অধ্যায় ৩০
ছফা যখন রবীন্দ্রনাথে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করলো তখন ভেতরটা বেশ নিরিবিলি-মাত্র দু-জন পাঠক বই পড়ছে। এর কারণ হয়তো একটু পরই লাইব্রেরিটা বন্ধ করে দেয়া হবে।
এমন পরিবেশ দেখে খুশিই হলো সে। ভালো করেই জানে, ভেতরের ছোট্ট একটা প্রাইভেট রুমে আছেন মাস্টার রমাকান্তকামার-আগে যেখানে মুশকান জুবেরি বসতো।
লাইব্রেরির ভেতরে ঢোকার সময় দু-জন মগ্ন পাঠকের কেউই মুখ তুলে তাকালো না, বইতে পুরোপুরি ডুবে আছে তারা। যতোটা সম্ভব কম আওয়াজ করে ধীরপদক্ষেপে লাইব্রেরির শেষ মাথায় ছোট্ট রুমটার দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। আল্তো করে টোকা দিলো দরজায়। পর পর দু-বার।
“দরজা খোলাই আছে।”
ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের কণ্ঠটা ভেসে এলো। ছফাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে মোটেও অবাক হলেন না প্রবীণ শিক্ষক।
“আদাব, স্যার,” ভেতরে ঢুকে বললো সে। “কেমন আছেন?”
“ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলেন মাস্টার।
স্বল্প পরিসরের ঘরটায় একমাত্র টেবিলের ওপাশে বসে আছেন তিনি। টেবিলের সামনে মাত্র দুটো চেয়ার। দড়ি দিয়ে বাধা কিছু বইয়ের স্তূপ আছে ঘরে, আর দেয়ালে তিনটি সাদা-কালো ছবি টাঙানো।
খালি চেয়ারটায় বসে পড়লো ছফা। “এরা কারা?” দেয়ালের ছবিগুলো দেখিয়ে জানতে চাইলো সে।
“ত্রিলোকনাথ বসু, অলোকনাথ বসু আর রাশেদ জুবেরি,” বললেন মাস্টার। “এই লাইব্রেরির পেছনে তাদের অবদানই বেশি।”
“তাহলে তো আরেকজনের ছবি থাকার কথা ছিলো এখানে!”
মাস্টার স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন।
“নতুন করে এই লাইব্রেরিটা দেবার পেছনে মুশকান জুবেরির অবদানই সবচেয়ে বেশি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি কী জন্যে এসেছেন সেটা বলেন।”
“বলছি বলছি,” মুচকি হেসে বললো ছফা। “আমি আগে ভাবতাম আপনি সত্য কথা বলেন সব সময়। অন্তত সুন্দরপুরের মানুষ তা-ই ভাবে-রমাকান্তকামার কখনও মিথ্যে বলেন না।” একটু থেমে আবার বললো, “সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!”
মাস্টার এবারও নির্বিকার রইলেন।
“কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো আপনিও মিথ্যে বলেন!”
“ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলুন, কী জানতে এসেছেন?” রমাকান্তকামারের কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত মাস্টারের দিকে চেয়ে থেকে বললো ছফা, “আপনি যে মোবাইলফোন ব্যবহার করেন সেটা আমাকে বলেননি।”
“আমি তো অনেক কিছুই ব্যবহার করি…” গম্ভীর মুখে বললেন মাস্টার। “…তার সবই কি আপনাকে বলেছি? আর আপনিও কি আমার কাছ থেকে সব কিছু জানতে চেয়েছেন?”
“সব কিছু না হোক, ফোনের কথা বলেছিলাম আপনাকে…গতকালই।”
“আমি আপনাকে স্কুলের ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম।”
“তা ঠিক। কিন্তু মোবাইলফোনটার নাম্বার দেননি।”
“আপনি সেটা চানওনি,” চট করে জবাব দিলেন মাস্টার।
মুচকি হাসলো ছফা। “তা চাইনি। তবে আজকাল নিজের ফোন মানে কিন্তু মোবাইলফোনই বোঝায়। সেটা কারো কাছে গোপন করার মানে বিশেষ কোনো কারণ আছে!”
ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন মাস্টার। “বিশেষ কারণ তো আছেই।”
“সেটা কী, জানতে পারি?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “আপনার কাছে কৈফিয়ত দেবার কোনো দরকার নেই আমার, তারপরও বলছি। ধরে নিন আপনার সন্দেহগ্রস্ত মনটাকে শান্ত করার জন্যই বলা, একটু থেমে আবার বললেন, “যে জিনিস আমি সব সময় ব্যবহার করি না, খুব দরকার পড়লে ব্যবহার করি, সেটার নাম্বার সবাইকে কেন দেবো?”
“বিশেষ কারোর সাথে যোগাযোগ করার দরকার পড়লেই ব্যবহার করেন?”
ছফার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও মাস্টার মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “হ্যাঁ।”
“সেই বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে কি মুশকান জুবেরিও আছে?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে মাস্টারের দিকে দৃষ্টি বিদ্ধ করে রাখলো, কিন্তু লোকটার অভিব্যক্তি হতাশ করলো তাকে।
মাস্টার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন। “ভদ্রমহিলার সাথে আমার কোনো ধরণের যোগাযোগ নেই-এ কথা সেদিনও বলেছি, আজকেও বলছি। চাইলে আপনি এটা খতিয়ে দেখতে পারেন।”
“তা আমি দেখবো। আপনার মতো যুধিষ্ঠির তো নই…ডিবির সামান্য একজন ইনভেস্টিগেটর। সন্দেহবাতিকতা আমার যোগ্যতারই অংশ। ওটা না থাকলে আমিও সুন্দরপুরবাসিদের মতো যাকে তাকে দেবতাজ্ঞান করে বসে থাকতাম!”
মাস্টারের মুখ পাথরে খোদাই করা গ্রিক দেবতাদের মতো হয়ে গেলো।
“ঐ মহিলা যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তার কিন্তু শক্ত প্রমাণ আছে আমার কাছে।”
ছফার প্রশ্নটা শুনে মাস্টার একটুও অবাক হলেন না। সেটা যে কী তা আমি জানি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “আমার ঘরে চোর পাঠিয়ে তল্লাশি করিয়েছে কেউ, কিছু জিনিস নিয়েও গিয়েছিলো, আবার ফেরত দিয়ে গেছে।”
একটু হেসে বললো সে, “চোর না বলে আপনার বলা উচিত অনুসন্ধানকারী।”
“বলতাম, যদি সে সত্যি সত্যি চোর না হতো!”
অবাক হলো ছফা-ভদ্রলোক কী করে এটা বুঝলেন? যাই হোক, সিদ্ধান্ত নিলো সরাসরিই বলবে এখন, ঘোরপ্যাঁচের আর দরকার নেই।
“মুশকান জুবেরির চিঠি পেয়েছিলেন আপনি, আর সেটা বেমালুম অস্বীকার করেছেন আমার কাছে।”
“ওটা চিঠি না…চিরকুট,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। “চিঠি আর চিরকুটের মধ্যে পার্থক্য আছে।”
বাঁকাহাসি দিলো নুরে ছফা। “কোনটা চিঠি আর কোনটা চিরকুট সেটা যদি একটু বলতেন উপকৃত হতাম।”
নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন মাস্টার, “চিঠিতে প্রেরকের নাম লেখা থাকে…ডাকের মাধ্যমে আসে ওটা। আর চিরকুট লোকমারফত দেয়া হয়।
অনেক সময় নাম-ধামেরও বালাই থাকে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “ধন্যবাদ। অনেক কিছু শিখলাম,” একটু থেমে আবার বললো, “তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, মুশকান জুবেরি আপনাকে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলো।”
“উনি পাঠিয়েছিলেন কিনা বলতে পারবো না।”
নুরে ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো। “আপনি বলতে চাইছেন, ওটা কে পাঠিয়েছিলো সে-ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন?”
“চিরকুটে উনার নাম লেখা ছিলো না, আর ভদ্রমহিলার হাতের লেখার সাথেও আমি পরিচিত নই, নিশ্চিত হবে কী করে?”
“ফেরারি আসামি হিসেবে নিজের নাম না লেখাটাই তো স্বাভাবিক।”
মাস্টার নির্বিকার রইলেন, কিছুই বললেন না।
“তবে আমি নিশ্চিত, ওটা কোনো মহিলার হাতের লেখাই। নারী পুরুষের হাতেরলেখা দেখলেই আমি চিনতে পারি। আপনি এটাকে আমার আরেকটি গুণ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। শুধু সন্দেহবাতিকতা দিয়ে তো ইনভেস্টিগেশনের কাজ চালানো যায় না,” বাঁকা হাসি দিয়ে আবার বললো সে, “চিরকুটের কথাগুলো পড়লে দুধের বাচ্চাও বলে দেবে ওটা মুশকান জুবেরিই পাঠিয়েছে।”
মাস্টার এ কথারও কোনো জবাব দিলেন না।
“এখন বলুন, চিরকুটটা আপনাকে কে দিলো?”
আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাস্টার। “এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কি আমি বাধ্য?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “অবশ্যই আপনি বাধ্য। কারণ যে জানতে চাচ্ছে সে যদুমধুকদুজাতীয় কেউ নয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন তদন্তকারী কর্মকতা…বেশ কয়েকজন মানুষের নিখোঁজ এবং সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডের কেস তদন্ত করছে। আপনার উচিত তাকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করা। অবশ্য, আপনি যদি কোনো ক্রিমিনালকে রক্ষা করার পণ না করে থাকেন তো।”
রমাকান্তকামার খোঁচাটা হজম করে নিলেন নির্বিকার থেকেই। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, “ট্রাস্টের ল-ইয়ার ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার। উনিই চিরকুটটা দিয়েছিলেন আমাকে ট্রাস্টের কাগজপত্রের সাথে।”
অবাক হলো নুরে ছফা। তার উচিত ছিলো ট্রাস্টের ল-ইয়ার কে সেটা খতিয়ে দেখা, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা কিন্তু সে তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলো ডাক্তার আসকারের উপরে।
“উনাকে আপনি আগে থেকে চিনতেন?”
“চেনার প্রশ্নই ওঠে না। ঐ মহিলা এখান থেকে চলে যাবার কিছু দিন পর এই ভদ্রলোক ডাকযোগে আমাকে সব কিছু জানান। ট্রাস্টের কিছু কাগজপত্রের সাথে তখন চিরকুটটাও দিয়েছিলেন।”
মাথা দোলালো নুরে ছফা। অবশেষে একটা সূত্র তাহলে পেলো। এই সুন্দরপুর থেকে! যে মাটিতে আছাড় খাইছেন সেই মাটি থেইক্যাই উঠতে হইবো-কেএস খানের আপ্তবাক্যটি তার মাথার ভেতরে অনুরণিত হলো আবার। এই ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের সাথে মুশকান নিশ্চয় যোগাযোগ রাখে! হয়তো সে-ই তাকে নিয়োগ দিয়েছে।
হঠাৎ কিছু একটা টের পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে। দেখতে পেলো তিন-চারজন যুবক ঘরে প্রবেশ করেছে। তাদের সবার চোখমুখ বেশ
.
অধ্যায় ৩১
সুন্দরপুরের নতুন এমপি জোনায়েদ রহমানের পৈতৃক বাড়িটি বেশ ছিমছাম আর বিশাল। মূল বাড়িটি কাঠের তৈরি, এখনও ভিটেয় পাকা দালান ওঠেনি।
ছফা অবাকই হলো। এই দেশে এমপি হবার সাথে সাথে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে ওঠে আর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বাড়িঘর!
এমপির বাড়ির বিশাল উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে ছফা। তার সামনে আরেকটা খালি চেয়ার আছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এমপি এখানে এসে বসবেন। ছফাকে যে চারজন যুবক নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যজন গেছে বাড়ির ভেতরে। ইচ্ছে করেই এইসব চ্যাংড়াদের কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করেনি সে। এরা এমপির চ্যালাচামুণ্ডা। নেতার পেছনে ঘুরে গর্ব বোধ করে। এককালে জমিদার, জোতদার, তালুকদার আর গ্রাম্য মোড়লেরা লাঠিয়াল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, এখনকার দিনে নেতারা এরকম যুবকদেরকে সে-কাজে ব্যবহার করে। পিএসের ক্ষমতা বরং ওদের নেতাকে দেখানোই বেশি ভালো হবে।
ঘৃণাভরে মাটিতে থুতু ফেললো ছফা। তাকে এ কাজ করতে দেখে চোখমুখ আরো শক্ত করে ফেললো এমপির ছেলেগুলো। এমন সময় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা এক তরুণ বের হয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে, তার সঙ্গে এই যুবকদের একজন। ছফা বুঝতে পারলো, এই তরুণই নতুন এমপি জোনায়েদ রহমান। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে সালাম দেয়া সরকারী কর্মকতা ছফার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু সেটা করলো না সে। ব্যাপারটা যেমন তরুণ এমপির চোখ এড়ালো না, তেমনি এড়ালো না তার সাঙ্গপাঙ্গদেরও।
এমপির চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মুহূর্তে। ছফার সামনে চেয়ারে বসে পড়লো সে। “আপনি একজন ডিবি অফিসার?” শান্তকণ্ঠেই জানতে চাইলো।
“হ্যাঁ।” ইচ্ছে করেই ‘স্যার’ সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকলো।
“সুন্দরপুরে কী কাজে এসেছেন?”
“একটা কেস ইনভেস্টিগেট করতে।”
“কোন্ কেস?”
“কিছু মানুষের নিখোঁজ হবার কেস তদন্ত করছি আমি। আর ঐ মুশকান জুবেরি সেই কেসের প্রাইম সাসপেক্ট।”
“বুঝলাম, কিন্তু আপনি মাস্টারসাহেবের পেছনে লেগেছেন কেন?”
“আমি উনার পেছনে লাগিনি, শুধুমাত্র একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, তা ও খুবই ভদ্রভাবে।”
“এই কেসে উনাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন?” ভুরু কুঁচকে ফেললো এমপি।
“কারণ উনার সাথে ঐ মহিলার যোগাযোগ আছে।”
অবিশ্বাসে মাথা দোলালো জোনায়েদ রহমান। “এটা সুন্দরপুরের কেউ বিশ্বাস করবে?” নিজের চ্যালাদের দিকে তাকালো সে। “মাস্টারসাহেব ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ রাখতে যাবেন কেন? আশ্চর্য!”
