ রেডিও কিনে দেবে। দাদা দিতে পারেনি, অতীনও তো এর বাবা-মাকে কিছুই দেয়নি! ফুলদি বরং হাউস সার্জন থাকার সময় নিজের সামান্য উপার্জনে বাড়ির জন্য একটা রেডিও কিনেছিল। যেমন করেই হোক, অতীন সামনের মাসেই মায়ের নামে অন্তত এক শো ডলার পাঠাবে!
সোমেনের বন্ধু জ্যোতি রায় আর একটা কথা মনে করিয়ে দিল! জ্যোতি রায় মাঝে মাঝেই ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছিল অতীনের দিকে, এক সময় সে জিজ্ঞেস করলো, আপনাকে আগে। কোথায় দেখেছি বলুন তো?
এইসব কথা শুনলেই অতীন ভয় পায়। তবে কি এই ছেলেটি জলপাইগুড়ি কিংবা উত্তরবাংলা থেকে এসেছে? রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল? পুরোনো প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তুলবে?
অতীন আড়ষ্ট গলায় বলেছিল, আমি লন্ডনে কিছুদিন ছিলাম বটে, বাট আই ডোন্ট থিংক উই মেট বিফোর!
জ্যোতি রায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছি, নো, নট ইন লানড়ান! তারও আগে। আমি মানুষের মুখ মনে রাখতে পারি, আপনাকে চেনা লাগছে, কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি
অতীন বলেছিল, হয়তো আমার মতন চেহারার অন্য কারুর সঙ্গে আপনি গুলিয়ে ফেলছেন। আপনাকে আমি আগে দেখিনি।
অতীন সরে গিয়েছিল জ্যোতি রায়ের পাশ থেকে। এ কথা ঠিক, জ্যোতি রায়কে সে আগে কখনো দেখেনি। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা জ্যোতি রায়ের, অতীনের থেকে দু’চার বছরের বড় হবে বয়েসে, এর মধ্যেই তার মাথায় সামান্য টাক পড়েছে। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা আছে।
একটু পরে জ্যোতি রায় আবার তার কাছে এসে কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিল, লেট মি ট্রাই এগেইন। আপনি কখনো বিহারের একটা শহরে, দেওঘর অর বৈদনাথধাম, এরকম একটা জায়গায় থাকতেন? আপনার কোনো আত্মীয়ের গানের ইকুল ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে অতীনের সব মনে পড়ে গেল। মাথায় টাকপড়া, এই নিখুঁত সাহেবী পোশাক পরা সুপুরুষ ব্যক্তিটিকে ভেদ করে সে দেখতে পেল একটি জেদী কিশোরকে। দেওঘর! বাপ্পা! বুলা মাসির ছেলে! একবার বুলা মাসিদের সঙ্গে ত্রিকূট পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল, সেবার কি বাপ্পা ছিল সঙ্গে? সেবারের কথা মনে না থাকলেও আর একবার পুজোর সময় দেওঘরে গিয়ে এই বাপ্পার সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল, সে প্রায়ই খেলতে আসতো তাদের সঙ্গে, সেই বয়েসেই সে ইংরিজি গান গাইতো। অতীনের চেয়ে তার দাদার সঙ্গেই বাপ্পার বন্ধুত্ব হয়েছিল বেশী।
অতীনের উদ্ভাসিত মুখ দেখে জ্যোতি রায় বলেছিল, ইউ সি, আই ডোন্ট ফরগেট ফেসেস! অনেকদিন আগেকার কথা, তাই না? তুমি খুব পোয়েট্রি রিসাইট করতে। তোমার কথা আমার পারটিকুলারলি মনে আছে, কারণ, একদিন হঠাৎ তোমার সঙ্গে আমার মারামারি হয়েছিল, আমি ঘুষি মেরে তোমার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম।
–আমার নয়, আমার দাদার!
–তোমার দাদাকে মেরেছিলাম? অফ কোর্স, তোমরা দু ভাই ছিলে, ঠিক! তোমাদের দু’ ভাইয়ের মুখের খুব মিল আছে তো! দোষটা আমারই ছিল। আই ওয়াজ ভেরি ইমপালসিভ দোজ ডেইজ, পরে আমি রিগ্রেট করেছি। তোমার দাদা এখন কোথায় আছেন, দেশে? তাকে চিঠি লেখার সময় তুমি জানিয়ে দিও প্লীজ যে, সেই জ্যোতি রায় এতদিন পরেও সিনসিয়ারলি তার কাছে ক্ষমা চাইছে!
