অদৃশ্য যুদ্ধ
৩১. আবেদন
যদিও ক্যাপ্টেন সিরডার বে তার শরীরে কুসংস্কারের ছিটেফোঁটাও নেই বলে গর্ব করেন, কিন্তু তবুও সবকিছু খুব বেশী ভালোভাবে চললে তিনি চিন্তিত হতে থাকেন। এ পর্যন্ত থ্যালসায় সবকিছু খুব বেশী ভালোভাবে চলেছে। একদম পরিকল্পনা মতো। বরফের বর্মটা পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছে। উল্লেখযোগ্য কোন সমস্যাও হয়নি। কিন্তু এখন তার শান্তি নষ্ট করেছে এই বিরক্তিকর চিঠি। ক্যাপ্টেন আবার পড়লেন।
সময়কাল: কোন সময় বা তারিখ নেই
পাবেন: ক্যাপ্টেন
প্রেরক: অজানা
স্যার, আমরা কয়েকজন আপনার কাছে একটি প্রস্তাব দিচ্ছি, যা আপনার সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবী করে। আমরা মনে করি, আমাদের অভিযানের শেষ এই থ্যালসায় হওয়া উচিত।
আমাদের সমস্ত উদ্দেশ্যই সফল হবে, কেবল মাত্র সাগান-২ এর বিপদগুলো ছাড়া। আমরা এও সম্পূর্ণভাবে জানি যে, বর্তমান জনসংখ্যার জন্য সেটা হবে একটা সমস্যা। বিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আমাদের প্রযুক্তি তার সমাধান দেবে–বিশেষত আমাদের ভূ-তাত্ত্বিক প্রকৌশল দিয়ে আমরা ভূমির পরিমাণ বাড়াতে পারব। নিয়মাবলীর ধারা ১৪, অনুচ্ছেদ ২৪(ক) অনুযায়ী, আমরা মহাকাশযানের কাউন্সিলকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য অনুরোধ জানাই।
-বেশ, ক্যাপ্টেন ম্যালিনা, অ্যাম্বেসেডর ক্যালডর, কোন মন্তব্য?
দু অতিথিই ক্যাপ্টেনের বিশাল কিন্তু নিরাভরণ রুমে বসে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ক্যালডর ডেপুটি ক্যাপ্টেনের দিকে একটা অস্পষ্ট নড় করলেন এবং চমৎকার থ্যালসান মদে আরেকবার চুমুক দেবার ইচ্ছেটা স্পষ্টই পরিত্যাগ করলেন। ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা, যে কিনা মানুষের চাইতে যন্ত্রের সঙ্গেই বেশী স্বচ্ছন্দ, মুদ্রিত কাগজটার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
–অন্ততঃ ভঙ্গিটা বেশ ভদ্র।
–আমিও তাই আশা করি–ক্যাপ্টেন অসহিষ্ণুভাবে বললেন, তুমি কি ধরতে পারছ কারা এটা করতে পারে।
-না কাউকে না। আমাদের বাদ দিলে প্রায় ১৫৮ জন সন্দেহের তালিকায় পড়বে।
-সেটা খুব ছোট কিছু নয়। কি ডক্টর, তোমার কোন তত্ত্ব আছে এ ব্যাপারে?
অবশ্যই আছে, ক্যালডর ভাবল। আমি মঙ্গলে দুটো দীর্ঘ বছর কাটিয়েছি। কিন্তু সেটা একটা সন্দেহ মাত্র, আর আমি ভুলও হতে পারি।
-এখনও নয় ক্যাপ্টেন। তবে আমি চোখ কান খোলা রাখব। কিছু জানলে সঙ্গে সঙ্গেই তোমাকে জানাব।
দু’জন অফিসার তাকে পুরোপুরিই বুঝতে পেরেছে। কাউন্সিলর হিসেবে, মোজেস ক্যালডর এমন কি ক্যাপ্টেনের কাছেও দায়বদ্ধ নয়। ম্যাগেলানে সে একজন স্বীকারোক্তি গ্রহণকারী পুরোহিতের কাছাকাছি পর্যায়ে আছে।
-আমি আশা করি ড. ক্যালডর, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে জানাবে। বিশেষত এমন কিছু যা এই যাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে সাহায্য করবে।
ক্যালডর ইতস্ততঃ করলেন। আশা করা যায় তিনি সেই প্রাচীন পুরোহিতের মতো অবস্থায় পরবেন না। যার কাছে কোন খুনী স্বীকারোক্তি দিয়েছে এবং অন্য খুনের পরিকল্পনা বলছে।
ক্যাপ্টেন তিক্ততার সাথে ভাবলেন, আমি তেমন সাহায্য পাবো না। তবে আমি এ দু’জনকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে পারি, যাদের কাছে বলা যায়। অবশ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমিই নেবো।
-প্রথম কথা হলো, আমি কী এর উত্তর দেবো, না দেখোনা? দুটোই বিপজ্জনক। যদি এমন হয় যে, এটা একটা সাধারণ অনুরোধ-হয়তো যে কোন একজনের সাময়িক মানসিক দুর্বলতা-সেক্ষেত্রে একে গুরুত্বের সঙ্গে নিলে ভুল হবে। কিন্তু এখানে যদি একটা দল থাকে, তাহলে কথা বলাটাই লাভজনক। সেক্ষেত্রে অবস্থাটা একটু সহজ হবে। কারা দায়ী সেটাও হয়তো বের করা যাবে।
কিন্তু তারপর কি হবে?–ক্যাপ্টেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন। এদের বন্দী করে রাখবো?
-আমার মনে হয় তোমার কথা বলা উচিত, ক্যালডর বললেন। অবজ্ঞা করলে সমস্যা সাধারণত বেড়েই যায়।
-আমারও তাই মনে হয়, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা বললেন। তবে আমি নিশ্চিত শক্তি কেন্দ্র পরিচালনার কোন কর্মী এতে জড়িত নয়। ওদের সবাইকে আমি গ্রাজুয়েট হবার সময় বা এর আগে থেকে চিনি।
তোমার বোকা হবার সম্ভাবনা আছে, ক্যালডর ভাবল। কেউ কি কাউকে সত্যি চিনতে পারে?
-বেশ, ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমিও এটাই ঠিক করেছি। আমার মনে হয় আমার কিছু ইতিহাস আবার পড়া দরকার। যদুর মনে পড়ে সমুদ্রের ম্যাগেলানও তার নাবিকদের নিয়ে কিছু সমস্যায় পড়েছিলেন।
-হ্যাঁ সে পড়েছিল, ক্যালডর জবাব দিলেন। তবে আমি বিশ্বাস করি তুমি তার মতো কাউকে নির্জন দ্বীপে পরিত্যাগ করবে না। অথবা তোমার অধিনায়কদের মধ্যে কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাবে না–সে নিজের মনেই যোগ করলো। মাঝে মাঝে ইতিহাসের কোন অংশ শোনানো বোকামী। কারণ ক্যাপ্টেন বেকে এটা মনে করিয়ে দেয়া আরও বোকামী হবে- যদিও নিশ্চয়ই তার মনে আছে সেই মহান অভিযাত্রী তার অভিযান শেষ করার আগেই নিহত হয়েছিলেন।
৩২. ক্লিনিক
জীবনে প্রত্যাবর্তন এবারে আগেরবারের মতো সুনিয়ন্ত্রিত ছিল না। লোরেন লোরেন সনের এবার জ্ঞান ফেরাটা প্রথম বারের মতো আনন্দদায়ক নয়। বাস্তবে এটা মাঝে মাঝে এমনই কষ্টকর যে তার মনে হত যে, ডুবে মরাই ভাল। তবে কিছুটা সজ্ঞানতা ফিরে এলেই সে তা ভুলে গেল। তার গলায় নল ঢোকানো। হাতে পায়ে তার লাগানো। হাত পা আটকানো, পুরোনো মত্যুছায়া মনে পড়তেই তার ভয় লাগল।
এখন আর ভয়ের কিছু নেই। সেতো নিশ্বাস নিচ্ছে না, তার ডায়াফ্রামও নড়ছে না। কি কিম্ভুত, তারা কি করছে?
তার মনিটরের কোন পরিবর্তনে একজন নার্স এল। সে হঠাৎ কানে মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। কিন্তু তার চোখ বুজে এল।
-মি, লোরেনসন আপনি ভাল আছেন। ভয়ের কিছু নেই। কদিনের মধ্যেই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন- না, কথা নয়।
কথা বলার কোন ইচ্ছে আমার নেই, লোরেন ভাবল। আমি ভালই জানি কি ঘটছে।
আবার হাতে ইনজেকশন, অন্তহীন ঘুম।
এর পরেরবার সে আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করল যে সবকিছু অন্যরকম। নল আর তারগুলো চলে গেছে। খুব দুর্বল লাগলেও অস্বস্তিটা নেই। এবং সে স্বাভাবিক শ্বাস নিচ্ছে।
-হ্যালো, একটা পুরুষ কণ্ঠ কয়েক মিটার দূরে শোনা গেল। লোরেন ঘোরার চেষ্টা করল। পাশের বিছানায় ব্যান্ডেজ মোড়া একটা মূর্তি চোখে পড়ল।
-আমার মনে হয় আপনি আমাকে চিনতে পারেননি মি. লোরেনসন। আমি লে, বিল হরটন, যোগাযোগ প্রকৌশলী। সাফবোর্ডে আঘাত পেয়েছি।
–বিল, কেমন আছ। তুমি কি করছ এখানে, লোরেন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আবার নার্স এল ঘুম নিয়ে।
এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং হাটাচলার জন্য আকুপাকু করছে। কমান্ডার নিউটন সামগ্রিকভাবে বিশ্বাস করেন যে তার রোগীদের কি এবং কেন হয়েছে তা জানানো উচিত। যদি তারা তা নাও বোঝে অন্তত তারা তার ডাক্তারী কাজের মধ্যে বাগড়া দেয় না।
-তোমার হয়তো মনে হতে পারে তুমি ভাল হয়ে গেছো লোরেন। কিন্তু তোমার ফুসফুস এখনও নিজেকে সুস্থ করছে। পৃথিবীর মতো থ্যালসার সাগর হলে কোন ঝামেলা হতো না। কিন্তু এটা অত লবনাক্ত নয়, খাওয়া যায়। তুমি প্রায় লিটার খানেক খেয়েছে। যেহেতু তোমরা শরীরের ফ্লুয়িড সাগরের চেয়ে বেশী লবনাক্ত তাই শরীরের আইসোটনক ব্যালান্স একদম উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। অসমোটিক প্রেশারে প্রচুর কোষপর্দা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তোমাকে ঠিক করার জন্য আমাদের দ্রুত অনেকগুলো পরীক্ষায় যেতে হয়েছে। বুঝতেই পারছো ডুবে যাওয়া তো আর সাধারণ মহাকাশ-দুর্ঘটনা নয়।
-আমি লক্ষ্মী হয়ে থাকব এবং তুমি যা করেছে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি কখন অতিথি প্রত্যাশা করতে পারি?
