৩০. হরষে বিষাদ

৩০. হরষে বিষাদ

মাথার কাছেই চন্দ্রিমা আলোক বিকিরণ করছে। অরণ্যের কীটপতঙ্গও যেন তাঁর সঙ্গসুখ উপভোগ করছে। তবুও কেন জানি দ্বারকায় প্রত্যাবর্তনের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। ঠিক তখনই হতাশা গ্রাস করল কৃষ্ণকে। দ্বারকা জলশূন্য। এক মহাব্যাধির প্রকোপে যেন ধ্বংস হয়েছে নগরী। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অন্তরিক্ষ। অতি দুর্গম গিরিশিখরের প্রান্তভাগ দিয়ে সূর্যদেবকে দেখা যাচ্ছে। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এই জন্মের স্মৃতি। আবার। প্রত্যাবর্তন হবে কি? মন খারাপ করছে ভারতবর্ষের জন্য। কৰ্ষণযোগ্য ভূমি কুরুক্ষেত্রের দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে উর্বরতা হারিয়েছে।

স্বর্গলোকের দেবতারা, কিন্নরীরা হয়তো তাঁকে সম্ভাষণ করবে। তখনও কি তাঁর মুক্তি ঘটবে? বার বার মনে পড়বে রাধার কথা। মিত্রবনে, বেণুবনে ওর সঙ্গে মিলনের কথা। যমুনার জলে জলকেলির কথা। হতলের বিলাসকক্ষে সেই জীবন নেই। সেই জীবন শুধু গাঙ্গেয় সমতলভূমিতেই সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কালের অধীশ্বরের চোখে জল এল। তিনি রাজা থাকাকালীন ব্রাহ্মণদের ভূমি ও গাভী দান করেছেন। আবার হত্যাও করেছেন প্রচুর স্বীয় প্রতিষ্ঠার কারণে। কত শত পরিবারের শোকাকুলা নারীরা তাঁকে অভিসম্পাত করেছে, গান্ধারী তো বটেই। তবুও এসবে তিনি ভীত নন। গান্ধারীর অভিশাপ শ্রবণেও তাঁর অশ্রু আসেনি। তবে এই মুহূর্তে রাধার আকুল-করা স্মৃতি রোমন্থনে কৃষ্ণ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠলেন। তিনি যেন স্বর্গলোকে গিয়েও বিস্মৃত হতে চান না এই প্রেমকে। তিনি শিহরিত অগ্নিদেবকে আগাম বলে রাখলেন এই নশ্বর দেহের লয় ক্ষয় হলেও রাধারমণের প্রেমের যেন মৃত্যু না ঘটে। সেই প্রেম যেন। অগ্নিতে দগ্ধ না হয়। বায়ু যেন তাকে কখনো ত্যাগ না করে। চিরবসন্ত স্থির অপেক্ষমাণ থাকে এই প্রেমলীলার কাছে। তাঁর এই গোপন প্রেম ভারতবর্ষের যুগান্তরের লীলাক্ষেত্রে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

তখনই কোথাও যেন প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। পাথরের পূজ্যতায় প্রেম লুপ্ত হতে চাইছে না যেন। এইসময় কৃষ্ণ অরণ্যের বৃক্ষশাখার ফাঁক দিয়ে আদিত্যদেবকে প্রকাশিত হতে দেখলেন। তখনই শুরু হল এক অপরিচিত শঙ্কার অর্কজ্যোতির মতো বস্তুবাদীরা যদি এই প্রেমকথার অভ্যন্তরে কৃষ্ণের নিষ্ঠুরতা অনুসন্ধিৎসার যোগ্য প্রয়োগের সন্ধান পেয়ে ব্যাপ্ত করে দিশা থেকে নতুন দিশায়! তখনই তিনি আবার নিশ্চিন্ত হলেন– কথাকার ব্যাসদেব রয়েছেন। তিনি কতখানি মহিমান্বিত করেছেন কৃষ্ণকে, তার তুলনায় অর্কজ্যোতির নাস্তিক্যবাদ তুচ্ছ। আর ইতিহাস সত্য কথার গল্প লিপিকৃত করে না। সে শুধু তর্জনী উঁচিয়ে গণেশদেবকে বলে, যা বুঝবে না, তা লিখবে না। তবু ক্লিষ্ট হল মন আত্মগত ক্ষয়ে।

.

৩১. অর্কজ্যোতি

কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অর্কজ্যোতি। সমগ্র ভারতবর্ষেই যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কর্মপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক বার নয়, দ্বিতীয় বারও প্রাবক্তিকপুরুষ কৃষ্ণ এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সেই পুরুষ, যিনি ঘোষণা করেছেন প্রকাশ প্রবৃত্তি মোহ আবির্ভূত হলেও তিনি দ্বেষ করেন না। বন্দিরা তাঁর দর্শনে ধন্য হয়েছিল। নাস্তিক্যবাদ প্রবলভাবে ঘৃণা করেন তিনি। অথচ ভূমি পিচ্ছিল রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর প্ররোচিত হত্যালীলায়। ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করছেন। রাজবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মহাকাব্যের বন্দনাগানও অচিরেই শোনা যাবে। হয়তো কাল অতিক্রম করে টিকে থাকবেন ব্যাসদেব ও মহাভারত। ভারতের অমৃত-আত্মা, সুপ্রাচীন জাতীয় জীবনের সত্তার চিরনতুন ব্রহ্মপ্রকাশ হিসেবে অক্ষয় থাকবে মহাভারত। মনের গহনে অর্কজ্যোতিও ভালো-মন্দের বিচারে ক্লান্তিহীন। বিচিত্র অধ্যবসায় তাঁর রয়েছে। তিনিও অনুসন্ধিৎসায় ক্লান্তিহীন। ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, সৌন্দর্য, আনন্দবোধ, উপাখ্যান, উপকথা, আধ্যাত্মিক অভীপ্সা, জ্যোৎস্না, সূর্যকিরণ– সবটাই আলোড়িত করে ওঁকে। আবার ওঁর মধেও রয়েছে তমিস্রা, দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক। জীবনের মানুষিক উত্তরাধিকার নাস্তিকেরও থাকে। তবে সেক্ষেত্রে সে যেন সমাজবহির্ভূত।

