৩১. অপলা ভেবে রেখেছিল

অপলা ভেবে রেখেছিল সে দু’দিন থাকবে, শুক্র ও শনি। খুব বেশি হলে তিন দিন। সোমবার ড. মাইতির ক্লাস। ঐ ক্লাসটি ধরতেই হবে। এ্যাবসেন্ট করলে তিনি নামের পাশে দাগ রাখেন এবং পরের দিন এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর কারোরই জানা থাকে না। প্রশ্নতেই শেষ নয় শান্ত মুখে এমন সব বলেন যা শুনলে ক্লাস ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। যেমন রীতাকে একদিন বললেন, ডাক্তার যে তোমাকে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার হাবভাব ডাক্তারের মত নয়, বিরহী প্রেমিকের মত। বুঝতে পারছি? এখন তুমি আমাকে বল, তোমার ডান হাতের কজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাড়টির কী নাম। উঁচু গলায় বল যেন সবাই শুনতে পায়।

রীতা কোনোমতে বলল, আমি জানি না। স্যার। বলেই সে বসে পড়ল এবং খুব ঘামতে লাগল। মাইতি স্যার বললেন, তোমাকে কিন্তু এখনো আমি বসতে বলিনি। কেউ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বসে পড়লে আমার খারাপ লাগে। কাজেই তোমাকে আমি এখন এমন প্রশ্ন করব যার উত্তর তোমার জানা আছে বলে আমার ধারণা। বল, প্ৰেম এবং ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য কী?

ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। এই হচ্ছে মাইতি স্যার। তার ক্লাস মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অপলা রোববার ভোরে বেশ সহজভাবেই বলল, আজ ঢাকা না গেলে কেমন হয় রে টেগরি? টগর গম্ভীর হয়ে বলল,

ভাল হয়।

কিন্তু মাইতি স্যার যে আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। সবার সামনে কাদিয়ে ছাড়বে। চিনিস তো না তাঁকে।

শরীরটা ভাল লাগছে না। কেমন যেন জ্বর জ্বর লাগছে, দেখ তো গায়ে হাত দিয়ে।

অপলার গা নদীর জলের মতো শীতল কিন্তু টগর উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, উফ খুব জ্বর তো।

যা, সুটকেস খুলে কাপড় বের করে ফেল। আগামী সোমবারের আগে ঢাকা গিয়ে পৌঁছলেই হবে। তোর আবার মন খারাপ লাগছে না তো?

না।

মার জন্যে কান্না আসছে না?

না।

একটু ও না?

টগর তার জবাবে হেসে ফেলল। এবং পরীক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল। সম্ভবত মনে করল, হাসাটা ঠিক নয়। মার জন্যে কিছুটা হলেও মন খারাপ করা দরকার। কিন্তু তার সত্যি সত্যি মার কথা মোটেও মনে পড়ছে না। বরং মার কাছে ফিরে যেতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছিল।

বাবা তার সঙ্গে খুব কথা-টথা বলে না। তবু তাকেই কেন জানি বেশি ভাল লাগে। এর কারণ কী সে প্রায়ই ভাবে। পরশু রাতে আপলাকে জিজ্ঞেস করল। অনেক ইতস্তত করে বলল খালামণি, বাবা বেশি ভাল, না মা?

দুজনই ভাল।

মন রাখা কথা। টগর বিশ্বাস করেনি। দু’জন লোক সমান সমান ভাল হতে পারে না। একজন একটু বেশি ভাল হলে অন্য জন একটু কম ভাল হবে। তাই নিয়ম। অপলা হাই তুলে বলল, কে বেশি ভাল, কে কম ভাল এসব দিয়ে কী করবি?

কিছু করব না।

কিছু না করলে ঘুমো। নাকি বাবার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছে করে?

না না। মনে হচ্ছে করে, আয় রেখে আসি।

অপলা সত্যি সত্যি তাকে রেখে আসতে গেল। টগর লক্ষ্য করেছে অপলা খালামণি যা বলে। সঙ্গে সঙ্গে তা করে। অন্য কোনো মেয়ে হলে, আয় রেখে আসি বলেও রেখে আসার কোনো রকম লক্ষণ দেখাত না। এবং এক সময় বড় বড় হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু আপলা খালামণি সে রকম নয়। সে যা বলবে তাই করবে। এজন্যেই তাকে এত ভাল লাগে। গত পরশু কালবৈশাখী ঝড় হল। ভীষণ ঝড়। হঠাৎ অপলা খালামণি বলল, চল টগর আম কুড়াতে যাই। কালবৈশাখীতে আম কুড়াতে হয়। টগরের ইচ্ছা করছিল, আবার ভয় ভয়ও করছিল। কী অন্ধকার চারদিক! আবার কেমন শো শো শব্দ উঠছে। বাবা বললেন, মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়বে। যেও না অপলা। খালামণি বলল, আমার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়লে কারো কোন ক্ষতি হবে না। বলেই সে নেমে গেল উঠোনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলিও গেল।

তারা ছুটোছুটি করে আমি এনে ঝুড়ি ভর্তি করছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। বাবা বললেন, টগর তোমার যেতে ইচ্ছা করছে?

