৩০. মাহির
ও যতবার ভালবাসতে যায়, জীবন ওকে হারিয়ে দেয়। আচ্ছা ও কি মানুষ না জ়িম্বাবোয়ে ক্রিকেট টিম! কিছুতেই কিছু করতে পারে না! সারাক্ষণ ‘হেরো’ লেখা একটা অদৃশ্য জামা যেন পরে থাকে ও। হাজার চেষ্টাতেও সেটা খুলতে পারে না।
আবছা অন্ধকার হয়ে আছে ঘরটা। সন্ধে হয়েছে কিছু আগে। তার ওপর ঘরের আলোও নেভানো। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না মাহির। এই ঘরে ও আসে মাঝে মাঝে, কিন্তু তাই বলে অন্ধকারে সব ঠিকমতো বুঝে নেবে তেমন পরিচিতও নয়।
বিছানায় উঠে বসে পায়ের কাছে হাতড়ে প্যান্টটা খুঁজল মাহির। কোথায় যে ফেলেছে বুঝতে পারছে না। বিছানাতেই তো রেখেছিল, কিন্তু এখন পাচ্ছে না কেন! মহা মুশকিল তো।
মাহির ভাল করে হাতড়ে দেখতে চাইল।
“কী হল? কী করছিস?” অন্ধকারের মধ্যে তুয়াদির গলা পেল মাহির।
“আমায় যেতে হবে তুয়াদি। আজ রিতুদা ফিরেছে দিল্লি থেকে। সেই দুপুরে ফিরেছে। আমার দেখা করতে যাওয়ার কথা। খুব আর্জেন্ট কাজ আছে! একজন আসবে। তাই…” মাহির এবার বিছানার পাশে রাখা টেবিলের দিকে ফিরল। সেই রাবার ব্যান্ড বাঁধা মোবাইলটা রাখা আছে। পরান সারিয়ে দিয়েছে আবার। তবে কতদিন চলবে কে জানে। মাহির ভাবল, মোবাইলটার স্ক্রিনের সামান্য সাদা আলোয় যদি খুঁজে পাওয়া যায়।
“তাই কী?” আবছায়ার মধ্যে তুয়াদি মাহিরের হাতটা ধরল, “আমার আবার ইচ্ছে করছে।”
“তুয়াদি, মাইরি এমন কোরো না, এটা খুব অন্যায় কিন্তু! এভাবে জোর করে…” মাহির অনেক কষ্টে রাগটা আটকাল।
“জোর করে কী?” তুয়াদি যেন আরও সরে এল গা ঘেঁষে!
তুয়াদির গায়ে যে কিছু নেই সেটা বুঝতে পারল মাহির।
তুয়াদি হেসে বলল, “ঢ্যামনামো দেখলে গা জ্বলে যায়! সতীপনা! আমি তোকে রেপ করি নাকি?”
ও হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলে রাখা মোবাইলটা দু’বারের চেষ্টায় তুলল। মাথার কাছটা টিপে আলো জ্বালাল। হাত ঘুরিয়ে দেখল বিছানাটা। দেখল, এক কোণে ছোট প্যান্টটা গুটিয়ে পড়ে আছে। এবার মেঝেতে দেখল। হ্যাঁ, জিন্সটা পড়ে আছে মাটিতে। ও হাত বাড়িয়ে ছোট প্যান্টটা নিল। তারপর মোবাইলটা বিছানায় রেখে পরে নিল প্যান্টটা।
“প্লিজ় তুয়াদি!” মাহির খাটের স্ট্যান্ডে ঝোলানো নিজের টি-শার্টটা পেড়ে মাথায় গলিয়ে নিয়ে বলল, “তোমার মনে যে এসব আছে, আমি আগে বুঝতে পারিনি। আমার ভাই তোমায় ভালবাসে। মা তোমার কাছে ওকে রেখে যায়। এর পরিবর্তে তুমি আমায় এসব করাও। এটা তো ব্ল্যাকমেল!”
“বেশ করব!” তুয়াদি আচমকা ফুঁসে উঠল, “আমি কি বাড়তি নাকি? আমার জীবন নেই! ইচ্ছে নেই! দাদারা একঘরে করে রাখবে! তোর ভাইকে দেখতে হবে। কেন রে? আমি দাসখত লিখে দিয়ে এসেছি নাকি? আমি যখন তোদের জন্য করব, তোকেও আমার জন্য করতে হবে। আমার বিয়ে হবে না বলে আমি কি সুখ পাব না? ঢ্যামনামো করবি না। যখন ডাকব আসবি। না হলে আবার এমন করব!”
ডিসেম্বরের দশ তারিখ এখন। ঠান্ডা পড়েছে সামান্য। মাহির মাথা নাড়ল নিজের মনে। তারপর টেবিলে রাখা জগের জল খেল। বলল, “এমন কোরো না তুয়াদি। আমরা বিপদে পড়েছি বলে তার সু্যোগ নেবে?”
“তোরা আমার সুযোগ নিচ্ছিস না?” তুয়াদি চাদরটা জড়িয়ে নিল শরীরে, “আমায় একা মেয়েমানুষ পেয়ে তোরা আমায় খাটিয়ে নিচ্ছিস না? আর, আমি তোর সঙ্গে কী খারাপ করেছি? আমার শরীরটা খারাপ? তোর যেমন ভাল লাগে সেভাবে আদর করি না? তা হলে?”
আদর করে তুয়াদি! একবার মাহিরকে পেলে ছিঁড়ে খাবার মতো করে! কিন্তু মাহির কি আর এখানে থাকে তখন! আবছা ঘরে চোখ বন্ধ করে ও পলির কথা ভাবে। পলির চোখ। ওর টিকোলো নাক। ওই মাখনের মতো ঘাড়ে ভেঙে পড়া চুলের গুচ্ছ। ভাবে, কাঁধের ওপর কেটে বসা ব্রেসিয়ারের কালো স্ট্র্যাপ। তুয়াদি যাই করুক না কেন, পলির কথা না মনে করলে মাহিরের কিছুই হয় না!
কিন্তু সেটা তো আর তুয়াদি জানে না। মাহির বোঝে যৌনতা হল সবচেয়ে বড় মিথ্যের জায়গা! কেউ যখন কারও সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, দু’জনের কেউই জানে না সত্যি সে কার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে!
কিন্তু মাহির নিরুপায়। তুয়াদি ওকে এমন করে ফাঁসিয়ে রেখেছে!
গত চারদিন তুয়াদি যায়নি ওদের বাড়িতে। ভাইকে একা রেখে মা তো আর যেতে পারে না কাজে। তাই মাহিরকেই থাকতে হয়েছিল বাড়িতে। পার্টি অফিসে আর যেতে পারেনি। ব্যাপারটা ভালভাবে নেয়নি রিতুদা। দিল্লিতে থাকলেও এখানকার সব খবর নেয় মানুষটা। কিছুই নজর এড়ায় না।
আজ রিতুদা দুপুরে ফিরবে দিল্লি থেকে। মাহির জানত। তাই মাকে দুপুরে ফোন করেছিল, “মা, আমি তো অনেকটা সময় থাকলাম। এবার তুমি যদি আজ একটু ছুটি করে চলে আসতে পারো, আমি অফিসে যেতে পারি!”
প্রথমে রিতুদার ব্যাপারটা মা ভাল মনে না নিলেও এখন আর কিছু বলে না। মাহিরকে মাস গেলে রিতুদা এখন হাজারদশেক টাকা দেয় হাতে। তা ছাড়া এদিক-ওদিক থেকে আরও তিন-চার হাজার চলে আসে। ভাইয়ের ডায়ালিসিসও অনেকটা কম টাকায় হয়ে যাচ্ছে। মা এখন শান্তই থাকে। মাহির একটা জিনিস বোঝে। টাকাপয়সা হল মশা মারার স্প্রে-র মতো। লোকজন ভনভন করলে ছড়িয়ে দাও, সব চুপ করে যাবে।
কিন্তু আজ মা মাহিরের কথায় কান দেয়নি। উলটে বলেছিল, “আমি আসতে পারব না বিকেলের আগে। তুই যেমন তুয়াকে অপমান করেছিস, তেমন এখন বোঝ!”
অপমান! মাহির আর কথা বাড়ায়নি। আসলে অপমান আর কই! একদিন তুয়াদির ঘরে তুয়াদি ওর ওপর জোরজবরদস্তি করেছিল। সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল মাহির। যদিও সফল হয়নি। নিজেই একসময় কেমন যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল। সেটা অপমান হল নাকি! তুয়াদি যা চেয়েছিল, তাই তো পেয়েছে। তা হলে? শুধু চলে আসার আগে মাহির বলেছিল, “দ্যাখো, আমি যদি আর তোমার কাছে আসি!”
মা সেদিন ফিরে এসেছিল বিকেলবেলা। আর দরজার কাছে জুতো খুলতে-খুলতেই শুরু করে দিয়েছিল চিৎকার!
ভাই ঘুমিয়েছিল। মায়ের চিৎকারে ভাই উঠে বসেছিল ধড়মড় করে। মাহির নিজে ঘাবড়ে গিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে।
মা বলছিল, “জানোয়ার ছেলে। আমায় মুখে রক্ত তুলে খাটতে হয় আর তুই এসব করছিস! আমি ফোন করেছিলাম তুয়াকে। ও বলেছে, তুই ওকে অপমান করেছিস। তাই আর আসবে না। শুয়োর, কোন সাহসে অপমান করিস তুই ওকে? জানিস না ও কী করে? তোদের রাবণের গুষ্টি টানতে-টানতে আমি মরলাম আর তুই যাকে-তাকে যা খুশি তাই বলে সাহেবগিরি দেখাবি! যা তুয়ার কাছে। ওকে পা ধরে নিয়ে আয় এখানে!”
মাহির মোবাইলটা পকেটে ভরল। তারপর চারিদিকে দেখে নিল কিছু পড়ে রইল কি না।
তুয়াদি হাসল ওকে দেখে। তারপর বলল, “পরের দিন কন্ডোম কিনে আনবি। আমি ওই পিল-টিল খেতে পারব না। একটা বড় প্যাকেট কিনে এনে দিবি। আমি রেখে দেব। আর বউদিকে বলিস আমি কাল যাব তোদের বাড়ি। যেন চিন্তা না করে!”
মাহির কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী সাংঘাতিক একটা ফাঁদে আটকে যাচ্ছে! কাউকে এসব বলতে পারবে না। কিন্তু সহ্যও করতে পারছে না! এর থেকে বেরোবে কী করে? ও ঘর থেকে বাইরে যাবে বলে পা বাড়াল।
তুয়াদি বলল, “পাশের গলিটা দিয়ে যাবি। না হলে দুই বউদি দেখতে পাবে। আবার খিস্তি শুরু করবে ঢেমনি মাগিগুলো!”
দাদাদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও তুয়াদির ঘরটা একেবারে আলাদা। ঢোকার পথও আলাদা। তাই এখানে এলে চট করে কারও চোখে পড়ে না।
তুয়াদি বলল, “আমি মেয়ে বলে কি আমার সেক্স করতে ইচ্ছে করতে পারে না? আমার তোকে ভাল লাগে। অনেকদিন থেকেই লাগে। এটা তুই বুঝিস না? আমি জানি আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক সামাজিকভাবে হয়তো হতে পারে না। কিন্তু যেটুকু পাওয়ার চান্স আছে, সেটা আমার চাই। তার জন্য আঙুল বাঁকাতে হলে বাঁকাবই!”
মাহির আর দাঁড়াল না। ওর সারা শরীর কেমন করছে। যৌনতার একটা টান আছেই। কিন্তু একবার সেটা শেষ হয়ে গেলে তার যে কী তীব্র বিরাগ, সেটা বুঝতে পারছে মাহির। আর শুধু তা নয়, ওর মনের মধ্যে একটা তীব্র অপরাধবোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই শরীর নিয়ে ও কীভাবে যাবে পলির কাছে!
পলি। নামটা মনে করলেই শরীরের ভেতরে যেন কেউ কর্পূর ভরে দেয় মাহিরের। কেন এত ভাল লাগে ওর পলিকে! কী স্মার্ট আর খোলা মনের মেয়ে! কী উদ্যোগী! শুনেছে ওই ওল্ড এজ হোমটার সঙ্গে অনেকে যুক্ত! কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তো শুধু পলিকেই দেখে একা হাতে সব সামলাতে।
রিতুদাকেও ভাল বলতে হবে। এককথার মানুষ! প্রথমে টালবাহানা করলেও পরে ঠিক ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কুড়ি লাখ টাকার একটা ফান্ড দিয়েছে ‘ব্রোঞ্জ ইয়ার্স’-কে! তবে মাহির জানে, এমনি-এমনি তো আর সেটা হয়নি।
ভাল করে দেখে, কাগজ তৈরি করে রিতুদাকে যেদিন ও সব কথা বলেছিল, যেদিন পলির তৈরি রিপোর্টটা দিয়েছিল, রিতুদা কিছু দেখেনি। শুধু বলেছিল, “ক্লাব জায়গা দখল করে রেখেছে সেটা তুলতে সময় লাগবে। ওদের ছেলেরা আমার খাস লোক। কিন্তু তার বদলে আমি ওদের একটা ফান্ড দিয়ে দিচ্ছি। আপাতত সেটা দিয়েই তুই হিরো হ, বুঝলি! শুধু আমার নামটা যেন লিখে দেয় সামনে, সেটা দেখবি। আর ভাই, আমি তোমার হিরো হওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তোমাকেও তো কিছু করতে হবে। তাই না?”
সামান্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল মাহির। সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। পার্টি অফিস ফাঁকা ছিল। বাইরে দরজার কাছে চারটে ফড়ে বসে শুধু আড্ডা দিচ্ছিল।
রিতুদা তোয়ালে দিয়ে মাথার ঘাম মুছতে-মুছতে বলেছিল, “কয়েকটা ভেড়ি আছে। ওই গঙ্গানগর ছাড়িয়ে। বেশ কয়েকমাস হল ওরা টাকাপয়সা দিচ্ছে না। কথাও শুনছে না। তুই জাস্ট যাবি। মানে, তুই আর টিটি। তোরা দু’জন অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই তোদের কেউ আটকাবে না। যোগেন বসাক বলে একটা লোক আছে। ও-ই সব কন্ট্রোল করে। জাস্ট গিয়ে মালটাকে উদোম কেলিয়ে দিবি। আনখাই মারবি আর কী! তুই তো ক্যারাটে জানিস। ওকে ‘মা’ বলতে দিবি না। জাস্ট মেরে বেরিয়ে আসবি। চেনা লোক গেলে আগে থেকেই যোগেন সাইডিং হয়ে যাবে। আর আসার আগে ওর কানের গোড়ায় এটা ধরবি। বলবি টাকা না পৌঁছলে বাড়িসুদ্ধু জ্বালিয়ে দেওয়া হবে! এই নে এটা রাখ।”
কথা শেষ করে রিতুদা পাশের ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করে রেখেছিল সামনে। বলেছিল, “এটা সেভেন এম এম। মুঙ্গেরি মাল। ভাল। এটা রাখ। না, চালাতে হবে না। শুধু বের করে দেখাবি।”
“মুঙ্গেরি!” মাহিরের চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছিল বাইরে! কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কী করা উচিত ওর! হাত কাঁপছিল মাহিরের। কান লাল হয়ে গিয়েছিল। মায়ের মুখ মনে পড়ছিল।
রিতুদা ওকে দেখে হেসেছিল। তারপর সামনে রাখা বোতল থেকে জল খেয়ে বলেছিল, “আগেও একবার এমন করে কাঁপছিলি। সেই একই ঢ্যামনামো আর করবি না। নে, তোল ওটা। কিছু হবে না। ইউজ় করতে হবে না। জাস্ট দেখাবি। এটা হল ঠাকুরের সেই ফোঁস। বুঝলি?”
মাহির বুঝতে পারছিল, কুড়ি লাখ টাকা অনুদান আসলে একটা ফাঁদ। ও কী করবে বুঝতে পারছিল না। এ কোন পথে এগোচ্ছে ও!
রিতুদা ওকে দেখেছিল ভাল করে। তারপর পাশে রাখা একটা প্যাকেট থেকে লজেন্স বের করে মুখে পুরে বলেছিল, “শোন, এটা তোকে করতে হবে। ওখানে কেউ ঢুকতে পারছে না। যোগেন আমার সব ছেলেপিলেকে চেনে। তোকে আর টিটিকে এখনও চেনে না। লাস্ট ন’মাস একটা টাকাও ও ঠেকায়নি। জানবি সব কিছুর দাম আছে। ওই যে পলির ফরসা চামড়া দেখে পিছলে গিয়েছিস তুই, তার তো একটা দাম দিতে হবে বাবু! তোল ওটা। ইউজ় করবি না। জাস্ট রাখবি। কিছু হলে আমি তো আছি।”
পিস্তলটা নিয়ে বাড়িতে এসে কোথায় যে রাখবে, বুঝতে পারছিল না মাহির। অনেক ভেবে খেলার কিট ব্যাগে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রেখে দিয়েছিল। সেদিন মাহির বুঝেছিল সত্যিকারের জীবনে হিরো হওয়ার দাম কী! বুঝেছিল, এই পৃথিবীতে বিনে পয়সায় দূষিত হাওয়া ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না!
যোগেন লোকটা দুবলা-পাতলা। পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি হাইট। সামনের একটা দাঁত নেই। দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না এই ভাঙাচোরা টাইপের লোকটার এমন প্রতাপ!
গঙ্গানগর জায়গাটার চারিদিকে মাছের ভেড়ি। আসল কাজে যাওয়ার আগে একদিন টিটি বাইক নিয়ে ঘুরে এসেছিল ওখান থেকে। তারপর রাতে বাড়িতে এসেছিল মাহিরের।
ও তখন সবে খাবার খেয়ে বাসন মেজে সাজিয়ে রাখছিল রান্নাঘরে। টিটি এসে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ওকে।
মা বিরক্ত হয়েছিল খুব। বলেছিল, “ওই মর্কটটা এখন এসেছে কেন এখানে?”
“কাজ আছে,” মাহির আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে।
মা বিরক্ত গলায় বলেছিল, “রাত বাড়লে কাজ বাড়ে যদি, তবে সেখানে গন্ডগোল হবেই!”
এসব বাজে কথা। আজকাল রাত আর দিনের পার্থক্য নেই! সারাক্ষণ মানুষজন ফাটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে! স্যার বলতেন, “কাজের সময় হয় না। কাজ হল ঈশ্বর মাহির। অলস মানুষ আর খারাপ মানুষে জানবি কোনও পার্থক্য নেই!”
মাহির অলস নয় মোটেই। কিন্তু ও কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে না! সেদিন টিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর আগে স্যারের মুখটা খুব মনে পড়েছিল মাহিরের। কেন কে জানে কষ্ট হয়েছিল খুব। মনে হচ্ছিল স্যারকে ধোঁকা দিচ্ছে কি মাহির!
“শোন, রাস্তা ইস্মুদ। আমি দেখে এসেছি। খবরও নিয়ে এসেছি। লোকটা রোজ বিকেলবেলা একা হাঁটতে বেরোয়। দু’জনে যাব। পুঁচকে মাল। তোর ব্যাক পকেটে এঁটে যাবে। তুলে ঝোপের ধারে নিয়ে গিয়ে ঠুসে দেব, ব্যস। ইজ়ি কাজ।”
মাহির চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “ধরা পড়ে গেলে!”
“দুর! ভাটের কথা বলিস না। কোন শালাটা ধরবে আমাদের?” টিটি বিরক্ত হয়ে মাথার ব্যান্ডটা ঠিক করেছিল, “শালা, ওখানকার বহুত পাবলিক খেপে আছে ওর ওপর। আমি পালানোর পথ দেখে এসেছি। ভাবিস না।”
মাহির তাও তাকিয়েছিল টিটির দিকে।
টিটি ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “শালা, গরিব হয়ে তো দেখলি কেমন লাগে! এবার এসব পেঁয়াজি ছাড়! তোর ওই স্যার আর বেঁচে নেই মাহির। তোর ভাই আর মা কিন্তু বেঁচে আছে!”
কাজটা করতে অসুবিধে হয়নি মাহিরের। শুধু প্রথম লাথিটা মারার আগে কেন কে জানে, লোকটার সামনের দাঁতটা দেখে মনে হয়েছিল, ওর বাবার সামনের দাঁতটাও এমন ভাঙা ছিল না?
আর নিজের ঘরে গেল না মাহির। ভেবেছিল স্নান করবে। কিন্তু সময় নেই। পলি আসবে আজ। টালিগঞ্জ থানার সামনে আসবে বলেছে। কী দরকার মেয়েটার জানে না। কিন্তু খুব জোর দিয়ে বলেছে মাহির যেন পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও দেখা করে ওর সঙ্গে!
এইভাবে পলির কাছে যেতে মন থেকে সাড়া পাচ্ছে না মাহির। কিন্তু সাড়ে ছ’টায় মেয়েটা আসবে বলেছে, তাই আর সময় নেই।
এমনিতেই সারা জীবন মেয়েদের খুব একটা সান্নিধ্য পায়নি মাহির। ওর বয়েজ় স্কুলের জীবনে সেভাবে সু্যোগ হয়নি। প্রাইভেটেও কারও কাছে পড়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই দূর থেকে মেয়েদের দেখত। সেই জন্যই কি না কে জানে, রেশমিকে দেখে মাথা পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল ওর। মনে হয়েছিল এই মেয়েটা যেন ওর সঙ্গে কথা বলে, পাত্তা দেয়। এই মেয়েটাকে ছাড়া আর থাকবে কী করে? ওর তুচ্ছ আর যন্ত্রণার জীবনে রেশমিই ছিল একমাত্র জানলা! নিজের সবটা দিয়ে মেয়েটাকে ভালবেসেছিল মাহির। কিছু নিজের কাছে লুকিয়ে রাখেনি। কিন্তু সেই মেয়েটা ওকে দায়ে-দফায় নানাভাবে ব্যবহার করে শেষপর্যন্ত ছেড়ে চলে গেল নিজের চেয়ে অনেক বড় একটা লোকের সঙ্গে! কেন? না লোকটার টাকা বেশি বলে!
মাহির সেদিন থেকে বুঝেছিল, টাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওর যদি অনেক টাকা থাকত, রেশমি কি ওকে ছেড়ে যেত!
একটা সর্বস্ব-খোয়ানো প্রেম চলে গেলে যা হয়, মাহিরের তাই হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কঙ্কালের শহর বুকে নিয়ে ঘুরছিল ও। মনে হত আর কোনওদিন কাউকে ওর ভাল লাগবে না। কিন্তু পলিকে দেখে সব আবার গুলিয়ে গিয়েছে মাহিরের। এমন কোনও মেয়ের সান্নিধ্য তো পায়নি কোনওদিন! সেখানে পলি ওদের বাড়িতে এসেছে ওকে খুঁজতে! ওকে নিয়ে ঘুরেছে। ওকে মেসেজ করে। ও তো ভাবতেই পারছে না! একদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় তো ওর হাতটাও ধরেছিল!
আজকাল ভোরবেলা অর্ধেক ঘুমের মধ্যে প্রায় রোজ পলিকে দেখে ও। নিজের পাশের কোলবালিশটা মনে মনে পলির সঙ্গে পালটে নেয়! নিজেকে কোলবালিশের সঙ্গে গেঁথে দিতে-দিতে কল্পনা করে পলি ভালবাসায়, আরামে ওকে আঁকড়ে ধরে আছে কাবুলি বিড়ালের মতো!
সেই পলি যদি ডাকে, তা হলে ও না গিয়ে থাকবে কেমন করে!
রাস্তায় বোঁচাদার পানের দোকানের সামনে টিটি দাঁড়িয়েছিল। ওকে দেখে বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল, “শালা, থাকিস কোথায়? ফোন করছি পাচ্ছি না? যা এক পিস মোবাইল রেখেছিস না! বাবরের আমলের! অর্ধেক সময়ে তো পাওয়াই যায় না। রিতুদা দুপুরে ঢুকে তোকে খুঁজছে। খচে আছে কিন্তু। তুই চল তাড়াতাড়ি।”
মাহির দেখল টিটিকে। মাথায় ব্যান্ডটা ছাড়া বাকি সব কিছু পালটে গেছে ওর। এখন আর অটোর কথা বলে না। রিতুদার দাক্ষিণ্যে টাকা লেগেছে ওর গায়ে! ভাল জামা, জিন্স। জুতোটাও বেশ দামি মনে হচ্ছে! গলায় একটা সোনার চেন দেখল আজ! লোডশেডিং-এ রাংতার মতো চকচক করছে টিটি।
“ক্যালানে হয়ে গেলি নাকি? কানে কথা যাচ্ছে না? রিতুদার মটকা গরম হয়ে আছে। বিশে, পগা আর নুলো লাগিয়েছে যে, তুই আজকাল আর নিয়মিত অফিসে আসিস না। তোর নাকি পাখনা গজিয়েছে! মাগিবাজির অলিম্পিকে নাকি সোনা জিতেছিস! রিতুদা বলছে তোকে যে-কাজ দিয়েছিল, সেটাও নাকি ঠিকমতো করিসনি! শালা, তুই মরবি আর আমাকেও ক্যাওড়াতলায় চালান করবি! চল তাড়াতাড়ি!”
“আমার একটা কাজ আছে,” মাহির গম্ভীর গলায় বলল।
“কা…” শব্দটা মাঝপথে থামিয়ে টিটি তাকিয়ে রইল, “শালা, আবার পলি!”
“পাঁচ মিনিট। প্লিজ়,” মাহির বলল, “টালিগঞ্জ থানার সামনে আসবে। পাঁচ মিনিট জাস্ট।”
“তুই মাইরি আবার রেশমি পার্ট টু করছিস নাকি?” টিটি সন্দেহের চোখে তাকাল, “তোর লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন কিছুই তো ভাল ঠেকছে না!”
মাহির ওর বাইকের পেছনে উঠে পড়ল। পুরনো বাইক! স্প্রিংগুলো সামান্য ককিয়ে উঠল মাহিরের চাপে।
ও বলল, “একবার ঘুরে চল প্লিজ়। আর্জেন্ট!”
টিটি নিজের মনে মাথা নাড়ল, “প্যান্টে আগুন লাগলে শালা সবার সবকিছু আর্জেন্ট হয়।”
মাতৃভবন হাসপাতালের সামনে দিয়ে না গিয়ে সামান্য ঘুরে থানার দিকে এগোল টিটি। মাহিরের ভাল লাগল। টিটি যতই ওকে বকাবকি করুক, আসলে ছেলেটা ওকে ভালবাসে খুব। হাসপাতালের সামনের রাস্তা দিয়ে গেলে পার্টি অফিসের মোড়টা পড়ে, তাই চিনুদার গ্যারেজের রাস্তাটা ধরেছে টিটি।
রিতুদা রেগে আছে! মনে মনে ভয় করছে মাহিরের। কিন্তু পলির সঙ্গে দেখা না করে ও যেতে পারবে না। আর রিতুদার কাজ তো ও করে দিয়েছে। তারক চক্রবর্তী। আইকা। নোঈ। সব তো খবর রাখছে। তা হলে কেন রেগে আছে রিতুদা! রিতুদার কাজে তো ওরা ‘না’ করে না! তা হলে!
যোগেনের ব্যাপারটার পরে রিতুদা মাহিরকে বেশ নির্ভর করতে শুরু করেছে। এতে অবশ্য নানা লোকের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু রিতুদা জানে কাকে কীভাবে রাখতে হয়।
যোগেনের ব্যাপারটা মিটিয়ে আসার সপ্তাহখানেক পরে আবার রাতে, সবাই চলে যাওয়ার পরে রিতুদা ডেকেছিল মাহিরকে। বলেছিল, “ওই যন্ত্রটা নিয়ে আসিস।”
রিতুদার টেবিলে গিয়ে পিস্তলটা রেখেছিল মাহির। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ও। এটা খুব ভয়ের একটা জিনিস। তারপর মা যদি দেখে ফেলত তবে তো হয়ে গিয়েছিল!
রিতুদা বসতে বলেছিল ওকে। পিস্তলটা নিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে বলেছিল, “তোর জন্য একটা কাজ আছে।”
“কাজ!” আবার কাজ! আবার কাউকে পেটাতে হবে নাকি! মাহিরের মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। শেষপর্যন্ত ও ভাড়া করা গুন্ডা হয়ে গেল! কোথায় ভাবত কানাভারোর মতো ডিফেন্ডার হবে, তা না পুরো মাস্তান বানিয়ে দিল জীবন!
“ভয় নেই,” রিতুদা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে একটা লজেন্স বের করেছিল পকেট থেকে। বলেছিল, “এবার আর মারামারি করতে হবে না। শোন, সোনাঝুরিতে বড় প্রজেক্ট আসছে। কিন্তু সেখানে আমাদেরই পার্টির তারক চক্রবর্তী বলে এক নেতা আছে। মালটা খুব সেয়ানা। সে বিশাল হাঁ করে বসে আছে! আমাদের কাছে খবর এসেছে যে, সেই জন্য ঝামেলা হতে পারে। তা ছাড়া আমাদের পার্টিরও নাম খারাপ হচ্ছে ওখানে। তাই আমায় বলা হয়েছে ওর ওপর নজর রাখতে। তুই একটু খবর নে যে, আসলে কেসটা কী। সত্যি কি তারক অমন হাঁ করে বসে আছে? নাকি অন্য গল্প আছে এর মধ্যে?”
কথা শেষ করে রিতুদা তাকিয়েছিল ওর দিকে, “এটা পারবি তো? আর শোন, তোর জন্য একটা জিনিস আছে।”
জিনিস! কী জিনিস সেটা বুঝতে পারেনি মাহির। দেখেছিল, রিতুদা একটা কাঠের বাক্স বের করে সামনে রেখেছিল। তারপর সেটার ঢাকনা খুলে বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনে, “এটা রাখ। নাইন এম এম চাইনিজ় মাল। চারবার ফুল ম্যাগাজ়িন ফায়ার করলেও গরম হয় না। হাতে ফাটার চান্স নেই। আর যখন-তখন লক হয়েও যায় না। বুঝেছিস? পার পিস কত জানিস? পঞ্চান্ন! রাখ এটা। চালাবি না দরকার না পড়লে। জাস্ট দেখাবি। ওই ফোঁস!”
মাহির নিরুপায় হয়ে তাকিয়েছিল পিস্তলটার দিকে। রিতুদা বলেছে, তখন আর কী করে না করবে! একবার যখন খেলায় ঢুকেই পড়েছে, পিছিয়ে আসবে কী করে! ওর মাস-মাইনের টাকা। ভাইয়ের চিকিৎসা সবটাই তো মাথায় রাখতে হবে।
তোয়ালে মুড়ে আবার আগের মতো লুকিয়ে রেখেছিল জিনিসটা।
কিন্তু ওর মনে হয়েছিল এই কাজটা আগের চেয়ে সহজ।
সোনাঝুরি জায়গাটা বেশ। সুন্দর সাজানো একমুঠো মফস্সল। পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে গিয়েছে। আর এই ছোট্ট জায়গায় তারক চক্রবর্তী একটা বিশাল বড় নাম! সবাই যে ভয় পায় তারককে, সেটা বুঝেছিল মাহির। আর এও জেনেছিল প্রাথমিকভাবে তিন-চারটে পার্টি থাকলেও এখন এই জমি, জুটমিল আর বড় ওই জোনাক-বাড়িটা কেনার দৌড়ে দু’জন অবশিষ্ট আছে। বাকিরা তারকের হাঁ মুখ দেখে গন্ডগোলের আভাস পেয়ে সরে পড়েছে। রিতুদার খবর যে ভুল নয় সেটা বুঝতে পেরেছিল।
আরও কিছুদিন খবর নেওয়ার পরে ও জানতে পেরেছিল, তারক ‘হোমওয়ার্ড বাউন্ড রিটেলর্স’ নামে একটা সংস্থার সঙ্গে কলকাতায় গোপন মিটিং করবে।
মাহির জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য মোতিবাবু? আমায় বুলু দিচ্ছেন না তো?”
সোনাঝুরিতে গিয়ে এই মোতি নামে লোকটাকেই ধরেছিল মাহির। নরমে-গরমে বুঝিয়ে দিয়েছিল ও কার কাছ থেকে আসছে। বুঝিয়ে দিয়েছিল, ওর মাথায় পার্টির হাত আছে। ওকে সাহায্য না করলে বিপদ আছে।
মোতি বোকা লোক নয়। রিতুদার নাম জানে। ক্ষমতাও বোঝে! তা ছাড়া এই সব লাইনে কেউ কারও হয় না। তাই নিজের আখের গোছাতে, রিতুদার গুড বুকে থাকতে চেয়ে মোতি বলেছিল, ও ঠিক খবর দেবে। শুধু সময়মতো ওকে যেন মনে রাখে রিতুদা!
মোতি বলেছিল, “আরে মাহিরভাই, আমি কেন সেধে ঢপ মারতে যাব? বলেইছি ফুল কো-অপারেশন করব। আপনি চলে যান রাজডাঙার পাশের নতুন বড় মলটায়। বিকেলে। তারকদা কথা বলবে একজনের সঙ্গে। ওই জমির কেসটা নিয়ে টাকাপয়সার কথা বলবে একটা রেস্তরাঁয় বসে। যান, দেখুন কী হয়!”
পরানদা লোকটার মোবাইল রিপেয়ারিং-এর দোকান আছে পাড়ায়। ভাল বাড়ির ছেলে। অবস্থার গতিকে এখন জীবন পড়তির দিকে। কিন্তু এখনও একটা বনেদিয়ানা আছে চেহারায়। বেশ মোটা গোলগাল চেহারা। টকটকে ফরসা রং। সারাক্ষণ পান খায়। দেখলে অনেকেই মারোয়াড়ি ভেবে হিন্দিতে কথা বলে!
সেদিন পরানদাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল মাহির। ও যে এখন রিতুদার সঙ্গে আছে, সেটা মোটামুটি জেনে গিয়েছে সবাই। আগে মাহির এটা কাউকে জানাত না। কিন্তু এটা বুঝেছে যে, এ বাজারে কিছুই ঢাকা থাকে না। সব বেরিয়ে পড়ে। তাই এই ব্যাপারটা ও আর লুকোয়নি। তাতে অবশ্য লাভই হয়েছে। এখন কাউকে কিছু বললে আর না করে না।
ও পরানদাকে বলেছিল, “তুমি আজ আমার সঙ্গে যাবে একটা মলে। কাজ আছে। রিতুদার কাজ। ভাল জামাকাপড় পরে নেবে, কেমন! একজন লোক আছে। তার পাশে বসবে। খাবে। আর শুনবে কী বলে। এটা ইমপর্ট্যান্ট কিন্তু।”
ঠিক তারক এসেছিল সেই মলে। একজন ভদ্রমহিলাও এসেছিল দেখা করতে। পরানদা পাশের টেবলে বসেছিল। কাস্টমার সেজে খাচ্ছিল বসে। রেস্তরাঁর বাইরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে মাহির দেখছিল তারক পরানদাকে কিছু বলছে। ও হাসছিল মনে মনে! তারক তো জানে না, পাশে কে বসে রয়েছে!
যে-মহিলাটি দেখা করতে এসেছিল, তাকেও খুব চেনা লাগছিল ওর। কিন্তু মনে করতে পারছিল না। আর সত্যি বলতে কী, ওসবে মনও ছিল না মাহিরের। তারকের দিকেই চোখ ছিল ওর।
কাজ শেষ করে পরানদাকে সোজা রিতুদার কাছে নিয়ে গিয়েছিল মাহির। পাশের টেবিলে বসে পরানদা যা শুনেছে সব বলে দিয়েছিল গড়গড় করে!
রিতুদা খুশি হয়েছিল খুব। কিন্তু চিন্তিতও দেখাচ্ছিল। পরানদা চলে যাওয়ার পর সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল মাহির, “কী হয়েছে রিতুদা? আপনি কিছু আশঙ্কা করছেন?”
রিতুদা বলেছিল, “কী জানিস তো, অন্য সব কিছুর মতো আমাদের পার্টিতেও নানা দল, উপদল, কাঠিবাজি আছে। তারকের সঙ্গে পার্টির কিছু নেতার র্যাপো ভাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ওই অঞ্চলে তারক একটা ফ্যাক্টর। তাই সরাসরি ওকে কিছু করা যাবে না। হাইকম্যান্ডকে বললেও, তারা সব শুনেও সবসময় কিছু করে না। প্লাস তারক তো আর সব টাকা একা গিলবে না! ভাগ করবে। তাই… ভাবছি!”
“ওই দেখ, দাঁড়িয়ে আছে!” থানার সামনে বাইকটা দাঁড় করিয়ে টিটি সামনের দিকে হাত তুলল।
টিটির বাইকটার এমন আওয়াজ যে, না তাকিয়ে উপায় নেই। মাহির দেখল পলি ওদের দেখেছে!
মাহির সময় নষ্ট না করে বাইক থেকে নেমে এগিয়ে গেল পলির দিকে। পলি হাতঘড়িটা দেখে বিরক্ত মুখে বলল, “সাড়ে ছ’মিনিট লেট! আমার বুঝি সময়ের দাম নেই! ওদিকে স্যার গাড়িতে ওয়েট করছেন!”
মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না। আমতা-আমতা করে বলল, “আমি আসলে বুঝতে পারিনি। মানে…”
পলি হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, “আরে, গালে কী হয়েছে? এমন লাল কেন?”
সর্বনাশ! তুয়াদি কামড়ে দিয়েছে আজ! এটা ভুলে গিয়েছিল মাহির।
ও বলল, “আর বোলো না, ভাই মাঝে মাঝে এমন করে! আঁচড়ে দিয়েছে!”
“ও!” পলি আলতো করে ছুঁল ওর গালটা। মাহিরের মনে হল খোলা ইলেকট্রিকের তারে হাত লেগে গিয়েছে ওর।
পলি বলল, “যাকগে। তোমার মোবাইলটা এখনও তুমি ফেললে না! আমি কতবার ফোন করছি পাচ্ছি না! কী টিটি, বন্ধুকে একটা নতুন মোবাইল কিনতে বলতে পারো না?”
টিটি হাসল। অপ্রস্তুত মুখে হেঁ হেঁ করল একটু। মাহির বুঝল, পলির আলো লেগে টিটিও অন্ধ হয়ে গিয়েছে!
মাহির আস্তে করে বলল, “অন্য গ্রহের নেটওয়ার্ক আমার মোবাইলে ধরে না!”
“মানে?” পলি ভুরু কুঁচকে তাকাল, “অন্য গ্রহ মানে কী? আমি এলিয়েন নাকি?”
মাহির কিছু না বলে হাসল শুধু।
পলি বলল, “দাও, তোমার মোবাইলটা। দেখি!”
“আমার মোবাইল?” এবার একটু ঘাবড়ে গেল মাহির। এই রে, ওটা বের করতে হবে! ওই ঘষা, রংচটা, রাবার ব্যান্ড লাগানো মোবাইলটা! ওটা তো ওর কাঙালপনার সাইনবোর্ড! সেটা দেখে কী করবে পলি?
“না তো কী? দেবে, নাকি আমি প্যান্টের পকেট থেকে বের করে নেব?”
“আরে,” হেসে মোবাইলটা বের করে দিল মাহির। পেছন ফিরে একবার টিটিকেও দেখে নিল। দেখল, টিটি শান্ত ছেলের মতো চুপ করে আছে।
পলি মোবাইলটা নিয়ে দেখল ভাল করে। তারপর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল, “এই নাও। এটা তোমার।”
“আমার?” মাহির অবাক হয়ে তাকাল।
“হ্যাঁ। মোবাইল আছে। দ্যাখো। আর এই মান্ধাতার আমলের জিনিসটাকে আজকেই ছুড়ে ফেলে দেবে। তোমার লজ্জা লাগে না!”
লজ্জা! মাহির মাথা নিচু করে নিল। লজ্জা জিনিসটা আর আসে না ওর। সবাই তো ওর জীবনের কঙ্কাল দেখে ফেলেছে। সেখানে আর লজ্জা পেয়ে কী করবে। আচমকা চোখে জল এসে গেল ওর। এমন তো কেউ কোনওদিন করেনি ওর জন্য!
পলি বলল, “কী হল নাও! অত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? এটা দিতেই ডেকেছিলাম।”
সংকোচের সঙ্গে মোবাইলটা নিল মাহির। চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলাল। ইস! তুয়াদির সঙ্গে শুয়ে এখানে এসেছে ও! পলিকে মিথ্যেও বলল দাগের ব্যাপারে। আর সেখানে মেয়েটা ওকে এসব দিচ্ছে! ও কী পাষণ্ড! শয়তান! পলিকে ঠকাচ্ছে ও!
মাহির হাসার চেষ্টা করল, “সেদিন তো আমায় রেস্তরাঁয় খাওয়ালে। আবার আজ এটা…”
“প্লিজ়, ন্যাকামো করবে না,” পলি বলল, “আর সেদিন যা হল!”
তা ঠিক! মাহিরের মনে পড়ে গেল। কী কাণ্ড! ওই লোকটা সবার সামনে মেয়েটাকে কীভাবে নিয়ে গেল!
“নিশান ঠিক আছে? সেদিন তো না খেয়ে চলে গেল!” মাহির জিজ্ঞেস করল।
“জানি না,” পলি হাতঘড়ি দেখে বলল, “খুব বাজে করেছে রাধির বাবা! এত টাকা লোকটার, কিন্তু ম্যানার্স জানে না! যাকগে। আমি যাই। কাজ আছে আমার।”
মাহির আর আটকাল না। এই নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। সেদিন ওখানে স্মরণ বলে সেই ছেলেটাও এসেছিল। কিন্তু সবার সামনে কেউই কাউকে চেনা দেয়নি। ভালই হয়েছে। সবাইকে তো আর সব কিছু জানিয়ে লাভ নেই!
মাহির থানায় লাগানো ঘড়িটা দেখল। রাস্তা থেকে দেখা যায়। ওর নিজেরও দেরি হচ্ছে। রিতুদার পারা চড়ছে ওদিকে। ও মাথা নাড়ল।
দেখল, পলি প্রায় দৌড়ে চলে গেল একটু দূরে দাঁড় করানো একটা গাড়ির দিকে। গাড়িটা বেশ বড়। ধূসর রঙের। গাড়িতে উঠে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওর দিকে হাত নাড়ল পলি। তারপর বেরিয়ে গেল।
মাহির এসে বসল বাইকে। টিটি বলল, “শালা, তুই তো কামাল করে দিয়েছিস! পুরো ক্যাচ কট কট একদম! এই জিনিসকে তুলে ফেলেছিস! কিন্তু সামলে ভাই। বড়লোকের মেয়ে। আমাদের কুত্তার পেট। ঘি হজম হবে তো?”
“ভাগ! চল অফিসে!”
মাহির কথাটা মুখে বললেও মনে মনে ভাল লাগছে খুব। কেমন একটা হালকা লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বেলুনের মতো আকাশে উড়ে যাবে না তো! পলি ওকে গিফট দিল! ওর গাল ছুঁয়ে দিল! নিজের এই সাধারণ খোলসটা ছেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল ওর। এই খোলসটা ভাল লাগে না মাহিরের। এটাকে লোকে ব্যবহার করে। নিংড়ে নেয়। এটা ছেড়ে একটা ভাল, পরিষ্কার মানুষ হতে ইচ্ছে করছে আজ। ইচ্ছে করছে সেই ছেলেটা হতে যাকে স্যার ভালবাসতেন। মনে মনে ঠিক করল আবার সেই ছেলেটা হতে হবে ওকে। পলির পাশে দাঁড়ানোর জন্য সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে হবে মাহিরকে!
“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ভাল কথা, ওই ছেলেটা আর মেয়েটার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেছিলি?”
মাহির ঠোঁট কামড়াল। স্মরণ আর নোঈ। ওরা এখনও কেন যোগাযোগ করেনি কে জানে!
তারককে পালটা দিতে রিতুদা বলেছিল, “অন্য গ্রুপটা, মানে ‘রিকো গ্রুপ’-এর সঙ্গে যোগাযোগ কর। ওরা মাল্টিন্যাশনাল। ওদের আউটলুক অন্যরকম। ওরা অত ঘুষ দেবে না। আর ওরা জুটমিলটাকে রিভাইভ করাতে চায় শুনলাম। শালা, ওদের কাজটা করিয়ে দিতে পারলে, আমার প্রেস্টিজ বাড়বে। হাইকম্যান্ড জানবে এই বাজারে আমি নতুন করে কর্মসংস্থান করছি। আমার লিফট হবে। তোদেরও হবে। পরের ভোটে একটা পদ আমার পাকা হয়ে যাবে। বুঝলি! তুই ওদের আমার সঙ্গে দেখা করতে বল। তারক নিশ্চয় এর মধ্যে ওদের ভড়কাতে শুরু করেছে। আর না করলেও করবে। তার আগেই আমাকে ঢুকে পড়তে হবে। বুঝলি কিছু?”
স্মরণ আর নোঈ যে ‘রিকো’-য় আছে সেই খবরটা নিয়েছিল মাহির। মোতিই বলেছিল ওকে। ও বুঝতে পেরেছিল এই গ্রুপটা বিশাল বড়, ওদের মাথাদের কাছে ঘেঁষা সহজ হবে না। তাই ওই স্মরণ আর নোঈকে টার্গেট করেই কাজ শুরু করতে হবে।
সোনাঝুরিতে একদিন গিয়েছিল ওই দু’জন। সেখান থেকে ওদের ফলো করেছিল মাহির। তারপর সুযোগ বুঝে স্মরণের বাড়িতে গিয়েছিল!
রিতুদা থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঘরে চারজন ছিল, কিন্তু মাহির ঢোকামাত্র সবাই বেরিয়ে গিয়েছে! ও কয়েকজনের মুখে হালকা হাসিও দেখেছে। মানে, আজ হবে মাহিরের!
ডিসেম্বরের এই সময়ে কলকাতায় গরম নেই বিশেষ। তাও রিতুদা কুলকুল করে ঘামছে!
মাহিরের গলা শুকিয়ে গিয়েছে। একটু আগে যে-ভাললাগা ছিল, সেটার জায়গায় ভয় এসে ঢুকে পড়েছে মনে।
মাহির মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“জানিস মাহির, আমার না হাই প্রেশার আছে। রাগ খুব বেশি তো! আমার মা, অনেক বয়স এখন, তাও সপ্তাহে একদিন উপোস করে আমার শরীরের জন্য। কারণ, ছোটবেলায় এক সন্ন্যাসী মাকে বলেছিল, আমার নাকি এমন রাগ যে, মাথার শিরা ছিঁড়ে মরে যেতে পারি! কিন্তু মা এটা জানে না যে, আমি মরার আগে আরও গোটাকয়েক জানোয়ারকে নিয়ে মরব।”
“রিতুদা, আমার ভাইয়ের খুব শরীর খারাপ ছিল। মায়ের কাজ থাকে তো, তাই…”
“তো আমার কী ছেঁড়া যাবে তাতে! শুয়োরের বাচ্চা! খালি অজুহাত! যখন টাকা দিই হাত পেতে নিস না! আর কাজের বেলায় ঢ্যামনামো! আমি কলকাতায় নেই বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছ!”
“কিন্তু…”
“চোপ বাঞ্চোত!” হাতের কাছে থাকা কাচের পেপার ওয়েটটা আচমকা ছুড়ে মারল রিতুদা!
কোনওমতে মাথা নিচু করে নিজেকে বাঁচাল মাহির। শব্দে বুঝল পেছনে রাখা একটা ছবি চুরমার হয়ে গিয়েছে! রিতুদা উঠে দাঁড়িয়েছে! চোখ লাল। সারা শরীর কাঁপছে। মাহির ভয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
রিতুদা এগিয়ে এসে চুলের মুঠিটা ধরল শক্ত করে। বলল, “ভাইয়ের মতো ভালবাসি বলে কিন্তু পার পাবি না! তুই জানিস, আজ সকালে তারক এসে আমার অফিসে বলে গেছে আমি নাকি কিছু করতে পারব না। ওই নাকি ঠিক করবে কে জমি পাবে ওখানে। আমায় সবাই বলছে তুই বেকার, ফালতু। আমি তোর ওপর ভরসা করেছিলাম। রিকোর কেউ এখনও এল না। কেন? কেন এমন হল? মাহির তোকে রাস্তা থেকে তুলেছি, আবার রাস্তায় ফেলে দিতে আমার সময় লাগবে না। ভাইকে নিয়ে কী করবি? নিজে কী করবি? তোর মায়ের কাজ যাতে বন্ধ হয় সেটাও দেখব। বল কী চাস? থানার সামনে দাঁড়িয়ে মাগিবাজি করবি, না কাজ করবি? বল মাহির, বল…”
হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে রইল মাহির, কাচের দরজা দিয়ে কিছু মুখ উঁকি মারছে। কারা যেন কিছু বলছে! কিন্তু কিছু মাথায় ঢুকছে না! ভাইয়ের মুখটা ভাসছে শুধু। মায়ের মুখটা ভাসছে! রিতুদা যদি সত্যি ক্ষতি করে দেয়! কী করবে ও? ঘন হচ্ছে ডিসেম্বরের সন্ধে। আর তার অন্ধকার ধীরে-ধীরে রক্তে মিশে যাচ্ছে মাহিরের। স্যার যে ছেলেটার মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন, সেই ছেলেটা আরও যেন গেঁথে যাচ্ছে মাটির গভীরে! একটা ধূসর গাড়ি চলে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে। সেই অন্য গ্রহ থেকে আসা মেয়েটা হাত নাড়ছে ওকে দেখে! চলে যাচ্ছে? মেয়েটা কি চলে যাচ্ছে! মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা, বশ্যতা মেনে নেওয়া এই ছেলেটার থেকে কি দূরে চলে যাচ্ছে মেয়েটা!
রিতুদা চুলের মুঠি ধরে রেখেছে। টান লাগছে! টান লাগছে খুব! শিকড় উপড়ে যাওয়ার আগে এমন টান আর যন্ত্রণাই কি অনুভব করে গাছ!
.
৩১. নোঈ
এত টানাপোড়েন আর ভাল লাগছে না নোঈর। একটা বাড়ির জন্য এই প্রজেক্টটা আটকে যাবে! এর কোনও মানে হয়! ও বিরক্ত হয়ে বাইরের দিকে তাকাল।
আজ চাঁদ উঠেছে আকাশে। চকচকে কাচের বুদ্বুদের মতো চাঁদ! মনে হচ্ছে কে যেন কলকাতার মাথায় একটা চিনে লণ্ঠন জ্বালিয়ে রেখেছে! সুন্দর লাগছে খুব। কিন্তু তাও কিছু ভাল লাগছে না নোঈর। অফিসে আজ ভাল সময় যায়নি ওর।
দিল্লি থেকে বস এসেছেন আজ। আর সবাই মিলে একটা মিটিং হয়েছে। তাতে পুশকিন আর ওর টিমকে বেশ বকাবকি করা হয়েছে! মনটা একদম ভাল নেই।
“তুমি জানলাটা বন্ধ করে নাও, ঠান্ডা লাগবে!” পুশকিন পাশ থেকে বলল।
গাড়ি হু হু করে ছুটছে বাইপাস দিয়ে। আজ রাত হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ড্রপ দিচ্ছে ওদের। পুশকিন গাড়ি আনেনি আজ। তাই একসঙ্গেই ফিরছে! সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে রয়েছে স্মরণ। গাড়িতে ওঠার পর থেকে এই প্রথম কথা বলল পুশকিন। আসলে সবটাই কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে!
নোঈ তাকাল। পুশকিন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। গাড়ির আবছায়ার ভেতরে পুশকিনের মুখটা কেমন যেন লাগছে। এমন বিষণ্ণ পুশকিনকে ও কোনওদিন দেখেনি।
নোঈ সামনের দিকে তাকাল। স্মরণ রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ও সময় নিল একটু তারপর হাত বাড়িয়ে আলতো করে ধরল পুশকিনের হাত। ছেলে হিসেবে পুশকিনের হাতটা খুব নরম। নোঈ হাতটায় চাপ দিল সামান্য!
পুশকিন তাকিয়ে হাসল অল্প। তারপর আবার বলল, “কাচটা তুলে দাও। নতুন ঠান্ডা পড়েছে। এটা ভাল নয়। সর্দি লেগে যাবে!”
নোঈ পুশকিনের আঙুলের মধ্যে নিজের আঙুলগুলো জড়িয়ে রাখল কিছুক্ষণ। দেখল পুশকিন সাড়া দিচ্ছে না! নোঈ তাকাল পুশকিনের দিকে। আবছায়া হলেও দু’জনে দু’জনের চোখ দেখতে পাচ্ছে!
নোঈ নীরবে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে! পুশকিন সামান্য মাথা নাড়ল শুধু!
“স্যার,” স্মরণ আচমকা পেছনে ফিরল।
নোঈ নিজের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে নিল।
“বলো,” পুশকিন তাকাল স্মরণের দিকে।
“একটা কথা বলব?”
পুশকিন হাসল। আজ সারাদিনে বোধহয় এই প্রথম, ভাবল নোঈ।
স্মরণ প্রায় ঘুরে বসে বলল, “মহিলা এমন ঢ্যাঁটা কেন?”
“কোন মহিলা?” পুশকিন অবাক হল।
“ওই দীপমালাদেবী! দাবিটা কি ওঁর? আমরা যা প্রস্তাব দিচ্ছি সেটা তো ভাল। ওদের জুট মিলের অবস্থা ভাল নয়। ওরা লায়াবিলিটিটা ঝেড়ে ফেলছে না কেন?”
“জুট মিল নিয়ে তো সমস্যা নেই,” পুশকিন বলল, “ওঁর সমস্যা তো বাড়িটা। জোনাক বাড়িটা!”
স্মরণ চশমাটা ঠেলে ওপরে তুলে বলল, “কিন্তু সেটাই বা কেন! দিয়ে দিলে তো ল্যাটা চুকে যায়!”
পুশকিন হাসল, “কেউ-কেউ হয়তো ল্যাটা চোকাতে চায় না! আজ বস তো সবার সামনেই কনফারেন্সরুমে দীপমালাদেবীকে কল করলেন। শুনলে তো কী বললেন উনি।”
“ওই তো, প্রশ্নটা জেনে তার উত্তরটা জানতে হবে। ইজ় দিস আ জোক!” স্মরণ মাথা নেড়ে সোজা হয়ে বসল।
পুশকিন আর কিছু বলল না। আবার বাইরের দিকে তাকাল।
স্মরণ আবার পেছনের দিকে ঘুরল, “স্যার।”
“কী হল?” পুশকিন আবার হাসল সামান্য।
নোঈ অবাক হয়ে যায়! স্মরণটা যেন ক্লাস সিক্সে পড়া একটা ছেলে! সারাক্ষণ ছটফট করছে! সুস্থির হয়ে বসতে পারে না এক মুহূর্তের জন্যও!
“একটা কথা বলব?”
নোঈ বলল, “সোজা হয়ে বোস না। সারাক্ষণ বকবক করে যাচ্ছিস! কী কথা বলতে চাস তুই?”
স্মরণ নোঈর কাছে ধাতানি খেয়ে হাসল। কিন্তু চুপ করল না। উলটে বলল, “আপনস্যার আপনাকে হিংসে করে কেন?”