অর্কজ্যোতিও একসময় অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা ছিলেন। যুবাকালে তিনিও ছিলেন পরম রমণীয়পুরুষ। মহিলারা একসময় ভালোবাসতেন যুবক অর্কজ্যোতিকে। ক্ষণকালীন বাসরশয্যা তাঁর জীবনেও এসেছিল।

এতটা স্মৃতিমেদুরতা অর্কজ্যোতির স্বভাবগত নয়। তিনি চিন্তকপুরুষ, তবে তা রাষ্ট্র সমাজ ও জীবনপ্রবাহ কেন্দ্রিক। এই বৃদ্ধ বয়সে নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো কিছু নেই। তাঁর অসংলগ্ন যাবতীয় চিন্তন তিনিও লিখে চলেছেন। এক্ষেত্রে লিখনের স্থল কর্মটি করছে রূপজ্যোতি। অসংখ্য প্রশ্ন তার। বর্তমান রাষ্ট্রনীতি নিয়ে অসম্ভব বিক্ষোভ রয়েছে ওর মধ্যে। রাজতন্ত্রের সমান্তরাল অথচ ক্ষমতায়ন এই ধারাটি নব্য যুবকদের দিয়ে যেতে চান অর্কজ্যোতি। রূপজ্যোতি আরও কিছু যুবককে এই নব্য পথের অনুগামী হওয়ার কারণে উতসাহিত করেছে। রাষ্ট্রের কাঠামোর পরিবর্তনে এটাই উপযুক্ত সময়। পুরুষেরা যৌবন হারিয়েছে কিন্তু কিশোরেরা তো রয়েছে। একদিন ওরাও অচিরেই গন্ধর্বপ্রতিম যৌবনে উপনীত হবে। নিপীড়ন সহ্য করার মানসিক গঠনও চাই। এদের জীবনও নারীকেন্দ্রিক চলে চলবে না। বারাঙ্গনা গৃহগুলি সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ রাখতে হবে।

রূপজ্যোতি আবার অসম্ভব মাতৃমুখী। তার মাতা অপালার এখন উন্মাদিনী দশা। কারণ সেই কৃষ্ণ। এক সাধুর কাছ থেকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে মাতা। আগে মাতৃগন্ধের সঙ্গে চন্দনগন্ধও থাকত। সেই সুবাস এখন হাওয়ায় অনুপস্থিত। পিতাও অত্যন্ত ক্ষিপ্ত। দাম্পত্যজীবনে অশান্তির অমানিশা। তার প্রক্ষেপ রূপজ্যোতির মধ্যেও এসে পড়েছে। সে বিভ্রান্ত। অর্কজ্যোতি কয়েক বারই গেছেন অপালার কাছে। কৃষ্ণপ্রেমে তার এখন পাগলপারা অবস্থা। ওষ্ঠাধার রসসিক্ত না থাকায় বিশাখজ্যোতিরও নাকি ঘৃণা করে অপালাকে আশ্লেষ চুম্বনে ভরিয়ে দিতে। আসলে শুদ্ধ দাম্পত্যজীবনে সন্দেহের কীট অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এখন শৃঙ্গার ধর্ষণেরই অনুরূপ কিছু। ঈর্ষা নামক বস্তুটি ভয়ংকর। দুর্মদ শত্রু নিধনকারী আবার সফল প্রেমিক কৃষ্ণকে অর্কজ্যোতি ঈর্ষা করে না তো! রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়তো প্রকারান্তরে কৃষ্ণদ্রোহিতা। শঙ্খচক্রপাণি, গদাধারী, নিখিল বেদ-বেদাঙ্গ পারদর্শী, এই কালের জ্যোতিষ্ক অনুপম পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে তিনি ঈর্ষা করেন না তো! তবে অর্কজ্যোতি সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়েছেন অপালার কৃষ্ণপ্রেমের পরিবর্তন ঘটাতে। সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবক রূপজ্যোতির কী কোনো সংশয় এসেছে।

.

৩২. জরার কাছে অশ্বত্থাম পূর্বকথা বর্ণন

‘এই ভারতবর্ষ মাত্র কয়েক বছর আগে একটি প্রকাণ্ড যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে–তার লোকমুখে শ্রুত নাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আমি অশ্বত্থামা কৌরবপক্ষের অন্তিম সেনাপতি। রাজচক্রবর্তী দুর্যোধন মৃত্যুর সায়াহ্নে আমাকে সেই পদে অভিষিক্ত করেছেন। কিন্তু কৌরব নয়, পান্ডবও নয়– কে এই কৃষ্ণ? সদম্ভে তিনি পান্ডবদের যুদ্ধশেষে বলেছেন, আমি লোকক্ষয়কারী বৃদ্ধ কাল। আমিই তোমাদের মঙ্গলের জন্য ছলে-বলে কৌশলে কিংবা মায়াবলে কৌরবদের বধ করেছি। ভারতবর্ষীয় ভক্তিবাদ তাঁর মুখ থেকে অনবরত নিঃসৃত হচ্ছে। অথচ যদুবংশ ধ্বংস করতেও তিনি এতটুকু দ্বিধা করেননি। ফলে যিনি আত্মবংশ ধ্বংসকারী, অন্যদের হত্যা তো তাঁর স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তি। কারা এই যদু? ভারতবর্ষের বিন্ধ্যাচলের উত্তরভাগই আসলে মর্ত বা পৃথিবী। আমরা সকলেই পৃথু। রাজার বংশধর। এই পৃথ্বীতে ভগীরথ আনয়ন করেছিলেন গঙ্গাকে। আর ভীষ্ম ছিলেন গঙ্গার পুত্র। তিনিই হস্তিনাপুরের রাজসূয় যজ্ঞে প্রথম সংবর্ধিত করেন যদুপতি কৃষ্ণকে। যযাতির জ্যেষ্ঠ পুত্র যদু। যদ্দুর বংশধরেরা কালে কালে বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ। যদুবংশের রাজসিংহাসনে আরোহণ করেননি কৃষ্ণ। তবে এককালে বৃষ্ণিদের সংহত করেন। সেই বৃষ্ণিসিংহই কৃষ্ণ। তোমাদের নিষাদদের এক অধিপতি একলব্য পৌন্ড্রক বাসুদেবের সঙ্গে মিলিত হয়ে কৃষ্ণকে আক্রমণ করেন কিন্তু পরাভূত হন। একলব্য পলায়ন করেন কিন্তু পৌন্ড্রক বাসুদেব নিহত হন কৃষ্ণের হাতে। সেই নিষাদপতি একলব্যের রক্ত তোমার শোণিতে, জরা। তুমি জাগ্রত হও, নিজেকে আবিষ্কার করো।’