নিজের ঘরে ফিরে অতীনের বারবার এইসব কথাই মনে পড়তে লাগলো। দেওঘরের সেই দিনগুলো কী অপূর্ব সুন্দর ছিল, হ্যাঁ, এই বাপ্পার সঙ্গে তার দাদার একবার মারামারি হয়েছিল বটে, দাদা বিশেষ মারামারি করতে পারতো না, বাপ্পাটাই ছিল গোঁয়ার, কিন্তু সে এমন কিছু না, পরে বাপ্পার সঙ্গে দাদার আবার ভাবও হয়ে গিয়েছিল, যতদূর মনে পড়ে। দাদার সঙ্গে তার মুখের মিল আছে, একথা তো বহুদিন কেউ বলেনি!
আজ সারাদিন পড়াশুনো করার কথা ছিল, অন্য কোনো কথা একবারও ভাববে না ঠিক করেছিল অতীন, কিন্তু এখন পড়াশুনো মাথায় উঠে গেল, যত রাজ্যের পুরোনো কথাই মনে পড়ছে! চোখের জল সে সামলাতে পারছে না কিছুতেই। হেথায় তুমায় মানাইছে না গো! ইক্কেবারে মানাইছে না গো!
এক সময় মুখ তুলতেই সে দেখতে পেল তার টেবিলের এক কোণে একটা চাবি পড়ে আছে। সে দারুণ চমকে উঠলো। এ কি ব্যাপার? ম্যাজিক নাকি? এখানেই পড়ে আছে চাবিটা, অথচ সে গত দু’ সপ্তাহের মধ্যে একবারও দেখতে পায়নি? মাঝখানে কেউ এসে রেখে গেছে? না, তা হতেই পারে না। তার ঘরে অন্য কে ঢুকবে? দরজার বাইরে পাপোসের তলায় তার ঘরে ঢোকার আর একটা চাবি আছে বটে, শর্মিলা কখনো সখনো একা এসে পড়লে সেটা ব্যবহার করতো। কিন্তু শর্মিলা এই কদিনের মধ্যে তার ঘরে আসবে, সে প্রশ্নই ওঠে না। চাবিটা আগে থেকেই এখানে পড়ে আছে, অতীন খেয়াল করেনি, হয়তো কোনো বইতে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এ ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?
চাবিটা অতীন হাতে তুলে নিয়ে চুপ করে বসে রইলো। ছোট একটা চাবি, টেবিল ক্লকে দম দেবার চাবির মতন, হ্যাঁ, ফাইল ক্যাবিনেটের চাবিও এই রকমই হয়। শর্মিলা এই চাবিটাই খুঁজছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দরকারি চাবি, তবু সেটার কথা এতদিন পর মনে পড়লো শর্মিলার?
এখন এটা নিয়ে কী করা যায়? শর্মিলাকে ফোন করে বলবে, এসে নিয়ে যেতে? না, তা হয় না। শর্মিলাকে কোনো ছুতোতেই সে আর তার বাড়িতে আসতে বলতে পারে না। শর্মিলা আজ টেলিফোনে যে-সুরে কথা বললো, তাতেই বোঝা যায়, সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। অতীন এতদিন চাবিটা দেখতে পায়নি, আজও টেলিফোন করার সময় খুঁজতে এসে পায়নি, এখন হঠাৎ পেয়ে গেল, এটা কি শর্মিলা বিশ্বাস করবে?
সবচেয়ে সহজ উপায়, চাবিটা একটা খামে ভরে পোস্ট করে দেওয়া। এখানে অনেক লোক হোটেলের চাবি ভুল করে পকেটে নিয়ে চলে যায়, পরে কোনো একটা জায়গা থেকে পোস্টে সেই চাবি হোটেলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
পোস্ট করলে শর্মিলা চাবিটা পশুর আগে পাবে না। শর্মিলা বলছিল, কাল সকালে চাবিটা ওর বিশেষ দরকার। এইসব চাবি ডুপ্লিকেট করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। অতীনের উচিত চাবিটা পৌঁছে দিয়ে আসা। শর্মিলার সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই, তবে পুরোনো সম্পর্কের খাতিরে কি সে এইটুকু উপকার করতে পারে না!
