৩০
শ্রীধর এসে বলল, ‘রাজমাতা ডেকেছেন আমায়?’
অন্নদা চকিতে স্নানঘরের দিকে তাকাল। রাজমাতা স্বর্ণময়ী স্নান করছেন। তাঁর প্রসাধন, তৈল, সুগন্ধী সব সাজিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে অন্নদা। স্বর্ণময়ীর সে অন্ধের যষ্টি, স্নানের সময়টুকু ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও তাকে রাজমাতা কাছছাড়া করেন না। ইচ্ছা করেই এই সময়ে সে শ্রীধরকে ডেকে পাঠিয়েছে।
অন্নদা ধীরেসুস্থে কথা আরম্ভ করল, ‘হ্যাঁ শ্রীধর। তবে উনি স্নান করছেন। একটু দেরি হবে। তুমি অপেক্ষা করো।’
‘আমি তবে ঘুরে আসছি।’ শ্রীধর প্রস্থানোদ্যত হতেই অন্নদা বলল, ‘না-না, উনি এখুনি এসে পড়বেন। সারাদিনই তো চরকির মতো ঘুরছ, একটু বিশ্রাম নাও। দাঁড়াও, কচি ডাব আছে, কেটে নিয়ে আসি।’
শ্রীধর একটু ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার জীবন পুরোটাই আবর্তিত হয় মহারাজাকে কেন্দ্র করে। মহারাজ কী পরবেন, কখন কোথায় যাবেন, কী চাইছেন, শ্রীধর সে’সব নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সে সহজ সরল প্রকৃতির, জটিল প্রসঙ্গে ঢোকেও না, তার মস্তিষ্কের সেই ক্ষমতাও নেই। রাজমাতা ডাকছেন শুনে সে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছে, কিন্তু এখন তার কী করা উচিত, সে বুঝতে পারছে না।
অন্নদা ডাবের জল নিয়ে এল। শ্রীধর নীরবে তা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পান করতে লাগল।
অন্নদা অর্ধস্বচ্ছ আড়াল থেকে শ্রীধরকে লক্ষ্য করছিল। বয়স আন্দাজ ত্রিশ, কিন্তু উদাস চোখ, মলিন পোশাক আর গালে অবিন্যস্ত দাড়ির জন্য একটু বেশিই বয়স্ক লাগে। ভালো ভালো। স্বামী সবসময়েই সোজাসরল, বাধ্য হওয়া প্রয়োজন।
অন্নদা অবগুণ্ঠন সরিয়ে বলল, ‘তুমি বে’ করোনী কেন, শ্রীধর?’
শ্রীধর চমকে উঠল। জনশূন্য কক্ষে রাজমাতার পরিচারিকার কাছ থেকে এই প্রশ্ন সে প্রত্যাশা করেনি!
শ্রীধরের বিস্মিত দৃষ্টি দেখে অন্নদা সহজ গলায় বলল, ‘আহ, লজ্জার কী আচে! আমি হলুম তোমার মায়ের মতো। ওই আবাগীকে পেটে না ধরে একটা ছেলে ধরলে সে তোমার মতোই হত। তাই জিগ্যেস করচি, বে’ থা করোনী কেন?’
শ্রীধর এবার একটু স্বাভাবিক হল। লঘু স্বরে বলল, ‘আজ্ঞে, করা হয়ে ওঠেনি মা। সারাদিন তো রাজবাড়িতেই কেটে যায়!’
‘সে কাটুক না!’ অন্নদা মিষ্টি করে হাসল, ‘তুমি কি নিজে মেয়ে ঠিক করবে নাকি? সে তোমার বাড়ির লোকের কাজ!’
‘না মা, আমার বাড়িতে কেউ নেই।’ শ্রীধর মাথা নাড়ল, ‘বাপমা দুজনেই গত হয়েছেন অনেক কাল আগে। থাকার মধ্যে আচেন এক বুড়ি পিসিমা। তিনিও দু’বছর হল কাশীবাসী হয়েচেন।’
সব তথ্যই অন্নদার জানা। তবু সে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আহা গো! তবে রাঁধাবাড়া কি নিজেকেই করতে হয় নাকি?’
শ্রীধর লাজুক হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, ওই চালিয়ে নিই মা। এই দেখুন না, আজ সকালেই কেমন হাতটা পুড়ে গিয়েচে। ফোসকাগুলো এত জ্বলচে!’
‘আহা গো! বালাই ষাট! পুরুষমানুষ রাঁধতে গেলে তো অনত্থ বাঁধবেই।’ অন্নদা মুখে কষ্ট ফুটিয়ে বলল, ‘তবে তো আমাদেরই কিচু একটা করতে হয়। আমি নাহয় তোমার জন্য একখানা ভালো পাত্রী দেখি, যে তোমার যত্নআত্তি নেবে।’
‘না না।’ আঁতকে উঠল শ্রীধর, ‘ও-ওসব করতে হবে না। আমি মহারাজাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি, ঘরসংসার করার…!’
‘তা বললে তো হয় না বাছা!’ মাথা দুলিয়ে বলল অন্নদা, ‘মা বলে ডেকেচ যখন, চোক বুজে তো বসে থাকতে পারব না। আর তোমার যত্নআত্তি না হলে তুমি রাজামশাইয়ের যত্ন নেবে কী করে?’
কথা বলতে বলতে বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছিল অন্নদা। অবশেষে তার প্রতীক্ষা শেষ হল। দরজা দিয়ে মেনকা ঢুকে এল।
‘আমায় ডেকেচ?’ শ্রীধরকে দেখে মেনকা চমকে উঠল।
এই মহলে পুরুষ আসে না। তাই মেনকার কাঁচুলির ওপরে কোনও আবরণ নেই। তার দৃঢ় স্তনদুটো উদ্ধত হয়ে রয়েছে। কাঁচুলির নীচে অনাবৃত তার নাভিও। সরু কোমর মিশেছে নীচের তলপেটে, যার ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম লেপ্টে রয়েছে।
নীচের বস্ত্রও আঁটসাঁট। নেই কোন লইয়া জাতীয় আবরণ।
শ্রীধর ভীতচোখে দেখছিল। মেনকাকে সে যে আগে দেখেনি তা নয়। যাতায়াতের পথে, পুষ্করিণীর পাশে, যে-কোনও অনুষ্ঠানে বহুবার দেখেছে, কথাও বলেছে। শ্রীধর স্বভাব উদাসীন, কিন্তু এই প্রায়নির্জন কক্ষে এত খোলামেলা মেনকাকে দেখে সে ঘামতে শুরু করল।
অন্নদা অপাঙ্গে একবার দেখল শ্রীধরকে। তারপর মেনকার দিকে ফিরে সহজভাবে বলল, ‘এসেচিস? তোর বানানো সেই তেলটা কুলুঙ্গিতে আচে, নিয়ে আয় তো মা!’
শ্রীধর একটু ছটফট করে উঠল, বলল, ‘আমি যাই!’
‘দাঁড়াও বাবা!’ অন্নদা বলল, ‘আমার মেয়ে চার-পাঁচরকম লতাপাতার নির্যাস দিয়ে এমন এক তেল বানিয়েচে, জ্বালাপোড়ায় দিলেই বড় আরাম হয়। কই রে মা, শ্রীধরের হাতে একটু তেলটা দিয়ে দে না!’
মেনকা তেলের পাত্রটা নিয়ে এগিয়ে এল। ঈষৎ কম্পিত হাতে কিছুটা তেল তুলে নিয়ে সে শ্রীধরের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল।
শ্রীধর অস্থির গলায় বলল, ‘আমি…আমি…আমাকে দিয়ে দিন, আমি মেখে নেব’খন।’
‘শোনো কতা ছেলের!’ মুখ টিপে হাসল অন্নদা, ‘নিজের চোককে কি নিজে দেকতে পাও? তবে নিজের গায়ে নিজে তেল মাকবে কী করে? মেনকা, তুই ওর কতা শুনিস না, মাকা দিকিনি ভালো করে।’
মেনকা আড়ষ্টভাবে শ্রীধরের হাতে তেল লাগাল।
‘ও কী হচ্চে মেনি? ওইভাবে লোকে দূর থেকে কুকুরকে খেতে দেয়, তেল মাকানো হয়? আমার জরুরি কাজ পড়ে গ্যাচে। এসে যেন দেখি, পুরো তেল মাকানো হয়ে গ্যাচে।’ অন্নদা ধমকে উঠল।
মেনকা বাধ্য হয়ে শ্রীধরের আরও কাছে এল। তার গায়ের উত্তাপ ও মেয়েলি গন্ধে শ্রীধরের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মেনকা শ্রীধরের হাতে তৈলমর্দন করতে লাগল। তার উত্তুঙ্গ বক্ষের সমান্তরালে রয়েছে শ্রীধরের মুখ। লোকটাই সত্যি সোজাসরল, পাথরের মতো মুখ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, জীবনে এই প্রথম তার দেহে স্পর্শ করছে কোন নারীহস্ত।
অন্নদা আগে থেকেই বলে রেখেছে, শ্রীধরকে মুগ্ধ করার কোনও ত্রুটি কেন মেনকা না করে। কিন্তু মেনকার যে দেহ মন জুড়ে শুধুই কেশব, কীভাবে সে অন্য এক পুরুষকে সম্মোহিত করবে?
নির্জন কক্ষে এক পরপুরুষের সেবা করতে করতে নীরবেই মেনকার চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে। ভাবে, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো জীবন কেন পেল না সে? কেন কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হতো তাকে! যাও বা একজনকে ভালোবাসল, সেই বা কেন এমন তঞ্চকতা করল? কেন এত ক্ষত তার বুকে!
সে বুঝতেও পারল না, তৈলের সঙ্গে তার অশ্রুও কেশবের হাতের ওপর পড়ে ফোসকা পড়া সেই অংশকে সিক্ত করে তুলছে। লবণাক্ত সেই জল পোড়ার জ্বালা বাড়িয়ে দিলেও শ্রীধর চুপ করে রয়েছে।
৩১
রুদ্রাক্ষ জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রতিবছর কি এইসময়েই ভাদুপুজো হয় তোমাদের এখানে?’
পবন বলল, ‘হ্যাঁ রুদ্রাক্ষ দাদা। মল্লভূম তো বটেই, ওদিকে শিখরভূম, ধলভূম থেকে এদিকে বেত্রগড়, হোমগড়, গোটা রাঢ়ভূমির বড় অঞ্চল জুড়ে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন হয়। এর পেছনে একটা করুণ কাহিনি রয়েছে।’
সামনের প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। একদিকে মহারাজ ও রাজপরিবারের সদস্যদের বসার জন্য অস্থায়ী মঞ্চ, অন্যদিকে উন্মুক্ত অঙ্গণে জনসাধারণের ঢল। পুরুষও রয়েছে যথেষ্ট। সকলে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে মহারাজের শুভাগমনের।
‘করুণ কাহিনি! কীরকম?’
পবন বলল, ‘লোকে বলে এই রাঢ় অঞ্চলেরই কাশীপুরের রাজার কন্যা ছিলেন রূপসী ভদ্রেশ্বরী। বিবাহের দিন ভদ্রেশ্বরীর হবু স্বামী ডাকাতদের হাতে খুন হন। ভদ্রেশ্বরী আত্মহত্যা করেন। তখন সারা রাজ্যে তাঁর স্মৃতিতে ভাদুপুজো শুরু হয়। ভদ্রেশ্বরীর বেশে দেবী দুর্গাই নাকি কিছুদিনের জন্য এসেছিলেন পৃথিবীতে।’
‘এটা মহারাজের ধারণা।’ রঘুনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘মৃন্ময়ী মন্দিরে বার্ষিক পুজোর দিন বলেছেন।’
‘হ্যাঁ।’ পবন বলল, ‘আরও বলেছিলেন, ভদ্রেশ্বরীর যা বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে নাকি শীতলদার স্ত্রীর আশ্চর্য মিল!’
‘ইহ! কোথায় গোলাপফুল কোথায় ভীমরুল!’ রঘুনাথ অদ্ভুত ভঙ্গি করল, ‘রানী ভদ্রেশ্বরী লোককে অপমান করতেন? না সবসময় হুল ফুটিয়ে কথা কইতেন? দাম্ভিক মেয়ে একখানা!’