দীর্ঘ এই কথনের পর অশ্বত্থামা থামলেন। ঔষধে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ‘জরা’ ব্যাধ জাগ্রত হয়েছে। তার পরিচয় সে পেয়েছে। এবার সে কৃষ্ণনিধনে প্রস্তুত।

.

৩৩. কৃষ্ণ

এই অরণ্যে কৃষ্ণের কোথাও যাওয়ার ত্বরা নেই। মনের গহনে বাঁশি বাজে, সুরের ডাক অনেক দিবস পরে তাঁর কাছে এসে ধরা দিচ্ছে। অদূরের পর্বতমালা ছাড়িয়ে সেই সুর দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে। কলির সন্ধাকালে তিনি এসেছিলেন। যুগক্ষয়ের লক্ষণগুলি স্পষ্ট। রাজতন্ত্র ক্ষয়প্রাপ্ত। সাধারণ জনগণের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। প্রলয়ংকর হয়তো কিছু ঘটবে। তিনি আর এসব নিয়ে ভাবতে চান না। বরং যুগের সংক্রান্তি তিনি ধরে রাখতে চান তাঁর বাঁশরির সুরে। শাম্বের কথা আচম্বিতে মনে পড়ল। ঘৃণ্য ব্যাধি থেকে তার কি মুক্তি ঘটল? চন্দ্রভাগার তীরে এই রোগের এক বৈদ্য বাস করেন, তাঁর ঠিকানা কি শাম্ব পেয়েছে? জাম্ববতীর তনয় শাম্ব, যদিও প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল সত্যভামা। তাদের সঙ্গে সহবাসের স্মৃতিও কি বাঁশিতে থাকবে না!

আর মনে পড়ছে সেই নদীর কথা। যমুনা। কৃষ্ণজল তার। সেই নদীর তীরবর্তী একটি ছায়াঘন মায়াকুঞ্জের কথাও মনে পড়ছে। গোপিনীদের শরীরে কামনার বহ্নি। কৃষ্ণের চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণে তারা নিজেদের স্বজনদের ভুলে গিয়ে তাঁর কাছেই থাকে। গোপরমণীরা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্রে অনেক স্বাধীনচেতা। পীনবক্ষ, ক্ষীণকটি, গুরুনিতম্বের রমণীদের উপভোগকাল কখনো বিস্মৃত হওয়া যায় না। কৃষ্ণের গলায়ও তখন থাকত কবচযুক্ত মুক্তহার, কানে কুন্ডল আর বাঁশরিতে চাতুর্যপূর্ণ আহ্বান। রমণীরা মক্ষিকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত অফুরান মধুভান্ডের অধিকারী কৃষ্ণের বক্ষে। অতি প্রার্থিনীদের অনেক সময় কোনো অবগুণ্ঠন ছাড়াই তৃপ্ত করেছেন কৃষ্ণ। চুম্বন সহযোগে ভরিয়ে রাখতেন ওদের অধর।

তারপরেই ডাক এল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের, মুহূর্তে ভেসে গেল বাঁশরি বাদন ও রমণ সম্ভোগের কাল।

সময়ের জননে সব কিছু লুপ্ত হলেও স্মৃতি তো থেকেই যায়। বাঁশরি তুলে নিলেন কৃষ্ণ। প্রাণের লক্ষ লক্ষ প্রশ্বাস ভরে দিলেন ওতে। পৃথিবীর ডানায় যেন কাঁপন লেগে গেল। গুনগুনিয়ে উঠল সময়। বসন্তবাহার দেখা দিল অরণ্যে। কোকিলের কৃজন সেই বাঁশির প্রাণভরা আবেদনে সাড়া। দিল। বৃদ্ধাবাসে থাকা রাধা, প্রৌঢ়া গোপিনীরাও বোধ হয় শুনল সেই ডাক। রাধা আর সখীরা যেন আবার ফিরে পেল কৃষ্ণকে। কৃষ্ণও বললেন, ‘অবশেষে এলেম তোমাদের কাছে।’