-এই মুহূর্তেই একজন ওয়েটিং রুমে আছে। তুমি পনেরো মিনিট পাবে। এরপর নার্স তাকে বের করে দেবে।
-আমাকে নিয়ে ভেবোনা, লে. বিল হরটন বলল। আমি চোখ বুজে থাকব।
৩৩. বন্ধন
মিরিসার খারাপ লাগছিল। অবশ্যই সেটা বড়ির দোষ। তবে এটা স্বস্তিকর যে এ ব্যাপারটা আর মাত্র একবার তার হবে যখন (এবং যদি!) সে দ্বিতীয়বার মা হবে। এটা অচিন্ত্যনীয় যে, আসলে সব প্রজন্মের মহিলারাই আগে তাদের জীবদ্দশার সর্ধেকটাই এই অস্বস্তিকর নিয়মিত দিনগুলো নিয়ে কাটাত। চান্দ্রমাসের সঙ্গে এই চক্রের মিল কি কেবল কাকতালীয়? সে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে। চিন্তা কর, দুটো উপগ্রহের থ্যালসা গ্রহে যদি এটা ঘটত। সমুদ্রের জোয়ারের মতো পাঁচ দিন অথবা সাত দিনের ব্যবধানে বিনা নোটিশের সে অবস্থার হাস্যকর দিক চিন্তা করে তার প্রায় হাসি চলে এল।
তার সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় সপ্তাহ খানেক লাগল। সে কাউকেই বলেনি। লোরেনকে, ব্র্যান্টতো বাদই –সে এখন ক্যালিপসোকে উত্তর দ্বীপে মেরামতে ব্যস্ত। ব্র্যান্ট যদি কোন প্রতিরোধ ছাড়াই এভাবে চলে না গিয়ে তার পাশে থাকতো তাহলে কি সে আরও কিছু করত? না, সেটা হতো অন্যায়-আদিম এমনকি মানবেতর প্রতিক্রিয়া। যদিও এধরনের প্রবৃত্তি সহজে মরে না। লোরেন ক্ষমাপ্রার্থনার সুরেই বলেছে যে, সে স্বপ্নে মাঝে মাঝে ব্র্যান্টের সঙ্গে যুদ্ধ করে।
সে ব্র্যান্টকে দোষ দিতে পারে না। বরং তার জন্য গর্বই বোধ করা উচিত। সে উত্তর দ্বীপে গিয়েছে তার ভীরুতার জন্য নয় বরং বিবেচনাবোধের জন্য। যাতে তারা দু’জনেই নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক করতে পারে।
তার সিদ্ধান্ত ঝোঁকের মাথায় হয়নি। তার সচেতনতার মাঝেই সপ্তাহ ধরে এর জন্ম হয়েছে। লোরেন চলে যাবে সে জানে। নক্ষত্রের পথে উড়ে যাবার আগে তার কি করতে হবে তাও সে জানে। তার প্রতিটি অনুভূতি বলছে–সে ঠিক কাজ করছে, কিন্তু ব্র্যান্ট কি বলবে? কিভাবে সে ব্যাপারটা নেবে? আরও বহু সমস্যার মধ্যে। সেটারও মুখোমুখি হতে হবে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি ব্র্যান্ট, সে ফিসফিসিয়ে বলল। আমি চাই তুমি ফিরে এসো। আমার দ্বিতীয় সন্তানটাই হবে তোমার। তবে প্রথম সন্তান নয়।
৩৪. কম্পিউটার নেটওয়ার্ক
ইয়েন ফ্লেচার ভাবছিল, কি অদ্ভুত যে আমার নামটা সবচেয়ে বিখ্যাত বিদ্রোহীর নামে রাখা। আমি কি হারতে পারি? দেখা যাক পিটকেইন দ্বীপে দুহাজার বছর আগে তারা নেমেছিল…. প্রয় একশ পুরুষ আগে, এটাকে সহজভাবে… ফ্লেচার তার মানসাঙ্ক কষার ব্যাপারে একটা সরল গর্ব অনুভব করে, যা বহুলোককেই অবাক এবং প্রভাবিত করে, বিশেষত শত বছর ধরে মানুষ যেখানে দুই আর দুই যোগ করতেও বোতাম টেপে। অংকের কিছু সূত্র আর লগারিদমের কিছু মান মনে রেখে করলে, মানসাঙ্ক কষতে যারা জানে না, তাদের কাছে ব্যাপারটা আরও রহস্যপূর্ণ হয়ে যায়। অবশ্যই সে সেই উদাহরণগুলোই করে যেগুলো সে আগেও করেছে, এবং খুব কমই কারও আগ্রহ থাকে তার উত্তর মিলিয়ে দেখার।
একশ পুরুষ আগে মানে একশ দুই পূর্বপুরুষ। তিন শূন্য এক শূন্যর লগ দুই করলে মানে তিরিশ দশমিক এক… ওরে ব্বাস! মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন লোক? কিছু একটা ভুল হয়েছে। এতে মানুষ পৃথিবীর জন্মের পর থেকে জন্মালেও হতো না। অবশ্য এখানে ধরা হয়েছে যে মানবজাতি শুধু বেড়েছে–কোনভাবে আত্মীয় সম্মন্ধ হয়নি। যাকগে একশ পুরুষ পর এমনিতেই সবাই সবার আত্মীয় হয়ে যায়। যদিও আমি প্রমাণ করতে পারব না যে ফ্লেচার ক্রিশ্চান বহু যুগ আগে আমারই পূর্বপুরুষ ছিলেন।
স্ক্রীন থেকে পুরোনো সব রেকর্ড মুছে ফেলে সে ভাবল, পুরো ব্যাপারটাই আকর্ষণীয়। তবে আমি কোন বিদ্রোহী নই। আমি একজন আবেদনকারী এবং এটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক অনুরোধ। কার্ল, রঞ্জিত, বব সবাই সায় দিয়েছে, ওয়ের্নার দ্বিধান্বিত, কিন্তু আমাদের সে ছেড়ে যাবে না। আমি কিভাবে অন্য ঘুমন্ত স্যাব্রাদের জানাই যে তারা যখন ঘুমিয়ে আছে তখন কি অপূর্ব এক জগত আমরা পেয়েছি।
এরমধ্যে অবশ্য আমাকে ক্যাপ্টেনকে উত্তর দিতে হবে।
.
ক্যাপ্টেন বে’র খুব অস্বস্তি লাগছিল যে তিনি মহাকাশযানের কাজকর্ম কিভাবে দেখবেন যখন তিনি জানেনই না কে বা কারা তার অফিসারদের অথবা ক্রুদের মধ্যে তাকে উদ্দেশ্য করে নামহীনভাবে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছে। তাদের পরিচয় বের করার কোন ব্যবস্থাই নেই। এটাই তাদের উদ্দেশ্য। সামাজিক ন্যায়বিচার রাখতে বহু আগের মৃত মেধাবীরাই এই ব্যবস্থা রেখেছিল ম্যাগেলান তৈরীর সময়। প্রধান যোগাযোগ প্রকৌশলীর কাছে তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে একটা স্টোর বসাবার কথা তুলেছিলেন। কিন্তু তাতে সে এতোটাই ব্যথিত হয়েছে যে, তিনি তৎক্ষণাৎ সে সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। তাই তিনি এখন প্রতিনিয়ত মুখগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছেন, ভাবভঙ্গী দেখছেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন কণ্ঠস্বরের ওঠানামা এবং চেষ্টা করছেন যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখানোর। হয়ত তিনি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন এবং তেমন কোন গুরুতর ব্যাপার ঘটেনি। কিন্তু তার ভয় হচ্ছে একটা বীজ বপন হয়ে গেছে, যেটা থ্যালসার কক্ষপথে থাকার সময় দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে।
তার প্রথম উত্তর ম্যালিনা আর ক্যালডরের সঙ্গে আলোচনার পর ঠিক করা হয়েছে তা যথেষ্ঠই বিনয়ী।
হতে: ক্যাপ্টেন
প্রতি: অজানা
তোমার তারিখহীন আবেদনের ব্যাপারে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আলোচনায় বসতে আমার কোন আপত্তি নেই। সেটা নেটওয়ার্ক বা কাউন্সিল যে কোন ভাবেই হতে পারে।
যদিও এতে তার প্রচন্ড আপত্তি আছে। মিলিয়ন খানেক মানুষকে একশ পঁচিশ আলোকবর্ষ দূরত্ব পার করে নিয়ে যাবার ট্রেনিং-এ তার সমস্ত সাবালক জীবনের অর্ধেকটা কেটে গেছে। এটাই তার জীবনের লক্ষ্য। পবিত্র বলে কিছু যদি তার। জীবনে থেকে থাকে, তাহলে এটাই তা। মহাকাশযানের কোন অচিন্তনীয় ক্ষতি অথবা সাগান ২-এর সূর্য নোভায় পরিণত হতে যাচ্ছে এরকম কেন ঘটনা ছাড়া তাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা যাবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে তাকে একটা কাজের পন্থাও বের করতে হবে। ক্রুরা কিছুটা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মাঝে বরফ কলের সামান্য ক্ষতি সারতে প্রায় দ্বিগুণ সময় লেগেছিল এবং এটাই স্বাভাবিক। সমগ্র মহাকাশযানের মনোবল নীচে নেমে যাচ্ছে। এখনই চাবুক মেরে। সেটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
-জন-তিরিশ হাজার কিলোমিটার নীচে তার সেক্রেটারীকে তিনি ডাকলেন আমাকে বরফশীল্ড তৈরীর শেষ খবর জানাও। আর ক্যাপ্টেন ম্যালিনাকে জানাও যে আমি তার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।
দিনে একবারের বেশী বরফ তে« যাবে কিনা তিনি জানেন না। তবে তার চেষ্টা তিনি করবেন।
৩৫. ফিরে আসা
লে, হটন আমুদে মানুষ হলেও, ইলেকট্রোফিউশন পদ্ধতির মাধ্যমে ভাঙ্গা হাড় সেড়ে উঠায় তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে লোরেন খুশিই হল। তারপর বিস্তারিত শুনল যে, তরুন প্রকৌশলী একদল উত্তরের খ্যাপার পাল্লায় পড়েছিল, যাদের জীবনের দ্বিতীয় প্রধান উদ্দেশ্যই হল উঁচু ঢেউয়ের মাথায় মাইক্রোজেট সাজেট নিয়ে সার্ফিং করা। হার্টন অবশ্য ভুক্তভোগী হয়ে শিখেছে যে, জিনিসটা যা দেখায় আসলে তার চেয়েও ভয়ংকর।
-আমি বেশ অবাক হলাম। লোরেন সাদামাটা ভাবেই বলল। আমি জানতাম তুমি নব্বই ভাগ বিপরীতকামী।
-আসলে বিরানব্বই। তবে মাঝে-মধ্যে রুচি পাল্টাতে আমার ভালই লাগে। হর্টন উৎফুল্লভাবে বলল।
লেফটেনেন্ট কিছুটা মজা করছিল। কোথায় যেন সে পড়েছিল যে, শতকরা একশভাগ এতই দুষ্প্রাপ্য যে তাকে অসুস্থতাই বলা যায়। সে অবশ্য তা বিশ্বাস করে না–তবে জিনিসটা ভাবতে তার ভাল লাগে না।
এখন লোরেন যখন একমাত্র রুগী সে ল্যাসান নার্সটিকে বোঝাতে পারল যে তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি আসলে অপ্রয়োজনীয় বিশেষত মিরিসার দৈনিক সাক্ষাতের সময়। সার্জন কমান্ডার নিউটন, অধিকাংশ ডাক্তারের মতোই যে লজ্জাহীনরকম খোলামেলা, শুধু ঠান্ডা গলায় বললেন- আরও এক সপ্তাহ লাগবে তোমার ঠিক হতে। যদি তোমার প্রেম করতেই হয়, তাহলে সব খাটুনি যেন সে করে।
অবশ্য আরও অতিথি ছিল। দুজন ছাড়া প্রত্যেকেই প্রত্যাশিত। মেয়র ওয়ার্ডেন নার্সকে তুড়ি মেরে ঢুকে পড়তেন। সৌভাগ্যক্রমে তার আর মিরিসার আসাটা কখনোই একসঙ্গে হতো না। প্রথমবার লোরেন মটকা মেরে পড়ে রইল কিন্তু চালাকীটা ঠিক ছিল না। লোরেনকে বাধ্য হয়ে কিছু ভেজা আদর নিতে হল। দ্বিতীয়বারে একটা পরীক্ষা চলছিল যার নল ছিল তার মুখের ভেতর। অতএব কোন কথা বলতে হয়নি। মেয়র যাবার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই অবশ্য পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেল।
ব্র্যান্ট ফ্যাকনরের সৌজন্য সাক্ষাৎ তাদের দুজনের জন্যই পীড়াদায়ক। তারা ভাবে কাঁকড়া, বরফকল, উত্তর দ্বীপের রাজনীতি সবকিছু নিয়ে আলোচনা করে কিন্তু শুধুমাত্র মিরিসার প্রসংগ ছাড়া। লোরেন বোঝে যে, ব্র্যান্ট চিন্তিত এমনকি লজ্জিত। কিছুটা দুঃখিতও। যাবার আগে সে মুখ তুলে বলে- লোরেন তুমি জান, ঐ ঢেউ নিয়ে আমার কিছু করার ছিল না। আমরা যদি আগের পথে চলতাম, আমরা রীফে আছড়ে পড়তাম। ক্যালিপসো গভীর সমুদ্রে পড়লে কোন সমস্যাই আর হতো না।
-আমি জানি এরচে ভাল আর কেউ করতে পারত না। লোরেন সত্যিই বলে।
–তুমি বুঝেছো দেখে ভাল লাগছে।
ব্র্যান্ট অবশ্যই ভারমুক্ত হয়েছে। ব্র্যান্টের প্রতি তার কিছুটা করুণাও হয়। সম্ভবত তার নৌচালনার দক্ষতা নিয়ে কথা উঠেছে। নিজের কাজের প্রতি ব্র্যান্টের মতো দায়বদ্ধ কারও জন্য তা অসহনীয়।
-তারা জাহাজটা বাঁচিয়েছে।
–হ্যাঁ। মেরামতের পর ওটা এখন একদম নতুন।
–আমার মতো।
-দুজনে হেসে দিল। লোরেনের হঠাৎ মনে হল, কুমার যদি আরেকটু কম সাহসী হত তবে কি ব্র্যান্ট খুশী হত।
৩৬. কিমানজারো
কিলমানজারোর স্বপ্ন কে দ্যাখে?