পবন মুখ টিপে হেসে বলল, ‘অ্যাই, মেয়ে আবার কীরে? তোর বউদিদি হয় রঘু! ঠিক করে কথা বল। শীতলদাদা সেদিন আমায় বলছিলেন, এবার থেকে রোজ সকালে রাজামশাই রানীমার সঙ্গে সঙ্গে বউদিদিকেও তোকে প্রণাম করতে হবে।’
‘কী?’ রঘুনাথ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, অনেকগুলো শঙ্খ বেজে উঠল, একপাশে পুষ্পসাজে সজ্জিত মেয়েরা উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।
‘মহারাজ এসে পড়েছেন!’ পবন অস্ফুটে বলল, ‘কে কোথায় দেখে ফেলবে, ওরেব্বাপ! সেদিন খুড়োর কাছে বেদম মার খেয়েছি।’
মুহূর্তে পবন অদৃশ্য। রঘুনাথ একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, ‘পবন এখন নিজের মাথা বাঁচাচ্ছে। রুদ্রাক্ষদাদা, তুমি এদিকে এসো।’
বীরহাম্বীর হৃষ্টচিত্তে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এমনিতেই তিনি সুপুরুষ, আজকের উৎসবের জন্য বিশেষ সাজ যেন তাঁর শৌর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পাশে শ্রীনিবাস আচার্য।
আজ আবহাওয়াও অনুকূল, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে দক্ষিণ দিক থেকে। মা মৃন্ময়ীর আশীর্বাদে সব আয়োজন উপযুক্ত হয়েছে। তিন রাজরানী তো বটেই, রাজপরিবারের সমস্ত রমণী রয়েছেন পুজোর পুরোভাগে। তবে সর্বাগ্রে চোখ যায় যার দিকে, সে হল সদ্যবিবাহিতা মনোহরা। গাঢ় বাসন্তী রঙের একটি পাটভাঙা কাপড়ে, হাতে কানে গলায় স্বর্ণালংকারে তাকে অপরূপা দেখাচ্ছে।
রুদ্রাক্ষ ও রঘুনাথ মহারাজার কাছে পৌঁছনোমাত্র তিনি লঘুস্বরে বললেন, ‘কী বুঝছ হে! তোমাদের তন্দায় এ’সব হয় নাকি?’
সে স্মিতমুখে দু’পাশে মাথা নাড়ল, ‘না রাজামশাই। ওখানে এ’সব তেমন হয় না।’ পরক্ষণেই কি মনে পড়তে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা মহারাজ, ভাদোই ধানের জন্যে কি এই ভাদুপুজো?’
‘কেউ কেউ বলে বটে। ভাদ্র মাসের আউশ ধান হল ভাদোই। বীরহাম্বীর বললেন, ‘তবে আমি ভাদু বলতে রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরীকেই বুঝি। এই বছরের পুজো দুটি কারণে স্মরণীয়। প্রথম কারণ, পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্রীনিবাস আচার্যকে এইবছরেই আমরা প্রথমবার পেলাম ভাদুপুজোয়। দ্বিতীয় কারণ, মা ভদ্রেশ্বরী এবারে আমার মা হয়েছেন।’
কথাটা বলে বীরহাম্বীর গর্বিত মুখে মনোহরাকে দেখালেন, ‘তুমি তো দেখেছ। আমার বধূমাতা! এবার থেকে মল্লরাজ্য সুখে সমৃদ্ধিতে আরও ভরে উঠবে।’
রঘুনাথ ব্যাজারমুখে কী বিড়বিড় করল শোনা গেল না।
রুদ্রাক্ষ কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পূর্বদিকে অন্তঃপুরবাসিনীদের জন্য নির্দিষ্ট পিছনদ্বার থেকে সুমিষ্ট নারী কণ্ঠে গান শোনা গেল।
এসো এসো ভাদু ধন****আমরা করি আমন্ত্রণ
হৃদয় মন্দিরে এসো গো****রেখেছি পেতে আসন।
কাশীপুরের মহারাজা****করেন ওগো ভাদু পূজা
হাতেতে মা জিলিপি খাজা ****পায়েতে ফুল বাতাসা।
বীরহাম্বীর হৃষ্টমুখে বললেন, ‘এই হল আগমনী গান। গান চলবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারপর সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হবে ভাদুবরণ। তোমরা বসো।’
রুদ্রাক্ষ মন দিয়ে গানটা শুনছিল। পাঁচটা লোকগীতির মতোই সুর। কিন্তু ওর গায়িকার কণ্ঠ যেন চেনা লাগছে।
আরো কিছুক্ষণ গানটা শুনতে শুনতে দেহ সামনের দিকে প্রসারিত করে সে দেখতে গেল, কে গাইছে। কিন্তু দেখার উপায় নেই। এই স্থানের মধ্যে রয়েছে গোটা প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, যাতে জমা হয়েছে অগণিত মানুষ, প্রত্যেকেই সঙ্গীতের তালে দেহ দোলাচ্ছে। কিছু মানুষ বড় বড় পাত্রে সাজাচ্ছে পদ্ম, আউশ ধানের শীষ, মিষ্টান্ন, পান। মহিলাদের হাতে রয়েছে আলতা, সিঁদুর, সুগন্ধি তেল।
রুদ্রাক্ষের উচাটন লক্ষ্য করে বীরহাম্বীর বললেন, ‘ভাদুপুজো মানে কিন্তু এ-পুজোয় কোনো যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র, পুরোহিত নেই রুদ্রাক্ষ। এতে নৈবেদ্য শুধুই ভাদু গান আর নির্মাল্য।’
রুদ্রাক্ষ এবার আর জিজ্ঞাসা না করে পারল না, ‘গান গাইছে কে মহারাজ? বড় সুমিষ্ট গলাখানি!’
‘হ্যাঁ, আমারই এক জ্ঞাতিভগিনী। আমার জ্যেষ্ঠতাত মাধব মল্লর কন্যা।’
রুদ্রাক্ষ বিদ্যুৎপৃষ্ঠ।
হেমনলিনী। সেই কবে প্রদ্যুম্নপুর বাজারে তার গান শুনেছিল। সেই সুললিত কণ্ঠ মনের অবচেতনে লুকিয়ে ছিল, সুরতরঙ্গ চেনামাত্র মন সংকেত পাঠিয়েছে।
প্রদ্যুম্নপুরের পুরোনো রাজবাড়ির আলোআঁধারিতে যে কয়েকমুহূর্ত সে হেমনলিনীকে দেখেছিল, পরেরবার রাজকুমারের বধূবরণের দিন দেখতে পায়নি।
শ্রীনিবাস বাচস্পতি বললেন, ‘হেমনলিনী বিধবা হয়েও পুজোয় গান গাইছে? বাহ, উত্তম।’
‘হ্যাঁ, পণ্ডিতমশাই।’ বীরহাম্বীর বললেন, ‘ভাদুপুজো আনন্দের উৎসব। কুমারী থেকে সধবা, বিধবা থেকে বৃদ্ধা, সবাই এই পুজোয় শামিল হয়। সত্যি বলতে কি, বছরে একটা দিনই হেমকে প্রদ্যুম্নপুর থেকে আনা হয় ভাদুর আগমনী গাইতে।’
আগমনী শেষ হতেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অপেক্ষারত পুরুষেরা মহারাজের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকল। তারপর গেয়ে উঠল,
ই বছর লিয়েছি জমি, ভাগে চাষ কৈরব
বাসমতী চালের কুচুড়ি ঘরে পুরে রাখব।
ভাদু যাবেক শ্বশুরবাড়ি দিব মিঠাই মণ্ডা
গামছা বাঁধা দই দিব, কড়ি চার গণ্ডা।
শেষ হতে না-হতেই অন্যদিক থেকে আরেক দল নাচতে নাচতে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল।
তিং দাং দাং তিনাং নিদাং
পিন্দাড়ে হাত লাগালি
ভাদুলো তুই নাগরে ভুলালি।
ধন্য ধন্য রূপ তোর
করে দিলি নিশি ভোর।
বীরহাম্বীর একটু সসঙ্কোচে বললেন, ‘আসলে কী জানেন পণ্ডিতমশাই, সব শ্রেণির উৎসব তো, তাই আদিরসের গানও থাকে।’
রুদ্রাক্ষ আবার পিছনদিকে তাকাল। হেমনলিনীর গান থেমে গেছে। সম্ভ্রান্ত রমণীদের কোনও আবরণ রয়েছে ওইদিকটায়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
সঙ্গীতের লয় ক্রমেই বেড়ে চলছিল। সঙ্গে নৃত্য। রুদ্রাক্ষের এতক্ষণ একভাবে বসে থেকে ক্লান্তি আসছিল। মহারাজের অনুমতি নিয়ে ও ধাপ বেয়ে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল প্রাঙ্গণের দিকে।
‘কেমন দেখচেন ভাদুপুজো?’ হাসি হাসি গলায় কারুর গলা শুনে রুদ্রাক্ষ ছড়াকার লোকটাকে দেখতে পেল। আকর্ণবিস্তৃত একটা হাসি হেসে সে বলল, ‘পুজো আচ্চা এখনও ভালো লাগে? হে-হে!’
‘লাগবে না কেন?’ রুদ্রাক্ষ চাপা স্বরে বলল, ‘কাজ কতটা এগোল?’
‘কাজ কাজের মতোই এগুচ্চে। ও নিয়ে ভাববেন না।…আপনার খবর কী?’
রুদ্রাক্ষ বুঝল, এই প্রকাশ্য উৎসবে কেশব প্রসঙ্গ উত্থাপনে উৎসাহী নয়। বলল, ‘চলছে। আপনাদের দেশে এসে ভালোই লাগছে।’
কেশব হাসি হাসি গলায় বলল, ‘কালাপাহাড়ের উত্তর ভ্রমণ তো শেষ, তা বিষ্ণুপুরে তিনি কবে পায়ের ধুলো দিচ্চেন?’
রুদ্রাক্ষ অপাঙ্গে কেশবকে দেখল, ‘আমি কী করে অত কথা জানি বলুন তো ছড়াকার মশাই! আমি নেহাতই সুলতানের দূতমাত্র। মহারাজের আশ্রয়ে কয়েকদিন রয়েছি।’
কেশব মুখ দিয়ে একটা হাসির শব্দ করে চুপ করে গেল। রুদ্রাক্ষ আর কিছু বলল না।
প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, ‘আপনাদের এই উৎসবটা সত্যিই বেশ সুন্দর। সব জাতের মানুষ একসঙ্গে যোগদান করেন।’
‘হ্যাঁ দূতমশাই, তা যা বলেচেন!’ কেশব হাত কচলাতে কচলাতে বলতে লাগল, ‘তবে শুদু যে এঁরাই থাকে ভাববেন না যেন, তেনারাও থাকেন!’ কেশব চোখ টিপল।
‘তেনারা মানে?’
‘মানে ওই…! ওইদিকে দাঁড়িয়েছিল দেখেননি? চোখে কাজল, বুকে কাঁচুলি?’
রুদ্রাক্ষ কেশবের আঙুল অনুসরণ করে দূরের অস্থায়ী ছাউনির সামনের কয়েকজন স্ত্রীলোক ছাড়া কাউকে দেখতে পেল না।
কেশব এবার কোমর দুলিয়ে গেয়ে উঠল,
‘সারা নিশি কেটে গেল, কালশশী এল না
শুকাল ফুলের বাসর, মালা দেওয়া হল না।’
ফের চোখ টিপে বলল, ‘যাবেন নাকি? একটু ফুর্তি হবে? আমাদের ধবাডাঙার তো আচেই, গোটা রাঢ় বাংলার সব রাঁড় একসঙ্গে। শুধু পচুন্দ করে তুলে নিলেই হল।’
রুদ্রাক্ষ লোকটার স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এমন রসিকতা করার সাহস কেউ দেখায়নি। ও শান্ত থেকে বলল, ‘না। আমি এগোলাম।’
এগিয়ে চলার ফাঁকে ওর দৃষ্টি চলে গেল ফেলে আসা সম্ভ্রান্ত রমণীদের ভদ্রকের দিকে।
হেমনলিনী কি আজ বিষ্ণুপুরে রাত্রিবাস করবে?
৩২
রঘুনাথ বলল, ‘একটু দাঁড়া। আজ দাদা আসবেন।’
‘বাহ!’ প্রসন্নমুখে বলে উঠল পবন, ‘রুদ্রাক্ষদাদাও খেলা শিখে গিয়েছে, আমরা চারজন হয়েই গেলাম। মাঠ থেকে একজনকে আনলেই হবে।’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘দাদা মানে শীতলকুমার? তিনিও খেলতে আসেন বুঝি?’