“কেন রাখবেন সেটা মাস্টারসাহেবই ভালো জানেন। আমি শুধু সেই কারণটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”
এমপি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “মহিলা এখান থেকে চলে যাবার পর দেখা গেলো, জমিদার বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দিয়ে গেছে তার প্রয়াত স্বামী রাশেদ জুবেরি। তিনিই মাস্টারসাহেবকে সেই ট্রাস্টের ট্রাস্টি করেছেন। এখানে ঐ মহিলার কোনো অবদান নেই।”
মুচকি হাসলো ছফা। পলিটিশিয়ানদের কথার মারপ্যাঁচ তার ভালো করেই জানা আছে। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর থেকে পালিয়েছে না বলে এমপি বলছে, সে চলে গেছে-এটাই প্রমাণ করে মহিলা এবং মাস্টারের ব্যাপারে তার পক্ষপাত।
“আপনি কি জানেন, আমিও সেই ট্রাস্টের একজন মেম্বার?” এমপি বললো।
“কিন্তু আপনার সাথে সম্ভবত ঐ মহিলা যোগাযোগ রাখেন না।”
ছফার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো তরুণ এমপি।
“শুনুন,” শীতল কণ্ঠে বললো নুরে ছফা। “আমি একটা কেস তদন্ত করছি, দরকার পড়লে যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি। আপনি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার কাজে বাধা দিতে পারেন না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে।”
“আমি বাধা দিলাম কোথায়?” অবাক হবার ভান করলো জোনায়েদ রহমান।
“এই যে, মাস্টারের ওখান থেকে এইসব ছেলেপেলেদের দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন…এটাকে আপনি কী বলবেন?”
এমপি হেসে ফেললো। “এটাকে তদন্ত কাজের বাধা হিসেবে দেখছেন আপনি? আশ্চর্য!” কাঁধ তুললো জোনায়েদ রহমান। “যাই হোক, আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন, আমার কিছু করার নেই। আমি শুধু আপনাকে একটা কথা পরিস্কার বলে দেবার জন্য ডেকে নিয়ে এসেছি-মাস্টারসাহেবকে কোনো রকম ডিস্টার্ব করবেন না।” শেষ কথাটা তর্জনি উঁচিয়ে, একেবারে রাজনৈতিক নেতাদের মতো করে বললো।
“ডিস্টার্ব বলতে কী বোঝাচ্ছেন?” শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো ছফা। এমপির হুমকিকে পাত্তাই দিলো না সে। “উনাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না আর?”
নিজের রাগ দমন করলেও বেশ ধমকের সাথে বললো সুন্দরপুরের এমপি, “ডিস্টার্ব বলতে, উনার বাসায় চোর-বাটপার পাঠিয়ে চুরি করাকে বুঝিয়েছি! এ কাজ করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”
“আমি চুরি করিয়েছি কে বললো?” ছফা একটুও বিচলিত হলো না।
জোনায়েদ রহমানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। “যাকে দিয়ে চুরি করিয়েছেন সে তো নিজেই মাস্টারসাহেবের কাছে গিয়ে পা ধরে মাফ চেয়ে গেছে। এ-ও বলে গেছে, ঐ আতর হারামজাদা তাকে এ কাজ করতে বলেছিলো।”
ছফার কপালে হালকা ভাঁজ পড়লো।
“ভাই, এই লোক তো ঐ ইতরের মোটরসাইকেলে কইরা ঘুইর্যা বেড়ায়, যুবকদের একজন বলে উঠলো।
“ইতরটা এখন জাতে উঠে গেছে, নিজে আর এ কাজ করে না,” বললো এমপি। “আপনি আতরকে বলেছেন মাস্টারসাহেবের বাড়িতে চুরি করার জন্য, সে নিজে না করে ঐ ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে।”
ছফা বুঝতে পারলো, বল্টু নামের ছেলেটা চুরির কথা স্বীকার করে ফেলেছে। এখন এটা অস্বীকার করলে খামোখাই আতরের উপরে নির্যাতন নেমে আসবে। ইনফর্মারকে আগেই বলেছিলো যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ না করাতে।
“আপনি চাইলে আমি সেই চোরকেও হাজির করতে পারি।” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে বললো এমপি।
“শুনুন,” গভীর করে দম নিয়ে বললো ছফা। “তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশকে অনেক কিছুই করতে হয়, আমিও তাই করেছি। এরজন্যে কারোর কাছে জবাবদিহি করার দরকার দেখছি না। তবে আপনাকে শুধু এটুকু বলবো, আপনি যে দলের এমপি, সেই দলের অনেক উপরের দিকের একজন এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী। এখানে উনার স্বার্থ জড়িত। আপনি যদি এই তদন্তে কোনো রকম নাক গলান তাহলে আমি বাধ্য হবো তাকে সব কিছু জানাতে।”
কথাটা যেনো এমপিসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের গায়ে জ্বলুনি ধরিয়ে দিলো। ছেলেদের মধ্যে একজন তেড়ে এসে কিছু বলতে যাবে অমনি হাত তুলে থামিয়ে দিলো জোনায়েদ রহমান। “আপনি কার কথা বলছেন?” নিজের রাগ দমন করে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।
“আপনার সাথে ফোনে আলাপ করিয়ে দেবো?” ছফা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো।
এমপির ভুরু কুঁচকে গেলো। “ঠিক আছে, ফোন দিন।”
ছফা পকেট থেকে ফোনটা বের করে পিএসের নাম্বারে ডায়াল করলো। তিনবার রিং হবার পর কলটা ধরলো আশেক মাহমুদ। নীচুকণ্ঠে পিএসকে জানালো সুন্দরপুরের এমপি তার কেসে ইন্টারফেয়ার করছে, রীতিমতো নিজের লোকজন দিয়ে তার বাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছে।
এমপির দিকে তাকালো ছফা। তরুণ এমপি রেগেমেগে চেয়ে আছে তার দিকে। ফোনের ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ শুনে গেলো। “উনাকে বলে দিন, আমার কেসের ব্যাপারে যেনো নাক না গলায়,” কথাটা বলে জোনায়েদ রহমানের দিকে তাকালো, তারপর ফোনটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। “নিন…উনার সাথে কথা বলুন।”
জোনায়েদ রহমান দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে চেপে ধরলো। “সুন্দরপুরের এমপি জোনায়েদ রহমান বলছি। আপনি কে বলছেন?” ওপাশ থেকে আশেক মাহমুদের পরিচয় পেয়ে বেশ অবাক হলো এমপি। এরকম কাউকে যে আশা করেনি বোঝাই যাচ্ছে।
তার মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি।
“স্লামালেকুম, ভাই…ভালো আছেন?” ছফার দিকে তাকালো চকিতে। “জি, ভাই…আমিও ভালো আছি।” তারপর ঘিরে থাকা ছেলেগুলোকে এক হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইশারা করলো, মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো ফোনের ওপাশের কথা।
এমপির ছেলেগুলো অবাক হলেও চুপচাপ চলে গেলো উঠোন ছেড়ে। তারাও ভড়কে গেছে কিছুটা।
“ভাই…বুঝতে পেরেছি, কিন্তু মাস্টারসাহেব এই অঞ্চলের সম্মানিত একজন মানুষ…সবাই উনাকে”।
ছফা বুঝতে পারলে, এমপির কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে কথা বলছে আশেক মাহমুদ। অনেকক্ষণ ফোনের ওপাশের কথা শুনে গেলো জোনায়েদ রহমান।
“জি, ভাই…ঠিক আছে…” মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হুম, বুঝতে পেরেছি…স্লামালেকুম, ভাই।” ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ছফার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো সুন্দরপুরের নতুন এমপি। “আশেকভাইয়ের সাথে এই কেসের সম্পর্ক কী?”
উঠে দাঁড়ালো ছফা। হাত বাড়ালো ফোনটা নেবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোনটা দিয়ে দিলো এমপি।
“এসব আপনার জানার দরকার নেই।” ফোনটা পকেটে ভরে নিলো সে। “আপাতত মাস্টারের সাথে আমার কাজ শেষ। ভদ্রলোক আমার কাছে স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি কবে কিভাবে উনার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। উনার কোনো দরকারই ছিলো না আপনাকে এসব জানানোর।”
হতভম্ব এমপি চেয়ে রইলো ছফার দিকে।
“আতর আলী আর তার ঐ ছেলেটা,” শান্তকণ্ঠে বললো নুরে ছফা। “তারা আমার হয়ে কাজ করেছে…তাদেরকে কিছু করবেন না, ঠিক আছে?”
জোনায়েদ রহমান হ্যাঁ না কিছুই বললো না। চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে রইলো।
তাকে একা রেখে চলে গেলো ছফা। এখানে আর কোনো কাজ নেই। সুন্দরপুরের পাট চুকে গেছে আপাতত।
.
অধ্যায় ৩২
রমাকান্তকামার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এলেন।
একটু আগে তার স্নেহধন্য ছাত্র জোনায়েদ লোকমারফত তার কাছে খবর পাঠিয়েছে, ঐ নুরে ছফার পেছনে নাকি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মতো ক্ষমতাবান একজন মানুষ। তিনি যেনো ঘুণাক্ষরেও সন্দেহভাজন কারোর সাথে যোগাযোগ না করেন। এসব থেকে তার দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো হবে।
অলোকনাথের নাতবৌ তিন বছর আগে তার কাছে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলো ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের মাধ্যমে-সে কথা ডিবি অফিসারকে বলা উচিত হয়েছে কিনা বুঝতে পারছেন না এখন। এরকম সততা না দেখালে কী এমন ক্ষতি ছিলো? যুধিষ্ঠিরও প্রয়োজনে মিথ্যে বলেছিলেন তিনি কি বলতে পারতেন না? তার তো মিথ্যে বলারও দরকার ছিলো না। স্রেফ বলে দিলেই পারতেন, কে পাঠিয়েছিলো সেটা তার মনে নেই। তিন বছর আগে কে একটা চিরকুট পাঠিয়েছে সেটা তার মতো বয়স্ক মানুষের স্মরণে না থাকারই কথা। তার চেয়েও ভালো হতো, চিরকুটটা নষ্ট করে ফেললে।
উকিল ভদ্রলোককে পুরো বিষয়টা জানিয়ে সতর্ক করার দরকার কিন্তু জোনায়েদের সতর্কবাণীর কারণে সে কাজও করতে পারছেন না। ডিবি অফিসার কিছুক্ষণ আগেই সুন্দরপুর ছেড়ে চলে গেছে, তার পরবর্তী টার্গেট যে উকিল হবে তাতে কোনো সংশয় নেই।
ডাক্তার আসকারের সাথে যে তার যোগাযোগ হয় মাঝেমধ্যে সেটাও ছফা বের করে ফেলবে খুব দ্রুত। আজকাল মোবাইলফোন হয়ে উঠেছে খুবই দরকারি আর ক্ষতিকর একটি জিনিস। এটা না থাকলে চলে না, আবার এটাই হয়ে উঠেছে সব নষ্টের মূল।
অবশ্য ডাক্তারকে তিনি ট্রাস্টের সদস্য করেননি, করার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলোকের সাথে তার পরিচয়ও ছিলো না। তিনি জানতেন না, লোকটার সাথে রাশেদের স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো। ভদ্রমহিলা যখন সুন্দরপুরে ছিলো তখন নাকি মাঝেমধ্যে এখানে আসতেন-এ কথা তিনি জেনেছেন অনেক পরে।
ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন অবশ্য দাবি করেছে, রাশেদ জুবেরি নিজেই নাকি তাকে সদস্য করার কথা বলে গেছিলেন। অন্যদিকে, ভদ্রলোককে ট্রাস্টের সদস্য করায় বেশ উপকারও হয়েছে। প্রখ্যাত চিকিৎসক তিনি, তার সামাজিক অবস্থান আর উঁচুমহলে ভালো যোগাযোগ ট্রাস্টের বেশ কাজে লেগেছে। যখনই দরকার পড়েছে ভদ্রলোক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন কি বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি সাহায্য করেছেন। মাস্টারের সাথে খুব অল্প ক-দিনেই তার সাথে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তার ফোনে যে কয়জনের নাম্বার আছে, তার মধ্যে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ অন্যতম। তাকে কি ফোন করে সব কিছু বলা দরকার?
রমাকান্তকামার এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। তার ধারণা, ডাক্তারের সাথে রাশেদের স্ত্রীর যোগাযোগ আছে।
মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন।
আরেকটা বিষয় তার মাথায় ঢুকছে না-প্রধানমন্ত্রীর পিএস কেন মুশকান জুবেরির কেসে আগ্রহী? ভদ্রলোকের সাথে এসবের কী সম্পর্ক?
এর আগে সুন্দরপুরের অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন, প্রয়াত এমপি আসাদুল্লাহই ছফাকে লেলিয়ে দিয়েছিলো মহিলার পেছনেতার উদ্দেশ্য ছিলো, অলোকনাথের সমস্ত সম্পত্তি করায়ত্ত করা। কিন্তু সুদূর ঢাকা থেকে এরকম ক্ষমতাবান একজন মানুষ কেন ঐ ভদ্রমহিলার পেছনে লাগবে? তার উদ্দেশ্যটাই বা কী?
কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না রমাকান্তকামারের।
.