সারা রাত ধরে অরণ্যে শিশির জমেছে। তারপর ভোরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে মোহময় স্বপ্নের বিস্তার হয়ে। কুয়াশার প্লাবনে রাতে ডুবেছিল যে গাছপালা স্তব্ধতায়, আবার ভোরের আলোয় তারা অন্যভাবে প্রকাশিত। কত বার তিনি বলেছেন, এই জড়জগৎ, জীবজগৎ তাঁরই সৃষ্টি। সন্দেহ হয়, এত বড়ো চিত্রকর কি তিনি! চলভাষ যন্ত্রটা রাধার হাতে তুলে দেওয়ার পর কেমন সন্দেহ ছিল ওর। সত্যি ওতে কথা বলা যায়! সঞ্জয় যেমন দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত হয়ে মহাভারতের যুদ্ধের ধারাভাষ্য দিচ্ছে, ঠিক তেমনিই বহুকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর আগামী কোনো দশকে মানুষ চলভাষে কথা বলবে। সেই সহস্র সহস্র বছর পরের বিজ্ঞান তিনি তাঁর একান্ত প্রেমিকাকে দিয়েছেন আর নিজের কাছে রেখেছেন। গোপন অবশ্য থাকেনি। এর কারিগরি নিয়ে কৃষ্ণকে কেউ প্রশ্ন করতে স্পর্ধা না করলেও ঈর্ষা থেকে গেছে সত্যভামা, জাম্ববতী, রুক্মিণীর এমনকী পাঞ্চালীরও। উপপত্নীদের তিনি আইপড দিলেও রাধার চলভাষের সাধারণ অথচ অপূর্ণ কৃৎকৌশল যুগেরও অগম্য। আসলে এ তো ঠিক চলভাষ নয়, কৃষ্ণের হৃদয়ের নির্যাস। একমাত্র রাধা আজও পারে সেই নির্যাসের কম্পনাঙ্ক। অনুভব করতে। তার বার্তা এসেছিল। তিনি প্রত্যুত্তর প্রেরণ করেননি। প্রবল বর্ষার জাদু বাস্তবের মেঘ যখন মাথার উপর ভিড় করবে তখন এই কালের রীতি মেনে তিনি ওদের দিয়ে উত্তর পাঠাবেন। এই জীবন। অনিকেত, অস্থায়ী। অস্তিত্বও পরিযায়ী। শুধু প্রেমের অভিজ্ঞতা শাশ্বত, রমণের লিপ্সা অনির্বাণ। এবার বাঁশিতে শৃঙ্গার রস ধরলেন কৃষ্ণ। চমকিত হয়ে দেখলেন হরিণীরা ঝাঁক বেঁধে তাঁর কাছে ছুটে এসেছে। ওরা স্পন্দিত হয়েছে। পাখিরাও জেগে উঠেছে। হিংস্র শ্বাপদ, মাংসাশী জন্তুরা একটু বিলম্বে সাড়া দিলেও ওরা চিনেছে রাধারমণকে। আবার রাধারমণের অভ্যন্তরের যৌনশক্তি জেগে উঠেছে। তিনি এমনকী পশুকুলকেও পারেন তৃপ্ত করতে। উদ্বুদ্ধ এই সৃজনশীলতা তাঁর মধ্যে এখনও রয়েছে বলে কৃষ্ণ গভীর তৃপ্তি পেলেন।

.

৩৪. বিশাখজ্যোতি

কুয়াশা-আবৃত সকাল। শেষ রাত্রে বৃষ্টি হয়েছে। পাথুরে পথও ভিজে উঠেছে। নগরে বাজার এখনও বসেনি। নগরদ্বারিকেরা গৃহে প্রত্যাবর্তন করছে রাত্রিকালীন প্রহরা সেরে। কয়েক জন সুরাসক্ত ব্যক্তি মুহুর্তিকাদের গৃহে রাত্রিযাপন করে ফিরে আসছে। ওদের চোখ আরক্ত। পানশালাগুলির ঝাঁপ সবে মাত্র নামানো হয়েছে। দূতক্রীড়ায় সর্বস্ব হারিয়ে কেউ কেউ পানশালাগুলির বন্ধ দরজায় আঘাত করছে। এইসময় নগরজুড়ে এক শৈথিল্যের চিত্র দেখা যায়। এই অতি প্রভাতেই অশ্বারোহণে খানিকটা দিগ্ভ্রান্ত হয়েই পথে নেমেছেন বিশাখজ্যোতি। মাথায় যদিও অভ্যাসবশত শিরস্ত্রাণ ধারণ করেছেন কিন্তু তিনি কর্মহীন। অপালার সঙ্গে যৌনমিলন হয় না বহু রাত। এসব তিনি অগ্রাহ্য করতে পারতেন যখন তিনি প্রবাসে দীর্ঘকালীন যুদ্ধযাত্রায় ব্যস্ত থাকতেন। অলস বাক্যালাপ ছাড়া এখন ওঁর কিছুই করার নেই। কৃষ্ণের সঙ্গে অলীক কিংবা বাস্তববাচিত সাক্ষাতের পর ছদ্মবেশ ত্যাগ করেছেন। সে বড়ো বিড়ম্বনার বিষয় ছিল। কণ্ঠস্বরেও আনয়ন করতে হয়েছিল পরিবর্তন। এসব তো ছিল চরের অধিকৃত বিষয়। এখন আর ছদ্মবেশের প্রয়োজন নেই। কৃষ্ণের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা উপনীত হওয়ার সময়ই অপালা এই উন্মাদিনীবৎ আচরণ শুরু করল। যা-ই হোক, কিছুটা অনিরুদ্দিষ্ট অশ্বারোহণের পর বিশাখজ্যোতি গুরুদেব অর্কজ্যোতির সমীপে এসে উপস্থিত হলেন। অর্কজ্যোতিকে ঘিরে তখন সতেরো-আঠারো সংখ্যার কয়েক জন কিশোর বসেছিল। তারা বোধ হয় কিছু পাঠ নিচ্ছিল। বিশাখজ্যোতি উপনীত হতেই তারা বিদায় নিল।

–বিমল প্রভাতে রাজপুরুষের দর্শন পেলাম।

–উপহাস করছেন, গুরুদেব!

–না। নতুন রাষ্ট্রচেতনার উদ্ভবে তোমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।

–শ্রৌত যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা যায়!

–আমি দেবপন্থী যাগযজ্ঞে বিশ্বাস করি না।

–ইষ্টি-যজ্ঞে বিশ্বাস করেন? যা কিনা মহারথী অশ্বত্থামা ব্রাহ্মমুহূর্তে পালন করে থাকেন।

–শ্ৰৌত যজ্ঞের তোমার প্রয়োজন কেন? -আমি সেই যজ্ঞ দ্বারা কৃষ্ণকে আহ্বান করতে চাই।

–কৃষ্ণ দেবতা নন। রক্ত-মাংসের নশ্বর মানুষ।

–গুরুদেব, আজকাল আমি দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি।

–চার্বাককৃত নাস্তিক্যবাদের যুক্ত খন্ডন করার মতো অব্যর্থ প্রমাণ কিছু পেয়েছ?

