৩১ আগস্ট, মঙ্গলবার ১৯৭১
আরো একটা ঘুমহারা রাত পার হয়ে এলাম। কাল থেকে অবশ্য লালু আর মা এ বাড়িতে রয়েছেন। সাড়ে দশটায় মঞ্জুর আর মিকি আসবেন, আমাকে নিয়ে এম.পি.এ. হোস্টেলে যাবেন। সকালে উঠেই মা আর লালুকে নিয়ে স্যান্ডউইচ বানাতে বসেছি। বেশকিছু স্যান্ডউইচ আর ওদের সবার জন্য একপ্রস্থ করে কাপড় নেব। পরশু রাত থেকে শোবার কাপড় পরে আছে। কি মনে করে শরীফের শেভিং সেটটা কাপড়ের প্যাকেটের মধ্যে ভরে নিলাম। কি জানি, যদি আরো কয়েকদিন না ছাড়ে।
বেলা এগারোটার দিকে এম.পি.এ. হোস্টেলে পৌঁছলাম। মঞ্জুর গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আর পাশে মিকি। আমি প্যাকেট দুটো হাতে নিয়ে পেছনের সিটে বসেছিলাম। ড্রাম ফ্যাক্টরির রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঢুকল ডানে–এম.পি.এ. হোস্টেলের গেটে পুলিশ দাড়িয়ে রাইফেল হাতে। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিল। ঢুকেই সামনে চওড়া খোলা লন, বায়ে বিরাট এম.পি.এ. হোস্টেল, সার সার ঘর। সামনে চওড়া টানা বারান্দা। বিভিন্ন ঘরে ইউনিফর্ম পরা লোকজন ব্যস্তভাবে চলফেরা করছে বিভিন্ন ধরনের ইউনিফর্ম। বোঝা যায় সাধারণ সেপাই থেকে বিভিন্ন র্যাঙ্কের অফিসার সবাই রয়েছে ওর মধ্যে।
মিকি বললেন, তুমি গাড়িতেই বসে থাক। আমরা আগে খোঁজ নিয়ে আসি। মিকি, মঞ্জুর সিড়ি দিয়ে উঠে বারান্দায় লোেকদের জিজ্ঞাসা করতে করতে বিভিন্ন ঘরে ঢুকতে লাগলেন। আমি বসে বসে চারদিকে তাকাতে লাগলাম। এইখানেই ওদেরকে এনেছে। এই ঘরগুলোর কোন একটাতে রেখেছেনাকি? ইয়া আল্লা, কোনগতিকে কারো মুখ যদি একঝলক দেখতে পেতাম! তাহলে এক্ষুণি গাড়ি থেকে দৌড়ে ওদের কাছে চলে যেতাম।
মিকি, মঞ্জুর ফিরে এসে বললেন, এখানে না। এর পেছন দিকের আরেকটা বাড়িতে যেতে বলল।
মঞ্জুর আবার গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় নামলেন। এম.পি.এ. হোস্টেল পেরিয়ে আরো খানিক গিয়ে আবার ডাইনে একটা গলিতে ঢুকলেন। একটুখানি গিয়ে বয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে থামলেন। এবার গলিতেই গাড়ি রেখে আমরা তিনজনেই নামলাম। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে একে ওকে জিগ্যেস করতে করতে এঘর-ওঘর করতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি একটু দূরে বারান্দা দিয়ে সফিন গুল যাচ্ছে। আমি সুবেদার সাহেব, সুবেদার সাহেব বলতে বলতে দ্রুত পা চালিয়ে তাকে ধরলাম। গুল আমাকে দেখে চমকে গেল। আমি এক নিশ্বাসে বললাম, সুবেদার সাহেব আমি ওদের খবর নিতে এসেছি। ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ওদের জন্য কিছু খাবার আর কাপড় এনেছি। সুবেদার সাহেব, আমাকে ওদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন।
সুবেদার গুলের মুখ দেখে মনে হল সে ফাপরে পড়েছে। গম্ভীর মুখে বলল, ওরা তো এখানে নেই। অন্য জায়গায় আছে। আচ্ছা আপনি আসুন আমার সঙ্গে। মিকি, মঞ্জুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ওনারা এখানেই অপেক্ষা করুন।
আমি সুবেদার সফিন গুলের পেছন পেছন একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানে টেবিলের পেছনে চেয়ারে এক অফিসার বসে আছেন, ঘরের ভেতরে এবং দরজার কাছাকাছি তিন-চারজন সশস্ত্র মিলিটারি পুলিশ। সুবেদার গুল উর্দুতে অফিসারটিকে কি কি যেন বলল, আমি ঠিকমত বুঝলাম না, যেন বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমার চোখ খালি জানালা দিয়ে, দরজা দিয়ে বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল–যদি হঠাৎ শরীফকে দেখতে পাই। একটু পরে গুল আমাকে সম্বােধন করে বলল, মাইজী, ওনারা তো এখন এখানে নাই। ওনারা ক্যান্টনমেন্টে আছেন। এখন তো দেখা যাবে না। আপনি বাড়ি চলে যান।
আমি মরিয়া হয়ে বললাম, আমি এখানে অপেক্ষা করি? ওরা এখানে ফিরবে তো?
