৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
পুরো নাম ভাদিমির ইলিচ উলিয়ানফ। যদিও তিনি বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে পরিচিত ভিন্ন নামে। রুশ বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ ভি, গাই লেনিন। জারের পুলিশকে ফাঁকি দেবার জন্য তিনি ছদ্মনাম নেন লেনিন। লেনিনের জন্য রাশিয়ার এক শিক্ষিত পরিবারে ১৮৭০ সালের ২২শে এপ্রিল (রাশিয়ার পুরনো ক্যালেন্ডার অনুসারে ১০ই এপ্রিল)। লেনিনের পিতা-মাতা থাকতেন ভল্গা নদীর তীরে সিমবিস্ক শহরে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে লেনিন ছিলেন তৃতীয়। লেনিনের বাবা ইলিয়া অস্ত্রাকান ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
ছটি সন্তানের উপরেই ছিল বাবা-মায়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব। তবে লেনিনের জীবনে যার প্রভাব পড়েছিল বাবা-মায়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব। তবে লেনিনের জীবনে যার প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি তিনি লেনিনের বড় ভাই আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার ছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি “নারোদনায় ভোলিয়ার” নামে এক বিপ্লবী সংগঠনের সভ্য হিসাবে গোপনে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
“নারোদনায়া ভোলিয়া” বিপ্লবী দলের সদস্যরা স্থির করলেন যার তৃতীয় আলেকজান্ডারকেও হত্যা করা হবে। লেনিনের ভাই আলেকডান্ডারও এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হলেন। এই সময় (১৮৮৬ সাল) লেনিনের বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। যখন পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন জারের গুপ্তচর বিভাগের লোকজন সব কিছু জানতে পেরে গেল। অন্য সকলের সাথে আলেকজান্ডারও ধরা পড়লেন। বিচারে অন্য চারজনের সাথে তার ফাঁসি হল।
বড় ভাইয়ের মৃত্যু লেনিনের জীবনে একটি বড় আঘাত হয়ে এসেছিল। এই সময়ে লেনিনের বয়স মাত্র সতেরো। তিনি স্থির করলেন তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হবেন।
ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় ছিল তার গভীর আগ্রহ আর মেধা। প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল ফল করে ভর্তি হলেন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেই সময় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একটি বিপ্লবী কেন্দ্র।
১৮৮৭ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছাত্রদের এক বিরাট সভা হল। সেই সভার নেতৃত্বের ভার ছিল লেনিনের উপর। এই কাজের জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হল। শুধু তাই নয়, পাছে তিনি নতুন কোন আন্দোলন শুরু করেন সেই জন্য ৭ই ডিসেম্বর তাকে কাজানের গভর্নরের নির্দেশে কোফুশনিকো নামে এক গ্রামে নির্বাসন দেওয়া হল।
এক বছরের নির্বাসন শেষ হল। লেনিন ফিরে এলেন কাজান শহরে। তার ইচ্ছা ছিল আবার পড়াশুনা শুরু করবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির অনুমতি দেওয়া হল না।
কাজানে ছিল একটি বিপ্লবী পাঠক্রম। তার সকল সদস্যরাই মার্কসবাদের চর্চা করত, পড়াশুনা করত, লেনিন এই পাঠচক্রের সদস্য হলেন। এখানেই তিনি প্রথম মার্কসীয় দর্শনের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হলেন।
এদিকে তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছিল। বাধ্য হয়ে উলিয়ানফ পরিবারের সদস্যরা এলেন সামারার মফঃস্বল অঞ্চলে। সামারায় এসে লেনিন স্থির করলেন তিনি আইনের পরীক্ষা দেবেন। পড়াশুনা বছরের পাঠক্রম মাত্র দেড় বছরে শেষ করে তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গে পরীক্ষা দিতে গেলেন। এ পরীক্ষার ফল বার হওয়ার পর দেখা গের লেনিন প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
১৮৯২ সাল নাগাদ তিনি সামারা কোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগ দিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন সামারা কাজান তার কাজের উপযুক্ত জায়গা নয়। আইনের ব্যবসাতেও মনোযোগী হতে পারছিলেন না। সামারা ছেড়ে এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গে।
লেনিন লিখলেন তার প্রথম প্রবন্ধ “জনসাধারণের বন্ধুরা কিরকম এবং কিভাবে তারা সোসাল ডেমক্রেটদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই প্রবন্ধ তিনি প্রথম বললেন, কৃষক শ্রমিক মৈত্রীর কথা। একমাত্র এই মৈত্রী পারে স্বৈরতন্ত্র, জমিদার ও বুর্জোয়াদের ক্ষমতার উচ্ছেদ, শ্রমিকদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজ গঠন করতে।
এই সব লেখালেখি প্রচারের সাথে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। ১৮৯৬ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদী চক্রগুলোকে নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য সংগ্রামের সঙ্” নামে একটিমাত্র রাজনৈতিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল, এই সঙ্ তারই ক্ৰণাবস্থা।
এই কাজের মধ্যেই লেনিনের সাথে পরিচয় হল নাদেজুদা ক্রপস্কাইয়ার সাথে। নাদেজুদা ছিলেন একটি নৈশ বিদ্যালয় শিক্ষিকা। এখানে প্রচার করতে আসতেন লেনিন। সেই সূত্রে দুজনের মধ্যে আলাপ হল। দুজনে দুজনের মতাদর্শ, আদর্শের সাথে পরিচিত হলেন। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল মধুর সম্পর্ক। নাদেজুদাও লেনিনের সাথে সংঘ পরিচালনার কাজে যুক্ত হলেন।
তার কাজকর্ম ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই সময় থোর্নটোন কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট করল। এই ধর্মঘটের নেতৃত্বের ভার ছিল “সংগ্রাম সরে “ উপর। এই ধর্মঘটের সাফল্যের প্রতিক্রিয়া অন্য অঞ্চলের শ্রমিকদের উপর গিয়ে পড়ল।
জারের পুলিশবাহিনী তৎপর হয়ে উঠল। লেনিনের সাথে সংগঠনের প্রায় সমস্ত নেতাকে গ্রেফতার করা হল। নিষিদ্ধ করা হল শ্রমিক শ্রেণীর সজ্ঞা।
লেনিনকে সেন্ট পিটার্সবুর্গের জেলখানার এক নির্জন কক্ষে বন্দী করে রেখে দেওয়া হল। জেলে বসে তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
চোদ্দ মাস বন্দী থাকবার পর তিন বছরের জন্য লেনিনকে নির্বাসন দেওয়া হল সাইবেরিয়ায়।
এক বছর পর নির্বাসিত হয়ে এলেন লেনিনের প্রিয়তমা ক্রপস্কাইয়া। প্রথমে তাকে অন্য জায়গায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল কিন্তু লেনিনের বাগদত্তা বলে তাকে শুশেনস্কোয়েতে থাকবার অনুমতি দেওয়া হল। দু মাস পর তাদের বিয়ে হল। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন তার প্রকৃত বন্ধু, সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত সহকারী।
আন্তরিক প্রচেষ্টায় বেশ কিছু বই আনিয়ে নিলেন লেনিন। তার মধ্যে ছিল মার্কস এঙ্গেলসের রচনাবলী। এখানেই তিনি তাদের রচনা জার্মান থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ শুরু করলেন। এছাড়া একের পর এক গ্রন্থ রচনা করতে আরম্ভ করলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল “রাশিয়ায় সোসাল ডেমোক্রোটদের কর্তব্য। এছাড়া “রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ”-এই দুটি বইয়ের মধ্যে লেনিনের চিন্তা-মনীষা, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনার স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয় বইটি রচনার সময় তিনি প্রথম ছদ্মনাম ব্যবহার করলেন লেনিন।
চিন্তা-ভাবনা পরিশ্রমের ফলে নির্বাসন শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিন্তু ক্রুপস্কাইয়ার সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে উঠলেন। অবশেষে নির্বাসন দণ্ডের মেয়াদ শেষ হলে ১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারি রওনা হলেন।
লেনিন ফিরে এলেন। তাকে সেন্ট পিটার্সবুর্গে থাকবার অনুমতি দেওয়া হল না। এমনকি কোন শিল্পনগরীতে বসবাস নিষিদ্ধ করা হল। বাধ্য হয়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গের কাছেই পসকফ বলে এক শহরে বাসা করলেন। এতে রাজধানীর নাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।
ঘুরে ঘুরে অল্পদিনের মধ্যেই নিজের কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করে ফেললেন। তার এই গোপন কাজকর্মের কথা জারের পুলিশবাহিনী কাছে গোপন ছিল না। একটি রিপোর্ট তার বিরুদ্ধে লেখা হল, “বিপ্লবীদের দলে উলিয়ানফের উপরে কেউ নেই। মহামান্য জারকে রক্ষা করতে গেলে তাকে সরিয়ে ফেলতে হবে।” লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হল।
সম্পূর্ণ ছদ্মবেশে কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ঘোড়ার গাড়িতে চেপে সীমান্ত পার হয়ে এলেন জার্মানি।
জার্মানিতে এসে প্রথমেই স্থির করলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির লিপজিগ শহর থেকে প্রকাশিত হল নতুন পত্রিকা ইসক্রা। যার অর্থ স্ফুলিঙ্গ। সেইদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এই স্ফুলিঙ্গই একদিন দাবানলে মত জ্বলে উঠবে।
সম্পূর্ণ গোপনে এই পত্রিকা পাঠিয়ে দেওয়া হল রাশিয়ায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হল দিকে দিকে। অল্পদিনের মধ্যেই ইসক্রা হয়ে উঠল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান মুখপত্র। আর জার্মানিতে থাকা সম্ভব হল না। গোয়েন্দা পুলিশের লোকজন এই সব বিপ্লবী কাজকর্ম বন্ধ করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে লেনিন ও তার সঙ্গীরা জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে এলেন ইংল্যান্ডে।
কিছুদিন পর সংবাদ পেলেন তার মা আর বোন ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে এসে রয়েছেন। মায়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্যারিসে গেলেন।
প্যারিস ত্যাগ করে আবার লন্ডনে ফিরে এলেন। কিন্তু এখান থেকে পত্রিকা প্রকাশ করার কাজ অসুবিধাজনক বিবেচনা করেই সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় চলে এলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ক্রুপস্কাইয়া। একটি ছোট বাড়ি ভাড়া করলেন দুজনে। অল্পদিনের মধ্যে এই বাড়িটি হয়ে উঠল বিপ্লবীদের প্রধান কর্মক্ষেত্র। ১৯০৩ সালে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস শহরে পার্টির অধিবেশন বসল। পুলিশের ভয়ে একটি ময়দান গুদামে সকলে জমায়েত হল। এখানেই জন্ম নিল বলশেভিক পার্টি।
পার্টি কগ্রসগুলোর প্রস্তুতি ও অধিবেশনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। ১৯০৫ সালের তৃতীয়, ১৯০৬ সালের চতুর্থ, ১৯০৭ সালের পঞ্চম কংগ্রেসে তিনিই প্রধান রিপোর্টগুলো পেশ করেন। কংগ্রেসে বলশেভিক (সংখ্যাগরিষ্ঠ) আর মেনশেভিকদের মধ্যে যে লড়াই চলে তার কথা তিনি শ্রমিক সাধারণের সামনে তুলে ধরেন।
একটু একটু করে যখন গড়ে উঠছে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী দল, ঠিক সেই সময় ১৯০৫ সালে রাশিয়ার বুকে ঘটল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। সেন্ট পিটার্সবুর্গে ছিল জারের শীতের প্রাসাদ। বন্ধ কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক তাদের ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে সেখান এসে ধর্না দিল। জারের প্রহরীরা নির্মমভাবে তাদের উপর গুলি চালাল। দিনটা ছিল ১৯০৫ সালের ৯ই জানুয়ারি। এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা পড়ল। রক্তের নদী বয়ে গেল সমস্ত প্রান্তর জুড়ে। এই পৈশাচিক ঘটনায় বিক্ষোভ আর ক্রোধে ফেটে পড়ল সমস্ত দেশ। গণ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল দেশের প্রান্তে প্রান্তে।
বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দেশ জুড়ে ধর্মঘট শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে আর দেশের বাইরে থাকা সম্ভব নয়, বিবেচনা করেই দীর্ঘ দিন পর রাশিয়ায় ফিরে এলেন লেনিন।
৫ই ডিসেম্বর মস্কো শহরে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হল। দুদিন পর এই ধর্মঘট প্রত্যক্ষ বিদ্রোহের রূপ নিল। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে উঠল ব্যারিকেড। রেললাইন তুলে ফেলা হল। শ্রমিকরা যে যা অস্ত্র পেল তাই নিয়ে লড়াই শুরু করল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, জারের সৈনিকরা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করল। শত শত মানুষকে হত্যা করা হল। হাজার হাজার মানুষকে বন্দী করে নির্বাসন দেওয়া হল। চরম অত্যাচারের মধ্যে জার চাইলেন বিপ্লবের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে। কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে জ্বলে ওঠা আগুনকে কি নেবানো যায়।
১৯০৭ সাল নাগাদ ফিনল্যান্ডের এক গ্রামের গিয়ে আশ্রয় নিলেন লেনিন। এখানে থাকতেন চাষীর ছদ্মবেশে। নেতারা নিয়মিত তার সাথে যোগাযোগ করতেন। এই সংবাদ জারের গুপ্তচরদের কানে গিয়ে পৌঁছাল, জারের তরফ থেকে ফিনল্যান্ডের সরকারের কাছে অনুরোধ করা হল লেনিনকে বন্দী করে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য। গোপনে এই সংবাদ পেয়ে দেশ ছাড়লেন লেনিন।
ফিনল্যান্ড পার হয়ে এলেন স্টকহোমে। সেখানে তারই প্রতীক্ষায় ছিলেন ক্রুপস্কাইয়া। দুজনে এলেন জেনিভায়। দেশের বাইরে গেলেও দেশের সঙ্গে যোগাযোগ এক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হল না। একদিকে যেমন দেশের সমস্ত সংবাদ তিনি সংগ্রহ করতেন, অন্যদিকে তার বিশ্বাসী অনুগামীদের মাধ্যমে বলশেভিক পার্টিকর্মীদের কাছে নির্দেশ উপদেশ দিতেন।
বলশেভিক পার্টির মুখপাত্র প্রলেতারি প্রত্রিকা হত জেনিভা থেকে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এই পত্রিকার অফিস সরিয়ে নিয়ে আসা হল প্যারিসে। এখানে আরো অনেক পলাতক রুশ বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময় প্যারিস ছিল বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। রাশিয়া থেকে বিপ্লবী সংগঠনের নেতারা এসে তার সাথে দেখা করত।
এদিকে রাশিয়ায় আন্দোলন ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। বলশেভিক পার্টির তরফে যে সমস্ত পত্রিকা বার হত তার চাহিদা ক্রমশই বেড়ে চলছিল। পার্টির সদস্যদের কাছ থেকে আবেদন আসতে থাকে, সাপ্তাহিক পত্রিকা নয়, চাই দৈনিক পত্রিকা।
লেনিন নিজেও একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করবার কথা ভাবছিলেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হল শ্রমিক শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকা প্রাভদা। এর অর্থ সত্য। লেনিন ও স্তালিন যুগ্মভাবে এর সম্পাদক হলেন। এই পত্রিকা রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই পত্রিকায় লেনিন অসংখ্য রচনা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনামে।
এরই মধ্যে দেখা দিল বিশ্বযুদ্ধ। হিংস্র উন্মাদনায় মেতে উঠল বিভিন্ন দেশ। লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন এই যুদ্ধের সুদূর প্রসারী ফলাফল। জারের লোহার শেকল আলগা হতে আরম্ভ করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
১৯১৭ সালের ১৬ই এপ্রিল দীর্ঘ দশ বছর পর দেশে ফিরলেন। তিনি এসে উঠলেন তার বোন আনার বাড়িতে।
লেনিনকে ধরবার জন্য পুলিশ হানা দিল আনার বাড়িতে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আগের দিন সেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন লেনিন। পুলিশ সমস্ত বাড়ি তছনছ করে ফেলল।
বিপদের গুরুত্ব বুঝে লেনিন পিটার্সবুর্গ ছেড়ে এক চাষীর ছদ্মবেশে পালিয়ে এলেন সীমান্তের কাছে রাজলিতে বলে এক ছোট শহরে।
কিন্তু এখানেও বিশ্রাম নেবার সময় নেই। কুঁড়েঘরে বসেই রচনা করলেন তার কয়েকটি বিখ্যাত রচনা। এখানে থেকেই তিনি লিখলেন দুটি চিঠি “বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল করতে হবে-” এবং “মাসৰ্কবাদ ও সশস্ত্র অভ্যুত্থান”।
এর পরেই তিনি চলে এলেন পিটার্সবুর্গের এক গোপন আস্তানায়। এখান থেকেই তিনি ১৯১৭ সালের লা অক্টোবর ঘোষণা করলেন “সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। অবিলম্বে শুরু হোক এই বিপ্লব।
ছোট ছোট সভায় লেনিনের এই নির্দেশ প্রচার করা হল। নেতৃস্থানীয় সকলেই একে একে উপস্থিত হতে আরম্ভ করল। ২৪শে অক্টোবর লেনিন এলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরের স্মেলনি ভবনে–এই ভবন হল বিপ্লবের সদর দপ্তর। চারদিকে দেওয়া হল প্রয়োজনীয় নির্দেশ। একে অন্যের সাথে যাতে ঠিকমত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হল। রেড গার্ডের সৈনিকরা প্রস্তুত হল। সামরিক বাহিনীর বহু ইউনিট এসে যোগ দিল তাদের সাথে।
চূড়ান্ত সময়ে ঘোষণা করা হল শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানল। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপ্লবী শ্রমিক আর রেড গার্ডেন সৈন্যরা। ২৫শে অক্টোবর (নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ৭ই নভেম্বর) রাত শেষ হবার আগেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গা দখল করে নিল বিপ্লবী বাহিনী। সরকারী বাহিনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু স্রোতের মুখে খড়কুটোর মত ভেসে গেল তারা। জারের অস্থায়ী সরকারের সদস্যরা গিয়ে আশ্রয় নিল তার শীতের প্রাসাদে।
প্রাসাদের অদূরেই সমুদ্রে দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধ জাহাজ আরোরা। আরোরা থেকে কামান গর্জে করল নিজেদের অধিকার।
তারপর ঘোষণা করা হল কৃষিজমি সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সনদ। এতদিন দেশের সমস্ত জমির মালিক ছিল জামিদার আর ভূস্বামীরা। তাই দেশের সমস্ত জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
কিন্তু বাধা এল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জমিদার, ভূস্বামী, রাজতন্ত্রের সমর্থকদের কাছ থেকে। এছাড়াও দেশের মধ্যে ছিল অসংখ্য প্রতিবিপ্লবী দল। দীর্ঘ চার বছর ধরে তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে লেনিনকে। অবশেষে গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে লেনিনের ডান হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হতেই আবার কাজ শুরু করলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবশেষে ২১শে জানুয়ারি ১৯২৪ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন সর্বহারার নেতা লেনিন।
তাই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যেখানেই শোষিত বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই উচ্চারিত হয় একটি নাম-মহামতি লেনিন।