তিরিশ
মাঝে মাঝে বাড়ি বদল করা ভাড়াটে বাসিন্দাদের নিয়তি। ভাড়ার ঊর্ধ্বগতি থামার কোনও লক্ষণ নেই, বরং লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চালের দাম থেকে মাছের দাম সবাই মাথা তুলে লম্বা হয়ে যাচ্ছে, ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল, সেই ভাড়া এখন দ্বিগুণ। সব জিনিসেরই দাম বাড়ে, শুধু টাকার দাম কমে।
যতই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক শুরুতে, কয়েক বছরের মধ্যেই অধিকাংশ ভাড়াটে-বাড়িওয়ালার সম্পর্ক হয়ে যায় অহি-নকুলের মতন। বাজারদর অনুপাতে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াতে চাইবেই, ভাড়াটে বেচারির উপার্জন না বাড়লে সে-ই বা বেশি দেয় কী করে, সুতরাং শুরু হয় মন কষাকষি, কথা বন্ধ, জল বন্ধ, কোথাও কোথাও লাঠালাঠিও বাদ থাকে না। এর পরের পর্ব মামলা-মোকদ্দমা এখন শুনছি, ভাড়াটেরা বাড়ি ছাড়ার সময় বাড়ির মালিকের কাছ থেকেই প্রচুর টাকা আদায় করে নেয়, তা কয়েক লক্ষও হতে পারে, কারণ মামলায় বাড়িওয়ালাদের জয়ের আশা সুদূর পরাহত, আইন ভাড়াটিয়াদেরই বেশি পক্ষে। সে সময়ে আমরা বাড়িওয়ালার তহবিল থেকে টাকা খসাবার মতন একটা অদ্ভুত কথা একেবারেই শুনিনি, আর মামলা করার মতন সময় বা মানসিকতা আমার বাবার একেবারেই ছিল না। বাড়িওয়ালা বিশেষ চাপ দিলে আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতাম অন্য জায়গায়।
বাগবাজারে বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়িওয়ালা আমাদের উঠে যাবার নোটিস দিয়ে অশেষ উপকার করলেন। শশব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে আমরা এমন একটা বাড়ি পেয়ে গেলাম, তেমন ভালো বাড়িতে আমরা আগে কখনও থাকিনি। এবং অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি যে ভাড়া আগের বাড়ির চেয়েও কম। এই সৌভাগ্যটি ঘটল বাবার এক প্রাক্তন ছাত্রের সৌজন্যে। তিনি সপরিবারে এমন একটি বাড়িতে থাকতেন, যেটাকে বেওয়ারিশ বলা যায়। বাড়িওয়ালার কোনও খোঁজ নেই। বছরের পর বছর কেউ খোঁজ নিতে আসেনা, আগেকার ঠিক করা ভাড়া রেন্ট কন্ট্রোল অফিসে মাসে মাসে জমা দিয়ে এলে ভাড়াটের পুরোপুরি অধিকার বজায় থাকে। সেই ছাত্রটি কোথাও বদলি হয়ে যাচ্ছেন, তিনি এমন বাড়িটি তার মাস্টারমশাইকে উপহার দিয়ে যেতে চান।
শ্যামপুকুর স্ট্রিটে সমাজপতি স্মৃতি সমিতির লাইব্রেরির উল্টোদিকের গলিতে সেই বাড়ি। এর আগে আমরা শুধু দু’-আড়াইখানা ঘরের ফ্ল্যাটে থেকেছি, কখনও একতলা ছেড়ে দোতলায় উঠিনি, এটা একেবারে পুরো বাড়ি, এবং দোতলা। এই প্রথম আমি যে শুধু সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ঘর পেলাম তাই-ই নয়, মা-বাবা, ভাই-বোনেরা সবাই দোতলায়, একতলায় আই অ্যাম দা মনার্ক অফ অল আই সার্ভে বলতে পারি অনায়াসে।
সামনের দিকের বসবার ঘরটি হয়ে গেল কৃত্তিবাস পত্রিকার কার্যালয়, সেখানে অফুরন্ত আড্ডার সুযোগ। আমার স্বাধীনতাও বেড়ে গেল অনেকখানি, তখন উড়নচণ্ডীপনার চূড়ান্ত অবস্থা, কত রাতে বাড়ি ফিরি তার ঠিক নেই, আমার ভাত ঢাকা থাকে একতলায়, আমি চোরের মতন পা টিপে টিপে ঢুকি, ওপরতলায় সবাই তখন ঘুমে আচ্ছন্ন, শুধু মা সদর দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে আমার ফেরা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর ঘুমোতেন, এবং সকালবেলা ভাতের থালাটা পরীক্ষা করে দেখতেন, আমি খেয়েছি কি না।
বাড়িটার চেহারা অবশ্য খুবই কদাকার, বাইরে থেকে কেউ দেখলে ভয় পেয়ে যাবে। প্রায় সুকুমার রায়ের বুড়ির বাড়ির মতন অবস্থা। বাড়িওয়ালার খোঁজ নেই, তাই বহুকাল কোনও রকম রঙের পলেস্তারা দেওয়া কিংবা সংস্কার করাও হয়নি। দোতলায় রাস্তার দিকে একটা বারান্দা এমন বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে যে, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে, অন্যান্য ঘর থেকেও মাঝে মাঝেই ইট ও চলটা খসে খসে পড়ে। তা পড়ুক, তবু তো খোলামেলা, হাত-পা ছড়িয়ে থাকার মতন নিজস্ব একটা গোটা বাড়ি। এর অবস্থানটিও খুব সুবিধেজনক, বাবার ইস্কুল মাত্র দু’-তিন মিনিটের রাস্তা। অত কাছে একটা ভালো লাইব্রেরি। ওটা সিনেমাপাড়া, মা অনায়াসে ম্যাটিনি শোতে বাংলা সিনেমা দেখে আসতে পারেন। শুনেছিলাম, এককালের খ্যাতিমান নায়ক রবীন মজুমদার ওই রাস্তাতেই থাকেন, তাকে দেখিনি অবশ্য, প্রায়ই দেখতাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে, তিনি লেখকও ছিলেন। কিন্তু মহালয়ার ভোরে রেডিয়োতে আনুনাসিক চণ্ডীপাঠের জন্য তাঁর খ্যাতি তাঁর লেখকসত্তাকে ঢেকে দিয়েছিল।
ওই রাস্তায় আরও একজন তৎকালীন উপন্যাস-লেখক থাকতেন, প্রাণতোষ ঘটক, তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় না হয়েই একবার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন দৈনিক বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক এবং খুব প্রতিপত্তিশালী মানুষ। সে সময় বসুমতী সাহিত্য মন্দির ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। খবরের কাগজ ছাড়াও সেখান থেকে প্রকাশিত হত মাসিক ও সাপ্তাহিক বসুমতী এবং সুলভে বহু অমূল্য ক্লাসিক গ্রন্থ। বসুমতী সংস্করণের অনেক সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ পড়ে আমরা খুবই উপকৃত হয়েছি।
কবিতার সঙ্গে টাকা-পয়সার কোনও সম্পর্ক নেই, উপার্জন বৃদ্ধির জন্য আমি বিভিন্ন বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় পৃষ্ঠার জন্য গল্প লিখে পাঠাতাম। ছাপাও হয়ে যেত, পেতাম প্রতিটির জন্য দশ-পনেরো টাকা। বসুমতীর রবিবাসরীয়তেও প্রকাশিত হল একটি গল্প, ছবিটবি দিয়ে। তারপর মাসের পর মাস কেটে যায়, সেই গল্পের পারিশ্রমিক, যার গালভরা অন্য নাম সম্মানদক্ষিণা, তা আর আসে না। আমি পত্র-পত্রিকার অফিসে তখন পর্যন্ত যাইনি, ডাকে লেখা পাঠাই, ছাপা হলে ডাকেই পত্রিকার কপি আসে, কয়েক জায়গা থেকে মানিঅর্ডারও আসে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম বলে ধরে নিয়েছিলাম। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে আড্ডার মধ্যিখান থেকে উঠে দু-একবার ‘পরিচয়’ পত্রিকার দফতরে গেছি দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, সেখানেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দর্শন পাই। আর ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার দফতরে আমি গিয়েছিলাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি পেয়ে, তিনি সেখানে সন্ধেবেলা দফতর সামলাতেন। কবিতা মনোনীত করে রেখেছিলেন আগেই, তবু ডেকেছিলেন, কারণ কৃত্তিবাসের দলবল সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল ছিল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছিলেন সবার কথা। ‘দেশ’ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার অনেকগুলি লেখা ছাপা হয়ে গেলেও আমি কখনও ঢুকিনি সুতারকিন স্ট্রিটে (তখন রাস্তাটির এই নামই ছিল), ওখানকার নতুন কার্যালয় ভবনটিতে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি চিঠি পেয়ে, প্রথম পা দিই। এখানেও কোনও লেখার আলোচনার জন্য নয়, নীরেনদা আমাকে ডেকেছিলেন একটি নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারে। ওঁর একটি কাব্যনাটকের অভিনয়ের মহড়া তখন চলছিল দিলীপ রায়ের পরিচালনায় (ডি এল রায়ের ছেলে এবং রজনীকান্ত সেনের নাতি, এই দুই গায়ক দিলীপ রায়ের কথা আমরা জানি, তৃতীয় দিলীপ রায় ছিলেন কবি।)। নীরেনদা হরবোলায় আমার অভিনয় সম্ভবত দেখেছিলেন, তাই আমার অভিনয়-প্রতিভা সম্পর্কে আশান্বিত হয়েছিলেন। দু’-একবার রিহার্সাল দিয়ে কেন যেন শেষ পর্যন্ত সে-নাটকে আমার মঞ্চে নামা হয়নি। কবিতা না লিখে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেতা হবার সম্ভাবনা আমার যথেষ্টই ছিল, কিন্তু ও লাইনে আমি লেগে থাকতে পারিনি।
এসব অনেক পরের কথা, তার আগে বসুমতী, কারও আমন্ত্রণ ছাড়াই সেখানে যেতে হয়েছিল আমাকে। কফি হাউসের বন্ধুরা বলল, বসুমতী অফিসে নিজে না গেলে টাকা পাওয়া যায় না। তাই গেলাম একদিন, চেনার কোনও অসুবিধে নেই। বউবাজার স্ট্রিটে বিশেষ দ্রষ্টব্য বাড়ি। ভেতরে ঢুকে, সিড়ি দিয়ে উঠতেই দেখি সামনেই সম্পাদকের ঘর, দরজার বাইরে তাঁর নামও লেখা। আমি আমার উদ্দেশ্যর কথা ব্যক্ত করতেই তিনি বিরক্তভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অতি কটু মুখভঙ্গি করে বললেন, টাকা? যাও, যাও এখান থেকে!
এ কথা ঠিক, এমন তুচ্ছ ব্যাপারে স্বয়ং সম্পাদককে বিরক্ত করা অনুচিত। কিন্তু আমি তো অনভিজ্ঞ। তখনও দাড়ি-গোঁফ কামাই না। প্রথম বাক্যটিতে বিনয়েরও অভাব ছিল না। তিনি বলতেই পারতেন, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ নাও। কিংবা কাউকে ডেকে আমাকে যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারতেন, তিনি তা করলেন না। পোকামাকড়ের মতন অবজ্ঞা করলেন আমাকে।
যে সম্পাদক তরুণ লেখকদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করেন না, তাঁকে আখেরে পস্তাতেই হয়। কারণ, প্রবীণ বা খ্যাতিমান লেখকরা শারীরিকভাবে অজর, অবিনশ্বর নন, তরুণদের জন্য রাস্তা খোলা রাখতেই হয়। তা ছাড়া কী করে ভুলে যান যে তাঁরাও এক সময় তরুণ ছিলেন?
লেখা ছাপা হয়েছে, অথচ টাকা পাব না কেন? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, টাকা? তোমার নাম ক’জন জানে? তোমার মতন নতুন একজনের লেখা আর নাম ছাপা হয়েছে, তাই তো যথেষ্ট!
এমন কথা শুনেও আত্মাভিমানে ঘা লাগবে না, এরকম কোনও তরুণ লেখক থাকতে পারে? আমি তেজের সঙ্গে বললাম, নতুন আর পুরনোতে কী যায় আসে, আপনার পত্রিকায় এক পৃষ্ঠা জুড়ে আমার গল্প ছাপা হয়েছে, সেই জায়গাটার দাম দেবেন না? তা হলে ছাপতে গেলেন কেন?
তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে একটা পাঁচ টাকার নোট আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, যাও। বিদায় হও!
আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকাটা তুলে হাতের মুঠোয় গোল্লা পাকিয়ে তাঁর দিকে আরও জোরে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, আমি কি ভিখিরি নাকি? এ টাকা দিয়ে আপনার বাড়ির ছেলেমেয়েদের চানাচুর খাওয়াবেন।
তিনি হেড অফিসের বড়বাবুর মতন রেগে আগুন, তেলেবেগুনে হয়ে ঘন ঘন বেল টিপে ডাকতে লাগলেন দারোয়ানকে। কিন্তু দারোয়ানের হাতে গলা ধাক্কা খাবার আগেই আমি দৌড়ে নেমে এসেছি রাস্তায়।
এই অপমানের জন্য অসম্ভব রাগে জ্বলেছি বেশ কিছুদিন। প্রায়ই দাঁতে দাঁত চেপে ভাবতাম, নিশুতি রাতে একদিন কেরোসিন তেল নিয়ে গিয়ে বসুমতী সাহিত্য মন্দিরে আগুন জ্বেলে দিয়ে আসব। কেরোসিনের টিন জোগাড় করে উঠতে পারিনি বলেই হয়তো সে সঙ্কল্প কাজে পরিণত হয়নি।
সম্ভবত আমার মতন আরও অনেক তরুণ লেখকের ক্রোধ ও অভিমানের দরুনই বসুমতী সাহিত্য মন্দির ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে শুরু করে। ওরকম ঐতিহ্যসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরের মধ্যেই একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক পরে রাজ্য সরকার সেটি অধিগ্রহণ করেও রক্ষা করতে পারেননি।
মাঝে মাঝে এরকম দু’-একটা গল্প লিখতাম বটে, কিন্তু গদ্য লেখায় ঠিক মন ছিল না। প্রকৃত আনন্দ কবিতার প্রথম পঙক্তিটি বিদ্যুৎ ঝলকের মতন অকস্মাৎ উদ্ভাসিত হওয়ায়, সঠিক শব্দটি খুঁজে পাওয়ার জন্য যে আকুলি-বিকুলি তাতেও আছে সুখ, কোনও কোনও যন্ত্রণাও যেমন মধুর। তবে গল্প লেখার জন্য মানি অর্ডারে পনেরো টাকা পেলেও যে খুবই চনমনে বোধ করতাম, তাও ঠিক।
আমাদের এ-বাড়ির দোতলার বিপজ্জনক ঝুল বারান্দাতে মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিয়ে দাড়ালাম। কারণ সরু রাস্তার ওপারের দৃশ্যটি বড় নয়নাভিরাম। সেখানে কোনও বনেদি ধনীর বাগান সমেত প্রকাণ্ড বাড়ি। অনেকেই তখন এই ধরনের বাড়িকে রাজবাড়ি বলত, অনেক সভ্য দেশের নগরীর মতন কলকাতারও বেশ কিছু বাড়ির সামনে বা পেছনে বাগান থাকত। লন্ডনের কোনও কোনও পল্লীতে যেমন একচিলতে হলেও প্রত্যেক বাড়িতে বাগান রাখা বাধ্যতামূলক। কলকাতার ব্যক্তিগত মালিকানার বাড়িগুলির সেইসব বাগান এখন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছু নব্যধনী মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের বাড়িতে সে রকম বাগান এখন থাকলেও থাকতে পারে, বাঙালিদের আর বাগান পোর ক্ষমতা নেই। শ্যামপুকুরের মোড়ে যে মিত্র বাড়িতে আমি টিউশানি করতাম, সে বাড়ির বাগান যেন একপ্রান্ত থেকে শেষ দেখা যায় না, এ বাড়িটির বাগান তেমন বড় নয়, এবং উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, পথচারীরা দেখতে পায় না, কিন্তু একেবারে পাশেই দোতলার বারান্দা থেকে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ পরিদৃশ্যমান। অনেক রকমের গাছপালা ফুলে ফলে ভরা, প্রচুর পাখি আসে সেখানে। দেখতে দেখতে আমার মনে হত, এই বাগানটির প্রকৃত মালিক কে? জমিটির মালিক ও বাড়ির শরিকরা, কিন্তু যারা দেখে, তারাও তো বাগানের শোভার অংশীদার। বকুল, কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধের ঝাপটা পর্যন্ত নাকে আসে।
এক একদিন সন্ধের সময় সেই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে একটি রমণীর চিৎকার ও জোর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতাম। খুবই রহস্যময় মনে হত, যেন কোনও শত্রুপক্ষের রাজকন্যাকে ওখানে বন্দিনী করে রাখা হয়েছে। পাড়ার লোক অবশ্য বলত, ও বাড়ির একটি বউ বদ্ধ ও হিংস্র ধরনের পাগল, তাই তাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়, কিন্তু আমার মনে তখন বন্দিনী রাজকন্যার চিত্রটিই বদ্ধমূল হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে কবিতা লেখারও চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। কবিতার মধ্যে কাহিনীর আভাস তো থাকতেই পারে, টি এস এলিয়ট কিংবা আঁরি মিসো’র কবিতা পড়ে তা আমরা জেনে গেছি, তবু কিছু কিছু কাহিনী যেন গদ্যভাষা দাবি করে। সে গল্পটি অবশ্য আজও লেখা হয়নি।
বাবা এ বাড়িতে এসে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম তাঁর শরীর আর নিতে পারছিল না। আমার ক্ষুদ্র চাকরির উপার্জনেও তেমন কিছু সাহায্য হয়নি। অল্প বয়স থেকে দেখেছি, বাবা ছটফটে স্বভাবের, জোরে জোরে হাঁটেন, এখন তার চলাফেরা অনেক শ্লথ হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে রাস্তায় থেমে গিয়ে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। অথচ তাঁর বয়স বেশি না, সদ্য পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। রক্তে উচ্চচাপ ও শর্করা অধিকাংশ শিক্ষকের নিয়তি, তা তো তাঁর আছেই৷ কিছুদিন আগে থেকে তাঁর এক অদ্ভুত ধরনের হাঁচি শুরু হয়েছে। তিনি সিগারেট খান না কিন্তু সব সময় নস্যি নেন, এমনকী যখন হাতে নস্যি থাকে না, তখনও দুটি আঙুল নস্যি ধরার ভঙ্গিতে থাকে। যারা নতুন নস্যি নেয়, তারা হাঁচবেই, পাকা নস্যিখোরদের কিন্তু হাঁচি আসে না। এত বছর নস্যি নেবার পর বাবা হাঁচতে শুরু করলেন, বিরাট জোরে, একবার শুরু হলে ত্রিশ-বত্রিশবারের কমে থামে না। তখন তাকে খুবই অসহায় দেখায়। ডাক্তারেরা জানালেন, এটা এক প্রকারের হৃদরোগ, এর নাম ডাইলেশান অফ হার্ট!
চাকরি করতে করতে আমি বাবা-মাকে খুশি করার জন্য একটা কাজ করে ফেলেছিলাম, আমি গ্র্যাজুয়েট হবার পর আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি বলে আমার মায়ের মনে একটা গোপন দুঃখ ছিল। তার মামাতো ভাইরা উচ্চশিক্ষিত, আর তার ছেলেরা কেউ এম এ পাস করবে না? আমার মেজো ভাই অনিল অবশ্য এম এ পাস করেছিল যথা সময়ে, কিন্তু তা অনেক দূরের কথা। তখনও এম এ পাস সম্পর্কে অনেকের মোহ ছিল। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনোয় আমার আর আগ্রহ ছিল না, কিন্তু মায়ের ক্ষোভের কথা জানতে পেরে আমি ভাবলাম, তা হলে একটা এম এ পরীক্ষা দিলেই তো হয় প্রাইভেটে। অর্থনীতি সম্পর্কে আমার ভীতি জন্মে গিয়েছিল, সবচেয়ে সহজতম উপায় বাংলায় এম এ ডিগ্রি অর্জন করা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন সহজ হয়নি!