‘খুব কম। আসলে দাদা এত ব্যস্ত থাকেন, সময়ই পান না।’
পবন সোৎসাহে পাত্তিগুলি সাজাচ্ছিল। মেজ রাজকুমার শীতল আসেন ছদ্মবেশে। খেলায় পোক্ত না হলেও তিনি সজ্জন প্রকৃতির, রঘুনাথের মতো চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেন না। পবনের প্রতিও তিনি বেশ স্নেহশীল।
মাঝে মাঝে পবন নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যায়, একজন শূদ্রসন্তান হয়েও তার খেলার সাথী কিনা দুই রাজকুমার! সেবার খুড়োর তাকে প্রহারের পর থেকে সে রঘুনাথকে এড়িয়ে চলছিল। কিন্তু রঘুনাথ শুনলে তো! পবন তার সঙ্গে কথা না বললে সে পবনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকায়, নানারকম উৎপীড়ন করে। বাধ্য হয়ে পবনকে কথা বলতে হয়।
‘ওই তো, দাদা এসে গিয়েছেন!’
পবন চমকে উঠে দাঁড়ায়, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে।
শীতলকুমার আজ এসেছে সেনাবাহিনীর পাইক সাজে। হাতে বল্লম, মাথায় পাগড়ি, অঙ্গে আচকান।
কিন্তু সঙ্গে কে? উচ্চতায় কিছু কম, মাথায় শিরস্ত্রাণ, রাজপুত্রের বেশ। মনে হচ্ছে, সে-ই বুঝি রাজকর্মচারী, শীতল তার দেহরক্ষী।
শীতল রুদ্রাক্ষকে হেসে বলল, ‘আপনিও এই আসরের সঙ্গী, জানতাম না!’
রুদ্রাক্ষও হাসল, ‘সবে যোগ দিয়েছি।’
‘বেশ বেশ।’ শীতল ছদ্মগাম্ভীর্য নিয়ে বলল, ‘পবন, তোমার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ে এসেছি। রোজ ফাঁকা মাঠে দৌরাত্ম্য করে বেড়াও, এঁকে হারিয়ে দেখাও!’
শীতল সঙ্গীকে বলল, ‘এখানে তুমি অবগুণ্ঠন খুলতে পারো। সকলেই আমার ভ্রাতৃস্থানীয়। মুখ ঢেকে তো খেলা হয় না!’
মুখাবরণ উন্মুক্ত করতেই রঘুনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘একি দাদা! তুই মানে…বউদিদিকে এভাবে বাইরে নিয়ে এসেছিস? বড়মা জানলে তো কেলেঙ্কারি বাধবে!’
‘বড়মা জানলে তো কেলেঙ্কারিটা বাধবে, কিন্তু জানাবে’টা কে? তুই নিশ্চয়ই নয়।’ শীতল চোখ পাকাল, তারপর রুদ্রাক্ষকে বলল, ‘আমার সহধর্মিণী মনোহরা। দশাবতার খেলায় অত্যন্ত পটু। তাই ভাবলাম তাকে আমাদের এই গুপ্ত আসরে একবার নিয়ে আসি! ভালো করিনি?’
পবনের বুকের মধ্যে কেউ সজোরে ঢাক পিটছিল।
প্রথমবার হেড়ে পাহাড়ের নদীর ধারে যে উচ্ছল মনোহরাকে সে দেখেছিল, সে যেন এখন অনেক পরিণত। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে তাদের এই জরাজীর্ণ আস্তানাটা দেখছে। তার মুখে কোনও প্রসাধন নেই, নেই সামান্য কাজলও। তবু কী সুন্দর!
‘কী ভাই পবন, শুরু করো খেলা?’
শীতলের কথায় পবন খেলা শুরু করতে যাচ্ছিল, মনোহরা ঝুঁকে পড়ে একখানা তাস তুলে নিল। নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, ‘এগুলো কি কার্তিক ফৌজদারের বানানো নাকি? মনে হচ্ছে না তো! আমাদের ওরকগুলোয় সুতির কাপড়ের ওপর তেঁতুল বিচির আঠা থাকে। এগুলোর গন্ধ অন্যরকম।’
‘হ্যাঁ।’ পবন সঙ্কুচিতভাবে বলল, ‘এগুলো আমি বানিয়েচি। তবে আপনি যদি বলেন, এখনই অন্য ওরক আনতে পারি।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে তো।’ রঘুনাথ বলল, ‘পঞ্চকল্যাণের গলায় লাগানো ঝোলাতেই তো আছে। নিয়ে আয় না পবন!’
‘না থাক।’ মনোহরা গম্ভীর মুখে বলল, ‘এগুলোতেই খেলা হোক।’
খেলা আরম্ভ হল। রঘুনাথ অন্যদিন তবু একটু আধটু খেলতে পারে, কিন্তু আজ যেন প্রথম থেকেই ভাগ্যদেবী তার ওপর বিরূপ। একটা ওরকও সে মনের মতো পাচ্ছিল না। তার মুখে ক্রমশই রাগ জমাছিল।
প্রথম পিঠে জিতে গেল মনোহরা। এবং হাত বাড়িয়ে বলল, ‘সবাই এক তঙ্কা করে এখানে রাখো।’
‘তঙ্কা?’ রঘুনাথ হাঁ, ‘কেন? তঙ্কা রাখতে যাব কেন?’
মনোহরা তার সুন্দর গ্রীবা ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে দেখতেই শীতল বলল, ‘ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি রঘু, তোর বউদিদি তঙ্কা বাজি রেখে খেলে। নাহলে নাকি আনন্দ পাওয়া যায় না!’
‘মানেটা কী?’ রঘুনাথের এবার ধৈর্যচ্যুতি হল, ‘এটা কি জুয়াখেলা হচ্চে নাকি, অ্যাঁ? ছি-ছি। না-না, আমরা তঙ্কা দিয়ে খেলব না।’
রুদ্রাক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মনোহরা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠল, ‘ও, আমি বুঝি জুয়াচোর? খেলা যখন আসে না, স্বীকার করলেই হয়! নাচতে না-জানলে দেখি উঠোন বাঁকা!’
রঘুনাথ রেগেমেগে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, রুদ্রাক্ষ থামিয়ে দিল, ‘আহ, একপিঠ খেলার পর এমন গোল করলে হয় নাকি? আচ্ছা, আমি আমার তঙ্কা রাখলাম। পবন, তোমার কাছে না থাকলে বলো, তোমারটা আমি দিয়ে দিচ্ছি।’
‘আপনি ঠাকুরপো’র টাও দিয়ে দিন।’ মনোহরা শ্লেষমিশ্রিত স্বরে বলল, ‘ছেলেমানুষ, কোথায় পাবে তঙ্কা!’
‘থাক। আমারটা আমিই দেব।’ রঘুনাথ তখনো ফুঁসছিল, ‘আর পবন আমার বন্ধু। ওর ভাগের তঙ্কাও আমি দেব। আমার নাম রঘুনাথ মল্ল, খরচ করতে আমি ভয় পাই না। প্রশ্ন নৈতিকতার। চলুক খেলা! দেখি কে কত তঙ্কা জেতে!’
মনোহরা মুখ টিপে হাসল। তার চোখাচোখি হয়ে গেল পবনের সঙ্গে।
৩৩
সামগ্রিক বঙ্গভূমি এখন নানা শাসকের যন্ত্রণায় জর্জরিত। একদিকে সুলতান কররাণীর সেনাপতি ফারমূলী ওরফে কালাপাহাড় আগ্রাসন বাড়িয়ে চলেছেন, অন্যদিকে যশোরে শাসন তুলে নিয়েছেন প্রতাপাদিত্য, খিজিরপুরে ঈশা খাঁ, শ্রীপুরে চাঁদ রায় কেদার রায়। বীরহাম্বীরের মতো তাঁরাও মোঘলদের চোখে ভূস্বামীমাত্র, তাদের নিয়েই স্মরণীয় বারোভূঁইয়া।
কালাপাহাড় এখন উৎকলে। কয়েকমাস আগে কালাপাহাড় মল্লভূম রাজ্যের সীমান্তবর্তী পথ ব্যবহারের জন্য যে অনুমতি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন, তা বীরহাম্বীর মঞ্জুর করেছিলেন। যদিও প্রথমে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন। সেই শ্রীনিবাস আচার্য।
‘কালাপাহাড়ের মতো একজন হিন্দুবিদ্বেষীকে কি আমার সীমান্তপথ ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত? সে তো যাচ্ছে আরেক হিন্দুরাজ্য ধ্বংস করতে! এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে মা মৃন্ময়ী আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন না?’
‘শোনো।’ শ্রীনিবাস আচার্য বলেন, ‘যখন বিভ্রান্তিতে ভুগবে, তখন সমগ্র পরিস্থিতি বিচার করে দেখবে। আচ্ছা, তুমি অনুমতি না দিলে কালাপাহাড় সীমান্তপথ ব্যবহার করবে না? ব্যবহার না করে অন্য পথে গেলেও কি সে তোমার চিরশত্রু হবে না?’
‘না তা নয়…!’ বীরহাম্বীর দ্বিধাগ্রস্ত।
‘উৎকলরাজ হরিচন্দন মুকুন্দদেব তোমার শত্রু। তাঁর শ্যেনদৃষ্টি অনেকদিন ধরেই এই মল্লভূমির উপর ন্যস্ত। প্রায়ই উৎকল সৈন্যরা আমাদের সীমান্তের গ্রামে লুঠপাট করে। অন্যদিকে কালাপাহাড় বিনয় দেখিয়ে তোমার কাছে অনুমতিপত্র চাইছে। এর মানে, তার অভিসন্ধি অন্য। আমাদের মন্দিরনগরীকে সে ছেড়ে দেবে, এই ভাবনা বাতুলতা। সেও অবশ্য তোমার শত্রু। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? তোমার এক শত্রু অন্য শত্রুকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে! তোমার কী করা উচিত?’ ব্রাহ্মণ চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে গেছিলেন।
‘তাহলে অনুমতি দিয়ে দিতে বলছেন পণ্ডিতমশাই? কিন্তু আমার যে এসব রক্তারক্তি আর ভালো লাগে না!’
‘তুমি রাজা! রাজ্যশাসন ও প্রজাদের রক্ষা তোমার সবচেয়ে বড় কর্তব্য। কৃষ্ণপদে শরণ নিয়েছ তো কী হয়েছে? শত্রুকে শত্রু দিয়ে উৎপাটন করা কূটনৈতিক চাল। কথাটা আমি বলছি না। বলেছেন চাণক্য।’ শ্রীনিবাস আচার্য শান্তলয়ে বলে যান,
‘খলানং কণ্টকানাং চ দ্বিবিধৈব প্রতিক্রিয়া
উপনামুখভঙ্গো বা দূর তৈব্য বিসর্জনম।।’
সমস্ত কপট হল কন্টকের তুল্য। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়।’
‘অর্থাৎ, আমি কালাপাহাড়কে এখন কিছু বুঝতে দেব না, সে গিয়ে উৎকল আক্রমণ করবে, যে পক্ষই হারুক, আমার লাভ, তাই তো, পণ্ডিতমশাই?’
‘বিলক্ষণ! শ্রীনিবাস আচার্য সম্মতি দিয়েছিলেন, ‘হতে পারে সুলতান কররাণী এর আগে দু-দুবার মুকুন্দদেবের কাছে পরাস্ত হয়েছেন, এবার সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। মুকুন্দদেব নিজে এখন বৃদ্ধ, কালাপাহাড়ের উন্মত্ততা ও নৃশংসতার সামনে তার সৈন্যরা দাঁড়াতে পারবে না। কালাপাহাড় উৎকল জয় করবেই।’
‘তার মানে উৎকলরাজ্যের অসংখ্য মন্দির…জগন্নাথ ধাম…সব শেষ!’ ধর্মপ্রাণ বীরহাম্বীর মূক হয়ে গিয়েছিলেন।
শ্রীনিবাস আচার্য আবার বলেছিলেন, ‘তুমি প্রস্তুত থেকো, ফেরার সময় কালাপাহাড়ের সঙ্গে মোকাবিলার। আর লক্ষ্য রেখো ‘ঘরশত্রু বিভীষণদের!’