“এই! কী সব বাজে কথা বলছিস!” নোঈ আবার কড়া গলায় শাসন করার চেষ্টা করল স্মরণকে।
স্মরণ বলল, “স্যার, এখন তো অফিস টাইম নয়। আমি আনঅফিশিয়ালি বলছি। কিন্তু কেন স্যার?”
পুশকিন মাথা নাড়ল, “ওসব কিছু নয়। ও তোমার ভুল ধারণা!”
“স্যার, দেখছিলেন, যখন কনফারেন্স রুমে বস আপনাকে বকছিলেন তখন উনি কী খুশি হচ্ছিলেন! আমাকে তো চাপা গলায় বললেন, এরপর তোমার হবে। নাও, অ্যাকাউন্টস থেকে আরও নাচতে-নাচতে গিয়ে ফিল্ডে নামো!”
“তাই?” পুশকিন হাসল।
স্মরণ বলল, “হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। এমনকী, কনফারেন্স আরম্ভ হওয়ার আগেও তো নোঈকে কী সব বলছিল। কী রে নোঈ, বল!”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারল না। এভাবে কি এসব কথা বলা উচিত?
আসলে বস এলেই অফিসে একটা টেন্সড অবস্থার সৃষ্টি হয়। ওদের নানা রিপোর্ট জমা দেওয়ার থাকে। নোঈরও ছিল। তাই সেটা নিয়ে দুপুর থেকে ব্যস্ত ছিল ও।
আপন আর পুশকিনের চেম্বার আলাদা। নোঈদের বসার জায়গাটা আবার অন্য ঘরে। সেখানে নিজের কিউবিকলে বসে জব রিপোর্টটা শেষবারের মতো দেখছিল নোঈ। তখনই আপন এসে দাঁড়িয়েছিল ওর পেছনে।
“কী করছ দেখি!” আচমকা আপন পেছন থেকে নোঈর ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
“স্যার,” নোঈ একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। চাকা লাগানো চেয়ারটা ঠেলে ও পিছিয়ে গিয়েছিল কিছুটা।
আপন বলেছিল, “এসব করে আর লাভ কী! ইফ ইউ রাইড অন আ সিঙ্কিং শিপ, ইউ আর বাউন্ড টু গো ডাউন উইথ ইট।”
“সরি স্যার, মানে?” নোঈ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আপনের দিকে।
আপন হেসে একটু ছড়িয়ে বসেছিল পাশের একটা খালি চেয়ারে। এই কিউবগুলো তিন দিকে ঘেরা। আপন একটা ফাইল তুলে নিয়েছিল টেবিল থেকে। সেটা উলটে-পালটে দেখেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, “লাইফ কখনও একরকম যায় না! ইটস আ সাইক্ল। একদিন বস আমার কাছ থেকে প্রোজেক্ট নিয়ে দিয়েছিলেন পুশকিনকে। আর আজ দ্য টেব্ল হ্যাজ় টার্নড। আমার কাছে ভেতরের খবর আছে। ওকে যে শোকজ় করা হয়েছিল, সেটার স্যাটিসফ্যাক্টরি রিপোর্ট ও দিতে পারেনি। কোম্পানি ইজ় নট হ্যাপি। হ্যাঁ, ওই বুদাপেস্টের কাজটায় কন্ট্রিবিউট করেছে বটে, কিন্তু সেটা তো সহজ কাজ ছিল। ও পাগলা স্মরণটাকে দিলে সেও করে দিত। আসল ব্যাপার ছিল এই মালিক জুটের কাজটা। আর পুশকিন হ্যাজ় ব্রট আবাউট হিজ় ডুম। আরে, একজন এজেড লেডিকে কনভিন্স করতে পারে না! ঘণ্টা কাজ পারে! আমাকে তো সেভাবে সেই চান্সই দেওয়া হল না! শোনো, আজ বস আমাদের নিয়ে কনফারেন্সে বসবেন। তোমাকেও জিজ্ঞেস করবেন কেন প্রজেক্টটা এত মাস ডিলে হয়ে আছে। কোন পয়েন্টে আটকে আছে? তুমি জাস্ট বলবে, এটা হয়েছে পুশকিনের জন্য। বস পুশকিনকে পছন্দ করেন। তাই এখনও বেঁচে আছে মালটা। কিন্তু বোর্ড অব ডাইরেকটর্স বসকেও ঝাড় দিয়েছেন। ফলে শি ইজ় ইন ডিপ শিট অলসো। তাই এবারের মিটিংটা খুব ইমপর্ট্যান্ট কিন্তু। তুমি বলবে যে, পুশকিন তোমাদের এনাফ কাজ করতে দিচ্ছে না। বলবে, ‘হোমওয়ার্ড বাউন্ড’-এর আইকা বাসুর সঙ্গে ওর শেডি ডিল হয়েছে। সেটা তুমি জেনেছ। আমরা ডিলে করালে ওরা প্রজেক্টটা পেয়ে যাবে। তাতে পুশকিনের পকেট ভারী হবে।”
“কী বলছেন স্যার?” নোঈ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আপনের দিকে।
আপন ওর ছোট কুতকুতে চোখ দুটো বুজিয়ে খিকখিক করে হেসে বলেছিল, “তুমি বাচ্চা মেয়ে। এসব বুঝবে না। বস নিজেকে বাঁচাতে একটা স্কেপগোট খুঁজছে। গিভ হার ওয়ান! ভেতর থেকে খবর পেয়েছি, আমায় এই প্রজেক্টটা দেওয়া হবে এর পর। তুমি আমার হয়ে কাজ করবে। তাই বলছি, নাউ ইজ় দ্য টাইম টু জাম্প শিপস!”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। কী বলছে কী আপন! এমন করতে কী করে বলতে পারে!
আপন এদিক-ওদিক দেখে চেয়ারটা গড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সামনে। তারপর গলা নামিয়ে বলেছিল, “শোনো, পরিস্থিতির সুযোগ নিতে শেখো। আমি জানি তোমার চাকরিটাতে ও হেল্প করেছে। কিন্তু কাজ আর পলিটিক্সে কেউ বন্ধু নেই। সবটাই টেম্পোরারি। নেল হিম। দিস ইজ় দ্য টাইম। না হলে কিন্তু ও সব ব্লেম তোমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে। আগেও এমন হয়েছে। ও সাংঘাতিক ছেলে! এমনকী, এও শোনা যায়, ও নাকি নিজের বউকে খুন করেছিল!”
“কী? কী বলছেন এসব?” নোঈ ঘাবড়ে গিয়েছিল খুব।
আপন বলেছিল, “হ্যাঁ। বাইরে ছিল তখন। আগের রাতেও যে-মেয়েটা সুস্থ থাকে, সে কী করে এক রাতের মধ্যে মারা যায়? শালা, টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছিল ব্যাপারটা। প্লাস ওর এক কাকা আর তার ছেলে মানে ওর খুড়তুতো ভাই আছে— ডাক্তার। তারাও কীসব ম্যানেজ করেছিল শুনেছি। হি ইজ় ইভ্ল। পিয়োর ইভ্ল। ওকে আমি ছোট থেকে চিনি। তুমি কী ভাবো, বস ওকে এমন প্রেফার করে কেন?”
“কেন?” নোঈ কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
আপন টাইয়ের নটটা আলগা করে নাক টেনে হেসেছিল। হালকা গোলাপি শার্টের হাতাটা গুটিয়ে বলেছিল, “বসের সঙ্গে ওর…” বলে চোখ টিপেছিল, “বস যখন এখানে আসে। হি ভিজ়িটস হার! আর… ইউ নো! আমি আর কী বলি!”
নোঈ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ও তাকিয়েছিল অবাক হয়ে। এসব আপন কী বলছে। ওকেই-বা বলছে কেন?
আপন পকেট থেকে একটা চুয়িংগাম বের করেছিল এবার। সময় নিয়ে র্যাপারটা খুলে মুখে দিয়েছিল সেটা। তারপর কোণে রাখা একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে সেই র্যাপারটা ফেলে দিয়ে বলেছিল, “তুমি বাচ্চা মেয়ে, তাই এতদিন বলিনি। কিন্তু তোমার কেরিয়ার ইজ় অ্যাট স্টেক। তাই বলছি। লাইফ হল সি-স-র মতো। একদিকে ডুবলে আর-একদিক ওঠে! তোমার টাইম এখন ওঠার। ডোন্ট ওয়েস্ট ইট। আজ তোমার দিন। সেভ ইয়োরসেলফ। প্লাস এই প্রোজেক্টটা নেক্সট আমার কাছে আসছে। তাই আমার টিমে তুমি থাকতে চাইলে এটা কোরো। আমি এমন কাউকে টিমে রাখব না, যে আমার কথা শোনে না। বুঝেছ?”
আপন চলে যাওয়ার আগে হেসেছিল। বলেছিল, “আমার কথা শোনো। আখেরে লাভ হবে। পুশকিন কিছু দেবে না তোমায়। বুঝেছ?”
বিশ্ববাংলার সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত রাত হলেও ট্র্যাফিক ভালই আছে। ডান দিকে বিশাল হোটেল দুটো রূপকথার রাজপ্রসাদের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা তুলে!
নোঈ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ওর ছোটবেলার কলকাতাটা যেন হারিয়ে গিয়েছে কোথায়! এই কলকাতাকে মাঝে মাঝে চিনতে পারে না নোঈ। একদিকে আকাশে গেঁথে যাওয়া বিশাল বাড়ি। মাফলারের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া ফ্লাইওভার। বিয়েবাড়ির মতো ঝলমলানো শপিং মল। খাবারের দোকান। রেস্তরাঁ। এসি বাস। মোবাইলের সাহায্যে বাড়ির ভেতর ডেকে নেওয়া গাড়ি। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। দামি লিফট আর এসি বসানো স্কুল। আর তার পাশে রাস্তায় স্তূপ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষ। বগবগে কালো ধোঁয়া বমি করতে-করতে যাওয়া টেম্পো। নোংরা দেওয়াল। ধুলোজমা পুরনো বাড়ি। বারান্দায় বসে থাকা মোটা চশমা আর খাটো পাজামা পরা জং ধরা মানুষ। জায়গায় জায়গায় পুঁজের মতো জমে থাকা অটোর লাইন। নোঈ মাঝে মাঝে বোঝে না আসল কলকাতা কোনটা! এই চকমেলানো শহরটা নাকি ওই ফুটপাথের ময়লা ন্যাংটো বাচ্চা ঘোরা শহরটা!
“কী রে, মাঝে মাঝে কী হয় তোর?” স্মরণ সামনে থেকে জিজ্ঞেস করল।
নোঈ হাসল সামনে তাকিয়ে, “কিছু না। এই ভাবছিলাম!”
“কী ভাবছিলি?” স্মরণ আরও ভাল করে ঘুরে বসার চেষ্টা করল আবার, কিন্তু সিট বেল্টের জন্য পারল না ঠিকমতো।
“এই যে, তোকে প্যাঁও স্ট্যান্ড করে কী করে?”
“মানে?” স্মরণ গম্ভীর হয়ে গেল, “আরে, প্যাঁও আমার মতো ডিভোটেড লাভার পাবে না কোথাও। জানিস, প্যাঁও যখন টিউশনে যেত আমি ওর জন্য গাছের তলায় সাড়ে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার মোবাইল ছিল না তো! সবাই হাসত আমায় দেখে। কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না। সাড়ে চার ঘণ্টা। তারপর ও পরীক্ষা দিয়ে বেরোলে আমি ফ্রুট জুস নিয়ে রেডি থাকতাম। চাইনিজ় খেতে ভালবাসত। আমি টিউশন করতাম তো, সেই টাকা জমিয়ে ওকে চাইনিজ় খাওয়াতাম। ওই যে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের একটা রেস্তরাঁ আছে না! সেই সিঁড়ি উঠে গেছে সোজা। সেইটায়। মেঘমল্লার থেকে অটো ধরত প্যাঁও। ওর সঙ্গে অটোর লাইনে দাঁড়াতাম আমি। নোট জ়েরক্স করে দিতাম। এমনকী, একবার ওর জুতো ছিঁড়ে গেল। আমি স্যারের বাড়ি থেকে খবরের কাগজ নিয়ে সেটা প্যাক করে রাসবিহারী মোড়ের মুচির কাছ থেকে সেটাও সারিয়ে এনেছিলাম। নানা লোকে আওয়াজ দিয়েছিল। স্যারও আওয়াজ দিয়েছিলেন খুব। কিন্তু প্যাঁওয়ের জন্য সব করতে পারি আমি।”
পুশকিন সব শুনে বলল, “তুমি ওর আয়ামাসি না প্রেমিক, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
স্মরণ একটা কথাতেই এমন ভোঁতা হয়ে গেল যে, নোঈ খিলখিল করে হেসে উঠল। আর ঠিক তখনই স্মরণের পকেটের ফোনটা বেজে উঠল শব্দ করে।
স্মরণ, পুশকিনের কথার ধাক্কা সামলে উঠে ফোনটা ধরতে সময় নিল একটু।
পুশকিন তাকাল নোঈর দিকে। তারপর চাপা গলায় বলল, “দ্যাটস মোর লাইক আ গুড গার্ল! ইউ শুড স্মাইল মোর। আজ অফিসে যা হল ভুলে যাও। এসব হয়। আমরা ঠিক ক্র্যাক করব কাজটা। ডোন্ট ওয়ারি!”
“স্যার,” ফোনটা রেখে স্মরণ সামলে ঘুরল আবার, “ওই মাহির ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করছিল কী হল কাজের। মানে, রিতুদা জিজ্ঞেস করছে। আমি বলেছি কাল বলব।”
মাহির! নোঈ অবাক হল। ছেলেটা অদ্ভুত বেশ। সেদিন আচমকা ওকে স্মরণদের বাড়িতে দেখে তো ঘাবড়েই গিয়েছিল!
ছেলেটা খুব লম্বা। ভাল চেহারা! একটা জিন্স আর টি-শার্ট পরা। পায়ে সাধারণ একটা চটি!
স্মরণ চশমাটা ঠিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কাকে চাইছেন?”
ছেলেটা নরম গলাতেই বলেছিল, “আপনাদেরই চাইছি।”
“আমাদের? মানে?” স্মরণ যে অবাক হয়েছে খুব, সেটা ওর গলার স্বরেই বুঝতে পেরেছিল নোঈ।
ছেলেটা বলেছিল, “বলতে পারেন আমি আপনাদের কাছে একজনের হয়ে এসেছি। সোনাঝুরির কাজের ব্যাপারে এসেছি!”
“সোনাঝুরি?” নোঈ এবার উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল স্মরণের পাশে!
ছেলেটা বলেছিল, “হ্যাঁ। দরকারি কাজ। একটু যদি শোনেন আপনাদের ক্ষতি হবে না।”
নোঈ অবাক হয়েছিল, “কে আপনি?”
ছেলেটা সময় নিয়েছিল একটু। তারপর নরম স্বরে বলেছিল, “আমি রিতুদার কাছ থেকে আসছি! আমার নাম মাহির।”
স্মরণ দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল, “আসুন।”
ছেলেটা সময় নিয়ে পায়ের জুতোটা খুলে বারান্দার একপাশে সরিয়ে রেখেছিল। তারপর ঢুকে এসেছিল ঘরে।
“বসুন,” স্মরণ হাত দিয়ে একটা গদির দিকে দেখিয়েছিল।
মাহির যে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে আসছে, ওর জামাকাপড় আর মুখচোখের ভাব দেখেই বুঝতে পেরেছিল নোঈ। বয়সও বেশি নয়। ওর কৌতূহল হয়েছিল, কী বলতে চায় ছেলেটা?
মাহির চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখেছিল একটু। তারপর হেসে বলেছিল, “আমার বয়স দেখে আপনারা হয়তো আমার কথা সিরিয়াসলি নেবেন না, কিন্তু আমি রিতুদার কাছ থেকে আসছি। রিতুদা কে চেনেন তো? এমপি মানে…”
নোঈ বলেছিল, “হ্যাঁ, নাম জানি। বলুন।”
মাহির বলেছিল, “আমি আপনাদের বেশি সময় নেব না। ছোট করে একটা কথা জানাতে চাই। আমরা জানি যে, সোনাঝুরির কাজটা নিয়ে তারক চক্রবর্তী আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু চাইছে। লোকটা খুবই বাজে আর বদ। আমাদের পার্টির নাম ও খারাপ করছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়ন। সেখানে আমরা কোনও কম্প্রোমাইজ় করব না। রিতুদা আপনাদের কোম্পানির কথা জানেন। খুব বড় আপনাদের কোম্পানি। তাই আপনাদের সাহায্য করতে চান। আমি জানি, আপনারা দু’জন কাজটা ফলো করছেন। তাই আপনাদের বললাম। এই রিতুদার কার্ড। আপনাদের বসকে বলবেন রিতুদা কথা বলতে চেয়েছেন। রিতুদার কিন্তু কোনও স্বার্থ নেই। আমাদের রাজ্যের ভাল করতে চান রিতুদা। তারকের মতো লোকদের জন্য আমাদের রাজ্যের মানুষের কোনও ক্ষতি রিতুদা হতে দেবেন না!”
ছেলেটা একটা কার্ড এগিয়ে দিয়েছিল। নোঈ কার্ডটা নিয়ে দেখেছিল ভাল করে। ছেলেটা সত্যি কথাই যে বলছে বুঝেছিল!
রিতেশ আইচ। ছোট করে রিতুদা। নোঈ কেন, লোকটার নাম সবাই জানে। কেউ মুখে না বললেও এটা ঘটনা যে, রিতুদা আগে পাতি গুন্ডা ছিল। সেই হিসেবেই তার নাম আর পরিচিতি। পরে পার্টির টিকিটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে। মনা পান্ডে বলে আর-একজন নেতা কাম মস্তানের সঙ্গে তার খুব ঝামেলা। মাঝে মাঝে পেপারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর পাওয়া যায়। এখন সেই লোকের সঙ্গে কথা বলতে হবে! এসব দালাল টাইপের লোকজন কেন ঢুকে পড়ে মাঝখানে! মাথা যখন গলিয়েছে তখন কিছু তো একটা দাবি আছেই। কিন্তু নোঈ বুঝেছিল এই ছেলেটি দূতমাত্র। একে এটুকুই বলা হয়েছিল।
স্মরণ সব শুনে চুপ করে ছিল একটু। তারপর বলেছিল, “আমরা জুনিয়র। অফিসে গিয়ে বলব আপনার কথা। আমাদের হাতে তো কিছু নেই!”
মাহির উঠে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটার হাইট ভাল। শরীরটাও পেটানো। নোঈর মনে হয়েছিল ব্যায়াম-ট্যায়াম করে নিশ্চয় ছেলেটা। স্পোর্টসম্যান টাইপ।
মাহির বলেছিল, “আপনারা সিরিয়াসলি কথাটা ভাবুন। অফিসে গিয়ে বলুন। রিতুদা কিন্তু সিরিয়াস এই ব্যাপারে! আমি তা হলে রিতুদাকে বলছি যে, আপনারা যোগাযোগ করছেন। কেমন! আপনাদেরই কিন্তু লাভ। মনে রাখবেন! আসছি।”
পুশকিন নাক টানল। জ্যাকেটের চেনটা গলা অবধি টেনে দিয়ে বলল, “আবার কেন ফোন করছে! আমি তো গিয়েছিলাম রিতুদার সঙ্গে কথা বলতে। বলেছি, সময়মতো নিশ্চয় জানাব। এরা কেউ একটা কথা বুঝতে পারছে না যে, আমার হাতে কিছু নেই। বসও বুঝতে পারছেন না, পলিটিক্যাল পার্টির লোকজনও বুঝতে পারছে না। আরে, দীপমালাদেবী যদি এমন জেদ ধরে বসে থাকেন যে, বাড়ি বিক্রি করবেন না, তা হলে আমি কী করতে পারি!”
নোঈ বলল, “আমি তো শুনলাম ‘মুছাল গ্রুপ’ নামে একটা কোম্পানি নাকি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে। পেপারে পড়ছিলাম। তারা আবার জোনাক-বাড়ি ছাড়াই কিনবে বলছে সব কিছু। আপনি কিছু জানেন?”
পুশকিন মাথা নাড়ল, “আমি শুনেছি, কিন্তু শিয়োর নই। আসলে আমাদের যে-ভিশনটা আছে ওই জায়গা নিয়ে, সেটা কিন্তু ইউনিক। আমাদের কোম্পানির প্রেস্টিজ বাড়ত এতে। কাউকে আপরুট না করে সব কিছু ঠিক করে সেখানে আবার নতুন করে সিটি বিল্ডিং ইজ় আ বিগ জব। জোনাক-বাড়ি তো প্রায় দশ বছর হল ডেজ়ার্টেড। তাও কেন যে ওই মহিলা সেটা ছাড়তে চাইছেন না! এটা আমার কাছে একটা মিস্ট্রি কিন্তু!”
স্মরণ যেন কিছু বলতে গিয়েও আচমকা চুপ করে গেল বলে মনে হল নোঈর। কী ব্যাপার! এমন হল কেন! সেদিন স্মরণদের বাড়িতেও এমন হয়েছিল না!
নোঈর মনে পড়ল ব্যাপারটা।
মাহির চলে যাওয়ার পরে কাকিমা খাবার নিয়ে এসেছিলেন। সাদা ফোলা লুচি, লাল-কমলা আলুর দম। আর নারকেল ছাঁচের মিষ্টি।
লুচি থেকে দারুণ ঘিয়ের গন্ধ বেরোচ্ছিল। নোঈ খুব সাবধানে খায়। কিন্তু সেদিন ভাবছিল আজ আর অত ভাববে না।
কাকিমা ছ’টা করে লুচি দিয়েছিলেন। সেটাই শুধু কমিয়েছিল নোঈ।
কাকিমা ওর পাশে বসে থুতনি ধরে বলেছিলেন, “খুব মেপে যে খাও বোঝা যাচ্ছে। এমন সুন্দর স্কিন আমি দেখিনি কোনওদিন।”
লজ্জা পেয়ে নোঈ মুখ নামিয়ে নিয়েছিল।
কাকিমা আবার বলেছিলেন, “স্মরণটা পাগল, জানো তো! বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ লেখে আর পড়ে। আমার সঙ্গে কথাই বলে না! তোমরা নাকি সোনাঝুরিতে কাজ করবে? তাই?”
নোঈ বলেছিল, “হ্যাঁ। ওই একটা জুট মিল…”
“আর জোনাক-বাড়ি?” কাকিমা কেমন অদ্ভুত মুখে বলে উঠেছিল, “বিয়ের পর ওর বাবার সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম সোনাঝুরিতে। জোনাক-বাড়িও দেখি। আসলে…”
“মা কী বলছ! আলুর দমে আলুর ভেতরে মশলা ঢোকেনি। বলেছি না আলুটা রান্নার আগে কয়েকটা ফুটো করে দেবে।”
নোঈ বলেছিল, “কোথায়! ঠিকই তো আছে! তা কাকিমা, আপনি কী বলছিলেন?”
কাকিমা আবার শুরু করেছিল, “আসলে ওর বাবা তো…”
“বাবা বোটানিস্ট ছিলেন,” স্মরণ আবার ওর মাকে বাধা দিয়ে বলেছিল, “বাবা-মা’র লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। মায়ের বাড়িতে বাবাকে মেনে নেয়নি। মা সবাইকে এই গল্প শোনায়। প্রেম করার চেয়েও প্রেমের গল্প শোনানোতে কিন্তু অনেক বেশি স্যাটিসফ্যাকশন আছে। তাই না?”
সেদিন বেশ অনেকক্ষণ ওদের বাড়িতে ছিল নোঈ। দেখেছিল, মাকে আর ওই বিষয় নিয়ে কিছু বলতেই দেয়নি স্মরণ।
গাড়িটা গড়িয়াহাট টপকাল। ঘড়ি দেখল নোঈ। প্রায় দশটা বাজে। আজ দেরি হয়ে গেছে খুব। বাড়িতে অবশ্য ফোন করে দিয়েছিল! কিন্তু এত দেরি হবে ভাবতে পারেনি ও। বস এত সময় নিয়ে নিয়েছিলেন!
বস খুব রাগী আর স্পষ্ট কথার মানুষ। আপন যেমন বলেছিল, তেমন কিন্তু কোনও কিছু হয়নি। বস ইন্ডিভিজ়ুয়ালি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। শুধু মূল ব্যাপারটা শুনে নিজেই ওই রুম থেকে ফোনের স্পিকার অন করে কল করেছিলেন দীপমালাদেবীকে।
কিন্তু ভদ্রমহিলা খুব ঠান্ডা গলায় বসকেও একই কথা বলে দিয়েছেন, “আমি আপাতত এই বাড়ি বিক্রি করব না। আমার ছেলে না বুঝে প্রথমে এটা ডিলে রেখেছিল। আমি জানি আপনারা সেইভাবেই ডসিয়ার আর প্রেজ়েন্টেশন তৈরি করেছেন। কিন্তু সরি। আমি একটা উত্তর খুঁজছি। সেটা না পাওয়া অবধি আমি অপারগ।”
ওদের কনফারেন্স রুমটা বেশ বড়। দীপমালাদেবীর গলাটা নরম শোনালেও তার দৃঢ়তা নিয়ে কারও মনেই কোনও সংশয় ছিল না।
বস বলেছিলেন, “আমাদের ব্যাপারটা একবার ভাবুন। আমাদের প্রজেক্টে সামাজিক উপকারও হবে। সোনাঝুরি উইল বি ইমেন্সলি বেনিফিটেড।”
দীপমালাদেবী যেন হেসেছিলেন সামান্য। তারপর বলেছিলেন, “আপনাদের পুশকিন ছেলেটা খুব পুশ করছে ব্যাপারটা নিয়ে। আমায় অনেকবার কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে! কিন্তু আমি ওকে যা বলার বলেছি। আর সোনাঝুরি! সোনাঝুরি মরল কী বাঁচল আই ডোন্ট কেয়ার!”
পুশকিন যে কাজটা নিয়ে খুব খাটছে, সেটা দীপমালাদেবীর কথাতেই বস বুঝে গিয়েছিলেন। নোঈ আড়চোখে তাকিয়েছিল আপনের দিকে। দেখেছিল, প্ল্যান আর আশা সবেতেই ছাই পড়ছে দেখে কেমন যেন চোয়াল ঝুলে গিয়েছিল লোকটার।
বস ফোনটা শেষ করে চুপ করে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ওদের বসতে বলে চলে গেছিলেন নিজের চেম্বারে।
সবাই এই ঘরে চুপচাপ বসেছিল। নোঈ বুঝতে পারছিল যে, টেনশনের একটা চোরাস্রোত বইছে। এখানে কোনও কথা বলা ঠিক হবে না।
স্মরণ জলের বোতল থেকে জল খেয়ে হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করার চেষ্টা করেছিল।
পুশকিন এর ভেতরেও হালকা গলায় বলেছিল, “ছেড়ে দাও, ও ঠিক হবে না!”
বস ফিরে এসেছিলেন দশ মিনিট পরে। তারপর পুশকিনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “লাস্টলি আর-একবার ট্রাই করি! আমি বোর্ড থেকে আরও দু’-আড়াই মাস টাইম নিয়ে এসেছি। তার মধ্যে কি তুমি ব্যাপারটা করতে পারবে?”
“আমি পারব ম্যাম,” আপন এবার নিজের নাকটা গলিয়ে দিয়েছিল।
“তোমায় জিজ্ঞেস করেছি? নিজের কাজটা কি পারো? ফলতার কাজটাও তো ড্র্যাগ করতে শুরু করেছে। সো স্টে আউট অফ ইট!”
“আমি পারব ম্যাম,” পুশকিন সোজা তাকিয়েছিল বসের দিকে।
সামনে খোলা ট্যাবের ওপর আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে বস বলেছিলেন, “ইউ বেটার ডু সামথিং। সামনে তোমাকে আর-একটা প্রজেক্টে আমরা ডিপ্লয় করব। বাট এটা আপাতত টপ প্রায়োরিটি। ইউজ় এভরি মেথড। লিভ নো স্টোন আনটার্নড। তুমি জানো হোয়াট মে কাম হ্যান্ডি!”