যতদূর মনে পড়ে, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই, দেবেশ রায়ও সেবার বাংলায় এম এ পরীক্ষা দেয়। এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায় আমারই মতন বি এ পাসের পর কোথাও চাকরি নিয়ে নির্দিষ্ট বছরের দু’ বছর পরে এম এ পরীক্ষায় বসে। আমি তখন চাকরি, টিউশানি ও কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদনায় খুবই ব্যস্ত, সময় খুব কম, তারই মধ্যে কালিদাস বসু নামে এক বন্ধুর বাড়িতে পড়াশুনো করতে যাই মাঝে মাঝে, সেখানে মোহিত, শিবশম্ভু পাল, দিব্য ভট্টাচার্য ও নিতাই পালের মতন ভালো ছাত্রেরা অনেক নোট তৈরি করে রাখে। আমাদের অন্য বন্ধু ফণিভূষণ ভট্টাচার্য আগেই যথাসময়ে ভালো রেজাল্ট করে পাস করেছে। তার নোটও আমাদের কাজে লাগত। আবার কখনও যাই দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। দীপেনের পারিবারিক অবস্থানটি বিচিত্র, সে কট্টর কমিউনিস্ট হলেও তার এক দিদি ও পিসি, মায়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও পূরবী মুখোপাধ্যায় শুধু কংগ্রেস নেত্রী নন, সে আমলে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। আমি রাজনীতি থেকে বিযুক্ত হলেও দীপেনের সঙ্গে ছাত্রজীবনের পরেও বেশ কয়েক বছর আমার গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল, যদিও মাঝে মাঝে খুব তর্ক হত, আমার তুলনায় দীপেনের শরীরের আয়তন অর্ধেক হলেও এক এক সময় সে বলত, এক থাপ্পড় মারব!
আমি প্রচুর বাংলা বই পড়েছি বলে মনে করেছিলাম, বাংলার এম এ তুড়ি দিয়ে পেয়ে যাব। কিন্তু বই পড়া বা বাংলা জানা আর পরীক্ষা এক নয়। বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী মুখস্থ করতে হয়, পালি ও প্রাকৃত ভাষা শিখতে হয় কিছুটা, এসব ধারণা ছিল না। কিন্তু একবার জলে নেমে সাঁতার না কেটে তো উপায় নেই। অন্যদের তুলনায় অনেক কম প্রস্তুতি নিয়ে আমি বসলাম পরীক্ষা দিতে। দীপেনের প্রতিভায় আমি এমনই মুগ্ধ ছিলাম যে আমার বিশ্বাস ছিল, দীপেনই সেবার প্রথম হবে।
মোহিতের মনে আছে কি না জানি না। সেবারে আমরা এম এ পরীক্ষাতেও টুকলি করার চেষ্টা করেছি। মাঝে মাঝেই সংস্কৃত শ্লোকের উদ্ধৃতি ছিটিয়ে দিতে পারলে রচনা ও অন্যান্য উত্তরপত্রের গৌরব বৃদ্ধি হয়। কিন্তু তত সংস্কৃত তো মনে গাঁথা নেই। একজন কেউ বন্ধু বুদ্ধি দিল, পরীক্ষা হলের হাই বেঞ্চে কাঠের ওপর কপিইং পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখে রাখলে অন্য কেউ দেখতে পায় না, কাগজ নয় বলে ধরা পড়ারও ভয় নেই। তাই পরীক্ষা শুরু হবার বেশ আগে দ্বারভাঙ্গা হলে ঢুকে হাইবেঞ্চে অনেক সংস্কৃত শ্লোক লিখে রাখলাম! কিন্তু হায় নিয়তি! ঠিক মতন আলো না থাকলে কপিইং পেন্সিলের লেখা পড়া যায় না। আমাদের বসবার জায়গার কাছেই একটা জানলা। ইনভিজিলেটর বা পরিদর্শক মশাই সেই জানলায় হেলান দিয়ে আগাগোড়া একটা ডিটেকটিভ বই পড়তে লাগলেন। আমাদের কাছে কাগজ বা বই থাকলেও তা দেখে দেখে লেখা যেত। কিন্তু আলোর অভাবে কপিইং পেন্সিলের কোনও লেখাই কাজে লাগানো গেল না। সে ভদ্দরলোককে তো আর সরে যেতে বলতে পারি না!
এরপর কিছুদিন আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ সময় কেটেছে। তখন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই বিভিন্ন অধ্যাপক-পরীক্ষকের কাছে নম্বর জানতে চাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আটশো নম্বরের পরীক্ষা, প্রতিটি পেপারে পঞ্চাশ পঞ্চাশ দুটি ভাগ। কোনও অর্ধেক পেপারে পনেরোর কম নম্বর পেলে সে নম্বর আর যোগ হয় না। বন্ধুরা বিভিন্ন অধ্যাপকের কাছে গিয়ে নম্বর জেনে উল্লসিত হচ্ছে, আমার সময় কম তাই যেতে পারি না, শুধু একদিন গেলাম দল বেঁধে সুকুমার সেনের কাছে। তিনি উদারভাবে বলে দিচ্ছেন, তাঁর পেপারে কে পেয়েছে সাঁইত্রিশ, কে বত্রিশ, কে ছাব্বিশ। আমার ব্যাপারে তিনি একেবারে চুপ। বন্ধুরাও সন্ত্রস্ত। আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমি কি কুড়িরও কম পেয়েছি? তিনি উদাসীনভাবে নীরব। আঠেরো? তিনি নিরুত্তর! পনেরো? পূর্বৎ! সেই বিশালকায় পণ্ডিত, যিনি অতি সহৃদয় ও ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, তিনি আমায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিলেন। তবে কি আমি এ পেপারে ফেল করেছি? অন্য পেপারগুলির তো খবরই জানি না!
তখন এম এ পরীক্ষায় থার্ড ক্লাসও ছিল। জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থার নাম থার্ড ক্লাস, লোকে এমনভাবেই কথাটা উচ্চারণ করত। কোনও একটা ফিল্ম খুবই খারাপ, লোকে মুখ বেঁকিয়ে বলত, থার্ড ক্লাস! ইলিশ মাছে স্বাদ নেই। লোকে মুখে তুলেই বলত, থার্ড ক্লাস। ট্রেনের কামরাও ছিল থার্ড ক্লাস। সেই জন্যই থার্ডের এই দুর্নাম। এখন ট্রেন ও এম এ পরীক্ষা থেকে থার্ড ক্লাস তুলে দেওয়া হয়েছে।
চূড়ান্ত ফলাফল বেরোবার কয়েকদিন আগে আমার মনে হল, তবে কি আমি বাংলায় এম এ পরীক্ষায় ফেল করব? তার চেয়েও খারাপ, থার্ড ক্লাস পাওয়া, ফেল করলে তবু একটা মিথ্যে অজুহাত ছিল, সবকটা পেপারে পরীক্ষা দিইনি, এ বছর ড্রপ করেছি। কিন্তু থার্ড ক্লাস? পরীক্ষা যে সবকটা দিয়েছি, তাও তো অনেকেই জানে! আমি একখানা বিতর্কিত উদীয়মান, না, প্রায় উদিত তরুণ কবি, একটি কবিতা পত্রিকার সম্পাদক, যে পত্রিকার বেশ নামডাক হয়েছে। সেই আমি বাংলা পরীক্ষায় ফেল করব কিংবা থার্ড ক্লাস? আমার তো থুতু ফেলে ডুবে মরা উচিত। ঝোঁকের মাথায় এম এ পরীক্ষা দিতে গিয়ে কী আহাম্মকিই না করেছি। পরীক্ষা দিতে নেই, পরীক্ষা না দিয়ে কত মানুষ কত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করে যায়।
খবরের কাগজে বেরোল, সেদিন এম এ পরীক্ষার ফলাফলের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকজন বন্ধু ডাকতে এল আমাকে। সেই ভাঙা বারান্দায় (ভারে এক সময় তার এক অংশ সত্যিই ভেঙে পড়েছিল) দাঁড়িয়ে রইলেন বাবা আর মা। তাঁদের সেই ব্যাগ্র, ব্যাকুল মুখ মনে পড়তে লাগল বারবার। আমার বুকের মধ্যে ভূমিকম্প চলছে। ঠিক করেই ফেলেছি, ফেল বা থার্ড ক্লাস পেলে আর বাড়ি ফিরব না, আত্মহত্যার সাহস সঞ্চয় করতে যদি না পারি, নিরুদ্দেশে চলে যাব।
আমি যে আত্মহত্যা করিনি বা নিরুদ্দেশ যাইনি, তাতেই বোঝা যাবে যে আমি কোনওক্রমে সেকেন্ড ক্লাসই পেয়েছিলাম। সে স্থান কত ওপরে বা নীচে তা আর কে জানতে যাচ্ছে! এবং সে বছর কেউই ফার্স্ট ক্লাস পায়নি! কেন সুকুমার সেন আমাকে অত ভয় দেখিয়েছিলেন, তা আজও জানি না।
এম এ পাস করার পর দেবেশ, মোহিত, দিব্য এবং আরও অনেকে অধ্যাপনা শুরু করে। দীপেন কী জীবিকা নিয়েছিল তা মনে নেই, সম্ভবত সে কমিউনিস্ট পার্টির ফুল টাইমার হয় এক সময় ‘পরিচয়’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়েছিল। আমার ওই এম এ পরীক্ষাটা কোনও কাজেই লাগেনি। এমনকী আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেটটা নেবারও কোনও গরল বোধ করিনি৷ অর্থাৎ নেওয়াই হয়নি কখনও। বাবা-মা খুশি হয়েছেন, তাই যথেষ্ট।
রেজাল্ট বেরোবার দিনও সন্ধের সময় আমাকে দক্ষিণ কলকাতায় টিউশানি করতে যেতে হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে বেশ অস্থির বোধ করছিলাম। কেন না, বন্ধু-বান্ধবরা অপেক্ষা করছে কলেজ স্ট্রিটে, রাত্তিরে অনেক হই-হল্লা হবে। দুর্বলতা চাপতে না পেরে এক সময় বলেই ফেললাম, জানো তো, আজ আমি এম এ পাস করেছি। ছাত্র-ছাত্রী দু’জনেই চমকিত এবং উৎফুল্ল। বিশেষত ছাত্রী অনুরাধার মুখে বিস্ময়, আনন্দ, বিষাদ খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সে তক্ষুনি তার মাকে ডেকে আনল। কৃষ্ণা গুহঠাকুরতা জানতেনই না যে সে বছর আমি এম এ পরীক্ষা দিয়েছি, সে কথা আমি সযত্নে গোপন রেখেছিলাম। তিনি সত্যিকারের চমকিত ও পুলকিত হয়ে আমার জন্য বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনুরাধার আন্তরিক ঝলমলে মুখখানা দেখে আমার মনে হল, যাক, আমার অল্প পরিশ্রমে এম এ পরীক্ষা দেওয়াটার কিছুটা মূল্য আছে তা হলে!
একত্রিশ
প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখের ভোরে আমরা যেতাম জোড়াসাঁকোয়। এখন রবীন্দ্র জন্মোৎসব সবচেয়ে বেশি ঘটা করে হয় রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে, তখন জোড়াসাঁকোই ছিল মূল কেন্দ্র, প্রচুর ছেলেমেয়ে দিনটিকে পবিত্র জ্ঞান করে স্নানটান সেরে, শুদ্ধ বস্ত্র পরে হাজির হত সেখানে, অনেক লিট্ল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীও উপস্থিত হত, কৃত্তিবাসের দলটিও জড়ো হত এক কোণে। বাংলার সমস্ত গায়ক-গায়িকা আসতেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, সঙ্গীতের আসর পরিচালনা করতেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তিনি, আমাদের চোখে ঠাকুরবাড়ির একমাত্র জীবন্ত প্রতিনিধি, অবশ্য অন্য পরিচয়ে তিনি বাংলার ব্যর্থতম রাজনৈতিক নেতা। এমন একটি বিপ্লবী দল গড়েছিলেন, যার নেতা ছিল কিন্তু কোনও কর্মী ছিল না, তিনি কয়েকবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে একবারও জয়ী হতে পারেননি।
জোড়াসাঁকোয় প্রচুর ভিড় হত, সেখানে আমরা বিক্রি করতাম কৃত্তিবাস পত্রিকা, নতুন সংখ্যা ছাড়াও পুরনো অবিক্রীত সংখ্যারও বেশ চাহিদা ছিল, আমরা ঘাড়ে করে নিয়ে যেতাম কয়েক বাণ্ডিল, ফেরার সময় এক কপিও থাকত না। পকেট ভর্তি খুচরো পয়সা, সদলবলে সেই দ্বিপ্রহরে কফি হাউসে আসর গুলজার করা হত। ওই রকম সময়েই কোনও এক বছরে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসটি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় কফি বোর্ড। এই কফি হাউসটি কলকাতার অন্যতম সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, অন্য রাজ্যের, এমনকী বিদেশেরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এখানকার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। সুতরাং কফি হাউস বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। একদিন গিয়ে দেখি বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদে আমরা টেবিল দখল করে, মোমবাতি জ্বেলে চিৎকার করে গান গেয়েছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিবাদ আরও কয়েকদিন চলেছিল, তারপর সেখানকার কর্মীদের নিয়ে সমবায় গঠন করে আবার চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়, কফি হাউস বন্ধ হয়নি।
রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর আগে পাড়ায় পাড়ায়, মফস্বলে এরকম রবীন্দ্র-পূজার প্রচলন ছিল না। শতবার্ষিকীর বছরে যত উৎসবের আয়োজন হয়, কোনও লেখককে কেন্দ্র করে তেমন উৎসব পৃথিবীর আর কোনও দেশেও হয়েছে বলে মনে হয় না। ইউনেস্কো একটি কার্যসূচি গ্রহণ করেছিল, ভারত সরকার এ দেশের প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীতে একটি রবীন্দ্রভবন স্থাপনের উদ্যোগ নেয় এবং পশ্চিম বাংলায় প্রতিটি জেলা শহরেও রবীন্দ্রভবন তৈরি হতে থাকে। বহু বিদেশি প্রসিদ্ধ লেখক ও মনীষী এসেছিলেন বিভিন্ন উৎসবে যোগ দিতে। তাঁদের মধ্যে ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়া হঠাৎ বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিলেন, তিনি নাকি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানেন না। আমন্ত্রণ পেয়ে ভারতে এসেছেন তাজমহল দেখতে।
পশ্চিম বাংলায় সেই পঁচিশে বৈশাখ দিনটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে পালিত হয়েছিল পুণ্যদিনের মতো। সকালবেলা শাঁখ বাজিয়ে, প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু। রাসবিহারী এভিনিউ ধরে শ্বেতবস্ত্র পরা যে প্রভাতফেরির দলটি যাচ্ছিল গান গাইতে গাইতে, তার পুরোভাগে ছিলেন এক দীর্ঘকায় তরুণ, সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়কে সম্ভবত আর কোনও মিছিলে কখনও দেখা যায়নি। ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে তাঁর তথ্যচিত্রটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল দিল্লিতে।
রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীতে বাঙালির এত উদ্দীপনার অন্য কারণও আছে। বাঙালিরা চতুর্দিকে মার খাচ্ছে অনবরত, মননে এবং শরীরেও। উদ্বাস্তুদের স্রোত অব্যাহত, শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হাঁটা যায় না, রিলিফ ক্যাম্পগুলিতে অসংখ্য মানুষ জীবতের মতন দিন কাটাচ্ছে। বিহার-ওড়িশা-মধ্যপ্রদেশের খানিক খানিক এলাকা নিয়ে তৈরি হয়েছে দণ্ডকারণ্য প্রকল্প, কিন্তু সেই পাহাড়ি, অরণ্যসঙ্কুল অচেনা পরিবেশে বাঙালি উদ্বাস্তুরা যেতে চায় না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের পশ্চিম বাংলাতেই রেখে দিতে চায় ভোটের স্বার্থে, যদিও পশ্চিম বাংলায় ঠিক কোন কোন অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, সে রকম কোনও পরিকল্পনা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি। কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খন্না বিদ্রুপ করে বিবৃতি দিলেন, দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার চেয়ে বিনা পরিশ্রমে ত্রাণ শিবিরে বা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকতে চাওয়াটা বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্মগত রোগ! কর্মঠ পঞ্জাবের উদ্বাস্তুরা তো এর মধ্যেই অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। (পঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ বরাদ্দও যে হয়েছে অনেক বেশি। সে তথ্য উল্লিখিত হয় না।)
অসম রাজ্যেও (তখন বলা হত আসাম, এখনও ইংরেজিতে তাই লেখা হয়) ঢুকে পড়েছে প্রচুর উদ্বাস্তু। সে রাজ্যে বাঙালিরা সংখ্যাগুরু হয়ে যেতে পারে, এ জন্য অসমিয়ারা শঙ্কিত। এমনিতেই ব্যবসাবাণিজ্য ও চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের আধিপত্যের জন্য অসমিয়াদের মধ্যে মনে মনে ক্ষোভ জমছিল, তাদের ভাষা সম্পর্কে অনেক শিক্ষিত বাঙালির, এমনকী রবীন্দ্রনাথেরও মনোভাব সঠিক ছিল না। জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন-অধিনায়ক-এ অসম রাজ্যের নাম উল্লেখ নেই বলে সেখানকার বহু অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত বর্জন করা হয়। (আমি একবার অসম সাহিত্য সভার অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে জাতীয় সঙ্গীতের ঘোষণার পর সবাই উঠে দাঁড়াবার পর শুনলাম, সে জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন নয়, অন্য) নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য অসমিয়ারা সচেতন হতে হতে ক্রমশ উগ্র হয়ে ওঠে, বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এক সময় শুরু হল সংঘর্ষ, তার পরিণতি ষাট সালের ভয়াবহ বাঙালি-বিরোধী দাঙ্গা।
স্বাধীনতার পর ভারতীয়ত্ব বোধের চেয়েও প্রাদেশিকতা বাড়ছে অনেক বেশি। বিভক্ত রাজ্য হিসেবে ক্ষুদ্র পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা গুরুত্ব হারাচ্ছে দিন দিন, তাদের একমাত্র গর্বের বিষয় রবীন্দ্রনাথ।
শতবার্ষিকীর সময় আমাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মহাজাতি সদনে এক বিশাল উৎসবে আমাদের ডাক পড়েছিল সমবেতভাবে গান গাইবার জন্য। একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়, গদ্য লেখকরা প্রায় কেউ-ই গান জানে না, অনেকের গলায় সুর নেই, কিন্তু কবিরা প্রায় সকলেই গান গাইতে পারে। কিংবা এমনকী বলা যেতে পারে যে, যাদের অন্তরে খানিকটা সুর আছে, তারাই কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হয়? আমাদের সমসাময়িক একজন গল্প লেখক একবার বিরক্তির সঙ্গে বলেছিল, কবির দল যখন তখন গান গেয়ে ওঠে কেন, সে ব্যাপারটা আমি বুঝি না!