এটা একটা অদ্ভুত শব্দ, নাম সে বোঝে, কিন্তু কার?
থ্যালসার গোধূলীর ধূসর আলোয় মোজেস ক্যালডর শুয়ে তারনার জেগে ওঠা শব্দগুলোর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছিল। খুব বেশী কেউ নেই এসময়। একটা বালির স্লেজের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
সম্ভবত কোন মৎস্য শিকারীর অপেক্ষায়।
কিলমানজারো।
ক্যালডর দাম্ভিক নয় তবে অন্য কেউ তার মতো বিচিত্র বিষয়ের ওপর প্রাচীন বই পড়েছে কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে। তার অবশ্য কয়েক টেরাবাইট তথ্য মাথায় ঢোকানো আছে, সেগুলো ঠিক জ্ঞান নয়, কেবল উপযুক্ত সংকেত দিলেই তা মনে আসবে।
এটা একটু দ্রুতই করা হয়ে যাচ্ছে, আর ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিনা তা নিয়েও তার সন্দেহ আছে। যদিও সে স্বপ্নকে অবজ্ঞা করে না। দু’হাজার বছর আগে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড এ ব্যাপারে বেশ খাঁটি কিছু কথা বলে গেছেন। আর যাই হোক, সে এমনিতেই আবার ঘুমাতে পারবে না। সে তার চোখ বন্ধ করল, ‘অনুসন্ধান কমান্ড চালু করল, এবং অপেক্ষা করতে লাগল। যদিও এটা পুরোটাই কল্পনা, পুরো ব্যাপারটাই অবচেতন মনে ঘটে–সে অসংখ্য পুরোনো ঘটনাকে মাথার ভেতরে দেখতে পায়। এখন তার শক্ত করে বন্ধ রাখা চোখের সামনে যে বিক্ষিপ্ত আকারের আলোর প্রভা ছিল সেখানে কিছু হচ্ছে। একটা কালো পর্দা অস্পষ্ট আলোর সামনে হঠাৎ যাদুর মতো চলে এল এবং সেখানে কিছু অক্ষর ফুটে উঠল।
কিলমানজারোঃ আগ্নেয়গিরি, আফ্রিকা, উচ্চতা ৫.৯ কি.মি।
পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ বন্দর।
আচ্ছা! তার মানেটা কি? সে তার মনকে এই সামান্য তথ্য নিয়ে খেলা করতে দিল। আরেক আগ্নেয়গিরি ক্র্যাকানের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে, যেটা নিশ্চয়ই বেশ কিছু চিন্তার জন্ম দিয়েছে।
প্রথম মহাকাশ বন্দর? সে এক প্রাচীন ইতিহাস। গ্রহ বসতির প্রথম পর্যায়কে এটা মনে করিয়ে দেয়, যা মানুষকে সৌরজগতে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দিয়েছিল এবং তারা এখানেও সেই পদ্ধতি ব্যবহার করছে–অত্যন্ত শক্ত পদার্থে গড়া তার দিয়ে বরফ নিয়ে যাচ্ছে ম্যাগেলানের কক্ষপথে।
কিন্তু এটাও সুদূরের কোন আফ্রিকার পর্বতের কান্নার কারণ নয়। যোগাযোগটা খুবই দূরের।
নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে।
সরাসরি কিছুই বের করা গেল না। এর মোগাযোগ বের করার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে ব্যাপারটাকে ছেড়ে দেয়া এবং অবচেতন মনের বিস্ময়কর কর্মপদ্ধতির ওপর বিশ্বাস রাখা।
কিলমানজারোকে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে হবে, যতদিন না হঠাৎ করে আবার মাথায় জেগে ওঠে।
৩৭. মদিরার শাশ্বত সত্যি
মিরিসার পর কুমার হলো লোরেনের কাছে সবচেয়ে প্রত্যাশিত এবং বেশী আসা অতিথি। তার ডাক নাম যাই হোক না কেন, লোরেনের কাছে তার স্বভাবটা অনেকটা সারমেয় বা সারমেয় ছানার কাছাকাছি। তারনায় বেশ কিছু কুকুর আছে, হয়তো সাগান-২ তেও থাকবে, মানুষের সঙ্গে বহু যুগের বন্ধুত্বের দাবীতে।
লোরেন এখন শুনেছে যে তার জন্য এই ছেলেটা সমুদ্রে কি ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছিল। তারা শুধু বেঁচে গেছে এইজন্য যে কুমার কখনোই সমুদ্রে ডুবুরীর ছুরি ছাড়া যায় না। তারপরও তাকে সমুদ্রের তলে প্রায় তিন মিনিট থাকতে হয়েছিল। ক্যালিপসোর সবাই ধরে নিয়েছিল যে, তারা দুজনেই মারা গেছে।
তবে নতুন এই বাঁধনে বাধা পড়লেও লোরেন এখনও কুমারের সঙ্গে কোন কথা খুঁজে পায় না। আমার জীবন রক্ষার জন্য ধন্যবাদ, এ কথা সরাসরি বলা খুব মুস্কিল। আর তাদের মধ্যে বিষয়ের ব্যবধান এত বেশী! যদি সে পৃথিবী বা মহাকাশযান সম্পর্কে কিছু বলতে চেষ্টা করে তাহলে সব কিছু এত বিস্তারিত বলতে হয় যে সে হাঁপিয়ে যায় এবং খুব শিগগিরিই আবিষ্কার করে যে পুরোটাই পন্ডশ্রম। কুমার তার বোনের মতো নয়। বর্তমানটাই তার বিশ-থ্যালসাই হচ্ছে তার কাছে। গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালডর একবার বলেছিল, সে বর্তমানের বাসিন্দা। অতীতের দুশ্চিন্তা বা ভবিষ্যতের ভাবনায় সে চিন্তিত নয়।
ক্লিনিকে শেষ রাতে ঘুমাবার আগে কুমার এক বিশাল বোতল নিয়ে উৎফুল্ল ভাবে ঢুকল।
১০৮ # দূর পৃথিবীর ডাক
-বলতো এটা কি?
–জানিনা।
–ক্র্যাকানের প্রথম মদিরা। এটা এবছর খুব ভাল হয়েছে।
–তুমি এতসব জানলে কি ভাবে?
-ওখানে আমাদের পরিবারের শত বছরের পুরানো ভাটিখানা আছে। সিংহ ব্র্যান্ড এ পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত।
কুমার দুটো গ্লাস নিয়ে ভর্তি করল। লোরেন একটা সতর্ক চুমুক দিল। একটু বেশী মিষ্টি কিন্তু খুব মসৃণ।
-কি নাম এটার?
–ক্র্যাকান স্পেশাল।
-ক্র্যাকানের ছানা একবার আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার কি ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে।
-তোমার কোন হ্যাং ওভার হবে না।
লোরেন আরেকটু বড় চুমুক দিল। এবং দ্রুত গ্লাস শেষ হয়ে গেল। দ্রুতই আবার তা ভরে গেল।
ল্যাসান হাসপাতালে শেষ রাত লোরেনের আনন্দেই কাটল। মেয়রকেও সে রাতে খারাপ লাগল না।
–আচ্ছা ব্র্যান্ট কোথায়? আমি তাকে সপ্তাহখানেক ধরে দেখছি না।
-সে উত্তর দ্বীপে। জাহাজ মেরামত করছে এবং সমুদ্র প্রাণীবিদদের সঙ্গে কথা বলছে। সবাই কাঁকড়া নিয়ে খুব উত্তেজিত। কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে না কি করা উচিত।
-তুমি কি জান ব্র্যান্টের ব্যাপারে আমারও একই অবস্থা।
কুমার হেসে দিল।
–ভেবোনা। উত্তর দ্বীপে সে এক মেয়ের সঙ্গে থাকছে।
–আচ্ছা। মিরিসা জানে?
–অবশ্যই।
–সে দুঃখ পেয়েছে?
–কেন পাবে? ব্র্যান্ট তাকে ভালবাসে এবং সে সবসময়ই ফিরে আসবে।
লোরেন তথ্যটা হজম করল। তার মনে হল সে এক জটিল সমীকরণের একটা বিশাল চলরাশি। মিরিসার কি আরও প্রেমিক আছে? তার কি জানার ইচ্ছা আছে? তার কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ?
কুমার গ্লাস ভরতে ভরতে বলল।
-যাহোক। আসল ব্যাপারটা হলো যে তাদের জেনেটিক ম্যাপ গৃহীত হয়েছে। এবং তারা একটা সন্তানের জন্য দরখাস্তও করেছে। সে যখন জন্মাবে তখন ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। তখন তারা শুধুই পরস্পরের সঙ্গে থাকবে। পৃথিবীতেও কি একই ব্যবস্থা ছিল?
-কখনো কখনো, লোরেন উত্তর দিল। তাহলে কুমার জানে না। জিনিসটা তবে দুজনের মধ্যেই গোপন থাকুক। অন্তত আমি আমার সন্তানকে দেখতে পাব লোরেন ভাবল। যদিও মাত্র কয়েক মাস তারপর…
অবাক হয়ে সে দেখল তার চোখ বেয়ে অশ্রু নামছে। শেষ কবে সে কেঁদেছে? দুশ বছর আগে। যখন পৃথিবী পুড়ছিল…।
-কি হয়েছে? কুমার জিজ্ঞেস করল। তুমি কি তোমার স্ত্রীর কথা ভাবছ? তার ব্যাকুলতা এতটাই খাঁটি যে লোরেন কিছু মনে করলনা। এ প্রসংগটা নীরব সমঝোতার মাধ্যমে কখনোই তোলা হয় না, কারণ এটা এখানে অপ্রাসংগিক। দুশ বছর আগের পৃথিবী আর তিনশ বছর পরের সাগান-২ থ্যালসা থেকে এতই দূরে যে তা অনুভূতিকে সেভাবে নাড়া দিতে পারেনা।
-না কুমার। আমি আমার স্ত্রীর কথা ভাবছি না…
–তুমি কি তাকে মিরিসার কথা বলবে?
-কি জানি। হয়তো… হয়তো না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমরা কি পুরো বোতলটা শেষ করতে পারি? কুমার? কুমার। রাতে নার্স এলে তাদের দেখে অবাক হয়ে গেল। চাদর দিয়ে তাদের ঢেকে দিল।
লোরেন আগে জাগল। প্রথমে ধাক্কা খেলেও সে হাসতে শুরু করল।
–হাসির কি আছে? বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে কুমার জিজ্ঞেস করল।
–তুমি সত্যিই জানতে চাও? আমি ভাবছি মিরিসা হিংসা করবে কিনা?
–আমি কিছুটা মাতাল হতে পারি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে কিছু হয়নি।
–আমিও জানি।
কিন্তু সে এখন জানে যে সে কুমারকে ভালবাসে। এজন্য নয় যে সে মিরিসার ভাই বা তার জীবন রক্ষাকারী। বরং সে কুমার শুধুমাত্র সে জন্যই। যৌনতার কোন সম্পর্ক এখানে নেই। এ ধারণাটা তাদের আনন্দিত করে তুলল। তারা ভালই আছে। যদিও তারনার জীবন ইতিমধ্যেই বেশ জটিল হয়ে গেছে।
-তুমি ঠিকই বলেছ, লোরেন বলল। ক্র্যাকান স্পেশালের কোন হ্যাং ওভার নেই। সত্যি বলতে আমার খুব ভাল লাগছে। তুমি কিছু বোতল বরং বলা যায় কয়েকশ লিটার মহাকাশযানে দিতে পার?