অধ্যায় ৩৩
ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত আছে। এই পেশায় সুনাম-দুনাম দুটোই সমানভাবে হাত ধরাধরি করে চলে। উকিলদের দুর্নাম থাকবে না তা কি হয়-ময়েজ উদ্দিন ওসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না। পেশাদার আইনজীবি হিসেবে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ সে। ঢাকা ক্লাবের মতো বনেদী জায়গায় সুযোগ না পেলেও সদ্য গজে ওঠা উত্তরা ক্লাবে ঠিকই ঠাই করে নিতে পেরেছে।
তার গ্রামের ক-জন আসতে পেরেছে এমন অবস্থানে? ঝালকাঠি নামের এক জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের কৃষকের ছেলে হিসেবে তার পক্ষে বড়জোর সারের ডিলার হওয়া ছাড়া আর কিছু হবার সুযোগ ছিলো না। তার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে তাকে বাদ দিলে, ঐ সারের ডিলারই সবচেয়ে ভালো পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়।
আদালতে গিয়ে কালো কোট পরে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার যে পরিচিত দৃশ্যটি দেখা যায় নাটক-সিনেমায়, সেরকম কোনো আইনজীবি ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার নয়। তার কাজকারবার সব কাগজে কলমে। অসংখ্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার সে, পাশাপাশি আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল পেপারওয়ার্কের কাজ করে থাকে। যে কোনো ব্যবসায়িক দলিল-চুক্তি আর বেচাকেনার কাজগুলো ক্লায়েন্টের স্বার্থে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। আর বলাই বাহুল্য, ক্লায়েন্টের হয়ে এরকম কাজ করতে গেলে প্রায়শই অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। এসব নিয়েও ময়েজ উদ্দিনের কোনো মাথাব্যথা নেই। নীতি-নৈতিকতা হলো অতি আদর্শবাদীদের মানসিক সমস্যা। ওই দলে সে পড়ে না। তবে এসব করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে যে পুলিশি ঝামেলায়ও পড়তে হয় সেটাই একমাত্র বিড়ম্বনা। আইনের সমঝদার হিসেবে এসব ঝামেলা থেকে কিভাবে নিস্তার পাওয়া যায় তাও সে ভালো করেই জানে।
এ মুহূর্তে দুপুরে লাঞ্চ করে পুরানা পল্টনের চেম্বারে বসে আছে সে, তার সামনে বসে আছে ডিবির এক কর্মকতা। আইনজীবী হিসেবে এসব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে ময়েজ উদ্দিন ভয় পায় না কখনও। তাদের হম্বিতম্বিকে ঠাণ্ডা মাথায় দন্তবিকশিত হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয় খুব সহজেই। এখনও সেটাই করছে।
“আমি তো বললামই, মুশকান জুবেরি নামের কাউকে চিনি না,” কথাটা বেশ জোর দিয়ে কিন্তু ধীরস্থিরভাবে বললো উকিল ভদ্রলোক। “আপনি আমার কাছে কেন এই মহিলা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।”
বাঁকাহাসি দিলো নুরে ছফা।
“আপনি তো এটাও বলছেন না, মহিলা করেছেটা কি?” যেনো নিদোষভাবেই জানতে চাইলো উকিল।
“মুশকান জুবেরি বেশ কয়েকজন মানুষ হত্যা এবং গুমের সন্দেহভাজন আসামি।”
আইনজীবী ভুরু কপালে তুলে ছফার কথাটা পুণরুক্তি করলো, “সন্দেহভাজন আসামি। আচ্ছা। মহিলা কেন ঐসব লোকজনকে গুম করলো? মানে, তার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো?”
বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “এটা আপনার না জানলেও চলবে।”
কাঁধ তুললো ভদ্রলোক। “তা ঠিক। এসব আমার জানার দরকার নেই।” একটু থেমে আবার বললো, “যাই হোক, আমার ক্লায়েন্টের সাথে এই মুশকান জুবেরি নামের সন্দেহভাজনের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিলো, তবে যে-সব লিগ্যাল পেপারওয়ার্ক করেছি ট্রাস্টের ট্রাস্টি রমাকান্তকামারের হয়ে, তার সাথে এই মহিলার কোনো সম্পর্ক নেই।”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছফা, তারপর পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিলো উকিলের দিকে। “এটা একটু দেখুন।”
ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে ঠোঁট ওল্টালো। “এটা কি? কে লিখেছে…কাকে লিখেছে?”
হেসে ফেললো ছফা। “আপনার স্মৃতিশক্তি দেখি বেশ দুর্বল।”
“তা বলতে পারেন, বয়স তো কম হলো না। সামনের বছর ষাটে পা দেবো।” নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে সে।
মুচকি হাসলো ছফা। “রমাকান্তকামার আমার কাছে গতকালই স্বীকার করেছেন, মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এটা পাঠিয়েছিলো আপনার মাধ্যমে…তিন বছর আগে।”
“তিন বছর আগে?” অবাক হবার ভান করলো আইনজীবী। “বলেন কি! যে মহিলার সাথে জীবনে যোগাযোগ হয়নি, তার চিঠি আমি রমাকান্তবাবুকে দিয়েছি?”
চোয়াল শক্ত করে ফেললো ছফা। “এটা চিঠি না, চিরকুট। চিঠিতে প্রেরক আর প্রাপকের নাম লেখা থাকে, চিরকুটে থাকে না।”
ঠোঁট ওল্টালো উকিল। “চিঠি হোক আর চিরকুট, আমার আসলেই মনে পড়ছে না এটা আমি রমাকান্তকামারকে দিয়েছিলাম কিনা। তিন বছর আগের কথা…কতো কাগজপত্রই তো লেনদেন করতে হয় আমাকে, সব কি মনে রাখা সম্ভব?” একটু থেমে আবার বললো, “আমার ক্লায়েন্ট রমাকান্তবাবুরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে, উনি হয়তো গুলিয়ে ফেলেছেন। ভদ্রমহিলা তো খুব সহজেই বেনামে ডাকযোগে উনার কাছে এটা পাঠাতে পারতেন।”
ছফার ইচ্ছে করলো উকিলের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তাছাড়া একজন আইনজীবীকে চড় মেরে খামোখা মামলা খাওয়ারও কোনো ইচ্ছে তার নেই। এরা পান থেকে চুন খসলেই মামলা ঠুকে দেয়।
“তা পারতেন, কিন্তু মহিলা সেটা করেনি, সে আপনাকেই বেশি বিশ্বস্ত মনে করেছে।”
দাঁত বের করে হাসলো আইনজীবী। “আমার পেশায় কিন্তু বিশ্বস্ততা বিশাল বড় একটি রেপুটেশন। অনেক সময় লেগে যায় এটা অর্জন করতে। কিন্তু যার সাথে আমার পরিচয় নেই তিনি কেন আমাকে বিশ্বাস করতে যাবেন?”
“তাহলে অস্বীকার করছেন, এটা মাস্টারকে দেননি আপনি?”
আবারো নিঃশব্দে হাসলো আইনজীবী। “বললাম না, মনে নেই। আন্দাজে কেন বলবো এটা আমি পাঠিয়েছি? আর অস্বীকারই বা করবো কেন! কতো চিঠিপত্র লেনদেন করতে হয় আমাকে…সব কি মনে থাকে?”
“শুনুন, আমি শুধু একটা তথ্য জানতে চাই,” ধীরকণ্ঠে বললো নুরে ছফা, “মুশকান জুবেরির সাথে আপনার কখন কোথায় যোগাযোগ হয়েছিলো-এখনও যোগাযোগ আছে কিনা। সে এখন কোথায় আছে।”
হেসে ফেললো উকিল, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে জোর দিয়ে বললো, “তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আর ওই মহিলা আমার ক্লায়েন্টও না। এটা বিশ্বাস না করলে আপনার এই তদন্ত কানাগলিতে ঢুকে পড়বে।” এরপর আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিলো সে। “আমার ধারণা, আপনি এরইমধ্যে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছেন।”
গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। “আচ্ছা। তাহলে বলুন, কিভাবে রমাকান্তকামারের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হলেন আপনি? ভদ্রলোক বলেছেন, আপনি কাগজপত্র পাঠানোর আগে উনি আপনাকে চিনতেনই না।”
মাথা দোলালো আইনজীবী। “কথা সত্যি।”
“রমাকান্তকামারের সাথে কিভাবে কন্ট্যাক্ট হয়েছিলো আপনার? কে করিয়ে দিলো সেটা?”
মাথা দোলালো ময়েজ উদ্দিন। “এটা তো বলা যাবে না। কেউ যদি নিজের পরিচয় গোপন রেখে তৃতীয় পক্ষ হয়ে অন্য কারোর ক্লায়েন্ট হবার জন্য আমাকে অনুরোধ করে সেটা কিন্তু বেআইনী নয়। এরকমটা প্রায়ই হয়ে থাকে আমাদের পেশায়। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, মুশকান জুবেরি এ কাজ করেনি।”
ছফার ধৈর্যসীমা শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকলো। “মনে হচ্ছে ঐ মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন।”
এবার আইনজীবী ভদ্রলোকের কৃত্রিম হাসিহাসি ভাবটা উবে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আমি কিন্তু এটাকে হুমকি হিসেবে দেখবো। আপনি সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন আমাকে!”
“আমি হুমকি দিচ্ছি না…বলছি, ঐ মহিলাকে রক্ষা করতে আপনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করতেও রাজি আছেন বলে মনে হচ্ছে,” শুধরে দিলো ছফা। “এটা আমার পারসেপশান।”
“আচ্ছা,” মাথা দোলালো উকিল। “তাহলে সম্ভবত আপনি এটাও আন্দাজ করতে পারছেন, কিভাবে কারা আমার ক্ষতি করতে পারে?”
“তা তো পারছিই।”
“কারা?”
“সেটা কিছুক্ষণ পরই টের পাবেন।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আইনজীবী। “কার কথা বলছেন? কাদের কথা বলছেন আপনি?”
“এমন একজন যার কথা আপনি কোনোভাবেই ফেলতে পারবেন না।”
“হা-হা-হা,” ময়েজ উদ্দিনের অট্টহাসিতে ছোট্ট চেম্বারটা ভরে গেলো। “অনেক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে সেই লোক?”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে হেলান দিলো নুরে ছফা।
“আইনের দিক থেকে আমাকে ধরা, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো কিছু আপনার এবং আপনার ঐ ক্ষমতাধর মানুষটার কাছে নেই-এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।”
“তা মাথায় রাখছি, কিন্তু আপনাকেও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এই দেশে সব কিছু আইন মোতাবেক চলে না, একটু থেমে আবার বললো, “এটা আমার মতো আপনিও ভালো করেই জানেন ক্ষমতাবানেরা আইনের পরোয়া করে না।”
আইনজীবী ভদ্রলোকের কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো। “আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? যা বলার স্পষ্ট করে বলুন।”
“এই মুশকান জুবেরির একজন শিকার হলো প্রাইমিনিস্টারের পিএস আশেক মাহমুদের ভাগ্নে।”
কথাটা শুনে উকিল একটু অবাক হলো।
“তিনি এখন নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে একটা তথ্যই জানতে চাইছেন-মুশকান জুবেরি কোথায় আছে।”
ময়েজ উদ্দিন অপেক্ষা করলো আরো কিছু শোনার জন্য।
“আমি তাকে এই চিরকুটটা দেখিয়েছি…বলেছি, এটা আপনার মাধ্যমে রমাকান্তবাবুকে দিয়েছে ঐ মহিলা। উনি আমাকে বলেছেন, আপনি যদি ভালোয় ভালোয় বলে দেন ঐ মহিলা এখন কোথায় আছে তাহলেই আপনার মঙ্গল। নইলে আপনার কাছ থেকে যেভাবেই হোক এটা বের করে নেবেন।”
“তাহলে উনি আপনাকে কেন পাঠিয়েছেন…নিজে ফোন করলেন না কেন? নাকি সরাসরি ফোন করে হুমকি দিতে ভয় পাচ্ছেন?”
মাথা দোলালো ছফা। উকিল সম্ভবত ভাবছে ক্ষমতাধর একজনের নাম ভাঙিয়ে সে ভয় দেখাচ্ছে তাকে। “উনি কিছু করার আগে আমি নিজে একবার চেষ্টা করে দেখতে এসেছি।”
“উনার হয়ে হুমকিটা দিতে?” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো উকিল।
“না। আপনার পাছা বাঁচাতে!”
ভদ্রলোকের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো আপত্তিকৰ শব্দটা শুনে। কোনো রকমে রাগ দমন করে বললো, “আমার পাছা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজের পাছা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার আছে।” কথাটা বলে গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “আপনি যে আপনার কেসটা নিয়ে কিছুই করতে পারছেন না সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আপনার ঐ পিএস হয়তো অধৈর্য হয়ে আপনাকে খুব চাপের মধ্যে রেখেছে, এখন নিজের পাছা বাঁচাতে এসেছেন আমার কাছে অদ্ভুত এক আব্দার নিয়ে-রাশেদ জুবেরির স্ত্রীর হদিস জানতে চাইছেন!”
ছফার চোখমুখও শক্ত হয়ে গেলো, তারপরও উকিলকে অবাক করে দিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ঠিক বলেছেন, উনি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বলতে পারেন, উনার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছে।”
দাঁত বের করে হাসলো উকিল। “এটাই স্বাভাবিক। তিন বছর ধরে একটা কেস সমাধান করতে পারছেন না, অধৈর্য হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।”
“শুনুন, আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ক্ষমতাবান মানুষেরা তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান মানুষজনের সাথে ডিল করার সময় খুব বেশি ধৈর্য দেখান না।”
“এটাই স্বাভাবিক। আপনি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।”
মুচকি হেসে মাথা দোলালো নুরে ছফা। “শুধু আমার কথা না ভেবে নিজেকেও হিসেবের মধ্যে রাখবেন।”
“আপনি আবারো হুমকি দিচ্ছেন কিন্তু!” তেঁতে উঠলো ভদ্রলোক।
গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। “একটু ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাটা শুনুন, এই তদন্তের জন্য দরকার শুধু সামান্য একটি তথ্য। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়তো আপনি দেবেন কিন্তু অনেক জল ঘোলা করে।”
ছফার কথাটা শুনে চিন্তিত দেখালো আইনজীবীকে কিন্তু মেজাজের ঝাঁঝ একটুও কমালো না। “জল ঘোলা করতে কী বোঝাচ্ছেন? উনি কী করবেন, অ্যাঁ?”
“কী আর করবেন, সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে জেনে নেবেন মুশকান জুবেরি এখন কোথায় আছে।”
“আরে, বার বার এক কথা বলছেন কেন!” চটে গেলো উকিল। “বললাম না, ঐ মহিলার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই! জীবনে তার সাথে আমার কথাও হয়নি, দেখা হবার তো প্রশ্নই ওঠে না! আমি কিভাবে তার খোঁজ দেবো?!”
“তাহলে উনার চিরকুটটা রমাকান্তকামারকে দিলেন কিভাবে?”
উকিলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আমি সেটা কাউকে বলতে বাধ্য নই। আপনার ঐ ক্ষমতাধর পিএস কী বাল ফেলবে ফেলুক!” ময়েজ উদ্দিন ক্ষেপে গেলো এবার। “উনাকে বলে দেবেন, এইসব মাস্তানি আর গুন্ডামি আমার সাথে যেনো করতে না আসে!”।
আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা দোলালো ছফা। তাহলে উনাকে বলে দেই, আমি ব্যর্থ…যা করার উনিই করুক।”
ছফার কণ্ঠের শীতলতা টের পেয়ে উকিল বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “কী করবে আপনার ঐ পিএস, অ্যাঁ? আমাকে তুলে নিয়ে যাবে?” চেঁচিয়ে উঠলো এবার। “গুম করবে?”
“সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
ভদ্রলোকের চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো, কপাল গেলো কুঁচকে। চট করে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। “গেট লস, ইউ স্কাউড্রেল!” রীতিমতো কাঁপতে লাগলো সে। “গুম-খুন করতে করতে সাহস অনেক বেড়ে গেছে, অ্যাঁ? দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে শালারা! যা খুশি তাই করবে?!”
ছফা নির্বিকার মুখে বসে রইলো চেয়ারে হেলান দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করলো লম্বা, পেটানো শরীরের একজন মানুষ। ছোটো করে ছাটা চুল, শ্যাম বর্ণের কঠিন মুখ। লোকটাকে ঢুকতে দেখে উকিল ভদ্রলোক ভড়কে গেলো।
.
অধ্যায় ৩৪
“কে আপনি?”
“চুপ!” উকিলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো এইমাত্র ঘরে প্রবেশ করা বলিষ্ঠ দেহের লোকটি। “কথা বললেই গুলি করে দেবো!” কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে আনলো সে, উকিলের মুখের কাছে অস্ত্রটা নেড়ে ইশারা করলো তাকে বসে পড়ার জন্য।
“আস্তে,” ছফা বললো সেই লোকের উদ্দেশ্যে। “সেফটি লক অফ আছে তো? গুলিটুলি না আবার বের হয়ে যায়!”
বলিষ্ঠ দেহের লোকটা পিস্তল নামিয়ে রাখলেও জায়গা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়ালো না।
“আপনি বসুন,” ছফা আদেশের সুরে বললো ময়েজ উদ্দিনকে।
চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বসে পড়লো উকিল, কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
“ও একা না, বাইরে আরো লোকজন আছে, একটা মাইক্রোবাসও আছে।”
ঢোঁক গিললো ভদ্রলোক।
“তবে আমি ঝামেলা করতে চাইছি না। আপনাকে তুলে নিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। পিএসকে আমি কথা দিয়েছি, আপনি যদি আমার সাথে কো-অপারেট করেন তাহলে এসবের কোনো দরকারই হবে না।”
ছফার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার। “ওটা যে মুশকান জুবেরির চিরকুট আমি জানতাম না…সত্যি বলছি,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বললো সে। “আমি শুধু কিছু কাগজপত্রের সাথে ওটা রমাকান্তবাবুকে দিয়েছিলাম।”
“চিরকুটটা আপনাকে কে দিতে বলেছিলো?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে উকিল বললো, “ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।”
তথ্যটা বিস্মিত করলো ছফাকে। মুশকানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ডাক্তারকে আগে থেকেই সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত ছিলো, কিন্তু প্রবীন এই ভদ্রলোককে মুশকান জুবেরি ব্যবহার করেছে, আদতে ডাক্তার আসকার এসব কর্মকাণ্ডের সাথে মোটেও জড়িত নন, মুশকানের কারণেই ভদ্রলোক আমেরিকায় পালিয়ে যান ঝামেলা থেকে বাঁচতে-কিছু দিন তার পেছনে সময় ব্যয় করার পর এমন ধারণাই পোষণ করতো ছফা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, লোকটার পেছনে আরো সময় এবং শ্রম ব্যয় করা উচিত ছিলো।
“উনি কেন আপনাকে দিয়ে এটা পাঠালেন?”
একটু ইতস্তত করলো উকিল। “উনিই আমাকে ট্রাস্টের ল-ইয়ার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।”
নুরে ছফা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এটা। পরক্ষণেই তার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো-ডাক্তার আসকার আমেরিকায় যাবার আগে না পরে এ কাজ করেছেন?
“চিরকুটটা উনি কবে দিয়েছিলেন আপনাকে?”
“অনেক দিন আগে, তিন বছর তো হবেই।”
“আমি সঠিক সময়টা জানতে চাইছি।”
“আমাকে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। ট্রাস্টের কাগজপত্র তৈরি করে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম রমাকান্তবাবুকে…ওটার রেকর্ড আছে।”
“তাহলে কাগজপত্র দেখে বলুন,” ছফা আদেশের সুরে বললো।
উকিল ভদ্রলোক প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে ডেস্কের ড্রয়ার ঘেটে অবশেষে একটা নথি বের করে আনলো। “এটা…”
উকিলের হাত থেকে নথিটা নিয়ে তারিখটা দেখে নিলো ছফা।
“চিরকুটটা পাঠিয়েছি এই তারিখে, তবে ওটা পেয়েছি আরো দু-দিন আগে।”
ছফা নড়েচড়ে বসলো। মুশকানের কেসের অনেক কিছুই তার মুখস্ত। সে ভালো করেই জানে, কবে কখন ডাক্তার দেশ ছেড়েছিলেন।
“এটা কিভাবে সম্ভব! ডাক্তার তো তার আগেই আমেরিকায় চলে গেছিলেন!” অনেকটা আপন মনেই বলে উঠলো সে।
“তা তো জানি না। উনি আমার চেম্বারে না এসে বাসায় গিয়ে চিরকুটটা দিয়েছিলেন। একটা মুখবন্ধ খামে ছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। মুশকান জুবেরি নিজে এসে চিরকুট দেবার মতো কাঁচা কাজ করবে না। তাছাড়া আইনজীবীর সাথেও তার সম্ভবত কোনো রকম যোগাযোগ নেই–এসব কাজ ডাক্তার আসকারই করেছেন।
“ডাক্তার তাহলে ঢাকায়ই ছিলেন!” কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না। ভদ্রলোক যে আমেরিকায় চলে গেছেন এটা খতিয়ে দেখা দরকার ছিলো। সম্ভবত দেশের ভেতরেই কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন, তারপর হয়তো বিদেশে চলে যান। আবার এমনও হতে পারে, ডাক্তার বিদেশে গিয়ে কিছু দিন পর দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তততদিনে ছফা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিলো তার ব্যাপারে। ধরেই নিয়েছিলো, ভদ্রলোক সহসা দেশে ফিরে আসবেন না।
“উনি কোথায় ছিলেন না ছিলেন সেটা তো আমি জানি না,” উকিল এখন পরাভূত মানুষ, নিজ থেকেই বলতে লাগলো। আমি যা জানি তা-ই বললাম আপনাকে। এটাই সত্যি। বিশ্বাস করুন।”
“এরপর কি আপনার সাথে উনার আর যোগাযোগ হয়নি?”
“হয়েছে, তবে ফোনে।”
“কোত্থেকে ফোন করেছিলেন উনি?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।
একটু ইতস্তত করলো উকিল। “দেশের বাইরে থেকে।”
“কোন দেশ থেকে?”
“নাম্বার দেখে মনে হয়েছে আমেরিকা থেকেই কলটা করেছিলেন।”
ছফার সমস্ত উত্তেজনা দপ করে নিভে গেলো। কয়েক মুহূর্ত উকিলের দিকে চেয়ে থেকে বললো, “শেষ কবে যোগাযোগ হয়েছিলো উনার সাথে?”
“গত বছর।”
“ডাক্তার যে নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন…”
কথাটা শেষ করার আগেই ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার মাথা দুলিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলো। “এক বছর আগের ঘটনা, নাম্বারটা আর কললিস্টে নেই।”
একটু ভেবে নিলো ছফা। “উনি আপনাকে কী জন্যে ফোন দিতেন?”
“ট্রাস্টের কাজকর্ম ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, খোঁজখবর নিতেন আর কি।”
“উনি ট্রাস্ট নিয়ে এতো মাথা ঘামান কেন?”
প্রশ্নটা শুনে ময়েজ উদ্দিন একটু অবাক হলো যেনো। “ট্রাস্ট্রের একজন মেম্বার হিসেবে খোঁজখবর নেবেন না?”
ছফা চমকে গেলো। ডাক্তার আসকার ট্রাস্ট্রেরও সদস্য! এটা সে জানতো না। আসলে, রমাকান্তকামার ছাড়াও যে ট্রাস্টে আরো কয়েকজন সদস্য আছে সেটা নিয়ে কখনও আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। “উনাকে কি মাস্টার নিজে ট্রাস্টের মেম্বার করেছেন নাকি…?”
“এটা রাশেদ জুবেরির ইচ্ছেতে হয়েছে। ডাক্তারের সাথে মি. জুবেরির ঘনিষ্ঠতা ছিলো।”
“হুম…বুঝতে পেরেছি,” শুধু এটুকুই বললো ছফা। মাস্টার তাকে এটা বলেননি। সেজন্যে ভদ্রলোককে দোষও দেয়া যায় না। দরকারের বাইরে আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু বলার মতো লোক নন তিনি।
“দেখুন, আমি যা জানতাম বলে দিয়েছি, এর বেশি কিছু জানি না,” উকিল ভদ্রলোক বললো। “এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা, তারপর পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন চেহারার লোকটার দিকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে গেলো ময়েজ উদ্দিনের দিকে।
“কী হচ্ছে! কী হচ্ছে!” একদম ভড়কে গিয়ে বলে উঠলো উকিল, নিজের চেয়ারে সেঁটে থাকার চেষ্টা করলো। “আমি সত্যিই বলেছি…বিশ্বাস করুন!”
জাঁদরেল চেহারার লোকটি উকিলের কলার ধরলো আস্তে করে।
ময়েজ উদ্দিন সাহায্যের আশায় তাকালো ছফার দিকে। “আ-আপনি আমাকে বলেছিলেন সত্যিটা বললে আমার কোনো ক্ষতি করবেন না…আমি কিন্তু সব সত্যি বলেছি!”
“হুম, তা বলেছিলাম,” বললো ছফা। “কিন্তু সত্যি বলেছেন নাকি মিথ্যে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে আমাকে।”
উকিলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “খতিয়ে দেখবেন মানে?” একটা ঢোঁক গিলে আবার বললো, “কিভাবে?”
এবার মুচকি হাসি দিলো ছফা। “ভয়ের কিছু নেই। আপনি আপনার ফোনটা ওকে দিয়ে দিন।” পিস্তল হাতে লোকটাকে দেখিয়ে বললো সে। “ডেস্ক ড্রয়ার আর ক্যাবিনেটের চাবিটাও।”
উকিল ভদ্রলোক স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু অস্ত্রধারী অপেক্ষা করলো না, ময়েজ উদ্দিনের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলফোনটা বের করে আনলো, তারপর আইনজীবীর কাঁধে টোকা দিয়ে চাবিগুলো চাইলো সে।
মন্ত্ৰতাড়িতের মতো ময়েজ উদ্দিন ডেস্কের উপরের দিকে একটা ড্রয়ার থেকে চাবির গোছাটা বের করে দিয়ে দিলো লোকটাকে।
নুরে ছফা ষণ্ডাটার কাছ থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে নিলো। “তুমি সবগুলো ড্রয়ার চেক করে দেখো। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে।”
“জি, স্যার,” লোকটা বললো, তারপর উকিলের দিকে তাকালো। “চুপচাপ এখানেই বসে থাকুন। একদম শব্দ করবেন না।”
উকিলের ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করে দিলো ছফা। ওদিকে পিস্তল হাতে লোকটা উকিলের ফাইল কেবিনেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
“আপনি আমার কাগজপত্র এভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন না!” আহত কণ্ঠে বললো ময়েজ উদ্দিন। “অনেক জরুরী কাগজপত্র আছে…ক্লায়েন্টদের অনেক গোপনীয়-”।
ছফা শীতল চোখে তাকালে উকিল ভদ্রলোক কথার মাঝপথে থেমে গেলো, আবারও নিজের কাজে ফিরে গেলো সে।
কয়েক মুহূর্ত পর, আইনজীবী ভদ্রলোকের দিকে তাকালো নুরে ছফা। ফোন ঘাঁটতে গিয়ে সে দেখেছে, রুবিনা নামের একজনের সাথে ভদ্রলোকের প্রণয়ঘটিত অসংখ্য মেসেজ। এই সেলফোন জিনিসটা যে আজকাল মানুষের সবচাইতে বড় প্রাইভেসি স্টোররুম হয়ে উঠেছে সেটা তার মতো তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে ভালো আর কে জানে। কারোর ফোন মানেই অসংখ্য গোপনীয় কাজকারবারের ভাণ্ডার।
“আমার কথা আপনি বিশ্বাস করেননি!” আশাহত কণ্ঠে বললো উকিল।
“এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার না,” চোখ না তুলেই বললো ছফা। “এটা একেবারেই বিশুদ্ধ একটি তদন্তের বিষয়।”
“অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করাকে আপনি তদন্ত বলছেন?”
মুচকি হাসলো ছফা, তার চোখ এখনও ফোনের দিকে নিবদ্ধ। “তদন্ত করার সময় প্রাইভেসি লঙ্ঘন হলে কী হলো না এসব নিয়ে মাথা ঘামালে এগোনোই যায় না। তারপর মুখ তুলে আশ্বস্ত করে বললো, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, আমার কেসের সাথে সম্পর্ক নেই এরকম কোনো কিছু নিয়ে আগ্রহ দেখাবো না। সেটা কোনো পরনারীর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারই হোক কিংবা গোপন কোনো ক্লায়েন্টের কথাই হোক না কেন।”
উকিলের চেহারা আরক্তিম হয়ে গেলো কথাটা শুনে।
আবারও মনোযোগ দিয়ে কললিস্ট আর মেসেজ বক্স ঘাঁটতে লাগলো ছফা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ময়েজ উদ্দিনের ভেতর থেকে। “আপনি আমার ফোনটা রাখনু, মি. ছফা, কয়েক মুহূর্ত পর আস্তে করে বললো সে। “আর ওকেও থামতে বলুন,” ষণ্ডাটাকে ইঙ্গিত করলো এবার।
মুখ তুলে তাকালো ছফা। তার চোখেমুখে প্রশ্ন।
গভীর করে দম নিলো ভদ্রলোক। “এসব ঘাঁটাঘাঁটি করে ডাক্তারের খোঁজ পাবেন না,” ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বললো উকিল। “ডাক্তার আসকার আমাকে না বললেও আমার ড্রাইভার জানে উনি কোথায় থাকেন।”
.