যাই হোক, মহাজাতি সদনের মঞ্চে শক্তি, শরৎকুমার, প্রণব মুখোপাধ্যায়, আমি এবং আরও কেউ কেউ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শুরু করলাম গান, সামনে প্রচুর দর্শক-শ্রোতা। দু’-এক পঙ্ক্তি গাইতে না গাইতেই ভেতরে শুরু হল গুঞ্জন, তারপর কেউ কেউ চিৎকার করে কী যেন বলতে লাগল। কারণটা ঠিক বোঝা গেল না, শ্রোতারা আমাদের গান পছন্দ করছে না! কিন্তু সুর তো ভুল হচ্ছে না, এক এক জন এক এক দিকে যাচ্ছি না, আগে রিহার্সাল দিয়ে নিয়েছি। চ্যাঁচামেচি আরও বাড়ছে, লোকেরা কি আমাদের থামতে বলছে? আমরা খারাপ গাইছি না, থামব কেন? তারপর অবস্থা এমন হল, কয়েকজন চেয়ার তুলে মারতে এল আমাদের। উদ্যোক্তারা পর্দা ফেলে দিল, তাড়াতাড়ি আমাদের পেছনের দরজা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল বাইরে।
আমাদের অপরাধটা কী, তা বুঝতেই পারছি না, প্রাণ বাঁচাবার জন্য লাগালাম দৌড়।
পরে জানা গেল, গানের জন্য নয়, আমাদের অপরাধ আমরা প্যান্ট-শার্ট পরে গান গাইতে উঠেছিলাম মঞ্চে। রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা পবিত্র ব্যাপার, প্যান্ট-শার্ট পরে গাইলে যে তার অপমান হয়, তা আমরা জানব কী করে? সুবিনয় রায়কে দেখেছি বটে, অন্য সময় তিনি স্যুট পরেন। কিন্তু মঞ্চে গান গাইতে বসার সময় ধুতি-পাঞ্জাবি। গায়িকারাও শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখেন গলা পর্যন্ত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে যখন নিজের গান গেয়েছিলেন, তখন কি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ছিল?
কল্লোল যুগের যে-সব তরুণ লেখক-কবিরা রবীন্দ্র-বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা সবাই এই সময়ে পরিণত বয়েসে রবীন্দ্র-ভক্ত হয়ে গেছেন। শতবার্ষিকীর সভা-সমিতিতে তাঁদের উজ্বল আসন। রবীন্দ্র-বিরোধিতার সঠিক মর্ম পাঠকরা কোনওদিন বুঝতে পারেননি। রবীন্দ্র-বিরোধীরা ব্যক্তিগতভাবে সকলে বরাবরই রবীন্দ্র-ভক্ত। রবীন্দ্র-বিরোধিতা যেমন এক সময় খুবই প্রয়োজনীয় ছিল, আবার রবীন্দ্র-সরোবরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত না হলে কারও পক্ষে বাংলা ভাষায় কিছু লেখাও সম্ভব নয়। আমাদের দশকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দূরত্ব হয়ে গেছে অনেকখানি, আমাদের পক্ষে আর রবীন্দ্র-বিরোধিতার কোনও কারণ ছিল না, কিন্তু যে-সব গুরুবাদী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেন, যাঁরা বলতেন, রবীন্দ্রনাথের পর আর কিছুই পাঠযোগ্য লেখা হয়নি, তাঁদের প্রতি উদ্মায় অনেক সময় কটুবাক্য বেরিয়ে এসেছে!
শান্তিনিকেতনের উৎসব দেখার জন্য আমরা সদলবলে গিয়েছিলাম। সেখানে তখন প্রচুর জনসমাগম, কোনও গেস্ট হাউস-হোটেলে স্থান পাবার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর একজন শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করে, অনেকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে, গিয়েছি তার ভরসায়। কিন্তু আমরা কেন খবর না দিয়ে এসেছি এই বলে সে ভর্ৎসনা করে কোথায় মিলিয়ে গেল, আর তার পাত্তাই পাওয়া গেল না। রাত্রে ফেরার ট্রেন নেই, আমাদের শুতে হবে গাছতলায়, তাতেও কোনও অসুবিধে ছিল না, কিন্তু আমাদের সঙ্গে রয়েছে একটি যুবতী! সাতজন পুরুষ ও একটি যুবতী শুয়ে আছে গাছতলায়, এ দৃশ্য তখনকার শান্তিনিকেতনে কোনওক্রমেই অনুমোদিত হত না। তা ছাড়া কয়েকজন ভি আই পি-র পদার্পণে সুরক্ষা বাহিনীর কড়াকড়ি ছিল। এ সঙ্কট মোচনে এগিয়ে এল আমার এক কলেজের সহপাঠী অরুণ মজুমদার, সে তখন বিশ্বভারতীতে অর্থনীতির অধ্যাপক, তার ঘরটি ছেড়ে দিল আমাদের জন্য। একমাত্র বিমল রায়চৌধুরী ছাড়া আমরা সবাই অবিবাহিত, তার স্ত্রী কবিতা সিংহ অনেক সময়ই আমাদের সহযাত্রিণী হয়, কফি হাউসের দু’-তিনখানা টেবিল জোড়া আড্ডায় সে-ই একমাত্র নারী সদস্য। অরুণের ঘরখানি খুবই ছোট, একটি মাত্র সরু খাট পাতা, সেটি দেওয়া হল বিমল-কবিতাকে, মেঝেতে আমরা বাকি ছ’জন। টিনের মধ্যে সার্ডিন মাছ যে-রকম থাকে, সেরকমই গায়ে গায়ে টাইট, এমনকী এপাশ-ওপাশ ফেরারও উপায় নেই। সারা রাত তো একভাবে শুয়ে থাকা যায় না। সেইজন্য পাশ ফিরতে হলে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ বা ডানদিকে ফিরে আবার শুয়ে পড়তে হয় খাপে খাপ মিলিয়ে। এরপর অনেক বছর ধরে আমাদের অন্যতম সঙ্গী ভাস্কর দত্ত অঙ্গভঙ্গি করে এ-গল্প বহু লোককে শুনিয়েছে। এর মধ্যে শক্তির স্বভাব লাথি ছোঁড়া, বিমল রায়চৌধুরী ঘুমের মধ্যে কথা বলে, কবিতা সিংহ একবার পড়ে গেল খাট থেকে—স্মরণীয় রাত্রি আর কাকে বলে!
তবু সেবারের পরমপ্রাপ্তি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখা, তাঁর গান শোনা। এরপর যতবার তাঁকে দেখেছি, মনে হয়েছে, ইনি মর্তের মানবী নন, কিন্নরী। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যে-সব রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি, সেগুলি মুখস্থ হয়ে গেছে, এবং সেই সব গান অন্য কারও কণ্ঠে ঠিক যেন মানায় না৷ রূপে তোমায় ভুলাবো না’, গানটি বহুদিন অন্য কোনও গায়িকা গাইতে সাহস পাননি। তেমনই, ‘বাজে করুণ সুরে’।
এর মধ্যে আবার বাবার মাঝে মাঝেই শরীর খারাপ হতে হতে এক সময় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। তাঁর টিউশানির উপার্জন বন্ধ হয়ে গেল, স্কুলের অর্ধ বেতন, সামনে আরও দুঃসময়ের আশঙ্কা। সেই সময় জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে যতটা দায়িত্ব আমার পালন করা উচিত ছিল, আমি তা করিনি। মাইনের টাকা বাড়িতে দিতাম বটে, কিন্তু মনটা বারমুখখা। সেই বয়সটায় বন্ধুদের সঙ্গে প্রায় সমকামীদের মতন নিবিড় সম্পর্ক। কয়েকজন বিশেষ বন্ধুর সঙ্গে সারা দিনে একবার অন্তত দেখা না হলে সর্বাঙ্গে ছটফটানি শুরু হয়। বাড়িতে অভাব, তবু কৃত্তিবাস পত্রিকা বার করতেই হবে, এ এক ধরনের পাগলামিরই মতন।
বাবার চিকিৎসার অবশ্য ত্রুটি হয়নি। তখন বিধান রায়ের পরই দ্বিতীয় ধন্বন্তরী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন ডাক্তার নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি সপ্তাহে একদিন বিনা পয়সায় রুগি দেখতেন, তা জেনে বাবাকে একদিন নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। সেদিন সাঙ্ঘাতিক রাগ ধরে গিয়েছিল, যদিও তা অসহায় মানুষের রাগ। এইসব বিখ্যাত, ব্যস্ত ডাক্তারদের বিনা পয়সায় রুগি দেখা নিছক ভড়ং বলে মনে হয়েছিল, উদারতার নাম ছড়াবার একটি প্রক্রিয়া। ভালো করে কিছুই শোনেন না, সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে অন্য বিষয়ে আলোচনা করতে করতে মাঝে মাঝে এদিকে তাকিয়ে হুঁ-হুঁ করেন। পাড়ার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান দেখে একটি মাত্র ওষুধের নাম বদলে দিলেন, ওষুধের ডিপোয় চাকরি করি বলে আমিও বুঝতে পারি, সেটি আসলে একই ওষুধের ভিন্ন কোম্পানির ভিন্ন নাম। রোগী এবং তার সঙ্গীর দিকে একবার অন্তত পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দু’-একটি সান্ত্বনাবাক্য বলা কি চিকিৎসকদের দায়িত্বের অঙ্গ নয়? দু’-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে যে-রোগীরা, তাদের জন্য এক গেলাস জল খাওয়াবারও ব্যবস্থা থাকে না।
ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার উল্টোদিকে গিয়ে ট্যাক্সি ধরতে হবে। অনবরত গাড়ি আসছে-যাচ্ছে, উদ্ভ্রান্তভাবে বাবা আমার হাত ধরলেন। রোগা হয়ে গেছেন অনেক, পাঞ্জাবি প্রায় ভেদ করে উঁচু হয়ে আছে পিঠের দু’দিকের হাড়, চামড়া শিথিল হয়ে গেছে, তাঁর হাতটি ঠাণ্ডা। বাচ্চা বয়সে যখন গ্রাম থেকে আসতাম, কলকাতার রাস্তার গাড়ি-ঘোড়ার বিপদ সম্পর্কে আমাকে সব সময় সচেতন করে দেওয়া হত, রাস্তা পার হবার সময় বাবা শক্তভাবে আমার হাত ধরে রাখতেন, তাঁর মুঠি দৃঢ়, ব্যক্তিত্বপূর্ণ। তারপর অনেক বছর পিতা-পুত্রের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, পথও বদলে গেছে। এখন বদলে গেছে ভূমিকা, এখুন পুত্রই হাত ধরে রাস্তা পার করাচ্ছে পিতাকে, গাঁক গাঁক শব্দে এগিয়ে আসছে দোতলা বাস, বাবা ভয় পেয়ে থমকে যাচ্ছেন, ছেলে মাঝ রাস্তায় বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভয়ের কিছু নেই, আমি তো আছি! বাবা বলছেন, ট্যাক্সি ভাড়া অনেক, তার দরকার কী, আমি বাসেই যেতে পারব। ছেলে এক সময় বাবার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলার সাহস পেত না, কোনও কথার প্রতিবাদ করত না, এখন সেই ছেলেই বলছে, না, বাসে ঝাঁকুনি লাগবে, ট্যাক্সি ডাকছি। বাবার যে হাতে ছেলে অনেকবার জোরালো থাপ্পড় খেয়েছে, এখন দুর্বল হয়ে পড়া সেই হাতটিই ধরে ছেলে তাঁকে সাহায্য করছে ট্যাক্সিতে উঠতে।
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধে কোনও উপকার হচ্ছে না দেখে আত্মীয়স্বজনদের পরামর্শে শুরু হল কবিরাজি চিকিৎসা। উত্তর কলকাতায় তখন অনেক নামজাদা কবিরাজ ছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে প্রবীণ কবিরাজ বনাম আধুনিক ডাক্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কাহিনী লিখেছিলেন আরও কিছুদিন পর, তখনও পর্যন্ত কবিরাজি চিকিৎসায় অনেকেরই দৃঢ় আস্থা ছিল, আর মাত্র এক দশকের মধ্যেই কবিরাজরা ক্রমশ অদৃশ্য হতে শুরু করেন। একজন বেশ রাশভারী চেহারার কবিরাজ দেখতে লাগলেন বাবাকে, তাঁর ভিজিট অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারদেরই সমান। আমি লক্ষ করলাম, কবিরাজরা ইংরেজি বলতে ভালোবাসেন, কথার মাঝে মাঝেই ইংরেজি শব্দ। অর্থাৎ বোঝাতে চান, অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারদের চেয়ে তাঁরা শিক্ষায় দীক্ষায় কম নন। অনেক কবিরাজই কিন্তু সংস্কৃত ভালো জানতেন, যে জ্ঞান অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারদের নেই, কিন্তু সংস্কৃত নিয়ে গর্ব করার দিন চলে গেছে। অনেক বাংলা অধ্যাপকেরও ইংরেজি বলার দুর্বলতা দেখেছি এই একই কারণে।
আমাদের দেশে কেউ কিছুদিন রোগে শয্যাশায়ী হলে আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে দেখতে আসেন, এটাই প্রথা, না এলে মনে করা হয় তাঁদের সামাজিকতা বোধ নেই, আত্মীয়দের প্রতি টান নেই। প্রতিদিনই এক গুচ্ছ আত্মীয় আসেন, তাঁদের চা খাওয়াতে হয়, কুশল বিনিময়ের পরই তাঁরা রোগীর ঘরে বসেই গল্প জুড়ে দেন। সকলের গল্পই এক, তাঁরা ঠিক এই অসুখের লক্ষণযুক্ত রোগী আর কোথায় কোথায় দেখেছেন, এবং সেই রোগীরা কী ভাবে মারা গেছে। অনেকেই আবার শখের ডাক্তার, নিজস্ব কোনও ওষুধ বা টোটকার কথা বলবেন, থানকুনি পাতা দিয়ে কাঁচকলার ঝোল জাতীয় পথ্য বাৎলাবেন কিংবা ডাক্তার-কবিরাজ বদল করার পরামর্শ দেবেন। অনেকেরই একজন করে চেনা ডাক্তার থাকে, যাঁরা আর সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বাবার পরিচিতের সংখ্যা অনেক, প্রাক্তন ছাত্ররাও আসেন, সকলেই উপদেশ নানারকম। সেইসব অভ্যাগতদের ধাক্কা সামলাবার ভার মায়ের ওপর দিয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্রটি যখন তখন পালিয়ে যায়।
কিছুদিন কবিরাজি ওষুধ খেয়ে বাবার কোমা হয়ে গেল। তখন এত নার্সিংহোম হয়নি, হাসপাতালে পাঠাবার কথাও কেউ বলেনি। তাঁকে বাড়িতেই রাখা হল, অর্ধচেতন অবস্থা, মাঝে মাঝে কিছু বলে ওঠেন। তা ঠিক বোঝা যায় না। আমার দিদিমাও এসে আছেন কিছু দিন ধরে, মার সঙ্গে তিনিও নিয়েছেন সেবার ভার। জ্যেষ্ঠ পুত্রটি প্রায় পলাতক হলেও তার অন্য দুটি ভাই ও বোন প্রায় সব সময়ই বাবার কাছাকাছি থাকে।
সপ্তাহ দু’য়েক পর তাঁর কোমার অবস্থা কেটে গিয়ে আবার জ্ঞান ফিরে এল পুরোপুরি, তিনি উঠে বসে নিজেই খাবার খেতে পারেন, খবরের কাগজ পড়েন, রেডিয়ো শোনেন। সারা বাড়িতে যে গুমোট বিষণ্ণভাব ছিল, সেটা কেটে গেল। বাবার কথাবার্তা বদলে গেল কিছুটা। এর আগে দেশ-বিভাগের ব্যথা-বেদনা তাঁকে কখনও প্রকাশ করতে দেখিনি। সংসার ও আশ্রিতদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেই এত ব্যস্ত থাকতেন যে স্মৃতিচারণেরও সময় পেতেন না। দেশ বিভাগের পর গোড়ার দিকে তাঁর ধারণা ছিল, আরও অনেকের মতন, দশ বছরের মধ্যেই খণ্ডিত ভারত আবার জোড়া লেগে যাবে। সতেরোশো সাতান্ন, আঠারোশো সাতান্ন, আবার উনিশশো সাতান্নতে ঘটবে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু উনিশ শো সাতান্ন কেটে গেল, তার চার বছর পরেও সেরকম কোনও লক্ষণ তো দেখা গেলই না, বরং দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই বিষিয়ে যাচ্ছে, উকট এক সমস্যা হয়ে ঝুলছে কাশ্মীর।
কোমা থেকে সেরে ওঠার পর বাবা অনর্গল বলতে শুরু করলেন তাঁর দেশের বাড়ির কথা। এতদিন পর যেন তাঁর আবার মনে হল, তিনি পশ্চিমবাংলার নাগরিক নন, এখানে তো বাসা ভাড়া করে থাকা, তাঁর আসল বাড়ি পূর্ববঙ্গে। তিনি বলতে লাগলেন, অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি, এবার যেতে হবে, দরজার একটা কব্জা বদল করা দরকার ছিল, বাতাবি লেবু গাছটায় এক সময় অনেক ফল হয়, গোয়ালন্দ ঘাটের সেই হোটেলের খাওয়া তোর মনে আছে? স্টিমার নেমে সেই হোটেলে খাব, তারপর নৌকোয়…ধুয়াসার গ্রামের পাশ দিয়ে…কত শাপলা ফুল ফুটেছে, চুনীকে লিখে দিলে সে মাদারিপুরে থাকবে, এই মাসেই যাব…(গ্রামে আমাদের এক নিকট প্রতিবেশীর পুত্রের নাম চুনী, তাঁকে আমরা চুনীকাকা বলে ডাকতাম। সেই পরিবারটি এদিকে চলে আসেনি, তখনও ওখানেই, দু’বছর আগে সেই চুনীকাকা মাদারিপুরের কাছেই রাস্তার ওপরে খুন হন, সে খবর আমরা জেনেছিলাম। বাবা এই রকম অনেক মৃত ব্যক্তিকেই জীবন্ত মনে করতে শুরু করলেন।)
একদিন সকালে বাবা আমাকে পাশে বসার ইঙ্গিত করে বললেন, তোর সঙ্গে একটা বিশেষ কথা আছে। আমি বিছানার একপ্রান্তে বসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা চুপ করে রইলেন। যেন ঠিক কী ভাবে কথাটা শুরু করবেন, সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। একটু পরে আবার বললেন, তোর সঙ্গে একটা বিশেষ কথা আছে। তারপর আবার চুপ। নিশ্বাস ফেলছেন ক্লান্তভাবে। এইভাবেই কেটে গেল প্রায় আধ ঘণ্টা। ঘরে অন্য লোকজন এসে গেল।
সেই বিশেষ কথাটি আর আমার শোনা হল না। সেইদিন সন্ধের পর পূর্ব বাংলার মাইজপাড়া গ্রামের কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়, টাউন স্কুলের শিক্ষক, সংসারযুদ্ধে বিধ্বস্ত সৈনিকের মতন শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করলেন মৃত্যুর কাছে। তাঁর বয়েস তখন একান্ন। জ্যেষ্ঠ পুত্রটির বয়স সাতাশ, অন্য ছেলেমেয়েরা তখনও ছাত্র-ছাত্রী। তাঁর স্ত্রী মীরার শরীরে-মনে তখনও প্রৌঢ়ত্বের ছোঁয়া লাগেনি।
বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি কিছুই নেই। মৃত্যুকালে বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা ছিল এগারোশো টাকা। এই তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়। অসুস্থ অবস্থাতেও মাঝে মাঝে বলতেন, টাকাটা তুলে দিতে হবে।
উইল করার কোনও প্রশ্ন নেই, মৃত ব্যক্তির ব্যাঙ্কের টাকা অন্য কেউ তুলতে পারে না, শ্রাদ্ধ-শান্তির খরচের জন্য আমাদের টাকা ধার করতে হয়েছিল। সাকসেশন সার্টিফিকেট নামে একটি অতি দুর্লভ বস্তু সংগ্রহ করে ব্যাঙ্ক থেকে সে টাকা তুলতে সময় লেগেছিল তিন বছর।