স্মরণ নেমে গিয়েছে রাসবিহারীতে। কী একটা নাকি কাজ আছে! কী কাজ আর নোঈ জিজ্ঞেস করেনি। করলেই হয়তো বলবে প্যাঁওয়ের জন্য কিছু কিনতে হবে!
বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। নোঈর খারাপ লাগছে। ও পুশকিনকে বলেছিল যে, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে পুশকিন আগে নেমে যাক। গাড়ি তো আছে, ও চলে যেতে পারবে। কিন্তু পুশকিন শোনেনি ওর কথা। তবে বাকি পথটা কথাও বলেনি তেমন। এমনকী, একবারও নোঈর হাতটাও ধরার চেষ্টা করেনি। গাড়ি তো ফাঁকা, তা হলে কেন!
নোঈর খারাপ লাগছে। পুশকিন কেন এমন দূরে-দূরে থাকছে! তা হলে কেন সেদিন চুমু খেয়েছিল! সেটা কি তা হলে একটা ফ্লিটিং ফিলিং! একটা ইমপাল্স! ছেলেরা কি এমনই হয়? এমন স্বার্থপর, শরীরসর্বস্ব? পুশকিনের ইচ্ছে করছিল বলেই কি কাছে এসেছিল? এতে নোঈর যে খারাপ লাগতে পারে, সেটা কি একবারও ভাবেনি?
আচমকা মনের মধ্যে কেমন একটা অভিমান জন্মাচ্ছে নোঈর। মনে হচ্ছে, ও তো বারবার কাছে যাচ্ছে। কেয়ার দেখাচ্ছে। পুশকিন কেন এমন দূরে ভেসে ভেসে আছে!
নোঈ সারাটা পথ আর কথাই বলেনি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। একবার মনে পড়েছিল আপনের কথাগুলো। ও জানে আপন জেলাস। তাই এসব নোংরামো করেছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য এখন মনে হল, এসব যদি সত্যি হয়!
গাড়ি থেকে নেমে আর পিছন দিকে না তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল নোঈ।
“কী হল?” ডাকল পুশকিন।
নোঈ মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
পুশকিন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে নোঈর জ্যাকেটটা ঠিক করে দিয়ে চাপা গলায় বলল, “গাড়িতে ড্রাইভার আছে। অমন রাগ করে না।”
“গাড়িতে আছে, সব জায়গায় থাকে না কিন্তু!” নোঈ বলতে চায়নি, কথাটা কেমন যেন বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে।
“আই লাইক ইউ সো মাচ, গার্ল। ইউ আর সো প্রিটি! আর এত ভাল তুমি! ইট ইজ় হার্ড টু রেজ়িস্ট। কিন্তু তুমি আমার চেয়ে বেশ কিছুটা ছোট। অ্যান্ড আই হ্যাভ আ পাস্ট নোঈ। তোমায় কী যে বলি! আমি… ”
আলতো কুয়াশা পড়ছে শহরে। ফিনফিনে একটা ওড়না কে যেন আস্তে-আস্তে নামিয়ে আনছে কলকাতার মাথায়। চারিদিক যেন পুরনো বাংলা ছবির মতো সাদা-কালো হয়ে আছে। নোঈ তাকাল পুশকিনের দিকে। আলোছায়ায় কেমন যেন রহস্যময় লাগছে ওকে। ছোট্ট ঠোঁট। টিকালো নাক। হাসলে সামান্য টোল পড়ে এমন গাল। নোঈর মনে হল ও আলাদা থাকতে পারছে না যেন।
নিজেকে অনেক কষ্টে আটকাল ও। তারপর ফিসফিস করে বলল, “সবার একটা পাস্ট থাকে। আয়্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন দ্যাট! শুনুন, এই প্রজেক্টের পরে যেখানে যাবেন, আমায় নিয়ে যাবেন। আমি একা থাকব না কলকাতায়!”
পুশকিন হাসল।
নোঈ আবার বলল, “আর-একটা কথা। আমার বাড়ির সামনে এটা। এখানে এই আফটার শেভটা মেখে আমার এত কাছে আসবেন না। বুঝলেন? আমি আসি।”
আর অপেক্ষা না করে, নোঈ প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেল ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে। কিন্তু মনে মনে যেন দেখতে পেল, আলতো কুয়াশার মধ্যে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুশকিন। আলো-ছায়ায় ওর কিছুটা দেখা যাচ্ছে। কিছুটা দেখা যাচ্ছে না!
বাড়িতে ঢুকে ব্যাগটা নিজের ঘরের বিছানায় ছুড়ে রাখল নোঈ। তারপর বাথরুমে ঢুকে গিজারের সুইচটা অন করে দিল। রাত হলেও, স্নান না করলে আজ অসুবিধে হবে ওর।
ও দেখল ওকে দরজা খুলে দিয়ে বাবা আজ বসার ঘরেই বসল। আশ্চর্য হল নোঈ। বাবা এখানে কেন? নিজের ঘরে থাকে তো এমন সময়! খুব একটা বেরোয় না।
“নোঈ, শোন,” মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডাকল এবার।
নোঈ ভেবেছিল মুখটা একটু ধুয়ে তারপর স্নান করতে যাবে। কিন্তু মা এমন করে ডাকল যে, ও থমকে গেল। মায়ের গলার ভেতরে আজ কিছু একটা আছে। অশান্তির গন্ধ পাচ্ছে ও! সারা দিন পরে নোঈর আর ভাল লাগছে না এসব। আজ আবার কী শুরু করবে মা!
“বলো,” মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল নোঈ।
“তুই শেষপর্যন্ত ওই দোজবরের সঙ্গে ঘুরছিস!”
“কী? মানে?” নোঈ তাকাল অবাক হয়ে। কী বলছে মা!
“ওই পুশকিন। ওর বউ তো মারা গিয়েছে। জানিস না? তোর চেয়ে কত বড়! তার সঙ্গে তুই… এত রাত করে তোকে বাড়ি ছাড়তে আসছে। মাথায় মাথা ঠেকিয়ে কী এত গুজগুজ করছিলি, হ্যাঁ? আমাদের এই পাড়ায় থাকতে দিবি না? মানসম্মান কিছুই কি রাখবি না?”
“কী বলছ!”
মা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সেই জন্য তোকে চাকরি দিয়েছে! কচি মেয়েদের মাথা খেতে ভাল লাগে! আর তুই! তুইও তার সঙ্গে হোটেল-রেস্তরাঁ করে বেড়াচ্ছিস!”
“মানে? আরে, যা খুশি তাই বলে যাচ্ছ!” কী বলবে বুঝতে পারল না নোঈ।
“কেন কিছুদিন আগে তুই ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসের ওখানে ওর সঙ্গে একটা রেস্তরাঁয় যাসনি? বিকেলে? তুই কি ভাবিস কলকাতায় সবাই অন্ধ? কেউ কিছু দেখে না?”
নোঈ দেখল বাবা চুপ করে বসে আছে। মায়ের রাগ যেন বাড়ছে আরও।
মা বলল, “তোর দিদি সম্বন্ধ পাঠিয়েছে বিদেশ থেকে। এবার তোকে বিয়ে দিয়ে দেবই। অনেক হয়েছে চাকরি। আর করতে হবে না কাজ। কাজের নাম করে কী হচ্ছে যেন বুঝতে পারছি না!”
“কে বলেছে তোমায় এসব?” নোঈ চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল।
“যে বলেছে, সে দেখেই বলেছে। কাক চোখ বন্ধ করে গু খেয়ে ভাবে কেউ দেখছে না। কিন্তু সবাই দেখে। তোকেও দেখেছে। ছিঃ, তুই এভাবে আমাদের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছিস! শেষে একটা আধবুড়ো…”
নোঈর সারা গা-হাত-পা কাঁপছে রাগে। বিকেল। রেস্তরাঁ। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনস। ওকে কে দেখেছে ও জানে। ভিড়-রাস্তার অন্য ফুটে কিছুটা দূরে ছিল নোঈ। কিন্তু তাও ওর চোখ এড়ায়নি। মা বলে যাচ্ছে এখনও, কিন্তু ওর আর কিছু মাথায় ঢুকছে না। কান লাল হয়ে গিয়েছে নোঈর। বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে! আর ওর চোখের সামনে ভাসছে সেই বিকেলটা। ভাসছে, রাস্তা টপকে একটু দূরে একটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আইকা।
.
৩২. পুশকিন
সেদিন মেঘ ছিল আকাশে। গাছের ছায়া আরও একটু বেশি ছায়াময় ছিল যেন। উলটো ফুটের বিশাল বড় বিল্ডিংটাকে রাক্ষস মনে হচ্ছিল পুশকিনের। মনে হচ্ছিল একটু পরেই এটা সামনে ছড়ানো মানুষগুলোকে আবার গিলে নেবে! হাতে ধরা স্যান্ডউইচের প্লেটের দিকে তাকিয়ে পুশকিনের নিজেকেও তেমনই একটা খাবার মনে হয়েছিল।
আর ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা ভেসে এসেছিল গাছের অন্যদিক থেকে। কে কাঁদছে এভাবে? পুশকিন ডান দিকে তাকিয়েছিল। রাস্তার এই দিকটায় সারি-সারি পাম গাছ। তার মাঝে কয়েকটা সবুজ রঙের বেঞ্চ পাতা ছিল। পুশকিন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে পাশের বেঞ্চটা গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। কান্নার আওয়াজ শুনে পুশকিন দু’পা পিছিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়েছিল। আর প্রথম দেখেছিল ওকে। স্মিতাকে।
হাতে একটা স্কার্ফ। তাতে মুখ গুঁজে কাঁদছে স্মিতা। পিঠ ফুলে-ফুলে উঠছিল ওর। পাশের বেঞ্চে রাখা খাবারের প্লেটটা পড়ে ছিল অবহেলায়। কী করা উচিত এখন? পুশকিন তাকিয়েছিল। তাকিয়েই ছিল। স্মিতা মুখ তুলেছিল কিছু সময় পরে। আর থমকে গিয়েছিল পুশকিন। এ মেয়ে এমন করে কাঁদছে! ওর মনে হয়েছিল মাখন থেকে ছুরি দিয়ে কেটে মেয়েটার মুখ বের করে এনেছেন ভগবান! পুশকিন হাঁ করে তাকিয়েছিল স্মিতার দিকে। এমন খাড়া আপ-টার্ন নাক! এমন বড়-বড় চোখ! চোখের পাতা! এমন গায়ের রং! এমন মেয়েরা কাঁদলে তো পৃথিবীতে ন্যায়বিচার বলে আর কিছু থাকবে না!
পুশকিন কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু কিছু একটা করতে ওর ইচ্ছে করছিল খুব। এভাবে কারও দিকে অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকতে নেই ও জানে। কিন্তু তাও নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারছিল না। তাকিয়েই ছিল স্মিতার দিকে। এই ক’দিন আসছে এই অফিসে, কিন্তু এই মেয়েটাকে তো আগে দেখেনি! রাক্ষস কোন কুঠুরিতে আটকে রেখেছিল একে!
স্মিতা এবার ঘুরে তাকিয়েছিল ওর দিকে। মেয়েটার ঠোঁটের ওপর একটা তিল আছে। পুশকিনের মনে হয়েছিল মাটির মধ্যে যেন আরও কয়েক ফুট গেঁথে গেল ও!
স্মিতা কিছু না বলে তাকিয়েছিল সোজা। মেঘ ছিঁড়ে একটা রোদের স্তম্ভ যেন নেমে এসেছিল স্মিতার দিকে। স্পটলাইট! পুশকিন বুঝতে পারছিল, ওর জীবনটা আজকে, এই দিন থেকে পালটে গেল একদম।
স্মিতা কিছু জিজ্ঞেস করার মতো অবস্থায় ছিল না। শুধু কষ্টে নুইয়ে আসা চোখ নিয়ে ও তাকিয়েই ছিল। সব পুরুষের বুকের ভেতরে ছোটবেলা থেকে যে-ছদ্মবেশী রাজপুত্রটা বসে থাকে, যে কোনও একদিন কাল্পনিক দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচাতে চায় রাজকুমারীকে, সেই রাজপুত্রটা বেরিয়ে এসেছিল পুশকিনের বুকের ভেতর থেকে। তবে কোমর থেকে তরোয়াল বের করে নিয়ে নয়, বাঁ হাতে ধরা ছোট জলের বোতলটা বাড়িয়ে স্মিতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল পুশকিন।
স্মিতা সময় নিয়েছিল সামান্য। তারপর হাত বাড়িয়ে নিয়েছিল জলের বোতলটা। কোনও কথা বলতে পারছিল না পুশকিন। ও শুধু তাকিয়ে ছিল। স্মিতা সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে জল দিয়েছিল চোখে-মুখে। তারপর ফিরিয়ে দিয়েছিল বোতলটা। পুশকিন যন্ত্রচালিতের মতো বোতলটা ফেরত নিয়েছিল। তারপর অন্য হাতের স্যান্ডউইচটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
স্মিতা তাকিয়ে ছিল সামান্য সময়। চোখে বিস্ময়। কিন্তু তারপর পুশকিনকে চমকে দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়েছিল স্যান্ডউইচটাও। পুশকিন আর কিছু না বলে পায়ে-পায়ে গিয়ে বসে পড়েছিল পাশে।
সেই শুরু। তারপর তিনবছর স্মিতার সঙ্গে ঘুরেছিল ও। স্মিতা সমস্ত কথা বলত পুশকিনকে। ওর বাবার ছোটবেলায় মারা যাওয়ার কথা। তার কাকাকে মায়ের বিয়ে করার কথা। স্কুলের কথা। প্রথম প্রেমের কথা। বলেছিল ওর সমস্ত কান্নার কথাও। পরে একদিন, বেঞ্চে বসে সেই কান্নার কথাটা বলতে গিয়ে স্মিতা বলেছিল, “তমাল আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছ’বছরের রিলেশন ছিল আমাদের। সেখানে আমায় ছেড়ে ও অন্য একজনকে বিয়ে করে নিল! বাবা মারা যাওয়ার পরে, আমার মা আমার কাকাকে বিয়ে করেছে শুনে, ওদের বাড়ির লোকজন ওকে সরে আসতে বলেছিল আমার কাছ থেকে। ওর মা আর বাবা খুব অশান্তি করেছে সেই ব্যাপারে। তাই তমাল আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। একবারও আমার কথা ভাবেনি। আমি যে ওকে ছাড়া থাকতে পারব না, তাও মনে রাখেনি। যেসব কথা দিয়েছিল, প্রমিস করেছিল সব ভুলে গিয়েছিল নিমেষে।”
এইসব কথা প্রায়ই বলত স্মিতা। পুশকিনের কষ্ট হত খুব। মনে হত, কে যেন বুকের মধ্যে বসে মাটি কোপাচ্ছে! কিন্তু তাও ও শুনত। স্মিতা যে ওর কাছে আসছে, ওর পাশে বসছে, ওকে ব্যক্তিগত কথা বলছে সেসব ভেবেই নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু সত্যি কি আর খুশি হত? হত না। বরং ক্রমে বুকের মধ্যে বিষ জমছিল ওর। মনে হচ্ছিল রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়া এই বিষ ওকে পাগল করে দেবে!
তাই একদিন ও ঠিক করে নিয়েছিল, আর নয়। আর স্মিতার কাছ থেকে তমালের কথা শুনবে না। বরং স্মিতার সঙ্গে আর কথাই বলবে না। সামনে থেকেও যে-মেয়েটা ওর হবে না কোনওদিন, তার ওপর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ! মানুষ নিজেকে যদি সুখ দিতে না-ও পারে, নিজেকে কষ্ট দেওয়ারও কোনও মানে হয় না।
স্মিতা চাকরি করত ওই বিল্ডিং-এরই অন্য একটা সফ্টওয়্যার ফার্মে। টিফিনে দেখা করত ওরা। আর ছুটির পরে একসঙ্গে ফিরত।
এই সিদ্ধান্তের পরের দিন আর টিফিনে পুশকিন গেল না বাইরে। ছুটির পরও ফিরল না একসঙ্গে। একদিনটা তারপর দু’দিন হল। দু’দিনটা চারদিন। আর চারদিন ঘুরে গেল এক সপ্তাহে। পুশকিন আর সামনেই যেত না স্মিতার।
তারপর একদিন কলকাতায় বৃষ্টি হল খুব। সবকিছু ডুবে গেল চারিদিকে। শুধু দ্বীপের মতো জেগে রইল অফিসের কাছের একটা বাসস্টপ আর ফুটপাথ।
তারই একটায় দাঁড়িয়ে সেদিন পুশকিন চেষ্টা করছিল কী করে বাড়ি ফেরা যায়। সন্ধে হয়ে এসেছিল প্রায়। অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল! আকাশে কাকের পালকের মতো রঙের মেঘ এসে জমছিল ক্রমে। সারা দিনের কাজের পর পুশকিনের আর কিছু ভাল লাগছিল না। স্মিতার কাছ থেকে সরে এলেও মনে মনে যে সরে আসতে পারেনি, সেটা বুঝতে পারছিল প্রতিমুহূর্তে। শূন্যতাও যে এমন ধারালো হয়, সেটা ভাবতে পারেনি কোনওদিন। সারাক্ষণ কেমন একটা অনিচ্ছে আর বিষাদ যেন মুড়ে ছিল ওকে। দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘুরতে-ঘুরতে সেদিন ওই ছোট্ট দ্বীপের মতো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে, ওরকম ঝিমধরা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কেমন অপ্রয়োজনীয় আর ফালতু মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, পুতুলের দম এবার ফুরিয়ে এল প্রায়! আর চলতে পারবে না। আর তখনই জল কেটে একটা হলুদ ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে।
কোমর অবধি জল ছিটকে এসেছিল পুশকিনের। খুব বিরক্ত হয়েছিল ও। ভেবেছিল কিছু বলবে। কিন্তু তার আগেই পেছনের দরজার কাচটা নামিয়ে বেরিয়ে এসেছিল একটা মুখ। স্মিতা! বলেছিল, “আর বাহাদুরি না দেখিয়ে উঠে এসো গাড়িতে।”
পুশকিন দ্বিধা নিয়ে তাকিয়েছিল। কেন কে জানে, আচমকা এক আকাশ মেঘের মতো অভিমান এসে ভিড় করেছিল ওর মনে।
“কী হল, এসো!” স্মিতা এবার ধমক দিয়েছিল। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন তাকাচ্ছিল ওদের দিকে। অফিসের দু’-চারটে পরিচিত মুখও ছিল সেই বাসস্টপে। তারাও তাকাচ্ছিল। তবে সেই সব লোকজন বেশি দেখছিল স্মিতাকেই। মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল পুশকিনের। হিংসের সবুজ দৈত্য কামড় দিয়েছিল ওর বুকে।
যদিও মনের ভেতরে দুটো পুশকিনের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল। একজনের যেমন হিংসে হচ্ছিল, তেমন আর-একজনের মনে হচ্ছিল, পুশকিন না এর থেকে সরে আসতে চাইছে! তা হলে! তা ছাড়া স্মিতা তো সারাক্ষণ ‘তমাল, তমাল’ করে কানের মধ্যে তমালগাছের জঙ্গল তুলে দিল! তা হলে কে ওকে দেখছে, কে দেখছে না তাতে পুশকিনের কী এসে গেল!
মানুষের মাঝে মাঝে কীসে যে কী এসে যায় তার উত্তর মানুষের নিজের কাছেও থাকে না!
“কী হল? নেমন্তন্নের কার্ড ছাপাতে হবে?” স্মিতা ধমক দিয়েছিল এবার।
পুশকিন আর কিছু না ভেবে, মনের মধ্যে পাকিয়ে ওঠা ঝগড়াটাকে মুলতুবি রেখে উঠে পড়েছিল গাড়িতে। আর তখনই আবার বৃষ্টি নেমেছিল ঝেঁপে!
গাড়িটা চলছিল বৃষ্টিতে আবছা একটা শহরের মধ্য দিয়ে। চারদিকের কাচ তোলা ছিল। সামনে বৃদ্ধ চালক একমনে তাকিয়ে ছিল পথের দিকে। পুরনো ওয়াইপারের ঘটঘট শব্দ আর ট্যাক্সির চালে ঝামরে পরা পিটার-প্যাটারের মধ্যে পুশকিন বসেছিল মাথা নিচু করে।
স্মিতা ওর কাঁধ ধরে জোর করে ঘুরিয়েছিল নিজের দিকে। তারপর রাগের গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে তোমার? আমায় এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কী করেছি? বলো। কী হয়েছে আজ বলতেই হবে!”
পুশকিন তাও মাথা নিচু করে বসেছিল। কিছু বলছিল না।
স্মিতা এবার ওর থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়েছিল জোর করে, “কী হল, বলো? এমন করছ কেন?”
পুশকিন এবার তাকিয়েছিল স্মিতার দিকে। বুকের ভেতরে কেমন একটা বেলুন ফুলছিল যেন। আটকে আসছিল দম। কষ্ট হচ্ছিল ওর। মনে হচ্ছিল বেলুনের সঙ্গে ও নিজেও হয়তো বোমার মতো ফেটে পড়বে! ওর গা ঘেঁষে বসেছিল স্মিতা। পারফিউমের ছোট ছোট ফুল ঝরে পড়ছিল স্মিতার প্রতিটা নিশ্বাসের সঙ্গে। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল পুশকিন। বুঝতে পারছিল এমন ঘূর্ণিতে ও পড়ে গিয়েছে, যেখান থেকে ওর বেরোনোর আর কোনও উপায় নেই!
“আচ্ছা, আর কিচ্ছু বলতে হবে না,” স্মিতা আচমকা ঘুরে বসেছিল।
পুশকিন ছিটকে উঠেছিল। ওর বুকের ভেতরের চুপ করে থাকা ছেলেটা এবার চাপা পড়া পিঁপড়ের মতো হাত-পা ছুড়ছিল। এ কী হল! স্মিতা রাগ করল নাকি! ঘাবড়ে গিয়েছিল পুশকিন। বেশি টেনে ফেলেছে কি নিজের মনখারাপটা? কাঙালের মতো করে উঠেছিল মনটা! আর নিজেকে আটকাতে পারেনি পুশকিন। মাথা নিচু করে বলেছিল, “বলছি তো! অত রাগ করো কেন?”
“স্যার, পরের স্টেশনটায় নামব,” স্মরণের কথায় ফিরে তাকাল পুশকিন। ওর সিটের উলটোদিকে বসে রয়েছে স্মরণ। আর স্মরণের পাশে বসে আছে নোঈ।
দুপুরের ট্রেন। ভিড় নেই তেমন। শিয়ালদহ থেকে বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছিল ওরা। পুশকিন ঘড়ি দেখল। প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। গাড়িতে এলে কি আরও তাড়াতাড়ি হত না!
স্মরণ দেখল, পুশকিন ঘড়ি দেখছে। ও বলল, “ট্রেনে তাড়াতাড়ি হল স্যার। সোনাঝুরির যাওয়ার রাস্তায় ফ্লাইওভার হচ্ছে। ওটা স্যার এখন আর রাস্তা নেই। ছোট গাড়ি গেলে উলটে যাবে নির্ঘাত। কী সাংঘাতিক যে অবস্থা! গাড়িগুলো পুরো র্যাফটিং-এর মতো করে দুলতে-দুলতে যায়। হয় আপনার শিরদাঁড়া পৌঁছবে নয়তো আপনার কোমর পৌঁছবে! দুটো কিছুতেই এক সঙ্গে পৌঁছবে না। তাই বললাম ট্রেনে চলুন।”
ট্রেনে যেতে অসুবিধে নেই পুশকিনের। বরং ভালই লাগছে। শীতের দুপুর। মফস্সলের ছোট ছোট স্টেশন। ট্রেনে ওঠা নানা ধরনের হকার। লজেন্সওয়ালা, বাদামওয়ালা, হজমের গুলি বিক্রেতা। কতদিন পরে এদের দেখছে পুশকিন! হ্যাঁ, এখানে ট্রেনগুলো একটু নোংরা, যেসব মানুষ ওঠে, তাদের অনেকেরই হাইজিন ভাল নয়। কিন্তু তাও বেশ লাগছে পুশকিনের। শিয়ালদা থেকে কুড়ি কিলোমিটার যাওয়ার পরেই কেমন যেন শহরটা ফুরিয়ে গেছে। বেশ বড় বড় ধানখেত। দিঘি। কলাবন। পুকুর ঘিরে ভিড় করে আসা তালবাগান। কতদিন পরে এসব দেখছে পুশকিন! জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল। শীতের রোদ কমলা রাংতার মতো ছড়িয়ে আছে জানলার পাশে। মাঝে মাঝে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। খড়-ছাওয়া মাটির বাড়ি। টিনের ছাদওয়ালা ইটের বাড়ি। ফাঁকা খেতে ক্রিকেট খেলছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে। কোথাও মাইক বাজছে। রাস্তার ওপর লেবেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছে টেম্পো, ম্যাটাডোর, সাইকেল। নানা পাখি উড়ছে। জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে পাশের মেঠো পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে ছোট মেয়ে। আর এইসব ছাড়িয়ে ঝমঝম করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। রেলগাড়ি। পুশকিনের আবার নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে!
“স্যার, নেমে রিকশা নিয়ে নেব। ওঁর অফিসটা একটু দূরে,” স্মরণ বলল।
পুশকিন বলল, “তুমি এত চিন্তা করছ কেন? ঠিকই সব হবে। ডোন্ট ওয়ারি।”
স্মরণ হাসল। পুশকিন দেখল, নোঈ চুপ করেই আছে। বেশ শব্দ হচ্ছে ট্রেনের। ধাতব ঝমঝমের ওপর গলা তুলে কোনও কথা বলাই মুশকিল। তাই নোঈ হয়তো চুপ করে আছে। কিন্তু পুশকিনের মনে হল আরও কিছু ব্যাপার ঘটেছে। আজ সকাল থেকেই মেয়েটা কেমন চুপচাপ। কথা কম বলছে। তবে পুশকিনও ঘাঁটাচ্ছে না। আন্দাজ করছে বাড়িতে কোনও ঝামেলা হয়েছে। মানে, সেই সম্ভাবনাই তো বেশি। সেদিন আইকা এসে যা বলে গিয়েছে, তাতে অন্তত সেটাই মনে হচ্ছে পুশকিনের।
বহুদিন পরে আইকাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল পুশকিন। আইকা নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছিল ওর ফ্ল্যাটে। পুশকিন ভেবেছিল, হঠাৎ কেন এল মেয়েটা! কোনও দরকার আছে কি? তা ছাড়া এখানে তো আগে আসেনি? তা হলে আইকা জানল কী করে এই ফ্ল্যাটের ঠিকানা? ও তো নিজে বলেনি কোনওদিন!
“ভেতরে আসতে বলবি না?” আইকা তাকিয়েছিল পুশকিনের দিকে।
পুশকিন সদ্য অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে ল্যাপটপটা নিয়ে বসেছিল। বুদাপেস্টের কাজটার কিছু কারেকশন ছিল। সেটা শেষ করে দু’দিনের মধ্যে জমা দিতে হত, তাই টেনশন ছিল একটু।
নিজের অজান্তেই হাতঘড়ির দিকে চোখ চলে গিয়েছিল পুশকিনের। রাত ন’টার সময়ে এখানে কী করছে মেয়েটা!
ও সরে দাঁড়িয়েছিল দরজা থেকে। আইকা ঘরে ঢুকেছিল। হাতব্যাগটা সোফার ওপর রেখে সময় নিয়ে ঘুরে-ঘুরে দেখেছিল গোটা ঘরটা।
প্রায় আড়াই হাজার স্কোয়ার-ফিটের ফ্ল্যাট। বসার ঘরটাও বেশ বড়। পুশকিন ছিমছাম জিনিস পছন্দ করে। তাই ঘরটাকেও সেইভাবেই সাজিয়েছে। একটা ছোট টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল শুধু ওর কাজ করার জায়গাটায়। তার কমলা রঙের আলো কেমন যেন ছড়িয়ে, মিশে যাচ্ছিল মেরুন অন্ধকারে।
আইকা একটা সিঙ্গল সোফায় বসেছিল। তারপর বলেছিল, “কী রে, বোস। তুই নিজের বাড়িতেই আছিস।”
পুশকিন হেসেছিল সামান্য। দু’পা এগিয়ে বসেছিল সামনের একটা চেয়ারে। বলেছিল, “তুই হঠাৎ এমন আন-অ্যানাউন্সড?”
“আমি কোথাকার রাজা যে, আসার আগে সবাইকে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বলে আসতে হবে? জানি তুই বিরক্ত হচ্ছিস। কিন্তু আমি কাজেই এসেছি!”
“বিরক্ত হব কেন?” পুশকিন হেসেছিল আবার।
“শোন, আমি কি কিছুই বুঝি না! ফালতু ঢং করিস না। আমি জানি ক্লাস টুয়েলভের সেই ব্যাপারটা তুই ভুলতে পারিসনি। কিন্তু এটা একবারও ভেবে দেখিসনি যে, আমারও বয়স তখন কত কম ছিল! আমারও ভুল হতে পারে। একটা ব্যাপারের জন্য এখনও এতটা হেট্রেড কেন পুশকিন?”
“হেট্রেড!” ভুরু তুলেছিল পুশকিন, “হেট ইজ় আ স্ট্রং ওয়ার্ড! সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।”
“তা হলে? হোয়াই ডু ইউ অলওয়েজ় রান আওয়ে ফ্রম মি?”
“আমি কারও কাছ থেকে পালাই না আইকা। আমি এমনই। কী করব বল। সবার কাছ থেকে সরে থাকি আমি। আয়্যাম আ লোনার আই গেস। আই লাইক টু স্টে আওয়ে।”
“এত অসামাজিক! কিন্তু সবার সঙ্গে তো নয়!”
“অসামাজিক হলে অসামাজিক! আর সবার সঙ্গে নয় মানে?” পুশকিন হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠেছিল। আইকার কথাটা কোনদিকে বাঁক নিচ্ছে!
“মানে তুই ভাল করেই জানিস!” আইকা ভুরু কুঁচকে অস্থির হয়েছিল সামান্য।
পুশকিন কথা ঘোরানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “কফি খাবি?”
“না, তুই বোস!” আইকা ওর হাত ধরে আবার টেনে বসিয়ে দিয়েছিল, “তুই কী করছিস পুশকিন? যা করছিস ভেবে করছিস তো?”
“মিনিং হোয়াট?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আইকার দিকে, “কী বলতে চাইছিস সোজা করে বল।”
“আবার ঢং করছিস! আগে তো এত ঢং করতিস না? আজকাল কী হয়েছে তোর?” আইকা মাথা নেড়েছিল বিরক্তিতে।
“আমি জানি না। এসব বলতে এসেছিস এত রাতে! আমার কিন্তু কাজ আছে।”
“সোনাঝুরি তো? আমাদের কম্পিটিটর ছিলি তোরা। এত লেট হয়ে গেল প্রজেক্ট যে, আমাদের কোম্পানি বোধহয় আর করবে না কাজটা। তুই তো ইনচার্জ, না?” আইকা জিজ্ঞেস করেছিল।
“প্লিজ় উই শুড নট ডিসকাস জব হিয়ার!”
“আমি তোর ওপর স্পায়িং করতে আসিনি। এসেছি তোকে বলতে যে, মাথায় রাখিস, নোঈর বয়সটা তোর চেয়ে অনেক কম।”
“আরে!” পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না, “এসব কী বলছিস তুই?”
“শোন, নোঈ খুব সুন্দরী, যে-কোনও ছেলের মাথা ঘুরে যাবেই। তোরও গেছে। প্লাস তুই তো একা। কাছে থাকিস ওর। ফলে…”
“ওয়েট, ওয়েট,” পুশকিন সামনের দিকে ঝুঁকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল আইকার দিকে, “তোর ব্যাপারটা কী? আমি কী করেছি?”
“নোঈর সঙ্গে তুই ইনভলভড নোস? আমি কিন্তু নিজে তোদের দু’জনকে দেখেছি দূর থেকে। ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসের একটা রেস্তরাঁয় ঢুকছিলি।”
“এখনও একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কোথাও গেলে লোকে এই চোখে দেখে সেটাকে!” পুশকিন হাত নেড়ে ব্যাপারটাকে সহজ করার চেষ্টা করেছিল।
“আমায় বোকা পেয়েছিস? বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে কি কিছু বোঝা যায় না?”
হেসে ফেলেছিল পুশকিন। আজকাল সবাই এসব কথা কোথা থেকে শেখে কে জানে! বডি ল্যাঙ্গোয়েজ! গত দশ বছরে বাঙালি এত নতুন শব্দ শিখে ফেলেছে যে, তার চোটে চোখে অন্ধকার দেখছে! এটাও তার একটা।
পুশকিন উঠে সামনে খোলা জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। লেকের ওদিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। বাইরের অন্ধকারের মধ্যে টিপটিপ আলো জ্বেলে যাচ্ছিল সার সার গাড়ি।
“উঠে গেলি কেন?” আইকা নিজেও উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে, “তোর ভাল লাগে নোঈকে? সোজা উত্তর দিবি। আমি সেদিন দেখেছি, নোঈ কীভাবে তোর গাল থেকে কী একটা সরিয়ে দিয়েছিল। দূরে, গাড়িতে আমি আর মা ছিলাম। নোঈ কারও সঙ্গে এমন করে না। কারও কাছে যায় না। আমি ওকে চিনি। ওর যে তোকে পছন্দ, আমি বুঝতে পারছি। না হলে ও কখনও ওর বাবার সঙ্গে রাগারাগি করে না!”
পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারেনি প্রথমে। তারপর বলেছিল, “দেখ, তোকে একটা কথা বলি। আমার জীবনটা সহজ নয়। আমার অতীতটাও নয়। আমি জানি সেটা। আর তাই…”
“তুই কি নোঈকে পছন্দ করিস? সোজা বল। ঘোরাবি না কথা। এই সব বেকার অতীত-টতিত বলবি না। হ্যাঁ কি না বল!” আইকা পুশকিনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কেমন যেন কোণঠাসা করে দিয়েছিল।
পুশকিন সময় নিয়েছিল। আইকার দিকে তাকিয়ে ঘরের নরম আলোর মধ্যে ওর মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কেন এমন রাতে এল আইকা? কী চায় আসলে? এমন করে জেরা করছে কেন?
পুশকিনের হঠাৎ মনে হয়েছিল, এসব কী ভাবছে ও! জীবনে সহজভাবে সত্যিটা বলে দিলে তো আর কোনও ঝামেলাই থাকে না। ও কেন সেখানে এত মাপজোক করছে! কেন এটা-ওটা ভাবছে! আজও তো অনেস্টি ইজ় দ্য বেস্ট পলিসি। সত্যি বললে তো কোনও ল্যাঠাই থাকে না।
ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “হ্যাঁ, নোঈকে আমার পছন্দ।”
আইকা স্থির হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বলেছিল, “কতদূর এগিয়েছে? মানে…”
“না। কাম অন! কী ভাবছিস তুই আমাকে!” পুশকিন বিরক্ত হয়েছিল।
আইকা বলেছিল, “আজকাল তো প্রেম আর ওসব আলাদা আলাদা। আমরাও ইউরোপিয়ান হয়ে গিয়েছি! তাই… আসলে কী জানিস দু’জনকে দেখলে বোঝা যায় যে, তারা কতটা ইন্টিমেট হয়েছে। তাই…”
“তুই এসব বলতে এসেছিস?”
আইকা থেমেছিল সামান্য সময়। যেন কিছুটা নিজের সঙ্গেই মনে মনে একটা তর্ক চলছিল ওর।
পুশকিন বলেছিল, “দেখ, আমি এমন কিছু করব না যাতে নোঈর ক্ষতি হয়। কাকু-কাকিমাকে বলিস এসব কিছু নয়। আমাদের তো কাউকে না কাউকে মনে মনে ভাল লাগেই। কিন্তু আমাদের তো বুঝতেও হয়, কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয়। আমি জানি কী সম্ভব নয়। আমি এমন কিছু করব না, যাতে কারও ক্ষতি বা সম্মানহানি হয়!”
আইকা মন দিয়ে শুনেছিল কথাটা। তারপর বলেছিল, “আমি জানি। তাই তোকে সরাসরি এসে ধরলাম। আসলে নোঈ মনে হচ্ছে সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে। তবে শুধু এটা নয়…আসলে… আর-একটা কথা। আমার নিজের কথা। আমি যে কাউকে জিজ্ঞেস করব… তেমন কেউ নেই। তাই সেটা বুঝতে পারছি না। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।”
পুশকিন অবাক হয়ে গিয়েছিল। আইকা সমস্যায় পড়ে ওর কাছে এসেছে কেন! তেমন তো কিছু বন্ধুত্ব নেই ওদের। মানে, পুশকিনের দিক থেকে তো নেই অন্তত। কিন্তু কেউ যদি এভাবে কিছু বলতে চায়, তা হলে মানুষ আর কী করবে! পুশকিন জানে, কারও কথা শোনাটাও খুব দরকার। মানুষ যত এগোচ্ছে, যত যোগাযোগের টেকনোলজি বাড়ছে, তত দ্বীপের মতো হয়ে যাচ্ছে মানুষ— টাওয়ার অব ব্যাবেল যেন! আইকার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খারাপ লেগেছিল পুশকিনের। মেয়েটার জীবনটা তো খুব কিছু সুখের নয়!
ও বলেছিল, “দাঁড়া, আগে কফি করি একটু!”
কফি করার সময় আইকা ওর ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখেছিল। তারপর রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “নিজেদের অত বড় বাড়ি। থাকিস না কেন রে ওখানে?”
হেসেছিল পুশকিন। বলেছিল, “আসলে অড আওয়ার্সে জব। তাই বাড়ির লোকের যাতে অসুবিধে না হয় সেজন্য। প্লাস আমার একাই ভাল লাগে।”
আইকা রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছিল এবার। ফ্রিজটা খুলে দেখেছিল ভেতরে কী আছে! বলেছিল, “সব তো দারুণ পরিষ্কার আর সাজানো দেখছি! আমারও একাই ভাল লাগে। শুভ মারা যাওয়ার পরে এতগুলো বছর তো একাই… তাই… আমারও ভাল লাগে এরকম। আর সেইজন্য বুঝতে পারছি না কী করব।”
“কেসটা কী?” কফির একটা বড় মাগ আইকার দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল পুশকিন।
আইকা কফিটায় একটা চুমুক দিয়ে বলেছিল, “আমায় একজন বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, জানিস?”
সোনাঝুরি স্টেশনটা মাঝারি মাপের। চারটে প্ল্যাটফর্ম। ওদের ট্রেন তিন নম্বরে ঢুকেছে। লোকজন কম এখন। কয়েকটা কুকুর এখানে-ওখানে ঘোরাফেরা করছে। একটা পাগল বসে রয়েছে সিমেন্টের সিটের ওপর। পুশকিনের বেশ লাগল। প্ল্যাটফর্মের শেষে কয়েকটা বাচ্চা খেলছে। কিতকিত।
ওরা লেভেল ক্রসিং-এর দিকে হাঁটতে লাগল। এদিকটা বেশ ঘিঞ্জি। একটা মিষ্টির দোকান আছে। ট্রেন এসেছিল বলে লেভেল ক্রসিং-এর গেট পড়েছিল। এবার সেটা খোলায় গাড়ি সাইকেল, রিকশা, অটো সব মাতালের মতো টলতে-টলতে চলছে। সেইসব বাঁচিয়ে ওরা এগোতে লাগল।
স্মরণ বলল, “আপনারা স্যার আসুন, আমি আগে গিয়ে দুটো রিকশা দেখছি। আর ওখানে গিয়ে বলবেন না রিতুদার কথা। প্লিজ়।”
রিতুদা! হ্যাঁ তার সঙ্গে তো দেখা করেছে পুশকিন। আর দেখেছে লোকটার খাঁই তারকের মতো নয়। সামান্য সময় কথা হলেও, রিতুদা কিন্তু বারবার বলেছে, জুট মিলটা যে আবার নতুন উদ্যমে ওরা চালু করতে চায় সেটা পার্টির হাইকম্যান্ডের ভাল লেগেছে। বলেছে, ‘রিকো গ্রুপ’-এর চিন্তা নেই। তারককে ভয় পেতে হবে না।
এই লোকটা নাকি গুন্ডা ছিল। চোখমুখ দেখলে মনে হয় সেই পদার্থ এখনও রয়ে গিয়েছে ভিতরে। কিন্তু ওর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছিল। বলেছিল, কোনও কিছু দরকার হলে যেন বলে। রিতুদার ঘরের বাইরে একটা ছেলেকে দেখেছিল পুশকিন। লম্বা-চওড়া। পেটানো স্বাস্থ্য। কিন্তু মুখটায় একটা অদ্ভুত ইনোসেন্স আছে। দেখেছিল, স্মরণের সঙ্গে ছেলেটা হেসে কথা বলছে খুব। পরে জেনেছিল, এই ছেলেটাই যোগাযোগ করেছিল স্মরণদের সঙ্গে। নাম, মাহির।
পুশকিন আবার একবার নোঈকে দেখল। গম্ভীর। মাটির দিকে মুখ নামানো।
ও আলতো করে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আজ?”
নোঈ কিছু না বলে তাকাল শুধু।
পুশকিন বলল, “এমন মুখ কেন?”
“আপনি তা হলে লক্ষ করেছেন?” নোঈর গলায় কেমন একটা রাগ।
“কী হয়েছে?” পুশকিন হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করল।
“আমার আজ খুব ঝগড়া হবে!” নোঈ মুখটা শক্ত করে বলল।
“সে কী, কেন? কার সঙ্গে?” পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারল না।
নোঈ সামান্য থমকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল পুশকিনের দিকে। তারপর বলল, “আপনার সঙ্গে।”
“আমার সঙ্গে? আমি কী করলাম?” পুশকিন অবাক হয়ে তাকাল নোঈর দিকে। এ কী বলে মেয়েটা!
পুশকিন আবার বলল, “ওই দ্যাখো, চুপ করে আছে! কী হয়েছে বলবে তো!”
নোঈ তাও কিছু বলল না। সামনে কিছু লোকজন থাকায় ওরা আস্তে হাঁটছে। পুশকিন বুঝতে পারল না ব্যাপারটা কী হয়েছে।
ও বলল, “ঠিক আছে, আমি যা করেছি তা ভুল হয়েছে। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।”
“না, একদম এসব বলবেন না। সারাটা পথ একবারও আমার দিকে ভাল করে তাকিয়েছেন? একবারও আমার সঙ্গে… আমাকেই কেন বারবার কাছে যেতে হবে? কেন? যাকগে, আমি এখন আর কোনও কথা বলব না স্যার। তা হলে উলটোপালটা কিছু বলে ফেলব! তাই…”
হাঁটতে-হাঁটতে ওরা রিকশা স্ট্যান্ডের কাছে চলে এসেছে। পুশকিন দেখল স্মরণ একটা রিকশায় উঠে ওদের পেছনের রিকশাটায় উঠতে বলছে। পুশকিন কী করবে বুঝতে পারল না। দেখল, নোঈ নিজের কথাটা শেষ না করে স্মরণের পাশে উঠে বসল।
স্মরণ ঘাবড়ে গেল একটু। নোঈ গম্ভীর গলায় বলল, “সরে বোস। আর জামা এমন অর্ধেক গুঁজে রাখিস কেন? ঠিকমতো পরতে পারিস না!”
স্মরণ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “যাঃ শালা, আমি কী করলাম!”
পুশকিন আর কথা বাড়াল না। নোঈ রাগী খুব। জেদও আছে প্রচণ্ড। দেখলে শান্তশিষ্ট মনে হয়, কিন্তু পুশকিন দেখেছে শান্ত মেয়েগুলোই বেশি রাগী হয়! যেমন ছিল স্মিতা। শান্ত কিন্তু রাগী। আচমকা আবার স্মিতার কথা মনে পড়ে গেল পুশকিনের!
সেই গাড়ির ভেতরে স্মিতার পাশে বসে আচমকা ঘাম দিয়েছিল পুশকিনের। কেন কে জানে, নিজেকে আটকাতে পারছিল না ও। যে- কথাটা বলা উচিত নয় সেটাই যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল মুখ দিয়ে! পুশকিন জানত যে, স্মিতার তমালকে ভাল লাগে। তমাল ওকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে স্মিতা সারাক্ষণ ফরম্যালিনে ডুবে থাকা মৃত পায়রার মতো হয়ে থাকে। তবু কেন কে জানে, সেই বৃষ্টির ভেতরে নিজেকে আটকাতে পারেনি পুশকিন। কিছুতেই আটকাতে পারেনি। কে যেন ওর শরীরের ভেতর থেকে কথাগুলো বের করে এনেছিল।
পুশকিন বলেছিল, “আমি তোমার সামনে আসছি না কারণ, এলেই আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি এই কষ্টের শেষ নেই। সমাধান নেই। তাই সরে আছি।”
“কেন?” স্মিতা পুশকিনের চোখে নিজের চোখ গেঁথে রেখেছিল একদম।
পুশকিন একবার আড়চোখে সামনে বসা ড্রাইভারকে দেখেছিল। কারও সামনে এত ব্যক্তিগত কথা ও বলে কী করে! আর স্মিতাই-বা কেন জিজ্ঞেস করছে! ওর এখন যা হাল তা দেখে কি বুঝতে পারছে না? কিন্তু মেয়েরা এমনই করে। হ্যাঁ করুক আর না করুক, সবটা শোনা তাদের চাই-ই চাই।
পুশকিন অস্থির হয়ে গিয়েছিল খুব। তারপর আর নিজেকে না আটকে বলেছিল, “আমার তোমাকে এত ভাল লাগে যে, সামনে এলে মনে হয় আমি জলের তলায় ডুবে যাচ্ছি! আমার… সব গুলিয়ে যায়! কিন্তু… আমি জানি তমাল তোমার সব। তাই নিজেকে কেন কষ্ট দেব ভেবে… মানে…”
“হ্যাঁ, তমাল আমার সব, ওকে আমার নিজের মনে হয়,” স্মিতা বলেছিল শান্ত গলায়।
পুশকিনের মনে হয়েছিল কেউ বোধহয় ওর শরীরে গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়েছে! কিছু জিনিস মনে মনে ভেবে নেওয়া আর সেটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার মধ্যে এক আকাশ পার্থক্য আছে। মনে মনে কিছু ভাবার মধ্যে এক শতাংশ হলেও আশা থাকে। সেলফ নেগেশন থাকে। কিন্তু একবার কেউ সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে বলে দিলে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়!
পুশকিন জানত, তমালকে ভালবাসে স্মিতা। কিন্তু যেই সেটা স্মিতা বলে দিয়েছিল ওর সব কিছু কেমন যেন দলা পাকিয়ে গিয়েছিল।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ছ’মাস লেগেছিল পুশকিনের। স্মিতা কিন্তু তাও যোগাযোগ রাখত ওর সঙ্গে। নিজে থেকে কথা বলত। খাবার নিয়ে আসত। শপিং-এ ধরে নিয়ে যেত জোর করে।
আর পুশকিন নিজেও বুঝতে পারছিল যে, ও তো আর অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না। তাই স্মিতার সঙ্গ পাচ্ছে ভেবে ধীরে ধীরে মেনেও নিয়েছিল সব। পুশকিনের নিজেরই অবাক লাগত মাঝে মাঝে। অন্যের জীবনে কিছু হলে, মানুষ কত জ্ঞান দেয়! কিন্তু নিজের জীবনে শুধুমাত্র যাকে পছন্দ করে, তার কাছাকাছি থাকবে বলে মানুষকে যে মেনে নিতে হয় কত জিনিস!
পুশকিন কেন ওর সঙ্গে ঘোরে, ওর সব কথা মেনে নেয় সবটাই জানত স্মিতা। এমনকী, কখনও-কখনও সামান্য দুর্বল হয়ে পুশকিন বলেও দিত ওর মনের কথা। তখন স্মিতা রাগ করত। বলত, “একই কথা বারবার বলো কেন?” কিন্তু পরেই আবার পুশকিন চলে গেলে সেই নিয়েও অভিমান দেখাত।
বাড়িতেও স্মিতার কথা ক্রমে জেনে যায় সবাই। মা রাগ করতে থাকে স্মিতার পারিবারিক অবস্থা শুনে। বাবাও বোঝানোর চেষ্টা করে ওকে। কিন্তু পুশকিনকে যেন ভূতে পেয়েছিল! এ যেন এক কুহক! যেন নিশিডাক! রাতে ঘুমের মধ্যে ও দেখত স্মিতা ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দেখত, কোন এক নাম না-জানা পুরুষের সঙ্গে পাহাড়ি কোনও এক শহরে বসে আছে ও। ঘুম ভেঙে একা অন্ধকারে বসে থাকত পুশকিন। কাঁদত বালিশে মুখ গুঁজে। মনে হত কেউ যেন ওর শরীরের চামড়া ধীরে-ধীরে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কাছে গেলে কষ্ট। আবার দূরে সরে থাকাও সম্ভব নয়। এক অদ্ভুত চোরাবালি যেন! ডুবে যাওয়ার মধ্যে এমন মৃত্যুভয় আর বাঁচার আনন্দ একসঙ্গে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি ও!
তারপর একদিন মা খুব রাগারাগি করেছিল। সারা দিন না খেয়ে, চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছিল একেবারে! আর তার এক সপ্তাহের মধ্যেই জোর করে বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল কয়েকটা। আত্মীয়স্বজনরা জেনে গিয়েছিল সব। সবাই মিলে পুশকিনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এই স্মিতা কেন ওর জন্য খারাপ। যে সাড়ে তিন বছর কোনও ছেলেকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখে, কাছে আসতে দেয় না, কিন্তু দূরেও যেতে দেয় না, যে অন্যের ভালবাসার সুযোগ নেয়, সে ভালমানুষ হতে পারে না। হয় সে শয়তান, নয়তো অসুস্থ। আর কোনওটাই সাংসারিক জীবনে কাম্য নয়। তাই সবাই মিলে একযোগে পুশকিনকে বোঝাতে শুরু করেছিল— ও যেন এসব ভুলে যায়।
মাসদুয়েক পরে এক রাতে পুশকিন আবার ওরকম কষ্টের স্বপ্ন দেখেছিল একটা। চোখে জল নিয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল একা। সব যেন কেমন গুলিয়ে গেছিল ওর। মনে হয়েছিল মাথাটা এবার ঠিক ফেটে যাবে। ভেতর থেকে কী যেন একটা ভেঙে, মরে, পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়েছিল পুশকিন। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো সেই মাঝরাতে ছাদে উঠে গিয়েছিল ও। ভাবছিল, আর কী হবে বেঁচে থেকে! কার জন্য বাঁচবে! ছাদের পাঁচিলের ওপর উঠেও পড়েছিল! পায়ের তলায় শূন্যতা। মাথার ওপর অপার অসীম কালো। শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিল পুশকিন। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে পেছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। এক হ্যাঁচকায় টেনে নামিয়ে এনেছিল ছাদের মেঝেতে। পুশকিনের গায়ে জোর ছিল না কোনও। কুঁকড়ে, নরম হয়ে ও মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল একদম। ধীরে-ধীরে জ্ঞান হারানোর সময়ে ওর দৃশ্যের মধ্যে, ফোঁটা-ফোঁটা জলের মতো এসে জমেছিল ভাই, বাবা, কানুদা, টুকুদি, মাসি, কাকা, মা…
পরের দিন দুপুরে ঘুম ভেঙেছিল পুশকিনের। দেখেছিল, মা বসে রয়েছে। ওকে চোখ খুলতে দেখে মা বলেছিল, “এই বয়সে তোর বাবাকে তোর জন্য ছাদে উঠতে হয়! তোকে টেনে নামাতে হয় পাঁচিল থেকে! তুই এমন হয়ে গিয়েছিস! শোন, আগে আমায় মেরে তারপর তুই মরবি। এটা মাথায় রাখিস। তাই তোর তাড়া থাকলে বল, আমি এখনই মরছি!”
এখানকার চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল পুশকিন। তারপর মুম্বইয়ে চাকরি নিয়েছিল। স্মিতার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। মা, বাবা, ভাই সবাই খুশি ছিল খুব। পুশকিন নিজেকে বুঝিয়েছিল, এই জীবনে সব কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। না-পাওয়াটাও মেনে নিতে হয়। যত পছন্দেরই হোক না কেন কেউ, মানুষকে একসময় মেনে নিতে হয় যে, সে হেরে গেছে। মেনে নিতে হয় এই সম্পর্ক, এই জীবন এইটুকুই ছিল। আর কিছু এর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া রুবিগুলির মতো, প্রিয় ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে যাওয়ার মতো, সেই সবচেয়ে পছন্দের জামাটার ছোট হয়ে যাওয়ার মতো, মেনে নিতে হয়, সব শেষ! আর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলো আমরা পাই এই ধরনের মেনে নেওয়া থেকেই। এই ধরনের সরে আসা থেকেই।
মুম্বই যাওয়ার আগের দিন কয়েকটা জিনিস কিনতে বেরিয়েছিল পুশকিন। সেসব কিনে দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল ওর। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে পারেনি। গলির মুখের আবছায়ায় একটা পরিচিত অবয়ব দেখে কেমন যেন বিদ্যুতের ছ্যাঁকা লেগেছিল পুশকিনের। স্মিতা! এখানে কী করছে?
স্মিতা ওকে দেখে প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে। পা কাঁপছিল পুশকিনের। বুকে কেমন গিঁট পড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মাটিতে পড়ে যাবে। এমন আচমকা কেউ কাছে আসে! এ তো খুনের চেষ্টা!
স্মিতা সোজা তাকিয়েছিল ওর দিকে। এদিক-ওদিক থেকে ছিটকে আসা আলোর টুকরো এসে বিঁধেছিল স্মিতার মুখে।
“তুমি চলে যাচ্ছ?” স্মিতা কেমন একটা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
পুশকিন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তাও মনের তলায় পড়ে থাকা কয়েকটা শব্দ কুড়িয়ে-কাঁচিয়ে নিয়ে ও বলেছিল, “হ্যাঁ, কালকে। মুম্বই।”
“কেন?” স্মিতা কিছুতেই চোখ সরাচ্ছিল না।
পুশকিনের কথাও আটকে গিয়েছিল যেন। তাও জোর করে অস্ফুটে বলেছিল, “মানে… তুমি তো জানো…”
“না বলো,” স্মিতা জেদের গলায় বলেছিল।
সেই, এক ব্যাপার! পুশকিনের মনে হয়েছিল এখনও বলতে হবে! এত কিছুর পরেও বলতে হবে! থাক তবে, আর কিছু বলে কাজ নেই। অনেক হয়েছে। তাই ও আর কিছু বলেনি। মাথা নামিয়ে স্মিতার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল।
স্মিতা আচমকা ওকে চেপে ধরেছিল দু’হাত দিয়ে, তারপর অদ্ভুত ঝরা পাতার গলায় বলেছিল, “কেন যোগাযোগ করো না তুমি? আমি পারছি না তোমায় ছাড়া থাকতে। আমি মরে যাব। বুঝতে পারছ? মরে যাব আমি। তুমি যাবে না, আমায় ছেড়ে কখনও যাবে না। বুঝেছ?”
পুশকিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। স্মিতাই তো এটা? কী বলছে ও? এও সম্ভব নাকি?
স্মিতা বলেছিল, “আমি এই ক’দিনে বুঝতে পেরেছি, আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। কিছুতেই না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমায় বিয়ে করবে?”
সেদিন থেকে দু’সপ্তাহের মাথায় স্মিতাকে বিয়ে করেছিল পুশকিন। ওর বাড়ির কেউ আসেনি। সবাই ছি ছি করেছিল। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাও কোনও কিছু ওকে আটকাতে পারেনি।
ফুলশয্যার রাতে, পুশকিন স্মিতাকে দু’হাত দিয়ে ধরে বলেছিল, “তুমি আমার সামান্য জীবনে এক পরি!”
স্মিতাও পুশকিনকে আঁকড়ে ধরে কাঁপা গলায় বলেছিল, “তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। আমায় ছেড়ে যাবে না তো?”
জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল সেটা। পুশকিনের ভেতরের আদিম পুরুষটা যেন জিতে গিয়েছিল সেদিন। স্মিতার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে পুশকিন ভেবেছিল, তমালকে স্মিতার জীবন থেকে ঠিক সরিয়ে দিতে পেরেছে ও।
কিন্তু জীবন সমুদ্রের মতো। কোনও কিছুই তাতে হারায় না। একদিন না একদিন কোনও না কোনও বালুতটে সেই হারানো জিনিসটাকেই ঠিক আছড়ে এনে ফেলে জীবন। বোঝায়, কোনও খেলাই শেষ হওয়ার আগে শেষ নয়।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ওরা দেখল জায়গাটাকে। ভাঙা রেললাইন চলে গিয়েছে একটা। চারিদিকে কেমন ঝোপজঙ্গল হয়ে আছে। একপাশ দিয়ে সরু রাস্তা। কয়েকটা গাছের ডালপালা সেই রাস্তার কিছুটা দখল নিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ওরা সেই পথে এগিয়ে গেল।
একজন বয়স্ক লোক বাড়ির সামনে রোদে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ওদের দেখে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর স্মরণকে দেখে চিনতে পারলেন ঠিক, “আরে তুমি?”
স্মরণ হেসে এগিয়ে গেল, “হ্যাঁ স্যার, আমি। আর এই আমার সঙ্গে…”
পুশকিন স্মরণকে কাঁধে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। তারপর নিজে এগিয়ে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল মানুষটাকে।
ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন সামান্য। বললেন, “কে বাবা! তোমায় তো ঠিক…”
“একদম চেনা যাচ্ছে না, বিজনকাকু! লোকে যে বলে, আমাকে আমার বাবার মতো দেখতে!”
বিজন স্তব্ধ হয়ে গেলেন একদম। যেন মোমের মূর্তি! যেন লাভায় আটকে যাওয়া প্রজাপতি! যেন বহুবছর পর হারানো সম্পদ ফেরত পাওয়া মানুষ!
বিজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “পরি… পরি…”
পুশকিন জানে পরি বলে কিছু হয় না। শুধু কিছু মানুষ আছে, যারা সারা জীবনেও এই সত্যিটা বিশ্বাস করে না। সারা জীবন তারা নিজেদের ক্রমাগত ঠকিয়ে যায়।
.
৩৩. পেখম
ঘুম নেমেছে অন্ধ তারার চোখে
পুকুরঘেরা ঝাপসা গাছের সারি
হাত ছুঁয়ে কে বৃষ্টি দিয়ে গেল!
মেঘলা, তোমার বকুল হতে পারি!
ফুল হবে? সেই সাধ্য ছিল কারও?
আমরা এখন সব খেলাতে হারি…
তবুও জেনো তোমার দিকে চেয়ে
সাজিয়ে রাখি জোনাকিদের বাড়ি
লেখাটা আর-একবার পড়ল পেখম, তারপর কাজুর ডায়েরিটা বন্ধ করে ঝোলার মধ্যে ভরে নিল। এই লেখাটা বেশ পছন্দ ওর। আজ অন্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা গুছিয়ে নেওয়ার আগে কেন কে জানে লেখাটা আর-একবার পড়তে ইচ্ছে হল! সত্যি কি কাজু ওর জন্য সাজিয়ে রাখবে এমন একটা জোনাক-রঙা বাড়ি?
ডায়েরিটা ঢুকিয়ে পেখম দেখে নিল চারিদিক। আর কি কিছু পড়ে রইল! নাঃ, আর কিছু পড়ে নেই। কিন্তু আসলে তো সবটাই পড়ে রইল! এই ঘর, এই চৌকি। ছোট কাঠের কারুকাজ করা ফ্রেমে বাঁধানো আয়না। দরজার কড়ায় ঝোলানো চুলের কালো ফিতে। ওই টেবিল। জড়ো করা বই। খবর কাগজের কাটিং। ঝরনা কলম। লাল কালি, সবুজ কালি। ঠাকুরদার এনে দেওয়া সেই আকাশি রঙের পেনসিল। কুমকুম টিপের বাক্স। ঠাকুরমার রুপোর পাউডার কেস। জমানো দেশলাইয়ের খোল। ইনফ্যান্ট স্কুলের প্রথম ইংরেজি বই। সব, সব তো রয়েই গেল! ওই জানলা, তার পাশে বাবু হয়ে বসে জোনাকি দেখা। মায়ের গায়ের গন্ধে ডুবে ঘুমিয়ে পড়া। বাবার পিঠে চড়ে ঘোড়া ছোটানোর আনন্দে খিলখিল শব্দে উড়ে যাওয়া। আর কাকুর সঙ্গে বসে, লোডশেডিং-এর আকাশে তারা দেখার সেই ছোট্ট পেখম, সব তো রয়েই গেল এখানে। এই ঘরে, এই বাড়িতে। ওই ছোট্ট কাপড়ের ঝোলা ব্যাগে এতগুলো বছর আর এত এত স্মৃতি কি ভরে নিয়ে যাওয়া যায়!
পেখম উঠল। আজ ওর শেষদিন এই বাড়িতে। কাল থেকে নতুন পথ, নতুন জীবন, নতুন সব কিছু। কাল কাজু আর ও চলে যাবে এই সোনাঝুরি ছেড়ে।
কেউ তো ওদের বুঝল না। কেউ তো জানতে চাইল না ওদের কী সম্পর্ক। সবাই শুধু পাঁচিল তুলেই গেল। সবাই দূরে সরিয়ে রাখতে চাইল ওদের। ভেঙে দিতে চাইল সব কিছু। কিন্তু জীবনটা ওদের। আর কারও নয়। তাই এভাবে নিজেদের জীবন অন্য কারও কাছে দিয়ে যাবে না ওরা।
আজ বৃষ্টি পড়ছে খুব। নিম্নচাপের বৃষ্টি। ক’দিন ভোগাবে। ঠাকুরদা আজ দোকানে যাননি। ফুলুদাদুর সঙ্গে নিজের ঘরে বসে দাবা খেলছেন। বাড়িতে মা আর কাকিমা মিলে বিয়ের কীসব ফর্দ করছে। বাবা ছিল। কিন্তু কী একটা কাজে বেরিয়ে গিয়েছে।
পেখম গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা ওর কাঠের আলমারিতে তুলে রাখল। এটা মায়ের হাতে পড়লে বিপদ আছে। তবে একটাই বাঁচোয়া, ও যেহেতু আর বাইরে বেরোয় না, তাই মা-ও ওর ঘরে এসে কিছু হাতড়ায় না।
পেখম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আর-একবার ঘরের ভেতরটা দেখল। কাল রাতে সবার নজর এড়িয়ে বেরিয়ে যাবে ও। তাই আজ রাতটুকুই এই ঘরে ওর শেষ রাত। কীসের যে বন্ধন! কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে ওর! এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে! কেন মা মেনে নেবে না কাজুকে? কেন বাড়ির লোকেরা কাজুকে পছন্দ করবে না? কেন ওর ইচ্ছেমতো তৈরি হবে না ওর জীবন? ও কি ক্রীতদাসী নাকি? মা, বাবা খেতে-পরতে দেয় বলে ওর ইচ্ছে আর জীবন কিনে নিয়েছে নাকি? কাজু ভাল লেখাপড়া জানে। পেখম নিজেও পড়াশোনা করে। তা হলে দু’জনে চাকরি করে কেন একযোগে সংসার চালাতে পারবে না? পেখম জানে এসব প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যাবে সারা জীবন। এগুলোর উত্তর ওদের বাড়ির লোকদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না।
পেখম কাকুদের ঘরে গেল। টেটু পড়ছে। পেছন থেকে ওকে দেখা যাচ্ছে। মাথা নিচু করে পড়ে যাচ্ছে ছেলেটা। দেখে আচমকা কেন কে জানে আবার চোখে জল এল ওর। টেটু যখন হয়েছিল, ওর মনে আছে, সারা দিন ওর সামনে বসে থাকত পেখম। বলত, “আমার ভাই!” টেটুও ওকেই সবচেয়ে বেশি চিনত যেন। পেখম না এসে বসলে খেতেই চাইত না। পেখমের কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে থাকত সারাক্ষণ। সেই ভাইকেও ছেড়ে চলে যেতে হবে!
নিজেকে শক্ত করল ও। এভাবে দুর্বল হলে হবে না। পৃথিবীতে দুর্বলদের জায়গা নেই। তুমি নরম হয়েছ কী লোকে সেটা তোমার অক্ষমতা, দুর্বলতা ভেবে তোমায় চেপে মাটিতে পুঁতে দেবে।
পেখম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে এগিয়ে গেল টেটুর কাছে। আলতো করে ওর মাথায় হাত দিল।
টেটু কী একটা লিখছিল। ঘুরে তাকাল, “আরে দিদি, তুই!”
“এমনি এলাম তোকে দেখতে। কী পড়ছিস?” পেখম সামান্য ঝুঁকে খাতাটা দেখল।
“আরে, দেখ না, ট্রানস্লেশন করতে দিয়েছেন স্যার। এসব কঠিন-কঠিন ইংরেজি আমি পারি? বলেছেন ডিকশনারি যেন না দেখি। আমি কি ভগবান যে, ডিকশনারি না দেখে নিজে থেকে সব মানে জেনে যাব!”
পেখম হাসল, “আরে, তুই দেখ। কে বারণ করেছে? এখানে তো আর কেউ দেখতে আসবে না!”
টেটু তাকাল পেখমের দিকে। তারপর বলল, “নাঃ, থাক। স্যারকে কথা দিয়েছি, আমি এমন কিছু করব না। কথার তো একটা দাম আছে, তাই না দিদি?”
পেখম হাসল। ঠিকই তো! কথারই তো দাম! মানুষের আর তো কিছু নেই কথা ছাড়া! অধিকাংশ মানুষ বোঝে না এটা। কিন্তু কেউ না বুঝলেই তো আর সেটা ভুল হয়ে যাবে না! ওর আশ্চর্য লাগল, টেটুর মতো ছোট ছেলে এসব জানে, কিন্তু বড়রা জানে না!
টেটু হাতের কলমটা বন্ধ করে ঘুরে বসল। তারপর চেয়ার সরিয়ে ওর দিকে ঘুরে বসল। বলল, “দিদি, একটা কথা বলব?”
“কী?” পেখম অবাক হল। টেটু তো এমন করে সিরিয়াস হয়ে কিছু বলে না কখনও।
টেটু দরজার দিকে তাকাল একবার। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “কাজুদা তো খুব ভাল ছেলে। কিন্তু বড়রা বুঝতে চাইছে না। এটাই তো প্রবলেম, তাই না?”
পেখম অবাক হয়ে গেল। টেটু এসব কী বলছে! ও এসব কথা জানল কী করে! এই কয়েকদিন আগেও তো বাচ্চা বাচ্চা ছিল! এমন বড় হয়ে গেল কী করে!
পেখম চোখ বড় করে বলল, “তুই এসব কথা জানলি কী করে? কে বলল তোকে এসব কথা?”
টেটু মাথা নেড়ে বলল, “দিদি, আমি ক্লাস নাইন। কত বড় হয়ে গিয়েছি বল তো! বিজনের বয়সি আমি। বিজন এখন থেকেই পার্টি করে! আর আমি এটা জানব না!”
পেখম কী বলবে বুঝতে পারল না। কয়েকদিন আগেও তো কেমন ছোট্টটি ছিল যেন! কী হল টেটুর!
টেটু বলল, “তুই দিদি বড্ড ন্যাতপ্যাতে। কাজুদা আর তোর প্রেমই তো হবে। তোরা সোনাঝুরির বেস্ট দেখতে। এমনই তো হওয়ার কথা।”
“চুপ কর! তুই এত পেকেছিস!”
“আরে! পাকার কী আছে!” টেটু হাসল, “আমি আরও অনেক কিছু জানি। বড় হচ্ছি না! বাবা যে মাকে রাতে মাঝে মাঝে আদর করে সেটাও শুনি! আগে বুঝতাম না মায়ের কীসের ভয় করে, এখন বুঝি। আমায় ক্লাসের একজন বলেছে। মানে, শিখিয়ে দিয়েছে। জানিস, আমার শুনতে লজ্জা লাগে। কিন্তু বাবার লজ্জা নেই!”
“চুপ, চুপ একদম!” পেখম এবার টেটুর মুখটা চেপে ধরল।
টেটু ওর হাতটা জোর করে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কাজুদার ভাই আছে না? ওই যে বাচ্চা ছেলেটা। ক্লাস ফাইভে পড়ে আমাদের স্কুলে। ও আমায় বলছিল কাজুদা নাকি বাড়িতে মনমরা হয়ে থাকে। ছেলেটার খুব গাছের বাতিক, জানিস! ওইটুকু ছেলে সারাক্ষণ গাছপালা নিয়ে পড়ে আছে! আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলে।”
পেখম বলল, “তুই এসব বলবি না আর। তুই এখনও অনেক ছোট। একদম এসব বলবি না!”
টেটু মাথা নেড়ে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না দিদি! আমাদের বাড়ির লোকগুলো খুব খারাপ। সবার এত লোভ! এই যে মালিকরা বাবাকে প্রোমোশন দিল। জেঠুর প্রোমোশন নিয়েও নাকি ওপরমহলে কথা বলবে। এই যে সবাইকে এসে এটা-ওটা দিয়ে যায়, সেসব দেখেই সবার মাথা ঘুরে গেছে! আমার খুব লজ্জা লাগে, যখন আমাদের বাড়ির লোকজন হ্যাংলাপনা করে। মনে হয়, আমার বাবা এমন! মা এমন! জেঠিমা এমন! স্যার বলেন, লোভ করতে নেই। এটা আমি জানি, বড়রা জানে না? তুই এক কাজ কর না!”
“কী কাজ?” পেখম অবাক হল।
টেটু আর-একবার দরজার দিকে তাকাল। তারপর গলাটা আরও খাদে নামিয়ে বলল, “তুই আর কাজুদা পালিয়ে যাচ্ছিস না কেন? তোরা পালিয়ে যা। দু’দিন ঝামেলা হবে, চিৎকার-চেঁচামেচি হবে। তারপর সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন আবার আসবি তোরা। ততদিনে কাজুদা একটা চাকরি ঠিক পেয়ে যাবে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন পালিয়ে যা দিদি। বাঁচতে চাইলে পালিয়ে যা!”
পেখম স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল টেটুর দিকে। কী বলল এটা ও? বিজন কি কিছু বলে দিয়েছে? কাল রাতে কাজু আর ও যে পালিয়ে যাচ্ছে, সেটা একমাত্র বিজন জানে। টেটুর সঙ্গে বিজনের কথা হয়। তবে খুব কিছু বন্ধুত্ব নেই!
পেখম সতর্ক হল। জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এটা বললি কেন?”
টেটু বলল, “আমি হলে তো তাই করতাম। তাই বললাম আর কী! প্লাস আমার নিজের একটা প্ল্যান আছে। যত তাড়াতাড়ি পারি এদের সবাইকে ছেড়ে পালাব আমি। আমাদের বাড়ির লোকেরা সবাই কেমন যেন। শুধু জেঠু আর ঠাকুরদা এমন নয়। বাকিরা এত লোভী!”
“টেটু!” পেখম ধমক দিল এবার, “বড়দের সম্বন্ধে এমন কথা বলতে আছে?”
টেটু হাসল, “বড়রা আর কতদিন বল তো বয়সের সুবিধে নিয়ে যা খুশি তাই করবে আর সম্মান ডিমান্ড করবে! এর একটা শেষ থাকা দরকার, না! আমি এই নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, জানিস!”
“ঠিক আছে। চুপ করে এখন পড়। এ ক’দিনে এত পেকে গেছিস জানতাম না!” পেখম জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। এতক্ষণ বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু শব্দ শুনে বুঝল, এবার ধরেছে।
টেটু টেবিল থেকে কলমটা তুলে প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঢাকনাটা খুলে ফেলল। তারপর বলল, “ভাল কথা বলছি দিদি। আর মাত্র সাতদিন বাকি আছে। বিয়ের কার্ড দেওয়াও প্রায় শেষ। ভেবে দেখিস কিন্তু।”
পেখম আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল। ঠাকুরদার ঘরে উঁকি দিল একবার। দেখল, ঠাকুরদা আর ফুলুদাদুর কোনওদিকে মন নেই। ও তাও দরজায় দাঁড়াল একটু। আজ মনে হচ্ছে সব কিছু আরও ভাল করে নিজের মনের মধ্যে নিয়ে নেয়। সব ছবি, সব মুহূর্ত বুকের মধ্যে জমা করে নেয়। আর এমন রাত, এমন সন্ধে তো পাবে না। মনখারাপ আর ভয় করছে পেখমের। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতটা যখন এগিয়ে গেছে তখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। কাজু ওকে এইসব বলেছিল আগেই। বলেছিল, কী কী ছাড়তে হবে। কাদের ছাড়তে হবে। কিন্তু তাও কথা শোনেনি পেখম। কাজুকে ছেড়ে ওর পক্ষে থাকা সম্ভব নয়!
বিজনদের বাড়ির সেই বাগানে কাজুর বুকের সঙ্গে লেপটে থেকে পেখম বলেছিল, “তুমি ভয় পাচ্ছ?”
কাজু বলেছিল, “হ্যাঁ, পাচ্ছি।”
“কীসের ভয়? সব ছেড়ে যেতে বলছি বলে?” পেখমের গলায় অভিমান এসে জমা হয়েছিল।
কাজু বলেছিল, “পেখম, জীবন তো থেমে থাকে না। তোমার হয়তো পরে আমাকে আর ভাল লাগবে না। হয়তো জানবে আমি এমন কিছু করেছি জীবনে, যাতে আমায় ঘেন্না করতে শুরু করবে!”
“মানে?” পেখম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে!
কাজু ইতস্তত করেছিল। কেমন একটা দ্বিধার ভাব ছিল ওর স্বরে। যেন কিছু আটকে আছে ওর মনে। এমনটা করতে কাজুকে কোনওদিন দেখেনি ও।
কাজু সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “মানে, মনখারাপের সময় তো মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। তখন সে যে কী করে ফেলে! কী বলে ফেলে! তাই…”
“থাক, মনখারাপের সময়ের কথা আমি আর শুনতে চাই না। অনেক মনখারাপ হয়েছে। আর না। আর শুনব না।”
“কিন্তু সেসব শোনা দরকার। সেসব আমি…”
“না, না, না। আমি শুনব না। যা হয়েছে, হয়ে গেছে… আমি সেসব শুনবই না!” জেদি গলায় বলেছিল পেখম, “এবার হল তো? আর ভয় নেই তো কিছু নিয়ে?”
কাজু এবার তাকিয়েছিল পেখমের দিকে। সামান্য হেসে বলেছিল, “না। ভয় আমার আছে। তোমাকে নিয়ে আছে!”
“আমাকে নিয়ে!” পেখম অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি তোমার সঙ্গে গাছের তলাতেও থাকতে পারি!”
“হা হা,” কাজু হেসে বলেছিল, “সেটা নয় পেখম। দ্যাখো, জীবনের এই মুহূর্তে তুমি যতটা প্রেম অনুভব করছ, এমনটা তো আর সারা জীবন থাকবে না! অভ্যেস, সব কিছুর মতো প্রেমকেও ভোঁতা করে দেয়। তখন যদি তোমার মনে হয় আমার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে ভুল করেছিলে! বাবাকে যে এত ভালবাসো, তাকে কষ্ট দিয়ে ভুল করেছিলে! তখন! আমার তো তুমি ছাড়া আর কিছু নেই পেখম! তুমি সেইসব ভেবে যদি পরে আমায় দূরে ঠেলে দাও! তাই ভয় লাগছে আমার।”
পেখম কাজুর মাথাটা ধরে নামিয়ে এনেছিল ওর দিকে। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কাজুর সমস্ত ভয়, দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব শুষে নিয়েছিল। কাজুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “খালি ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে একই কথা বলছ! এসব নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না, কেমন!”
তারপর ওরা ঠিক করেছিল দিন।
কাজু বলেছিল, “গেট মিটিং আছে আর-একটা। মালিকরা তো আগের কথা শুনল না! তাই মিটিংটা এবার আরও বড় করে করতে হবে। আমি জানি মালিকরা সেটা বানচাল করার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি সেটা ম্যানেজ করব। পুলিশ, গুন্ডা যাই আসুক। তুমি ভয় পাবে না। আমি ঠিক সেফলি বেরিয়ে যাব। তারপর…”
“তোমার কিছু হবে না তো?”
পেখমের মাথায় হাত বুলিয়ে কাজু বলেছিল, “আমি বলছি তো। আমি আসব তোমার কাছে।”
পেখম নিজের গলা থেকে কালো কারে ঝোলানো রুপোর চৌকো লকেটওয়ালা হারটা খুলে হাতে দিয়েছিল কাজুর। বলেছিল, “এটা তুমি সঙ্গে রাখবে। কেমন?”
“কিছু বলবি?” ঠাকুরদা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন হঠাৎ।
পেখম হাসল। তারপর পায়ে-পায়ে ঢুকে এল ঘরে। বলল, “একটা কথা বলবে?”
“গজের প্যাঁচে পড়েছে মন্ত্রী! পরে বললে হবে?” ঠাকুরদা আবার দাবার বোর্ডের দিকে মুখ ফেরালেন।
পেখম বলল, “না, এখনই বলো।”
ঠাকুরদা হাসলেন, “তুই সত্যি পাগলি! বল।”
“আচ্ছা ঠাকুরদা, তোমার ছোটবেলার সব বন্ধুর নাম মনে আছে? তাদের জীবনের সব কিছু মনে আছে? ফুলুদাদু ছাড়া বলছি।”
ঠাকুরদা অবাক হয়ে তাকালেন, “আর কি মনে থাকে? আমার আশি হল। স্মৃতি তো ফিকে হবেই। তাই না?”
“তা হলে, বলাই বলে সেই বন্ধুর এত কিছু মনে আছে কেমন করে?”
ঠাকুরদা থমকে গেলেন। কী বলবেন যেন বুঝতে পারলেন না।
ফুলুদাদু বলল, “বগলা, তুই ওকে বলাইয়ের গল্প করেছিস? ওঃ, কী ছেলে ছিল! না?”
পেখম বলল, “তুমি ওকে ভুলতে পারোনি। কারণ, বলাই কাউকে ওরকম পাগলের মতো ভালবেসেছিল বলেই, তাই না! ওরকম তো দেখা যায় না! সবাই তো নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। মুখে প্রেম বললেও আসল সময় এলে কিছু করতে পারে না, ভয় পায়। একটা সেফ জীবন চায়। তাই না? কিন্তু বলাই তা চায়নি। আর দ্যাখো, তাই সবাই ফিকে হয়ে গেলেও ওর কথা তুমি মনে রেখে দিয়েছ! ভোলোনি! ও কষ্ট পেয়েছিল, ওর কিছু হয়নি। কিন্তু তোমরা কেউ যা পারোনি ও কিন্তু সেটাই পেরেছিল। তাই তোমরা ওকে ভুলতে পারোনি। আমরা বাঙালিরা, উত্তম-সুচিত্রা দেখে গদগদ হই। চোখের জল ফেলি। কিন্তু নিজের বাড়ির কেউ কিছু করলে এমন করি কেন?”
ঠাকুরদা এবার উঠে এলেন। পেখমের মাথায় হাত দিলেন আলতো করে। তারপর মৃদু গলায় বললেন, “সামনে বিয়ে। আর এসব মনে রাখিস না।”
“তুমি ভুলতে পেরেছ বলাইকে? সেটা তো তাও তোমার বন্ধুর জীবন ছিল, আর এটা তো আমার নিজের জীবন। কী করে ভুলি?”
ঠাকুরদা কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন আবার। পেখম হাসল। ঠাকুরদা ওকে খুব ভালবাসেন, কিন্তু ও এটাও বোঝে যে, ঠাকুরদা কোথায় যেন বদ্ধ!
পেখমের কষ্ট শুধু বাবাকে নিয়ে। ও বুঝতে পারে বাবার এসব কিছু ভাল লাগছে না। কিন্তু মাকে বাবা বেশ ভয় পায়। মায়ের কথা বাবা কাটে না। মা এমন রাগী! এমন ঝামেলা করে যে, বাবা খুব সমঝে চলে মাকে।
গতকাল রাতেও তো মা বাবাকে বলেছিল, “এদিকে আমরা সব আয়োজন করছি। কিন্তু তারপর যদি তোমার গুণধর মেয়ে কোনও ঝামেলা করে! বা ওই পাজি ছেলেটা যদি কিছু করে তখন কিন্তু…”
বাবা বিছানায় বসে একটা বই পড়ছিল। মায়ের কথা শুনে বলেছিল, “আমি তো বলেছি, আমি আছি। চিন্তা কোরো না!”
মা রাগের সঙ্গে বলেছিল, “কীসের পুলিশ তুমি কে জানে! দেখি কী করো তুমি!”
পেখম হাসল নিজের মনে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। না বাবা, না মা। সবাই দেখবে শুধু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে। ও ভাবল একবার মায়েদের ঘরে যাবে। কিন্তু তারপরেই মত পালটাল। না যাবে না। গেলেই বিয়ে নিয়ে গালগল্প শুরু করে দেবে। ভাল লাগে না এসব কথা ওর। মা বোঝে না যে, ওর এসব ভাল লাগে না। মালিকরা যত পয়সাওয়ালা লোকই হোক না কেন, তাতে ওর আগ্রহ নেই কোনও।
পেখম আবার নিজের ঘরের দিকে ফিরল। কিন্তু তার আগেই ছোটকার গলা শুনতে পেল মেন গেটের কাছে।
“বউদি, বউদি! বাবা!”
ছোটকার গলার ভেতর এমন কিছু একটা ছিল যে, পেখম দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল ঠাকুরদা, ফুলুদাদু, মা আর ছোটকাকিমা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ছোটকা এসে দাঁড়াল ওদের বারান্দায়। ছোটকা হাঁপাচ্ছে। হাতে ধরা সাইকেলের চাবিটা নিয়ে অস্থিরভাবে একবার মুঠো খুলছে আর মুঠো বন্ধ করছে!
“কী হয়েছে?” ঠাকুরদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ছোটকা বলল, “আরে, ফ্যাক্টরি গেটে খুব ঝামেলা হয়েছে। কাজু জানোয়ারটা লোক নিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে। আমাদের প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গেছে। লোকজন জানোই তো, কাজ না করার ছুতো পেলেই হল। বোমা পড়েছে প্রচুর! পুলিশ এসেছে! দাদাও গেছে।”
বোমা! পুলিশ! পেখমের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষে! কাজু কেমন আছে? ও ঠিক আছে কি? ওর কিছু হয়নি তো?
মা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর কাজু! পুলিশ ধরেছে ওকে!”
ছোটকা বলল, “ও শয়তানের বাচ্চা। সবাইকে খেপিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়েছে! কোথায় গেছে কে জানে! তবে জানোয়ারটা পালিয়ে যাবে কোথায়! চারদিকে আমাদের লোক! একবার হাতে পেলে না!”
পেখম তাকিয়ে রইল সবার দিকে। কেমন যেন অচেনা মানুষ মনে হচ্ছে সবাইকে। মনে হচ্ছে এরা কারা ঢুকে এসেছে ওদের বাড়িতে! সবার মধ্যে এমন তীব্র নৃশংসতা আগে দেখেনি ও! সবাই যেন কাজুকে পেলেই মেরে দেবে! এ যেন এক চক্রব্যূহ! এ যেন প্রবল মৃত্যুর আয়োজন! কী করে মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে পারে! পেখমের মনে হল কাজু আটকে পড়েছে একরাশ লোভী আর স্বার্থান্ধ মানুষের মধ্যে!
পেখম চোখ বন্ধ করল। ওর মনে পড়ে গেল প্রথম দিন কাজুকে দেখার সেই মুহূর্তটা।
জানুয়ারি মাস ছিল সেটা। সকালের আলোর ভেতর কেমন একটা পাতলা দুধের সরের মতো কুয়াশা পড়েছিল। পেখমদের ছোট্ট বাড়িটার পাশের পুকুরের জলে তখনও ভাল করে সূর্য এসে দাঁড়ায়নি। পেখম একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে দুধের গ্লাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। কাজু এসেছিল একটা লাল-হলুদ ডোরা-কাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে।
রোদের ঢালু মিনারের ভেতর সোনাকুচির মতো ধুলো উড়ছিল। তার মধ্যে কাজুর হালকা দাড়ি আর টানা-টানা চোখ কেমন যেন স্বপ্ন থেকে উঠে আসা মানুষের মতো লেগেছিল পেখমের। পেখম যেন বুঝেছিল আজ থেকে ওর জীবনের আর-একটা দিক খুলে গেল। সেদিকে আর কেউ নেই কাজু ছাড়া!
পেখম চোখ খুলল। বাইরের শব্দ শুনে বুঝল, বৃষ্টি শুরু হল আবার! আর সেই জলে ধুয়ে যেতে লাগল সব সম্পর্কের টান, সব বন্ধন! মুছে যেতে লাগল আকাশের তারা, ঘোড়ার খুরের শব্দ, মায়ের গায়ের ঘুম-পাড়ানি গন্ধ! নিভে যেতে লাগল মাইলের পর মাইল জোনাকির আলো!
পেখম বুঝল, কাল এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বাবা ছাড়া আর কারও জন্য মনখারাপ করবে না ওর! বুঝল, ওর জীবনে আজকের পর থেকে কাজু ছাড়া আর কেউ রইল না!
.
৩৪. মাহির
ছোট্ট ভাঁজে মণীশ আর রাজাকে কাটিয়ে এগিয়ে আসছে ছেলেটা। মাঠের ডান দিক থেকে আড়াআড়িভাবে বল নিয়ে ঢুকে আসছে ভেতরের দিকে। ছেলেটা রোগা, মাঝারি হাইট! হরিণের মতো দৌড়োচ্ছে! বলটাকে একবার ডান পায়ে আর-একবার বাঁ পায়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে ছোট ছোট লাফে। এবার রাইট ব্যাক ঝাঁপি পাশ থেকে দৌড়ে এল আটকাবে বলে। কিন্তু একটা ছোট্ট টোকায় বলটাকে ঝাঁপির পায়ের ওপর দিয়ে তুলে দিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে গেল। সামনে শুধু মাহির একা। বিকেলের রোদ তেরছা করে এসে পড়েছে স্টেডিয়ামের পাশে ঘিরে থাকা দেবদারু গাছগুলোর মাথায়। হাওয়া দিচ্ছে আজ! লেকের দিক থেকে আসা হাওয়ায় ছেলেটার জার্সি উড়ছে পতাকার মতো! মাহির দেখল পতাদা চিৎকার করছে সাইড লাইন থেকে। বিশাল ভুঁড়িটা টি-শার্টের নীচ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। পইতেটা দেখা যাচ্ছে। মাহির তাকাল একবার। ছেলেটা সামনে এসে পড়েছে প্রায়! গ্যালারির সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। রেফারি ঘড়ি দেখছে। যে-কোনও সময়ে শেষ হয়ে যাবে খেলা। মাহির জানে গোল খেয়ে গেলেই সব শেষ! আর ফিরে আসার উপায় নেই। ওকে টপকে গেলে পেছনে শুধু সুমিত। ছেলেটা বলটা আবার বাঁ পা থেকে ডান পায়ে নিল। আড়চোখে দেখে নিল পেছনে কেউ আসছে কি না! পেছনে দশ মিটারের মধ্যে কেউ নেই! ছেলেটা এগিয়ে আসছে। মাহির তাকিয়ে আছে। হাওয়ার জোর বাড়ল আর-একটু। দেবদারু গাছের মাথা থেকে রোদ সরে যাচ্ছে আরও। গ্যালারির লোকগুলো কীসব যেন বলছে! আবছা শব্দ সব। মাহিরের আর কিছু মাথায় নেই। শুধু দুটো পা দেখছে ও। বলটার ওপর ঘুরছে দুটো পা! ছেলেটা এগিয়ে এল আরও। মাহিরও এগোল। ছেলেটা বাঁ পা দিয়ে ভাঁজ মারতে গেল। মাহির ডান দিকের পায়ের ওপর ট্যাকল করবে বলে চার্জ করল। বলটা সামান্য লাফিয়ে ঘুরে গিয়ে লাগল ওর বুটের ডগায়। বলটা ছিটকে গেল! কোথাও ঝনঝন করে শব্দ হল একটা। আর চোখ খুলে উঠে বসল মাহির।
ছেলেটা কি কাটিয়ে যেতে পারল? গোলটা কি হল? নাকি ও ক্লিয়ার করে দিতে পারল বলটাকে! কিছু বুঝতে পারছে না ও। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে। বুকের ভেতরটা কেমন একটা করছে! খেলার আর কত বাকি ছিল! মাহির দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। এই ডিসেম্বরের শীতেও ঘেমে গেছে একদম! ওর মনে হচ্ছে সত্যি মাঠের মধ্যেই ও ছিল! এত জীবন্ত হয় স্বপ্ন!
মাহির ধাতস্থ হতে সময় নিল একটু। আজ বাড়িতে একা আছে ও। শরীরটা ভাল নেই। মা ভাইকে নিয়ে গেছে ডায়ালিসিস করাতে। ওর সামান্য জ্বর, তাই আজ আর ও যায়নি রিতুদার কাছে। তবে আর কোনওদিন যাবে কি না, সেটাও ভেবে দেখছে এই সু্যোগে। রিতুদা ওকে যে-পথে নামাতে চাইছে সেটা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। মা ঠিকই বলেছিল, এরা অজগর সাপের মতো। সম্পূর্ণ গিলে নিতে চায়!
মাহির হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের আলোটা জ্বালাল। সন্ধে হয়ে গেছে। ভাই আর মায়ের আসতে দেরি আছে এখনও। এই দিনগুলোয় মায়ের আসতে প্রায় রাত দশটা বাজে। ও মোবাইলটা তুলল। নতুন মোবাইল। সাবধানে ব্যবহার করে মাহির। পলি দিয়েছে এটা। এর মূল্যই আলাদা! সওয়া ছ’টা বাজে। কাল পঁচিশে ডিসেম্বর। ছুটি। আজ রাস্তাঘাটে তাই ভিড় বেশ। মাহিরের মনে হল, যতই শরীর খারাপ লাগুক, ওর আজ মায়ের সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল!
বিছানা থেকে মাটিতে পা ঝুলিয়ে বসল মাহির। মেঝেটা ঠান্ডা হয়ে আছে। পুরনো বাড়ির ভাঙা লাল মেঝে। মাটিতে একটা গেলাস পড়ে আছে। বিছানার পাশে প্লাস্টিকের টুলের ওপর রাখা ছিল গেলাসটা। ঘুমের মধ্যে পা ছুড়েছিল ও, তাই মেঝেতে টুলসমেত ওটা উলটে পড়ে গেছে। এটারই কি আওয়াজ হয়েছে?
মাহির উঠে গেলাসটা তুলল। প্লাস্টিকের টুলটাও সোজা করে ঘরের এক কোণে সরিয়ে রাখল। শোওয়ার আগে জ্বর কমানোর ওষুধ খেয়েছিল। কাজ দিয়েছে। ঘাম হচ্ছে। এখন শরীরটাও অত খারাপ লাগছে না। বরং খিদে পাচ্ছে। দুপুরে আজ বিশেষ কিছু খেতে পারেনি! ডাক্তার দেখিয়েছিল গতকাল। সে কতগুলো কী ওষুধ দিয়েছে কে জানে, গা বমি-বমি করছিল খাওয়ার পরে! এখন অবশ্য তেমন কিছু লাগছে না।
মাহির এবার সুইচবোর্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে টিউবলাইটটা জ্বালাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশের নরম আলোর সুইচটা বন্ধ করে দিল। এই ডিমলাইটটা নতুন লাগিয়েছে ও। একটা জ্যোৎস্নার মতো আলো হয় জ্বালালে! ভাল লাগে মাহিরের।
মাঝে মাঝে জীবনকে বোঝে না মাহির। স্যার বলতেন, “বুঝবি, বাঁচতে-বাঁচতে শিখবি, শিখতে-শিখতে বুঝবি!” কিন্তু তাও বোঝে না মাহির। জীবনের মানে কী! এই পৃথিবীতে যা করতে ভাল লাগে মানুষের তা করা উচিত নয়! যেমন তেল-ঝালের খাবার খাওয়া, কাজ না করে আড্ডা দেওয়া, অবৈধভাবে কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এই সব কিছুর মধ্যে যে একটা মজা আছে সেটা আসলে নিষিদ্ধ! কারণ, এতে নাকি পরে কষ্ট পেতে হবে। আর যা করতে ভাল লাগে না, যা করা কঠিন, যেমন পরিশ্রম, একাগ্রচিত্তে ফলের চিন্তা না করে কাজ করে যাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি, সেসব নাকি ভাল খুব! ভবিষ্যতে কোনও একদিন নাকি এর সুফল পাওয়া যাবে। এইসব ভাবলে আজকাল মাঝে মাঝে মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায় ওর। ঠিক ভুল সব গুলিয়ে যায়। কী করা উচিত সেটাও বুঝতে পারে না। আর তখনই পলির কথা ভাবে মাহির। পলি যেন ওর জীবনের মানেবই হয়ে গিয়েছে। পলির কথা ভাবলে ওর নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। ঠিক আর উচিতটা সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নিজের ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরটায় এল মাহির। মা যাওয়ার আগে বিছানা গুছিয়ে গিয়েছে। ভাই এসে শুয়ে পড়বে। এই দিনটায় শরীরের ওপর খুব ধকল যায়। ভাই জেগে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ।
ভাইয়ের বালিশটার দিকে তাকাল মাহির। কষ্ট হল দেখে। জড়পদার্থের মতো হয়ে গিয়েছে ভাই! ডাক্তাররা বলছেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। এবার কিডনিটা রিপ্লেস করে দেওয়া দরকার। মায়ের সঙ্গে মিলে গিয়েছে কিডনি। কিন্তু সেটা করতে গেলেও তো খরচ আছে। তা ছাড়া মায়ের ওপর যা ধকল যাবে, তাতে মা কি নিজে আর কাজ করতে পারবে? মাহিরের ওপরেই তো সব দায়িত্ব এসে জড়ো হবে। মাহির কী করবে তখন? এই ইলেভেন পাশ নিয়ে তো চাকরি পাবে না। খেলার দিকটাতেও আজকাল যায় না আর। ওই দিকেও যে অন্ধকার, সেটা বুঝে গেছে। তা হলে পড়ে রইল কে, রিতুদা? সেই রিতুদার কাছেই কি যেতে হবে শেষ পর্যন্ত? কী করবে ও?
গত পরশু মেজাজ খারাপ ছিল খুব। জ্বর-জ্বর লাগছিল বিকেল থেকে। কিছু ভাল লাগছিল না। তাই লালপাড়ার পাশের পেট্রোল পাম্পে গিয়ে বসেছিল ও।
পাম্পের কোণে একটা জায়গা আছে। সামান্য আবছা অন্ধকার। সেখানে নিমগাছের তলায় ভাঙা বেঞ্চে বসেছিল। টিটি ছিল সঙ্গে।
ওকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে টিটি বলেছিল, “তুই এমন বিলা হয়ে আছিস কেন রে?”
মাহির প্রথমে উত্তর দেয়নি। টিটি জোরাজুরি করায় বলেছিল, “আমার আজকাল কিছু ভাল লাগে না জানিস! কিচ্ছু ভাল লাগে না। মনে হয়, কী করছি এই জীবনটা নিয়ে? কেন এসব করছি? শালা পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি একদম। খেলাটাও ভেস্তে গেল। রিতুদা হারামি শালা, ফার্স্ট ডিভিশনে নাকি চান্স দেবে! তোর কথা শোনাও ভুল হয়েছে! শালা, কী করি! এত কনফিউজ়ড লাগে! জীবনে কী করব, আমি বুঝি না!”
টিটি শুনে হেসেছিল নিজের মনে। তারপর পকেট থেকে একটা গাঁজাভরা সিগারেট বের করে নাকের কাছে ধরে শুঁকেছিল। তারপর দেশলাই বের করে বলেছিল, “প্রেমে পড়েছিস মনে হচ্ছে! পলির?”
ধরা পড়ে গিয়ে সামান্য তুত্লে ছিল মাহির। বলেছিল, “না… মানে… আসলে…”
“ব্যস ব্যস! বুঝে গেছি! শালা তোদের এই প্রেম জিনিসটা বেকার। দেখ, তোর মতো মালকেও কীসব আন্টুবান্টু বকাচ্ছে! শালা, ঘোড়া রোগ পুষিস না। আমাদের প্রেম করতে নেই। খুব হিট উঠলে লাগিয়ে আসবি আসল জায়গা থেকে। এসব প্রেম মারাস না। পলিকে দেখেছিস! ফাইভ স্টার হোটেল টাইপ। শোন, ও হল ঘি! তোর কুত্তার পেটে হজম হবে না!”
“বাজে কথা বলিস না,” মাহির রেগে গেছিল, “আমায় রেস্তরাঁয় বন্ধুদের কাছে নিয়ে গিয়েছে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বারো হাজার টাকার মোবাইল কিনে দিয়েছে! এমনি-এমনি! ওর মনে কিছু নেই বলছিস! জানিস, আমার হাত ধরে কথা বলে!”
টিটি হাতের সিগারেটটা না ধরিয়ে দেশলাইটা রেখে দিয়েছিল পকেটে। হয়তো মনে পড়ে গেছিল, ওরা পেট্রোল পাম্পের পাশে বসে আছে। টিটি এরপর তাকিয়েছিল ওর দিকে। বলেছিল, “ভালই আছিস। আসলে কী জানিস, তোর পেট এখন ভরতি। তাই এসব নিয়ে ভাবছিস। অস্তিত্ব নিয়ে ন্যাকড়াপনা করছিস! জীবনে ওসব না ভেবে কাজ কর, কাজ। দেখবি, ওসব মাথায় আসবে না। কাজে ডুবে থাকলে আর কিছু মনে হবে না। শালা, আমায় খিস্তি করছে! মনে আছে, একদিন আমার এঁটো রোল কেমন খেয়েছিলিস! খিদের কথা ভুলে যাস না মাহির। জীবন এমন পোঁদে লাথাবে না! ওসব পলি-ফলি ভুলে যা! শালা প্রেম মারাচ্ছে! যেন সলমন খানের ছবি!”
খিদেটা পাচ্ছে ভালই। মাহির জানে বাড়িতে কোথায় বিস্কুট রাখা থাকে। ও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ির পেছন দিকে একচিলতে বারান্দার পাশে ছোট্ট রান্নাঘর। মা যতটা পারে গুছিয়ে রাখে। মাহির খুট করে রান্নাঘরের আলোটা জ্বালাল।
হলুদ বাল্ব। রান্নার তেল-কালিতে কেমন জং ধরা লোহার মতো হয়ে গেছে। অসুস্থ লাগছে দেখতে। ছায়া ছায়া আলো পড়েছে।
হলুদ টিনটা দেখতে পেল ও। একটা তাকের ওপর রাখা আছে। হাত বাড়িয়ে টিনটা নিল মাহির। তারপর নাড়াল। কিন্তু শব্দ হল না কোনও। কী হল? বিস্কুট নেই? মাহির টিনটা খুলে ভেতরে হাত ঢোকাল। আঙুলের ডগায় বিস্কুটের গুঁড়ো লাগল। কিন্তু বিস্কুট নেই!
টিনের কৌটোটা বন্ধ করে আবার জায়গায় রেখে দিল ও। তারপর এদিক-ওদিক দেখল। নাঃ, কিছু নেই! অন্য সময় একটু মুড়ি থাকে, আজ সেটাও পেল না।
খিদে পেলে পাগল-পাগল লাগে মাহিরের। এখনও লাগছে। যেহেতু দুপুরে ঠিকমতো খায়নি, এখন যেন তাই দ্বিগুণ খিদে পেয়েছে।
রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে আবার ঘরে ফিরে এল মাহির। দেওয়ালে ঝোলানো কিটব্যাগটা নামাল। তারপর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা প্লাস্টিক বের করে আনল। এখানে সামান্য একটু টাকা ও সরিয়ে রাখে। মা এটাতে হাত দেয় না।
মাসের শেষ, বাড়িতে বিশেষ টাকাপয়সা নেই এখন। যা ছিল মা নিয়ে গেছে। টেবিলের ওপরে রাখা ওর মানিব্যাগে কিছু খুচরো পড়ে আছে।
কিটব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা বের করে আনল মাহির। হাতে তোয়ালে মোড়া পিস্তল ঠেকল। শরীরটা কেমন যেন করে উঠল! এটার কথা আজ ভুলেই গিয়েছিল। নাঃ, এটা আর রাখবে না। রিতুদার সঙ্গে যখন কাজ আর করবে না তখন এটা ফেরত দিয়ে দেবে। আর যাই হোক, গুন্ডা হবে না ও। দরকার হলে কুলিগিরি করে খাবে, কিন্তু ওই কাজ করতে পারবে না।
প্লাস্টিকের প্যাকেটে পাঁচশো টাকার মতো সরানো আছে। মা এটা জানে না। মাহির প্যাকেট থেকে একশো টাকা বের করল।
ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েকটা পা গেলেই অশোকদার দোকান। রোল, চাউমিন, মাছের চপ বিকেল থেকেই বিক্রি হতে শুরু করে।
টাকাটা হাতে করে ভাবল মাহির। এক প্লেট এগ চাউ তিরিশ টাকা নেয়। সেটা কি খাওয়া ঠিক হবে? মায়ের আজ কত টাকা খরচ হবে কে জানে! হুট করে এখন খাবারের পেছনে এতটা টাকা খরচ করা ঠিক হবে না। কিন্তু পেটের মধ্যে একটা জ্যান্ত তিমি ঢুকে পড়েছে!
পাশে অবশ্য সতুয়ার দোকানও আছে। বিহারি ছেলে সতুয়া। সবাই ভুজিয়াওয়ালা বলে ওকে। ওর কাছ থেকে দশ টাকার মুড়িমাখা কিনে খেলেও হয়। যদিও মন চাইছে অশোকদার দোকানের রোল বা চাউ, কিন্তু ওই সেই ব্যাপার— যা ভাল লাগে, ইচ্ছে করে, তার সুদূরপ্রসারী ফল খারাপ হয়! পলির জিপিএস ওকে পথ দেখাচ্ছে আবার।
সতুয়ার দোকানেই যাবে ঠিক করল মাহির।
ও এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে ঘরের কোণে রাখা হাওয়াই চটিটা পরতে গেল। আর ঠিক তখনই পাল্লা ঠেলে ঘরে ঢুকে এল তুয়াদি।
এই সেরেছে! মাহির চোয়াল শক্ত করল। ও দ্রুত টাকাটা প্যান্টের পকেটে গুঁজে ফেলল। আর আসার সময় পেল না!
ও গম্ভীর হয়ে বলল, “মা নেই। ভাইকে নিয়ে গিয়েছে।”
“আমি জানি,” তুয়াদি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল।
কী বিপদ! আজ আবার! মাহিরের মুখটা তেতো হয়ে গেল নিমেষে। পেটের তিমিটাও যেন তুয়াদিকে দেখে ঝিমিয়ে পড়ল।
ও বলল, “আমার জ্বর তুয়াদি… আজ মানে…”
“শালা!” তুয়াদি নাইটির ওপরে চাপানো কার্ডিগানের হাতাটা গুটিয়ে এগিয়ে এল, “আমায় কী মনে হয় তোর! আমি সারাক্ষণ তোর সঙ্গে শোব বলে ঘুরি নাকি?”
ঘাবড়ে গেল মাহির, “না মানে… আমি তা বলিনি…”
তুয়াদি এগিয়ে এসে ভুরু কুঁচকে বলল, “তোকে আমার খুব ভাল লাগে। তাই সেক্স করতে চাই। না হলে সেক্স করার লোক কি আমার কম আছে! আমি তোর চেয়ে অনেক বড়। এটা বিদেশ হলে না হয় বিয়ে করতে বলতাম। কিন্তু এখানে তো আর তা হবে না। তাই… যাক গে!” তুয়াদি থামল। তারপর হাত বাড়িয়ে কপালটা ধরে দেখল। বলল, “বউদির কাছে শুনেছিলাম, তোর জ্বর। তাই এসেছি। জানি আজ ডায়ালিসিসের দিন। বুঝলি?”
মাহির দেখল তুয়াদিকে। এমন করে প্রেমের কথা বলল যেন দোকানে মাছ কিনতে গিয়েছে! ওর চোখে পড়ল তুয়াদির হাতটা। আঙুলগুলো খয়া-খয়া। হাতে অর্ধেক নেলপলিশ, গালে মেচেতা আসবে-আসবে করছে। নাইটির ওপর দিয়ে ভুঁড়ি বোঝা যাচ্ছে। দেখেই কেমন লাগল মাহিরের। ও কী করে এর সঙ্গে শোয়! নিজের অজান্তেই পলির পাশে তুয়াদিকে রেখে একটা তুলনা করে ফেলল মনে মনে! রেস্তরাঁয় পলির পাশ ঘেঁষে বসেছিল মাহির। কী সুন্দর গন্ধ পাচ্ছিল! আর হাতের সঙ্গে হাতের ঘষা লাগছিল ওর। এমন লাগছিল মাহিরের, ভাল লাগার সঙ্গে যৌনতাও টের পাচ্ছিল ও! মনে হচ্ছিল, কোনওদিন কি ও পলিকে আদর করতে পারবে? তুয়াদি যখন জোর করে, যখন ওকে বিছানায় চেপে ধরে ওর ওপর বসে, মাহির চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে পলিকে কল্পনা করতে থাকে। না হলে ও জানে এই যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না!
“কী হল?” তুয়াদি তাকাল ওর দিকে, “এমন মুখ করছিস কেন?”
“কিছু না, আমি বেরোব,” মাহির ছোট কথায় কাজ সারতে চাইল।
তুয়াদি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “তোর কি আমাকে বেশ্যা মনে হয়! জানিস, আমি তোর সঙ্গে ছাড়া আর কারও সঙ্গে শুই না। আমায় দেখলেই অমন বিলা চোপা করে থাকিস কেন! শোন, তোকে আগে বলেছিলাম না, একটা ছোটখাটো সেলাইয়ের জায়গা দেখেছি আমি। কাজ আছে। জনাদশেক মেয়ের সঙ্গে কথাও বলেছি। আমি একা পারব না। তুই আমার সঙ্গে কাজ করতে পারিস। ফিফটি-ফিফটি পার্টনার। করবি?”
মাহির চুপ করে গেল। আগেও একবার এমন কথা বলেছিল তুয়াদি। তা হলে কি সত্যি কাজটা এবার শুরু করবে? আর ওকে কাজ করতে বলছে কেন! মাহির তো জানে না কী কাজ। জানে না এর ভবিষ্যৎ কেমন। কিন্তু ওর মনে হল রিতুদার কাছ থেকে বেরোনোর এটাও একটা পথ হতে পারে। তবে তুয়াদি বলেই ভয় হয়। ওখানে আটকে গেলে পলির কাছে ও যাবে কী করে?
পলিকে ছাড়া আজকাল আর কিছু ভাবতে পারে না মাহির! জানে, পলিদের সঙ্গে ওর অবস্থার অনেক ফারাক। কিন্তু পলি কেমন মেয়ে সেটা তো জানে। যে সমাজসেবামূলক কাজ করে এত, সে কি আর-পাঁচজনের মতো হবে! তা ছাড়া, এই যে পলি ওকে নিয়ে বেরোয়, এই যে ওকে গিফ্ট দিল, ওকে মাঝে মাঝে রাতে মেসেজ করে, তার মধ্যে কি ন্যূনতম কোনও সংকেত বা ইঙ্গিত নেই? আছে। পলির চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে মাহির। সে টিটি যাই বলুক। ও তো জানে পলির সঙ্গে ওর কেমন সম্পর্ক!
ও তুয়াদিকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, “আমি দেখি। এখনও কিছু বলতে পারছি না।”
তুয়াদি তাকাল ওর দিকে। তারপর মুখটা নামিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমায় সবাই এমন করে দূরে ঠেলে দেয় কেন বল তো? আমি কি মানুষ নই? মা-বাবা নেই আমার। দাদারা অমন করে! তোকে ভাল লাগে আমার। তোর চেয়ে বয়সে বড় আমি, কিন্তু কী করব! ভাল লাগা কি ওভাবে বয়স দেখে আসে! তুই আমার সঙ্গে এমন করলে আমার খুব খারাপ লাগে! ঠিক আছে, তোকে করতে হবে না কাজ। আমার কাছে আসতেও হবে না। আমি তোর ভাইকে যেমন দেখছি দেখব। কেমন? আমি নিজে থেকে তোর কাছে আসি বলে কি আমার মানসম্মান নেই!”
আচমকা এমন কথায় অবাক হল মাহির। সত্যি বলছে তুয়াদি? নাকি এটাও ইয়ারকি! মানে, সত্যি ওকে আর তুয়াদিকে খুশি করতে হবে না!
তুয়াদি বলল, “যা, আজ থেকে ছেড়ে দিলাম তোকে। আর কিছু করতে হবে না। আমি একা, একাই ভাল। তোকে আর জড়াব না। আমি আসি।”
মাহিরের কথার অপেক্ষা না করে তুয়াদি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল!
মাহির কী বলবে কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু মনের ভেতরে কোথাও একটা হাঁপ ছাড়ল যেন! মনে হল বুকের ওপর থেকে বোঝা নামল! হঠাৎ হালকা লাগল মাহিরের। প্রথমে রিতুদা, তারপর তুয়াদি। এক-এক করে এইসব ভুলভাল মানুষগুলোকে কাটিয়ে দিচ্ছে ও। এটা ভাল ব্যাপার। পলির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে ও। মাহির ঠিক করল, জ্বরটা ছাড়লে আবার প্র্যাকটিসে যাবে। পতাদাকে ঠিক হাতে-পায়ে ধরে ম্যানেজ করে নেবে। মন দিয়ে ফুটবলটা খেলবে। স্পোর্টসম্যান ও, এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। পড়াশোনায় পারেনি, কিন্তু খেলাটায় পারতেই হবে ওকে। পলির জন্য নিজেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হবে। ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যাপারটাও দেখবে। কিছু একটা তো করবেই! কিন্তু আর এসব নয়। মানুষ হওয়ার সময় এসেছে! ও মাথা তুলে দেখল, টিকটিকিটা আরশোলাটাকে ধাওয়া করছে এখনও, কিন্তু বাগে আনতে পারছে না! চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মাহিরের। জীবন ওকে খাওয়ার জন্য হাঁ করে রয়েছে! কিন্তু ও সেটা হতে দেবে না। ডিফেন্ডার হয়ে খেলতে-খেলতে ও কেমন যেন গুটিয়ে ছিল এতদিন! বহুত হয়েছে ডিফেন্সিভ, আর নয়! এবার উলটো মার দেওয়ার সময় এসেছে।
নিজের ভেতরে কেমন একটা উদ্দীপনা আসছে মাহিরের। মনে হচ্ছে সব শালাকে একাই দেখে নিতে পারবে। শুধু পলি যেন পাশে থাকে। ও দেওয়ালে ঝোলানো মা কালীর ফোটোর দিকে তাকিয়ে প্রণাম করল। এসব কোনওদিন করে না মাহির। কিন্তু আজ মনে হল একবার স্মরণ করে! মনের মধ্যে একটা জোর পেল ও। ভাল কিছু করার জোর। মানুষের মতো কিছু করার জোর।
টাকাটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরোল মাহির। কিন্তু দরজায় তালা দিল না। টেনে দিল শুধু। এখানে সবাই চেনে ওকে। তা ছাড়া এখন বাড়ির সামনে সব পাড়ার ছেলেরা রয়েছে। ক্যারম বোর্ড পেতে খেলছে। মাহিরকে সবাই সমীহ করে চলে।
সতুয়ার দোকানটা তিন-চারটে বাড়ি পরে। মাহির দেখল বেশ ভিড় আছে। ও দাঁড়াল একপাশে। বয়স্ক মানুষ এসেছে কয়েকজন। তার মধ্যে পরানদাকেও দেখল।
পরানদা কিছু না বলে হাসল।
মাহির জিজ্ঞেস করল, “সব ঠিক আছে?”
পরানদা বলল, “হ্যাঁ। আর তোর অমন কিছু হয় না? সেদিন শালা ব্যাপক সাঁটিয়েছিলাম! আর হয় না?”
মাহির হাসল, “হলে জানাব। তুমি মুড়ি নাও। সতুয়া হাত বাড়িয়ে রয়েছে।”
পরানদা ঘুরে মুড়ি নিল এবার। তারপর হাত নেড়ে বেরিয়ে গেল।
“দশ টাকার মুড়ি মেখে দে, তেল কম দিবি, আর দুটো কাঁচালঙ্কা…” চার-পাঁচজনের মাথার ওপর দিয়ে নোটটা সামনে বাড়িয়ে দিল মাহির।
“আরও দশ টাকার দিস আলাদা করে,” মাহির পাশ থেকে গলা পেল একটা। মুখ ঘুরিয়ে দেখল টিটি এসে বাইকটা দাঁড় করিয়েছে পাশে।
“তুই?” মাহির অবাক হল।
“কেন? আসতে পারি না?”
মাহির হাসল, “তোর না আজ বিরাটি থেকে কীসব পেপার দিয়ে আসার কথা ছিল! যাসনি?”
“গেছিলাম। হয়ে গিয়েছে কাজ। রিতুদার কাছে পেপার দিয়ে এসেছি। পার্টি অফিসে শুনলাম তোর ওপর নাকি রিতুদা খচে আছে! তুই যাচ্ছিস না! ফোন তুলছিস না! আমি বললাম ওর জ্বর হয়েছে। কিন্তু মানছে না কেউ। কী করছিস মাহির? নিজের পেছনে নিজে আছোলা দিচ্ছিস! কেন? আগেও একবার এমন করেছিলি মনে আছে? মনে আছে রিতুদা কেলিয়েছিল তোকে!”
সতুয়া মুড়ির দুটো ঠোঙা বাড়িয়ে দিল। দুটোর টাকা দিয়ে ব্যালেন্স ফেরত নিল মাহির। টিটি নিজের টাকাটা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু মাহির দিতে দিল না।
মুড়ির ঠোঙা নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াল দু’জনে। ঝিমধরা একটা সন্ধে নামছে। আজ ধোঁয়াশা বেশ। স্ট্রিট লাইটগুলো কেমন আবছা হয়ে আছে। যেন চুনগোলা জলের মধ্যে মাছের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। মানুষজনকে কেমন জলরঙে আঁকা মনে হচ্ছে।
টিটি বাইকে বসে ঠোঙাটা খুলল। তারপর মুড়ি হাতে ঢেলে খেতে-খেতে বলল, “তোর কেসটা কী? কী হয়েছে তোর?”
মুড়ি মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চিবোল মাহির। সেই তিমিমাছটা কোথায় যে পালাল! তুয়াদির সঙ্গে কথা বলার পরে ওর খিদে-টিদে পাচ্ছে না একদম! তাও জোর করেই খেল।
“শালা, কালা নাকি? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?” টিটি বিরক্ত হল, “এটা কি শালা প্রেমের গল্প হচ্ছে! তুই মাঝে মাঝে এমন করবি আর আমি সেখান থেকে তোকে মানাতে আসব! আমায় শালা হিরো পেয়েছ?”
“আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি,” মাহির বলল গম্ভীর গলায়।
“কী? থার্ড আম্পায়ার হয়ে গেলি নাকি?” টিটি বাইক থেকে নেমে দাঁত দিয়ে ঠোঙাটাকে কামড়ে ধরে বাইকটাকে স্ট্যান্ড করাল। তারপর ঠোঙাটা হাতে নিয়ে বলল, “আবার কী ভূত ঢুকল মাথায়? দাবিটা কী তোর?”
“আমি কি গুন্ডা? আমায় কী ভাবিস তোরা?” মাহির অর্ধেক মুড়ি খেয়ে ঠোঙাটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলল দূরে রাখা একটা ভ্যাটের দিকে।
“না, গুন্ডা নয়। কিন্তু আমাদের সবারই কিছু কাজ আছে। তোরও আছে। এসব বলছিস কেন?”
মাহির কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিল।
“তা কী করবি ঠিক করেছিস?” টিটিও আর খেল না। কিন্তু ও ফেলল না ঠোঙাটা। বাইকের ডিকিতে রেখে দিল।
“আমি আবার ফুটবল শুরু করব। ট্রায়াল দেব বড় ক্লাবে। আমি ওটাই পারি। ওটাই করব। পলি যে-বাড়ির মেয়ে ওর সঙ্গে ভবিষ্যৎ দেখতে গেলে এসব করলে হবে না। প্লাস প্রাইভেটে এইচএস-টা দিয়ে দেব। অনেক ছোটলোকপনা হয়েছে। আর না।”
“ওয়াহ্ বেটা! আমরা এখন ছোটলোক! তোর সঙ্গে সারা জীবন থাকলাম আর এখন আমরা ছোটলোক! আর তোর ভাই? তার চিকিৎসা? সেটার কী হবে?”
মাহির চোয়াল শক্ত করে তাকাল টিটির দিকে। ছেলেটা সারা জীবন ওকে পেছনে টেনে গেল। কিছুতেই এগোতে দিল না। টিটি কি ওর সত্যি বন্ধু! পলির সঙ্গে ওর কিছু একটা হতে পারে জানার পর থেকেই টিটি কেন ওকে সারাক্ষণ এমন করে নেগেটিভ কথা বলে! ওকে কেন এই পাঁক থেকে বেরোতে দিতে চায় না!
মাহির চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি ঠিক করে নিয়েছি। পলির জন্য আমি সব পারি! আমি পরের দিন ওকে বলে দেব আমার মনের কথা। আমায় ভাল হতেই হবে।”
“শালা, এটা কে রে!” টিটি বিরক্ত হল, “এটা কি মানুষ না অন্য কিছু! কী শালা, সব মাথায় উঠে গেল নাকি? ভাইয়ের কথা ভাব। ওর চিকিৎসার কী হবে!”
মাহির উত্তর দিল না। এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্ন দিয়ে ও নিজেকে আটকে রাখবে না। এই প্রশ্নটা ওকে সামনে আলোর দিকে এগোতে দিচ্ছে না। ভাই! ভাইয়ের কী হবে! আরে বাবা, আগে নিজের কী হবে সেটা কি দেখবে না! আর ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবে। তেমন হলে পলিকে বলবে। ওর চেনাশোনা অনেক। ও কিছু করে দিতে পারবে নিশ্চয়ই। পলি যে ওকে পছন্দ করে, সেটা তো মাহির জানে।
“জানি না শালা কী করছিস!” টিটি মাথা নাড়ল, “পুরো ঝাড় কেস হয়ে গেছিস! প্রেম শালা বহুত বেকার জিনিস! ভাল উঠছিলি। কামাচ্ছিলি। সেখানে… এসব কঠিন কাজে মাথা গলাচ্ছিস! কেন কে জানে!”
মাহির বলল, “কঠিন কাজ কেন কঠিন জানিস? সেটা ঠিক বলে। ভাল বলে। যে-কোনও কঠিন জিনিস ভাল হয়। ঠিক হয়। সহজে ভাল কিছু করা যায় না টিটি। এটা বুঝিস না তোরা! আমার বয়স আছে এখনও। আমি ভাল কিছু করতে পারি। আমি গুন্ডা নই।”
টিটি তাকাল ওর দিকে। তারপর বাইকে চড়ে বসল। স্ট্যান্ড থেকে বাইকটা নামিয়ে বলল, “ভাইয়ের কথাটা ভাবিস। কে দেবে তোকে ছ’লাখ টাকা! স্বপ্ন আর বাস্তবটা এক নয়। পেছনে যখন পড়বে না, তখন পলি-টলি সব বেরিয়ে যাবে! পেট বড় বালাই গুরু! তুই প্রেমে পড়ে সব ভুলে গেছিস। শোন মাহির, আমি আছি। দরকারে বলবি। আমরা ছোটবেলার বন্ধু, তুই ভুলে যাচ্ছিস। কিন্তু আমি ভুলছি না।”
টিটি আর না দাঁড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল।
মাহির দেখল তাকিয়ে। ধোঁয়াশার মধ্যে ধীরে-ধীরে মিশে গেল টিটি। টিটি ওর বন্ধু, কিন্তু শুধু সেটা নিয়ে জীবন চলবে না। জীবনে ওপরে উঠতে গেলে পিছুটান ছাড়তে হয়। কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। পলির সঙ্গে কাল ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলবে মাহির। পলি নিশ্চয় সাহায্য করবে।
ও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল। মাকে কি একবার ফোন করবে? রাতের খাবারটা তা হলে নিয়ে নেবে সামনে থেকে। জুঁইদি সন্ধে থেকে রুটি-তড়কা নিয়ে বসে। কিনে নিলেই হবে।
কিন্তু তারপর আর ফোন করল না। টিটির কথাটা মনে পড়ল আবার। পেট বড় বালাই! রিতুদাও এমন বলেছিল না!
এই ডিসেম্বরেও যে কেউ এমন ঘামতে পারে রিতুদাকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না মাহির। সেদিনও একটা তোয়ালে দিয়ে বারবার করে মাথা আর মুখ মুছছিল লোকটা। মাহির গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। ওকে দেখে একটা লজেন্স ছুড়ে দিয়েছিল ওর দিকে। বলেছিল, “কী রে, আজকাল কী হয়েছে তোর! ভালই তো কাজ করছিলি। ক’দিন এমন ড্যাম্প মেরে আছিস কেন!”
মাহির কিছু না বলে চুপ করেছিল। রিতুদা ওকে সেই যে চুল ধরে এই ঘরে মেরেছিল, সেটা ভুলতে পারেনি। সেদিন কোথায় যেন কী একটা উপড়ে গিয়েছিল। নিজেকে এত ছোট আর তুচ্ছ মনে হয়েছিল যে, তারপর থেকে ওর মনটা কেমন হয়ে গিয়েছে যেন। এত ছোট কেউ কাউকে করতে পারে! হ্যাঁ, তারপর ও কাজ করছিল, কিন্তু সেটা করতে হয় বলে! রিতুদা কী করে ওকে অমন অপমান করতে পারল!
ও বলেছিল, “কিছু বলবেন দাদা!”
“হ্যাঁ, তাই তো ডাকলাম। সোনাঝুরির কেস পেকে গিয়েছে খুব। ফাইনাল স্টেজ বলতে পারিস। পার্টি হাইকম্যান্ড থেকে আমাকে বলা হয়েছে যা ঠিক হবে তাই করতে! শোন, তুই এখন থেকে ওইদিকে যাবি। বিজন সরখেল বলে একটা লোক আছে। ওর ওপর তারক চক্রবর্তীর লোকজন হামলা করতে পারে। তুই বিজনকে গার্ড দিবি। যন্তর রাখবি সঙ্গে। এটা ইমপর্ট্যান্ট। কিছু হলে চালিয়ে দিবি। শালা, আমি বুঝে নেব বাকিটা। তারকের খুব পেঁয়াজি বেড়েছে। হাইকম্যান্ডের কাছে আমার নামে নালিশ করেছে! সেখানেও দু’-একটা বুড়ো ঢ্যামনা আছে যারা কাট মানি খায় তারকের কাছ থেকে। তাদের জন্য হাইকম্যান্ড থেকে সরাসরি কিছু করা যাবে না তারকের ওপর। তাই আমায় বলা হয়েছে ব্যাপারটা দেখতে। সোনাঝুরিতে প্রোজেক্ট হতেই হবে। না হলে চাপ আছে। আমাদের সরকারের প্রেস্টিজ ওটা। প্লাস অত শ্রমিক! সামনে ভোট আসছে। বুঝতে পারছিস তো! বিজনের যেন কিছু না হয়।”
মাহিরের কী হয়েছিল কে জানে! আচমকা কী যেন একটা ছিঁড়ে গিয়েছিল ভেতর থেকে। ও বলেছিল, “আমি গুন্ডামো করতে পারব না রিতুদা।”
“কী?” রিতুদা প্রথমে বুঝতে পারেনি।
“আমি বন্দুক-পিস্তল নিয়ে ওসব করতে পারব না রিতুদা। আমি ভদ্রবাড়ির ছেলে। আমায় আপনি গুন্ডা পেয়েছেন নাকি?”
“শালা, কী বলছিস তুই! ব্যাপারটা মেটা অবধি তুই বিজনকে চোখে-চোখে রাখবি। এর জন্য এককালীন দু’লাখ দেওয়া হবে তোকে। প্লাস যা টাকা পাস, তা তো পাবিই। তোর ভাইয়ের কেসটাও আমরা সাল্টে দেব। এত টাকা কোনওদিন বাপের জন্মে দেখেছিস!”
“আমি পারব না, রিতুদা। আমি গুন্ডা নই। আমি প্লেয়ার। আপনি বলেছিলেন আমার ফার্স্ট ডিভিশন টিমে চান্স করিয়ে দেবেন, কিন্তু কিছুই তো হল না! আমি তো পাতি গুন্ডা হয়ে গেলাম!”
“শোন, আমাদের সবার কাজ থাকে পৃথিবীতে। যেটা যার কাজ, তাকেই মানায়। তুই নিজেও জানিস যে, তুই ঢপের প্লেয়ার! ওটাতে তুই কোনওদিন কিছু করতে পারবি না। যাতে পারবি সেই কাজ দিচ্ছি! এটা তোর কাজ। টাকা পাবি ভাল। টাকা দরকার মাহির। পেটের টান শালা বড়-বড় বাতেলার পেছনে দিয়ে দেয়! যা বললাম কর। ভাল হবে,” রিতুদা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আবার ঘামছিল গলগল করে। মাথার দু’পাশের শিরা ফুলে উঠেছিল।
দেখে ভয় লাগছিল মাহিরের। ওর মনে হচ্ছিল আবার যদি কিছু ছুড়ে মারে! আবার যদি এসে চুলের মুঠি ধরে! বুঝতে পারছিল এখানে বলে-কয়ে কিছু হবে না। তার চেয়ে সময় নিয়ে নিক কদিন। সুযোগ বুঝে ‘না’ বলে দেবে ফোনে। সব জায়গায় গায়ের জোর চলে না।
মাহির বলেছিল, “আমি একটু ভেবে নিই রিতুদা।”
“ভেবে নিই মানে?” রিতুদা খেপে গিয়েছিল, “শালা, তোকে ভাবতে বলেছি জানোয়ার! ভাবতে হলে ভাইয়ের কথা ভাব। তার অসুখের কথা ভাব। টাকা লাগবে না?”
মাহির চুপ করে গিয়েছিল। সবাই ওর এই একটা বিন্দুতে চাপ দেয়! একটাই বিন্দু, ভাই! পৃথিবী কেন সারাক্ষণ দুর্বল জায়গায় আঘাত করে! রিতুদারও তো ভাই ছিল। তা হলে? ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবন এমন একটা ভাই দিয়ে আসলে ওকেই পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছে!
“যা, কাল এসে ডিটেলটা বুঝে নিস। জানবি পেট বড় বালাই। শালা, সব কাপ্তেনি পেছন দিয়ে বেরোবে! এখন ফোট। কাল আসবি।”
বাড়ির দিকে এগোল মাহির। শীতের সন্ধে গাঢ় হয়ে আসছে। ধোঁয়াশার মনখারাপ চেপে আসছে চারিদিকে। সামনের পথ অজানা, কিন্তু তবু এগোতে হবে মাহিরকে। জীবনে দাঁড়াতে হলে শুধু অভিযোগ করলে হয় না। কাজ করতে হয়।
দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢুকল মাহির। আর ঢুকেই ঘাবড়ে গেল! আরে, পলি! দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে পলি। দরজা ভেজানো ছিল বলে ঘরে ঢুকে পড়েছে। কী করছে ও? আসার কথা তো ছিল না! তা হলে!
বুকের ভেতরটা কেমন করছে মাহিরের। তিমিমাছটা আবার জেগে উঠেছে, তবে এবার তার অন্য রকম দাবি! ফাঁকা ঘর। নির্জন বাড়ি! ওরা দু’জন। মাহির কোনওদিন তো ভাবতেই পারেনি এভাবে ও পলিকে পাবে! দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল মাহির। এমন সুযোগ আর পাবে না। ও আজকেই ওর কথাটা বলে দেবে পলিকে।
ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল মাহির। ওর ঘরে ঢোকার শব্দে পেছনে ফিরল পলি! সঙ্গে সঙ্গে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল মাহিরের। দেখল, পলির হাতে চকচক করছে পিস্তল! পাশের বিছানায় কিটব্যাগটা খোলা। তোয়ালেটা পড়ে আছে এক কোণে।
মাহিরের মনে হল পেট থেকে লাফ দিয়ে তিমি এবার বেরিয়ে আসবে বাইরে! পলির হাতে এটা এল কী করে? ইস, ব্যাগটা বেখেয়ালে কেন রেখে গিয়েছিল বিছানায়! পলি কী ভাবল ওকে! এখন কী হবে? কী করে ও পলিকে বোঝাবে যে আসলে ও খারাপ নয়! আসলে এটা রিতুদার! আসলে, পলির জন্য ও সব ছাড়তে পারে! আসলে… আসলে… আসলে…
মাহির লাভায় আটকে যাওয়া মানুষের মতো তাকিয়ে থাকল পলির দিকে। পলি ওর দিকে তাকিয়েই আছে। হাতের পিস্তলটা কাঁপছে সামান্য।
মাহির কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “পলি আমি… এটা আমার। মানে আমার না…”
পলি তাকিয়েই আছে!
মাহির বলল, “রিতুদা রাখতে দিয়েছে। আসলে নানা ঝামেলা হয় তো! তাই… আমি ছেড়ে দিয়েছি রিতুদাকে। ওই পার্টি ছেড়ে দিয়েছি। প্লিজ়… পলি প্লিজ়…”
পলি পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল ওর দিকে। তারপর পিস্তলটা তুলে এক চোখ টিপে তাক করার মতো করে বলল, “ঢিঁচক্যাঁওও!”
মাহির তাকিয়ে রইল। দেখল পলি হাসছে। যেন মজা পেয়েছে খুব! কেন হাসছে পলি! রেগে গিয়ে হাসছে কি? অবজ্ঞা করে হাসছে? ওকে কি নরকের কীট ভাবছে? ভাবছে, এ কেমন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করতে যাচ্ছে! কেন হাসছে পলি! কী বলতে চায় ও এই হাসি দিয়ে!
মাহির আবার অস্ফুটে বলল, “প্লিজ়…”
পলি পিস্তলটা ঘুরিয়ে দেখল ভাল করে। মুখে এখনও হাসি। তারপর জিনিসটা বিছানায় রেখে দিয়ে বলল, “এমন জিনিস ঘরে রেখে দরজা ভেজিয়ে বাইরে গেছিলে! জানো, আমি পিস্তল আগে কাছ থেকে দেখিনি। হাতে নিয়ে এই প্রথম দেখলাম! কী ভারী! চালাও কী করে?”
“আমি চালাই না,” মাহিরের মনে হল পলির সামনে কী করলে ও বুঝবে যে, মাহির সত্যি কথা বলছে! বুকের ভেতরে কেমন একটা করছে ওর। মনে হচ্ছে এত কাছে এসে সব এভাবে শেষ হয়ে যাবে! নিজেকে মনে মনে গালি দিল! ওর বোকামোর জন্য হল এটা! এমন করে কেউ কিটব্যাগটা রেখে যায় সামনে! সব যে নষ্ট হতে বসেছে! এখন কী করবে মাহির!
পলি হেসে বলল, “সে আমি বুঝতে পারছি। যাক বাবা…”
যাক বাবা? মানে? কে যাবে? কোথায় যাবে? বাবাই-বা আসে কোথা থেকে এর ভেতরে! পলি কী বলতে চাইছে! টেনশনে মাহিরের মনে হল, এক্ষুনি ও মাথা ঘুরে পড়ে যাবে!
পলি বলল, “তোমায় দিয়ে হবে…”
ওকে দিয়ে হবে? মাহিরের মাথায় ঢুকছে না কিছু। কী বলছে পলি? ও বলল, “পলি আমি অমন নই। ওটা আমার নয়। বিশ্বাস করো। আমি আসলে…”
পলি এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়াল মাহিরের। তারপর আচমকা হাত দুটো নিজের হাতে শক্ত করে ধরল। বলল, “পারলে তুমিই পারবে। আমায় প্লিজ় হেল্প করো মাহির। আয়্যাম ইন ট্রাবল।”
ট্রাবল! মাহির তাকিয়ে রইল পলির দিকে। ঘরের আলো যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। পলি ওর এত কাছে! সুন্দর গন্ধ আসছে পলির শরীর থেকে। কেমন একটা লাগছে মাহিরের। কেমন ঘোর এসে যাচ্ছে। ও যেন চোখ খুলে রাখতে পারছে না। পলির কোমরটা পেঁচিয়ে নিজের দিকে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে ওর। ওর শরীর আর মন যেন ওর কথা শুনছে না!
পলি বলল, “আমার স্যারের স্ত্রী আমায় খুব ভয় দেখাচ্ছে। আমার জীবন শেষ করে দেবে বলছে। লোক পাঠিয়েছিল আমার বাড়িতে। ও চায় স্যারকে আমি ছেড়ে দিই। বলে আমার বয়সি মেয়ে আছে স্যারের। কিন্তু আমি স্যারকে ছাড়া থাকব কী করে? তুমি বলো মাহির, প্রেম কি বয়স, অবস্থা, ন্যায়-অন্যায় বোঝে! বোঝে না। আমিই-বা কী করে বুঝব! স্যারকে ছাড়া আমি মরে যাব। তুমি স্যারের বউকে বা ওর গুন্ডাদের কিছু বলো। রিতুদাকে বলো যেন আমায় হেল্প করেন। তুমি পারবে। এই… এই পিস্তলটা নিয়ে ওদের সামনে একটু নাচাবে। ওরা ঠিক তোমার কথা শুনবে। আমায় প্লিজ় হেল্প করো। যা টাকা লাগবে আমি দেব। প্লিজ় মাহির… গুন্ডাদের গুন্ডারাই শায়েস্তা করতে পারে… আর কেউ পারে না। প্লিজ়…”
পলি এগিয়ে আসছে আরও। আরও কীসব বলছে। জড়িয়ে যাচ্ছে পলির কথা। পলি গালে হাত দিচ্ছে মাহিরের। কীসব বলছে। কিন্তু মাহিরের কিছু মাথায় ঢুকছে না। পলি ওর স্যারকে ভালবাসে! পলি অন্যকে ভালবাসে! আর গুন্ডা! গুন্ডা শায়েস্তা করতে পারবে গুন্ডাকে! কে গুন্ডা? মাহির? মাহিরকে পলি গুন্ডা ভাবে! তাই এসেছে নিজের নোংরামো ঢাকার জন্য! পিঠ বাঁচানোর জন্য!
পলিকে দেখল মাহির। কিন্তু মনে হল রোগা সেই ফুটবলারটা এগিয়ে আসছে। বলের ওপর ঘুরছে ওর পা। কাটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবে ওকে জীবন। জীবন! এটা জীবন! পলি টাকা দিতে চাইছে ওকে! ও কি গুন্ডা! ওকে দেখে লোকে ভয় পায়! তাই কি সতুয়া সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওকে আগে মুড়ি দিয়ে দিল! এটা কী হচ্ছে! সবাই কীভাবে দেখছে! ওকে টাকা দিলে ও শায়েস্তা করে দেবে লোকজনকে!
পকেটে ফোনটা নড়ছে। কে ফোন করছে! কেন ফোন করছে একটা গুন্ডাকে! পলির সুন্দর মুখটা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে বীভৎস একটা মুখ! পলি টাকা দিতে চাইছে। বলছে, ওরা তো নিয়ে থাকে। নিয়ে থাকে? মাহির নেবে?
যন্ত্রের মতো পকেট থেকে ফোনটা বের করল মাহির। রিসিভ করে কানে লাগাল। রিতুদা। রিতুদা কীসব বলছে। রাগ করছে। কেন মাহির জানাচ্ছে না সেই নিয়ে রাগ করছে। সামনে পলি কীসব বলছে। ছেলেটা বল নিয়ে চলে এল প্রায়। ওকে কাটিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে। বিকেলের রোদ অনেকটা সরে গেছে দেবদারুর মাথা থেকে। পতাদাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। শুধু চিৎকার ভেসে আসছে। কারা যেন হল্লা করছে খুব। আর ভাই শুয়ে আছে। ওর চিররুগ্ণ, অসহায় ভাই আজ দাঁড়িয়েছে গোলে, সুমিতের জায়গায়। ছেলেটা মাহিরকে টপকে গেলেই ভাইকে একা পাবে। ভাইকে কি একা ছেড়ে দেবে মাহির! ঘুমের মধ্যে যে ভাই ওকে খোঁজে, ওর নাম ধরে ডাকে, তাকে একা ছেড়ে দেবে! কী করে দেবে! নিজের ভাইকে কী করে একা ছাড়বে মাহির!
ও হাত তুলে থামাল পলিকে। তারপর ফোনে রিতুদাকে বলল, “আমি রাজি রিতুদা। টাকাটা একটু বাড়িয়ো। ভাইটার অপারেশন সামনে। কেমন?”
তারপর ফোনটা রেখে তাকাল পলির দিকে। পলি তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কাঁধের ওপর কেটে বসা ব্রেসিয়ারের কালো স্ট্র্যাপটা দেখা যাচ্ছে! সেইদিকে ভাল করে তাকাল মাহির। গুন্ডা তো ও! গুন্ডারা এমন করতেই পারে! ও হাত দিয়ে স্ট্র্যাপটা ধরে জামার তলায় গুঁজে দিল। তারপর বলল, “দু’লাখ লাগবে। কাজ হয়ে যাবে। একপয়সা কম নয়। রাজি হলে বলো। না হলে ফোটো!”
সন্ধে গাঢ় হয়ে এল কলকাতায়। সামনে ধোঁয়াশা। মনে মনে ভাইয়ের দিকে তাকাল মাহির। তারপর সেই আবছা, ধোঁয়া ঢাকা পথের দিকে এগিয়ে গেল, একা!