সুবেদার সফিন গুল গম্ভীর মুখে বলল, মাইজী, আপনি বাড়ি চলে যান। এখানে অপেক্ষা করার সুবিধা নাই। আপনি পরে খবর নেবেন। নিজে আসবেন না। অন্য লোক দিয়ে খবর নেবেন।
আমি নিরুপায় হয়ে বললাম, তাহলে এই প্যাকেট দুটো রাখেন। ওদের কাপড় আর কিছু খাবার।
সুবেদার গুলও যেন নিরুপায় হয়ে প্যাকেট দুটো নিল। বলল, আপনি আর আসবেন না, ওনারা ঠিক বাড়ি ফিরে যাবেন। চিন্তা করবেন না।
মলিন মুখে মিকি-মঞ্জরের সঙ্গে গাড়িতে উঠলাম। বাড়ি যখন পৌঁছলাম, বেলা পৌঁনে দুটো। মা, লালু অধীর আগ্রহে নিচের ঘরে অপেক্ষা করছিলেন। লালু বলল, খালুজান খুব বেশি অস্থির হয়ে গেছেন।
আমি ডাইনিং রুমে চৌকিটার ওপর শুয়ে পড়ে বললাম, মা, আপনি গিয়ে বাবাকে সামলান। আমি এখন ওর সামনে দাঁড়াতে পারব না।
মা দোতলায় উঠে গেলেন। লালু আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দ কান্নায় আকুল হল।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল কে জানে। হঠাৎ পোর্চে গাড়ির শব্দ। আমি লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখি আমাদের সেই সাদা হিলম্যান মিংকস। গাড়ি থেকে নামছে শরীফ, জামী, মাসুম। শুধু রুমী নেই।
আমার গলা চিরে একটা আর্তস্বর বেরোল, রুমীকে ছাড়ে নি?
কেউ কোন উত্তর দিল না। একে একে ঘরে এসে ঢুকল। আমি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনজনকেই জড়িয়ে ধরলাম। তারপর হঠাৎ চেতনায় ধাক্কা লাগল। ওদের পরনের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি দলা-মোচড়া হেঁড়া, ধুলো-ময়লা লাগা, ওদের মুখে-চোখে গভীর যন্ত্রণা, দুঃখ আর অপমানের ছাপ, ওদের শরীর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ওরা যেন দাঁড়াতে পারছে না। তাড়াতাড়ি ওদের বসিয়ে ঠাণ্ডা পানির বোতল আর গেলাস নিয়ে এলাম। লালুকে বললাম চা বানাতে, মাকে বললাম বাবাকে গিয়ে খবর দিতে।
ওরা একেকজনে দুতিন গেলাস করে পানি খেল, ওদের পিপাসা যেন মিটতেই চায় না। আমি বললাম, বেলা দেড়টা পর্যন্ত আমি মিকি আর মঞ্জর এম.পি.এ. হোস্টেলে ঘোরাফেরা করেছি। সুবেদার গুল বলল, তোমাদের নাকি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে।
শরীফ বলল, না, আমাদের ক্যান্টনমেন্টে নেয় নি তো! আমরা ঐ এম.পি.এ. হোস্টেলেই ছিলাম।
বল কি! সুবেদার তাহলে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে? কখন ছেড়েছে তোমাদের? আমাদের ঐ দেড়টার দিকেই ছেড়েছে। গাড়ির চাবি ওরা নিয়ে নিয়েছিল। সেইটা খুঁজে পেতে খানিক দেরি হল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আড়াইটা বাজে।
আমি তাজ্জব হয়ে বললাম, কি রকম নিপাট মিথ্যে কথা বলে ওরা! আমি আবার তোমাদের জন্য এক প্যাকেট স্যান্ডউইচ, সবার জন্য একসেট করে কাপড় গুলের কাছে দিয়ে এলাম। ওগুলো আবার রাখলও সে। তখনি তো বলে দিতে পারত, তোমাদের ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে এক সঙ্গেই ফিরতে পারতাম।
ওরো তিনজনেই কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে নীরবে চেয়ে রইল। আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে বললাম, কি? তোমরা সব অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
জামী বলল, মা, তুমি এখনো তোমার মান্ধাতা আমলের ধারণা নিয়ে বসে আছ। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ব্রিটিশরা রাজবন্দীদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করত। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে দিত, খাবার, কাপড় পাঠাতে দিত, তারপর ফাঁসি দিয়ে লাশটা আত্মীয়দের ফিরিয়ে দিত। ভাবছ এখনো ব্যবস্থা ওইরকমই আছে? জেনে রাখ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এই পাঁচ মাসে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ বিষয়ে পাঁচশো বছর এগিয়ে গেছে। ওদের কীর্তিকলাপ শুনলে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীও মাথা হেঁট করবে। তার প্রমাণ আমরা এই দুদিন দুরাতে দেখে এসেছি। ইনফ্যাক্ট, আমরা সশরীরে, সজ্ঞানে হাবিয়া দোজখ ঘুরে এসেছি। সব বলব। শুনে শেষ করতে তোমার দুদিন লাগবে।
ওপর থেকে বাবার ডাকাডাকি শোনা যাচ্ছে ও শরী! রুমী। জামী। মাসুম। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম, বাবার কাছে যাও আগে। উনি একেবারে উতলা হয়ে রয়েছেন। আমি ততক্ষণে ফোন করে সবাইকে খবরটা দেই।