বাড়ি থেকে বেরুবে না ভেবেছিল, তাও বেরুতে হলো। সে অবশ্য দাড়ি কামালো না, সাইকেলটাও নিল না। সন্ধে হতে এখনও কিছুটা দেরি আছে, সে হাঁটবে। শর্মিলার সঙ্গে দেখা করেও চাবিটা পৌঁছে দেবার একটা উপায় ভেবে ফেলেছে সে। শর্মিলার বাড়ির লেটার বক্সে সে চাবিটা ফেলে দিয়ে আসবে গোপনে। চাবিটা সেইজন্য সে একটা সাদা খামে ভরে এনেছে। কাল সকালে বেরুবার আগে শর্মিলা লেটার বক্স দেখবেই।
একটু ঘুর পথে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো অতীন। আকাশে আবার মেঘ জমেছে, যাক, গরমটা এবার কাটবে। আজ রাত্তিরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। সর্দিটা জমে শুকনো হয়ে গেছে তার বুকে, আর একবার বৃষ্টি না ভিজলে গলবে না।
পার্ল স্ট্রিটে শর্মিলাদের বাড়ির কাছে পৌঁছোতে পৌঁছোতে অন্ধকার হয়ে এলো। কিন্তু একটু দূরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো অতীন। ঐ বাড়ির পর্চে দাঁড়িয়ে তিনটি সাদা ছেলেমেয়ে গল্প করছে। ওদের সামনে দিয়ে গিয়ে লেটার বক্সে কি কিছু ফেলা যায়? ফেললেও ওরা কিছুই বলবে না, অতীনের দিকে ফিরেও তাকাবে না, তবু, ওদের মধ্যে কেউ যদি অতীনকে চিনে। ফেলে? অতীন নিজেই যে চাবিটা ফেরত দিতে এসেছে, সে কথা সে কারুকে জানাতে চায় না।
একটা স্ট্রিট লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে পর পর দুটো সিগারেট পোড়ালো অতীন। সিগারেট টানলেই কাশি আসছে, তবু একা একা কি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? ছেলেমেয়েগুলো যে যাচ্ছে না! এই চাবিটা দেবার পরেই শর্মিলার সঙ্গে সব যোগাযোগের ইতি। বেরুবার আগে অতীন খুব ভালো করে নিজের ঘরটা দেখে এসেছে, শর্মিলার আর কোনো কিছুই সেখানে পড়ে নেই। চাবিটা টেবিলের ওপরেই ছিল, এটা যেন প্রায় একটা মিরাল।
রাস্তায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দারুণ বোকা বোকা লাগে। কাঁধটা উঁচু করে রয়েছে। দুপুরবেলা সোমেনের ঘরে অত হৈ হল্লা হচ্ছিল কিন্তু অতীন তার সঙ্গে সুর মেলাতে পারেনি। সে আমেরিকান ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও প্রাণখুলে মিশতে পারে না, বাঙালী কিংবা ভারতীয়দের সঙ্গেও হৃদ্যতা হয় না। সব জায়গাতেই সে আড়ষ্ট, এমন কি এই যে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা, এখানেও সে স্বাভাবিক নয়। হেথায় তুমায় মানাইছে না গো! ইক্কেবারে মানাইছে না গো!
ছেলেমেয়ে তিনটি এবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অতীনের সামনে দিয়েই চলে গেল। ভাগ্যিস অতীন যায়নি, ওদের মধ্যে একটি মেয়ে শর্মিলাদের পাশের ঘরেই থাকে। শর্মিলার বোন সুমির মুখোমুখিও পড়তে চায় না অতীন। সুমিকে সে ভয় পায়।
আরও দু মিনিট অপেক্ষা করার পর অতীন এগোলো। খামটা পকেট থেকে বার করে হাতে নিয়েছে। পরপর অনেকগুলো চিঠির বাক্স, এর মধ্যে কোনটা শর্মিলাদের? এই জায়গাটায় আলো জ্বালা নেই। সুইচটা কোথায় কে জানে! আধো-অন্ধকারের মধ্যেই অতীন ঝুঁকে ঝুঁকে বাক্সর নামগুলো পড়তে লাগলো।
ভেতরের দরজাটা ঠেলে হঠাৎ বেরিয়ে এলো শর্মিলা, প্রথমে সে অতীনকে দেখতে পায়নি, দ্রুত নেমে যেতে যাচ্ছিল, অতীন সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সে মুখ ফেরালো। বলে উঠলো বাবলু?