বাবা শেষবারের মতন একবার বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। যাওয়া হল না। শেষদিন তিনি আমায় কী বিশেষ কথা বলতে চেয়েছিলেন, সে কৌতূহল আমার রয়ে গেল আজীবন।
বত্রিশ
এক সময় পার্ক স্ট্রিটের নাম ছিল সাহেবপাড়া, ষাটের দশকের প্রথম দিকেও সেখানে অনেক সাহেব-মেম দেখা যেত, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছিল প্রচুর এবং তখনও পর্যন্ত বিদেশি পর্যটকরা কলকাতা শহরটিকে অচ্ছুত হিসেবে গণ্য করেনি। কলকাতা মিছিল-নগরী ছিল বটে কিন্তু নোংরা-আবর্জনাময় শহর হিসেবে বদনাম রটেনি, চৌরঙ্গি-ময়দান-জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি-দক্ষিণেশ্বর-বোটানিকাল গার্ডেনে ঘুরে বেড়াত নানা বর্ণের ও বিচিত্র পোশাক পরা অসংখ্য পরদেশী ভ্রমণকারী। দূর থেকে তাদের দেখতাম, কখনও পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। প্রথম যে বিদেশির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, তাঁর নাম অ্যালেন গিন্সবার্গ।
বুদ্ধদেব বসু একবার আমেরিকায় অধ্যাপনা সেরে এসে দেশ পত্রিকায় ‘বিট বংশ ও গ্রীনিচ গ্রাম’ নামে একটি চমৎকার রচনা লিখেছিলেন, সেটি পড়েই প্রথম বিট কবি-লেখক সম্প্রদায় বা বিটনিকদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পারি। তার আগে জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্রেগরি করসো, লরেন্স ফের্লিংগেটি এই সব নাম ভাসা ভাসাভাবে শোনা ছিল শুধু। এবং খবরে পড়েছিলাম, অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ নামের একটি চটি কবিতার বই এক লক্ষ (কিংবা এক মিলিয়ন বা দশ লক্ষও হতে পারে) কপি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে সারা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দা রোড’ সেই সময়কার তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর উপন্যাস। বিট কবি-লেখক-চিত্রশিল্পী-সঙ্গীতশিল্পীরা এক বিশেষ ধরনের জীবনদর্শনে বিশ্বাসী। এরা কোনও প্রকার সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করে না। জীবিকার জন্য কারও দাসত্ব করতে রাজি নয়, জীবনযাত্রার মান খুব কমিয়ে, অর্থাৎ ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে, আধ-পেটা খেয়েও কোনওক্রমে দিন কাটাতে পারে, অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে খুব ঝোঁক। এবং গাঁজা-ভাঙ-চরস-মেষ্কালিন-পিয়োটি প্রভৃতি নেশার দ্রব্য ব্যবহার করে অতীন্দ্রিয় জগতের সন্ধানী।
এইসব নেশার দ্রব্য নিয়ে তখন খুব আলোচনা চলছে, পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম যুক্তি, টিমোথি লিয়ারি নামে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মান্যগণ্য অধ্যাপক ঘোষণা করেছেন যে মদ-সিগারেট ইত্যাদি অত্যন্ত খারাপ নেশা কিন্তু গাঁজা শরীর ও মনের জন্য বিশেষ উপকারী! অলডাস হাক্সলির মতন উচ্চমার্গের বুদ্ধিজীবী লেখকও ‘ডোরস অফ পারসেপশান’ নামে বই লিখে অবচেতনের গহনলোকের সন্ধানে নেশার প্রভাবের কথা ব্যক্ত করেছেন। আমাদের দেশের সাধু-সন্ন্যাসীরা যেমন গাঁজা-ভাঙ খেয়ে দৈব উপলব্ধির সন্ধান করেন, লেখক-শিল্পীরাও তেমনই এইসব সেবন করে পেতে পারেন নতুন সৃষ্টির প্রেরণা। (বলাই বাহুল্য, এই মতের বিরুদ্ধবাদীদের সংখ্যাই বেশি।) বিট সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের আউল-বাউল-সহজিয়াদের খুব একটা তফাত নেই। এ সবই সমাজের ধরাবাঁধা গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহের সুর তখন চতুর্দিকে, ইংল্যান্ডেও তখন কিংসলে অ্যামিসের মতন তরুণ লেখকরা অ্যাংরি ইয়াংমেন নামে পরিচিত হচ্ছেন, এমনকী সোভিয়েত রাশিয়াতেও ইয়েফতুশেঙ্কো ও ভজনেসেন্স্কির মতন কবি ভাঙতে চাইছেন রাষ্ট্রীয় নির্দেশ।
আমেরিকায় বুদ্ধদের বসুর সঙ্গে যখন অ্যালেন গিন্সবার্গের দেখা হয়, তখন সে বলেছিল, আমি একদিন ভারতবর্ষে যাবই, এমনকী যদি পায়ে হেঁটেও যেতে হয়, তাও সই। ভারতের আধ্যাত্মিক রহস্যময়তার প্রতি তার এমন প্রবল টান। এবং সত্যিই, প্রায় পায়ে হেঁটেই এবং মধ্যপ্রাচ্যে হিচ হাইকিং করে ও কিছুটা জাহাজে চেপে সে হাজির হয়েছিল এ দেশে। কলকাতায় এসে সে বুদ্ধদেব বসু-আবু সয়ীদ আইয়ুব-নীহাররঞ্জন রায়- শিশিরকুমার ভাদুড়ী-সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সেরে তারপর নিজেই তরুণ লেখকদের সন্ধানে হাজির হয় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে।
অ্যালেনের সঙ্গে ছিল পিটার অর্লভস্কি, স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে, তারা দুই বন্ধু। অ্যালেনের মধ্যমাকৃতি, পাতলা চেহারা, মুখভর্তি দাড়ি, কোনওদিন চুলও কাটে না বোধহয়, বাবড়িতে সদ্য টাক পড়তে শুরু করেছে, আমাদের চেয়ে বছর দশেকের বড়, আর পিটার লম্বা-চওড়া বলশালী পুরুষ, দাড়ি-গোঁফ নেই, মুখখানি লাজুক ধরনের, দুজনেই ততদিনে পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে শুরু করেছে, পায়ে রবারের চটি। অ্যালেন অন্যদের সঙ্গে পিটারের আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলত, এ আমার স্ত্রী! এবং পিটারের মুখে সম্মতিসূচক হাসি।
পুরুষে-পুরুষে কিংবা নারীতে-নারীতে সমকাম যে ভূ-ভারতে কখনও ছিল না তা নয়, চিরকালই ছিল, কিন্তু রক্ষা করা হয়েছে কঠিন গোপনীয়তা, ওই সম্পর্ক অনুচ্চার্য। পশ্চিম গোলার্ধেও এই সম্পর্কের দৃষ্টান্ত আছে সেই অ্যারিস্টটলের আমল থেকে, সেখানেও গোপনীয়তা রক্ষা করা হত, জানাজানি হলেই সামাজিক লাঞ্ছনা, এমনকী কারাদণ্ডও। এতগুলি শতাব্দী পেরিয়ে হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সেই গোপনীয়তা ও নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল, লজ্জা কিংবা ভয় তুচ্ছ করে দিকে দিকে অনেক মানুষ নিজেদের সমকামী বলে ঘোষণা করতে লাগল। শুধু শিল্পে-সাহিত্যে নয়, একটানা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন নানাভাবেই বিদ্রোহ শুরু হচ্ছে, যেমন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতেও গুঞ্জরিত হচ্ছিল বিক্ষোভ, যার প্রকাশ ঘটে হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়ায়, তেমনই ধনতান্ত্রিক আমেরিকাতেও জেগে উঠেছে কৃষ্ণাঙ্গরা, মাঝে মাঝেই খুঁসে উঠছে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবীরা। সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিকে ধিক্কার জানায় প্রকাশ্যে। মানুষের যৌনসঙ্গী নির্বাচন তার ব্যক্তিগত রুচি এবং পারস্পরিক সম্মতির ব্যাপার, সেখানে সমাজ বা রাষ্ট্রের নাক গলানো কিংবা নীতিবাগিশতা আর মানুষ মেনে নিতে রাজি নয়।
সমকামকে প্রকৃতির নীতিসম্মত বলা যায় না, কারণ প্রকৃতির অমোঘ বিধান, অনন্ত উৎপাদন। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি, গাছপালা, জলজ প্রাণীরাও শুধু বংশবৃদ্ধি করে যাবে। কিন্তু মানুষ তো প্রকৃতির বিরুদ্ধেও গেছে বারবার, এবং জয়ীও হয়েছে। আগে সমকামীদের মনে করা হত বিকৃত-মানস কিংবা পঙ্গুতার মতন কোনও রোগগ্রস্ত, কিন্তু এখন প্রকাশ্য ঘোষণার পর জানা যেতে লাগল, অনেক রাষ্ট্রনেতা, মন্ত্রী, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, চিকিৎসকও সমকামী, তাঁদের মেধা ও পরিচালন-ক্ষমতা উচ্চস্তরের এবং সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক। নারী-মুক্তি আন্দোলনের নেত্রীরাও এই সম্পর্কের স্বীকৃতি জানালেন। এমনকী সিনেমার জনপ্রিয় রোমান্টিক নায়ক, যার প্রেমের দৃশ্যের অভিনয় দেখে লক্ষ লক্ষ যুবতীর হৃদয় আন্দোলিত হয়, হঠাৎ খবর ফাঁস হয়ে যায় যে সেই রকম কোনও কোনও নায়কও ব্যক্তিগত জীবনে নারীদের পছন্দ করে না, পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে বসবাস করে। মাত্র শ’খানেক বছর আগে দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান লেখক অস্কার ওয়াইল্ডকে এই অপবাদে জেল খাটতে হয়েছিল এবং তাঁর পরবর্তী জীবনটাও ধ্বংস হয়ে যায়, আর এখন পুরুষে-পুরুষে কিংবা নারীতে নারীতে বিবাহ পর্যন্ত কোনও কোনও জায়গায় আইনসিদ্ধ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ অত্যন্ত শিক্ষিত মানুষ, কাব্য-সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে অনেক পড়াশুনো করেছে, কিন্তু সেই বয়েসে তার নানারকম চমক সৃষ্টির দিকে ঝোঁক ছিল, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে আচার ব্যবহারে উগ্র, তার বিশ্বাস ছিল, সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতন শিল্পী-সাহিত্যিকরাও যদি প্রথা ভাঙতে চায়, তবে তাদেরও উগ্রপন্থী হওয়া দরকার। একবার এক কবিতা-পাঠের আসরে (কলকাতা নয়, তার স্বদেশে) একজন শ্রোতা মাঝপথে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করেছিল, এসব কবিতার মানে কী? অ্যালেন কোনও উত্তর না দিয়ে, মঞ্চে দাঁড়িয়েই জামা-প্যান্ট-জাঙ্গিয়া খুলে ফেলে সহাস্যে বলেছিল, এই আমার কবিতার মানে! কলকাতায় প্রগতিশীল নামে পরিচিত কিছু ব্যক্তি অ্যালেনকে আমেরিকার চর বা সি.আই.এ.-র এজেন্ট আখ্যা দিয়েছিল, তখন তাদের চোখে সব আমেরিকানই সি.আই.এ.। অ্যালেন যে তার অনেক কবিতায় আমেরিকা নামে দেশটা ও সেখানকার শাসকদের কী প্রচণ্ড গালিগালাজ দিয়েছে, তা এরা পড়েনি। পঞ্চাশ বছর আগেও এরকম কোনও কবির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ফাঁসি হত! যে-কোনও দেশেরই সব মানুষকে এক শ্রেণীতে ফেলা এক ধরনের মূর্খতা।
অ্যালেন আর পিটার প্রথমে এসে উঠেছিল চাঁদনি বাজারের কাছে আমজাদিয়া নামে একটি অতি নিম্নমানের হোটেলে, স্যাঁতসেঁতে ঘর, দেওয়ালে ময়লা দাগ, জানলা বন্ধ হয় না, বিছানা ভর্তি ছারপোকা। শৌচাগারটি এমনই নোংরা ও কদর্য যে আমাদেরও গা ঘিনঘিন করে, হাতল ভাঙা মগটিও শ্যাওলা ধরা। শ্বেতাঙ্গ, তায় আমেরিকান, তারা যে এমন কষ্টসহিষ্ণু হতে পারে তা আমাদের ধারণায় ছিল না। ওদের দেশে অনেক গণ্ডা ফাউন্ডেশন, যারা লেখক-শিল্পীদের নানাভাবে অর্থ সাহায্য করে, বিট জেনারেশনের কেউ তাদের দ্বারস্থ হবে না, সরকারি অনগ্রহও নেবে না। শুধু বই বিক্রির টাকায় পিটারসহ অ্যালেনের বিশ্বপরিভ্রমণ। যতই বিক্রি হোক, চটি কবিতার বই, তার দামও সামান্য। এই আত্মনিগ্রহও যেন সাধনা। অ্যালেন প্রায়ই বলত, কবিতা রচনা চব্বিশ ঘণ্টার কাজ, সুতরাং অন্য কোনও জীবিকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
আমার ও অ্যালেন গিন্সবার্গের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। সে কবিতার জন্য আত্ম-নিবেদিত, আর আমি জীবিকার ধান্দায় অহোরাত্র নিবদ্ধ। সকালে টিউশানি, দুপুরে সরকারি অফিসে কেরানিগিরি, পিতৃবিয়োগের পর সন্ধ্যাতেও একটি সংবাদপত্র অফিসে পার্টটাইম কাজ নিয়েছি রাত্রে আর একটি টিউশানি। তারই মধ্যে কৃত্তিবাস সম্পাদনা ও গভীর রাতে কিছু লেখালেখির চেষ্টা। তখন থাকি নাগের বাজারের কাছে যাটগাছিতে, সেখান থেকে দক্ষিণ কলকাতা পর্যন্ত বারবার ছোটাছুটি, তারই ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা দিতে যেতাম অ্যালেনদের সঙ্গে। সুখের বিষয় সরকারি চাকরিতে ফাঁকি দেবার অনেক সুযোগ ছিল। (ফাঁকি কথাটা বোধহয় ঠিক হল না, কাজের অভাবে সময়ের সদ্ব্যবহার বলাই সঙ্গত।) আমার চেয়ে বরং শক্তির সঙ্গে অ্যালেনের জীবনযাত্রা ও জীবনদর্শনের মিল অনেক বেশি। শক্তি তখন দাড়ি রাখে, কোনও কাজকর্মে মন নেই, কবিতা লেখাই তার ধ্যানজ্ঞান এবং কবিতার জন্য সে যথেচ্ছাচারও করতে পারে। অ্যালেনের সঙ্গে শক্তি একবার চলে গেল তারাপীঠ, আরও কোথাও কোথাও গিয়েছিল বোধহয়, বাড়ির বাইরে রাত কাটানো শক্তির পক্ষে ছিল স্বাভাবিক। একবার অনেকে মিলে দল বেঁধে যাওয়া হয়েছিল জামসেদপুরের এক সাহিত্য-সমাবেশে, অ্যালেন গিন্সবার্গ তখনই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি হলেও আত্মাভিমান ছিল না বিন্দুমাত্র, অনাহূতভাবেই আমাদের সঙ্গী হয়ে সেও গিয়েছিল সেখানে। জামসেদপুর থেকে সমীর রায়চৌধুরীর কাছে চাইবাসায়, আমি তখন ফিরে এসেছি। সমীর ও তার ভাই মলয় সম্ভবত সেই সময়েই অ্যালেনের কাছে প্রেরণা পেয়ে কিছু পরবর্তীকালে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পরিকল্পনা করে।
সে সময় আমার সঙ্গে অ্যালেনের তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি, আমি সময় পাইনি। শক্তি, সন্দীপন, শরৎকুমার, তারাপদ রায়, উৎপলকুমার বসু, জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গেই অন্তরঙ্গতা হয়েছিল বেশি। আমার সঙ্গে পরিচয় দৃঢ় হয় অনেক পরে, বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এপারে চলে এসে যশোর রোডের দুপাশে সামান্য সামান্য ছাউনির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কোনওক্রমে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। তখন আমেরিকায় বব ডিলান, জন বায়েজদের মতন সঙ্গীতশিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা এইসব শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে একটি কমিটি গড়েছিল এবং সেই কমিটির পক্ষ থেকে অ্যালেনকে পাঠানো হয়েছিল সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা দেখে আসার জন্য। দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসে অ্যালেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমিই তাকে নিয়ে যাই যশোর সীমান্ত পর্যন্ত। সেবারেও অতি বর্ষণে যশোর রোড ডুবে গিয়েছিল কিছু জায়গায়, তার ফলে শরণার্থীদের যন্ত্রণা ও মৃত্যুহার বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি, গাইঘাটার কাছে গাড়ি ছেড়ে আমাদের নৌকোয় চাপতে হয়েছিল। শরণার্থী শিবিরগুলি অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখার পর ফিরে গিয়ে অ্যালেন তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহে প্রচুর উদ্যম নেয় তো বটেই এবং লেখে তার বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। সে কবিতায় সুর দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সে গানও গেয়েছে বহু সমাবেশে, সে গানটির রেকর্ডও বেরিয়েছে। সে গান যদি কেউ মন দিয়ে শোনে, তা হলে হঠাৎ এক জায়গায় আমার নামটি তার কানে ধাক্কা দেবে।
কলকাতা ও কাশী মিলিয়ে অ্যালেন ও পিটার প্রথমবারে থেকে গিয়েছিল ছ’মাস। বিশেষ কোনও প্রসঙ্গ না থাকলেও একজন কবির সঙ্গে আলাপচারিতে অনেক কিছু জানা হয়ে যায়। শুধু ইংরেজি কবিতা নয়, ফরাসি ও জার্মান কবিতা সম্পর্কেও অ্যালেনের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল, তাঁর কাছে শিখেছি আধুনিক সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার কথা। অ্যালেনের তোলা একটি ফটোগ্রাফ দিয়ে হয়েছিল এক সংখ্যা কৃত্তিবাসের মলাট, তাঁর সঙ্গে বসে আমি তার তিনটি কবিতার অনুবাদ করে ছাপিয়েছিলাম আমাদের পত্রিকায়। অ্যালেনও আমাদের কয়েকজনের কবিতা অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিল সিটি লাইট জার্নালে। ওদের দলেরই অন্যতম কবি লরেন্স ফের্লিংগেটির সিটি লাইট নামে বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা আছে সানফ্রান্সিসকো শহরে।
আমাদের দেশে সাধু-সন্ন্যাসী, সঙ্গীতশিল্পী থেকে রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালারা পর্যন্ত অনেকেই গাঁজায় দম দেয় বহু যুগ ধরে, মধ্যবিত্তদের মধ্যে তা ছিল ঘৃণার বস্তু। মধ্যবিত্ত এমনকী উচ্চবিত্ত সমাজের ছেলেমেয়েরা গাঁজা টানতে শেখে সাহেবদের কাছ থেকে। প্রথমে বিট জেনারেশন, পরবর্তীকালে তাদেরই বংশধর হিপিরা গাঁজার ধোঁয়াকে জাতে তুলে দেয়। ভিয়েতনামে আমেরিকানদের অন্যায্য ও অমানবিক যুদ্ধের প্রতিবাদেই হিপি সম্প্রদায়ের উদ্ভব এবং তারা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। অ্যালেন গিন্সবার্গকে তারা গুরু বলে মেনেছিল, তার কাছ থেকে ওরা প্রধানত তিনটি জিনিস নেয়, রাস্তা-ঘাটে শুয়ে থাকার মতন কষ্টসহিষ্ণুতা, গাঁজা ও হরে কৃষ্ণ হরে রাম গান। এ ব্যাপারে আমারও সামান্য কৃতিত্ব আছে। অ্যালেন হরে কৃষ্ণ গানটি প্রথম শোনে কাশীতে, কিন্তু সুরটি ঠিক তুলতে পারছিল না। তার অনুরোধে এক রাত্রে ওই দু’ লাইন গান অন্তত পঞ্চাশবার গেয়ে শোনাতে হয়। আমি বারবার তাকে শুধরে দিয়েছি, হড়ড়ড়ে কৃস্স্না নয়, হরে কৃষ্ণ, ড়্যাম নয়, রাম…। অর্থাৎ হিপিদের গুরু অ্যালেন গিন্সবার্গ, আমি অ্যালেন গিন্সবার্গের ওই গানের গুরু বলা যেতে পারে। ও গান তো আর আমাদের শিখতে হয় না, বাল্যকাল থেকে শুনে শুনে কানে গেঁথে যায়।
আমাদের কয়েকজনকে গাঁজা টানার দীক্ষা দিয়েছিল অ্যালেন। শ্মশান যে একটা দ্রষ্টব্যস্থান কিংবা নিয়মিত গন্তব্য স্থান, তা আমরা আগে জানতাম না। অ্যালেন ও পিটারের সঙ্গে আমরা অনেক সন্ধে ও মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কাটিয়েছি নিমতলা শ্মশানে। সেখানে গুটিকতক ভক্ত পরিবৃত হয়ে বসে থাকে এক এক জন সাধু। কিছু গাঁজা কিনে নিয়ে গিয়ে আমরাও জুড়ে যেতাম সেই ভক্তদের সঙ্গে। সাধুবাবা তরিবত করে এক একবার গাঁজা সেজে প্রথমে নিজে প্রসাদ করে দেন, তারপর কল্কেটি গোল হয়ে হাতে হাতে ঘোরে। প্রথম প্রথম মনে হত, গাঁজা ব্যাপারটা একটা প্রচণ্ড ধাপ্পা, ওতে কোনও নেশাই হয় না। পরে আস্তে আস্তে তার মর্ম বুঝেছি, গাঁজা শুধু টানলেই হয় না, তার সঙ্গে অনেকখানি মনঃসংযোগ দরকার। কয়েকবার দম দেবার পর শুরু হয় সাধুবাবার সঙ্গে কথাবার্তা। অ্যালেন প্রত্যেক সাধুর কাছ থেকেই জানতে চায় তাঁর দৈবী অভিজ্ঞতার কথা। কোন পদ্ধতিতে জাগ্রত হয় কুলকুণ্ডলিনী, কখন উন্মীলিত হয় তৃতীয় চক্ষু ইত্যাদি। সাধুদের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হচ্ছে হিন্দি, আমাদের কারও কারওকে দোভাষীর কাজ করতে হয়। একদিন এক সাধু অ্যালেনের নানা প্রশ্ন শুনে বললেন, তুমি তো আংরেজ, তুমি আমাদের শাস্ত্র সম্পর্কে কতটুকু জানো, সেটা না বুঝলে আমি উত্তর দেব কী করে? তা শুনে অ্যালেন আমাকে বলল, ওঁকে বললো, আমি একটা বাচ্চা, আমি প্রথম থেকে পাঠ নিতে চাই। আমি বলতে গেলাম, সাহেব বলছেন, হাম বাচ্চা হ্যায়…হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে, কালো ওড়নায় মাথা ঢাকা এক মেমসাহেব বিশুদ্ধ হিন্দিতে বলল, ম্যায় বাচ্চে হুঁ! অ্যালেনের সঙ্গে এরকম কেউ কেউ মাঝে মাঝে আসত, কেউ কেউ সহজেই শিখে নিত বাংলা বা হিন্দি, অ্যালেন অবশ্য কঠোরভাবে এক ভাষী।
আর একটি নেশার দ্রব্যের কথাও এখানে উল্লেখ করতেই হয়। তখন এল.এস.ডি. নামে একটি ড্রাগ অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। এল.এস.ডি-র পুরো নামটি আজ আর মনে নেই, এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি চমকপ্রদ ওষুধ হিসেবে, পাগলদের চিকিৎসার জন্য। মানুষের কোনও স্মৃতিই নাকি হারায় না। মানসলোকের অনেক গহনে জমা হয়ে থাকে, উপরিতলে আর উঠে আসে না, এই ওষুধটি সেইসব অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। পূর্বস্মৃতি ফিরে পেলেই তো পাগলদের পাগলামি সেরে যাবে। ওষুধটি তখনও পরীক্ষামূলক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী হতে পারে জানা যায়নি, এর মধ্যেই সেটি নেশার দ্রব্য হিসেবে দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে গেল। লুপ্ত স্মৃতি কে না ফিরে পেতে চায়! ওষুধটি বাজারে ছাড়া হয়নি, কিন্তু আমেরিকায় বিজ্ঞানের ছাত্ররা কোনওক্রমে একটি-দুটি জোগাড় করে তার কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের পর নিজেরাই বানিয়ে ফেলতে লাগলেন ল্যাবরেটরিতে। নিষিদ্ধ ওষুধ হিসেবে সেটির দারুণ চাহিদা। অ্যালেনের কাছে এল.এস.ডি. সেবনের রোমহর্ষক বর্ণনা শুনে আমাদেরও খুব কৌতুহল হয়েছিল। খুবই কড়া ওষুধ, উল্টোপাল্টা ব্যবহারে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। সে রকম ঘটেছেও। ছোট্ট ট্যাবলেট, প্রথমে একটি দিয়ে শুরু করতে হয়, কিছুদিন অভ্যস্ত হবার পর দুটি, তার বেশি খাওয়া সত্যিই বিপজ্জনক। যদিও জানা গেল, জ্যাক কেরুয়াক একসঙ্গে চারটি ট্যাবলেট খেয়ে তার মাতৃগর্ভে থাকার স্মৃতিও ফিরে পেয়েছিল। এই দাবির সত্যি-মিথ্যে জানি না, যদি সত্যি হয় তা হলে এই কারণেই জ্যাক কেরুয়াকের অকালমৃত্যু হয়েছিল কি না তাই-ই বা কে বলতে পারে।
এ দেশে এল.এস.ডি. পাওয়ার কথা নয়, কিছু হিপি সঙ্গে নিয়ে আসে। শক্তির অতিরিক্ত আগ্রহে অ্যালেন ওদের কাছ থেকে চারটি ট্যাবলেট জোগাড় করে দিল এবং এর ব্যবহার প্রণালী শিখিয়ে দিয়ে সাবধান করে দিল বারবার। ওষুধটি খেয়েই শুয়ে পড়তে হয়, এর পর চার ঘণ্টা একটুও নড়াচড়া করা নিষেধ, এই সময়ের মধ্যে ক্ষুধাবোধ কিংবা মলমূত্র ত্যাগের ইচ্ছে কিছুই জাগবে না, তৃষ্ণা পেতে পারে, সেজন্যই পাশেই রাখা দরকার জলের পাত্র এবং অবশ্যই একজন বিনা নেশায় নজর রাখবে, হঠাৎ বুকে ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক ডাকতে হবে।
বন্ধুদের মধ্যে আর কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আমার স্বভাব হচ্ছে এই, আমি নিজে থেকে হঠাৎ কোনও দুঃসাহসিক কাজ করতে পারি না, কিন্তু অন্য কেউ সেরকম কিছু শুরু করলে মনে হয়, দেখাই যাক না। সুতরাং শক্তির সঙ্গী আমি। নিজেদের বাড়িতে এইসব কাণ্ড করার সুবিধে নেই, তারাপদ রায় তখন মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে একা থাকে। তারাপদ অসম্ভব বন্ধুবৎসল মানুষ, তাঁর ফাঁকা বাড়িতে আমরা অনেক অত্যাচার করেছি, সেখানেই শক্তি ও আমি ওষুধ মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লাম এক খাটে পাশাপাশি। তারাপদ বসে রইল চেয়ারে।
সত্যিই আজীবন মনে রাখার মতন সেই অভিজ্ঞতা। শক্তি ও আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দু’ রকম। ওষুধটি খাওয়ার একটু পরেই চোখ বুজে আসে, তারপর দেখা যায় অসংখ্য রংয়ের কারুকার্য, যেন শূন্যতার মধ্যে হঠাৎ ঝাপটা মারছে রং, যেন একটা বিশাল দেওয়াল চিত্রিত হচ্ছে। তারপরই বিদ্যুৎ চমকের মতন কোনও দৃশ্য, কোনও রাস্তা, কোনও মানুষের মুখ, একটা জামা ছিড়ে যাওয়া, মাটিতে ঝনঝন করে পড়ল খুচরো পয়সা… ক্রমশ দৃশ্যগুলি স্থির হতে থাকে, একবার দেখি যে একটা পুকুরের ধারে বাঁকা খেজুরগাছ বেয়ে উঠছে একটা ছ’-সাত বছরের ছেলে…কে ছেলেটি? তারপর চিনতে পারি, এ তো আমিই আমার ছ-সাত বছরের চেহারা, যেন সিনেমায় ধরে রাখা। এই রকম আরও দৃশ্য। এর মধ্যে জোর করে চোখ খুললে আবার সব কিছু সাধারণ হয়ে যায়, এই তো তারাপদর ঘর, চেয়ারে বসে চুরুট ফুঁকছে তারাপদ, দেওয়ালে জট পাকানো ইলেকট্রিকের তার…কিন্তু এই বাস্তবতাও খুব ক্ষণস্থায়ী, তারপরই মনে হয়, ঘরটা দুলছে, জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ছে মেঘ, দেওয়াল তো নেই, রামধনু।
মোট কথা সেই চার ঘণ্টা আমার কাছে সুমধুর উপভোগ্যই হয়েছিল, কিন্তু শক্তির তা হয়নি। কিছুক্ষণ পর থেকেই শক্তির মনে হয়, ওর পা দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তারাপদ ওর পায়ে হাত ছুইয়ে বলেছিল, সেরকম কিছু নয়, তবু শক্তি সে কথাই বলতে লাগল বারবার। তারপর শক্তির মনে হয়, মৃত্যুর সময় মানুষের পায়ের দিক থেকেই ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। খুব সম্ভবত এই নেশার ঘোরে কোনও একটা চিন্তা একবার পেয়ে বসলে আর কিছুতেই যেতে চায় না। আমি যদিও শুনিনি, নিজেই তখন আচ্ছন্ন ছিলাম, তবে শক্তি নাকি সত্যি সত্যি মরে যাচ্ছে ভেবে এক সময় বলে উঠেছিল, তারাপদ, আমার লাস্ট ওয়ার্ড লিখে নে!
ঠিক চার ঘণ্টা পরে শক্তি আর আমি এক সঙ্গেই উঠে বসেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুব খিদে পেয়েছিল, কিন্তু আর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। আরও দুটি ট্যাবলেট বাকি ছিল, শক্তি আবার একদিন এই নেশার পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তারাপদ বন্ধুদের বাঁচাবার জন্যই সেই মূল্যবান বড়ি দুটি ফেলে দেয় নর্দমায়।
এর পরেও আমি আরও অনেক রকম নেশার দ্রব্য পরীক্ষা করে দেখেছি, কিন্তু একমাত্র সিগারেট ছাড়া আর কোনও নেশার দাসত্ব করিনি। এতগুলি বছর পরেও বুঝতে পারি, এই নিরীহ সিগারেটের মতন হারামজাদা নেশা আর হয় না। অনেক চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছি না।
তেত্রিশ
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, কিংবা তারও আগে যাঁরা কলকাতা শহর দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সব পাড়াতেই কিছু বাড়ির গায়ে ‘টু-লেট’ লেখা বোর্ড ঝোলানো থাকত। এই প্রজন্মের অনেকে হয়তো ‘টু-লেট’ মানেই বুঝবে না। তখন প্রচুর খালি বাড়ির মালিকরা ভাড়াটেদের ডাকাডাকি করত, ভাড়া নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা পাত্রী দেখার মতন বাড়ি ঘুরে দেখে অপছন্দের ঠোঁট উল্টে চলে যেত কিংবা দরাদরি করত, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতনই বাড়িওয়ালারা তোষামোদের হাসি হাসত। দেশ বিভাগের পর সে-অবস্থাটা একেবারেই উল্টে যায়। আগেকার সব খালি বাড়ি, ভূতের বাড়ি, বেওয়ারিশ বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল, ভাড়া বাড়তে লাগল হু হু করে, বাড়িওয়ালা শ্রেণীরই তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, ভাড়া ছাড়াও বে-আইনি কালো টাকার সেলামি নামে একটি প্রথা চালু হল, এমনকী যে ভাড়াপ্রার্থী চড়া ভাড়া ও সেলামি দিতেও রাজি, তার চেহারা বা আচরণ পছন্দ না হলে বাড়ির মালিক অবজ্ঞার সঙ্গে বাঁ হাত নেড়ে বলত, হবে না, হবে না! অর্থাৎ একই বস্তু বায়ার্স মার্কেট থেকে সেলার্স মার্কেটে রূপান্তরিত হয়ে গেল রাতারাতি।
আমাদের শ্যামপুকুর স্ট্রিটের আরামের বাড়িটি ছাড়তে হল এক বিচিত্র কারণে। বছরের পর বছর বাড়িওয়ালার কোনও হদিস ছিল না, আমরা রেন্ট কন্ট্রোল অফিসে নিয়মিত ভাড়া জমা দিয়ে এসেছি। ভাড়া বাকি না পড়লে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়, আদালতের নির্দেশ ছাড়া। সুতরাং আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম। বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে কোনও রকম খোঁজখবর নেওয়া হয় না বলে অতি প্রয়োজনীয় কিছু কিছু মেরামতির কাজ আমাদের খরচেই করতে হত। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় সাদা প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরা এক সুদর্শন যুবক এসে হাজির হল, দেখলে মনে হয় সে বিমানবাহিনীর কর্মী, পরিচয় দেবার পর জানা গেল সে সত্যিই তাই এবং তার অন্য পরিচয়, এই বাড়ির মালিকদের পরিবারের সে অন্যতম জামাই। টাউন স্কুলের শিক্ষক মহাশয়টির মৃত্যুসংবাদ সে কোনও সূত্রে শুনে শোক প্রকাশ করতে এসেছে। তখন চা পানের সময়, তাকেও চা দেওয়া হলে সে সেই চায়ের প্রচুর সুখ্যাতি করে বিদায় নিল কিছু পরে। দু’-চারদিন পরেই সে ফিরে এল আবার। আমাদের বাড়ির মতন চা নাকি সে আর কোথাও পান করেনি। তাই এসেছে সেই চায়ের টানে৷ এর পরেও সে আসতে লাগল ঘনঘন, চায়ের আকর্ষণেই, কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যায়। তার ব্যবহার অতি ভদ্র, এবং মিষ্টভাষী, এরকম একজন এসে চা খেতে চাইছে এবং প্রত্যেকবার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। আমি ওই সময় প্রায় দিনই বাড়িতে থাকি না। সে রান্নাঘরে আমার মায়ের কাছাকাছি বসে গাল-গল্পের ফাঁকে টুক করে বলা শুরু করল, মাসিমা, আপনার ছেলেকে বলুন, বাড়িটা ছেড়ে দিতে। এ বাড়িটা আমার ভাগে পড়েছে, আমি এটা ভেঙে নতুন বাড়ি বানাব। সপ্তাহের পর সপ্তাহ এরকম চলতে থাকায় মা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। সে ভয় দেখায় না, মামলা-মোকদ্দমার কথা উচ্চারণও করে না, কিন্তু এমনই মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে লাগল যে আমাকে একদিন বললেন, নাঃ, আর এ বাড়িতে থাকা যাবে না। এ ছেলেটিকে দেখলেই এখন ভয় করে! ও চলে যাবার পরেও ওর নিশ্বাস এ বাড়ির মধ্যে ভেসে বেড়ায়। যেহেতু সে কখনও রুক্ষ ব্যবহার করেনি, সেইজন্য তার সঙ্গে ঝগড়ারও প্রশ্ন ওঠে না। সেই একজন চা খেতে আসা যুবকের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্যই আমরা সে বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।
পরে অবশ্য অনেক শুভার্থী আমাকে বলেছে যে, কলকাতা শহরের অমন সুবিধেজনক জায়গার বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে আমরা অতি নির্বোধের মতন কাজ করেছি। সারা জীবনেও আমাদের তোলা যেত না নিয়মিত ভাড়া দিয়ে গেলে। বাড়িভাড়ার মামলা মিটতে লাগে কম পক্ষে দশ বছর, তাও বিচারকের রায় যায় ভাড়াটেদের পক্ষেই। ওই যুবকটির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। স্বেচ্ছায় ছাড়তে হলেও মালিকদের কাছ থেকে অন্তত পাঁচ-দশ হাজার টাকা আদায় করা যেত অনায়াসেই। এইসব ব্যাপারে আমি সত্যিই নির্বোধ।
এর আগে আমরা অনেকবার বাসা বদল করেছি, সে ব্যবস্থা করতেন বাবা, তাঁর ছাত্রদের অভিভাবকদের সাহায্য নিয়ে। এখন দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। কিছুদিন খোঁজাখুঁজির পর হন্যে হয়ে এই উপলব্ধি হল যে কলকাতা শহরের এলাকার মধ্যে টিকে থাকার সাধ্য আমাদের নেই। ষাটের দশক থেকেই অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত বাঙালি কলকাতা ছেড়ে মফস্বলে চলে যেতে বাধ্য হয়, আমাদেরও যোগ দিতে হল সেই এক্সোডাসে। শেষ পর্যন্ত দু’খানা ঘরের একটি ফ্ল্যাট পছন্দ হল নাগেরবাজার অঞ্চলে সাতগাছিতে, কেউ কেউ বলে ষাটগাছি, যোগীপাড়া রোডে। এত দূরের এই ফ্ল্যাটের ভাড়া শ্যামপুকুরের বাড়ির ছ’গুণ। নামে রোড হলেও রাস্তাটি বেশ সংক্ষিপ্ত, বাই লেন হওয়াই উচিত ছিল। পরে দেশ-বিদেশের অনেকে আমার ঠিকানা দেখে প্রশ্ন করেছে, ওখানে বুঝি অনেক যোগী থাকেন? তাঁরা কেমন? আমি অবশ্য কোনো যোগী দেখিনি।
বাড়িটি অবশ্য বর্ণনা দেবার মতনই মনোহর। বেশ কয়েক বিঘে জমির মাঝখানে একটি দোতলা বাড়িতে পাঁচটি ফ্ল্যাট, সামনে ও ডানদিকে বড় বড় গাছ ও বাগান, একটি পুকুর, ইনকাম ট্যাক্সের এক ধনাঢ্য উকিল এর মালিক। ফ্ল্যাটটির সামনে গোল বারান্দায় বসলে নানারকম গাছে দেখা যায় হরেক রকম পাখি। একেবারে সামনেই একটি লম্বা আতাগাছে মাঝে মাঝে এসে বসে একটি ইষ্টকুটুম পাখি, পূর্ব বাংলার গ্রাম ছাড়ার পর এই পাখিটিকে দেখলাম অনেকদিন বাদে। গ্রাম ছাড়ার পর মাঝে মাঝে আমি কলকাতার গঙ্গায় সাঁতার কেটেছি, এখানে আবার সাঁতার শুরু হল। ভাড়াবাড়িতে থেকে সংলগ্ন পুকুরে সাঁতার কাটার বিলাসিতা ক’জনের হয়!