৩৮. বিতর্ক
যদিও এটা একটা সহজ প্রশ্ন কিন্তু উত্তরটা বেশ জটিল ম্যাগেলানের শৃঙ্খলার কি হবে যদি এর প্রাথমিক লক্ষ্যটাকেই ভোটাভোটিতে নেয়া হয়?
অবশ্য, ভোটের ফলাফল অলঙ্ঘনীয় নয় এবং তিনি চাইলে তা অগ্রাহ্য করতে পারেন। সবাই যদি থেকে যেতে চায় (তিনি কল্পনাও করতে পারেন না–) তাহলে তাকে তাই করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা সবাইকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে ফেলবে। ক্রুরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যাবে, এবং সে ধরনের কথা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না।
আবার এক নেতাকে দৃঢ় হতে হবে, কিন্তু মাথা মোটা নয়। প্রস্তাবটায় ভালো চিন্তা আছে, এবং তা যথেষ্ঠ আকর্ষণীয়। আসলেই তিনি রাজকীয় অভ্যর্থনা নীচে পাচ্ছেন এবং সেই মহিলা ডেকাথেলন চ্যাম্পিয়নের সাথে আবার সাক্ষাতের সুযোগ তিনি হারাতে চাইবেন না। এটা একটা চমৎকার গ্রহ এবং মহাদেশ সৃষ্টির পদ্ধতিকে তারা আরেকটু গতি দিলেই আরও এক মিলিয়ন লোকের থাকার ব্যবস্থা করা যায়। সাগান-২-কে কলোনী করার চাইতে এটা অনেক সহজ, আর সাগান ২-এ তারা নাও পৌঁছুতে পারেন। যদিও মহাকাশযানের ক্ষমতা ৯৮ ভাগ বর্তমান, তবুও বিপদের কথা কেউই বলতে পারেনা। তার খুব বিশ্বস্ত ক’জন অফিসারই ৪৮ আলোকবর্ষে তাদের বরফ বর্মের একাংশ হারিয়ে যাবার কথা জানে। যে গ্রহাণুর কারণে এটা হয়েছিল, তা যদি আরেকটু কাছে আসত…।
কেউ কেউ অবশ্য বলে জিনিসটা আসলে পৃথিবীর কোন প্রাচীন ছোট মহাকাশ যান।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ভাবে অবশ্য এটা সম্ভব নয়, আর এমন মজার হাইপোথিসিস প্রমাণেরও কোন উপায় নেই। এর ওপর আবার সেই আবেদনকারীরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে “নব্য থ্যালসান” হিসেবে। ক্যাপ্টেন বে অবাক হচ্ছেন এই ভেবে, এর মানে কি তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হবার চেষ্টা চালাচ্ছে? তাই যদি হয়, এদের যত শিগগির সবার সামনে আনা যায় ততই মঙ্গল।
হ্যাঁ, মহাকাশযানে কাউন্সিল ডাকতে হবে এখুনি।
.
মোজেস ক্যালডর বিনয়ের সঙ্গেই দ্রুত প্রস্তাবটা প্রত্যাখান করলেন।
-না ক্যাপ্টেন–এই বিতর্কে আমি জড়াতে পারি না। পক্ষে অথবা বিপক্ষে–কোন। পক্ষেই। যদি আমি তা করি এরা আমার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলবে। তবে সভাপতি বা সমন্বয়কারী হিসেবে আমি থাকতে পারি যদি তুমি চাও।
-ঠিক আছে, ক্যাপ্টেন দ্রুতই উত্তর দিলেন। আসলে এই পর্যন্তই তিনি আশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা তুলবে কে? নব্য থ্যালসানরা নিজেদের দেখাবে সেটা নিশ্চয়ই আশা করা যায় না।
-আমার মনে হয় আমার কোন আলাপ বা বিতর্কে না গিয়ে সরাসরি ভোটাভোটিতে যেতে পারি, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা প্রস্তাব করলেন।
ব্যক্তিগতভাবে ক্যাপ্টেন এটা চান। কিন্তু এখানে একটা সুশিক্ষিত গণতান্ত্রিক সমাজ থেকে আসা মানুষদের সমন্বয়ে এই মহাকাশযানের সমগ্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত। নব্য থ্যালসানরা কাউন্সিল চাচ্ছে তাদের বক্তব্য সবার কাছে তুলে ধরার জন্য। তিনি সে সুযোগ তাদের না দিলে, দু’শ বছর আগে যে বিশ্বাসে পৃথিবীবাসী তাকে নিয়োগপত্র দিয়েছিল, তার অবমাননা হবে। যেটা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কাউন্সিল বসানো খুব সহজ নয়। ব্যতিক্রম ছাড়া সবারই ভোটাভোটিতে অংশ নেয়ার অধিকার আছে। কাজের সময় পুনঃনির্ধারণ করতে হবে, ঘুমানোর সময় নিয়ে ঝামেলা হবে। তার চাইতেও বড় ঝামেলা হবে যেহেতু অর্ধেকেরও বেশী ক্রু থ্যালসায় থাকছে নিরাপত্তার ব্যাপারে। যেটা আগে কখনোই হিসাব করতে হয়নি। ফলাফল যাই আসুক না কেন, এই বিতর্ক যদি ল্যাসানরা শুনতে পায়…
আর তাই লোরেন লোরেনসন কাউন্সিল শুরু হলে তার তারনায় অফিসের দরজা এই প্রথমবারের মতো বন্ধ করে একা বসেছিল। আবার সে একটা পুরো দৃষ্টিসীমার মতো বড় গগলস পরে ছিল। তবে সমুদ্রের তলদেশ নয় বরং এবার সে আছে। ম্যাগেলানের পরিচিত সভাকক্ষে। সে তার কলিগদের দেখছিল, আর যখনই তাকাচ্ছিল তার চোখের সামনে তাদের মন্তব্য এবং সিদ্ধান্ত ফুটে উঠছিল। এ মুহূর্তে অবশ্য একটা কথাই কেবল ফুটে আছে।
.
উপজীব্যঃ মহাকাশযান ম্যাগেলান কি থ্যালসায় তার যাত্রা শেষ করবে, যদি যাত্রার সব উদ্দেশ্যই এখানে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়।
.
আচ্ছা–মোজেস ওখানে, সবাইকে স্ক্যান করতে করতে লোরেন ভাবল। এজন্যই তাকে কিছুদিন পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে ক্লান্ত লাগছে–ক্যাপ্টেনকেও। ব্যাপারটা যা ভেবেছি তার চাইতে মনে হয় ঘোলাটে…
ক্যালডর গলা খাঁকড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
-ক্যাপ্টেন, অফিসাররা এবং কুরা- যদিও এটা আমাদের প্রথম কাউন্সিল কিন্তু তোমরা সবাই নিয়মকানুন জান। যদি তোমরা কিছু বলতে চাও, হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। যদি কেউ লিখিত বক্তব্য দিতে চাও, কিপ্যাড ব্যবহার করবে। তোমাদের পরিচয় গোপন করবার জন্য ঠিকানা মুছে যাবে। আর দুক্ষেত্রেই যতটা সম্ভব সংক্ষেপ করবে। যদি কারো কোন কথা না থাকে, আমি আইটেম নম্বর ০০১ কে তুলে ধরছি। নব্য থ্যালসানরা ০০১ এ কিছু আবেদন করেছিল। এটাই ক্যাপ্টেন বের কাছে দুসপ্তাহ আগে এসেছিল।
সম্ভবতঃ সবচে আলোচিত বক্তব্য হল যে, এখানে থাকাটা তাদের কর্তব্য। ল্যাসানদের তাদের প্রয়োজন–প্রাযুক্তিক, সাংস্কৃতিক এবং জেনেটিক্যালি। লোরেন। অবাক হল, যদিও যুক্তিগুলো সে স্বীকার করছে, তবুও যে কোনভাবেই আগে ল্যাসানদের মতামত নিতে হবে। তারা নিশ্চয়ই সাম্রাজ্যবাদী নয়!
সবাইকে আবেদনটা পড়ার সময় দেয়া হলে ক্যালডর কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যেহেতু কেউ এর পক্ষে কিছু বলেনি অবশ্য পরেও বলা যাবে। আমি লেঃ এলগারকে বিপক্ষে বলার সুযোগ দিচ্ছি।
রেমন্ড এলগার চিন্তাশীল তরুণ, শক্তি ও যোগাযোগ প্রকৌশলী। লোরেন তাকে সামান্যই চেনে। তার সঙ্গীতে প্রতিভা আছে এবং বলা হয় যে এই যাত্রা সম্বন্ধে সে একটি মহাকাব্য লিখছে। যদিও একটা লাইনও যদি কেউ দেখতে চায়, তবে সে উত্তর দেয় সাগান-২ এ যাবার পরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। লেঃ এলগার যে তার ভূমিকার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে সেটা স্বাভাবিক। তার কাব্যিক স্বভাব তাকে এটাই করতে বলবে, আর হয়তো সে সত্যি সত্যি মহাকাব্যটা লিখছে।
-ক্যাপ্টেন, সহকর্মীরা আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার মনে হয় আমাদের মনের ভেতর সবাই স্বীকার করি যে, থ্যালসায় থেকে যাবার পরিকল্পনাটায় প্রচুর আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু একবার ভাবুন যে, আমরা মাত্র ১৬১ জন এখানে উপস্থিত। আমাদের কি কোন অধিকার আছে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবার যার প্রভাব ঘুমন্ত মিলিয়ন মানুষের উপর পড়বে। আর ল্যাসানদের ব্যাপারে বা কি হবে? বলা হচ্ছে আমরা তাদের সাহায্য করব। সত্যিই কি তাই? তাদের নিজস্ব একটা জীবনধারা আছে, এবং সেটা চমৎকারভাবেই চলছে। আর আমাদের ইতিহাস, ট্রেনিং এর কথা চিন্তা করি–যে উদ্দেশ্যে আমরা বহু বছর আগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আপনারা কি মনে করেন, আমাদের মিলিয়ন মানুষ ল্যাসানদের অংশ হয়ে যাবে তাদের ধ্বংস না করেই?
আর তাছাড়া আছে কর্তব্যের প্রশ্ন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের এই যাত্রার জন্য উৎসর্গ করেছে শুধু মানব জাতিকে আরো ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ দেয়ার জন্য। যত বেশী নক্ষত্রজগতে আমরা পৌঁছুবো তত মানব জাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে, ধ্বংসের বিপরীতে। আমরা জানি থ্যালসার আগ্নেয়গিরি কি করেছে। কে জানে ভবিষ্যতে এটা আরো কি করবে
মিছরির ছুরির মতো কেউ কেউ টেকটোনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে নতুন ভূমি তৈরী করে বাড়তি জনসংখ্যার সংস্থানের কথা বলছে। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, হাজার বছর ধরে গবেষণার পরও এটি ঠিক বিজ্ঞ ন হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ৩১৭৫ সালের নাজকা প্লেটের ভূমিধ্বসের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। থ্যালসার মাঝে খুঁচিয়ে নতুন ভূমি ওঠানোর মতো দুর্বুদ্ধি আর দুটো হতে পারে না।
বেশী কিছু বলার নেই। এ ব্যাপারে একটিই সিদ্ধান্ত হতে পারে। ল্যাসানদের তাদের নিজেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমাদের যেতে হবে সাগান-২ এ।
ধীরে ধীরে উঠে আসা তুমুল করতালিতে লোরেন অবাক হলো না। কেউ হাততালি না দিলেও অবাক হতে হবে। বিচারক হিসেবে বলা যায় দর্শকরা দুভাগে সমান ভাগ হয়ে গেছে। অবশ্য অনেকেই ব্যাপারটা সমর্থন না করলেও, উপস্থাপনার। সৌন্দর্যের জন্য করতালি দিয়েছে।
-ধন্যবাদ লেঃ এলগার, সভাপতি ক্যালডর বললেন। তোমার সাহসিকতার প্রশংসা করি। এখন এর বিপক্ষে কেউ কি বলবেন। একটা অস্বস্তি সবাইকে থমকে দিল, তারপর নেমে এল বিশাল নিস্তব্ধতা। প্রায় এক মিনিট কিছুই হল না। তারপর
পর্দায় শব্দগুলো ফুটে ওঠা আরম্ভ করল।
০০২, ক্যাপ্টেন কি মিশনের সাফল্যের সম্ভাবনার বর্তমান হিসেবটা দেবেন?