–কৃষ্ণের সঙ্গে আমার কথোপকথন হয়েছে দক্ষিণের কোনো অরণ্যে। তবে সাক্ষাৎ স্বপ্ন নাকি বাস্তব এর সীমারেখা অনির্ণীত থেকে গেছে।

–দীর্ঘ অবসরে বুদ্ধির প্রখরতা তোমার হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া অপালার কারণেও তুমি বিষণ্ণ।

–কৃষ্ণ আমাকে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করেছেন।

–কীভাবে?

–তিনি মানসিকভাবে অপালাকে হরণ করেছেন।

–এতে আমারও কিছু দায় রয়েছে।

–তার অর্থ?

–কৃষ্ণের কাছে আমি তোমাদের দাম্পত্যপ্রেমের জয়গান করেছিলাম।

–ভালোই হয়েছে, আমাদের সম্পর্কের পরিচয়ের দরজাটা খুলে গেছে।

–এবার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিছু অন্বেষণ তোমার আর নেই। শুধু প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করতে হবে- আমিই শ্রেষ্ঠ।

–অহমিকা হয়ে যাবে। মধ্যমেধার মানুষ এই উচ্চারণ করলে বিকৃতি আসবে।

–তুমি কি অগ্নিকে মান্য কর?

–হ্যাঁ, তিনি সব শুদ্ধ করে দেন।

–মৃত্যুর পর তোমার হৃদয় কি কম্পিত হবে?

–জানি না, সেই অভিজ্ঞতা আমার অনায়ত্ত।

–হবে না। যাবতীয় হৃৎকম্প নির্বাপিত করবেন অগ্নি। সেই অগ্নি তোমাকে চাইছেন।

–আত্মাহুতি!

–বলতে পারো।

–কিশোরদের আপনি বিভ্রান্ত করছেন।

-তুমি তো কর্মহীন। প্রভুত্ব, বিস্তার এসব চাও না?

–কে দেবে আমায়?

–আমি দেব।

–রাষ্ট্রদ্রোহিতা ভয়ংকর পাপ, গুরুদেব।

–ভ্রমাত্মক ধারণা। রাষ্ট্র উৎপীড়ক হলে, তার উচ্ছেদ আবশ্যক।

–পান্ডবেরা প্রজাকল্যাণকামী। রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির দয়ালু। তিনি উৎপীড়ক হতে পারেন না।

–পান্ডবেরা দুর্বল। যুধিষ্ঠিরের দৌর্বল্য সর্বজনবিদিত। অর্জুন হীনবল হয়ে পড়েছেন। সীমান্তপ্রদেশগুলিতে মাৎস্যন্যায় চলেছে।

–শুনেছি পরীক্ষিৎ অভিষিক্ত হবেন। আর আমরা কি কৃষ্ণের কথা বিস্মৃত হচ্ছি না?

–তিনি এখন অরণ্যে শ্মশান শয্যা নিয়েছেন।

–এই দ্রোহ তাহলে সুযোগের সদ্ব্যবহার?

–রাজতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে পান্ডব-কৌরবদের দীর্ঘকালীন যুদ্ধে। এখন প্রজাতন্ত্রের বিকাশ প্রয়োজন।

–তবে সেখানে আমার মতো প্রাক্তন রাজপুরুষেররও প্রয়োজন নেই।

–রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটলে রাজপুরুষদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না। বিশাখজ্যোতি, সময়ের সঙ্গে নিজেকেও বদলাতে হবে। প্রজাতন্ত্রেরও রক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। জনগণবিপ্লবের বল্গাহীন বিশৃঙ্খলা যেকোনো সময় দেখা দিতে পারে।

–এ ছাড়াও ভারতবর্ষের মতো বিপুলা দেশে প্রজাতন্ত্রের সার্বিক অভিযান সফল নাও হতে পারে। ব্যর্থতাই আবশ্যিক পরিণতি।

–চিরকালই তুমি নঞর্থক ভাবনার ঋত্বিক। সীমান্তপ্রদেশগুলিতে জনগণবিপ্লব এখনই সম্ভব। কৃষ্ণের সাহাহ্নকাল উপস্থিত। তাঁর তিরোধানে যুধিষ্ঠির মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠবেন। কল্পিত স্বৰ্গযাত্রা ব্যতীত কোনো পথই উন্মুক্ত থাকবে না। অর্জুনও হীনবল। ফলে অবশিষ্ট ভ্রাতারা দ্রৌপদী-সহ যুধিষ্ঠিরকে অনুগমন করবেন। রাজ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

–প্রজারা বিলাপ করবে না?

–এই মুহূর্তটাই অমূল্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুপ্ত বীজ এই সময়ই মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে। কিশোরদের আমি প্রাচীরগাত্রে জনগণবিপ্লবের আশু সংকেতের চিত্র অঙ্কন করতে নির্দেশ দিয়েছি।

–রূপজ্যোতির কোনো ক্ষতি হবে না?

–এই বিপ্লবেই সে-ই তো হবে প্রকৃত নায়ক।

–আপনার নির্দেশের আজ্ঞাবহ পুতুল?

–সে বীর ক্ষত্রিয়, আদর্শবাদী। আমি তাকে পুত্রপ্রতিম স্নেহ করি।

–তার ধ্বংসের পূর্বে আমার বিপর্যয় আসবে। এসব কুচিন্তা তুমি হৃদয় থেকে অপসারিত করো।

–কতিপয় কিশোর, যুবকদের নিয়ে আপনি জনগণবিপ্লব ঘটাবেন?

–তুমি আমাকে এতটাই অশিক্ষক মনে কর?

–আমি আপনার জ্যোতির্বিদ্যা চর্চাকে সম্মান করি। চার্বাকদর্শনও আংশিকভাবে মান্য করি, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিসন্ধি সমর্থন করি না।

–করতে পার না, কেন জান?

–কেন?