হুঁ।

আমার মনে হয় এ রকম ক্ষেত্রে যাওয়াই উচিত। ভয়কে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। তা ছাড়া কালবৈশাখীর ঝড়ে বাচ্চাদের ওপর কখনো ডাল ভেঙে পড়ে না। নিযম নেই।

কার নিয়ম?

প্রকৃতির নিয়ম।

বাবা খুব হাসতে লাগলেন। বড়দের সব কথা সব সময় বোঝা যায় না। টগর অবশ্যি খুব বুঝতে চেষ্টা করে। বড়দের কথা শুনতে তার খুব ভাল লাগে।

রোজ রাতে তারা সবাই বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ গল্প করে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। তবু সে জেগে থাকতে চেষ্টা করে। কত রকম কথা বলে বাবা আর খালামণি। বেশিব ভাগ কথারই সে অর্থ বুঝতে পারে না। তবু শুনতে ভাল লাগে।

অপলা টগরকে আমার বিছানায় শুইয়ে দেবার কোনো দরকার নেই। তুমি একা একা ভয় পাবে; ও থাকুক তোমার সঙ্গে।

আমার এত ভয়টয় নেই।

বল কী! এ বাড়িতে কিন্তু ভূত আছে। সাদা চাদর গায়ে দিয়ে অশরীরী কে একজন বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে। ফুলির মা তোমাকে সেই গল্প বলেনি?

বলেছে।

ভূত বিশ্বাস কর না?

করব না কেন, করি?

সে কী, আমার তো ধারণা ডাক্তাররা ভূত বিশ্বাস করে না।

কোনো কোনো ডাক্তার আবার করেও। তা ছাড়া আমি তো এখনো ডাক্তার হইনি।

ডাক্তাররাই যদি ভূতে বিশ্বাস করে তাহলে আমরা সাধারণ মানুষেরা যাব কোথায়?

আপনি বুঝি সাধারণ মানুষ?

তোমার কী ধারণা আমি অসাধারণ?

লেখকরা সাধারণ মানুষ নন।

আমি লেখক তোমাকে কে বলল? এক সময় ছিলাম, এখন না। ঐ সব পূর্ব জন্মের কথা। এখন আর মনে করতে চাই না।

আপনাকে আবার লেখালেখি শুরু করতে হবে।

अद्धि शहद ना।

হতেই হবে। আপনাকে দিয়ে নতুন একটি লেখা শুরু করিয়ে তার পর যাব। তার আগে যাব না।

আর যদি শুরু করতে না পারি তা হলে কী থেকে যাবে?

হ্যাঁ।

টগর লক্ষ্য করল হ্যাঁ বলার পর পরই খালামণি খুব গম্ভীর হয়ে পড়ল। তার পর হঠাৎ উঠে চলে গেল। বড়দের কথাবার্তার মত তাদের আচার আচরণও দুর্বোধ্য। খালামণি যে ভাবে উঠে চলে গেছে তাতে মনে হয় সে খুব রাগ করেছে। কেন সে শুধু শুধু রাগ করবে? বাবা কী রাগ করার মত কিছু বলেছে? কিছুই বলেনি।

রাতে ঘুমুবার সময় টগর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, খালামণি তুমি বাবার ওপর রাগ করেছ? অপলা অবাক হয়ে বলল, রাগ করব কেন? আমি কারো সঙ্গে রাগটাগ করতে পারি না।

বাবাও কারো সঙ্গে রাগ করে না।

উনি মহাপুরুষ কী না তাই।

মহাপুরুষর কী খালামণি?

জানি না। কী; ঘুমো। নাকি বাবার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে?

তোমার সঙ্গেই ঘুমুতে ইচ্ছা করছে।

টগর অপলার গলা জড়িয়ে ধরল। অপলা বিরক্ত স্বরে বলল, গরমের মধ্যে এরকম জাপটে ধরে আছিস কেন? একটু দূরে যা। টগর দূরে সরে গেল।

রাগ করলি নাকি টগর?

না।

তুই তোর বাবার মত হবি বড় হলে। কারো জন্যে কোনো টান থাকবে না। পাথরের মত মানুষ।

বাবা পাথরের মত?

হ্যাঁ শক্ত পাথর।

আর মা কিসের মত?