‘কী বলছেন!’
‘ঠিকই বলছি। বলো তো, কালাপাহাড়ের মল্লরাজ্য আক্রমণে কারা লাভবান হবে?’
‘কেউ হবে না।’ দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়েছিলেন বীরহাম্বীর, ‘কালাপাহাড় একজন হিন্দুবিদ্বেষী, যার কাজই হল বিধর্মীদের উপর ধ্বংসলীলা ও পাশবিক অত্যাচার।’
‘এসব আবেগতাড়িত কথা। বিশ্ব সংসারে মানুষই সেই প্রাণী, যাকে ঈশ্বর দিয়েছেন উন্নততর মস্তিষ্ক। লাভ-লোকসানের জটিল অঙ্ক সবসময় সহজ সমীকরণে চলে না।’
বীরহাম্বীর শ্রীনিবাসের দিকে নির্নিমেষে চেয়েছিলেন। গুরুর সহজ ভাষায় বলা কথাগুলো দুর্বোধ্য ঠেকছে।
শ্রীনিবাস আচার্য স্পষ্টভাবে বললেন, ‘এই রাজ্যে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা মল্লভূম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি করে চায় তোমাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে। তারাই জোটবদ্ধ হচ্ছে।’
‘আমাকে সরিয়ে তাদের লাভ?’
‘লাভ একটাই, তারা হবে মল্লরাজ্যের অধীশ্বর!’
‘কিন্তু…কালাপাহাড় যদি মল্লরাজ্য অধিকারই করে নেয়, সে তো নিজেই সিংহাসনে বসবে! বীরহাম্বীর রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা তো সিংহাসন পাবে না। তা কি তারা বুঝছে না?’
‘কালাপাহাড়কে আমি চিনি, বীরহাম্বীর!’ শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘মল্লরাজ্যে সে রাজত্ব করার জন্য আসছে না।’
‘তবে? কী অভিপ্রায়ে তবে তার এই দুরভিসন্ধি?’
‘উৎকলে কি সে রাজত্ব করতে গিয়েছে? না। গিয়েছে বুক পুড়ে যাওয়া অপমানের প্রতিশোধ নিতে! ঠিক তেমনই সে আসবে মল্লরাজ্যে। মন্দিরনগরী, তাই।’
বীরহাম্বীর অস্থিরভাবে বলেন, ‘কিন্তু কারা তার আগমনে খুশি হবে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না পণ্ডিতমশাই।’
‘বোঝার সময় এখনও হয়নি, বীর! উপযুক্ত সময়ে আমিই তোমায় বলব। এখন তুমি শুধু চোখকান খোলা রাখো।’
৩৪
আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি রাঢ় বাংলায় পরিচিত নলসংক্রান্তি নামে। নলসংক্রান্তির দিন স্বয়ং রানী শিরোমণি নলপুজো করেন।
এই অঞ্চলের প্রধান শস্য আমন ধান। ধানগাছ গর্ভবতী হওয়ার সময় তাকে সাধ খাওয়ানোর রীতিই হল নলপুজো। মহারানী শস্যের সমৃদ্ধি কামনা করে রাজপ্রাসাদে ব্যঞ্জনসহযোগে পুজো করেন। কৃষকরা মাঠে ওল, মানকচু, সর্ষে, আতপ চাল দিয়ে ধানগাছকে সোহাগে ভরিয়ে দেয়।
অন্তঃপুরে মহারানীর পাশে বসে মনোহরা মালা গাঁথছিল। প্রসাদের পাত্র সাজাচ্ছিলেন জগতকুমারের স্ত্রী অহল্যা। মেনকা বিদ্যুৎলতার মতো কক্ষে প্রবেশ করছিল, আবার কোন কাজে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল। মনোহরা ফিক করে হেসে বলল, ‘শ্রীধর খুড়ো কি আজ অন্দরমহলে এসেছে নাকি গো?’
‘শ্রীধর?’ শিরোমণি বললেন, ‘না-না, শ্রীধর কই! সে তো মহারাজের সঙ্গে গোপগ্রামে গিয়েছে!’
‘ওহ!’ মনোহরা মুখে কৃত্রিম বিষাদ ফুটিয়ে বলল, ‘মেনকামাসি বারবার নীচে ছুটছে তো, তাই ভাবলুম বুঝি…!’
মেনকা ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। মনোহরা মহারানীর পুত্রবধূ হওয়ার পর মেনকা পড়েছে আতান্তরে। মনোহরাকে সে খুব ভালোবাসে, কিন্তু আগে যে শাসনটুকু করত, তা আর করতে পারে না। পরিচারিকা হয়ে আর যাই হোক, যুবরানীকে শাসন করা যায় না।
এদিকে রাজপুত্রের সঙ্গে বিবাহের পরও মনোহরার গাম্ভীর্য আসেনি, একইরকম আমুদে রয়ে গিয়েছে।
মেনকা তবু কাতরগলায় বলল, ‘আপনিই দেখুন রানীমা, আমাকে কীরকম জ্বালাতন করে!’
মনোহরা তবু হেসে হেসে বলল, ‘একটা কথা বলো তো, তোমাকে আমি কী বলে ডাকব? মেনকামাসি না মেনকাখুড়ি? হি-হি!’
‘বড়দের সামনে খুব ডেঁপোমি হচ্ছে, না?’ অহল্যা হেসে বললেন, ‘নেহাত মাটির তালের মতো শাশুড়ি পেয়েছিস বলে এ-যাত্রা বেঁচে গেলি। গুনুর গুনুর শাশুড়ি হলে বুঝতিস কত ধানে কত চাল!’
‘গুনুর গুনুর শাশুড়ি!’ মনোহরা অবাক, ‘সে আবার কী?’
শিরোমণি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এবার বললেন, ‘ওমা সেই ছড়াটা শুনিসনি?
ছোট সরাটি ভেঙে গেছে বড় সরাটি আছে
গুনুর গুনুর কোরো না বউমা, হাতের আটকাল আছে।।’
‘মানে?’
‘মানে হল, শাশুড়ি রোজ ছোট সরাতে করে বউকে খেতে দেয়। বউয়ের পেট ভরে না। ছোট সরাটা একদিন ভেঙে গেছে। বউ খুব খুশি। সে ভাবছে এবার শাশুড়ি তাকে বড় সরার মাপে খেতে দেবে। শাশুড়ি তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলছে, সরা ভাঙলে কী হবে, আমার হাতের মাপ আছে। সেই মাপেই তোমাকে খেতে দেওয়া হবে।’
মনোহরা হেসে কুটিপাটি।
‘আরও একখানা মনে পড়ছে।’ শিরোমণি বলেন,
‘সাত বউকে এক আস্কা, খড়কার ডগে ঘি
গুঁজুর গুঁজুর করছ বউরা, খেতে লারছ কি?
সাত বউকে একখানা মাত্র আস্কে পিঠে নামমাত্র ঘি দিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে। বউদের মধ্যে অসন্তোষের গুঞ্জন দেখে শাশুড়ি বলছে, কী হল? এতখানি পিঠে কি খেতে পারছ না তোমরা?’
মনোহরা এবার আরও জোরে হেসে ওঠে।
মেনকা ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ‘হুঁহ, ওইরকম একখান শ্বাশুড়ি হলে তোমার বেশ হত।
‘এমন মজার ছড়া জন্মে শুনিনি!’ মনোহরা হেসেই যায়, ‘তুমি কোত্থেকে শুনলে, মা?’
‘আরে, এটা তো কেশব ছড়াকারের ছড়া! তোদের বে’তে ছড়াগুলো বাঁধল মনে নেই?’ অহল্যা দূর থেকে বললেন।
মনোহরা মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘হুঁ। সামনে আরেকখানা বে আসচে, তাকে আবার ছড়া বাঁধতে হবে। তবে এই বে’তে বউয়ের শাশুড়ি নেই, ঝঞ্ঝাটও নেই। যাই, কেশবখুড়োকে গিয়ে কাজ শুরু করতে বলি!’
মেনকা এতক্ষণ হাসছিল, হঠাৎ তার মুখটা কালো হয়ে গেল। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে চলে গেল বাইরে।
৩৫
বীরহাম্বীর রাজ্যের সমৃদ্ধি ও পরাক্রম যতই বাড়িয়ে চলছিলেন, দিল্লীশ্বর আকবরের সিপাহশালার ততই কুপিত হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের চোখে ভূ-স্বামীর বাড়াবাড়ি পছন্দ হচ্ছিল না। মাঝে-মাঝেই রাজা কর ফাঁকি দিয়েছেন, যে বছর হিসাবমতো দিয়েছেন, মোঘল সেনা রাজস্ব তুলে মল্লভূমি পেরোনো মাত্র লোকলস্কর পাঠিয়ে ডাকাতের ছদ্মবেশে তা লুঠ করে নিয়েছেন।
মোঘল সিপাহশালার বুঝতে পারতেন সবই। অবাক হয়ে ভাবতেন, হাজার হোক বীরহাম্বীর রাজ মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। সেই তিনিই আড়াল থেকে ‘ডাকাতি’ আয়োজন করছেন! এইভাবে ঠকাচ্ছেন মোঘলদের ন্যায্য কর! ‘ডাকাতরাজা’-র প্রতি তাঁদের ক্রোধ ক্রমশই বাড়ছিল।
এর উপর বীরহাম্বীর গোপগ্রামের কামানঢালাতে এমনসব কামান বানাতে লাগলেন যে ইন্দ্রহাস ও রায়না মহলের মোঘল সেনারা আশঙ্কিত হয়ে উঠল।
শুধু গোপগ্রাম নয়, প্রদ্যোৎগড় ও কুম্ভলস্থলগড়ের অরণ্যে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে এলেন আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণে সুশিক্ষিত মিরদাহা কারিগরদের। মিরদাহা কারিগরেরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে কামান ও অস্ত্রনির্মাণে দক্ষ করে তুলল স্থানীয় শ্রমিকদের। তৈরি হতে লাগল একের পর এক সুবিশাল কামান। কোনটার নাম গোরক, কোনটা ঝুলঝাড়া, কোনটা আবার বাঘমুয়া। সেইসঙ্গে তৈরি হচ্ছিল লাগল রাশি রাশি ঢাল, তলোয়ার, বল্লম। সবচেয়ে বড় কামানটির নাম দলমাদল। বলয় আকৃতির তেষট্টিটা পেটাই লৌহ ফলককে ঝালাই করে ২৯৬ মণের এই বিধ্বংসী কামান তৈরি করল জগন্নাথ কর্মকার নামে এক ওস্তাদ কারিগর।
এখানেই শেষ নয়। শ্রীনিবাস আচার্যের পরামর্শে বীরহাম্বীর এখানে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে শুরু করলেন। প্রথমেই নির্মিত হল দুটো দুর্গ। সেই দুই দুর্গ একইসঙ্গে ব্যবহার করা যাবে প্রবেশপথ হিসেবেও। তাই তাদের নামকরণ করা হল পাথরদরজা। আকারে একটি বড়, অন্যটি ছোট।
আগাগোড়া মাকড়া পাথরে নির্মিত এই পাথরদরজা দুটো উচ্চতায় ও প্রস্থে বেশ বড়, এদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নির্মাণ করা হল পত্রাকৃতির খিলান পথ। পথের অভ্যন্তরে তৈরি করা হল বিশাল দরজার মতো দুটো কুলুঙ্গি। সেই কুলুঙ্গিতে অষ্টপ্রহরের জন্য নিযুক্ত করা হল দ্বাররক্ষীদের।
বীরহাম্বীর ও শ্রীনিবাস আচার্য এসে কর্মকাণ্ড নিয়মিত তদারক করতে লাগলেন।
শ্রীনিবাস আচার্যের পরামর্শে খিলানের ছাদের নীচের দিক করা হল গম্বুজ আকৃতির। খোদাই পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হল ছাদের আড়ালি দেওয়াল। পরিদর্শনে এসে আচার্য বললেন, ‘এই যে আড়ালি দেওয়ালের মধ্যে ছোট ছোট গর্তগুলো দেখছ, এখানে চোখ রেখে ভিতরে বসে সৈন্যরা যুদ্ধের সময়ে বিষাক্ত তীর বা গোলাগুলি ছুঁড়তে পারবে।’
বীরহাম্বীর চমৎকৃত। বললেন, ‘বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের কলাকৌশল এত বিশদে আপনি কীভাবে জানলেন প্রভু?’
