৩১ অক্টোবর, রবিবার ১৯৭১
আজ ফখরুজ্জামান বিলেত রওনা হবে। প্লেন দুপুরের পরে। সকাল নয়টায় আঞ্জকে পরীবাগের শাহ সাহেবের কাছে নিয়ে গেছি ফখরুর জন্য দোয়া চাইতে। তারপর আবার সাড়ে দশটায় ও লালুকে নিয়ে গেছি গুলশানে, ফখরুর সঙ্গে দেখা করবার জন্য। আজুও যাচ্ছে ফখরুর সঙ্গে। ছেলেমেয়েরা দেশেই থাকবে ওর মার কাছে।
দুপুরে শরীফ বাসায় ফিরল মুখ কালো করে, শুনছো, খুব খারাপ খবর। খালেদ মমাশাররফ যুদ্ধে মারা গেছে।
আমার বুক ধড়াস করে উঠল, কি সর্বনাশ! কার কাছে শুনলে?
বাঁকার কাছে। বাঁকা খুব ভেঙে পড়েছে।
আমাদেরও ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। একি নিদারুণ সংবাদ! একি সর্বনাশ হলো! খালেদ মোশাররফ নেই, যুদ্ধে মারা গেছে?
রুমীদের গ্রেপ্তারের ধাক্কা একটু একটু করে কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করছি, ঢাকার বুকে গেরিলাদের বিভিন্ন অ্যাকশান মনের মধ্যে একটু একটু করে আশার সঞ্চার করছে–এর মধ্যে আবার একি বিনামেঘে বজ্রপাত!
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দোতলায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম খালেদেরই কথা।
এই খালেদ–ক্র্যাকডাউনের সময়ই তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে তার পাঞ্জাবি বস তাকে কুমিল্লা থেকে সিলেটে পাঠিয়েছিল, কিন্তু আয়ু ছিল খালেদের, দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধি খাটিয়ে সে নিশ্চিত মৃত্যুর ছোবল এড়ায় সে-যাত্রা। এড়িয়ে, সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়, পেছনে ঢাকায় পড়ে থাকে তার সুন্দরী তরুণী স্ত্রী, ফুলের মতো ফুটফুটে দুটি মেয়ে। সে জানতও না, ২৫ মার্চের কালরাত্রে পাক বর্বরবাহিনী তার শ্বশুরবাড়ি তছনছ করে দিয়েছিল; শ্বশুর, শাশুড়ি, বড় শালী, ভায়রাভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে জানত না, তার স্ত্রী ও কন্যারা পাক হানাদারের হাত এড়াতে একেকদিন একেজনের বাড়িতে লুকিয়ে থাকছিল। কিংবা সত্যি কি সে জানত না? সে নিশ্চয় জানত এরকমটাই ঘটবে তার পরিবার-পরিজনদের জীবনে। তা জেনেই সে তাদেরকে পেছনে ফেলে সামনের পথ ধরে চলে গিয়েছিল অনিশ্চয়ের দিকে। সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়ে সে পালিয়ে আসা বিদ্রোহী বাঙালি সামরিক বাহিনীর অফিসার জওয়ান আর যুদ্ধকামী শত শত যুবক-কিশোরদের জড়ো করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার দুরূহ কাজে মগ্ন হয়েছিল।
ঢাকা থেকে তার ফ্যামিলির খবর প্রথম সে পায় তার বন্ধুর ছোট ভাই শহীদুল্লাহ খান বাদলের মারফত। বাদল এবং তার তিন বন্ধু আসফাকুস সামাদ (অ্যাসফী), মাসুদ ও বদি ২৭ মার্চেই ঢাকা ছাড়ে, তাদের বিশ্বাস হয় পাক আর্মির এতবড় ক্র্যাকডাউনের পর নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। তারাও যোগ দিতে চায় সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে। তারা যুদ্ধের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তারা তখনও জানত না খালেদ মোশাররফ কোথায় আছে। কিন্তু পথে নানাজনের সঙ্গে দেখা হতে হতে এবং নানা ঘটনা ঘটতে ঘটতে শেষমেষ খালেদ মোশাররফের সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ ঘটে যায়।
খালেদ বাদলকে বলে এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এর জন্য দরকার রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলা বাহিনী। তুমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। যারা আসতে চায়, মুক্তিযুদ্ধ করতে চায়, তাদের এখানে পাঠাতে থাক।
খালেদ আরো বলে, যুদ্ধ হবে তিনফ্রন্টে-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক সামরিক ফ্রন্টের জন্য রয়েছে নিয়মিত সেনাবাহিনী, অন্য দুটি ফ্রন্টের জন্য প্রয়োজন সারাদেশের তরুণ সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, সাংবাদিক সকল স্তরের স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে হবে। এই দিকটা পুরোপুরি সংগঠনের ভার খালেদ মোশাররফ বাদলের ওপরই দেয়। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সিতে ফার্স্ট হওয়া অসাধারণ মেধাবী ছেলে বাদল নিজের সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ একপাশে ঠেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন কাজে।
খালেদ মোশাররফের পরামর্শ এবং প্রেরণাতেই বাদল বারেবারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা এসেছে। বন্ধু অ্যাসফী সামাদের সহায়তায় সংগঠিত করেছে ঢাকার তরুণদের–যারা যুদ্ধে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, অথচ পথ পাচ্ছেনা। তাদের কাছ থেকে পথের নির্দেশ নিয়ে একে একে ছোট ছোট দলে ওপারে গেছে কাজী, মায়া, ফতে, পুলু, গাজী, সিরাজ, আনু ও আরো অনেকে। গেছে শাহাদত চৌধুরী, আহরার আহমদ, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন সালেক, ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের কাদের, এ. আর. খোন্দকার, সুলতান মাহমুদ। গেছে পি.আই.এর পাইলট ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, ক্যাপ্টেন শাহাব এবং এরকম আরো বহুজন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি বাদল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী রুবী ও তার মাকে ঢাকা থেকে নিয়ে খালেদের কাছে পৌঁছে দেয় অনেক কষ্ট করে। যাবার সময় পথে ঘোড়াশালে ও ভৈরববাজারে পাক বিমানবাহিনীর বম্বিং ও স্ট্রেফিংয়ের মধ্যে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে, পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে করতে অবশেষে একদিন রুবী পৌঁছে যায় খালেদের কাছে। কিন্তু মেয়ে দুটি রয়ে যায় ঢাকাতে। রুবীর ভাই দীপুর বন্ধু মাহমুদের বাসায় ছিল মেয়েরা। পাক আর্মি দীপু ও মেয়ে দুটিকে ধরে ফেলে। তারপর সামরিক কর্তৃপক্ষ অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস মিসেস আনোয়ারা মনসুরের হেফাজতে রেখে দেয় খালেদ মোশাররফের মেয়ে দুটিকে।
মেজর খালেদ মোশাররফের স্ত্রীকে ঢাকা থেকে পার করে দেবার অপরাধে সামরিক সরকার হুলিয়া বের করে বাদলের নামে। তবুও এই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বাদল কিছুদিন পর আবার ঢাকা আসে। এবার তার কাজ খালেদের মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেয়া। খুব কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আনোয়ারা মনসুরের বাসা হলো এলিফ্যান্ট রোডের নাশেমন সরকারি ভবনে, তিনতলার ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে দুটি বাচ্চা হাইজ্যাক করে আনা বড় সহজ কাজ নয়। বাদলের এ কাজে তার সঙ্গী হলো বদি, কাজী, স্বপন ও চুন্নু। চুলু নিচে গাড়িতে বসে রইল স্টার্ট দিয়ে। বাকি চারজন অস্ত্রসহ তিনতলায় উঠে গেল। কিন্তু দুটি মেয়েকেই নিয়ে আসতে পারল না ওরা। আনোয়ারা মনসুরের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাড়ির অন্য কেউ একজনকে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে স্বপন পিস্তলের একটা ফাঁকা গুলি ছোড়ে দেয়ালে। তারপরই হুলস্থুল লেগে যায়। আনোয়ারা মনসুরের বড় বোন ছুটে আসলে একজন তার পায়ের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলি পায়ের চামড়া ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। আনোয়ারা মনসুরের মাথায় স্টেনের বাটের আঘাত লাগে। বড় মেয়ে বেবী বাদলকে চিনত, কিন্তু ছোটটি চিনত না। মিসেস মনসুর ছোট মেয়ে রুপনকে বুকে জাপটে ধরে বসেছিলেন। গুলির পর বাদলরা ওখানে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ মনে করে নি। বাদল বেবীকে তুলে নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে নিচে নেমে আসে। দেখে, গাড়ির কাছাকাছি লোক জমে যাচ্ছে। বদি প্রচণ্ড ধমকে কয়েকজনকে ঘাবড়ে দেয়। ওরা দ্রুত গাড়িতে উঠে উধাও হয়ে যায়। শহরে আর কোথাও দাঁড়ায় নি। গোপীবাগে গিয়ে এক জায়গায় চুলু ওদের নামিয়ে দেয়। বাদল আর কাজী বেবীকে নিয়ে মানিকনগর দিয়ে গিয়ে দাউদকান্দি হয়ে পথে অনেক বিপত্তি পেরিয়ে তারপর খালেদ মোশাররফের ক্যাম্পে পৌঁছায়।