-তোমার দ্বি-হস্তে এখনও শৃঙ্খলের চিহ্ন বর্তমান। তুমি নিজস্ব চিন্তার দৈন্য সম্পর্কে অবহিত নও। ভবিষ্যতে তোমাকে আমার প্রয়োজন।

–এবার আমায় বিদায় দিন, গুরুদেব।

–কোথাও যেন আমাদের এইসব আলোচনার প্রকাশ না ঘটে।

–আমি আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করব না।

–বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হও।

–কিন্তু ব্যক্তি মাত্রেই দ্বান্দ্বিক।

–বস্তুবাদে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, ভাববাদে রয়েছে। প্রত্যয়ে সম্পৃক্ত হও বিশাখজ্যোতি।

বিশাখজ্যোতি নির্গমন করলে, কৃতভানু নামে এক যুবক গুরুদেবের কাছে এল। গুরুদেব হেসে বললেন, ‘অনুসরণের প্রয়োজন নেই, তবে তোমার সতর্ক ব্যবহারের প্রশংসা করি।’

যুবকটি বিদায় নিলে গুরুদেব সামান্য দ্বিধান্বিত হলেন। অতিরিক্ত স্নেহ করেন একদা রাজপুরুষ বিশাখজ্যোতিকে। রাষ্ট্রকে বা দেশকে সে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু চিন্তার অর্গল মুক্ত করতে পারে না। তবে বিপ্লবের পথে ক্ষত্রিয়ের লৌহকঠিন্য একান্ত আবশ্যক। প্রেমিকেরও প্রয়োজন রয়েছে। তিনি নিজেও তো রাষ্ট্রের কল্যাণ চান। রাজতন্ত্রের বিরোধী হয়ে প্রজাকল্যাণমূলক কেন্দ্রীয় প্রশাসন। তবে সীমান্ত প্রদেশগুলিতে অব্যাহত থাকবে জনগণতন্ত্র। পরীক্ষিতের পথ কন্টক-কীর্ণ হওয়া আবশ্যক। যুদ্ধের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি অকল্যাণ আনয়ন করতে পারে। বহিরাগত শত্রুদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সাহসী যুবকদের সমন্বয় প্রয়োজন। বিপ্লব নিশ্চেষ্টতা দূর। করবে। রাজাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ফলে প্রজার জন্য কল্যাণমূলক কর্ম রাজতন্ত্রের পক্ষে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে।

.

৩৫. মহাপার্শ্ব

–মুহূর্তিকা, এই রাতটা আমি ক্রয় করতে চাই।

–ইতরজনের এত স্পর্ধা! এই শরীর রাজপুরুষদের জন্য সংবর্ধিত।

–আমি আজকে তোর রাজপুরুষ।

–ছি, তোর গাত্রের উৎকট গন্ধ আমার অসহ্য লাগে।

–মুদ্রা দিয়ে আমি তোর সেই কষ্ট লাঘব করে দেব।

–কত কাহ্নপন দিবি আমায়?

–কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা।

–রাজকোষ থেকে চুরি করেছিস? তবে তো এখনই নগরদ্বারকে খবর দিতে হয়।

–উৎকোচ পেয়েছি।

–কোনো ভয়ংকর কান্ডে ব্যপৃত হয়েছিস নিশ্চয়! দূর হবি এক্ষুনি।

–বিশ্বাস কর মুহূর্তিকে, আমি তেমন কোনো কাজ করিনি।

–তবে স্বর্ণমুদ্রা কোথায় পেলি?

–তোর শরীরটা দিবি তো?

–স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তোর যাবতীয় যৌনতৃষ্ণা মিটিয়ে দেব। কিন্তু তুই কি পারবি?

–আমি কি বীর্যহীন পুরুষ?

–এই পেলব পা দিয়ে তোর পুরুষাঙ্গে সামান্য চাপ দিলেই যাবতীয় বীর্যরস মুহূর্তে নির্গত হয়ে যাবে। কত রাজপুরুষ এই ক্রিয়ায় পরাভূত হয়েছেন। তবে কিছুক্ষণ টিকিয়ে রাখার কৌশলও আমার জ্ঞাত আছে।

–তবে তাই করিস।

–আগে বলবি কোথায় পেলি?

–আরও একটি সুখ তোর কাছে প্রত্যাশা করি।

–আমার সন্তানের পিতা হবি?

–আমি তো তোরই অন্নদাস। প্রতিপালনও তো সেই তোকেই করতে হবে।

–তবে কী চাস?

–আমার পুরুষাঙ্গটি তোর মুখগহ্বরে প্রবেশ করাব।

–শিথিলতা দূর করার ঔষধি চাইছিস।

–হ্যাঁ, মুহূর্তিকে।

–দন্ত বসিয়ে একটু রক্ত নির্গত করব।

–মূত্রত্যাগে জ্বালা করবে না?

–তার ঔষধ আমার কাছে আছে।

–জিহ্বা দিয়ে লেহন করে দিবি তো?

–তোর বির্যরসে খিদে মেটাব। তরলীকৃত হয়ে যায়নি তো?

–না, এখনও বেশ ঘন।  

মহাপার্শ্ব মুহূর্তিকাটির কেশ উন্মুক্ত করে দিল।

দুটি স্বর্ণমুদ্রা ওর হাতে দিতেই রমণীটি বলল, ‘তোর উপায়ের সূত্র জেনে আমার প্রয়োজন নেই। তবে দ্বাররক্ষীদের কোনো কারণে আগমন ঘটলে আমি তোর কথা জানিয়ে দেব।’

কেশরাশির অতুলনীয় গন্ধে মহাপার্শ্বের আরামে নিদ্রা চলে আসছিল। মুহুর্তিকাটি নগ্ন হতেই মহাপার্শ্ব নিম্নাঙ্গটি ওর মুখগহ্বরে প্রবেশ করিয়ে চাপ দিতেই থাকল।

.

৩৬. সেই যুবক

বালির গহাকন্দর থেকে দ্বারপাল ওকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে আনে। হাওয়ায় তরঙ্গায়িত চাবুক যুবকের পিঠে পড়লে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করার পরিবর্তে মিনতি করতে থাকে, ‘প্রভু, আমি নির্দোষ। কোনো অন্যায়কর্ম করিনি।’

–তবে গুহাকরে লুকিয়ে ছিলি কেন?

–ভয়ে। দ্বারপালের সজ্যের পদাঘাত ওর মুখে এসে লাগে। বহুদিনের অভুক্ত দুর্বল শরীরটা নিয়ে যুবক ছিটকে যায়। তার অনাবৃত পৃষ্ঠদেশের রক্তধারায় চাঁদের আলো এসে পড়ে এবং তাতে ক্ষতস্থানে বেদনার কোনো উপশম না হলেও রাজপথের রাত্রিকালীন স্তব্ধতায় ওর কাতর মিনতি ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

–তুই কি কোনো তস্কর, নাকি দস্যুসর্দার?

–এসব কিছুই না, প্রভু।

–তবে তুই কে? সঠিক উত্তর না দিলে তোকে সোজা বধ্যভূমিতে নিয়ে যাব আমি।

–আমি একজন সৈনিক।

–তোর অশ্ব, অস্ত্র এসব কোথায় তবে?

–আমি কৌরবপক্ষের যোদ্ধা ছিলাম প্রভু।

আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে দ্বারপালের চোখ। চাবুকের আস্ফালন তীব্রতর হয়।

–মুখ থেকে কোনো যন্ত্রণার অভিব্যক্তি নির্গত করবি না, তবে পীড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। সেনাধ্যক্ষ কে ছিল?

–বিশাখজ্যোতি।

বিদ্রুপের অট্টহাসি আরও ছড়িয়ে গেল বাতাসে। যুবককে রক্ষ্ম দিয়ে বেঁধে অশ্বে আরোহণ করে দ্রুতবেগে রাজপথ পার করে চলল দ্বারপাল। এই স্বাস্থ্যবান যুবকটিকে সে গৃহেই নিয়ে যেতে চায়। ক্রীতদাস হিসেবে মন্দ হবে না। এ ছাড়া দেহটি এখনও নধর। যৌনাঙ্গটিও নিশ্চয় পুষ্ট। রাত্রিকালে ওটি নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকা যাবে। নারী অপেক্ষা সুন্দর যুবকদের প্রতি দ্বারপালের আসক্তি বেশি।

.

৩৭. রাধাকৃষ্ণলীলার সারসংক্ষেপ

শ্রীরাধিকা বললে, ‘নাথ, তুমি অত কী দেখছ আমায়?’

–শুধু দেখছি আর দেখছি।

–কেশব, তুমি আমার কত দূর দেখতে পাচ্ছ?

–আজ আমি তোমার সবটাই দেখতে পাচ্ছি। আমায় পূর্ণ আহার দেবে তো?

কৃষ্ণ শ্রীরাধিকার গলার মালা ছিন্নভিন্ন করে ফেললেন। ওর শরীরটা দু-হাতে তুলে নিয়ে শয্যার সমীপে চলে এলেন। কক্ষের প্রদীপ তখন নিভে গেছে। শুধু শয্যাপারে আরেকটি দীপ ক্ষীণশিখা নিয়ে কম্পমান ছিল। কৃষ্ণ রাধিকাকে শয্যায় ন্যস্ত করে ত্বরিত গতিতে যাবতীয় বস্তু ছিনিয়ে নিয়ে বিবসনা করলেন। তারপর রাধার উপর শায়িত হয়ে স্তন দুটি মর্দন করতে লাগলেন। মুহূর্তে উন্মাদিনী হয়ে ওঠা রাধা কৃষ্ণের যাবতীয় বস্ত্র ছিঁড়ে ফেলল। দন্ত বসিয়ে দিয়ে এক আশ্লেষ চুম্বনে কৃষ্ণ ভরিয়ে দিলেন রাধাকে। এবার রাধারমণ শ্রীরাধিকার অপূর্ব জঘার উপর অশ্বারোহীর মতো চেপে বসলেন। ঈষৎ ঘর্মাক্ত রাধা যোনিদ্বার বিস্ফোরিত করল। কৃষ্ণ তখন ওষ্ঠ দিয়ে যথাক্রমে ওর স্তন, নিতম্ব, জঘায় চুম্বন করতে থাকলেন। তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ একত্রিত করে যোনিগহ্বরে আলতো প্রবেশ করলে এবং কয়েক বার সামান্য উত্থিত হয়ে যোনিতে লিঙ্গের স্পর্শ লাগাতে থাকলেন। তারপর শ্রীরাধিকা সত্যিই যেন দেবীভঙ্গিমায় জেগে উঠল। ওর বিস্ফারিত যযানি কৃষ্ণের লিঙ্গের উপর স্থাপন করলে কৃষ্ণ আরও বেশ কয়েক বার জিহ্বা দিয়ে লেহন করলেন। তখন যৌন উন্মাদিনী রাধা কৃষ্ণের লিঙ্গটি মুখগহ্বরে গ্রহণ করল। রাধা তখন কৃষ্ণের উপর আরোহন করেছে। এবং পুরুষোত্তম ভগবান নব্যযৌবনপ্রাপ্ত পুরুষের মতো কাতর আহ্বান করছেন যে, তিনি আর বীর্যধারণ করতে পারছেন না, এবার যেন সে সঙ্গমে লিপ্ত হতে দেয়। অবশেষে রাধিকার যোনিদ্বারে প্রবিষ্ট হল পুরুষোত্তমের পুরুষাঙ্গ। তিনি আপ্লুত কণ্ঠে ডেকে বললেন, ‘রাধে, জয় রাধে।‘ আর শ্রীরাধিকা তখন যোনি-জঙ্ঘা-নিতম্ব সর্বস্ব সমর্পণ করে কেশবের লিঙ্গদেশ সম্পূর্ণ গ্রস্ত হতে দিলে।

রতি সম্পূর্ণ হতেই কৃষ্ণ আছড়ে পড়লেন রাধার দেহে। ঠিক তখনই আরেক বার রাধা বললে, ‘হে যদুনন্দন, আমি যদি গর্ভবতী হই?’

|||||||||| কৃষ্ণ মৃদু হাসলেন, কোনো উত্তর দিলেন না। প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল তাঁর শেষ সঙ্গম।

স্মৃতিটা মনে আসতেই কেমন বিষবাষ্পে ভরে উঠল হৃদয়। কৃষ্ণের প্রদত্ত চলভাষ যন্ত্রটি নদীর জলে নিক্ষেপ করল রাধা। তাঁর সঙ্গে বার্তার আকাঙ্ক্ষা থেকে এভাবেই নিবৃত্তি ঘটল। যন্ত্রও হারিয়ে গেল জলের অতল আহ্বানে। সেই কালের কাছে গোপন রইল তার প্রকৃত রহস্যময়তা।

.

৩৮. বিদুর

অগ্নিদেব বললেন, ‘এই মহাত্মনের দাহকার্য আমায় দ্বারা হবে না।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘কেন?’

–ইনি সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর দেহ সমাধিস্থ হয়। আগুনে পোড়ানো যায় না।

যুধিষ্ঠির একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদিও কত জল প্রবাহিত হচ্ছে। সমুদ্রে, পূর্ণ সমুদ্র এত অচঞ্চল কেন?

কৃষ্ণ বলেছিলেন, বিদুরকে দেখো। কামনাশীলের পক্ষে শান্তি অর্জন সম্ভব। নিতান্ত ভৃত্যের মতোই ধৃতরাষ্ট্রের মাথার উপরে চামর দোলাচ্ছেন, আবার সাবধান করছেন তিনি।

মুহূর্তের জন্য আরও এক বার যুধিষ্ঠির মৃতবৎ বিদুরের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি যুধিষ্ঠিরঅগ্নি আপনাকে গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছে।’

যোগজ শক্তি সঞ্চার হল যেন। পরম ধার্মিক বিন্দুর প্রাণাধিক প্রিয় যুধিষ্ঠিরের দেহে যোগবলে প্রবেশ করলেন।

কৃষ্ণের দর্শন নেই দীর্ঘকাল। এঁদের মৃত্যুসংবাদ এখনও শ্রুত হয়নি। প্রবীণেরা তাঁকে ছেড়ে বহু আগেই চলে গেছেন। মধ্যম পান্ডব ভীম তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। যুধিষ্ঠিরের কোমল বাহুস্পর্শে দ্রৌপদী আর উত্থিত হয় না। অর্জুনও পরাভূত হচ্ছেন দিকে দিকে।

.

৩৯. অপালা ও মধুর রতি

‘শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর প্রেয়সী ভাবাপন্ন ভক্তদের যে মধুর সম্বন্ধ এবং প্রিয় সম্বন্ধজনিত পরস্পরের মধ্যে যে সম্ভোগভাব তার নাম মধুর রতি। এই সম্ভোগ আট প্রকারের হয়– স্মরণ, কীর্তন, দর্শন, কেলি গুহ্যভাষণ, সংকল্প, অধ্যবসায় এবং ক্রিয়া-নিবৃত্তি।’

বিশাখজ্যোতি সস্নেহে হাত রাখলেন অপালার মাথায়, ‘তুমি এত জান!’

–স্বামী, আপনিও কি তাঁকে গ্রহণ করছেন?

–তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কোনো এক অরণ্যপ্রান্তে। তুমি যাবে তাঁর কাছে?

–আমি তো প্রভুকে নিত্য দেখি। কত উদ্দীপন অনুভব করি।

–যেমন?

–রূপ, বয়স, শৃঙ্গ, বেত্র, শঙ্খ, বিনোদ, নর্ম, বিক্রম– এগুলি সবই উদ্দীপন। আমি অনুভব করি। তিনি সুন্দর কথা বলেন।

–তিনিই তো ভাষাবেত্তা, সুবেশ, অতিশয় বলবান, বীরচূড়ামণি, দয়ালু, বুদ্ধিমান, ক্ষমাশীল।

–তাঁর সম্পর্কে এসব কথা বলে কারা প্রচার করেন?

–কেউ না। এসব হচ্ছে কৃষ্ণভক্তির সারাৎসার। বৈধী ভক্তি হচ্ছে। ঐশ্বর্য ও জ্ঞানমিশ্রিত।

–আমি মূর্খ নারী, আমার সেই ভক্তি নেই।

খুব হেসে বিশাখজ্যোতি বললেন, ‘তবে অপালার কী ভক্তি?

–শুদ্ধ, অহেতুকী ভক্তি। ব্রজবাসীদেরও নাকি এই ভক্তি রয়েছে।

–তবে তো এর পরীক্ষা হয়েছে!

–পরীক্ষা আত্মগত। আমার তাই মনে হয়েছে। আমি তো অতি হীন। সম্প্রদায়ের ভক্ত।

বিশাখজ্যোতি অপালাকে এবার চুম্বন করলেন।

–তুমি যে এত নৃত্য-গীত পটীয়সী সেটা তো আমি জানতাম না। অভিমান হচ্ছিল।

–স্বামী, আমি কৃষ্ণমন্ত্র জপ করতে করতেই এসব শিখেছি। কৃষ্ণমন্ত্র হচ্ছে বেদের সারাৎসার।

–শুনেছি সেইভাবে কৃষ্ণমন্ত্র জপ করলে সংসারে থাকার ইচ্ছে চলে যায়। তখন রূপজ্যোতির কী হবে?

খুব কোমল স্থানে আঘাত হয়ে গেল। অপালা এবার কাঁদতে থাকল।

–কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরনাথা।

–তার মানে?

–হরর্নামৈব কেবলম্। হরিনামই সব।

–স্বামী, আপনিও কি তবে কৃষ্ণভক্ত?

–ভক্তি তো আমার আসে না।

–তবে আপনি ঐশ্বর্য আর জ্ঞানের পথে তাঁর অনুসন্ধান করুন।

–রূপজ্যোতি বলে, তুমি কখনো অকারণে কাঁদতে থাক, কখনো নাচতে থাক, আবার কখনো গাইতেও থাক।

–কৃষ্ণনাম তখন আমায় আচ্ছন্ন করে। এসব শুনে আপনি রাগ করেছেন?

–না অপালা।

কৃষ্ণের প্রতি অসূয়া থেকে বিশাখজ্যোতি অনেকটাই মুক্ত হলেন।