‘সে কী! বেদ জানি বলে সমরকৌশল জানব না?’ স্মিতমুখে বলেন আচার্য, ‘পঞ্চম বেদ অর্থাৎ মহাভারতে যে প্রকারের ব্যুহ, রণনীতির কথা বলা আছে, সেই কৌশল দিয়ে পরাস্ত করা যাবে না, এমন সৈন্যদল যে ভূভারতের নেই, বীর! ভুলে যেও না, যার বিরুদ্ধে তোমার লড়াই, সে নিজে কিন্তু রামায়ণ থেকে মহাভারত, উপনিষদ থেকে আরণ্যক গুলে খেয়েছে।’
গুরুর উপদেশে বীরহাম্বীর দুই দরজার দেওয়ালের ছাদে নিযুক্ত করলেন সশস্ত্র সৈন্যদের। প্রথম ও দ্বিতীয় দুয়ারের মাঝে খনন করা হল সুগভীর এক খাদ, যেখানে সবসময় জলস্রোত বহমান।
অতঃপর রাজদরবার ও রাজদুর্গকে কেন্দ্র করে স্তরে স্তরে সাত স্তবক সুগভীর পরিখা খনন হল। নির্মিত হল জলদুর্গ। পরিখার পাড়ে পাড়ে রোপিত হল বিষাক্ত কাঁটা গাছ ও লতাগুল্ম। পরিখার নিয়মিত তদারকির জন্য মুলকিমজুর রইল প্রতিহারীরা। পরিখার পাড়ে স্থাপন করা হল কামান। সেখানে সর্বক্ষণ থাকছে অস্ত্রধারী সৈনিক।
শুধু রাজধানীতেই নয়, অসুরগড়, বেত্রগড়, হোমগড়ের মতো বহু দুর্গ নির্মিত হচ্ছিল রাজ্যের দিকে দিকে। সব কাজই সম্পন্ন হয়ে গেল প্রায় ঝড়ের বেগে, কয়েকটি মাত্র চান্দ্রমাসের মধ্যে।
মল্লরাজার প্রস্তুতি দেখে মোঘল সিপাহশালার যখন উৎকণ্ঠায়, ঠিক সেইসময় তাঁর কাছে খবর এল, ফারমুলী মল্লরাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন। মোঘল সিপাহশালার উল্লসিত। এ তো সুবর্ণসুযোগ! গোপনে তিনি হাত মেলালেন পাঠান সেনাপতির সঙ্গে।
এইসব ঘটনাস্রোত যখন ঘটে চলছিল রুদ্রাক্ষ তখন কোথায়? সে গুছিয়ে বসেছে বিষ্ণুপুরের রাজদরবারে। দ্রুত সে মহারাজের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে।
তার বন্ধু ফারমুলী যে দুটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন তার একটি সে বলতে গেলে, করেই ফেলেছে। তার বিষ্ণুপুরে আসার পর একবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অন্যান্য কুমারদের মহলে সে ঘুরে ঘুরে জানতে চেষ্টা করেছে, কার অসন্তোষ ঠিক কতখানি।
কখনও সে সঙ্গোপনে চলে গিয়েছে প্রদ্যুম্নপুরে। মাধব মল্লের সঙ্গে চলেছে ষড়যন্ত্র। তখন হেমনলিনীকে চোখের দেখা দেখে মন ভালো করেছে।
কখনো গিয়েছে হিকিমমহলেও। জগতকুমারের সঙ্গে কাটাতে হয়েছে সময়।
কিন্তু ফারমুলীর ন্যস্ত দ্বিতীয় কাজটিতে একটুও এগোতে পারেনি। রাধামোহন লাহিড়ীর সন্ধান পায়নি। এখন সে বলতে গেলে গোটা মল্লভূমির প্রতিটি লাহিড়ী পদবীর মানুষকে চেনে। তাতে লাভ হয়নি।
বাধ্য হয়ে সে ফারমুলীকে লিখেছে, ‘রাজু, আমার মনে হয় না, রাধামোহন লাহিড়ী তন্দা থেকে মল্লরাজ্যে এসেছিলেন। এখানে আমি ব্যক্তিগত এবং রাজসহায়তা, দু’ভাবেই খুঁজেছি। পাইনি।’
‘তুমি কি নিশ্চিত, রাধামোহন লাহিড়ী কখনও ওখানে যাননি?’
‘সম্ভবত না। কারণ, রাজধানী বিষ্ণুপুরের লাহিড়ীপাড়া ছাড়াও গোটা মল্লরাজ্যে আমি ভালো করে সন্ধান করেছি। দুই কন্যা নিয়ে ওই নামের কেউ গত দুই দশকে এখানে আসেননি!’
৩৬
ফারমুলী এখন তাণ্ডব চালাচ্ছে কামরূপে। কামরূপের রাজা নরনারায়ণ, সেনাপতি শিলা রায়। শিলা রায়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপে কামরূপ সাম্রাজ্য ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু কালাপাহাড় যখন কামরূপ আক্রমণ করলেন, শিলা রায় তখন ছিলেন না। কালাপাহাড়ের পাঠান বাহিনী কামরূপ ছিন্নভিন্ন করল, পবিত্র কামাখ্যা মন্দির ধ্বংস ও বিগ্রহ চূর্ণ করল। বহু হিন্দু দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল!
কালাপাহাড় রুদ্রাক্ষকে লিখল, ‘উত্তর ধ্বংস হয়েছে। এবার উৎকলের পালা। আসছি! ফেরার পথে সাক্ষাৎ হবে। সব ঠিক করে রেখো।’
রুদ্রাক্ষ এখনও রাজ অতিথিভবনেই থাকে, মাঝেমধ্যে মহারাজের কোন প্রমোদভ্রমণে সঙ্গী হয়, আবার কখনও রঘুনাথের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
একেকসময় সে নিজেই ভেবে পায় না, কেন এই মহাপাপে সে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তন্দায় সে রয়েছে অনেক বছর, ফৌজদার থেকে রাজীবলোচনের সুলতানের জামাতা, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ধর্মান্ধ মহম্মদ ফারমুলী হয়ে ওঠা, সব পরিবর্তনের সে সাক্ষী। দুজনের শৈশবের বন্ধুত্বও থেকে গেছে অটুট। এমনকী বন্ধুর জন্য রুদ্রাক্ষও গ্রহণ করেছে ইসলাম ধর্ম। অবশ্য সে কথা এদেশে কেশব ছড়াকার ছাড়া কেউ জানে না।
মহারাজা বীরহাম্বীরের সঙ্গে রুদ্রাক্ষের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তিনি জানেন, রুদ্রাক্ষ কালাপাহাড়ের বাল্যসখা। মহারাজ একদিন ওকে জিগ্যেসও করেছিলেন, একজন ব্রাহ্মণ সুপণ্ডিত হয়েও কালাপাহাড়ের এমন পরিবর্তনের কারণ কী।
রুদ্রাক্ষ সেদিন হেসে বলেছিল, ‘এই হিংসা, ক্রোধোন্মত্ততার পেছনে কালাপাহাড়ের যন্ত্রণাটা যে কতখানি তীব্র সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারি মহারাজ। ও অবশ্য আমার কাছে শুধুই রাজু। যবনকন্যাকে বিবাহ করার জন্য ওকে অকথ্য অপমান সহ্য করতে হয়েছিল।’
তারপর রুদ্রাক্ষ বীরহাম্বীরের কাছে একে একে খুলে বলেছিল নানা ঘটনা। ভাদুড়িয়া গ্রামে শৈশবের খেলাধুলো থেকে কৈশোরে গৌড়ে গিয়ে পণ্ডিত সায়নাচার্যের চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন, শিক্ষার্থে রাজুর বৃন্দাবন গমন, তার বিবাহ থেকে শুরু করে তন্দায় এসে ফৌজদার হয়ে সুলতানের সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু, এই পুরো সময়েই তার আর রাজুর বন্ধুত্ব ছিল অটুট।
রাজুর বিবাহের সময় রুদ্রাক্ষ ছিল তন্দায়, তাই তার বিবাহকালটুকু বাদ দিলে তার গোটা প্রথম জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে রুদ্রাক্ষ। দুই বন্ধু একইসঙ্গে বড় হয়েছে।
সংঘাত বেধেছিল রাজু সুলতানের জামাতা হওয়ার পর। গোটা ভাদুড়িয়া গ্রাম ও স্বয়ং পিতামহও যখন যবনকন্যাকে বিয়ে করার অপরাধে রাজুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তখন রাজুকে শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে জগন্নাথমন্দিরে প্রায়শ্চিত্ত করার পরামর্শ রুদ্রাক্ষই দিয়েছিল।
কিন্তু ফল হল সম্পূর্ণ বিপরীত। জগন্নাথমন্দিরের পাণ্ডাদের নিষ্ঠুরতায় রাজু আমূল বদলে গেল, সারাজীবনের জন্য। ধীর স্থির বেদজ্ঞ পণ্ডিত থেকে রূপান্তরিত হল অসহিষ্ণু এক ধর্মোন্মাদ যুদ্ধনেতায়। রুদ্রাক্ষ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কোনো ফল হয়নি। রাজুর নৃশংসতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
সব জেনেও রুদ্রাক্ষ সরে আসতে পারেনি শুধুমাত্র ওই কঠিন বর্মের ভেতরে, ওই নির্মমতার গভীরে যে প্রচণ্ড ব্যথাপ্রবণ আঘাত পাওয়া হৃদয় রয়েছে তার কথা ভেবে। বিস্ময়ের ব্যাপার, রাজু সকলকে ধর্মান্তরিত করার জন্য নৃশংস পথ অবলম্বন করলেও নিজের বন্ধুকে কখনো এই ব্যাপারে জোর করেনি। রুদ্রাক্ষ স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছিল। রাজীবলোচন ও রুদ্রাক্ষের বন্ধুত্ব পরিবর্তিত হয়েছে ফারমুলী-রহমানের দোস্তিতে।
এরপর মহানন্দা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে, তবু সবেতেই রাজুর সঙ্গী থেকেছে রুদ্রাক্ষ।
এইসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে ইতস্তত রাজপ্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছিল রুদ্রাক্ষ, তার চোখে পড়ল মৃন্ময়ী মন্দিরের পিছন থেকে মহিলাদের উলুধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
রুদ্রাক্ষ কৌতূহলী হয়ে কিছুটা এগোতেই দেখতে পেল রাজজ্যোতিষী দেবনাথ বাচস্পতি মৃদু লয়ে হেঁটে আসছেন। প্রসন্ন মুখ।
রুদ্রাক্ষ করজোড়ে প্রণাম করল, ‘কেমন আছেন বাচস্পতিমশাই?’
দেবনাথ বাচস্পতি রুদ্রাক্ষের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ‘উত্তম। শুনেছ তো, রাজবাড়িতে নতুন অতিথি আসতে চলেছে?’
‘নতুন অতিথি?’
‘হ্যাঁ। মধ্যম রাজপুত্র শীতলকুমার পিতা হতে চলেছেন। আজ তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের মঙ্গলকামনায় পুজো ছিল মৃন্ময়ী মন্দিরে। মায়ের আশীর্বাদে সব কিছু ভালভাবে মিটুক। জয় বাবা মল্লেশ্বর!’
রুদ্রাক্ষ অস্ফুটে শুধু একবার বলল, ‘জয় বাবা মল্লেশ্বর!’
ওর অন্তঃস্থল কেঁপে উঠল।
৩৭
অনাড়ম্বরভাবে হয়ে গেল মেনকার সঙ্গে শ্রীধরের বিবাহ। যদিও মহারাজ ও মহারানী চেয়েছিলেন সাড়ম্বরে হোক, মেনকা কিছুতেই সম্মত হয়নি। মুখে বলল, ‘কিছুদিন বাদেই রাজবাড়িতে নতুন অতিথি আসছে, তখনই ধুমধাম হবে’খন। দাসী বাঁদির বে’তে আবার মোচ্ছব কীসের? আপনাদের ভালোবাসা পাচ্চি, এই আমার কত ভাগ্যি!’
আরও একটি ব্যাপারেও মেনকা রাজি হল না। সে হল কূলদেবী মৃন্ময়ী মন্দিরে বিগ্রহের সামনে বিবাহ করতে। তার এক কথা, ‘ওখানে দিনের পর দিন বলি হতে দেখেছি। আর কোনও মন্দির নেই বুঝি রাজ্যে!’