০০৩. যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের একাংশের কাছ থেকে নমুনা মতামতের জরিপ নেয়া হোক।
০০৪. ল্যাসানরা কি ভাবে-সেটা জিজ্ঞেস করা হোক। এটা তো তাদের জগৎ।
কম্পিউটার পূর্ণ গোপনীয়তা এবং নিরপেক্ষতার মাঝে কাউন্সিল মেম্বারদের মধ্য থেকে মন্তব্য নিচ্ছে। দুই হাজার বছরের মধ্যে এর চাইতে ভালো করে কেউ মতামত নিতে ও তৈরী করার পদ্ধতি দেখাতে পারেনি। সবাই তাদের এক হাতের মধ্যে এটে যাওয়া কি প্যাডের সাতটা বোতাম দিয়ে মন্তব্য লিখছে। কিছু চিন্তা না করে সাত স্পর্শে লিখে যাওয়াটা সম্ভবত প্রথম অর্জিত দক্ষতা।
লোরেন দর্শকদের দিকে তাকিয়ে অবাক হল যে, সবার দুহাত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কেউ সেই পরিচিত দূরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই যাতে বোঝা যায় যে, একটা লুকানো কি প্যাড ব্যাবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও অনেকেই কথা বলছে।
০১৫. একটা মধ্যপন্থা কেমন হয়? আমাদের কেউ কেউ হয়তো থাকতে চাইবে। বাকীরা যাত্রা করবে।
ক্যালডর আবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
–এটা যদিও আলোচ্য সূচীর বাইরের প্রস্তাব, তবে এটাও বিবেচনায় থাকবে।
–০০২ এর জবাবে বলছি, সভাপতির কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার ব্যাপারটা ভুলে গিয়েই ক্যাপ্টেন বে বলে উঠলেন, এখানে ৯৮ ভাগ সম্ভাবনা আছে। আমি অবাক হব না যদি- এই সম্ভাবনা উত্তর বা দক্ষিণ দ্বীপের পানির উপর ভেসে যাবার চাইতে বেশী হয়।
০২১. ক্র্যাকান ছাড়া আর কি আছে যেখানে তারা অসহায়। ল্যাসানদের জীবনে কোন চ্যালেঞ্জ নেই। সম্ভবত আমাদের পক্ষ দিয়ে তেমন কিছু দেয়া উচিৎ।
কি. রা.
এটা নিশ্চয়ই দেখা যাক-হ্যাঁ কিংসলে রামসেন। তার নিজেকে লুকিয়ে রাখার কোন ইচ্ছাই নেই। দেখা যাচ্ছে সে অবশ্য এমন একটা কথা বলেছে যা সবার মনেই উঁকি দিয়েছে।
০২২. আমরা তো ক্র্যাকানের ডিপ স্পেস অ্যান্টেনাটা আবার তৈরী করে তাদের
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। র.ম.ম. ০২৩. বড়জোর দশ বছরের কাজ। কি.রা,
-ভদ্রমহোদয়গণ ক্যালডর একটু অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠলেন- আমরা বিষয়বস্তুর বাইরে চলে যাচ্ছি।
আমার কি কিছু বলা উচিৎ? লোরেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করল। না এই বিতর্কের বাইরে আমি থাকব। আমি দুই পক্ষেই অনেক কিছু দেখছি। খুব শিগগিরি আমাকে কর্তব্য এবং আনন্দ এই দুয়ের মাঝে কোন একটা বেছে নিতে হবে। তবে সেটা এক্ষুনি নয়, এক্ষুণি নয়…
–আমি বেশ অবাক হচ্ছি, দুমিনিট যাবত স্ক্রীনে কোন লেখা না আসায় ক্যালডর বলে উঠলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আর কারও কিছুই বলার নেই।
তিনি আশায় আশায় মিনিট খানেক আরো বসে রইলেন।
-বেশ। সম্ভবত আপনারা ব্যাপারটা নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করতে চান। আমরা এখনই ভোটাভোটিতে যাব না। আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা পর্যন্ত আপনারা এভাবে আপনাদের মন্তব্য জানাতে পারবেন। ধন্যবাদ।
তিনি ক্যাপ্টেন বের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তিনি দ্রুত স্বস্তির ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-ধন্যবাদ ড. ক্যালডর। মহাকাশযানের কাউন্সিলের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। এরপর বে দুশ্চিন্তার সঙ্গে ক্যালডরের দিকে তাকালেন। তিনি ডিসপ্লে স্ক্রীনের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন যেন এই প্রথম তিনি সেটা দেখছেন।
-ড. ঠিক আছ তো?
-দুঃখিত ক্যাপ্টেন। ভালোই আছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হঠাৎ মনে পড়ল কিনা।
হ্যাঁ, অবশ্যই হাজারবার সে তার অবচেতন মনে খুঁজে বেরিয়েছে একটা উত্তর যা ০২১ দিয়ে দিয়েছে–ল্যাসানদের কোন সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ নেই। সেজন্যই সে কিলমানজারোর স্বপ্ন দেখেছিল।
৩৯. বরফাবৃত
আমি দুঃখিত ইভলিন–অনেকদিন পর তোমার সাথে কথা বলছি। এটা কি এজন্য যে ভবিষ্যৎ আমার শক্তি এবং মনোযোগের অধিকাংশই বেশী বেশী করে গ্রাস করছে, আর সে সঙ্গে সঙ্গে তোমার স্মৃতি আমার মনে ধূসর হয়ে আসছে?
তাই হওয়া উচিত, এবং যুক্তিযুক্তভাবে এটাকেই আমার স্বাগত জানানো উচিত। অতীত খুব বেশী আঁকড়ে থাকাটাও একটা অসুস্থতা–যেটা তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে। কিন্তু আমি মনে প্রাণে এই তিক্ত সত্যকে গ্রহণ করতে চাই না।
গত কয়েক সপ্তাহে মহাকাশযানে অনেক কিছু ঘটেছে। মহাকাশযানে যা ঘটছে তার নাম দিয়েছি–অদৃশ্য যুদ্ধ। প্রথমে একটা কৌতুক হিসাবেই বলেছিলাম। কিন্তু ব্য: “টা এখন গুরুতর হয়ে গেছে। আশা করি খুব বেশি গুরুতর নয়।
কিছু কু থ্যালসায় থেকে যেতে চাইছে-তাতে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না। তারা চাইছে সাগান-২ এর চিন্তা বাদ দিয়ে পুরো অভিযানের এখানেই সমাপ্তি ঘটাতে। অবশ্য এদের সংখ্যাটা আমরা জানি না। কারণ এদের পরিচয় এখনো গোপন।
কাউন্সিলের আটচল্লিশ ঘন্টা পরে আমরা ভোট নিয়েছিলাম। যদিও ভোটদানটা গোপন। কিন্তু আমি জানি না কিভাবে ফলাফলটাকে বিশ্বাস করব-১৫১ জন যাত্রার পক্ষে, মাত্র ৬ জন যাত্রা শেষ করার পক্ষে এবং ৪ জন সিদ্ধান্তহীন।
ক্যাপ্টেন বে খুশী। তার ধারণা অবস্থা তার আয়ত্তে। তবে কিছু সতর্কতা নিতে হবে। সে বুঝতে পেরেছে যত বেশী দিন আমরা এখানে থাকব, থেকে যাবার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। ওই কয়েকজনের ব্যাপারে তার মাথাব্যথা নেই- “তারা যদি চলে যেতে চায় যাক। আমার তাদের ধরে রাখার কোন ইচ্ছাই নেই।” এভাবেই সে জিনিসটাকে দেখছে। কিন্তু অন্য ক্রুদের ভেতরে ব্যাপারটা সংক্রামিত হতে পারে এই নিয়ে সে চিন্তিত।
তাই বরফের বর্ম বানানোটা তরান্বিত করা হয়েছে। এখন ব্যাপারটা স্বয়ংক্রিয়, সুন্দরভাবে চলছে। আমরা ঠিক করেছি দিনে একবারের বদলে দু’বার বরফপাত ওঠাব। যদি ব্যাপারটা করা যায় আমরা চার মাসের মধ্যে রওয়ানা দিতে পারব। এটা এখনও ঘোষণা হয়নি। তবে মনে হয় না কেউ আপত্তি করবে, নব্য ল্যাসান অথবা অন্য কেউই।
আরেকটা ব্যাপার হলো, যেটার হয়ত কোন গুরুত্বই নেই কিন্তু আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। তোমার কি মনে আছে ইভলিন–আমাদের প্রথম দিকের পরিচয়ের সময়ে কিভাবে আমরা পরস্পরকে গল্প পড়ে শোনাতাম? হাজার বছর আগে যখন কোন ভিডিও বা সেনসরি সিস্টেম ছিল না, তখন মানুষ কিভাবে বাস করত তা জানার জন্য এটা বেশ ভালো উপায়।
সে সময় তুমি একবার আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলে –যদিও সজ্ঞানে তার কোন স্মৃতিই আমি মনে রাখিনি-আফ্রিকার এক বিশাল পর্বত সম্বন্ধে, নামটা অদ্ভুত, কিলমানজারো। আমি মহাকাশযানের আর্কাইভ খুঁজে দেখলাম কেন এই নামটা আমাকে খোঁচাচ্ছে।
এই পর্বতের বহু উঁচুতে, বরফ লাইনেরও ওপরে এক গর্তে একটা লেপার্ডের জমাট শরীর পাওয়া গিয়েছিল। সেটা ছিল একটা রহস্য। কেন কিভাবে ওটা তার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের এতো উপরে গিয়ে উঠেছিল কেউ বলতে পারেনি।
তুমি জান ইভলিন, যদিও অনেকেই ফালতু বলে কিন্তু আমি আমার ইনটুইশনের ব্যাপারে গর্ব অনুভব করি। আমার মনে হচ্ছে সেরকম এখানে কিছু একটা ঘটবে।
একবার নয়, বেশ কয়েকবার এক ধরণের বিশাল শক্তিশালী সামুদ্রিক প্রাণী তাদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের অনেক দূরে পাওয়া গিয়েছে। একটাকে সেদিন আমরা ধরেছি। এগুলো পৃথিবীর সমুদ্র কাঁকড়ার মতো।
এগুলোর বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত নই। আর হয়তোবা সেটা একটা অর্থহীন প্রশ্নও বটে। কিন্তু তারা অবশ্যই সুসংবদ্ধ সামাজিক প্রাণী, আদিম প্রাযুক্তিক জ্ঞানসম্পন্ন কথাটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেল। যদিও তাদের আবিষ্কারের পর তারা পিঁপড়ে যা উইপোকার চাইতে বেশী কোন ক্ষমতা দেখায়নি, কিন্তু তাদের কাজের মাত্রাটা অন্যরকম এবং বেশ আকর্ষণীয়। সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা ধাতু খুঁজে পেয়েছে। যদিও তা কেবল গয়না হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে এবং তারও পুরোটাই ল্যাসানদের কাছ থেকে চুরি করা।
কিছুদিন আগেই একটা কাঁকড়া বরফ কলের একদম মাঝখান পর্যন্ত হেঁটে চলে এসেছিল। সহজ ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে এটা খাবারের খোঁজে এসেছিল। কিন্তু যেখান থেকে এটা এসেছে, সেখানেই প্রচুর খাবার আছে এবং তা পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে।
আমার জানতে ইচ্ছে করে কাঁকড়াটা এতো দূরে কি করছিলো। মনে হয় এ প্রশ্নের উত্তরটা ল্যাসানদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যদি সাগান-২ এর যাত্রার দীর্ঘ শীতন্দ্রিার আগে উত্তরটা পেতাম।
৪০. মুখোমুখি
ক্যাপ্টেন বে প্রেসিডেন্ট ফারাদীনের অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সাধারণত এডগার ফারাদীন ক্যাপ্টেনকে তার প্রথম নাম ধরেই সম্বোধন করেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াইনের বোতল খোলন। কিন্তু এবার তিনি “সিরডার” বললেন না ওয়াইনও ঢাললেন না, তবে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন।
-আমি একটা অস্বস্তিকর খবর পেয়েছি ক্যাপ্টেন বে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, প্রধান মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বসবেন।
এই প্রথমবারের মতো ক্যাপ্টেন বে প্রেসিডেন্টকে কোন একটা বিষয়ে সরাসরি আসতে দেখলেন, এবং তার অফিসে প্রথম বারের মতো প্রধামন্ত্রীকেও।
-সেক্ষেত্রে, মি. প্রেসিডেন্ট আমি কি অ্যামবেসডর ক্যালডরকে আসতে আমন্ত্রণ জানাতে পারি?