অতীন খামসুদ্ধ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে নিরাসক্ত গলায় বললো, তোমার চাবি!
যেন চাবি শব্দটা সে জীবনেই শোনেনি, এইরকম প্রগাঢ় বিস্ময়ে শর্মিলা বললো, চাবি? কিসের চাবি?
অতীন ভুরু কুঁচকে বললো, তোমার চাবি, হারিয়ে ফেলেছিলে! সেটা কি পেয়ে গেছো নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে আবার বদলে গেল শর্মিলা, হাহাকারের মতন তার গলা ভেঙে গেল, সে বললো, না, পাইনি, আমার চাবি হারিয়ে গেছে!
অতীন বললো, এই নাও, আমার ঘরেই পড়ে ছিল, আমি আগে দেখতে। পাইনি।
অতীনের চোখের দিকে না শুকিয়ে শর্মিলা খামটা নিল। নিজের হাতব্যাগে সেটা ভরতে গিয়েও ফেলে দিল মাটিতে। তখুনি তুলে নেবার বদলে সে ঘুরে গিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে হু-হুঁ করে কেঁদে ফেলে বললো, তুমি আমায় ক্ষমা করো বাবলু, যদি পারো, যদি পারো, আমি আর কোনোদিন তোমাকে মুখ দেখাতে পারবো না!
শর্মিলার কান্নাটা অতীনের ন্যাকামি মনে হলো। মানুষকে অপমান করে, দিনের পর দিন অবহেলা দেখিয়ে তারপর একবার ক্ষমা চাইলেই হলো! শর্মিলা তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চায় না সেটা সোজাসুজি বলে দিলেই পারতো, এত নাটক করার কী দরকার ছিল?
অতীন কড়া গলায় বললো, ক্ষমা টমার কী আছে! আমি তোমার চাবিটা আগে খুঁজে পাইনি, আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট!
শর্মিলা দেয়ালে মাথা রেখে বললো, বাবলু, তুমি আমাকে ভুলে যেও! আমি তোমার কাছে। মিথ্যে কথা বলেছি। আমি খারাপ, খুব খারাপ, আমি তোমার যোগ্য নই। আমি অনেক কথা ভুলে যাই, লোকে বিশ্বাস করে না, আমি ইচ্ছে করে তোমায় মিথ্যে কথা বলিনি বাবলু, সত্যি আমার মনে ছিল না…।
–মিথ্যে কথা? কী মিথ্যে কথা তুমি বলেছিলে আমাকে?
–একটা সাংঘাতিক মিথ্যে, মানে, এমন একটা অন্যায় আমি গোপন করে গেছি, যার কোনো ক্ষমা নেই!
–অন্যায়? কিসের অন্যায়? আমার সঙ্গে তোমার…
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার সঙ্গে আগে কারুর সম্পর্ক ছিল কি না। কেউ আমাকে কখনো আদর-কেউ আমাকে আগে ছুঁয়েছে, আমি বলেছিলাম, না, কেউ না, সেটা মিথ্যে কথা বাবলু! কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোমাকে ঠকাতে চাইনি বাবলু, সত্যি আমার মনে ছিল না! লংফেলো ব্রীজে তুমি একটা কাগজ কুড়িয়ে নিলে, তাতে একটা ছবি দেখে হঠাৎ সব মনে পড়ে গেল। ছি ছি ছি, বাবলু, আমি তোমাকে ঠকাতে গিয়েছিলুম। আমি নষ্ট, আমি, আমি, তোমার মতন একজন মানুষকে।
এবারে অতীনের অবাক হবার পালা। এসব কী বলছে শর্মিলা? শর্মিলা আর যাই করুক, তার মতন মেয়ে কারুকে ঠকাবে, মিথ্যে কথা বলবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। শর্মিলা জেদী, অভিমানী, কিন্তু সে কিছুতেই অসৎ হতে পারে না!
–তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলে? না, আমি তা বিশ্বাস করি না।
–আমার জীবনটাই মিথ্যে হয়ে গেছে, বাবলু! ঐ কাগজটায় একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি ছিল, ঠিক আমার ঐ বয়েসে…আমাদের বাড়িতে একজন মাস্টার মশাই থাকতেন, আমরা তাকে মাস্টারজ্যেই বলতুম, ভাইবোন সবাইকে পড়াতেন, সেই মাস্টারজ্যেঠু একদিন আমার ঠোঁটে… আমাকে জোর করে কোলে নিয়ে…আমার ফ্রক খুলে, আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি নষ্ট, নষ্ট, বাবলু, তোমাকে বলিনি আগে, তুমি আমাকে এত বিশ্বাস করেছিলে
অতীন শর্মিলার হাত চেপে ধরে বললো, এসব কী বলছো তুমি? তোমার আট-ন বছর বয়েসে কী একটা ঘটেছিল, সেই জন্য তুমি এরকম করছো? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি?
শর্মিলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললো, আমাকে আর ছুঁয়ো না বাবলু, আমি তোমার যোগ্য নই, আমি ভীষণ খারাপ?
সত্যিই প্রায় উন্মাদিনীর মতন হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে দেখে অতীন তাকে জোর করে বুকে চেপে ধরে বললো, মিলি, চুপ করো! চুপ করো! আট ন’ বছর বয়েসে, তখন তোমার ভালো করে জ্ঞান হয়নি, সেইসময় একটা পারভার্ট তোমার শরীর ছুঁয়েছিল, সেটা আবার একটা মনে রাখবার মতন ব্যাপার নাকি? এটা জানলে আমি কিছু মনে করবো, তুমি আমাকে এতই অর্ডিনারি ভাবো? তুমি আমাকে একটুও চেনোনি?
জলভরা মুখখানা তুলে শর্মিলা ধারালো গলায় বললো, এইসব শুনেও তুমি আমাকে ঘেন্না। করবে না?
অতীন বললো, অত ছোট বয়েসের ওটা তো কোনো ব্যাপারই নয়, বড় বয়েসেও কেউ যদি
হঠাৎ কোনোদিন তোমার শরীর নিয়ে হলেও আমি কিছুই ভাবতাম না। তবু তুমি আমার কাছে পবিত্র!
–আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল বাবলু! আমি আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলুম, আমি ওয়াশিংটন ডি সি-তে গিয়ে একদিন শিপিং পিল–
–ছিঃ মিলি! চুপ করো, চুপ করো, তুমি আমাকে কত কষ্ট দিয়েছো জানো না? আমাকে তুমি একটা কথাও বলোনি…।
বাবলু, আমি ভেবেছিলুম, সারা জীবন তোমাকে আমার এই মুখটা আর দেখাতে পারবো না!
অতীন এবার জিভ দিয়ে শর্মিলার চোখের জল চেটে নিতে লাগলো। সুমি এসে পড়তে পারে, কিংবা অন্য কেউ দেখলো বা না দেখলো তাতে কিছু আসে যায় না। অতীন টের পেল তার বুক অসম্ভব জোরে কাঁপছে, শর্মিলারও সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। শুধু দুটি হৃদয় নয়, দুটি শরীবও পরস্পরের জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিল।
সুমি বাড়িতে নেই। একটু পরে শর্মিলা অতীনকে ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর কান্নায়-হাসিতে, আদরে-উত্তাপে কাটতে লাগলো সময়। এর আগে কোনোদিন ওরা এই ঘরে মিলিত হতে সাহস করেনি। কিন্তু আজ সবকিছু তুচ্ছ।
এক সময় শর্মিলার পাশে শুয়ে একটা সিগারেট ধরাবার পর অতীন ভাবলো, এবার কি সে শর্মিলাকে অলির ব্যাপারটা সব খুলে বলবে? পরক্ষণেই সে মন বদলে ফেললো! শর্মিলার বালিকা বয়েসের ঐ তুচ্ছ ঘটনাটার সঙ্গে তার আর অলির সম্পর্কের কোনো তুলনাই চলে না। এখন অলির কথা তুললে অলিকে ছোট করা হবে! অলির প্রতি হাজার অবিচার করলেও অলির মর্যাদাকে তুচ্ছ করার কোনো অধিকার তার নেই।