আসল কারণ অন্য। ওই মৃন্ময়ী মন্দিরের পাশ দিয়ে সে যখন কেশবের কাছে অভিসারে যেত, মনে মনে মায়ের কাছে কেশবকেই পতিরূপে পাওয়ার কামনা করত। ফিরে আসার সময় গিয়ে বসত দালানে। ভাবত এই মন্দিরেই একদিন তার সীমন্তে সিঁদুর পরিয়ে দেবে কেশব! সেই মন্দিরেই এখন অন্য এক পুরুষকে বিবাহ কী করে করবে মেনকা?
শেষে এগিয়ে এলেন শ্রীনিবাস আচার্য। বললেন, ‘দুই প্রাণের মিলন হওয়া নিয়ে তো কথা! আমিই নাহয় বৈষ্ণবমতে ওদের বিবাহ’টা দিয়ে দিই!’
মহারাজের খাস পরিচারকের সঙ্গে মহারানীর খাস পরিচারিকার বিবাহ সুসম্পন্ন হল। শ্রীধর আগে থাকত পরিচারকমহলের এক প্রকোষ্ঠে। মহারাজের আদেশে দুর্গাপ্রসাদ ঘোষ তাকে হিকিমমহলের পিছনে একটা দালান বানিয়ে দিলেন। বিয়ের পর মেনকা সেই গৃহে শ্রীধরের ঘরণী হয়ে প্রবেশ করল।
বিবাহের আগের রাতে অন্নদা এসেছিল মেনকার কাছে। মেনকা তখন আহারান্তে শুয়ে নেওয়ার উদ্যোগ করছিল। ভোরবেলা উঠতে হবে।
অন্নদা এসে তীক্ষ্নচোখে পাত্রীকে কিছুক্ষণ দেখল। তারপর বলল, ‘সেই হতচ্ছাড়াকে তো ক’দিন ধরে বিষ্ণুপুরের চৌহদ্দিতে দেখতে পাওয়া যাচ্চে না। আমি অনেক লোক লাগিয়েছি। কেউই সন্ধান দিতে পারেনি। তোর শোকে গলায় কলসি দড়ি বেঁধে ডুবে মরল নাকি?’
মেনকা চুপ করে রইল। এই সংবাদ সে আগেই শুনেছে। গত সাতদিন ধরে কেশব নিরুদ্দেশ।
কোথায় গেল সে? মেনকার বিয়ে শুনে সে কি দেশান্তরী হল? এতই যদি দুঃখ, তবে কেন সে মেনকাকে বিয়ে করল না? মেনকার দেহমন জুড়ে এখনও তো শুধু সে-ই! সে জানে কেশব মিথ্যাচারী, দুর্বৃত্ত, লম্পট, তবু একবার যদি এসে সে মেনকার সামনে দাঁড়ায়, তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়, মেনকা সবকিছু উপেক্ষা করে, সবাইকে অগ্রাহ্য করে চলে যাবে তার কাছে!
ভালোবাসা এতটাই অসহায়, এতটাই অন্ধ!
মেনকার বুকে উথালপাথাল। অন্নদা বলেছিল, ‘মরলে তো হাড় জুড়োয়। কিন্তু তলে তলে অন্য কিচু করতে গেচে কিনা সেই নিয়েই চিন্তা হচ্চে।’
‘অন্য কিচু! মানে?’
অন্নদা মুখ শক্ত করেছিল। তারপর মেনকার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘ওই নচ্ছারটা চেয়েছিল, তুই সারাজীবন বে’ না করে ওর রক্ষিতা হয়ে থাকবি। সেই রাগে শয়তানটা যদি আমাদের আসল পরিচয় বের করে ফেলে…!’
বুক কেঁপে উঠেছিল মেনকার। প্রাণপণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে বলেছিল, ‘না না। পারবে না। পারার হলে এতবছরেই তা পারত।’
অন্নদা আর কিছু বলেনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রস্থান করেছিল।
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তার জীবন যে এইভাবে বদলে যাবে, শ্রীধর কস্মিনকালেও ভাবেনি। তার বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। এও কি সম্ভব! সে সারাক্ষণ নিজেকে মহারাজের সেবায় ন্যস্ত রেখেছে, অন্য কোনদিকে তাকানোর সুযোগ বা আকাঙ্ক্ষা কোনওটাই হয়নি, আর তার ভাগ্যেই কিনা আসতে চলেছে এমন এক যুবতী, যাকে গোটা ভৃত্যকূল মনে মনে যাঞা করে।
শ্রীধর শৈশবেই অনাথ। সে বেদনা ভুলতে দিনরাত মেতে থাকে পাখি নিয়ে। পুরোনো বাসস্থানে শত ব্যস্ততা সামলেও সে প্রায় পঞ্চাশটি পাখি পুষেছিল। পায়রা থেকে শুরু করে শালিক, ময়না, টিয়া, কত পাখিদের সে পরমস্নেহে লালন করে।
দিনান্তে ক্লান্ত দেহে সে যখন ঘরে ফেরে, ওই পাখিদের পরিচর্যাতেই কেটে যায় বাকি সময়। নিজের মাতৃসঙ্গটুকু সে পায়নি, নারীদের সঙ্গে কীভাবে বাক্যালাপ করতে হয়, কীভাবে তাদের তুষ্ট করতে হয়, সবেতেই সে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।
তাই এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে সহভৃত্যরা তার রঙ্গ-রসিকতা করেছে, মনে মনে ঈর্ষান্বিতও হয়েছে, কিন্তু শ্রীধর নিজে এখনও অভিভূত, কিঞ্চিৎ বিহ্বলও।
তাই বিবাহের পরের প্রথম রাতে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর দিকে সে ভালো করে তাকাতেই পারছিল না।
তাকাতে ইচ্ছা করছিল না মেনকারও। অন্নদার চাপে সে শ্রীধরকে বিবাহ করেছে, কিন্তু মনে মনে তো তার পতি কেশব। তার পূর্বে শৈশবে যার কণ্ঠে বরমাল্য দিয়েছিল, তাকে আর মনে পড়ে না। কিন্তু যে ওর যৌবনের প্রতিটি পর্বে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে, তাকে বিস্মৃত হওয়া কি এতই সোজা?
বেশ কিছুসময় ফুলশয্যায় দুজনে নির্বাক নিশ্চল রইল। তারপর শ্রীধর বলল, ‘আমি একলা মানুষ…সারাদিন রাজামশাইয়ের সেবায় ব্যস্ত থাকি। তাঁরই অনুগ্রহে এই নতুন বাড়ি। তুমিই এই বাড়ির কর্ত্রী। তোমাকেই সব সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে হবে।’
মেনকা চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘ঠিক আছে।’
সামান্য ইতস্তত করে শ্রীধর বলল, ‘চালচুলোহীন হয়ে বিয়ে করেছি, তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। তাই এইটা যদি…!’
প্রদীপের ম্লান আলোয় মেনকা দেখল, শ্রীধরের দুই হাতের মাঝে তিরতির করে কাঁপছে একটা পায়রা। বোঝা যায়, একেবারে সদ্যোজাত। এতক্ষণ সম্ভবত সে শ্রীধরের হাতের উষ্ণতায় নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল, এখন চমকে জেগে উঠে পিটপিট করে দেখছে।
মেনকা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাতেই শ্রীধর কিছুটা অপরাধীর সুরে বলল, ‘লাল বলছিল, তুমি পায়রা খুব ভালবাসো। আমারও বড় প্রিয়। ওর মা মঙ্গলা আমার সবচেয়ে বাধ্য পাখি। আজই ডিম ফুটে বেরিয়েছে। কী সুন্দর, না?’
মেনকা মাথা নাড়ল। পায়রাটা সত্যিই বড় সুন্দর। উজ্জ্বল দুধসাদা রঙে পূর্ণ ছোট্ট দেহটা, গলার কাছটা ছোট্ট একটা কালো অংশ, যেন তিল! ঠোঁট আর পা’গুলো টকটকে লাল, যেন এখুনি রক্ত বেরিয়ে আসবে।
শ্রীধর একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘দেখতে এত সুন্দর, ওরও নাম রেখেছি তোমার নামে। মেনকা। ভালো মানিয়েছে না?’
মেনকা বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে।
শ্রীধর একটু ইতস্তত করে বলে, ‘মেনকাকে নিয়ে তুমি খাটে ভালো করে শোও। আমার এই কোণাটুকুতেই হয়ে যাবে।’
মেনকা এবার চমকে তাকাল। প্রেমিক মানেই সে এতদিন জেনে এসেছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে বলপূর্বক নিজের কাম চরিতার্থ করা, সঙ্গমশেষে ফেলে উঠে যাওয়া, কথায় কথায় আঘাত করার নামই পৌরুষ।
এর বাইরেও যে অন্যরকম কেউ হয়, যে পুরুষ কিনা একটা সদ্যোজাত নির্মল প্রাণ ফুলশয্যায় স্ত্রীকে উপহার দিতে পারে, অপরিচিতা স্ত্রীকে সম্মান দিতে পারে, মেনকা সেটা আবিষ্কার করে খুব অবাক হয়ে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
৩৮
কিছুদিনের মধ্যেই আগুন জ্বলে উঠল। সুবিশাল পাঠানবাহিনী নিয়ে দাবানলের মতো কালাপাহাড় শ্রীক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন। রাতের অন্ধকারে মল্লভূমের অরণ্যরাজ্য পেরিয়ে উন্মত্ত পশুর মতো তারা ছুটতে লাগল উৎকলের দিকে। গোটা উড়িষ্যা জুড়ে কেঁপে উঠল, ‘কালাপাহাড় আসছে!’
হরিচন্দন মুকুন্দদেব যখন প্রথম শুনলেন মহম্মদ ফারমুলী রাজধানী জাজপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তাঁর মুখের প্রতিটি ভাঁজ কুঞ্চিত হয়ে গেল।
প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বনাথ দাসকে তিনি বললেন, ‘দু-দুবার হেরেও কররাণীর আশ মেটেনি। কোনও এক অর্বাচীনকে পাঠাচ্ছে!’
বিশ্বনাথ চুপ করে রইলেন। সারা দেশে ফারমুলী বা কালাপাহাড়ের কথা ছড়িয়ে পড়লেও বৃদ্ধ রাজা অবহিত নন। তেলেঙ্গা মুকুন্দদেব যৌবনে অত্যন্ত তেজি রণনায়ক ছিলেন। উৎকল ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যরা তাঁর শাসনে কাঁপত।
সামরিক উৎকর্ষতার জন্য প্রতিবেশী রাজারাও তাঁকে সমীহ করে চলতেন, এখনো চলেন। এই গোত্রের মানুষরা শেষ বয়সে আত্মম্ভরিতার শিকার হয়ে পড়েন। আর তখনই হয় গণ্ডগোল। শত্রুকে শক্তিহীন মনে করার মতো নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই নেই।
বিশ্বনাথ দাস একটু পরে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘মহম্মদ ফারমুলী হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিল রাজামশাই। সুলতানের কন্যাকে বিবাহ করে মুসলমান হয়েছে। গোটা বাংলা এখন এর অত্যাচারে সন্ত্রস্ত। ইনি শুধু রাজ্য আক্রমণ করেন না, সেখানকার সব মন্দির ধ্বংস করেন। নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচারের জন্য সারা বাংলা এঁকে কালাপাহাড় নামে চেনে।’
শুনতে শুনতে মুকুন্দদেবের মুখ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেল, ‘ধর্মান্তরিত পাপিষ্ঠ! সেনা প্রস্তুত করো। আমি ওকে নিজের হাতে হত্যা করবো!’
কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটল ঠিক সম্পূর্ণ বিপরীত। উৎকলের সীমানা অতিক্রম করে কালাপাহাড় সরাসরি আক্রমণ করল রাজধানী জাজপুর। তার কৌশলী নেতৃত্বে পাঠানবাহিনী এমন সংঘবদ্ধভাবে লড়াই করতে শুরু করল, যে উৎকল সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে লাগল। বাহিনীর পুরোভাগে কালাপাহাড়ের দৈত্যাকৃতি শরীর, খুনির মতো চোখ, কালো পোশাক, বিকট হাসি দেখেই তাদের মনোবল ভেঙে গেল।
সুলতান কররাণীর বহুকাঙ্ক্ষিত উৎকল করায়ত্ব হতে বেশি সময় লাগল না। রাজা মুকুন্দদেব যুদ্ধে নিহত হলেন, গোটা উৎকলে শুরু হল কালাপাহাড়ের দাপাদাপি।
প্রথমেই জাজপুরের বিখ্যাত পার্বতী মন্দির ভাঙা হল। পাঠান সৈন্যরা মন্দিরের সুউচ্চ স্থাপত্য ভূলুণ্ঠিত করার পর কালাপাহাড় নিজে লৌহমুগর দিয়ে দেবীমূর্তিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল, তারপর বাম হাত দিয়ে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।
তীব্র জিঘাংসায়, প্রতিশোধের আক্রোশে তার শরীর তখন কম্পমান।
জাজপুর পরিণত হল নরককুণ্ডে। মাটিতে মিশে গেল অজস্র মন্দির। প্রজাদের ওপর চলল অকল্পনীয় অত্যাচার! ধর্মান্তরে সম্মত না-হলেই পৈশাচিক অত্যাচার, ধর্ষণ, নৃশংস হত্যা।
নরনারী প্রাণ হাতে পালাতে লাগল উৎকল ছেড়ে। পথের দু’পাশে মেয়েদের ধর্ষিত বিবস্ত্র লাশ পড়ে থাকতে লাগল। হিন্দুদের ওপর চলল পাশবিক অত্যাচার, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের ধর্মান্তর করানো যাচ্ছে।
একের পর-এক জনপদকে শ্মশান করে দিয়ে সেনার দল ছুটে যেতে লাগল পুরীর দিকে। পথমধ্যে শয়ে শয়ে মন্দির মাটিতে মিশে যেতে থাকল কালাপাহাড়ের নির্দেশে।
তবে মন্দিরের বিগ্রহকে ধ্বংস করার এক্তিয়ার অন্য সৈন্যের নেই, সেই অধিকার শুধু কালাপাহাড়ের।
মন্দির সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হলে পায়ে পায়ে বিগ্রহের সামনে এগিয়ে আসে কালাপাহাড়, তার ওপর প্রবল ঘৃণায় বাম হাত দিয়ে মুগুরের কঠোর আঘাতে ভূতলে ফেলে দেয় মূর্তিটিকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে বারবার। হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের সময় সে মানুষ থাকে না!
জান্তব ক্রোধে সে চিৎকার করে আদেশ দেয়, ‘বেশক ধর্মান্তর করো সবক’টাকে। বদতমিজ কাফেরের বাচ্চাগুলো রাজি না হলে কুকুরের মতো কোতল করো। লুটে নাও জেনানাদের ইজ্জত।’
অবশেষে একদিন কালাপাহাড় এসে পৌঁছল জগন্নাথ মন্দিরের সামনে। তার স্থির দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে অস্বাভাবিক দ্রুত।
এই সেই মন্দির, এই সেই পবিত্র জগন্নাথধাম! এখান থেকেই কয়েক বছর আগে রিক্ত, অভুক্ত, নিঃস্ব অবস্থায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল পাণ্ডারা।
এই সেই জগন্নাথ, যাকে এককালে নিজের শরীর মন সমর্পণ করেছিল সে। এই সেই ঈশ্বর, যার উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনের সেই চতুষ্পাঠীতে তরুণ শিক্ষকের কাছে বসে একসঙ্গে বেঁধেছিল গান!
সব যেন মনে হয় গতজন্মের স্মৃতি! তবু মনে পড়ে যায় কালাপাহাড়ের। বৃন্দাবনের সেই সবুজ গাছগাছালিতে ছাওয়া শিক্ষালয়ে বসে আছেন তরুণ শিক্ষক। যেন সাক্ষাৎ শ্রীচৈতন্য। এক পংক্তি করে তিনি রচনা করছেন বৈষ্ণব পদাবলী। অন্ত্যমিল খুঁজে তাঁকে সাহায্য করছে কিশোর রাজীবলোচন।
বদন চান্দ কোন কুঁদারে কুন্দিল গো কেনা কুঁদিল দুটি আঁখি।
দেখিতে দেখিতে মোর পরাণ যেমন করে সেই সে পরাণ তাঁর সাখি।
বাকিটা মনে পড়ে না। মনে পড়ে না শিক্ষকের নামও। মাঝখান দিয়ে কেটে গিয়েছে অনেক অনেকগুলো কালান্তক বছর। সেই স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে বড্ড! কালাপাহাড়ের চোখ জ্বালা করে ওঠে।
মনসবদার রহিম খাঁ এসে সেলাম ঠোকে, ‘আমাদের কি এখনই ঢুকতে হবে, হুজৌর?’
মুহূর্তে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে যায় কালাপাহাড়ের! বলে, ‘হ্যাঁ। কেন, কোই তকলিফ আছে?’
রহিম খাঁ বলে, ‘সেনারা বহুদূর থেকে এসেছে। খানাপিনা তেমন হয়নি। আজ যদি একটু আরাম করে…!’
‘নেহি!’ গর্জে ওঠে কালাপাহাড়, ‘এখনই ঢুকতে হবে অন্দরে।’
‘জি! রহিম খাঁ বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডাকে কালাপাহাড়, ‘আওর এক বাত! মন্দিরের একজন পাণ্ডাও যেন পালাতে না পারে!’
কয়েক দণ্ড মাত্র। জগন্নাথ মন্দিরের সমস্ত পাণ্ডাকে দাঁড় করানো হয়েছে মন্দিরের প্রধান দালানে। সমস্ত পাণ্ডারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। তাদের মুখ রক্তশূন্য, ঠোঁটে চলছে ইষ্টনাম জপ। তারা কিছুতেই পালাতে পারেনি। তার আগেই মন্দির ঘিরে রেখেছিল পাঠান সেনারা।
কালাপাহাড় তাঁর জুতোয় আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল। তার এক হাতে প্রকাণ্ড লৌহমুদগল, অন্যহাতে শাণিত তরবারি। চোখ আশ্চর্যজনক শান্ত!
পবিত্র মন্দির চত্বরে চামড়ার জুতো পরে নির্বিকারে কালাপাহাড়ের পদচারণার শব্দ উঠছে মসমস, আর চমকে চমকে উঠছে পুরোহিতের দল! গোটা প্রাঙ্গণে বিরাজ করছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
সারির একেবারে সম্মুখে প্রধান পাণ্ডা নরসিংহ দয়িতাপতি। হ্যাঁ, এঁরই নেতৃত্বে একদিন মন্দির থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণ রাজীবলোচন রায় ভাদুড়িকে।
কালাপাহাড়ের চক্ষু দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। বহুদিন পরে আবার জ্বলে যাচ্ছে তার মুখ। অনুভব করছে সেই চড়ের যন্ত্রণা।
সে চিৎকার করে ওঠে, ‘বাজাও!’
মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় ঘণ্টা বাজানো, সঙ্গে বাজতে থাকে ঢোল। পাণ্ডারা সভয়ে দেখে, পাঠান সেনারা বাজাচ্ছে ঢোল আর ঘণ্টা।
কালাপাহাড় ফের চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কেমন লাগছে গরুর গোস্তের আওয়াজ? বহোত মিঠা, না?’
জগন্নাথ মন্দিরে গরুর চামড়ার ঢোল বাজানো হচ্ছে! শিহরিত হয়ে ওঠে পাণ্ডারা।
‘হা হা হা হা!’ কালাপাহাড় আকাশ বাতাস পাতাল কাঁপিয়ে হাসে। সে চায়, তার অট্টহাস্যে যেন কেঁপে ওঠেন স্বর্গের দেবতারাও। সত্যিই যদি দেবতারা থেকে থাকেন, আসুন! এসে তাকে আটকান!
আসলে কেউ নেই! কোথাও কেউ নেই! হিন্দু ধর্ম পুত্তলিকার ধর্ম! ভণ্ডামির ধর্ম!
এক হাবসী খোজা আসে। সেলাম ঠুকে তার হাতে তুলে দেয় একটি পাত্র। সেই পাত্র রন্ধনকৃত গোমাংসে পূর্ণ। কালাপাহাড় সোল্লাসে মুখে পুরতে থাকে একটার পর একটা খণ্ড। তারপর মুখ থেকে উচ্ছিষ্ট বের করে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে মন্দিরেই।
পাণ্ডাদের আর্তনাদ থেমে গেছে। সে শক্তিও তাদের নেই।
একসময় সে গিয়ে দাঁড়ায় নরসিংহ দয়িতাপতির সামনে। হেসে বলে, ‘কী প্রধান পাণ্ডাজি? মনে পড়ে, কীভাবে আমায় অপমান করে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন? মনে পড়ে সেই চড়ের কথা?’
নরসিংহ দয়িতাপতি অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকেন। অস্ফুটে বলেন, ‘আপনি যবন বিবাহ করেছিলেন তাই…!’
‘চুপ! একদম চুপ! জিভ টেনে উপড়ে নেব!’ নিমেষে কালাপাহাড়ের হাস্যমুখ বিকৃত হয়ে যায়, গর্জন করে ওঠে, ‘তুমি না প্রধান পুরোহিত? তুমি না বিশ্বাবসুর বংশধর? কপিল সংহিতা পড়েছ না পড়োনি? জানো না, মহাপাপীও এই শ্রীক্ষেত্রে এলে তার সব পাপ ক্ষয় হয়ে যায়?’
নরসিংহ দয়িতাপতি নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
কালাপাহাড় তর্জনি উঁচিয়ে বলে, ‘তোমাদের প্রস্তরদেবতারা কত শক্তিশালী? তোমাদের এই অপরিসীম লাঞ্ছনায় তাঁরা নীরব কেন? প্রতারক!’
দূরে শোনা যাচ্ছে পুরীর সাধারণ মানুষের ক্রন্দন। পাঠান সেনারা যথেচ্ছভাবে প্রহার করছে, নির্বিচারে হত্যা করছে। নারীদের উপরে চলছে গণধর্ষণ।
এদিকে অতি দ্রুত খোঁড়া হয় একের পর এক প্রকাণ্ড গর্ত। সেই গর্ত পূর্ণ করা হয় পুরীষ, মলমূত্রে গোমাংসের উচ্ছিষ্টে। তারপর একেকটি গর্তে গেথে দেওয়া হয় একেকজন পাণ্ডাকে। শুধুমাত্র নাক বেরিয়ে থাকে বাইরে, গোটা দেহটাই শক্ত রজ্জুতে বাধা অবস্থায় ছটফট করতে থাকে ভেতরে। মুখে গুঁজে দেওয়া হয় পট্টবস্ত্র! তীব্র দুর্গন্ধে তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাদের আর্তরবে আকাশবাতাস কাঁপছে। এভাবেই অনাহারে একসময় মৃত্যু হবে তাদের। কিন্তু মৃত্যুর শেষক্ষণ পর্যন্ত সহ্য করতে হবে এই অসহ্য যন্ত্রণা।
ব্যতিক্রম শুধু নরসিংহ দয়িতাপতি। কালাপাহাড়ের আদেশে তাঁকে গর্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় না। নরসিংহ ভাবেন, তবে কি প্রধান পুরোহিত বলে মিলল তাঁর নিষ্কৃতি? হয়তো তাই!
তাঁর কৌতূহল দ্রুত নিবৃত্ত হয়। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তিনি দেখেন, মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়েছে গরুর শবদেহ। গরুটিকে হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে, দেহের একেবারে মাঝখান বরাবর কেটে। রক্ত ঝরছে এখনও।
কী বীভৎস দৃশ্য! নরসিংহ দয়িতাপতি চোখ বুঁজে ফেললেন। তখনই শুনতে পেলেন কালাপাহাড়ের কণ্ঠস্বর।
‘পুরীর সবচেয়ে আচ্ছা যে দর্জি, তাকে নিয়ে এসো। প্রধান পাণ্ডাকে গরুর লাশের মধ্যে ঢুকিয়ে বাহার থেকে সেলাই করে দিতে বলো। পাণ্ডাজি ভেতরে শ্বাস নেওয়ার জন্য যত ছটফট করে উঠবে, গরুর লাশটাও ততই ধড়ফড় করে উঠবে। ওহ, ক্যা মজা! জলদি যাও!’
কী? নরসিংহ দয়িতাপতি কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না! মৃত জন্তুর দেহের ভিতরের তীব্র দুর্গন্ধে শ্বাসরোধ হয়ে তিলে তিলে মৃত্যু হবে তাঁর?
নিজের ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য ভুলে আর্তনাদ করে উঠলেন জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান পাণ্ডা! লুটিয়ে পড়তে চাইলেন কালাপাহাড়ের পায়ে।
কিন্তু পারলেন না। কারণ ততক্ষণে তাঁকে শক্ত দড়িতে বেঁধে ফেলা শুরু হয়েছে। শিষ্টতা ভুলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তাঁর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদে মুখরিত হয়ে উঠল মন্দির প্রাঙ্গণ।
কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসে না। বৃদ্ধ এক দর্জি এগিয়ে আসে মোটা ছুঁচ নিয়ে।
চারপাশের তীব্র কলরোল, হাহাকারের মাঝে কালাপাহাড় বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রক্তপিপাসু জল্লাদের মত।
তারপর ধীর পায়ে এগোয় গর্ভগৃহের দিকে। একসময়ের প্রাণাধিক প্রিয় জগন্নাথের দিকে ঘৃণাভরে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘মিথ্যে! তুমি মিথ্যে!’
তারপর বাম হাত দিয়ে সজোরে কুঠারাঘাত করে বিগ্রহের ওপর। নিজের অজান্তেই অশ্রু ঝরতে থাকে চোখ দিয়ে।
বিগ্রহ ধ্বংস সম্পূর্ণ হলে চোখ মুছে সে আকাশের দিকে তাকায়। তারপর সিংহনাদ করে ওঠে। ‘চলো সব মল্লভূম!’
৩৯
বৈষ্ণবমতে মেনকা ও শ্রীধরের বিবাহ সম্পন্ন হওয়ায় রাজপণ্ডিত শ্রীব্যাস আচার্য থেকে প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন, সকলের মনে অসন্তোষ দেখা দিল। সকলেই একবাক্যে বললেন, বৈষ্ণব পণ্ডিত শ্রীনিবাস আচার্যকে রাজা যেভাবে তোল্লাই দিচ্ছেন, যেভাবে মা মৃন্ময়ীর নিজভূমিতে প্লাবিত হচ্ছে ভক্তিরস, এর ফল ভালো হবে না।
এই কয়েকমাসের মধ্যে গোটা রাজ্যে গজিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির, সে নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু রাজপ্রাঙ্গণের মধ্যে বিবাহ বৈষ্ণব মতে হবে কেন?
তার উপর রাজা বীরহাম্বীর মৃন্ময়ী মন্দিরে নরবলি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এই কারণেও শ্রীব্যাস আচার্য ও তাঁর দলের অন্যরা ক্রুদ্ধ হয়েছেন। মা মৃন্ময়ী ভয়ঙ্করী। নরবলি বন্ধ করার অর্থ তাঁর মুখ থেকে খাবারের গ্রাস কেড়ে নেওয়া।
রুদ্রাক্ষ এই সবকিছুর উপর তীক্ষ্ন নজর রাখছিল। রাজ্যে কালাপাহাড়ের আগমন সময়ের অপেক্ষা। মল্লভূম আকারে আয়তনে বড় না হলেও অরণ্যের মধ্যে। প্রায় সব সামন্তরাজা বীরহাম্বীরের বিশ্বাসভাজন। সর্বোপরি মল্লরাজ্যে চলছে কামানের অতি-উৎপাদন। কালাপাহাড়ের জয় নিশ্চিত করতে রুদ্রাক্ষ মল্লরাজের সব শত্রুকে একত্রিত করেছে। কাউকে সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে, কাউকে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে।
শুধু এটুকুই নয়, সময়ে সময়ে মোঘল চৌকির সেনাদের দিয়ে গোপনে চিঠি পাঠানো এবং কালাপাহাড়ের আদেশনামা গ্রহণ, সবই সে করেছে অতি গোপনে। একনিষ্ঠভাবে।
কিন্তু রুদ্রাক্ষের সব চিঠিরই শেষ কথাটা ছিল হুবহু এক।
‘মল্লরাজ্য দখলের পর তোমার সেনারা মাধব মল্লের কন্যা হেমনলিনীর যেন কোনও ক্ষতি না করে, রাজু তুমি একটু দেখো!’
এহেন বয়ান পেয়ে শেষে কালাপাহাড় রসিকতা করে লিখেছিল, ‘কী ব্যাপার হে! শেষে কি মন দিয়ে বসলে নাকি? তোমার চিরকুমার ব্রত কি ঘুচে যাবে?’
রুদ্রাক্ষ উত্তর দেয়নি। রাজুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু হওয়ার কারণে তার জীবন কখন যেন রাজুকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল। রাজু যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, রুদ্রাক্ষও সমর্থন করেছিল বন্ধুকে। এতগুলো বছর রাজুর সঙ্গেই অতিবাহিত হয়েছে। কখনও মনে হয়নি নিজেরও একটা সংসার থাকলে বেশ হত।
কিন্তু আজকাল যখনই সে একাকী থাকে, তখন মনে হয়, হেমনলিনীর মতো কাউকে পাশে পেলে তার জীবনটা এমন ছন্নছাড়া হয়ে যেত না। কিন্তু যা হবার নয়, তা ভেবে লাভ কী? কিন্তু মন তো মস্তিষ্কের কথা শোনে না। তাই তার হৃদয় বারেবারে ছুটে যেতে চায় প্রদ্যুম্নপুরের প্রাসাদে।
প্রত্যূষে বিছানায় শুয়ে রুদ্রাক্ষ এমনই সব চিন্তা করছিল, এমন সময় রাজবাড়ির ভৃত্য এসে মৃদুস্বরে বলল, ‘আজ্ঞে, রাজামশাই আপনাকে সত্বর সাক্ষাৎ করতে বললেন।’
‘এই প্রভাতে?’
ওর বিস্ময়ের কারণ স্বাভাবিক। দিনের প্রথমার্ধে রাজা রাজকার্যে ব্যস্ত থাকেন, তখন একান্তে কথা হয় না। দুজনের পৃথক সাক্ষাতের সময় সন্ধ্যায়। কখনও প্রমোদ উদ্যানে, কখনও বা সদ্য নির্মিত পরিখাপাড়ে।
ভৃত্য বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
বীরহাম্বীর রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে উন্মুক্ত অলিন্দে একা দাঁড়িয়েছিলেন। পাশেই পুষ্করিণী। রাজা আনমনে কিছু ভাবছিলেন, আর পুষ্করিণীতে ছোট ছোট লোষ্ট্রখণ্ড নিক্ষেপ করছিলেন। লোষ্ট্রখণ্ডগুলি আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। কয়েকমুহূর্তের জন্য, আবার ফিরে যাচ্ছিল আগের অবস্থায়।
রুদ্রাক্ষকে দেখে বীরহাম্বীর হাসলেন। বললেন, ‘কী সংবাদ, রুদ্রাক্ষ?’
‘উত্তম, মহারাজ। আপনি কুশল তো? হঠাৎ এই ভোরে তলব?’
বীরহাম্বীর স্মিতমুখে বললেন, ‘প্রভাতেই মন সবচেয়ে সতেজ থাকে, রুদ্রাক্ষ। মানুষের হৃদয় সূর্যমুখী ফুলের মতো। সকালবেলার সতেজতা ধীরে ধীরে মলিন হতে হতে হয়ে ওঠে ম্রিয়মাণ।’
রুদ্রাক্ষ হাসল, ‘ভালো বললেন মহারাজ!’
বীরহাম্বীর বললেন, ‘তোমায় আমি গত সন্ধ্যাতেও ডাকতে পাঠিয়েছিলাম। তুমি ছিলে না।’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘ও হ্যাঁ। গতকাল রঘুনাথ ও আমি সান্ধ্যভ্রমণে গেছিলাম হেড়ে পাহাড়ের দিকে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।’
বীরহাম্বীর একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি সম্ভবত জানো না, কিছুদিন হল, ছোটরানী কাঞ্চনমণি তাঁর ভ্রাতার বিবাহ উপলক্ষে পিত্রালয়ে গিয়েছেন। রঘুনাথও সঙ্গে গিয়েছে।’
রুদ্রাক্ষ অপ্রস্তুত! এরপরে কী বলবে, ভাবতে তার মস্তিষ্ক যতটুকু সময় নিল, তার মধ্যেই বীরহাম্বীর বলে উঠলেন, ‘মাধব মল্ল কী পরামর্শ দিলেন? কালাপাহাড়ের মল্লভূম আক্রমণ করার এই কি উপযুক্ত সময়?’
রুদ্রাক্ষ অনুভব করল, তার দেহে রক্তচলাচল দ্রুত হচ্ছে।
ঠিক এইসময় আকস্মিক উপস্থিত হলেন শ্রীনিবাস আচার্য। তাঁর মুখ গম্ভীর।
রুদ্রাক্ষ কিছু বলার আগেই শ্রীনিবাস আচার্য এগিয়ে এসে বললেন, ‘মৌন থেকো না রুদ্রাক্ষ। তুমি যে গোপনে প্রদ্যুম্নপুরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, সে আমরা জানি। আমি এও জানি, কালাপাহাড় উৎকল জয় করে প্রত্যাবর্তনের সময় এই মন্দিররাজ্যে পদধূলি দেবে!’
‘একমত আচার্যমশাই!’ বীরহাম্বীর অস্থিরভাবে বললেন, ‘কিন্তু যেটা আমার বুদ্ধির অগম্য, সেটা হল, এই ভূখণ্ডে সে কবে আক্রমণ করবে তার চক্রান্ত করার জন্য সে রুদ্রাক্ষকে পাঠাল কেন? কেনই বা রুদ্রাক্ষ আমার সঙ্গে সখ্যতার অভিনয় এমন সুচারুভাবে করে চলেছে?’
রুদ্রাক্ষর কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে! বহুমূল্য রাজকীয় শয্যায় রাতের পর রাত ছটফট করেছে সে। তার প্রতি মহারাজের ব্যবহার যত গাঢ় হয়েছে, ততই তীব্র অনুশোচনায় সে বিদ্ধ হয়েছে। সে আজ জানতে পারছে, মহারাজ প্রথম থেকেই সব জানেন!
ও প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে বলল, ‘আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন মহারাজ। আমি মাথা পেতে নেব।’
বীরহাম্বীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বললেন, ‘আগের আমি হলে এতক্ষণে তোমার স্থান হত কোতলখানায়। আমার রাজ্যের যে ক্ষতি করে, তাকে এক মুহূর্তের জন্য মল্লভূমে নিঃশ্বাস নিতে দিতাম না আমি। কিন্তু রুদ্রাক্ষ, আচার্য মশাই যে আমাকে ক্ষমা করতে শিখিয়েছেন!’
রুদ্রাক্ষ প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
রাজা বললেন, ‘আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগেই তুমি এই রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে।’
‘যথা আজ্ঞা।’ রুদ্রাক্ষ নতজানু হল। আবেগে তার অন্তর তোলপাড় হচ্ছে। মল্লরাজ্যে সে এসেছিল চর হয়ে, কিন্তু কখন যে এই রাজ্যের সবাই, ওর আপন হয়ে গিয়েছে, তা ও বুঝতে পারেনি। আজ যেন ও উপলব্ধি করল, রঘুনাথ, পবন, এমনকি স্বয়ং মহারাজ ওর বড় কাছের মানুষ।
আর হেমনলিনী?
ও ভগ্নস্বরে বলল, ‘মহারাজ, যে মনোভাব নিয়ে এসেছিলাম, সেই মনোভাব আমার পরিবর্তিত হয়েছে। তাই যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যেতে চাই।’
‘কী?’
‘আপনার বিরুদ্ধে রাজ্যে যে ষড়যন্ত্রের জট পাকানো হচ্ছে, তার মূলে আছে আপনার প্রতি কুচক্রীদের প্রবল বিদ্বেষ—কিছুটা ঈর্ষা, বাকিটা ধর্মীয় অসন্তোষ। আপনি বুদ্ধিমান, বুঝে নেবেন।’
পিছু ফিরেও একটু থমকাল রুদ্রাক্ষ। এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল শ্রীনিবাস আচার্য ও রাজাকে। আর্দ্রস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি দেশের যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আপনার, আপনার এই রাজ্যের আর ক্ষতি করব না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আপনার থেকে অনেক কিছু শিখেছি। প্রণাম!’