প্রেসিডেন্ট সামান্য ইতস্ততঃ করলেন। তারপর বললেন “অবশ্যই”। ক্যাপ্টেন ফ্যাকাসে হাসিটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এটা হলো কূটনৈতিক সূক্ষ্মতা-তারা হয়তো পদমর্যাদায় বেশী কিন্তু সংখ্যায় বেশী নয়।
ক্যাপ্টেন ভালোমতোই জানেন প্রধানমন্ত্রী বার্গম্যানই হচ্ছেন ক্ষমতার পেছনের মূল কলকাঠি নাড়াবার লোক। প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছে পুরো মন্ত্রীসভা এবং তাদের পেছনে আছে জেফারসন মার্ক-২ এর সংবিধান। জিনিসটা কয়েক শতাব্দী ধরে কাজ করছে। ক্যাপ্টেন বে অবশ্য টের পাচ্ছেন যে, সেটা এখন একটা হুমকির সামনে পড়েছে।
ক্যালডর নিজেকে দ্রুত মিসেস ফারাদীনের কাছ থেকে মুক্ত করলেন, যিনি ক্যালডরকে প্রেসিডেন্ট ভবন ঢেলে সাজানোর কাজে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
প্রধানমন্ত্রী এলেন কয়েক মিনিট পরে তার স্বভাবসিদ্ধ দুর্বোধ্য ভঙ্গী নিয়ে।
সবাই বসলে প্রেসিডেন্ট টেবিলে হাত ছড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে অনুযোগের দৃষ্টিতে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
-ক্যাপ্টেন বে, ডক্যালডর-আমরা কিছু খুব অস্বস্তিকর সংবাদ পেয়েছি। আমরা শুনেছি যে আপনারা আপনাদের যাত্রা সাগান-২ এ শেষ না করে এখানেই শেষ করতে চাচ্ছেন? এটা কি সত্যি?
ক্যাপ্টেন বে বিশাল স্বস্তি পেলেন-তারপরই বিরক্তিতে তার মনটা ভরে গেল। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেশ বড় গলদ রয়েছে। কাউন্সিলের আবেদনটা এরা হয়তো জানেনা।
যদিও এমন আশা করা বোধহয় এখন ঠিক নয়।
-মি. প্রেসিডেন্ট, মি. প্রধানমন্ত্রী আপনারা যদি এমন কোন গুজব শুনে থাকেন–তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি এর মধ্যে কোন সত্যতা নেই। আমরা যে। প্রতিদিন ছয়শো টন বরফ ওপরে নিয়ে যাচ্ছি, সেটা সম্বন্ধে আপনাদের কি ধারণা? এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলে কি আমরা সেটা করতাম?
-হয়তোবা। যদি আপনারা কোন কারণে মন পরিবর্তন করেনই, বরফ ওঠানো বন্ধ করলে আমরা সতর্ক হয়ে যাব।
দ্রুত জবাবটা ক্যাপ্টেনকে মুহূর্তের জন্য থমকে দিল। এই সৌহার্দ্যপূর্ণ মানুষগুলোকে তিনি একটু কমই হিসেব করেছিলেন। তারপর তিনি বুঝতে পারলেন যে, এরা এবং এদের কম্পিউটার ইতিমধ্যেই সব সম্ভাব্য হিসাব করেছে।
-সেটা সত্যি। তবে আমি আপনাদের যেটা বলতে চাই যদিও এটা এখনও অঘোষিত এবং গোপনীয়-আমরা উত্তোলন দ্বিগুন করছি, বরফ বর্ম তাড়াতাড়ি তৈরী করার জন্য। এখানে থাকা তো দূরে থাক আমরা তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছি। আমার আশা ছিল যে তথ্যটা আপনাদের আরও আনন্দদায়ক পরিস্থিতিতে জানাব।
প্রেসিডেন্টতে তার বিস্ময় লুকাবার চেষ্টা করলেনই না, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও পুরোপুরি তা চেপে রাখতে পারলেন না এবং তারা হজম করার আগেই ক্যাপ্টেন বে। আবার আক্রমন করলেন,
-এবং মি. প্রেসিডেন্ট আপনার অভিযোগের স্বপক্ষে একটা প্রমাণ আমরা আশা করতে পারি। নাহলে আপনারা কিভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত করবেন?
-আমার মনে হয় সেটা সম্ভব নয়। সেটা আমাদের তথ্যের উৎসকে উন্মোচন করে ফেলবে।
-তাহলে তো ব্যাপারটা ঝুলে থাকল। আজ থেকে একশ তিরিশ দিন পরে, আমাদের নতুন হিসাব অনুযায়ী আমরা না যাওয়া পর্যন্ত আপনারা বিশ্বাস করবেন না।
একটু চিন্তিত এবং হতাশ নিস্তব্ধতা জমে থাকল। তারপর ক্যালডর বললেন,
–আমি কি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একটু একান্তে আলাপ করতে পারি?
–অবশ্যই।
তারা বাইরে থাকা অবস্থায়, প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,
–তারা কি সত্যি বলছে?
–ক্যালডর মিথ্যে বলবেন না- এটা নিশ্চিত। তবে সে হয়ত সবটা জানে না।
তারা অবশ্য আলাপ চালানোর জন্য সময় পেলেন না, কারণ বাকী দু’জন আলোচনার জন্য ঢুকে পড়েছে। ক্যাপ্টেন বে বললেন,
-মি. প্রেসিডেন্ট, ড. ক্যালডর এবং আমি মনে করি কিছু জিনিস আমাদের বলা উচিৎ। আমরা এটাকে থামিয়ে রাখার পক্ষপাতি-কারণ জিনিসটা লজ্জাজনক এবং আমরা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবতঃ আমরা ভুল ভেবেছি এবং সেক্ষেত্রে আপনাদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। তিনি তাদের কাউন্সিলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন এবং শেষ উপসংহার টানলেন এই বলে যে, আপনারা চাইলে আমি রেকর্ড দেখাতে পারি। আমাদের লুকানোর কিছু নেই।
-সেটার দরকার নেই, সিরডার প্রেসিডেন্ট বললেন। স্পষ্টতই তিনি বিরাট ভারমুক্ত।
তবে প্রধানমন্ত্রী এখনও চিন্তিত।
–একমিনিট প্রেসিডেন্ট। এটা কিন্তু আমরা যে রিপোর্ট পেয়েছি তা বাতিল করে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে সেটা বেশ ভালোভাবে তৈরী।
-আমি নিশ্চিত ক্যাপ্টেন সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন?
–যদি আপনারা বলেন, তাতে কি আছে।
আবার একটা বিরতি। প্রেসিডেন্ট ওয়াইনের দিকে এগুলেন, ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বললেন,
-প্রথমে পান করা যাক। তারপর আমি বলব, কিভাবে আমরা পেয়েছি।
৪১. রাতের আলাপ
এটা স্বচ্ছন্দে এগুচ্ছে–ফ্লেচার ভাবল। অবশ্যই ভোটের ব্যাপারটায় সে হতাশ, তবে সে অবাক হয়েছে এই ভেবে যে, এটা কত নিখুঁতভাবে মতামতকে তুলে ধরেছে। সে তার দু’জন ষড়যন্ত্রের সাথীকে বলেছিল তাদের স্বপক্ষের নোটগুলো হিসাব করতে-নব্য থ্যালসান আন্দোলনের শক্তি জানতে।
বরাবরের মতোই এরপর কি করব সেটা হচ্ছে সমস্যা। সে একজন প্রকৌশলী রাজনীতিবিদ নয় যদিও সেদিকেই সে যাচ্ছে। কারণ নিজেকে উন্মোচন না করলে আর নতুন সমর্থক পাওয়া যাবে না।
এখন দুটো উপায় আছে। প্রথমটি এবং সহজও বটে-মহাকাশযান থেকে পালিয়ে যাওয়া। যাত্রা শুরুর সময় রিপোর্ট এ ব্যর্থ হলেই হয়। ক্যাপ্টেন বে যথেষ্ঠই ব্যস্ত থাকবে। আর ল্যাসান বন্ধুরা তাকে লুকিয়ে রাখবে ম্যাগেলান না যাওয়া পর্যন্ত।
সেটা হবে দ্বৈত পলায়ন- অঘোষিত সুসংবদ্ধ স্যাব্রা সমাজ থেকেও।
তাকে তার ঘুমন্ত বন্ধুবান্ধব, এমনকি তার আপন ভাই এবং বোনকেও ফেলে পালাতে হবে। তিন শতাব্দী পরে কঠিন সাগান-২ এ বসে তারা কি ভাবে তার সম্পর্কে, যখন তারা শুনবে, তাদের সামনে স্বর্গের দরজা খুলে গিয়েছিল এক মুহূর্তের জন্য।
আর এখন সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। নতুন শিডিউলে বরফ তোলার গতি কম্পিউটারে একটাই অর্থ বহন করে। যদিও সে তার বন্ধুদের সঙ্গে এখনও কোন কথা বলেনি। কিন্তু আর একটি মাত্র উপায় হচ্ছে…
তার মনে যা আছে তার প্রকাশের শব্দটি হলো-অন্তর্ঘাত।
রোজ কিলিয়ান কখনো ডেলাইলার নাম শোনেনি এবং শুনলেও সে সম্ভবত আঁতকে উঠতো তার সঙ্গে তুলনায়। সে সরল এবং কিছুটা কাঁচাও, বহু ল্যাসানদের মতোই-যারা পৃথিবীর জৌলুসে ঘেরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহী। কার্ল বসেলির সঙ্গে তার ভালোবাসা শুধু তার জন্যই নয়, কার্লের জন্যও সেটা প্রথম প্রগাঢ় অনুভূতি। তাদের দু’জনেরই হৃদয় বিচ্ছেদের চিন্তায় ভেঙ্গে যায়। এক শেষ রাতে রোজ, কার্লের কাঁধে মাথা রেখে ফেঁপাচ্ছিল। কার্ল তার ব্যাথা সহ্য করতে পারছিল না। সে বলল-প্রতিজ্ঞা কর কাউকে বলবে না। আমি তোমার জন্য একটা খুব ভালো সংবাদ এনেছি। খুব গোপন কথা, কেউ জানে না। মহাকাশযান আর যাচ্ছে না। আমরা থ্যালসায় থাকছি।
রোজ বিস্ময়ে বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়।
–আমাকে খুশি করার জন্য বলছ নাতো।
-না এটা সত্যি। কিন্তু আর কাউকে বলো না। এটা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে।
-নিশ্চয়ই প্রিয়।
কিন্তু রোজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ম্যারিয়েনও কাঁদছিল তার পৃথিবীর প্রেমিকের জন্য সুতরাং তাকে তো বলতেই হয়..
…এবং ম্যারিয়েন সুখবরটা পৌঁছে দিল পলিনের কাছে… সে সিভেটনাকে না বলে থাকতেই পারে না… সে গোপন সংবাদটা ভাঙ্গল ক্রিস্টালের কাছে… এবং ক্রিস্টাল হচ্ছে প্রেসিডেন্টের কন্যা।
৪২. বেঁচে যাওয়া
এটা একটা অপ্রিয় কাজ, ক্যাপ্টেন বে ভাবলেন। ইয়েন ফ্লেচার একজন ভালো মানুষ–আমি নিজে তার নিয়োগ অনুমোদন করেছিলাম। সে কিভাবে এই কাজ করল? সম্ভবতঃ কোন একক ব্যাখ্যা নেই। সে যদি একজন স্যাব্রা না হতো, এবং যদি নীচের ওই মেয়েটির ভালোবাসায় না জড়াত তাহলে হয়তো এটা ঘটতো না। একের সঙ্গে এক যোগ করে দুই এর বেশী হওয়াটাকে যেন কি বলে? কিসের সাইন ওহহো সাইনেরজি। তবে এটা তার মনে হয়, অন্য কিছু একটা–যেটা তার কখনোই জানা হবে না। ক্যালডরের একটা মন্তব্য মনে পড়ল। সে প্রতিটি ব্যাপারেই কোন মন্তব্য রাখবে-ক্রুদের মানসিকতার আলোচনার সময় সে একবার বলেছিল,
-আমরা সবাই পঙ্গু ক্যাপ্টেন। স্বীকার করো আর নাই করা। পৃথিবীর শেষ কয়েকটা বছর আমরা যারা সেখানে কাটিয়েছি তাদের প্রত্যেকেই এর শিকার। এবং আমরা সবাই একটা অপরাধবোধে ভুগছি।
-অপরাধবোধ? ক্যাপ্টেন অবাক হয়ে বলে উঠলেন।
-হ্যাঁ, যদিও আমাদের দোষ নয় সেটা। আমরা বেঁচে গেছি–একমাত্র রক্ষা পেয়েছি। এবং বেঁচে যাওয়া লোকেরা, বেঁচে যাওয়ায় সব সময়ই অপরাধবোধে ভোগে। এটা একটা অস্বস্তিকর মন্তব্য তবে ইয়েন ফ্লেচার এবং অনেক কিছুই এটা ব্যাখ্যা করে।
আমরা সবাই পঙ্গু।
আমি জানি না মোজেস ক্যালডর তোমার আঘাতটা কি এবং কিভাবে তুমি সেটা সামলাও। আমি আমারটা জানি। এবং আমার সঙ্গের মানুষদের ভালোর জন্য সেটা ব্যবহার করি। যেটা আমাকে আজ এখানে এনে দিয়েছে। এবং আমি তার জন্য গর্বিত।
আগেকার যুগে হলে আমি একজন একনায়ক অথবা যুদ্ধবাজ নেতা হতাম। তার বদলে আমি হয়েছিলাম মহাদেশীয় পুলিশের প্রধান। তারপর মহাকাশযান নির্মাণের প্রধান সমন্বয়কারী এবং সব শেষে মহাকাশযানের প্রধান ক্যাপ্টেন। আমার ক্ষমতার লোভকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। ক্যাপ্টেনের সিন্দুক যার চাবি শুধু তার কাছেই থাকে, তিনি সেদিকে এগুলেন। একটা দরজা ঠেলতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। ভেতরে আছে কিছু কাগজ, কিছু মেডেল আর ট্রফি এবং একটা ছোট, কারুকাজবিহীন কাঠের বাক্স যাতে রুপোর অক্ষরে সি. বে, খোদাই করা। ক্যাপ্টেন বাক্সটা টেবিলে রাখলেন। কোলে পরিচিত স্পর্শে তার ভালো লাগছিল। বাক্সটা খুলে তার ভেলভেটের ওপর শুয়ে থাকা চকচকে ক্ষমতাবান যন্ত্রটার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। তার এই অস্বাভাবিক চিন্তা একসময় মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ছিল। সাধারণত এটা কোন ক্ষতি করেনা-আদিম সমাজে অনেক সময় এটা ছিল মূল্যবান। এবং বহুবার এটা ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করেছে–ভালো এবং মন্দ দুদিকেই।
-আমি জানি তুমি পুরুষত্বের চিহ্ন, ক্যাপ্টেন ফিসফিসিয়ে বললেন। তুমি একটা বন্দুক। আমি তোমাকে আগেও ব্যবহার করেছি। আমি তোমাকে আবারও ব্যবহার করতে পারি।
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ ছিল। কিন্তু তার মধ্যেই তা কয়েক বছর ঘুরে এসেছে। তিনি তার ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কয়েক মুহূর্তের জন্য সাইকোথেরাপিষ্টের সতর্ক কাজ মূল্যহীন হয়ে গিয়েছিল। পেছনের স্মৃতি হঠাৎ বেশীই ফিরে এসেছিল। তিনি আতংক এবং অদম্য আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন শেষের সে দশকগুলোর দিকে, যা মানুষের সবচেয়ে ভালো এবং খারাপ জিনিসগুলোকে বের করে নিয়ে এসেছিল। তার মনে পড়ল কায়রোতে তরুণ পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসেবে কিভাবে দাঙ্গাবাজ ভীড়ের উপর সে প্রথম গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছিল। বুলেট ছোরা হয়েছিল মূলত ছত্রভঙ্গ করার জন্য কিন্তু দু’জন মারা গিয়েছিল।
তারা কি নিয়ে দাঙ্গা করেছিল? সে জানতও না–শেষ দিকে বহু রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আন্দোলন চলছিল। এবং সেটা আরও ছিল বিশাল সব অপরাধীর যুগ। তাদের হারানোর কিছু ছিল না। এবং ভবিষ্যত বলতেও কিছু ছিল না। সুতরাং তারা যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল। অধিকাংশই ছিল সাইকোপ্যাথ। তবে কিছু ছিল প্রায় জিনিয়াস। জোসেফ কিবারের কথা তার মনে পড়ল, যে একটা মহাকাশযান চুরি করে ফেলেছিল প্রায়। কেউ জানেনা তার কি হয়েছে। এবং ক্যাপ্টেন বে মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে যে, এমন যদি হয় যে ঘুমন্ত কারও মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে।
৩৬০০ খ্রীষ্টাব্দের পর জন্মদান আইন করে বন্ধ করে দেওয়ায় জনসংখ্যা কমে আসছিল। কোয়ান্টাম ড্রাইভ এবং ম্যাগেলানের মতো মহাকাশযান তৈরীর প্রতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হতো। এ সবই এবং ঘনিয়ে আসা শেষ দিনের ছায়া সমাজে এমন এক চাপ ফেলেছিল যে বাস্তবিকই যে কেউ সৌরজগৎ ছাড়তে পারবে তা অবাস্তব বলেই মনে হতো। ক্যাপ্টেন বে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করলেন সেই সব মানুষদের কথা যারা তাদের শেষ বছরগুলো উৎসর্গ করেছিলেন এমন এক উদ্দেশ্যে যার সাফল্য বা ব্যর্থতা কোনটিই তাদের স্পর্শ করবে না। তিনি এখনও দেখতে পান প্রেসিডেন্ট এলিজাবেথ উইন্ডরকে। ক্লান্ত কিন্তু গর্বিত ভঙ্গীতে তিনি মহাকাশযান পরিদর্শন করে ফিরে যাচ্ছেন পৃথিবীতে, যে গ্রহের আয়ু আর মাত্র কয়েকদিন। আসলে তার সময় ছিল আরও কম। পোর্ট ক্যাভেরালে নামার আগেই তার মহাকাশ প্লেনটিতে লুকানো বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।
ক্যাপ্টেনের রক্ত এখনও শীতল হয়ে আসে ঘটনাটা স্মরণ করলে। বোমাটা ছিল ম্যাগেলানের উদ্দেশ্যে, সময়ের ভুলের জন্য মহাকাশযানটি রক্ষা পেয়েছিলো। তবে মজার ব্যাপার হল প্রতিটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এর কৃতিত্ব নিয়েছিল।
জোনাথান কল্ডওয়েল এবং তার অনুসারীরা আরও জোরেসোরে বলছিল যে, আসলে এগুলো কিছু নয়, ঈশ্বর পরীক্ষা করছেন মানুষকে, যেমন তিনি আগেও পরীক্ষা করেছেন। সূর্যের যাই হোক না কেন পৃথিবী তার পথেই স্বাভাবিক ভাবে ঘুরবে। এবং মানব জাতি রক্ষা পাবে যদি সকল অবিশ্বাসীরা তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে। এবং তখন হয়তো তিনি মত পরিবর্তন করবেন। আবার “ঈশ্বরের ইচ্ছা নামের গোষ্ঠীরা বিশ্বাস করত একদম উল্টো কথা। শেষ বিচারের দিন সমাগত এবং কোনভাবেই তা ফেরানো যাবেনা। বরং একে স্বাগত জানানো উচিত, কারণ যারা বিশ্বাসী, তারা এরপর ভোগ করবে অনন্ত সুখ। এবং তাই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে দুই গোষ্ঠীই সিদ্ধান্তে এল যে, মানব জাতির এই ভবিতব্য হতে রক্ষা পাবার চেষ্টা অনুচিত। সব মহাকাশযান ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
ভাগ্য ভালো যে, দুই গোষ্ঠীই পরস্পরকে এমনভাবে অপছন্দ করত যে শেষের এই লক্ষ্য পূরণের জন্যও তারা একত্রে কাজ করতে পারেনি। এবং প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্ট উইন্ডরের মৃত্যুর পর তাদের সন্ত্রাস নিজেদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল, অবশ্যই বিশ্বনিরাপত্তা দপ্তরের মাধ্যমে, যদিও তারা তা ক্যাপ্টেন বের কাছে স্বীকার করেনি, যে বোমাটি পেতেছিল ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা গোষ্ঠী এবং সময় পিছিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা ভন্ডুল করেছে কল্ডওয়েলের অনুসারীরা। বিপরীত একটা গুজবও অবশ্য বাজারে চালু ছিল।
এগুলো সবই এখন ইতিহাস। এখন কয়েকজনই মাত্র জানে এবং শিগগিরই সবাই সব ভুলে যাবে। এবং কি আশ্চর্য ম্যাগেলান আবার অন্তর্ঘাতের বিপদের সামনে।
ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় স্যাব্রারা অনেক যোগ্যতর এবং ধর্মীয় মৌলবাদে আচ্ছন্ন নয়। তারা সেজন্যই আরও বড় সমস্যা হতে পারে। তবে ক্যাপ্টেন বে বিশ্বাস করেন তিনি ব্যাপারটাকে সামলাতে পারবেন।
-তুমি একজন ভালো মানুষ ইয়েন ফ্লেচার-তিক্ততায় বললেন তিনি। তোমার চাইতে ভালো মানুষকে আমি হত্যা করেছি। এবং যখন কোন উপায় থাকে না, আমি অত্যাচারই করি। তবে তিনি এ ব্যপারে গর্ব বোধ করেন যে, তিনি এটা মোটেই উপভোগ করেন না। এবং এখন আরও অনেক ভালো পদ্ধতি আছে এজন্য।
৪৩. জিজ্ঞাসাবাদ
এখন ম্যাগেলান একজন নতুন ক্রু পেয়েছে। এক বছর আগে যেমন ক্যালডরকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল তেমনি ভাবেই তাকেও অসময়ে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। এবং তিনি এখন নতুন অবস্থায় খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। একমাত্র জরুরী কোন অবস্থায়ই এ ধরনের কাজ ঘটে। কম্পিউটারের রেকর্ডে ড. মার্কাস স্টেইন, প্রাক্তন তেরান গোয়েন্দা ব্যুরোর প্রধান বিজ্ঞানীর জ্ঞান এবং কর্মদক্ষতা এখন প্রয়োজন।
পৃথিবীতে তার বন্ধুরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করত কেন সে এতো কিছু থাকতে অপরাধতত্ত্বের প্রফেসর হল। এবং তারও একটাই উত্তর ছিল, এর একমাত্র বিকল্প ছিল একজন অপরাধী হওয়া। স্টেইনের এক সপ্তাহ লাগল ম্যাগেলানের হাসপাতালের সাধারণ মস্তিষ্কের গ্রাফ করার মেশিনটাকে পরিবর্তন করতে এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামকে পরীক্ষা করতে। ইতিমধ্যে চারজন স্যাব্রাকে তাদের রুমে আটকে রাখা হল এবং তারা দৃঢ়ভাবে কোন অপরাধ স্বীকার করল না। তার জন্য প্রস্তুতি দেখে ইয়েন ফ্লেচার খুব একটা ভালো বোধ করছিল না। বৈদ্যুতিক চেয়ার এবং অন্যান্য জিনিসগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর রক্তাক্ত যুগের যন্ত্রের খুব বেশি মিল। ড. স্টেইন তাকে সহজ করে নিলেন একজন ভালো জিজ্ঞাসাবাদকারীর কৃত্রিম অন্ত রঙ্গতা দিয়ে।
-ইয়েন ঘাবড়াবার কিছু নেই। বিশ্বাস কর তুমি কিছুই বুঝবে না। এমনকি তুমি বুঝতেও পারবেনা যে তুমি আমাকে উত্তর দিচ্ছ–এবং তুমি কিছু লুকাতে পারবে না। তুমি যেহেতু বুদ্ধিমান, সেহেতু আমি তোমাকে সবকিছু খুলে বলব। আমি কি করব তা ঠিকঠিক তোমাকে বলছি। এবং আশ্চর্য হলেও এ জিনিসটা আমার কাজে সাহায্য করবে। তুমি চাও না চাও–তোমার অবচেতন মন আমাকে বিশ্বাস করবে এবং সাহায্য করবে। কি গাধা-ফ্লেচার ভাবল। এতো সহজে আমাকে বোকা বানানোর কথা চিন্তা করল কিভাবে? কিন্তু কিছু সে বলল, কারণ সাহায্যকারীরা ততক্ষণে তাকে ঢিলে বাধন দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে আটকে দিয়েছে। সে বাধা দেয়ারও চেষ্টা করল না। কারণ তার দুই প্রাক্তন বিশালদেহী সহকর্মী সতর্কভাবেই চোখাচোখি এড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
-তোমার যদি তৃষ্ণা পায় বা বাথরুমে যাবার দরকার হয় বলবে। এবারের অধিবেশন হবে ঠিক এক ঘন্টার। পরে আরও ছোটভাবে কয়েকবার বসতে হতে পারে। আমি চাই তুমি আরাম করে বস।
এ পরিস্থিতিতে শেষ মন্তব্যটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও কেউই সেটাকে হাস্যকর হিসেবে নিল না।
-দুঃখিত যে তোমার মাথা কামাতে হল। কিন্তু মাথার ইলেকট্রোডগুলো চুল মোটেও পছন্দ করে না। আর তোমার চোখও ঢেকে দিতে হবে, না হলে চোখের সংবেদনশীলতা আমাদের হিসেবে গন্ডগোল করে দেবে… এখন তোমাকে একগাদা প্রশ্ন করা হবে যা হ্যাঁ, না এবং জানি না এই তিন উত্তরে সীমাবদ্ধ। তোমাকে মুখে বলতে হবে না, তোমার মস্তিষ্কই সেই উত্তর দিয়ে দেবে এবং কম্পিউটারের ট্রাইনারী যুক্তি তা বুঝে নেবে।
এবং কোনভাবেই তুমি মিথ্যা বলতে পারবে না। ইচ্ছে হলে চেষ্টা করে দেখতে পার! বিশ্বাস কর, পৃথিবীর সেরা কিছু মস্তিষ্ক এই যন্ত্র তৈরী করেছে, এবং একে কেউ বোকা বানাতে পারেনি। তোমার মাথায় হেয়ালী উত্তর এলে কম্পিউটার শুধু তার প্রশ্নগুলোর ছক পাল্টে দেবে। তৈরী? বেশ… জোরে… রেকর্ডিং… চ্যানেল ৫ চেক… শুরু।
তোমার নাম ইয়েন ফ্লেচার… উত্তর হ্যাঁ… অথবা না
তোমার নাম স্মিথ… উত্তর হ্যাঁ… অথবা না তুমি মঙ্গলের লোয়েল শহরে জন্মেছ, উত্তর হ্যাঁ… অথবা না
তোমার নাম জন স্মিথ… উত্তর হ্যাঁ… অথবা না
তুমি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে জন্মেছ… উত্তর হ্যাঁ… অথবা না
তুমি ৩৫৮৫ এর ৩রা মার্চ জন্মেছ….
তুমি ৩৫৮৪ এর ৩১ শে ডিসেম্বর জন্মেছ…
প্রশ্নগুলো এতো দ্রুত আসতে শুরু করল যে সামান্য আচ্ছন্ন অবস্থায় না থাকলেও ফ্লেচার এর মিথ্যে উত্তর দিতে পারত না। আর দিলেও লাভ হতো না, জানা উত্তরগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে কম্পিউটার তা শুধরে নিত। কিছুক্ষণ পর পর। আবার তাই উত্তরগুলো ঝালিয়ে নেয়া হচ্ছিল (তোমার নাম ইয়েন ফ্লেচার… তুমি কেপটাউনের জুলুল্যান্ডে জন্মেছ…) এবং নিশ্চিত হওয়া উত্তরগুলোর প্রশ্নগুলোও মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। পুরো ব্যাপারটিই স্বয়ংক্রিয়, শুধুমাত্র শারীরবিদ্যার হা-না ব্যাপারটা স্থির করতে যা একটু সময় লাগে।
প্রাগৈতিহাসিক মিথ্যা ধরার যন্ত্রগুলো এ ব্যাপারে বেশ সফল হলেও পুরো নিশ্চয়তা ছিল অসম্ভব। প্রায় দু’শ বছর লেগেছিল এই ব্যবস্থাটাকে সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন করতে। এবং তখন বিচার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। সিভিল এবং ক্রিমিনাল কোর্টে কোন বিচার ঘন্টাখানেকের বেশী চলত না।
বিংশ শতাব্দীর বিশ প্রশ্নের ধাঁধার মতোই ছিল এই প্রশ্নোত্তর পর্ব। মোদ্দা ব্যাপারটাই হলো যে, যে কোন তথ্যই কিছু হা-না প্রশ্নের ছকে ভেঙ্গে ফেলা যায়। এবং আশ্চর্য হলো একটা এক্সপার্ট মেশিন ও এক্সপার্ট মানুষ বিশটা প্রশ্নের কমেই সব বের করে ফেলতে পারে।
ঠিক একঘন্টা পরে যখন হতবুদ্ধি ইয়েন ফ্লেচারকে চেয়ার থেকে টেনে তোলা হল তার কোন ধারণাই ছিল না যে তাকে কি জিজ্ঞেস করা হয়েছে এবং সে কি উত্তর দিয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে কিছুই বলেনি। সে কিছুটা অবাকই হল যখন ড. স্টেইন ফুর্তির সঙ্গে বললেন, ঠিক আছে ইয়েন, তোমাকে আর লাগবে না। যদিও প্রফেসরের গর্ব ছিল যে তিনি কাউকে কখনো আঘাত করেন না, কিন্তু একজন ভালো জিজ্ঞাসাবাদকারীর ভেতরে কিছুটা স্যাডিস্ট মনোভাব থাকেই-সম্পূর্ণ মানসিকভাবে হলেও আর এটা তার মনোবল এবং সুনামও বাড়িয়ে দেয়, যা তার হয়ে অর্ধেক জয় করে। ইয়েন ফ্লেচার টাল সামলে তার ডিটেনশন রুমের দিকে রওয়ানা দেবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন।–ও আচ্ছা ইয়েন, ভালো কথা-বরফের ঐ বুদ্ধিটা কখনোই কাজ করত না।
আসলে সম্ভবত তা ভালোই কাজ করত। তবে সেটা এখন কোন ব্যাপার নয়। লেঃ ফ্লেচারের মুখের ভাবটাই তার বুদ্ধির খেলার পুরস্কার।
তিনি আবার ঘুমুতে যাবেন সাগান-২ এ পৌঁছানো না পর্যন্ত। কিন্তু এখন তার বিশ্রামের সময়।
আগামীকাল তিনি থ্যালসায় নামবেন। হয়তো এর চমৎকার কোন সৈকতে সাঁতার কাটবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি তার এক বিশ্বস্ত, পুরানো বন্ধুর সান্নিধ্য চান।
বায়ুশূন্য প্রকোষ্ঠ থেকে তিনি যে বইটি বার করলেন তা শুধুমাত্র প্রথম সংস্করণ না বরং এখনকার একমাত্র সংস্করণ। তিনি হালকাভাবে পাতা উল্টাতে লাগলেন। কেননা, এর প্রতিটা পাতাই তার মুখস্ত। তিনি পড়তে শুরু করলেন। পৃথিবীর ধ্বংসের পঞ্চাশ আলোকবর্ষ পরে বেকার স্ট্রীটে আবার কুয়াশা গড়াতে শুরু করল।
-মাত্র চারজন স্যাব্রাই এর সঙ্গে জড়িত, ক্যাপ্টেন বে বলতেন। ভাগ্য ভালো আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা লাগেনি।
-আমি বুঝি না তারা কিভাবে আশা করেছিল যে এটা করে তারা পার পেয়ে যাবে, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা বিরস স্বরে বললেন।
–আমারও বিশ্বাস তারা তা পারত না। তবে ভাগ্য ভালো যে এর পরীক্ষা দিতে হয়নি। আর, তারাও কিছুটা দোদুল্যমান ছিল।
-পরিকল্পনা ‘ক’ ছিল বর্মটাকে ক্ষতিগ্রস্থ করা। জানোই তো ফ্লেচার একজন উত্তোলনকারী ক্রু এবং ব্যাপারটাকে রি-প্রোগ্রামিং এর কাজেও সে যুক্ত ছিল। যদি একটা বরফের টুকরোও কয়েক মিটার বেগে আছড়ে পড়ে কি হবে চিন্তা করতে পার?
একে একটা দুর্ঘটনার মতো সাজানো যায়। কিন্তু পরবর্তী অনুসন্ধানে বেরিয়ে যেতে পারে যে সবকিছুই ঠিক ছিল। আর বর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তা মেরামত সম্ভব। ফ্লেচারের আশা ছিল এই দেরী করে তার পক্ষে আর লোক জড়ো করবে। সে। হয়তো ঠিক। থ্যালসায় আরেকটা বছর থাকলে… ‘খ’ ছিল মহাকাশযানে জীবন ব্যবস্থা ক্ষত্মিস্থ করা। এবং এটারও সমস্যা ‘ক’ এর মতোই। পরিকল্পনা ‘গ’ ছিল সবচে চিন্তার কারণ যা এই যাত্রাকে শেষ করে দিত। ভাগ্য ভালো কোন স্যাব্রা ইঞ্জিন বিভাগে নেই। তাদের কাছে ড্রাইভের কাছে যাওয়াটা বেশ কঠিন ব্যাপার হতো…
প্রত্যেকেই থমকে গেল–যদিও কমান্ডার রবালিনের চাইতে বেশী কেউ না।
-এটা খুব কঠিন নয় স্যার। বিশেষত যদি কেউ দৃঢ় সংকল্প হয়। বড় সমস্যা হল চিরস্থায়ীভাবে ড্রাইভের ক্ষতি করতে হলে মহাকাশযানের ক্ষতি করতে হবে। সে পরিমাণ কারিগরী জ্ঞান তাদের আছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।
-তারা এর ওপরে কাজ করছিল–ক্যাপ্টেন ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলেন। আমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে হবে। এখানে, দুপুরে সব সিনিয়র অফিসারদের মিটিং হবে।
এবং সার্জন কমান্ডার নিউটন সবার মনের প্রশ্নটা করে বসলেন,
-ক্যাপ্টেন তাদের কি কোর্ট মার্শাল হবে?
-তার দরকার হবে না। দোষ প্রমাণিত হয়েছে। মহাকাশযান নিয়ম অনুযায়ী এখন সমস্যা হচ্ছে শাস্তি নির্ধারণ।
প্রত্যেকেই অপেক্ষা করলেন, অপেক্ষা।
-সকলকে ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেনের সমাপ্তিতে তার অফিসাররা নীরবে স্থান ত্যাগ করলেন।
রুমে একা বসে ক্যাপ্টেনের নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। যাকগে, তাও তো ব্যাপারটা চুকে গেছে। ম্যাগেলান মানুষ ঝড়ের হত থেকে রক্ষা পেয়েছে। অন্য তিন স্যাব্রা ঝামেলা না হলেও-ইয়েন ফ্লেচারকে নিয়ে কি করা যায়? তার সেলফের মারাত্মক খেলনার কথা তার মনে এল। তিনি ক্যাপ্টেন, একটা দুর্ঘটনা সাজানো তেমন ব্যাপার না…। তিনি তার কল্পনা সরিয়ে রাখলেন। কোনভাবেই তিনি তা করতে পারেন না। তিনি অবশ্য মনস্থির করে ফেলেছেন, এবং তা সবারই সমর্থন পাবে।
একবার একজন বলেছিলেন যে সব সমস্যার একটি সহজ, আকর্ষণীয় কিন্তু ভুল সমাধান রয়েছে। আর তার সমাধানটি নিশ্চিত, সাধারণ, আকর্ষণীয় কিন্তু একদম ঠিক। স্যাব্রারা থ্যালসায় থাকতে চায়। তারা থাকতে পারবে। তার কোনই সন্দেহ নেই যে তারা হবে মূল্যবান নাগরিক। সম্ভবত ঠিক যেমন আক্রমনাত্মক, শক্তিশালী চরিত্র এই সমাজের প্রয়োজন।
কি আশ্চর্য যে ইতিহাস নিজেরই পুনরাবৃত্তি করছে। ম্যাগেলানের মতো সে তার কিছু মানুষদের ত্যাগ করে যাচ্ছেন। তবে তিনি কি তাদের শাস্তি দিচ্ছেন না পুরস্কৃত করছেন তা তিন’শ বছরের আগে জানা যাবে না।