এতসবের মধ্যেও খালেদ মোশাররফ মাথা ঠাণ্ডা রেখে মুক্তিযুদ্ধের কাজ চালিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে দুই নম্বর সেক্টর, মেলাঘর তার হেডকোয়ার্টার্স। নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বিরাট গেরিলা বাহিনী। দেশের অন্য সব জায়গা থেকে তো বটেই, বিশেষ করে ঢাকার যত শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান, টগবগে, বেপরোয়া ছেলে, এসে জড়ো হয়েছে এই সেক্টর টুতে। খালেদ মোশাররফ কেবল তাদের সেক্টর কম্যান্ডারই নয়, খালেদ মোশাররফ তাদের হিরো। যতগুলো ছেলে সেক্টরে রাখার অনুমতি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছেলেকে আশ্রয় দিত খালেদ। নির্দিষ্টসংখ্যক ছেলের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ রেশন দুইগুণ বেশি ছেলেরা ভাগ করে খেত। খালেদ বলত, ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য আমার প্রচুর ছেলে দরকার। অথচ আওয়ামী লীগের ক্লিয়ারেন্স, ইউথ ক্যাম্পের সার্টিফিকেট বা ভারত সরকারের অনুমোদন পেরিয়ে যে কয়টা ছেলে আমাকে দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়।তাই খালেদ বাদলকে বলত, যত পার, সরাসরি ছেলে রিক্রুট করে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় যুদ্ধ। দলমত নির্বিশেষে যারাই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসবে, তাদের সবাইকে আমি সমানভাবে গ্রহণ করব।
বাদলরা তাই করত। ফলে, খাতায় যত ছেলের নাম থাকত, তার চেয়ে অনেক বেশি ছেলেকে খালেদ ক্যাম্পে রেখে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে ঢাকা পাঠাবার জন্য তৈরি করত। তিনশো ছেলের রেশন ছয়শো ছেলে ভাগ করে খেত। হাত খরচের টাকাও এভাবে ভাগ হয়ে একেকটি ছেলে পেত মাসে এগারো ইন্ডিয়ান রুপি।
বহু ছেলে যুদ্ধ করার উন্মাদনায় আগরতলা এসেও কোথাও ট্রেনিং নিতে পারছিল, বসে বসে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। খালেদ মোশাররফ এভাবে ভারত সরকারের নাকের ডগায় লুকিয়ে বেশি বেশি স্বাধীনতাকামী যুদ্ধকামী ছেলেদেরকে তার পক্ষপুটে আশ্রয় দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করার পলিসি না নিলে ঢাকার গেরিলা তৎপরতা এত সাফল্য আসত কি না, এরকম অব্যাহত গতি বজায় থাকত কি না, সন্দেহ। ২৯-৩০ আগস্টে এত বেশিসংখ্যক গেরিলা ধরা পড়ার পরও মাত্র দেড় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। প্রচুর, অজস্র, অসংখ্য গেরিলা ঢাকায় বিভিন্ন দিক দিয়ে শহরে ঢুকছে, অ্যাকশান করছে, পাক আর্মিকে নাস্তানাবুদ করছে, সামরিক সরকারের ভিত্তি নড়িয়ে দিচ্ছে, অবরুদ্ধ দেশবাসীর মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছে–এটাও সম্ভব হচ্ছে খালেদেরই দূরদর্শিতার জন্য। আসলে খালেদ স্বপ্নদ্রষ্টা। খালেদ শক্তিমান, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। বাংলাদেশের জন্য যা ভালো মনে করেছে, তাই কাজে পরিণত করতে দ্বিধাবোধ করে নি। এক্ষেত্রে সে আওয়ামী লীগের বা ভারত সরকারের নির্দেশ বিধিনিষেধের ধার ধারে নি। তার এই সাহস, দুঃসাহস, আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যতের দিকে নির্ভুল নির্ভীক দৃষ্টিপাত করার ক্ষমতা তাকে সেক্টর টুর গেরিলা ছেলেদের কাছে করে তুলেছে অসম্ভব জনপ্রিয়। প্রায় দেবতার মত। খালেদের যে কোন হুকুম চোখ বন্ধ করে তামিল করার জন্য প্রতিটি গেরিলা ছেলে একপায়ে খাড়া। খালেদ মোশাররফ সেক্টর টুর প্রাণ।
সেই খালেদ মোশাররফ যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছে। নিঃসন্দেহে তার জন্য গৌরবের মৃত্যু, শহীদের সম্মান পেয়েছে সে। কিন্তু সেক্টর টুর জন্য? মেলাঘরের উদ্দাম, দুঃসাহসী গেরিলা বাহিনীর জন্য? ঢাকায় অবরুদ্ধ আমাদের জন্য? আমাদের জন্য এরচেয়ে বড় সর্বনাশ আর কি হতে পারে?
খালেদের মৃত্যুসংবাদে মনের মধ্যে রুমীর শোক দ্বিগুণ উথলে উঠল। মেলাঘর থেকে ফেরার পরে রুমী কতো যে খালেদের গল্প বলত। খালেদই তো ছেলেদের বলত কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না। চায় রক্তস্নাত শহীদ। তাই কি খালেদ আজ শহীদ? লক্ষ লক্ষ ছেলেকে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়ে খালেদ কোথায় চলে গেল?
দূরে একটা গ্রেনেড ফাটল। কোন এক রুমী, এক বদি, এক জুয়েল, এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল অপরাহ্নে মৃত্যু-ভয় তুচ্ছ করে কোথাও আঘাত হানল। স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খালেদ মোশাররফের হাতে গড়া গেরিলারা। ওই ছেলেরা কি জানে, ওদের নেতা আর নেই?
খালেদ নেই, রুমী নেই, বদি নেই, জুয়েল নেই কিন্তু যুদ্ধ আছে–স্বাধীনতার যুদ্ধ।