সেও পাথরের মত। তোমাদের সবাই পাথর।

অপলা খুব হাসতে লাগল। টগর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, হাসতে হাসতে খালামণির চোখে পানি এসে গেছে। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে আর হাসছে। হাসির দমকায় খাট কাঁপছে। ও ঘর থেকে বাবা এসে বললেন, কী হচ্ছে এখানে? টগর বলল, খালামণি শুধু হাসছে।

শুধু শুধু কেউ এ রকম হাসে?

অপলা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি হাসি। কোনো কারণ ছাড়াই আমি হাসি এবং কাদি। আপনি ঘুমুতে যান। ইচ্ছা করলে আপনি আপনার পুত্রকেও নিতে পারেন।

বসি কিছুক্ষণ তোমার কাছে। হাসির গল্পটি বল। আমারো হাসতে ইচ্ছা করছে।

আমার আর করছে না। ঘুম পাচ্ছে।

বাবা উঠে চলে গেলেন। টগর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল। তার কেবলি মনে হতে লাগল। খালামণি এখানে এসে বদলে গেছে। তার ধারণা বাবাও সেটা জানেন। এবং তিনিও তার মতই জেগে জেগে খালামণির ব্যাপারটা ভাবেন। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কেন খালামণি এ রকম করছে? পরশু দিনের আগের দিন বিকেলে খালামণি বলল, আজ নদীর পাড়ে যাব। একটা নৌকা ভাড়া করে খুব ঘুরব। দুলাভাই তৈরি হয়ে নিন। ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে যাব। দৃশ্য দেখতে দেখতে চা খাব। বাবা বললেন, নদী তো অনেকখানি দূর। চার পঁাচ মাইল হবে।

হলে হবে। আপনি তৈরি হন। খাতা-কলম সঙ্গে নিন। হঠাৎ কোনো ভাব এসে গেলে লিখে

ফেলবেন।

ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।

হলে হবে।

খালামণি ফ্লাক্স ভর্তি করে চা করল। কী একটা খাবার তৈরি করল। তারপর হঠাৎ মত বদলাল। গম্ভীর হয়ে বলল, দুলাভাইকে নিয়ে কোনো কাজ নেই। আমি আর তুই যাব।

বাবা কাপড় আনছে তো।

পরেছে পরুক। কাপড় পরে বসে থাকুক। চল আমরা রওনা দিয়ে দিই। সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে। হাতে সময় নেই।

টগর মৃদু স্বরে বলল, বাবাকে নিয়ে যাই? অপলা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই তাহলে থাক তোর বাবার সঙ্গে। আমি চললাম। অপলা সত্যি সত্যি একা একা রওনা হয়ে গেল। বাবা পেছন থেকে ডাকল, এ্যাই অপলা, এ্যাই। খালামণি ফিরেও তাকাল না। ফ্লাক্স দোলাতে দোলাতে হন হন করে ছুটিতে লাগল। বাবা ফুলির আব্বাকে বলে দিলেন সঙ্গে যেতে। তার পর হাসি মুখে টগরকে বললেন, তোর খালার কী হয়েছে রে?

জানি না। কী হয়েছে।

রাগ নাকি?

হুঁ।

কার ওপর রাগ?

তোমার ওপর।

আমার ওপর রাগ, তো তোকে কেন নেয়নি?

আমার ওপরও রাগ।

বলিস কী। পৃথিবীর সবার ওপরই সে রাগ করেছে নাকি?

হুঁ।

বাবা খুব হাসতে লাগলেন। এতে হাসির কী আছে? বড়রা অকারণে কেন হাসে? এবং কেন মাঝে মাঝে ছোটদের মত পৃথিবীর সবার সঙ্গে রাগ করে? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। হয়ত বড় হলেই উত্তর জানা যাবে। কিংবা কে জানে হয়ত জানা যাবে না।

তিন দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। অপলার ঢাকা ফিরে যাবার কোন লক্ষণ নেই। রানু দু’টি আর্জেন্ট টেলিগ্রাফ পাঠিয়েছে। দু’টিতেই লেখা, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আপলার মধ্যে ফিরে যাবার কোন লক্ষণ নেই। ওসমান সাহেব বললেন, পড়াশোনা বন্ধ করে এখানে পড়ে আছ। যাওয়া উচিত না।

হ্যাঁ উচিত।

কবে যাবে? এখানকার স্কুলের একজন টিচার তোমাদের সঙ্গে যাবেন। তাকে বলে রেখেছি। কাল রওনা দিলে কেমন হয়।

আপনি যাচ্ছেন না?

আমি আরো কয়েকদিন থাকব।

তাহলে আমিও থাকব। টগরকে কারো সঙ্গে পাঠিয়ে দিন।

ঠিক বলছি তুমি!

ঠিকই বলছি।

এক রাতে ঘুম ভেঙে টগর দেখল। খালামণি কাঁদছে। সে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে তোমার? অপলা ধরা গলায় বলল, জানি না। কী হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *