৩০. সেটেলমেন্ট অফিসারদের জিম্মাদারি

সেটেলমেন্ট অফিসারদের জিম্মাদারি

জমি, জমির সেচ, জমি থেকে পাওয়া ফসল, জমির মালিকানা, মালিকদের কী জাত— এইসব কিছু থেকেই ভালরকম আমদানি হত আমিনদের। আমি তো আগেই বলেছি নথিপত্রে কারসাজির কথা। জমি ভাল না খারাপ সেটা ঠিক হওয়ার কথা জমি থেকে কতটা ফসল মেলে তাই দিয়ে। আসলে কিন্তু আমিন কী পেল তাই দিয়ে ঠিক হত কাজটা। কে জমির মালিক সেটাই হচ্ছে সবথেকে জরুরি। জরিপকারেরা তা ঠিক মতো আন্দাজ করতে পারতেন না। তাই নাম উলটোপালটা করে চলত বদমাইশি। শির জমি (seer lands) আর সিকমি আসামির (Sikhmee Asamees) কোনও ফারাক করা হত না। জানার কোনও ইচ্ছাও ছিল না কে হল মৌরসি কিষান। কোনও জবরদস্ত রাজপুত বা ব্রাহ্মণ রিশবত ইনকার করলে রেকর্ডে তাদের দেখানো হত চামার (chummar) বলে! রেজিস্ট্রার অব হোল্ডিং খুলে আম রেকর্ড পরখ করতে গিয়ে যখন হাঁক পাড়ত ফৌলানা (fullanah) চামারের নাম ধরে তখন জাতের গুমরে তারা সেই ডাকে সাড়া দিত না। পরে সেই লাচার আদমিকেই আবার আর্জি জানাতে হত সেটেলমেন্ট অফিসারকে। ততক্ষণে তার মালুম হয়েছে হাল। তাই কানুনগো আর মুহুরিদের খুশ করে তবে পাল্টাত রেকর্ড। এগুলো হচ্ছে স্রেফ মামুলি কাম যা পেয়াদারা করে।

আসল জঙ্গ দেখতে চাইলে যেতে হবে মাছেরি-ই-পয়মাস (macheree-i-paeemash)-এর ময়দানে। যেখানে কাজের নামে লুঠমার চালাচ্ছে মুনশি আর তার জুড়িদারেরা।

খুসরা যাচাই পরখ হলে জরিপকার তাতে দস্তখত করে পাঠিয়ে দিতেন মুনশিখানায়। পুরো জমির কথা যে কাগজে লেখা আছে দস্তখত করা হত শুধু সেটাতে। এবার রাত হলে বসত মুনশিজির দরবার। হাত ফেরতা হত বহু টাকা আর পালটে যেত নকশা। যে পাতায় জরিপকারের দস্তখত আছে সেই পাতাটার কোনও রদবদল করা হত না আর বাকি সব তফসিল পালটে যেত। সাবুদ আছে ফতেপুর জেলায় তেমনটাই হয়েছিল। বাকি জেলাগুলোতেও যে কারচুপি হয়নি তেমন কথা কে জোর দিয়ে বলবে।

জরিপের নথিপত্র কম বেশি তৈরি হলে পাঠিয়ে দেওয়া হত সেটেলমেন্ট দপ্তরে। সেটেলমেন্ট অফিসার এর আর কী ঠিক করবেন কারণ তাঁর নিজের বানানো বন্দোবস্তই বলে দিচ্ছে নথিপত্রে কোনও ভুল নেই। করার কাজ বলতে স্রেফ ফিরিস্ত বা দুলমেওয়েসি (ferisht ba dulmewesee) বা কিষানদের নামগুলো শুধরে নেওয়া। একবার বহাল হয়ে গেছে আবার করে জরিপের কাগজপত্র নড়াচড়া করায় পুরোটাই ঘেঁটে যেত। নতিজা, হয়রানের হয়রানি বেড়েই চলা!

তা হলে সেটেলমেন্ট দপ্তরের আসল কাজ কী? মহল ধরে ধরে তার রাজস্ব মুকারর্র‌র করা। জমিতে রায়তের দখল কতটা তাই দিয়ে ঠিক করা মালগুজারি কী হবে। জমির রাজস্ব বাড়ানো হবে না কমানো হবে সেই রিপোর্ট দর্জ করা। যদি কাজ ঠিকঠাক করতে চাওয়া হত তা হলে সাহেব সেটেলমেন্ট অফিসারের উচিত ছিল সরেজমিনে যাওয়া। গ্রামে গিয়ে তবে করা দরকারি ফয়সালা। ইনশাল্লা! কে করে এত মেহনত! ইচ্ছা থাকলেও দেখা যাবে ওপরওয়ালারা হুকুম জারি করছে, বন্ধ কর এই কাম! তারাও নিজের ইজ্জত কায়েম রাখতে ঠিক যা বলা হয়েছে সেটাই করে। যে কাজে তারা বহাল হয়েছে সেই কাজ করতে না পারায় তারাও আখেরে বেমুরাদ হয়ে ওঠে। লাগভগ একটা পরগনাকে অনেকগুলো টুকরো বলে ভেবে নেওয়া হয়। খেয়াল মতো সেই জমিগুলোর খাসলতে কোনও ফারাক নেই আর সবারই মেলে সেচের পানি। এবার মোহতিমিন বন্দোবস্ত মোতাবেক সেখানে জারি করবেন কোনও হুকুম। সত্যিই ধরে নেওয়া হবে সেই পরগনার জমি হল সব থেকে ভাল আর পানিরও কোনও সমস্যা নেই। কোনও জমিদার তখন সেখানে হাজির থাকলে জোড় হাতে আর্জি জানাতে বসবে, “গরিব পরওয়ার মেরা সব ধরতি বালুয়া হ্যায়, পানি নেহি!” (Gureeb purwar mera sub dhurtee bullooa haee, panee nahee!) সাহেব জবাব দেবে, “আমি কি ঘোড়ায় চড়ে পরগনায় বাঘ শিকারে যাইনি? লেকিন মালিক গ্রাম যে সড়ক থেকে পাঁচ ক্রোশ দূর! তাতে তোর কী! আমি কি অন্ধা যে তোর নজর দিয়ে দেখব?” সাহেব নিজের বুদ্ধি জাহির করে একটু মুচকি হাসবেন। সেরেস্তাদার আর পেশকারেরা হেসে গড়িয়ে পড়বে আর বলতে বসবে— আরে! কমবখত! হুজুর অন্ধা হ্যায়! (Aye! Kumbukhat! Hauzoor undha hae!)

এই ভাবে বেমতলব তালুকগুলোর উলটো-সিধা দাম ঠিক হয়ে যায়। আর সত্যি সত্যিই যে মহলগুলো থেকে আমদানি হতে পারত সেগুলো তখন মামুলি। যে তালুকের ফলন বেশি আর যে তালুকের ফলন কম সবই তাদের নজরে বরাবর। বন্দোবস্তের খতিয়ান দেখেও তারা কিছু মালুম করতে চান না। অথচ বারে বারেই ধরা পড়েছে এইসব খতিয়ানে কত গরমিল। তাও সেই বুনিয়াদের উপরই চালু হয়েছে বন্দোবস্ত। একটা গ্রাম থেকে কতটা আমদানি হতে পারে তা ঠিক হত মালগুজারির গড়পড়তা আয় দিয়ে। এরপর সেই আয়কে গুণ করা হত কত বিঘা চাষ হয়েছে তা দিয়ে। বাদ যেত গ্রামের মামুলি সব খরচ আর জমিদারের মালিকানা (Malikana) বাবদ ১০ শতাংশ। বাকি আমদানির পুরোটাই সরকারের জমা (Jhumma)। তসকিন (taksin) করা যাক কোনও একটা তালুকে ১০০০ বিঘা জমি চাষ হয়। বিঘা পিছু মালগুজারি আদায় ৩ টাকা। তা হলে পুরো জায়দাদের আমদানি ধরা হবে ৩০০০ টাকা। এর থেকে ২ জন চৌকিদার আর ১ জন গোরেয়েতের (goraet) মাসোহারা ২ টাকা। এ ছাড়া আছে একজন পাটোয়ারি যাকে দেওয়া হয় ৪ টাকা। মাহিনা বাবদ তা হলে বছরে খরচ ১২০ টাকা। ১০ শতাংশ মালিকানা হিসাবে জমিদার পাবে ৩০০ টাকা। এরপর যে হিসাব দাঁড়াচ্ছে তা হল,

হাল হাসিল (জায়দাদ মোতাবেক)৩০০০ টাকা
বাদ ১০ শতাংশ মালিকানা৩০০ টাকা
মোট আয়২৭০০ টাকা
বাদ নোকরদের মাহিনা১২০ টাকা
সরকারের খাজনা বাবদ আয়২৫৮০ টাকা

এই হিসাব মতো সরকার আমদানির ৮৬ শতাংশ রাজস্ব বাবদ নিজের ঘরে তুলছে।

জমিদারের কাজ কি তা হলে রায়তের কাছ থেকে স্রেফ খাজনা আদায়? সময় সময় তাকে তো জবরদস্তি গরিব কিষানদের বীজ, হাল বা বলদ কেনার টাকাও আগাম দিতে হয়, যাতে চাষের মরশুমে কোনও নওবত না আসে। পুরনো ইঁদারা মেরামত বা নতুন বানানো, কানুনগো-তহশিলদার বা থানেদারকে নজরানা দেওয়া এ সবই হচ্ছে জমিদারের কাজ। কিন্তু এইসব খরচের কোনওটাই হিসাবে ধরা হয় না। নজরানার কথা তো স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই জবরদস্তি আর লুঠমার চলতেই থাকে। তাই জরুরি হল এই রকম লুকোনো খরচের জন্য একটা বন্দোবস্ত। পাঁচ বা দশ বিঘা জমিতে চাষ দেবে বলে কোনও একজন রায়ত একজোড়া বলদ আর হাল খরিদ করল। এবার সে হিসাব করুক কার পিছনে কতটা টাকা সে খরচ করেছে আর চাষ করতে তার খরচ কত। এই সঙ্গে যোগ দিতে হবে বাজার চলতি বীজ আর ভুসার দামও। পুরোটা হিসাব করলেই নজরে আসবে আমদানির ঘর খালি। এবার সেই রায়ত চিন্তাভাবনা করুক চাষ করে তার কিছু ফয়দা হবে কি?

জমিদারেরা যে কায়দায় লুঠমার চালায় সেটা এমনিতে খুব মজাদার আর সেটেলমেন্ট অফিসারকে তারা যে ভাবে ধোঁকা দেয় তাজ্জব হতে হয় তা দেখে। কোনও এক জমিদারের রাস্তার পাশে ১৫০ বিঘা ফালতু জমি পড়ে ছিল। জমি জরিপের সময় সে তার ওই জমির কথা কবুল করল না। পড়শি জমিদারের ভাগে ওই জমি মুফতে এসে যাওয়ায় সে মহা খুশ। রাস্তার অন্য ধারে ছিল বেশ কিছুটা খাসা জমি। প্রথম জমিদার এবার দরখাস্ত করল সেই খাসা জমিটা নাকি তার, তাকে ধোঁকা দিয়ে তা হড়প করা হয়েছে। দু’বছর বাদে বন্দোবস্ত চালু হওয়ার মুখে আবার আর্জি পেশ করল, তালুকের মাপ ১০০০ বিঘা কিন্তু জরিপের সময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে ৭৫০ বিঘা। অন্যদিকে তার পড়শি জমিদারের এলাকা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। তাই সব দলিল দস্তাবেজ যেন যাচাই-পরখ করা হয়। সাবুদ মিলল তার নালিশের। খুব মামুলি একটা রকম খেসারত দেওয়ার পর ১৫০ বিঘা খাসা জমি তার দখলে চলে এল। আর ফালতু জমির মালিকানা চলে গেল আর এক তরফে।

তুরই (turaee) চাষ করলে জমি তারপর এক-দু’বছর ফেলে রাখাটাই রেওয়াজ। সেই জমিতে এমন ঘাসের জঙ্গল হয়ে যায় যে তখন দেখলে কারও মালুমই হবে না ওখানে কোনও দিন চাষ হয়েছিল। জরিপকার আর সেটেলমেন্ট অফিসারেরা হয়তো কখনও সেই জমিতেই শুয়োর আর চিড়িয়া শিকারে গেছেন। তাদের দেখে মনে হয়েছে ওই জমি তো জঙ্গল ওখানে চাষ হতে পারে না। জরিপ হয়ে গেলে জঙ্গল সাফ করে আবার চালু হয় চাষ আর খুশ নসিব রায়ত আর জমিদাররা রেহাই পায় রাজস্বের হাত থেকে।

১. বেমুরাদ: হতাশ, মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *