রুনি বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আসমানী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কারণ সেও জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা নৌকায় উঠেছে বেলা উঠার পর। বেশ বড়সড় পালওয়ালা নৌকা। যদিও নৌকায় এখনো পাল তোলা হয় নি। দুজন মাঝি লাগি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝারি ধরনের খাল–এখনো ভালোমতো পানি আসে নি। নৌকায় দারোগাবাড়ির পরিবারের সকল মহিলা সদস্য ছাড়া দুজন পুরুষ আছে। একজন আমাদের পূর্বপরিচিত— কুদ্দুস। কুদ্দুসের পরনে আজ পায়জামা পাঞ্জাবি। মাথায় নীল রঙের কিস্তি টুপি। তাকে ভদ্রলোকের মতো লাগছে। সে মোটামুটি নির্বিকার ভঙ্গিতে পান খাচ্ছে। পানের রসে তার ঠোঁট টকটকে লাল। সে পরনের পাঞ্জাবি দিয়েই তার ঠোঁট মুছছে। পাঞ্জাবি লাল দাগে ভরে যাচ্ছে। অন্যজন অপরিচিত এক হিন্দু ভদ্রলোক–কেশব বাবু। এই গরমেও গায়ে ভারি চাদর। তিনি নৌকার পাটাতনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। ভদ্রলোক ময়মনসিংহ জজ কোটের পেশকার। দেশের অবস্থা খারাপ মনে করে দুই মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মিলিটারি আসার পর মেয়ে দুটিকে তার মাসির বাড়ি ইছাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন যাচ্ছেন মেয়েদের খোজে। কেশব বাবু বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ। তার হাঁপানি আছে। নৌকায় উঠার পরপর তার হাঁপানির টান উঠেছে। তিনি ফুসফুসে বাতাস ভরানোর চেষ্টায় ছটফট করছেন। ফুসফুস ভরছে না। এই ভদ্রলোক কে, তাদের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছেন?–আসমানী তাও জানে না। মনে হচ্ছে আসমানী জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। নৌকা যেখানে ইচ্ছা যাক, কিছু যায় আসে না।
নৌকার ছাঁই শাড়ি দিয়ে ঢাকা, যেন ভেতরের মহিলাদের দেখা না যায়। আসমানী শাড়ির ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে আছে। ভেতরের মহিলারা চাপা। গলায় কাঁদছেন। কান্নার শব্দ সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং কেউই একনাগাড়ে কাঁদছে না। হঠাৎ একসঙ্গে সবাই চুপ করে যাচ্ছে, আবার এক সঙ্গে সবাই কাঁদতে শুরু করছে।
আসমানী শান্ত হয়ে বসে আছে। সে কাঁদছে না বা তার কান্না আসছেও না। এজন্য সে একটু লজ্জিতও বোধ করছে। তার চোখের সামনে এত বড় শোকের ঘটনা ঘটল। বলতে গেলে এখন সে এই পরিবারেরই একজন সদস্য, তার কেন কান্না আসবে না?
রুনি নৌকার পাটাতনে বসে পানি স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। যেভাবে বুকে আছে পানিতে উল্টে পড়ে যেতে পারে। রুনিকে একটা ধমক দেওয়া দরকার। সেই ধমক দিতেও ইচ্ছা করছে না। পানিতে পড়ে গেলে পড়ে যাক।
রুনি আবারো বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আসমানী বিরক্ত গলায় বলল, জানি না।
জানো না কেন?
আসমানী চুপ করে রইল। রুনি বলল, মা, বিলো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কুদ্দুস বলল, আমরা যাইতেছি ইছাপুর।
ইছাপুরে যাচ্ছি কেন?
আসমানী বলল, রুনি, তুমি কি একটু চুপ করবে?
চুপ করব কেন?
আসমানী জবাব দিল না। কুদ্দুস বলল, ছোট আম্মা, মিলিটারির কারণে বাঁচনের জন্য যাইতেছি।
মিলিটারি সবাইকে মেরে ফেলছে?
ঘটনা পেরায় সেই রকম।
ইছাপুরে মিলিটারি নেই?
জে না।
ইছাপুরে মিলিটারি নেই কেন?
আমাদের দেশটা কি বিরাট?
আরেকবাসরে, বিরাট বলে বিরাট!
ঐ বুড়ো ভদ্রলোক এরকম করছেন কেন?
শরীর ভালো না, হাঁপানি।
উনি কি মারা যাচ্ছেন?
আরে না ছোট আখ, কী যেন কম। মিত্যু অত সহজ না। মিত্যু বড়ই কঠিন।
আসমানী এক ঝলক কুদ্দুসের দিকে তাকাল। মৃত্যু সহজ না সে বলছে কীভাবে? সে নিজে কি দেখছে না মৃত্যু কত সহজ হয়ে গেছে! তিনজন মানুষকে ধরে নিয়ে গেল। সুস্থ সবল ভালোমানুষ। ভোরবেলা খবর এলো, মোতালেব সাহেবের ডেডবডি গাঙের পারে পড়ে আছে। অন্য দুটি ডেডবডি পানিতে ভেসে চলে গেছে। মোতালেব সাহেবের শবদেহ উদ্ধার হয় নি। কে আনতে যাবে? সবাই জীবন বাচানোর জন্য ব্যস্ত। তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়েছেন মোতালেব সাহেবের স্ত্রী জাহেদা খানম। তাকে কুদ্দুস এসে বলেছিল, আম্মা, চলেন আপনে আর আমি দুইজনে যাই। লাশটা নিয়া আসি। আপনে সঙ্গে থাকলে মিলিটারি কিছু বলবে না। ইস্ত্রী স্বামীর ডেডবিডি নিতে আসছে এটা অন্য ব্যাপার। মিলিটারি যত খারাপই হউক, এরা মানুষ। এইটা বিবেচনা করব। জাহেদা রাজি হন নি।
নৌকায় তিনি বেশ স্বাভাবিক আছেন। কান্নাকাটি করছেন না। অপরিচিত এক মহিলার কাছ থেকে পান নিয়ে মুখে দিলেন। তার পান খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, তিনি পান খেয়ে খুব আরাম পাচ্ছেন। মাথা বের করে নদীর পানিতে পিক ফেলছেন। তার কোলে একটা বালিশ। তিনি বালিশ হাতছাড়া করছেন না। বালিশের তুলার ভেতর টাকা এবং সোনার গয়না।
আসমানী অলস চোখে তাকিয়ে আছে। চারদিক এত সুন্দর! মানুষের দুঃখ কষ্টে প্রকৃতির কিছু যায় আসে না। সে তার মতোই থাকে। খালের পানি কী পরিষ্কার! ঝকঝকি করছে। এই সময়ে নদীর পানি ঘোলা থাকে। ভদ্র মাসের দিকে পানি পরিষ্কাব হতে থাকে। এই খালের পানি এত পরিষ্কার কেন? কিছুক্ষণ পরপর আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বিক উড়ে যাচ্ছে। নীল আকাশে বক, উড়ছে–এই দৃশ্যটা এত সুন্দর! দেশ যদি ঠিকঠাক হয়ে যায়, আবার যদি শাহেদের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে শাহেদকে নিয়ে ঠিক এই খাল দিয়ে নৌকাভ্রমণে যেতে হবে। শাহেদের সঙ্গে কি দেখা হবে?
কেশব বাবু উঠে বসেছেন। তার চোখ টকটকে লাল। চোখের কোণে ময়লা জমেছে। তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না; কুদ্দুস বলল, শরীরের ভাব কী?
কেশব বাবু বললেন, একটু ভালো বোধ করছি! চোখ যন্ত্রণা দিচ্ছে।
মনে হয় চউখ উঠতেছে। চাইরদিকে চউখ উঠা ব্যারাম।
ইছাপুর যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?
ধরেন আর দুই ঘণ্টা।
রুনি এক দৃষ্টিতে কেশব বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুদ্দুস বলল, ছোট আম্মা, এই রকম কইরা চউখ উঠা মাইনসের চউখের দিকে তাকাইতে নাই। যে তাকায় তারও চউখ উঠে।
রুনি বলল, কেন?
কুদ্দুস উদাস গলায় বলল, কেন তা ক্যামনে বলব? এইটা হইল আল্লাপাকের বিধান।
আল্লাপাকের বিধান থাকা সত্ত্বেও রুনি তাকিয়েই রইল। এরকম লাল চোখের মানুষ সে আগে দেখে নি।
কেশব বাবু বললেন, খবরটা শোনা দরকার।
কুদ্দুস বলল, শোনা দরকার হইলে শুনেন, আপনের কাছে তো টেনজিস্টার আছে।
মেয়েরা সব কান্নাকাটি করছে, এর মধ্যে টেনজিস্টার ছাড়াটা কি ঠিক হবে?
সেইটা আফনের বিবেচনা।
কেশব বাবু ঢাকা ধরলেন। খবরে বলা হলো–পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিদেশী সাংবাদিকদের একটি টিম সারা প্রদেশে ঘুরে বলেছেন— আইনশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দেশের কাজকর্ম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। অফিস আদালতে উপস্থিতির সংখ্যা আগের মতো। যারা এখনো কাজে যোগ দেন নি তাদের অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। গণচীনের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে বাইরের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়, পূর্ব পাকিস্তানে চালের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চালভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম নৌবন্দরে ভিড়েছে। মাল খালাস শুরু হয়েছে।
কুদ্দুস বলল, দেশের অবস্থা তো ভালোই।
কেশব বাবু বললেন, হুঁ।
তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো।
ইছাপুরে নৌকা ভিড়ল দুপুর নাগাদ। নৌকাঘাট জনশূন্য। অন্য সময় কেরায়া নৌকা, ঘাস কাটা নৌকায় জায়গাটা জমজমাট হয়ে থাকে। আজ একটা প্রাণীও নেই। চা-বিস্কিটের একটা দোকান ছিল, সেটাও বন্ধ। কুদ্দুস বলল, কেমন কেমন জানি লাগতেছে, বিষয়টা কী?
বিষয় জানতে দেরি হলো না। মিলিটারির একটা দল আজ ভোরবেলাতেই ইছাপুরে এসেছে। তারা জায়গা নিয়েছে ইছাপুর থানায়। তাণ্ডব শুরু হয়েছে। মিলিটারিরা ড্রাম ভর্তি কেরোসিন নিয়ে এসেছে। হিন্দু ঘরবাড়ি জ্বালানো শুরু ধ্ৰুং।। ঘরবাড়ি জ্বালানোর জন্য আজকের দিনটাও শুভ। বাতাস নেই, বৃষ্টি
কুদ্দুসরা নৌকা থেকে নামল না। শুধু কেশব বাবু নেমে গেলেন। কাঁদো। কাঁদো মুখে রুনিকে বললেন, মা গো, আমার জন্য একটু প্রার্থনা করো।
রুনি খুবই অবাক হলো। এত মানুষ থাকতে এই লোকটা তাকে প্রার্থনা করতে বলছে কেন? প্রার্থনা কীভাবে করে তাও তো সে জানে না।
নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝি দুজনই প্ৰাণপণে লগি ঠেলছে। এই অঞ্চল থেকে যত দ্রুত সরে যাওয়া যায়।
খালের পাড়ে বুড়ো এক লোক বসে ছিল। সে চাপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চইল্যা যান। তাড়াতাড়ি।
আসমানী বলল, আমরা যাব কোথায়?
কুদ্দুস পানের কৌটা থেকে পান বের করে মুখে দিল। উদাস গলায় বলল, জানি না।
জাহেদা বললেন, কুদ্দুস, সিংধা এখান থেকে কত দূর?
কুদ্দুস নদীর পানিতে থুথু ফেলে বলল, কাছেই।
জাহেদা বললেন, আমাদের সিংধা নিয়া চল। সিংধায় আমার ফুফু-শাশুড়ির বাড়ি।
কুদ্দুস বলল, আইচ্ছা।
জাহেদা আসমানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আসমানী শোন, সিংধায় তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না। তুমি আমাদের ঘাড়ে চাপার পর থেকে বিপদ-আপদ শুরু হয়েছে। তাছাড়া সিংধায় এত মানুষ নিয়ে আমি উঠতে পারব না।
আসমানী বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কোথায় যাব? জাহেদা তার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কোলবালিশ নিয়ে ঘুরে বসলেন। তিনি আরেকটা পান মুখে দিয়েছেন। তাঁর মুখভর্তি পানের রস। রুনি বলল, মা উনি আমাদের নিতে চাচ্ছেন না কেন? আসমানী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। তার কাছে জবাব ছিল না। রুনি বলল, আমরা এখন কোথায় যাব মা?
আসমানী অবিকল কুদ্দুসের মতো উদাস গলায় বলল, জানি না।
জাহেদা বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়েছেন। তাকে দেখে মনে হবে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে পান খাবার জন্যে মুখ নড়ছে। আসমানী একবার ভাবল বলে, খালাম্মা, আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। আমার পেটে সন্তান। আমাকে এইভাবে ফেলে রেখে যাবেন না। তারপরই মনে হলো, কী হবে! তার নিজেরও ঘুম পাচ্ছে। একটা বালিশ থাকলে কিছুক্ষণ ঘুমাত। চিন্তাভাবনাহীন কিছু সময় পার হয়ে যেত ঘুমে ঘুমে।