অধ্যায় ৩৫
ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের চেম্বার থেকে বের হয়েই প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদকে ফোন করেছিলো ছফা। উকিল ভদ্রলোক যে অবশেষে মুখ খুলেছে সেটা জানিয়ে দেয়া হয় তাকে।
তিন বছর আগে সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসার পর মুশকান জুবেরি উঠেছিলো ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের ফ্ল্যাটে। তারপর একই ভবনে অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকা নিঃসঙ্গ এমপি আসাদুল্লাহকে হত্যা করার পর পর আত্মগোপনে চলে যায় সে। মহিলার সঙ্গে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদও লাপাত্তা হয়ে যান। সুতরাং মুশকানকে ধরতে হলে ডাক্তারকে কজায় নিতে হবে সবার আগে। ডাক্তারই জানেন মুশকান কোথায় আছে। তাই ছফা এখন পিএসের ব্যক্তিগত গানম্যান আসলামকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বনানীতে।
ময়েজ উদ্দিনকে যতোটা ভয় দেখানোর দরকার ছিলো ততোটাই করেছে। একটুও বাড়াবাড়ি করেনি। তা করার অবশ্য দরকারও ছিলো না। তার মেদহীন পেটানো শরীর আর জাঁদরেল চেহারাটাই যথেষ্ট ছিলো। পিস্তল হাতে অমন কঠিন মুখের কাউকে দেখলে ভয় পাবারই কথা। তার আরেকটি গুণ হলো, দরকার না পড়লে সে খুব একটা কথা বলে না। বাড়তি কোনো প্রশ্নও করে না।
এতো দিন ছফা জানতো, ডাক্তার আমেরিকায় চলে গেছেন, কিন্তু ট্রাস্টের উকিল তাকে জানিয়েছে, ভদ্রলোক আমেরিকায় গেলেও মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। আর ঢাকায় কোথায় থাকেন সেটাও উকিলের জানা আছে!
এখন দরকার আসকার ইবনে সায়িদকে নিজের কজায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার। স্বনামখ্যাত ডাক্তার হিসেবে তার সাথে রয়েছে সমাজের উঁচু মহলে ভালো যোগাযোগ। পিএস যেনো ছফাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন-এমন অনুরোধের কথা শুনে আশেক মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছে, এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রশাসন কিংবা বড় কোনো রাজনৈতিক নেতা তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এগুলো সামাল দেবার ক্ষমতা তার রয়েছে।
যে গাড়িটা আসলাম চালাচ্ছে সেটা পিএসের দুটো সরকারী গাড়ির একটি-পথে কোনো রকম ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে যেনো পড়তে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা-আশেক মাহমুদ যেচে এই গাড়িটা আর নিজের গানম্যান আসলামকে দিয়েছে তাকে। আরো বলে দিয়েছে, লোকবলের দরকার পড়লে ছফা যেনো কোনো রকম সঙ্কোচ না করে। অবশ্য এ মুহূর্তে সেটার কোনো দরকারও দেখছে না সে। সত্তুরোর্ধ এক ডাক্তার, কেএস খানের মতো ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের একজন সাবেক ডিবি অফিসারের সামনেই ঘাবড়ে গিয়ে সব গরগর করে বলে দিয়েছিলেন, ছফার মুখোমুখি হলে কী করবেন তিনি?
মুচকি হাসলো নুরে ছফা। উকিল ভদ্রলোক যখন বুঝতে পারলো নিজের উপরে ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছে তখন ঠিকই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ডাক্তার আসকার কখনও উকিলকে বলেননি তিনি কোথায় আছেন, কিন্তু ময়েজ উদ্দিন অদ্ভুতভাবেই জেনে গেছিলো তার বাড়ির হদিস।
প্রায় বছরখানেক আগে তার দীর্ঘ দিনের ড্রাইভার চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চলে গেলে একজন নতুন ড্রাইভারের দরকার পড়ে, তখন পরিচিত একজনের রেফারেন্স নিয়ে এক ড্রাইভার আসে তার কাছে ইন্টারভিউ দিতে। ময়েজ উদ্দিন যখন জানতে চায় এর আগে সে কোথায় কাজ করেছে, তখন ঐ লোক জানায়, দীর্ঘদিন সে কাজ করেছে। ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নামের এক ডাক্তারের ড্রাইভার হিসেবে।
নড়েচড়ে ওঠে উকিল। ডাক্তারের চাকরিটা তাহলে ছেড়ে দিলে কেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার জানায়, ডাক্তার এখন ঘন ঘন দেশের বাইরে যান, মাসের পর মাস বাইরে থাকেন, সেজন্যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন।
ডাক্তারের সাবেক ড্রাইভারকেই ময়েজ উদ্দিন তার ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ঐ ইন্টারভিউয়ের পরে। ফলে নিজের ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে, খুব সহজেই তার পুরনো মনিবের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নেয় উকিল।
ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারের পুরানা পল্টনের অফিস থেকে বিকেলে বের হলেও বনানীতে পৌঁছাতে পাক্কা দেড় ঘণ্টা লেগে গেলো ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের কারণে। বনানীর তিন নাম্বার রোডের ১২ নাম্বার বাড়িটার সামনে ছফাদের গাড়ি থামলো সন্ধ্যার একটু আগে।
গাড়ির ভেতর থেকেই বাড়িটার দিকে তাকালো সে। এটা বনানীর খুব কম সংখ্যক অভিজাত বাড়ির একটি, যা এখনও ডুপ্লেক্স হিসেবে টিকে আছে। আশেপাশে সবগুলো বাড়ি সময়ের আবর্তে মাল্টিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্টে রুপান্তরিত হয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে পড়লো নুরে ছফা, বন্ধ গেটটায় টোকা মারলো সে। আসলাম ড্রাইভিং সিট থেকে বের হয়ে এসে গেটের ডানদিকে থাকা কলিংবেলের সুইচ টিপে দিলো।
প্রায় তিন-চার মিনিট পর বিশাল গেটটার মাঝে যে ছোটো দরজা আছে সেটা খুলে মাথা বের করলো এক লোক। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ছফা মুখ খুললো।
“ডাক্তারসাহেব আছেন না?”
ভুরু কুঁচকে গেলো তার। “আপনারা কারা?!”
আসলাম খপ্ করে তার কলার ধরে ফেললো। “ডাক্তার কোথায়?”
আসলামের এমন আচরণে ভড়কে গেলো লোকটা।
“আমরা পুলিশ। বুঝতে পেরেছিস?”
লোকটার চেহারা দেখে মনে হলো এই জীবনে কখনও কোনো পুলিশ তার কলার ধরে কিছু জানতে চায়নি।
“ডাক্তার ছাড়া আর কে থাকে এখানে?” ছফা বেশ শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো। তার ভাবভঙ্গিটাই এমন, ভালো করেই জানে এখানে ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ থাকেন।
লোকটা ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে আছে দেখে আসলাম একটা ঝাঁকুনি দিলো তাকে। “স্যারের কথার জবাব দে, বানচোত!”
“আ-আর তো কেউ থাকে না।”
ছফা আর আসলাম আস্তে করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
“দরজা বন্ধ করে দে,” হুকুমের স্বরে বললো আসলাম।
দারোয়ান ভড়কে গেলেও কথামতোই কাজ করলো।
“স্যার, একে কী করবো?” ছফার কাছে জানতে চাইলো গানম্যান।
“ওকে আমাদের সাথে নিয়ে আসো,” কথাটা বলেই ছোট্ট লনটা পেরিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে।
আসলাম যুবকের এক হাত শক্ত করে ধরে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে চললো ছফার পেছন পেছন।
“ডাক্তার কি নীচতলায় থাকেন?” পেছনে না তাকিয়েই জানতে চাইলো ছফা।
“না, উপর তলায় থাকেন,” জবাব দিলো যুবক।
নীচ তলায় ঢুকে একটা আধপেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো তারা তিনজন। কেউ কোনো শব্দ করলো না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ছফা দেখতে পেলো ডাক্তার আসকার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। নিরিবিলি বাড়িতে শোরগোলের আওয়াজ শুনে হয়তো খোঁজ নেবার জন্য নীচে নামতে যাচ্ছিলেন তিনি।
.
অধ্যায় ৩৬
সিঙ্কের নাইট গাউন পরা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সৌম্যকান্ত অবয়বটি সামান্য কুঁজো হয়ে আছে, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার ল্যান্ডিংয়ের কাছে। একটু আগে কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনি যথেষ্ট অবাক হয়েছিলেন। এরকম কিছুর আশঙ্কা যে তার মনে উঁকি দেয়নি তা নয়, কিন্তু সত্যি বলতে, নুরে ছফাকে মোটেও আশা করেননি তিনি!
“কেমন আছেন, ডাক্তারসাহেব?” সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মুচকি হেসে বললো ছফা। “খুব অবাক হয়েছেন মনে হয়।”
ঘটনার আকস্মিকতায় ডাক্তার কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো প্রকট হলো।
“আপনার পেছনে আমার আরো সময় ব্যয় করা দরকার ছিলো,” অনেকটা অফসোসের সুরে বললো সে। “বলতে লজ্জা নেই, আপনাকে আমি খাটো করে দেখেছিলাম।”
ডাক্তার কিছুই বললেন না।
“তো, আমেরিকা থেকে কবে এলেন?”
“যাওয়া আসার মধ্যেই আছি। শেষবার এসেছি গত মাসে,” বেশ শান্ত কণ্ঠেই বললেন ভদ্রলোক।
কপালে চোখ তুলে ফেললো ছফা।
“এতে অবাক হবার কিছু নেই, আমি ফ্রিকোয়েন্টলি ট্রাভেল করি…এটা সবাই জানে।”
“কিন্তু সবাই যেটা জানে না তা হলো, আপনি আগে কখনও ঢাকায় এসে চোরের মতো ঘাপটি মেরে থাকতেন না।”
ডাক্তার নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলেন, তবে চোর শব্দটার ব্যবহারে ভেতরে ভেতরে যে রুষ্ট হয়েছেন সেটা অবশ্য বোঝা গেলো। “দেশে ফিরে এলে ঘোষণা দিয়ে জানাতে হবে তা তো জানতাম না,” আস্তে করে বললেন তিনি। “নাকি আমি কোনো ফেরারি আসামি? থানায় গিয়ে রিপোর্ট করার কথা ছিলো?”
ছফা অবাক হলো ডাক্তারের এমন কথায়। কেএস খান আর জাওয়াদের কাছ থেকে যতোটুকু জেনেছে, এই লোক খুব সহজেই ভেঙে পড়েছিলেন-নরম, ভঙ্গুর আর ভদ্র একজন মানুষ। কিন্তু এখন তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, লোকটা অতো নরম স্বভাবের নয়।
“আপনি তো আপনার নিজের হাসপাতালকেও কিছু জানাননি?”
“আমার নিজের হাসপাতাল, আমি কাকে জানাবো?” মাথা দোলালেন ডাক্তার। “আপনাকে মনে রাখতে হবে, ওখানকার কারো কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয় না, বরং হাসপাতালের সবাই আমার কাছে জবাবদিহি করে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “হুম, তা ঠিক। এই সুবিধাটুকু আপনার আছে। হাজার হলেও, ওটার ত্রিশ পার্সেন্ট মালিক তো আপনিই।”
“তিন বছর আগের কথা,” ডাক্তার বললেন। “মনে হচ্ছে আপনি পুরোপুরি আপডেটেড নন। পার্সেন্টেজটা এখন পাঁচচল্লিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।”
কপালে চোখ উঠে গেলো নুরে ছফার। “তাহলে কংগ্র্যাচুলেশন্স, ডাক্তার।”
গুভেচ্ছাটি গ্রহণ করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না আসকার ইবনে সায়িদের অভিব্যক্তিতে। “এখন বলুন, জোর করে আমার বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?”
হাসলো নুরে ছফা, আসলামের দিকে তাকালো সে। চোখমুখ কঠিন করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে। এই বাড়ির দারোয়ান।
“আমি যে মুশকান জুবেরির খোঁজ করছি আপনি সেটা ভালো করেই জানেন।”
বাঁকাহাসি দিলেন ডাক্তার। “আপনার ধারণা, সে এই বাড়িতে আছে?”
মাথা দোলালো ছফা। “নাহ্। আমার মনে হয় না, ঐ মহিলা এরকম কাঁচা কাজ করবে।” ডাক্তারের দিকে চোখ স্থির করে বেশ জোর দিয়ে বললো, “তবে সে কোথায় আছে, আপনি জানেন।”
আসকার ইবনে সায়িদের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। “তিন বছর ধরে তাকে খুঁজে না পেয়ে শেষে আমার কাছেই এলেন?”
ছফা এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে আশেপাশে তাকালো। “চলুন, কোথাও বসি…আপনার সাথে অনেক কথা বলতে হবে আমাকে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার, ড্রইংরুমের দিকে যেতে যেতে পেছন দিকে না তাকিয়েই বললেন, “ওয়াহাবকে ছেড়ে দিন, ও গেটের কাছে থাকুক, ও এ বাড়ির দারোয়ান, ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”
আসলামকে ইশারা করলো ছফা। দারোয়ান ছেলেটাকে হাত নেড়ে নীচে চলে যেতে বললো সে।
ডাক্তার তার বিশাল ড্রইংরুমের একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়লেন। “আপনার ধারণা, মুশকান কোথায় আছে সেটা আমি জানি?”
আসলামকে নিয়ে বড় সোফাটাতে বসে পড়লো ছফা। “হ্যাঁ, আমার সেরকমই ধারণা।”
“তাহলে তো, আমার মতো মানুষকে এরকম একটি তথ্য জানিয়ে দিয়ে মুশকান বেশ কাঁচা কাজই করে ফেলেছে,” ব্যঙ্গ করে বললেন আসকার ইবনে সায়িদ।
“মানুষ তো, ভুল করতেই পারে,” ছফা হেসে বললো। “কেউই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়। যতোই বুদ্ধিমান মানুষ হোক, ভুল তো করেই।”
“তা ঠিক, আর সেটা আপনার বেলায়ও খাটে।”
“তবে মুশকান জুবেরি কোথায় আছে সেটা কেবল আপনিই জানেন-এ ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত। এখানে আমার কোনো ভুল নেই।”
“আপনার এমন ধারণার কারণ?”
পকেট থেকে রমাকান্তকামারকে দেয়া সেই চিরকুটটা বের করে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে দিলো নুরে ছফা। “এটা দেখুন, আশা করি চিনতে পারবেন।”
চিরকুটটা হাতে নিয়ে একটু দূর থেকে দেখার চেষ্টা করলেন ডাক্তার, তারপর নাইটগাউনের বুক পকেট থেকে রিডিং গ্লাসটা বের করে নাকের উপর চাপিয়ে দিলেন। একটু সময় নিয়ে পড়লেন চিরকুটটা। “এটা কার?” পড়া শেষে জানতে চাইলেন।
“আপনি বলতে চাইছেন, আপনি জানেন না?”
“আমি কিভাবে জানবো? মুখবন্ধ একটা খাম দিয়েছিলাম উকিলকে…সেটা তো খুলে দেখিনি। অন্যের চিঠি পড়ার মতো বদঅভ্যেস আমার নেই।”
“কিন্তু অন্যের হয়ে চিঠি পাঠানোর অভ্যেসটা ঠিকই আছে।”
“কী বলতে চাইছেন?” চোখমুখ শক্ত করে জানতে চাইলেন ডাক্তার।
“রমাকান্তকামার স্বীকার করেছেন আমার কাছে, এটা তাকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দির খোন্দকার দিয়েছিলো তিন বছর আগে…সুন্দরপুর থেকে মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাবার ক-দিন পর।”
ডাক্তার অপেক্ষা করলেন আরো কিছু শোনার জন্য।
“আর ময়েজ উদ্দিন খোন্দকারও একটু আগে স্বীকার করেছে, চিরকুটটা আপনি তাকে দিয়েছিলেন।”
আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “হ্যাঁ। মুশকান আমার ফ্ল্যাট থেকে চলে যাবার আগে একটা মুখবন্ধ খাম রেখে গেছিলো, একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “সেই সাথে ছোট্ট একটা নোট। তাতে সে অনুরোধ করেছিলো, আমি যেনো খামটা রমাকান্তকামারকে দেবার ব্যবস্থা করি।”
ছফার মুখে হাসি দেখা গেলো কিন্তু সেই হাসি সন্তুষ্টির নয়।
“আমার পক্ষে সুন্দরপুরে গিয়ে এটা দেয়া সম্ভব ছিলো না বলে মি. খোন্দকারের মাধ্যমে খামটা মাস্টারের কাছে পাঠিয়েছিলাম।”
“ঐ উকিলকেও আপনিই নিয়োগ দিয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ। রাশেদ আমাকে বলেছিলো, আমি যেনো ভালো কোনো ল ইয়ারকে অ্যাপয়েন্ট দেই ট্রাস্টের জন্য।”
“মি. জুবেরিকে আপনি তাহলে ভালো করেই চিনতেন?”
“অবশ্যই। ও আমার দূরসম্পর্কের কাজিন হয়। আমার মাধ্যমেই ওর সাথে মুশকানের পরিচয় হয়। আমার হাসপাতালেই দীর্ঘদিন ট্রিটমেন্ট নিয়েছে।”
একটু ভেবে নিলো ছফা। “মুশকান জুবেরির সাথে আপনার শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছিলো?”
“প্রায় তিন বছর আগে।”
মুচকি হাসি দেখা দিলো তার ঠোঁটে। “এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?”
“নাহ্,” শান্তকণ্ঠেই বললেন ডাক্তার। “আপনি একজন পুলিশ অফিসার…তদন্ত করে দেখেন, তারপর কী বিশ্বাস করবেন না করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “ভালো কথা, মুশকানের বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগটা আসলে কি?”
ডাক্তারের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে দারুণ অবাক হলো। “আমার তো ধারণা, এটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন।” আসলামের সামনে এসব কথা বলতে একটু দ্বিধা কাজ করলেও এখন সেটা না বলে উপায় নেই। এ মুহূর্তে তাকে এই আলাপ থেকে সরিয়ে দেয়াটা খুবই বেমানান দেখায়। “মুশকান জুবেরি অনেকগুলো মানুষ হত্যা করে গুম করে ফেলেছে।”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “ও কেন এটা করবে?”
“এ কথা জানতে চাইছেন আপনি??”
“আপনার কথা বুঝলাম না?”
দাঁতে দাঁত পিষে ফেললো নুরে ছফা। “আপনি সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন?”
“সব কিছু মানে?”
“মি. খান…আমার সিনিয়র…আপনি তার কাছে যা যা বলেছিলেন তিন বছর আগে, সেসবের কথা বলছি।”
বাঁকা হাসি দিলেন ডাক্তার। “এরকম আজগুবি কথা তাহলে আপনিও বিশ্বাস করে বসে আছেন!”
ভুরু কুঁচকে গেলো ছফার।
“আপনি কী করে বিশ্বাস করলেন, আমি যা বলেছি তার সবই সত্যি?”
ডাক্তারের দিকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। ভদ্রলোক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছে না। “আপনি বলতে চাইছেন, আপনি আমার সিনিয়রকে ওরকম কথা বলেননি?”
আসকার ইবনে সায়িদ আলতো করে মাথা দোলালেন। “না, সেটা আমি বলছি না। ঐ ক্রনিক ডিজিজে ভোগা ভদ্রলোককে আসলেই এরকম উদ্ভট কথা বলেছিলাম। যাই হোক, সেটা যে কেউ বিশ্বাস করবে জানতাম না।”
“কী বলতে চাইছেন, আপনি? সব কিছু অস্বীকার করতে চাইছেন এখন?”
কাঁধ তুললেন ডাক্তার। “ওটা অবশ্য কোনো জবানবন্দী ছিলো না। আর যিনি এসেছিলেন, তিনিও রিটায়ার্ড করা এক ডিবি অফিসার। তার কাছে কী বলেছি না বলেছি সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।”
ছফার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো। “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন-”।
তার কথা শেষ করা আগেই আসকার ইবনে সায়িদ বলতে শুরু করলেন, “যা বলেছিলাম সেটা একজনের অনুরোধেই বলেছিলাম। ওসব কথা মোটেও সত্যি নয়।”
অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।
“খুবই উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য একটি গল্প বলেছিলাম তার অনুরোধে।”
.
অধ্যায় ৩৭
মুশকান জুবেরি আন্দিজের বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়নি?!
হবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ঐ সময় তার জন্মই হয়নি!
তিন বছর আগে কেএস খানের কাছে যে কাহিনী বলেছিলেন ডাক্তার, সেখান থেকে পুরোপুরি ইউ-টার্ন নিয়ে, সব কিছু অস্বীকার করে নতুন আরেকটি গল্প বলছেন এখন। নুরে ছফার মনে হচ্ছে, সে একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। সব কিছু ঘোলাটে আর প্রহেলিকাময় করে তুলছেন আসকার ইবনে সায়িদ।
গভীর করে নিশ্বাস নিলো সে।
“আমি অবশ্য এমন গল্প বলতে রাজি হইনি,” বললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “কিন্তু ও যখন সবটা খুলে বললো, তখন তাকে বাঁচাতে এমন কাজ করতে রাজি হই।”
“সবটা মানে?”
“সুন্দরপুরের এমপি তার নামে আজগুবি সব অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলো, মানুষের কাছে তাকে ডাইনি বলে প্রচার করেছে, যাতে করে সে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। “লোকটার আসল উদ্দেশ্য ছিলো জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি দখল করা।”
ছফাও এরকম কথা শুনেছিলো আতরের কাছ থেকে।
“মুশকানের ধারণা, ঐ এমপিই আপনাকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলো। তাই আপনাকে উদ্ভট একটা গল্প বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলো সে।”
“আমি এমপির হয়ে কাজ করেছি?!” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ছফা।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “ও সেরকমই ধারনা করেছিলো।”
ছফা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। সুন্দরপুরের অনেকেই এমন ধারনা করে ইদানিং কিন্তু তাই বলে স্বয়ং মুশকান জুবেরি?! “আপনি আমাকে হাসালেন, ডাক্তার,” বললো সে। “তাহলে যেসব মানুষকে সুন্দরপুরে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলেছে মুশকান, তাদের ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?” ইচ্ছে করেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়ার কথাটা এড়িয়ে গেলো আসলামের উপস্থিতির কারনে।
“এ ব্যাপারে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। “সুন্দরপুর থেকে ঢাকায় এসে আমার ফ্ল্যাটে ওঠার পর।”
“সে আপনাকে কী বলেছিলো?”
“ওর ধারনা, এমপি আসাদুল্লাহই ওদেরকে কিছু করেছে।”
“কি?!” নুরে ছফা আৎকে উঠলো। “এমপি!?” মাথা দোলালো সে। “আপনার মুশকান এমন একজনের উপর পিণ্ডি চাপিয়ে দিচ্ছে, যে এখন মৃত! দারুণ অ্যালিবাই!”
“দেখুন, বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার ব্যাপার। আমি শুধু, ও কী বলেছে, সেটা বলছি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ছফা, “আচ্ছা, বলুন…মুশকান আপনাকে কী বলেছে।” কথাটা একটু তীর্যক শোনালো যদিও।
“ওখানকার এমপি কড়া নজরদারিতে রাখতো ওকে। ওর সাথে কোনো ছেলের সম্পর্ক হোক, তা সে চাইতো না। ওর ধারনা, সম্ভবত ঐ দু-জন লোক সুন্দরপুরে যাবার পর থেকে এমপির লোকজন তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছিলো। সুন্দরপুর থেকে চলে যাবার সময় ঐ লোকগুলোই তাদেরকে গুম করে ফেলে।” একটু থেমে ছফার দিকে তাকালেন তিনি। সে এখন অবিশ্বাসে হাসছে। “তবে ও নিজেও এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না। এটা নিছকই ওর ধারণা।”
“তাহলে এমপি আসাদুল্লাহই সব করেছে…মুশকান জুবেরি ধোঁয়া তুলসী পাতা?”
কাঁধ তুললেন ডাক্তার। “একজন ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সব কিছু খতিয়ে দেখে, প্রমাণের উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করাটাই আপনার উচিত হবে। ও কোনো অপরাধ করেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখেন। আর সত্যি বলতে, ও যা বলেছে তা-ই আপনাকে বললাম। এখানে আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “সেটা তো আমি করবোই,” একটু থেমে আবার বললো, “তাহলে কি প্রতিশোধ নেবার জন্য এমপিকে খুন করেছে মুশকান?”
ঠোঁট ওল্টালেন ডাক্তার। “সেটা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সে এমপির সাথে দেখা করে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো।”
“মুশকান যে এমপির সাথে দেখা করেছিলো সেটা আপনাকে বলেছে?”
“অবশ্যই। ও আমাকে বলেছিলো এমপির সাথে কথা বলবে। সম্ভবত রাশেদের সম্পত্তিগুলো যে ট্রাস্টের নামে দান করেছে সেটা জানানোর জন্য…সেই সাথে, মাস্টারের যেনো কোনো ক্ষতি না করে সেটাও হয়তো বলতে চেয়েছিলো।” গভীর করে নিশ্বাস নিলেন আবার। “হয়তো ভদ্রলোকের কাছে জানতে চেয়েছিলো, কেন সে তার পেছনে এভাবে লাগলো, এসব করে তার কী লাভ হলো…এই আর কি।”
“মুশকান তাহলে এমপির সাথে কথা বলেছিলো?”
“বলেছিলো। ওর সাথে কথা বলার পর, সেদিন রাতেই ভদ্রলোক মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলো লোকটা। মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করায় হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়।”
“দারুণ! সব পাজল মিলিয়ে দিচ্ছে আপনার বলা এই গালগল্প!” তিক্ত মুখে বললো ছফা, “এমপির মৃত্যুর জন্য তো কেউ মুশকানকে সন্দেহই করেনি…পোস্টমর্টেম রিপোর্টও বলেছে ওটা মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্কের ফলাফল, তাহলে সে চোরের মতো পালিয়ে গেলো কেন?”
“ও আগেই ঠিক করে রেখেছিলো এমপির সাথে কথা বলে দেশ ছাড়বে। এমপির মৃত্যুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।”
কপট প্রশংসার অভিব্যক্তি ছফার মুখে। “তা এখন বলুন, আপনার মুশকান জুবেরি কোন্ দেশে গেছে?”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “সেটা আমাকে বলেনি। আর আমিও জানতে চাইনি।”
“এতো কিছু বললো আর এটা বললো না আপনাকে? আপনি বলতে চাইছেন, মুশকান আপনাকে বিশ্বাস করতো না?”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, আমি নিজেই জানতে চাইনি। ওটা জানা থাকলে আমি হয়তো পুলিশি জেরার মুখে সব বলে দিতাম।”
বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “সবই না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনি দেশ ছাড়লেন কেন?”
গভীর করে দম নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “দুটো কারণে দেশের বাইরে গেছিলাম কিছু দিনের জন্য আপনার জ্বালাতন থেকে বাঁচতে আর আমার হার্টের চেকআপ করাতে।”
“আপনার নিজের হাসপাতাল থাকতে আমেরিকায় কেন? আপনার তো দেখি নিজের হাসপাতালের উপরেই ভরসা নেই।”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার হাসপাতালেই চেক আপ করি, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে গেলে সেখানেও করাই। এর মানে, নিজের হাসপাতালের উপর ভরসা নেই যদি ভাবেন তো কিছু করার নেই।”
ছফা কিছু বললো না। ডাক্তারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে সে। “যাই হোক, কয়েক মাস পরই আবার দেশে ফিরে এসেছিলাম আমি।”
“কাউকে না জানিয়ে!”
“দেশে এসে আমি যদি সেটা গোপন রাখি তার কারনও কিন্তু আপনি। উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতেই এটা করেছি।”
তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো নুরে ছফা। “আপনি মনে করছেন আমি আপনার এই নতুন গল্পটা বিশ্বাস করবো? আমার কাছে প্রমাণ নেই বলতে চাইছেন?”
মুচকি হাসলেন ডাক্তার। “থাকলে তো আপনি মুশকানের বিরুদ্ধে হিউম্যান অর্গ্যান পাচারের সন্দেহ করে মামলা করতেন না! সম্ভবত আপনি তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগই করেছেন, তাই না?”
ছফা টের পেলো রাগে রীতিমতো তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। সত্যিটা হলো, মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে সে মানব-অঙ্গ পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগও করতে পারেনি-সেই সব অঙ্গ ভক্ষণের অভিযোগ তোলা তো দূরের কথা। সে কেবল ঐ মহিলার বিরুদ্ধে কিছু লোকজনকে গুম করার প্রাথমিক অভিযোগ করে একটি মামলা করেছে। সেই মামলায় এমনকি এটারও উল্লেখ নেই, মহিলা লোকজনকে কি উদ্দেশ্যে গুম করেছে-কেন করেছে। তবে সরকারী তদন্তে বাধা দেয়া, ছফাকে হত্যাচেষ্টাসহ তার অস্ত্র কেড়ে নেবার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে আরো দুটো মামলা করেছে সুন্দরপুর থানায়।
“এ থেকেই বোঝা যায়, ওর ধারণাই সত্যি,” ডাক্তার বললেন।
সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো ছফা।
“এই উদ্ভট গল্পটা যে কেউ বিশ্বাস করবে না সেটা আপনি নিজেও জানতেন।”
ভুরু কুঁচকে তাকালো ডিবির জাঁদেরল ইনভেস্টিগেটর। “আপনি কী বলতে চাইছেন, আন্দিজের ঘটনা মিথ্যে?”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “এটাই তো এই ঘটনার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট।”
“আপনি পরিস্কার করে বলেন, হেয়ালি করবেন না। আমি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং কোনো গল্প শুনতে আসিনি।”
“আপনার কাছে গল্প বলে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে আমারও নেই।” একটু থেমে আবার বললেন, “তাহলে শুনুন, সংক্ষেপেই বলি। আন্দিজের ঘটনাটা যে মিথ্য নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওটা সত্যি সত্যি ঘটেছিলো। দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে আঠারোজন বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে এক বাংলাদেশি তরুণী ডাক্তারও ছিলো। এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। সেই তরুণীও অন্যদের মতো নরমাংস খেয়েই জীবন বাঁচায়।”
কথাটা শুনে এই প্রথম আসলামের অভিব্যক্তিতে বিস্ময় দেখা গেলো। অনেকটা আৎকে উঠলো সে।
“কিন্তু ওই তরুণী মুশকান ছিলো না!”
“তাহলে সে কে ছিলো?” অবিশ্বাসে প্রশ্নটা করলেও ছফার ইচ্ছে করছে ডাক্তারের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। তাকে ছেলে ভোলানো গল্প বলে বিশ্বাস করাতে চাইছে! লোকটার দুঃসাহসের তারিফ না করে পারলো না।
“সমস্যা হলো, আমি যা বলবো সেটা আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। ঐ আজগুবি গল্পটাই বিশ্বাস করতে চাইবেন আপনি। তবে সবটা শোনার পর, আশা করি সন্তুষ্ট না হলেও কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝে নিতে পারবেন।”
ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। ডাক্তার যেনো সাসপেন্স গল্প। বলছেন। ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছেন উত্তেজনা।
“আমি যে তরুণীর কথা বলছি সে কে ছিলো, জানেন?”
নুরে ছফা চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে।
“রুখসান!”
“এই রুখসানটা কে?” অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো ছফা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। “সত্যি বলতে, মুশকানের মেয়ে!”
.
অধ্যায় ৩৮
নুরে ছফার মনে হচ্ছে তাকে ঠেলেঠুলে প্রহেলিকাময় গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাক্তারের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শুধু বুঝতে পারছে, তার সাথে বিরাট কোনো চালাকি করা হচ্ছে।
কথাটা শোনার পর থেকে সে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার আসকারের দিকে। নতুন একটি চরিত্র রুখসান আমদানি করে মুশকানের সাথে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু ছফার কাছে এমন কিছু আছে যা ডাক্তারের এসব গল্পকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে এক লহমায়।
“আপনি যদি জানতেন আমার কাছে কতো শক্তিশালী প্রমাণ আছে, তাহলে এসব বলার আগে অন্তত এক শ’ বার ভেবে নিতেন,” তিক্তমুখে বললো। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে অবার।
ডাক্তার আসকারের নির্বিকার মুখ দেখে বোঝা গেলো না তিনি ভড়কে গেছেন কিনা। পিএসের গানম্যান আসলাম শক্তমুখে চেয়ে আছে তার দিকে।
নুরে ছফা সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “পৃথিবীটা অনেক বেশি ছোটো, ঝুঝলেন ডাক্তার? আর কেন জানি বাঙালিদের জন্য এই পৃথিবীটা আরো বেশি ছোটো।”
ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে গেলো সামান্য।
“মুশকান জুবেরির যে শিকারের কেসটা নিয়ে আমি তদন্ত করছি, সেই হাসিবের মা সত্তর দশকে আমেরিকায় ছিলেন স্বামীর সাথে। ওখানে তিনি প্রতিবেশী হিসেবে কাকে পেয়েছিলেন, জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললো, “মুশকান জুবেরিকে!”
এ কথা শোনার পরও ডাক্তার নির্বিকার থাকলেন।
ছফার কাছে মনে হচ্ছে, ডাক্তার জোর করে অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। “খুব বেশি কাকতালীয় মনে হচ্ছে?”
স্মিত হাসলেন আসকার ইবনে সায়িদ, তবে কিছু বললেন না।
“হাসিবের মায়ের সাথে প্রতিবেশী মুশকানের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তিনি এ-ও জানতেন, আন্দিজে প্লেন ক্র্যাশের শিকার হয়েছিলো মুশকান, মৃত মানুষের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিলো আশি দিনেরও বেশি সময়।”
গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ডাক্তার আসকার, যেনো কী বলবেন গুছিয়ে নিচ্ছেন।
“ঐ ভদ্রমহিলা এখন দেশে আছেন…মৃত্যুপথযাত্রি। তার মাধ্যমে মুশকানের একটি ছবিও জোগাড় করেছি আমি।”
আসকার ইবনে সায়িদের ভুরু কুঁচকে গেলো সামান্য।
“আপনার এই বানোয়াট গল্পটা যে এভাবে ধরা খাবে সেটা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। আমার কথাটা পুরোপুরি না শুনেই-”
হাত তুলে ডাক্তারকে থামিয়ে দিলো ছফা। “অনেক হয়েছে, আর এসব গাঁজাখুরি গল্প বলবেন না আমাকে। আমার ধৈর্য কিন্তু অসীম নয়।”
কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ। “পুরোটা শুনতে না চাইলে কী আর করা!”
ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো। “পুরোটা বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আবার বললো সে, “আমি যা বললাম তারপরও আপনার বলার কিছু আছে নাকি?”
“সত্যটাকে যদি গল্পই বলেন তাহলে বলবো, আমি তো কেবল শুরু করেছি। এখন আপনি শুনতে চাইলে বলতে পারি, নইলে নিজেই তদন্ত করে বাকিটা জেনে নেবেন। এক সময় না এক সময় এই সত্যটাই আবিষ্কার করবেন আপনি।”
ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন ডাক্তারের দিকে। এই ভদ্রলোক কেএস খানের সামান্য চাপেই ভেঙে পড়েছিলেন, গরগর করে বলে দিয়েছিলেন সবকিছু। কিন্তু এখন তার মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে, তাতে আগেরবারের সাথে কোনো মিলই পাচ্ছে না সে।
“আপনি এমন চালাকি করেছেন, যেটা আমাকে ভুলপথে পরিচালিত করবে, তদন্তটাকে কানাগলিতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে।”
এবার পরিহাসের হাসি হাসলেন ডাক্তার। অবশ্য, আগেরবার আমি সেটাই করেছিলাম।” একটু থেমে আবার বললেন, “সেজন্যে আপনাকে দোষও দিতে পারছি না।”
ছফা কিছু বললো না। তার কাছে মনে হচ্ছে, যে ডাক্তার এখন তার সামনে বসে আছে সে অন্য কেউ। ছফার সহকারী জাওয়াদ তাকে সবটাই বলেছিলো। কিভাবে মি, খান কথার মারপ্যাঁচে স্বনামধন্য ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদকে কাবু করেছিলো কোনো রকম হুমকি-ধামকি ছাড়াই।
“এবারও যে আপনি চালাকি করছেন সেটার প্রমাণ তো আমি দিলামই।”
“কীসের প্রমাণ?” ডাক্তার যেনো বুঝতে পারেননি কিছু।
“এততক্ষণ আমি আপনাকে যা বললাম সেটা শোনার পরও বুঝতে পারছেন না?”
কাঁধ তুললেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আসলেই বুঝতে পারছি না।”
দাঁতে দাঁত পিষে ছফা বললো, “আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন…তারা দীর্ঘদিন প্রতিবেশী ছিলো।”
“হ্যাঁ, সেটা তো বুঝেছি কিন্তু আপনি এটাকে প্রমান বলছেন কেন?”
“এজন্যে বলছি, আর্জুমান্দ বেগম মুশকানের মায়ের বান্ধবী ছিলেন না, উনি মুশকানের বান্ধবী ছিলেন!”
হাসলেন ডাক্তার। “আপনার ঐ পিএসের বোন, তিনি কি কখনও মুশকানের মেয়েকে দেখেছেন?” একটু থেমে হিসেব করে নিলেন যেনো। “সম্ভবত দেখেননি। দেখার কথাও না। ওর তখন বিয়েই হয়নি…মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলো।”
“কার কথা বলছেন আপনি?” ছফা অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
“মুশকান জুবেরির মায়ের কথা বলছি।”
“উফ!” অধৈর্য হয়ে উঠলো ছফা। বার বার এক প্যাচাল পাড়ছেন কেন! আর্জুমান্দ বেগম মুশকান জুবেরিকে চিনতেন…তার মাকে না!”
“আমি তো সেটাই বলছি,” চট করে বললেন ডাক্তার।
“তাহলে বার বার তার মায়ের কথা কেন বলছেন?”
“কারণ ওই মহিলাই মুশকান জুবেরির মা ছিলো, আপনি যে মুশকানকে খুঁজছেন সে ছিলো তার মেয়ে!”
“স্টপ ইট!” ধমকে উঠলো ছফা। “মুশকান…মুশকান জুবেরি মা! বার বার কী সব বলে যাচ্ছেন! আপনি ভেবেছেন কি, আমি আপনার গোলকধাঁধায় পড়ে খাবি খাবো?”
মাথা দোলালেন ডাক্তার। “দুঃখিত, আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। আসলে আপনাকে দোষ দেয়া যায় না, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না…আর মাঝখানে অনেক প্রশ্ন করায় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি।”
ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে। “ঠিক আছে, বলুন আপনার আজগুবি গল্প!”
“যে মুশকানকে আপনি চেনেন তার আসল নাম রুখসান! আর তার মায়ের নাম ছিলো মুশকান সোহেলি!”
.
অধ্যায় ৩৯
মুশকানের নাম আসলে রুখসান! আর তার মায়ের নাম মুশকান সোহেলি?!
এরকম অসম্ভব কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ছফা। তার কাছে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমনজানি অনুভূতি হলো। বুঝতেও একটু সময় নিলো সে। ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“এসবের মানে কি?”
মুচকি হাসলেন ডাক্তার, তবে সেই হাসিতে কোনো তাচ্ছিল্যভাব নেই। যেনো তিনিও জানেন, এ কথা শুনে যে কেউ অবাক হবে।
“আপনার ঐ পিএসের বোন যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন,” আস্তে করে বললেন বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। “কিন্তু মহিলা তো আর জানতেন না, পরবর্তীকালে মুশকান সোহেলি বিয়ে করে ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম দেয়, একটু থেমে ছফাকে দেখে নিলেন তিনি। সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। “আর সেই মেয়ে দেখতে হয়েছিলো অবিকল তার মায়ের মতোই।”
এতে অবাক হলো না ছফা। অনেক ছেলে-মেয়েই দেখতে বাবা-মায়ের মতো হয়। একেবারে হুবহুও হয়। তার নিজের মা-ই দেখতে ছিলো হুবহু তার নানীর মতো। তবে নানীকে তারা দেখেছে বয়সকালে, ফলে তাদের কাছে মিলটা তেমনভাবে ধরা না পড়লেও, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে। ঠিকই ধরা পড়েছিলো। নানীর যুবা বয়সের ছবি দেখেও ছফা বুঝতে পেরেছিলো মিলটা ছিলো বিস্ময়কর রকমেরই। একই বয়সের নানী আর তার মায়ের ছবি দেখলে মনে হতো একজনের ছবিই দেখছে-কিংবা যমজ বোনের!
“নিউটনের বাবার নাম কি ছিলো জানেন?”
ডাক্তারের এমন প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।
“নিউটন! ওয়েস্টে এটা খুবই পপুলার ট্রেন্ড-বাবার নামে সন্তানের নাম রাখা। সন্তানের বেলায় কেবল যোগ করা হয় ‘জুনিয়র’ শব্দটি। যেমন জুনিয়র বুশ, ওর বাবার নামও ছিলো বুশ।”
“আপনি বলতে চাইছেন, মুশকানের মা নিজের মেয়ের নাম রেখেছিলো মুশকান?”
ছফার কথায় মাথা দোলালেন ডাক্তার আসকার। “না, না…ওর মা এ কাজ করেনি।”
“তাহলে?”
“মুশকানের মেয়ের নাম ছিলো রুখসান, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।
ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো, কিছুই বললো না। মুশকান আর রুখসানের গোলকধাঁধা থেকে এখনও বের হতে পারছে না।
“সুন্দর নাম, সন্দেহ নেই কিন্তু পরবর্তীকালে কিছু ঘটনার কারনে রুখসান তার নামটা পাল্টে ফেলে।”
“কি ঘটনা?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো নুরে ছফা।
“মুশকান সোহেলি, মানে মুশকানের মা আন্দিজ থেকে ফিরে আসার পর বাঙালি কমিউনিটিতে কোণঠসা হয়ে পড়ে, বাধ্য হয়ে সে চলে যায় বৃটেনে, মেডিকেল প্র্যাকটিস শুরু করে সে। ওখানেই এক বাঙালি ডাক্তারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়, প্রেম হয়, তারা বিয়েও করে ফেলে। তাদের ছোট্ট সংসারে আসে রুখসান।” একটু থামলেন আসকার ইবনে সায়িদ। “রুখসানের জন্মের কয়েক বছর পরই দেশের টানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চলে আসে ঢাকায়। মেয়েটার বয়স যখন ছয় কি সাত, তখনই ওর বাবা আন্দিজের ঘটনাটা জেনে যায়। ডাক্তার গম্ভীর হয়ে চুপ মেরে গেলেন। “দোষটা মুশকানেরই!…আন্দিজ সারভাইভারদের উপরে অনেকগুলো পেপার ক্লিপিংসের একটি অ্যালবাম সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো ও। ঘটনাচক্রে অ্যালবামটা ওর স্বামী দেখে ফেলে।”
ছফার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগের ঘটনাটি। মুশকান জুবেরি তাকে এরকম একটি অ্যালবাম দেখিয়েছিলো। কয়েকটি ছবি দেখার পর সে অচেতন হয়ে পড়ে। এখন কেবল ঝাপসা একটা স্মৃতি আছে। কখনও কখনও স্বপ্নে হানা দেয় সেই মুহূর্তটির কিছু অংশ। একেবারেই বিক্ষিপ্তভাবে।
“এই ঘটনার পর থেকে স্বামীর সাথে ওর দূরত্ব বেড়ে যায়,” ডাক্তার বললেন। “মুশকান কেন স্বামীকে বিয়ের আগে এটা বলেনি, কেন সে কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলো-এই ছিলো ভদ্রলোকের অভিযোগ। তো, ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদের দিকেই মোড় নেয়। ও খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আর স্বাধীনচেতা ছিলো, স্বামীর এমন আচরণের পর একসাথে আর থাকেনি, মেয়েকে নিয়ে আলাদা বসবাস করতে শুরু করে। ওর বাবাও কখনও মেয়ের দাবি নিয়ে সামনে আসেনি আর। ভদ্রলোক ডিভোর্সের এক বছরের মাথায় আবার বিয়ে করে ফেলে। তবে মুশকান আর সে পথে যায়নি। পুরুষবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলো সম্ভবত। একমাত্র সন্তান রুখসানকে নিয়ে একাকি জীবন বেছে নেয়, নিজের মতো করে গড়ে তোলে মেয়েকে। ও আবার রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলো। রুখসানও মায়ের প্রভাবে রবীন্দ্রভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মা-মেয়ের সুখের এই ছোট্ট সংসারটি বেশি দিন টেকেনি। রুখসানের বয়স যখন চৌদ্দ, ওর মা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পায় রুখসান। বলতে পারেন, ভয়াবহ এক ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। নানান রকম অ্যাবনরমালিটি গ্রো করে ওর মধ্যে। সম্ভবত, সে কারণেই মায়ের মৃত্যুর পরের বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার সময় এলো, নিজের নাম পাল্টে সে মুশকান সোহেলি রাখলো।”
ছফার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। আগে ক্লাস নাইনে থাকতে এসএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করা হতো, তখন ইচ্ছে করলে নিজের নাম, জন্মসাল, তারিখ, সব কিছু ইচ্ছেমতো বদলে ফেলার সুযোগ ছিলো। এখনকার মতো স্মার্টকার্ড, ভোটার আইডিকার্ড কিংবা জন্মসনদের বালাই ছিলো না তখন।
ছফার মনে পড়ে গেলো, তার নিজের নামটাও পাল্টানোর খুব ইচ্ছে ছিলো-জ্ঞান হবার পর থেকে নুরে ছফা নামটার মধ্যে গেঁয়ো একটা গন্ধ পেতো সে। আর লোকজনও ঠিকভাবে ধরতে পারতো না প্রথমবার শোনার পর। অন্য অনেকের মতো সে-ও চেয়েছিলো নামটা একটু ‘স্মার্ট’ করতে, কিন্তু তার কঠিন শাসনের বাবার কড়া ধমক খেয়ে নিজেকে বিরত রাখে।
দুই দুইটা খাসি জবাই দিয়া আকিকা কইর্যা আমার বাপে এই নাম রাখসে!…আর পোলায় কিনা সেয়ানা হইয়া এখন সেই নাম বাদ দিবার চায়! এত্ত বড় সাহস হইসে…এমুন পোলারে কাইট্টা…! নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তার জাঁদরেল বাবার এইসব গালমন্দ আর রাগি চেহারাটা এখনও চোখে ভাসে।
আজাদ রহমান-নিজের পছন্দ করা নামটা এখনও তার মনে আছে।
“সম্ভবত মায়ের মৃত্যুটাকে মেনে নিতে পারেনি বলে এমনটা করেছিলো,” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার আবার বললেন। “মায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যেও করে থাকতে পারে…কে জানে।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আসকার ইবনে সায়িদের ভেতর থেকে। এভাবেই সে রুখসান থেকে হয়ে গেলো মুশকান সোহেলি। তারও অনেক বছর পরে, বিয়ের পর হলো মুশকান জুবেরি।”
“আপনি এতো সব জানলেন কিভাবে?” সন্দেহের সুরে জানতে চাইলো ছফা। “এসব কথা তো সত্য না-ও হতে পারে?”
হেসে ফেললেন ডাক্তার। “তখন তো কেউ মুশকানের পিছে লাগেনি যে, নিজেকে বাঁচানোর জন্য বানোয়াট একটা গল্প বলবে সে। তাছাড়া মুশকানের সাথে…মানে, রুখসানের মায়ের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমার। বয়সেও আমরা প্রায় সমবয়সী ছিলাম। একসাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছি আমরা। ও মারা গেলে আমিই ওর মেয়ের অভিভাবক হয়ে উঠি। যা বললাম, তার অনেক কিছুই নিজের চোখে দেখেছি আমি।”
চুপ মেরে রইলো নুরে ছফা। ডাক্তারের বয়স আর পেশা হিসেবে নিলে, রুখসানের মায়ের সাথে তার বন্ধুত্বের ব্যাপারটা খাপ খেয়ে যায়।
“আমার কী মনে হয় জানেন?” আসকার ইবনে সায়িদ বললেন। “ও ওর মায়ের ব্যাপারে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড হয়ে পড়েছিলো…কাইন্ড অব অবসেসড।”
মাথা নেড়ে সায় দিতে গিয়েও দিলো না ছফা।
“মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা ছিলো একেবারে অন্য রকম। বন্ধু…একমাত্র সঙ্গি…একমাত্র অভিভাবক!” আবারো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ডাক্তারের ভেতর থেকে। ঘরে নেমে এলো কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।
“কিন্তু আপনি কেন আমার সিনিয়র মি. খানের কাছে এরকম উদ্ভট গল্প বললেন?” জানতে চাইলো ছফা।
গভীর করে নিশ্বাস নিলেন ডাক্তার। “এটা আগেই বলেছি…ও মনে করেছিলো আপনি সুন্দরপুরের এমপির হয়ে ওর পেছনে লেগেছেন, ঐ এমপি যেহেতু ওর রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস রান্না করার উদ্ভট একটি অপবাদ রটিয়েছিলো, তাই ও মনে করেছিলো আপনাকেও এরকম কথা বিশ্বাস করাতে, যাতে সবাই বোঝে আপনি এমপির লোক। আপনার উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলো সে। আপনাকে নাজেহাল করার জন্যই এটা করতে বলেছিলো আমাকে।”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছফা।
“ও জানতো, এরকম উদ্ভট গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। বড় কর্তাদের কাছে আপনি হাস্যকর পাত্র হয়ে উঠবেন।”
ছফার ভুরু কুঁচকে গেলো।
“ওর ধারণাটা যে ঠিক ছিলো তার প্রমাণ তো আপনি নিজেই। ঐ অভিযোগ তুলে মামলা করার সাহসও দেখাননি।”
ছফার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। মহিলা এদিক থেকে সফলই বলা যায়। সে নিজেও এমন উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য গল্পটা চেপে গেছে সবার কাছ থেকে। এসব বললে যে তাকে পাগল, নয়তো উর্বর মস্তিষ্কের মানুষ ভাববে শুধু সে কারণে নয়, বরং তার আরেকটা ভয় ছিলো-মানুষ চিরযৌবন লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।
“মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অগ্যান খেলে চিরযৌবন লাভ করা যায়-এ কথা তো বিশ্বাস করবে অতি আশাবাদী মানুষ, নয়তো বোকারহদ্দরা।”
ছফার কাছে মনে হলো ডাক্তার প্রকারান্তরে তাকে বোকা বলছেন! এমন সময় কিছু একটা মনে পড়ে গেলো তার, সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠলো সে।
“কিন্তু যতোটুকু জেনেছি, আপনার অরিয়েন্ট হাসপাতালে আমেরিকা থেকে এক ডাক্তার এসে মুশকান জুবেরিকে নিয়ে এসব কথা রটিয়েছিলো…ঐ লোকের ব্যাপারটা কি তাহলে?”
আক্ষেপে মাথা দোলালেন ডাক্তার। “মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়ার ফলে যে ভবিষ্যতে ঝামেলা হতে পারে সেটা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। ঐ ডাক্তারের আবির্ভাবের পরই সেটা প্রথম টের পায়।”
ছফা তাকালো আসলামের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে সে ঘরের আসবাবপত্রের মতোই নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে।
“হাসপাতালের একজন ওনার হিসেবে ওই সিচুয়েশনটা সামাল দিতে গিয়ে আমাকে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছিলো। ভদ্রলোককে বোঝাতেই পারছিলাম না, মুশকান তার মায়ের নামটা নিয়ে নেওয়াতে এই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। লোকটা যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলো-চিরযৌবন লাভের সিক্রেট জানতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সে। একেবারে ছেলেমানুষি ভাবনা! যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ঐ লোককে আমি বোঝাতে পেরেছিলাম, তবে ঐ ঘটনার কিছু দিন পর মুশকান ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে চাকরিটাই ছেড়ে দেয়।” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “অবশ্য তার চাকরি ছাড়ার কারণ অন্য কিছু ছিলো। এখানকার রোগীদের আত্মীয়স্বজন রোগী মারা গেলে ডাক্তারদের উপরে যেভাবে চড়াও হয়, সেটা ওকে ভীষণ আপসেট করতো। চোখের সামনে এরকম কয়েকটি ঘটনা দেখে ভড়কে গেছিলো। আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিলো বলতে পারেন। আমাকে ও জানিয়েছিলো, হাসপাতালে চাকরি আর করবে না।”
“যে ডাক্তার মুশকানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলো সে এখন কোথায়?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। ছফার সন্দেহটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। “চার-পাঁচ বছর আগে ভদ্রলোক দুবাইর এক হসপিটালে কাজ করতো, এখন কোথায় আছে জানি না।”
ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না সে, তবে এ নিয়ে কিছু বললোও না।
হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলেন ডাক্তার। “আমার শরীর ভালো নেই, একটু পর ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা কিন্তু উঠে দাঁড়ালো না, তার বদলে গানম্যান আসলামের দিকে ফিরলো। লোকটা কয়েক মুহূর্ত চোখের ভাষা পড়েই উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেলো ডাক্তারের দিকে।
“আপনার মোবাইলফোনটা দিন,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে।
অসহায়ের মতো তাকালেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “আ আমার…” কণ্ঠ ধরে এলো তার। ছফার দিকে ফিরলেন। “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?”
“আমি সত্যি-মিথ্যা খতিয়ে না দেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।” ভু
রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন আসকার ইবনে সায়িদ।
“মুশকানকে হাতের মুঠোয় না পেলে কী করে বুঝবো আপনার গল্পটা সত্যি নাকি মিথ্যে!”
ডাক্তারের নিশ্বাস দ্রুত হতে শুরু করলো। আক্ষেপে মাথা দোলালেন তিনি। কিন্তু ও কোথায় আছে সেটা তো আমি জানি না।”
এবার বাঁকাহাসি দিলো ছফা। “এতোক্ষণ ধরে আপনি যা বলেছেন তাতে হয়তো সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন যেটা বলছেন সেটা একদমই নির্জলা মিথ্যে। মুশকানের সাথে আপনার বেশ ভালোই যোগাযোগ আছে, আর আমি সেটাই প্রমাণ করবো এখন।”
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার।
“আপনার ফোন আর পাসপোর্ট-ও দুটো হাতে পেলেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।”
“আ-আমি তো সেলফোন ইউজ করি না।”
কথাটা শুনে হেসে ফেললো ছফা, আদেশ করলো গানম্যানকে, “সার্চ করো।”
ডাক্তার হতভম্ব হয়ে তাকালেন ছফার দিকে। “আপনি বিনা ওয়ারেন্টে আমার বাসায় ঢুকেছেন, এখন আবার আমাকে সার্চ করতে বলছেন! আপনি এটা করতে পারেন না!”
“আইনত করতে পারি না,” জবাব দিলো সে, “কিন্তু আমি আপনার সাথে আইন-টাইন দেখাচ্ছি না এখন।”
আসলাম আগ্রাসি মনোভাব নিয়ে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর ইশারা করলো।
চুপচাপ উঠে দাঁড়ালেন আসকার ইবনে সায়িদ। “আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আপনার নামে কপ্লেইন করবো!” অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করার পরও হুঙ্কার দেবার চেষ্টা করলেন তিনি। “ওকে আমি বলবো-”
“আপনি প্রাইমিনিস্টারের কাছেও যেতে পারেন,” ডাক্তারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো নুরে ছফা। “ওসব জুজুর ভয় আমাকে দেখাবেন না। ভালোয় ভালোয় যা চাই তা দিয়ে দিন, নইলে আপনার সাথে অসম্মানজনক কিছু করা হবে।”
সন্দেহভাজনদের যেভাবে দেহতল্লাশি করে পুলিশ, তেমনিভাবে ডাক্তারের সারা শরীর তল্লাশি করলো পিএসের গানম্যান আসলাম, কিন্তু কিছুই পেলো না।
“ফোন তো নাই, স্যার। আমি এই লোকের ঘরগুলো তল্লাশি করি?”
ডাক্তারের দিকে তাকালো ছফা, “নিজে থেকে আপনার পাসপোর্ট আর ফোনটা দিয়ে দিন…নইলে ও কিন্তু ঠিকই তল্লাশি করে ওগুলো খুঁজে বের করবে, মাঝখান থেকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে আপনার ঘরগুলো।”
ডাক্তার আসকার বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। “আপনি আমার পাসপোর্ট চাইছেন!?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “আমি যা যা চাইবো তার সবই আপনাকে দিতে হবে, নয়তো সেটা আদায় করে নেবো।”
“আপনি বেআইনী কাজ করছেন, অফিসার!”
হেসে ফেললো নুরে ছফা। “মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করার জন্য যা যা করার করার দরকার সবই আমি করবো।”
ডাক্তার তাকিয়ে রইলেন ছফার দিকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না কী শুনছেন!
“আসলাম, তুমি উনার ঘরগুলো সার্চ করো।”