কৃত্তিবাসের ঠিকানাও বদলে গেল এই বাড়িতে। অনেক কবি ও কবিযশোপ্রার্থী অনেক দূর থেকে, এমনকী সুদূর দক্ষিণ কলকাতা থেকেও ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আসত এখানে৷ এত বড় বাগানের মধ্যে উকিলবাবুর শখ করে বানানো বাড়িটি দেখে তাদের কারও কারও ধারণা হল, ওটা আমাদের নিজস্ব বাড়ি, অর্থাৎ আমি সম্পন্ন পরিবারের সন্তান। সরাসরি প্রশ্ন না করলে আমি তাদের এই ধারণাটি জিইয়ে রেখে মজা পেতাম।
বসবাসের পক্ষে বাড়িটি অতি চমৎকার ও আরামদায়ক, শুধু যাতায়াতের কষ্ট মেনে নিতেই হত। মফস্বলের বাসে হাড়-পাঁজরা পর্যন্ত ঝরঝরে হয়ে যায়। ঘোর দুপুরেও এইসব বাস ভিড়ে ভর্তি, প্রায়ই যেতে হত পা-দানিতে এক পা ঠেকিয়ে ঝুলতে ঝুলতে। সেই রকম ঝুলন্ত যাত্রার সময়েই এক সহযাত্রী যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়, তার নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সে তখন বাগুইহাটির দিকে একটা স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। একটা নাটকের দল গড়ে বাংলা নাটকে নতুন জোয়ার আনার স্বপ্নের কথা সে আমাকে শোনাত। আমারও তো তখন স্বপ্নই সম্বল।
এই বাড়িটির আর একটি বিশেষ সুবিধে ছিল। আমি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকি বাড়ির বাইরে, আমার তিন ভাইবোন তখনও ছাত্র-ছাত্রী, সুতরাং মাকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হয়। কিন্তু খুব কাছেই পূর্ববঙ্গ পরিত্যাগী আমার কয়েকজন মামা বাড়ি করেছেন। সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বোন, অর্থাৎ আমার দিদিমার জন্যও একটি ছোট বাড়ি করে দিয়েছেন ওই পাড়ায়, দিদিমা সেখানেই থাকছেন তাঁর ছেলে বউয়ের সঙ্গে। মা ইচ্ছে করলেই যে-কোনও সময় সেখানে চলে যেতে পারবেন, কিংবা তাঁরা আসবেন এ বাড়িতে। মায়ের এরকম নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েই যেন আমি বাড়ি ফেরার সময়টা পিছিয়ে দিতে লাগলাম ক্রমশ। মধ্য রাত্তিরের আগে আড্ডাই ভাঙে না যে। মা কিন্তু আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে কখনও নিশ্চিন্ত হননি, রাত দশটা বেজে গেলেই আমার প্রতীক্ষায় নিত্যদিন দাঁড়িয়ে থাকতেন বারান্দায়। দেরিতে ফেরার জন্য আমার অভিনব বহু যুক্তিরও অভাব ছিল না। জনসেবক নামে একটি সংবাদপত্রে বিকেলবেলা পার্টটাইম কাজ নেওয়ার ফলে আরও সুবিধে হয়ে গেল। সংবাদপত্রের কাজ সম্পর্কে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই, নাইট ডিউটি, হঠাৎ হঠাৎ বাইরে যাওয়া, এসব স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়। আমার দায়িত্ব ছিল রবিবাসরীয় চারটি পৃষ্ঠার সম্পাদনা, বন্ধুবান্ধবদেরই গল্প-প্রবন্ধ ছাপা হত, চেনাশুনো তরুণ শিল্পীরা করে দিত অলঙ্করণ— সেইসব লেখক ও শিল্পীরা সবাই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছেন—আমার কাজ ছিল প্রতিদিন বড় জোর দু’ঘণ্টা। সংবাদ বিভাগের সঙ্গে আমার কোনও সংস্ৰবই ছিল না। কিন্তু কোনওদিন রাত বারোটার পরে বাড়ি ফিরে গম্ভীরভাবে জানাতাম, আজ সারা রাত থাকতে বলেছিল, আমি তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে চলে এলাম!
সাতগাছির রাস্তায় পরপর উদ্বাস্তু কলোনি। সবগুলিই এককালে কলকাতার ধনীবাবুদের বাগানবাড়ি ছিল, জবরদখল হয়ে গেছে। যোগীপাড়ার গলির ঠিক সামনের কলোনিটিই আমার পূর্ব-চেনা। এটার মালিক গ্রে স্ট্রিটের ঘোষ পরিবার, আমার স্কুলের বন্ধু আশুর সঙ্গে এই বাগানবাড়িতে কৈশোর বয়সে পিকনিক করতে এসেছি বেশ কয়েকবার।
সেই একটি উদ্বাস্তু কলোনির প্রথম স্থাপনা থেকে একটু একটু করে রূপান্তর আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানুষগুলিকেও দেখেছি বদলাতে। সেই সব দেখা থেকেই ‘অর্জুন’ উপন্যাসটি লেখা। আরও পরবর্তীকালে পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসেও এই অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে।
সাতগাছির বাড়িতে এসে আমার রুটিন কিছুটা বদলায়, সকালবেলার টিউশানিটা ছাড়তে বাধ্য হই। কেন না, সকালবেলা কলকাতায় গিয়ে টিউশানি করে ফিরে আসা, তারপর স্নান-খাওয়া সেরে অফিসে ছোটা খুবই ঝকমারির ব্যাপার। সে টিউশানির উপার্জন পুষিয়ে নিতে হয় টুকটাক লেখালেখি করে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আহ্বানে প্রথম আনন্দবাজার অফিসে যাই, তারপর নীরেনদা আমাকে কিছু কিছু গ্রন্থ সমালোচনা করতে দিতেন। সে সুযোগ পেয়ে আমার আত্মাদের অবধি ছিল না। বিনা পয়সায় নতুন নতুন বই পাওয়া যাবে, আবার সেগুলি সম্পর্কে লিখলে পয়সাও পাওয়া যাবে, একেই বুঝি বলে সোনায় সোহাগা! বেশ কয়েক বছর আমি বই সমালোচনার কাজ করেছি। তা করতে গিয়ে বিপদও হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী অশোককুমার সরকারের বড় ছেলে অভীককুমার সরকার যখন সদ্য কিছু কিছু কাজ দেখাশুনো করতে শুরু করেন তখন তিনি বিদেশি সাংবাদিকতার মতন মান রক্ষার অত্যুৎসাহে একদিন আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আপনি বই রিভিউ করেন, ঠিক যে-যে বইয়ের যেমন গুণাগুণ তা সঠিকভাবে লিখবেন, অন্য কোনও চিন্তা করবেন না, দরকার হলে কড়া সমালোচনা করবেন। তা শুনে আমি তৎকালীন এক অতি জনপ্রিয় লেখকের ভুল তথ্যপূর্ণ ও অমনোযোগে লেখা একটি উপন্যাস সম্পর্কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিলাম। সেই লেখক ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে অশোককুমার সরকারের কাছে নালিশ করেন এবং আনন্দবাজারে লেখা বন্ধ করে দেবার হুমকি দেন। আর একজন বিখ্যাত লেখক অভিশাপ দেন, ওই ছেলেটির আঙুলে কুষ্ঠ হবে! (অনেক বছর পরে দেশ পত্রিকায় আমার একটি ধর্ম সম্পর্কিত লেখার জন্য ছাপার অক্ষরে আমার আঙুলে কুষ্ঠ হবার অভিশাপ দেওয়া হয়, কিন্তু আমার আঙুলগুলো এখনও পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই আছে।)
আগে আমি নিজস্ব লেখা পড়ার সময় পেতাম বেশি রাত্রে। এখানে ফিরিই অনেক দেরিতে, তা ছাড়া দু’-এক সন্ধে এই বাড়িতে থেকে দেখেছি, দিনের আলো নিবে যাবার পর এ অঞ্চলে সুস্থিরভাবে পড়াশুনো করা অসম্ভব। এমন মশার উপদ্রব! আবাল্য কাটিয়েছি উত্তর কলকাতায়, সেখানে কখনও মশারি টাঙিয়ে শুইনি, মশার অভিজ্ঞতাই ছিল না, এখানে মশারির বাইরে বসে থাকাও কষ্টকর। দমদমের ছাত্র-ছাত্রীরা সন্ধের পর কী করে পড়াশুনো করে কে জানে? সকালের টিউশানিটা ছাড়ার পর সময় পেলাম অনেক। সেই থেকে সকালবেলাতেই লেখালেখির অভ্যেস আমার শুরু হয়ে গেল, সন্ধের পর আর কলম ছুঁই না পারতপক্ষে।
রাত্তিরের টিউশানিটাও সরিয়ে আনলাম বিকেলে, অফিস ছুটির পর টুক করে সেটা সেরে এসে আড্ডা জমত সংবাদপত্রের দফতরে। দশ টাকা-পনেরো টাকা পাওয়া যায় বলে অনেক তরুণ লেখক ও শিল্পীই সাগ্রহে লেখা ও ছবি দিতেন, এমনকী কমলকুমার মজুমদারও ধারাবাহিক রচনা লিখেছেন। পত্রিকাটি কংগ্রেস দলের। কিন্তু রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় রাজনীতির নামগন্ধও থাকত না, কংগ্রেসের কর্তারা কেউ মাথা ঘামাতেন না। সে পত্রিকায় আমার সহকর্মী ছিলেন প্রখ্যাত ও আমাদের প্রিয় লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। কমলকুমারের লেখা ‘গোলাপ সুন্দরী’ আমি পড়তে দিয়েছিলাম জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে, কমলকুমারের সঙ্গে তাঁর আলাপও করিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু দু’জনে এমনই বিপরীতধর্মী মানুষ যে ওঁদের মধ্যে ভাব জমেনি। কমলকুমার আমাদের সক্রেটিস, তার সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গেরও সাক্ষাৎকার ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। সে এক মজার দৃশ্য। কমলদা কথা বলতে লাগলেন পল ভেরলেন ও ত্রিস্তঁ করবিয়ের-এর কবিতা বিষয়ে, আর অ্যালেন বলতে লাগল উপনিষদ ও সাংখ্যদর্শনের কথা। এঁদেরও ভাব জমেনি।
অ্যালেন একদিন পিটারকে নিয়ে আমাদের ষাটগাছির বাড়িতেও এসেছিল বাসে চেপে। আমি বা একজন বাঙালি তরুণ কবি কেমনভাবে থাকে, সেটা দেখার আগ্রহ ছিল তার। বাড়িটা তো ভালোই, কিন্তু আমি যে মা ও ভাইবোনের সঙ্গে এক সংসারে বসবাস করি, মা আমাদের জন্য রান্না করে দেন, জামাকাপড় কেচে দেন, এসব জেনে সে কৌতুক বোধ করেছিল বেশ। ওদের দেশে কোনও সাবালক পুরুষের পক্ষে এমন জীবন অচিন্ত্যনীয়। ওরা মাতৃসঙ্গ খুব কমই পায়, মাতৃস্মৃতি নিয়ে কবিতা লেখে। অ্যালেনের দীর্ঘ কবিতা ‘কাডিস’, তার মা সম্পর্কে বিলাপগাথা।
অ্যালেনকে খাওয়ানোর কোনও ঝামেলাই ছিল না, ভাতের মধ্যে ডাল, তরকারি, বেগুনভাজা, মাছের ঝোল সব একসঙ্গে মেখে নিয়ে সে দিব্যি হাত দিয়ে খেতে শিখেছিল। একজন সাহেবের ওই প্রকার আহারপদ্ধতি দেখে দরজার পাশে ভিড় করে থাকা মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসেছিলেন। পিটার কাঁটা বেছে মাছ খেতেও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। পিটার অ্যালেনের ছায়াসঙ্গী হলেও তার নিজস্ব গুণও ছিল অনেক। সেও কিছু কবিতা লিখেছে, সে যেমন বাঁশি বাজাতে পারে, তেমনই সাইকেল চালাতে চালাতে দু’হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও পারে। শেষের দিকে এক প্রখর বাকপটু বাঙালি ললনার সঙ্গে তার প্রেমও হয়ে গিয়েছিল। অ্যালেন নারীবিমুখ হলেও পিটারের আসক্তি উভয় দিকেই।
অ্যালেন পিটারের আগমনবার্তা শুনে পাশের পাড়া থেকে আমার এক পিসেমশাই এসেছিলেন দেখা করতে, জীবনে তিনি কখনও কোনও সাহেবের সঙ্গে কথা বলেননি বলে সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও নিজের ইংরেজি জ্ঞান যাচাই করতে চান। সাহেবরা এ দেশে একশো নব্বই বছর রাজত্ব করে গেলেও অনেক শিক্ষিত বাঙালি কখনও কোনও সাহেবের মুখোমুখি হয়নি। পিসেমশাই অ্যালেনের সামনে শেকসপিয়ার থেকে কয়েক লাইন মুখস্থ বলতে শুরু করলে অ্যালেন মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি একটা বাংলা কবিতা মুখস্থ বলতে পারেন? পিসেমশাই পারেননি। এই আমাদের শিক্ষিত বাঙালি।
অত দূরে বাড়ি নিলেও বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই ছুটির দিনে এসে হাজির হত। পুকুরধারে বসে খাওয়া-দাওয়া করলে মনে হত বেশ একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে পিকনিকের মতন। একবার আটচল্লিশ ঘণ্টা হরতাল ডাকা হয়েছে, বাড়ি থেকে বেরোবার উপায় নেই, হঠাৎ দেখি একটু বেলার দিকে গেট ঠেলে ঢুকছে শক্তি। কী করে এলে? কিছুটা হেঁটে, তারপর একটা দমকলের গাড়িতে চেপে। শক্তির অসাধ্য কিছুই ছিল না। একবার রাত দুটোর সময় হাওড়ায় পার্থসারথি চৌধুরীর কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে, একটা গ্যারাজগামী ফাঁকা দোতলা বাস থামিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিজের বাড়ির গলির মধ্যে পর্যন্ত সেই বাস নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বন্ধু, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিজীবী পার্থসারথি চৌধুরী যখন হাওড়ার জেলাশাসক ছিল, তার কোয়ার্টার মানে এক বিশাল ঐতিহ্যসম্পন্ন প্রাচীন প্রাসাদ, সেখানে আমাদের আড্ডা জমত প্রায়ই, পাথর স্ত্রী গীতা প্রখ্যাত জাদুকর পি সি সরকারের মেয়ে, এই দম্পতির আতিথেয়তার তুলনা নেই। এসব অবশ্য অনেক পরের কথা। আমাদের পরবর্তীকালের বন্ধু ও কবি এবং পুলিশের কর্তা আয়ান রশিদ খান তখন হাওড়ার এস পি, সে পার্থর বাড়িতে নিয়ে এসেছিল ভারতবিখ্যাত গায়ক আমির খানকে। আমির খান নেশা বা আড্ডার সময় গলা খুলতে চাইতেন না, আমাদের কাকুতি-মিনতিতে সবে মাত্র একটু ছেরছার শুরু করেছিলেন, শক্তি তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিল, বুড়ো, তুমি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারো না কেন? আমির খান বেশ চটেছিলেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে না পারার কারণে নয়, তাঁকে বুড়ো বলার জন্য! সত্যিই অনুচিত সেই সম্বোধন, আমির খান ছিলেন সবল চেহারার সুপুরুষ। যাকে-তাকে বুড়ো বলা ছিল শক্তির স্বভাব, সেইজন্যই বোধহয় সে নিজে আর বুড়ো হল না।
অ্যালেনের কলকাতা থেকে বিদায় নেবার শেষ রাত্রিটিতে আমরা মোচ্ছব করেছিলাম উৎপলকুমার বসুর ভবানীপুরের বাড়িতে। সে বাড়িতে উৎপল তখন অভিভাবকহীন একলা সংসারী। অ্যালেনরা ভারত-প্রবাসে প্যান্ট-শার্ট পুরোপুরি ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরত সবসময়, পিটার তো দারুণ গরম, পিচ-গলা দুপুরেও হাঁটত খালি পায়ে, কিন্তু ফেরার সময় বিমানের টিকিট কাটতে গিয়ে তারা শুনল, ওই পোশাকে প্লেনে ওঠা যাবে না। তখন ইউরোপ আমেরিকার দিকে জাহাজ-যাত্রার বদলে বিমানযাত্রা সবেমাত্র চালু হয়েছে, নিয়মকানুনের কড়াকড়ি ছিল অনেক রকম। অনেক ঝগড়াঝাঁটি করেও লাভ হয়নি, আমাদেরই কারও কারও কাছ থেকে জামাপ্যান্ট ধার করেছিল অ্যালেন, জুতো কিনতে বাধ্য হয়েছিল। সেই শেষ রাতটিতে প্রচুর পানাহার করে আমরা সবাই মিলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এক ঘরে। অ্যালেন পরে কবিতা লিখেছে ‘লাস্ট নাইট ইন ক্যালকাটা’, তার মধ্যে কয়েকটি পঙ্ক্তি এরকম:
O spirit of poetry, no use calling on you
abbling in this emptiness furnished with beds
under the bright oval mirror—perfect
night for sleepers to dissolve in tranquil
blankness, and rest there eight hours
—waking to stained fingers, bitter mouth
and lung gripped by cigarette hunger…
সাধারণত আমাদের রাত্রির আড্ডা হত ওয়েলিংটন মোড়-ধর্মতলা অঞ্চলে, সেখান থেকে উত্তর-দক্ষিণের যাত্রীরা ভাগ হয়ে যেত এক সময়। উত্তর কলকাতাবাসীরই তখন সংখ্যাধিক্য, আমরা সে ক’জন শ্যামবাজারের মোড়ে এসে আবার শুরু করতাম দ্বিতীয় দফা। সবাই অবিবাহিত, সেইজন্য বাড়ি ফেরার টান কিংবা ফেরার পর বকুনি খাওয়ার ভয় কম। শক্তি ও শরৎকুমার থাকে কাছাকাছি একই দিকে, সন্দীপনও ততদিনে হাওড়া ছেড়ে চলে এসেছে বরানগরে। শ্যামবাজার মোড়ের সেই গভীর রাতের আড্ডায় রোমহর্ষক ঘটনাও ঘটেছে মাঝেমাঝে। সকলেই কিছু না-কিছু লিখেছে সে বিষয়ে। শরৎকুমারের লাইন ‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক’ এখনও অনেকে উদ্ধৃতি দেয়। শক্তির বিখ্যাত কবিতা, ‘সে বড় সুখের সময় নয়…’, এরকম মাঝরাতে শ্যামবাজার থেকে তার বাড়ি ফেরারই বর্ণনা। ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যায়। তবু যেন আড্ডা ভাঙতে ইচ্ছেই করে না। সন্দীপন ও আমাকে যেতে হয় আরও অনেক দূরে, একমাত্র বাহন শেয়ারের ট্যাক্সি। বরানগর আর নাগেরবাজারমুখী ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে দু’ দিকের রাস্তায়, শেয়ারে নেয় এক টাকা, দু’ টাকা। সে-যাত্রাও এক একদিন নাটকীয় হত বেশ। ষাটের দশকের শেষভাগে যখন নকশাল আন্দোলন শুরু হয়, চতুর্দিকে খুনোখুনির আতঙ্ক, তখনও আমরা নৈশ অভিযান বন্ধ করিনি। সেই বয়সে মৃত্যু নিয়ে জুয়াখেলার একটা ভাব তো থাকেই।
যশোর রোডে ষাটগাছির মোড়ে নেমে খানিকটা হেঁটে আসতে হয় আমাদের বাড়িতে। অন্ধকার গলিপথ, তারপর বাড়ির সামনের গেট ঠেলে বাগানের মধ্য দিয়ে আসা। কয়েক ধাপ সিঁড়ির পর একটা রোয়াক, তারপর ভেতরে ঢোকার দরজা। সে দরজা আমার জন্য খোলা রাখতেই হয়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন মা। এবাড়ির জমির ডানদিকের শেষ প্রান্তের দেওয়ালের ওপাশেই একটা পরিত্যক্ত কবরখানা। মা একদিন বলেছিলেন, অনেক রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায়ই কবরখানাটার দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি ভূত-প্রেত কিছু দেখা যায়। কোনওদিন কিছুই দেখি না তো, তা হলে বোধহয় ওসব কিছু নেই! বাবার মৃত্যুর এক বছর পরে মা বলেছিলেন, আর নিয়ম করে বার্ষিক শ্রাদ্ধ করার দরকার নেই, শুধু শুধু পিণ্ডি দিয়ে কী হবে, মরা মানুষ কিছু খেতে পারে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। যাই হোক, একদিন সেরকম রাতে ফিরছি, সিঁড়ির ঠিক মুখটায় দেখি, একটা বেশ বড় সাপ শুয়ে আছে। এর আগে দিনেরবেলায় ঝোপে ঝাড়ে দু’-একটা সাপ দেখেছি, সাপ তো থাকবেই, ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় দ্রুত মনুষ্য বসতি হচ্ছে বলেই তো সাপেরা সব অন্তর্ধান করে যাবে না। তা বলে আমার বাড়িতে ঢোকার মুখে, এত রাতে কোনও সাপের কি শুয়ে থাকাটা উচিত কাজ হল! আর একটু হলেই ওর গায়ে আমার পা পড়ে যেতে পারত, তা হলে আর রক্ষে ছিল না। নড়া-চড়া না করলে সাপ এমনি এমনি কামড়ায় না জানি, কিন্তু চুপ করেই বা দাঁড়িয়ে থাকব কতক্ষণ। মা আমাকে বাগান পেরিয়ে আসতে দেখেছেন, এখন যত দেরি হবে ততই তাঁর উৎকণ্ঠা বাড়বে। সাপ সাপ বলে চেঁচিয়ে ওঠাও ঠিক হবে না, তাতে বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের মানুষজন জেগে যাবে। পেছন ফিরে দৌড়ে পালাব? যদি সাপটা তাড়া করে? ইস্কুলের বাংলা ক্লাসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিয়ে বাক্য গঠন করতে বলা হত, এ যে তার সার্থক দৃষ্টান্ত! কয়েক মুহূর্ত পরেই মাথার মধ্যে একটা যুক্তি এসে গেল। সেই আঠাশ বছরের যুবকের শরীর এক লাফে সাপটিকে পার হয়ে উঠে গেল ওপরের রকে।
রাত্তিরবেলা বলেই সে পেরেছিল, দিনের আলোয় সে এতটা সাহস দেখাতে পারত না বোধহয়।
চৌত্রিশ
উনিশশো বাষট্টি সালে অক্টোবর মাসের কুড়ি তারিখটি আমাদের দেশের, আমাদের জাতীয় জীবনে, আমাদের মানসিকতায়, আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নের এক নিদারুণ সন্ধিক্ষণ। ওই দিন চিন ও ভারতের সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। এ রকম অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ বোধহয় ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি, অথচ এর কুফল হয়েছে সুদূরপ্রসারী।
চিন আর ভারতের যুক্ত জনসংখ্যা পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ। প্রতিবেশী এই দুটি রাষ্ট্র হাতে হাত মিলিয়ে চললে পৃথিবীর অন্য সব শক্তিশালী দেশগুলিও চিন-ভারতকে সমীহ করতে বাধ্য হত। সেই রকমই তো ছিল অনেকদিন, খুবই বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ শ্লোগান আমরা শুনেছি কতবার। এ দেশে যারা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের চোখেও মাও সে তুং (এখন মাও যে দং) অতি শ্রদ্ধেয় নেতা, তিনি কখনও ভারতে আসেননি, কিন্তু তাঁর প্রতিনিধি হয়ে চু এন লাই একাধিকবার ভারতে এসেছেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাবলীল ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ, শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাত ধরে তিনি নেচেছেন পর্যন্ত। তা হলে কেন হঠাৎ এই যুদ্ধ? প্রথমটা আমরা এর কারণ ঠিক বুঝতেই পারিনি!
ভারতের সীমান্তরেখা ম্যাকমেহন লাইন। চিনের দিকে ব্রিটিশ ও মাঞ্চু সাম্রাজ্যের আমলে স্বীকৃত একটা সীমারেখা আছে, যাকে বর্তমান সমাজতন্ত্রবাদী চিনও মনে করে ‘চিরাচরিত’ অধিকার। আগের শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদীদের সীমানা চিহ্নকে একালের সমাজতন্ত্রবাদীরা চিরাচরিত বলে দাবি করেন কোন যুক্তিতে, তা বোঝা দুষ্কর। সে যাই হোক, বিতর্কিত মাঝখানের এলাকাটি নিছকই উষর প্রান্তর, জনবসতি নেই, একটা ঘাসও গজায় না, সে রকম জমি দখলের জন্য ভারতের মতন প্রাচীন বন্ধুকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে হবে। অবশ্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও কয়েক বছর ধরে চিনের প্রতি কিছু কিছু অসমীচীন কথাবার্তা বলা হচ্ছিল, এমনও শোনা গেছে, তবু বাক্য বিনিময়ের বদলে হঠাৎ গোলাগুলি?
যুদ্ধ শুরু হবার পরেই বোঝা গেল, ভারতের সমরশক্তি চিনের তুলনায় অনেক দুর্বল। পাহাড় ডিঙিয়ে নেমে আসতে লাগলো চিনা বাহিনী, প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে পিছিয়ে এল ভারতীয় সেনারা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি যাদের নেই, তারা এই প্রথম স্বাধীন ভারতে দেখল যুদ্ধের আবহাওয়া, শুনল বিকট সাইরেন, দেখল নিষ্প্রদীপ। আর সেই সঙ্গে উদ্ভট সব গুজব, যেন চিনে সৈন্যরা যে-কোনওদিন এসে পড়বে কলকাতায়।
এক মাস পর, যেমন আচমকা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই রকম ভাবেই, প্রায় তেজপুর শহরের উপান্তে এসে চিনাবাহিনী একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে আবার পিছিয়ে গেল, কয়েক হাজার বর্গমাইল দখল করে থানা গেড়ে বসে রইলো ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা’র ওপারে।
দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে কোন দেশ প্রথম আক্রমণ করে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী এমন প্রচার চলতে থাকে যে প্রকৃত সত্য নিরুপণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করেন পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা। যুদ্ধের সময় সব দেশেরই অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করে নিজের দেশকে। দেশাত্মবোধ তখন এমনিতেই উগ্র হয়ে থাকে, তা ছাড়া পরাধীনতার আশঙ্কাও কাজ করে ভেতরে ভেতরে। ভারতের দিক থেকে কিছু কিছু উস্কানিমূলক হঠকারিতা ছিল, কিন্তু এত কম শক্তি নিয়ে চিনা বাহিনীকে নিজে থেকে দুর্গম পাহাড় অঞ্চলে আক্রমণ করতে যাবে, এতখানি মুঢ়তা কি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব! আমাদের মনে হয়েছিল, চিনই আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে, সে জন্য আমরা মর্মাহত বোধ করেছিলাম। কিন্তু এই প্রশ্নে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ফাটল ধরে যায়, ডাঙ্গেপন্থীরা ম্যাকমেহন লাইনকেই প্রকৃত সীমারেখা বলে মেনে নিয়ে, ভারত সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে চিনকেই আক্রমণকারী বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু পার্টির একটি বড় অংশ মনে করে যে সমাজবাদী দেশ চিন কখনও অন্যায় আক্রমণ করতে পারে না, সুতরাং এ যুদ্ধের দায় ভারতের কংগ্রেস সরকারের। এই মতভেদের ফলেই ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল দু’বছর পরে।
ভাঙনের কারণটি আরও গভীর।
ঐতিহাসিক টয়েনবির একটি উক্তি আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের সঙ্গে প্রকৃত লড়াই ধনতন্ত্রের নয়, জাতীয়তাবাদের। সমাজতন্ত্রের সমর্থকরা ধনতন্ত্রকেই প্রধান শত্রু মনে করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, কিন্তু নিজেদের জাতীয়তাবাদ ভুলতে পারে না। যদিও সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শবাদী সহাবস্থান সম্ভব নয়। সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্তই তো রাষ্ট্রগুলির সীমারেখা মুছে ফেলা, সরকারের বিলোপ, সেখানে জাতীয়তাবাদের কোনও স্থান নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অনেকগুলি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, বিস্তৃত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিনের মতন এত বড় একটা দেশ জড়তা, কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে সমাজতান্ত্রিক পথে দ্রুত উন্নতি করতে থাকে, তবু জাতীয়তাবাদ নিশ্চিহ্ন হবার বদলে দিন দিন যেন আরও উগ্র হয়ে উঠছে। দেশপ্রেম বা স্বজাতিপ্রেম এমনই এক তীব্র নেশা, যা কোনও উন্নত আদর্শ দিয়েও দমন করা যায় না। নইলে রাশিয়া ও চিনের মতন দুটি সমাজতন্ত্রী দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হবে কেন? সীমান্ত সংঘর্ষও হয়ে গেছে। হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার মতন দুটি সমাজতন্ত্রী দেশের মানুষের মধ্যে এমনই তীব্র ঘৃণার সম্পর্ক যে তৃতীয় কোনও দেশে দেখা হলে তারা পরস্পর বাক্যালাপও করে না।
ভারত-চিন সীমান্ত যুদ্ধের পশ্চাৎপটে আছে রাশিয়া-চিনের মতপার্থক্য শুধু নয়, বিদ্বেষ। জওহরলাল নেহরুর ভারত সরকার আমেরিকান ব্লকে যোগ না দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘেঁষা, পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক না হলেও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের। কমিউনিস্ট পার্টির ডাঙ্গেপন্থীরাও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক। চিন এখন সোভিয়েত ইউনিয়নকেই মনে করে ‘সংশোধনবাদী’ আর নিজেরা ‘প্রকৃত বিপ্লববাদী’। চিন থেকে ভারতের উদ্দেশে প্রচার চালিয়েও এই বিভাজনের কথা বলা হতে লাগল বারবার। আরও কয়েক বছর পর, দ্বিধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অধিকতর শক্তিশালী শাখা সি পি আই (এম) যখন পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারে যোগ দিল, তখন চিনের প্রচারে তারা হয়ে গেল ‘নয়া সংশোধনবাদী’, সেই প্রচারের বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করার গরম গরম শ্লোগানে আবার ভাগ হল কমিউনিস্ট পার্টি, নকশালবাড়ির পটভূমিকায় গঠিত হল তৃতীয় দল, সি পি আই (এম এল)। অর্থাৎ ভারতের বামপন্থী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখার আড়াল থেকে চিনের ভূমিকাই হয়ে গেল প্রধান।
সেই এক মাসের চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের আর একটি সাঙ্ঘাতিক কুফল হল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রবলহীনতা ও দক্ষতার অভাব প্রকট হয়ে পড়ায় সাঙ্ঘাতিক আলোড়ন হল দেশে। উগ্র দক্ষিণপন্থীরা গর্জন শুরু করে দিল। নেহরু বাধ্য হলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননকে বিদায় দিতে। তিনি ভেবেছিলেন জোট নিরপেক্ষতা ও পঞ্চশীল নীতির জন্য ভারতকে কখনও যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে না, অস্ত্রসম্ভারও মজুত রাখার প্রয়োজন নেই। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডের মতন দেশ যেমন কোনও যুদ্ধেই যোগ না দিয়ে নিজস্ব সম্পদ বাড়ায়। কিন্তু চিনের কাছে অপমানজনক পরাজয় সহ্য করার পর দক্ষিণপন্থীদের চাপে প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়ে গেল বহুগুণ, নানা দেশ থেকে কেনা হতে লাগল আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম। ভারতের যমজ রাষ্ট্র পাকিস্তান তার প্রাক্তন সহোদরের চিরশত্রু হবার ভূমিকা নিয়েছে, সেই পাকিস্তান যুদি দেখে যে ভারতের সেনাবাহিনী নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হচ্ছে, তখন পাকিস্তানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? শুরু হল প্রতিযোগিতা, দু’ দেশেরই প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়তে লাগল অস্বাভাবিক হারে। দু’দেশেরই কোটি কোটি মানুষ ডুবে রইল অশিক্ষার অন্ধকারে ও দারিদ্র্যে, জাতীয় সম্পদ ব্যয় হতে লাগল যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহে। অস্ত্র জমে জমে পাহাড় হলে তার ব্যবহার তো চাই। তাই পঁয়ষট্টি সালে লেগে গেল আর এক ভারত-পাকিস্তান অনাবশ্যক যুদ্ধ। এবং আশ্চর্যের কিছু নেই, ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথে গণতান্ত্রিক ভারতের বদলে স্বৈরাচারী, একনায়কপন্থী পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য হাত মেলাল ধনতান্ত্রিক আমেরিকা ও সমাজতান্ত্রিক চিন। উদ্দেশ্য একই, জাতীয় স্বার্থ। ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া, পাকিস্তানকে আমেরিকা ও চিন। টয়েনবির উক্তিই যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।
ভারত-পাকিস্তান পরস্পারিক বিবাদে মত্ত হয়ে অন্য সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজে পিছিয়ে থাকুক, আর সেই ফাঁকে এগিয়ে যাক চিন, চিনের এই সুপরিকল্পিত ফাঁদে আটকে রইল উপমহাদেশের দুটি দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিশুরা। এমনকী ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা বানাবার নির্বোধ প্রতিযোগিতার মূল খুঁজতে গেলেও হয়তো সেই বাষট্টির চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ফিরে যেতে হবে।
সেই বাষট্টি সালে তো আমাদের এসব বোঝার কথা নয়, আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম চিনের আচরণে। চিনের ঐতিহ্য ও আধুনিক সমাজতন্ত্রী চিনকে আমরা দেখতাম শ্রদ্ধার চোখে, আমার বন্ধু দিলীপ দত্তের অনুবাদ করা চিনা কবিতার একটি সংকলন বেরিয়েছিল কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে।
অ্যালেন গীন্সবার্গ চলে যাবার পর আরও অনেক বিদেশি কবি-লেখকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। মনে পড়ে জাপানি লেখক মিসিমার কথা। তখন কোনও লেখক সংবাদপত্র অফিসে বা বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে এসে তরুণ কবি-লেখকদের খোঁজ করলে আমাদের ডাক পড়ত, কারণ তরুণ লেখকদের মধ্যে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী বেশ সঙঘবদ্ধ। জাপানি সাহিত্যের দিকে তখন আমাদের মন ফিরেছে। ওসামু দাজাই নামে এক লেখকের ‘আর মানুষ নই’ নামে উপন্যাসটিকে মনে হয়েছিল খুবই আধুনিক গুণসম্পন্ন। ওঁর আর একটি উপন্যাসের নাম ‘অস্ত সূর্য’, এই নামটির তাৎপর্য এই যে জাপান সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। ‘চাবি’ নামে আর একটি উপন্যাস (লেখকের নাম ভুলে গেছি) জনপ্রিয় হয়েছিল খুবই। আর এশিয়ার দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার প্রাপক কাওয়াবাতার উপন্যাস বাংলায় অনূদিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। তবে মিসিমা-ই আমাদের স্বচক্ষে দেখা প্রথম জাপানি লেখক। দীর্ঘকায়, সুপুরুষ এবং প্রতিভামণ্ডিত ললাট। তিনি ইংরেজি তেমন জানতেন না, কিন্তু ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে ভালো দখল ছিল। আমরা কয়েকজন তখন কমলকুমার মজুমদারের কাছে প্রতি রবিবার দুপুরে ফরাসি ভাষা শিখতাম, তিনি বিনা বেতনে পড়াতেন না, তাতে নাকি সঠিক শিক্ষা হয় না, তাই মাইনে নিতেন এক টাকা। অতি কঠোর ছিল তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি, প্রথমেই সংস্কৃত শব্দরূপ ও ধাতুরূপের মতন তিনি আমাদের মুখস্থ করতে দিয়েছিলেন ফরাসি ধাতুরূপ৷ সে যাই হোক, সেই স্বল্প বিদ্যা নিয়ে মিসিমার সঙ্গে কয়েকটি ফরাসি বাক্য বলায় তাঁর সঙ্গে আমার একটু বেশি ভাব হয়েছিল। মিসিমা’র নামও নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হচ্ছিল, কিন্তু কয়েক বছর পরেই জানা গেল, তিনি জাপানের কোনও উগ্রপন্থী দলের নেতা হিসেবে, নিজের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে হারাকিরি করেছেন।
এক আমেরিকান প্রৌঢ়া মহিলা একদিন আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন, তার নাম রুথ স্টেফান, তিনিও কবি, যদিও আমরা তাঁর নাম শুনিনি। তিনি অন্যান্যদের বাদ দিয়ে প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে সন্ধে কাটাতে চান। এবং কবিতা শোনান। মহিলাটি বেশ মিষ্টিভাষী, কবিতাগুলি অতি সাধারণ, অর্থাৎ শখের কবি। ক্রমশ জানা গেল, এই রুথ স্টেফান খুবই ধনী রমণী, আমেরিকার কয়েকটি চেইন স্টোর্সের মালিক, তাঁর দুটি স্বামী মারা গেছে, এবং প্রত্যেকবারই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন আরও প্রচুর সম্পত্তি। সারা বছরই প্রায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন করেন। মানুষের কবিতার প্রতি কী দুর্বলতা! এ রকম একজন ধনবতী রমণী পাঁচতারা হোটেলে বিলাসব্যসনে সময় কাটাবেন, মিশবেন তাঁর সমপর্যায়ের ধনীদের সঙ্গে, তা নয়, সাধারণ চায়ের দোকানের ভাঙা চেয়ারে বসে এত দূর ও দরিদ্র দেশের কয়েকটি যুবককে তাঁর কবিতা শুনিয়ে কী এমন পরমার্থ লাভ হবে? তবু, আমরা একটু প্রশংসা করলেই তাঁর সদ্য বিগত-যৌবন মুখখানি ঝলমল করে উঠত খুশিতে।
ইংল্যান্ডের এলিয়ট-পরবর্তী অন্যতম প্রধান কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও এসেছিলেন কলকাতায়, তাঁর সঙ্গে সেবারে আলাপ হয়েছিল সামান্যই, তিনি যামিনী রায় ও বিষ্ণু দে’র সঙ্গেই বেশি সময় কাটান।
বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন ছিল তখন প্রতি বছর শীতকালে একটি অতি আকর্ষণীয় উৎসব। বাংলার সব রকমের গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া পর্যন্ত এবং নাচ এবং নাটক, কবিতা পাঠ, সাহিত্য আলোচনা নিয়ে কয়েকদিনের জমজমাট আসর, বৃহৎ মূল মণ্ডপের চারপাশে মেলার মতন রকমারি জিনিসের দোকান, খাবারের স্টল এবং এক পাশ জুড়ে অনেকগুলি বইয়ের স্টল। এখনকার কলকাতার বইমেলার পূর্বসূরী বলা যেতে পারে সেই বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনকে। পরের দিকে ময়দানে এই সম্মেলন আরও বড় আকারে রূপ নিলেও প্রথম কয়েক বছর চলেছিল উত্তর কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারে।
উৎসবের কয়েকটা দিন আমরা সদলবলে বিকেল থেকেই জড়ো হতাম মার্কাস স্কোয়ারে। সেখানেই অনেক রাত্রি পর্যন্ত আড্ডা ও পানাহার। সব অনুষ্ঠান দেখতাম বা শুনতাম না, মাঠের মধ্যে বসে থাকতাম গোল হয়ে। একবার আমরা একটা কবিতার স্টলও দিয়েছিলাম কৃত্তিবাস থেকে, তার নাম ছিল ‘অতি আধুনিকতা’, আমাদের বন্ধু শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় কাঁটাতার দিয়ে সে স্টলটি এমন অপূর্ব সুন্দরভাবে সাজিয়েছিল, যা দেখলেই ভয় করে। আটজন কবির নতুন কবিতা ছাপা হয়েছিল আলাদাভাবে রঙিন কাগজে, সেগুলির সম্পাদনা ও মুদ্রণ পারিপাট্য দেখেছিল সন্দীপন। প্রত্যেকটি কবিতার দাম দু’আনা, প্রায় জোর জুলুম করেই সেগুলি বিক্রি করা হত। আমাদের স্টলের কাছাকাছি কেউ কৌতূহলী হয়ে এলে তার রক্ষে নেই, কিনতেই হবে। একসময় এক বৃদ্ধা মহিলা এসে দাঁড়ালেন স্টলের কাছে, টুকটুকে ফর্সা রং, অভিজাত চেহারা, আমরা কয়েকজন তাঁকে ঘিরে ধরে চিলুবিলু করে বলতে লাগলাম, দিদিমা, এগুলো কিনুন, আধুনিক কবিতা পড়ুন! তিনি একগাল হেসে বললেন, দাঁত নেই!
এক সন্ধেবেলা আমরা মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে, কেউ কেউ ঘাস ছিঁড়ে চিবুচ্ছি, কেউ কেউ সিগারেট টানছি, গৌরকিশোর ঘোষ একজন লম্বা মতন সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এ সাহেবও তরুণ কবিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চান। চিড়িয়াখানার বিশেষ কোনও প্রাণীর মতন আমরাই সেই তরুণ কবি। সাহেবটির নাম পল এঙ্গেল, তিনি আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগীয় প্রধান এবং একজন কবি। এঁরও নাম আমরা আগে শুনিনি। কিন্তু কবিতার প্রতি এই সাহেবটির এমনই টান যে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে ঘুরে ইনি কবিদের সঙ্গে পরিচয় করে বেড়াচ্ছেন। ভারতেও ইনি দিল্লি, মুম্বই ঘুরে তারপর এসেছেন কলকাতায়। ইতিমধ্যেই তিনি কার কাছে যেন গুজব শুনেছেন যে দিল্লি ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী, মুম্বই বাণিজ্যিক রাজধানী আর কলকাতা সাংস্কৃতিক রাজধানী। সেই জন্য কলকাতা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহ বেশি।
আমরা তবু ব্রিটিশ ইংরেজিতে কিছুটা অভ্যস্ত, আমেরিকান ইংরেজিতে বেশ অসুবিধে হয়। সেইজন্যই আমেরিকান ফিল্মের, বিশেষত ওয়েস্টার্ন ছবির সংলাপ অনেকটাই বুঝতে পারি না। অ্যালেন গীন্সবার্গের কথা বুঝতেও প্রথম দিকে অনেকটা অনুমান করতে হতো। পল এঙ্গেল কথা বলেন জোর দিয়ে, ধীর লয়ে, স্পষ্ট উচ্চারণে, সে জন্য তাঁর সঙ্গে ভাব জমাতে বেশ সুবিধে হয়ে গেল। ইনি পণ্ডিত লোক, রোডস স্কলার ছিলেন, ইংরেজির অধ্যাপক। কিন্তু কবিতা লেখেন ট্র্যাডিশনাল ধরনের, তাতে আধুনিকতার উপাদান বিশেষ নেই। প্রথম দিন তাঁর কবিতা শুনে শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, এ যে দেখছি পাড়ার প্রাণগোপালের মতন বিয়ের পদ্য লেখে! অতটা খারাপ অবশ্য নয়, রবীন্দ্র অনুসারী কবিবৃন্দের মতন প্রথাসিদ্ধ, কিন্তু ওই ধরনের রচনা সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই ছিল তখন আমাদের স্বভাব।
মানুষটি অবশ্য বেশ সহৃদয়। জোরে জোরে হাসেন, সমালোচনা শুনেও বিরূপ না হয়ে হাসতে পারেন। তিনি কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরে দেখার জন্য গাইড না নিয়ে কবিদের সঙ্গেই ঘুরতে চান। আমাদের কেউ কেউ সময় করে পল এঙ্গেলের সঙ্গে ঘুরেছে বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, কালীঘাট। আমি বেশি সময় দিতে পারিনি, শক্তির হাতে ছিল অঢেল সময়। জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গেও তাঁর খুব হৃদ্যতা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে একমাত্র জ্যোতির্ময়ই তখন বিবাহিত, অনেক প্রণয়প্রার্থীর মধ্যে থেকে সে বুদ্ধদেব বসুর বড় মেয়ে মীনাক্ষীকে ছিনিয়ে নিয়েছে এবং আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। জ্যোতি পড়াশুনো করেছে ইংরেজিতে, ইংরেজি জ্ঞানের জন্যই সে অল্প বয়েসে চাকরি পেয়েছে স্টেটসম্যান পত্রিকায়, (পরে অতি যত্নে বাংলা শিখে সে ঝকঝকে বাংলা সাহিত্য-ভাষাতেও দক্ষ হয়) আর আমরা তো ভালো করে ইংরেজি বাক্য গঠন করতেই পারি না। জ্যোতির ফ্ল্যাটে প্রায়ই আমন্ত্রণ হত পল এঙ্গেলের, আমরাও কয়েকজন জুটে যেতাম সেখানে।
টিপিক্যাল আমেরিকান বলতে যা বোঝায়, পল এঙ্গেল অনেকটা সেই ধরনের। লম্বা-চওড়া চেহারা, খানিকটা দিল-দরিয়া ভাব, আবার স্বাজাত্যাভিমান খুব বেশি। যদিও শতকরা চল্লিশ জন আমেরিকান জীবনে মদ স্পর্শ করে না, কিন্তু সিনেমার আমেরিকানদের খুব মদ্যপায়ী মনে হয়, পল এঙ্গেলও সে রকমই সুরারসিক। তবে টিপিক্যাল আমেরিকানদের সঙ্গে তাঁর তফাত এই, তারা কবিতার বিশেষ ধার ধারে না, কিন্তু এই সাহেবটি কবিতা নিয়ে মশগুল, শুধু নিজের কবিতা নয়, কবিতা জিনিসটার প্রতিই তাঁর খুব প্রেম, প্রায়ই কথায় কথায় বলতেন, পৃথিবীর সব কবিরাই আমার আত্মীয়।
রুথ স্টেফান আমাদের সঙ্গে বসতেন চায়ের দোকানে বা পার্কে, কিন্তু পল এঙ্গেল প্রায় জোর করেই মাঝে মাঝে আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন তাঁর গ্র্যান্ড হোটেলের ঘরে। সেখানে বসত কবিতা পাঠের আসর। আমাদের বাংলা কবিতা তিনি কিছুই বোঝেন না, সুতরাং অনুরোধ করেছিলেন অন্তত দুটি করে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আনতে। আমাদের কারওই তখনও কোনও কবিতারই ইংরেজি অনুবাদ হয়নি, কেউ আগ্রহ দেখায়নি। অগত্যা নিজেরাই অনুবাদ করেছিলাম, অন্যদের তুলনায় আমার ইংরেজি জ্ঞান খুবই কাঁচা, সে অনুবাদ যে কী পদার্থ হয়েছিল, তা ভাবলেও এখন লজ্জা হয়। আমাদের নিত্যসঙ্গী ভাস্কর দত্ত কখনও কবিতা লেখেনি, ভবিষ্যতেও লেখার পরিকল্পনা ছিল না, সেও সরাসরি ইংরেজিতে দু’ খানা লিখে কবি সেজে গেল। কারণ সে আড্ডা-সুখ থেকে বঞ্চিত হতে চায়নি।
বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের শেষ দিন দুপুরে রকমারি বাঙালি রান্নার একটি পঙক্তি ভোজের আয়োজন করতেন উদ্যোক্তারা। সুক্তো, গয়না বড়ি ভাজা, মাছ-পাতুরি, ভাপা দই ইত্যাদি অনেক কিছু। সেখানে পল এঙ্গেল এবং আরও কিছু সাহেব-মেমও আমন্ত্রিত ছিলেন। আমার পাশে বসে খেতে খেতে পল এঙ্গেল একটি পটল ভাজায় কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই বস্তুটা কী? পটল জিনিসটা এখন পশ্চিম দেশগুলিতে কিছুটা সুলভ হলেও তখন খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল। অনেকেই পটল দেখেইনি কখনও? পটলের ইংরেজি কী? আমরা ওয়ার্ড বুকে বিভিন্ন তরিতরকারির ইংরেজি নাম মুখস্থ করেছি অল্প বয়েসে, তাও অনেক বদলে গেছে। বেগুনের নাম আমরা জানতাম ব্রিঞ্জাল, পরে শুনলাম, সেটা হয়ে গেছে এগ প্ল্যান্ট। দইকে বলতাম কার্ড পরে হয়ে গেল ইয়োগার্ট। ঢ্যাঁড়সের ইংরেজি লেডিজ ফিঙ্গার? শুনলে লোকে হাসে। কিন্তু পটলের সে রকম ইংরেজি মনে পড়ল না। আমি অসহায়ভাবে তাকালাম সামনের পঙক্তিতে বসা, আমাদের চেয়ে কিছুটা প্রবীণ কবি অরুণকুমার সরকারের দিকে। অরুণকুমার সরকার একটুও দ্বিধা না করে অতি সপ্রতিভভাবে বললেন, দিস ইজ কল্ড পট্ল্! ডোঞ্চ ইউ নো ইট? এই ডোঞ্চ ইয়ু নো ইট প্রশ্নেই পল এঙ্গেল কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন। সাহেবরাও তো সব ইংরেজি শব্দ মুখস্থ রাখে না। পল এঙ্গেল ভাবলেন বুঝি এই পট্ল্ও ইংরাজি অভিধানে আছে, তাই বলতে লাগলেন, অফ কোর্স, অফ কোর্স।
বিদায় নেবার দিন পল এঙ্গেল একটি কাণ্ড করে আমাদের খুব বিপদে ফেলে দিলেন। তিনি নানারকম ডট পেন (বস্তুটি তখন নতুন) এনেছিলেন, সেগুলি বিলিয়ে দিলেন আমাদের মধ্যে এবং দু’ বোতল স্কচ আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা বন্ধুরা মিলে এটা খেয়ো একদিন। এই বোতল দুটি নিয়েই মহা মুশকিল। আমাদের ঘনিষ্ঠ দলটির কারুরই বাড়িতে বসে মদ্যপানের প্রশ্নই ওঠে না, এমনকী হাতে করে বাড়িতে এই বোতল নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে তখনও মদ একটা নিদারুণ ঘৃণ্য বা ভয়াবহ বস্তু। বাংলা সিনেমায় শুধু চোর-ডাকাত-লম্পটরাই মদ্যপান করে, মদ্যপায়ীরা নেশার ঝোঁকে তার বউকে মারে, তার গয়না বিক্রি করে দেয়, সংসারের সর্বনাশ ডেকে আনে। সাহিত্যিকরা কক্ষনও লেখার মধ্যে নিজেদের মদ্যপানের কথা স্বীকার করেন না। তান্ত্রিকেরা কারণ বারি পান করতে পারেন, রামপ্রসাদের সুরা পান করি নে আমি, সুধা খাই জয় কালী বলে’-ও ঠিক আছে, কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির মদ্যপান অতি গর্হিত কাজ।
স্কচ হুইস্কি তখন অতি দুর্লভ ও দামি বস্তু। বোতল দুটি ফেলেও দেওয়া যায় না প্রাণে ধরে। বেশি লোককে জানানোও চলে না। তবু একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক কী করে যেন শুনে ফেলে বললেন, তোমরা সোনাগাছির কোনও মেয়ের কাছে চলে যাও না। ওদের কারও ঘর ভাড়া নেবে। ঘণ্টায় বড় জোর পনেরো টাকা নেবে।
আমরা উত্তর কলকাতার অধিবাসীরা সবাই সোনাগাছি চিনি। সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে বাসে বা পায়ে হেঁটে যাবার সময় দেখতে পাই সেই পল্লী, দিনের বেলা শুনশান, রাত্তির বেলা জমজমাট। কিন্তু কখনও তার ভেতরে ঢুকিনি, সেটা যে নিষিদ্ধ পল্লী। তখন আমরা সব রকম নিষেধের বেড়া ভাঙছি, এ আর এমনকী! সেই বোতল দুটি নিয়ে আমরা সন্ধেবেলা সোনাগাছিতে একটি মেয়ের ঘরে গিয়ে বসলাম সদলবলে।
আমি আমার সঙ্গীদের নাম উল্লেখ করতে চাই না, কারণ এখন পরিণত বয়েসে তাঁরা কিংবা তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা এইসব প্রসঙ্গের উত্থাপন পছন্দ করবেন কি না তা ঠিক জানি না। কিন্তু আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, সেই সন্ধেতে এবং পরে আরও অনেকবার সেই পল্লীর মেয়েদের সংসর্গে আমি জীবনের বা আমাদের সমাজের যে দিকটি দেখতে পেয়েছি, তা না দেখলে আমার বোধ অনেকখানিই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। যে-উদ্দেশ্যে পুরুষরা চুপি চুপি এদিক ওদিক তাকিয়ে সুট করে ওই সব গলিতে ঢুকে পড়ে, আমাদের সে উদ্দেশ্য ছিল না, গেলাস ও জল ছাড়া আমরা আর কিছুই চাই না শুনে মেয়েটি বেশ অবাক-খুশি হয়েছিল। সব সময় আমরা কয়েকজন পুরুষ দল বেঁধে ঘুরি, আমাদের দিনগুলি নারী-সঙ্গ বঞ্চিত, তখন সাহিত্য জগতে মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম, যে দু’চারজন লিখতেন তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা যেত না বিশেষ, আর পাঠিকারা কবিদের পাত্তাই দিত না। আমাদের মদ্যপানের এই আসরে একটি মেয়ে এসে বসেছে পাশে, সে গেলাসে জল ঢেলে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে আমাদের কথা শুনে হেসে গড়াচ্ছে, এ তো অভিনব অভিজ্ঞতা! তার ভাব-ভঙ্গি-ব্যবহার কিছুই অস্বাভাবিক নয়, আমাদেরই চেনাশুনো পরিবারের মেয়েদের মতন। একটা খুব সাধারণ উপমা দেওয়া যায়। খুব ছোট বয়সে দেখেছিলাম, পাড়ায় একটা চোর ধরা পড়েছে, সবাই মিলে তাকে মারছে, কোনওক্রমে ভিড় ঠেলে ঠুলে ঢুকে চোরটিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম খুবই। আমার ধারণা ছিল, চোরদের বোধহয় মাথায় শিং থাকে, হাতে থাকে বাঘের মতননখ, তা তো নয়, এ যে যে-কোনও মানুষের মতন। তেমনি বেশ্যাদের সম্পর্কেও ধারণা ছিল অস্পষ্ট, যেন তাদের পোশাক-ব্যবহার-হাসি সবই অন্যরকম।
তখন সেক্স ওয়ার্কার বা যৌন কর্মী আখ্যা চালু হয়নি, লোকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল বেশ্যা, খবরের কাগজে লেখা হত পতিতা বা বারাঙ্গনা। ‘পতিতা’র মতন অপপ্রয়োগ বুঝি আর কোনও শব্দের হয় না। পুরুষপ্রধান সমাজ এই বৃত্তিটি চালু রেখেছে, অনেক মেয়েকেই জোর করে ধরে আনা হয়, অনেক মেয়েকে ছলে-বলে-কৌশলে ঠেলে দেওয়া হয় লোভী পুরুষদের সামনে, তবু তারা কি করে পতিতা হয়? পুরুষদের তো কেউ পতিত বলে না। যেমন অসতী কথাটার ঠিক পুংলিঙ্গ নেই। এটা একটা বহু যুগ বাহিত কুৎসিত ভণ্ডামি। এ পল্লীর একাধিক মেয়েকে দেখেছি, ভারী সরল দুঃখী ও সব সময় অসহায় ভাব। অর্থের বিনিময়ে তাদের শরীর বহু-ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সেই অর্থের সামান্যই ভাগ পায় তারা। তাদের ওপর অত্যাচার ও নিষ্পেষণ করার লোক অনেক, বিশেষত প্রত্যেক মেয়েরই ফাইফরমাশ খাটার জন্য একটি করে লোক থাকে, ওখানকার ভাষায় যার নাম নোকর, আসলে তার কাছেই মেয়েটি যেন ক্রীতদাসী। এ ছাড়া রয়েছে দালাল, পাড়ার গুণ্ডা, বাড়িওয়ালি মাসি। এর মধ্যে মাত্র দু’চারটি মেয়েই আত্মরক্ষার কারণে দুর্মুখ ও ঝানু হয়ে যায়, নিষ্ঠুর ভাব দেখায়, বাকিরা সবাই অসহায়ভাবে অমানবিক শোষণের শিকার।
আমরা যে মেয়েটির কাছে প্রায়ই যেতাম, তার নাম মল্লিকা। একদিন সে কথায় কথায় বলেছিল, সে দানিবাবুর নাতনি। এটা সত্যিও হতে পারে, অথবা অলীক। প্রখ্যাত অভিনেতা গিরিশ ঘোষের ছেলে, তিনিও শিশির ভাদুড়ীর পূর্ব যুগে ডাকসাইটে অভিনেতা ছিলেন, সেই দানিবাবু বিয়ে করেননি। গিরিশবাবু নাকি স্বপ্নে দেখেছিলেন কিংবা কোনও জ্যোতিষী তাঁকে বলেছিল, দানি বিয়ে করলেই মারা যাবে। দানিবাবু বিয়ে না করলেও ব্রহ্মচারী ছিলেন না। বহু ললনা ভোগ করেছেন, সুতরাং তাঁর অবৈধ পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এই মল্লিকা একদিন আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যেমন মোটরগাড়ির কয়েকজন ড্রাইভার একসঙ্গে গুলতানি করলে শুধু গাড়ি নিয়েই আলোচনা করে, সে রকম তরুণ কবিরাও যখনই আড্ডায় বসে, তারা শুধু কবিতা নিয়েই কথা বলে। মল্লিকার ঘরে বসে আমরাও কবিতার পত্রপত্রিকা, কোনও কোনও সম্পাদকের মুণ্ডপাত ও কবিতা বিষয়ক বিতর্কেই মত্ত থাকতাম গেলাস হাতে নিয়ে। সেসব শুনতে শুনতে মল্লিকার চোখ ট্যারা হয়ে যেত গভীর অভিনিবেশে। একদিন সে অন্য একটি ঘর থেকে উমা নাম্নী আর একটি মেয়েকে ডেকে আনল। সে নাকি পদ্য লেখে! আমাদের অনেক পেড়াপিড়িতে, দারুণ লাজুকভাবে মাথা নাড়তে নাড়তেও শেষ পর্যন্ত সে নিয়ে এল এগারোখানা খাতা। সব কবিতায় ভর্তি। সে কবিতার মান যাই-ই হোক, তবু সে এই নির্দয়, কঠিন, অবমানোর জীবনে থেকেও সেগুলি লিখেছে কেন? জানা গেল, তেরো বছর বয়েস থেকে উমা সে পল্লীতে আছে, তখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ, প্রতিদিনই শেষ রাতে কিংবা ভোরে সে কিছু না কিছু লেখে। সে ছাপাবার কথা ভাবেনি, খ্যাতির মোহ জানেই না, লিখে অর্থ উপার্জনের কোনও প্রশ্নই নেই, তবু সে এগারোখানা খাতা কবিতা লিখে ভরিয়ে ফেলেছে কেন?
ডাকাত ও খুনি জাঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্তও এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। জাঁ জেনে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত, তবু তিনি অদ্ভুত এক নীচের তলার মানুষের ভাষায় একটি উপন্যাস লিখছিলেন আপনমনে। সে লেখা কোনওদিন জেলখানার বাইরে যাবে কি না, কেউ পড়বে কি না, সে বিষয়ে কোনও ধারণাই তাঁর ছিল না, তবু কেন লিখছিলেন, কীসের প্রেরণায়? একেই কি বলে দৈবী প্রেরণা? জাঁ জেনের সেই উপন্যাস ‘আওয়ার লেডি অফ দা ফ্লাওয়ার্স’ কোনওক্রমে বাইরে যায়, মুদ্রিত হয়, শিক্ষিত সমাজে দারুণ আলোড়ন ওঠে। জাঁ পল সার্ত ওই উপন্যাস পাঠ করে গুণ্ডা ও ডাকাত জাঁ জেনে সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম, সন্ত জেনে।
ওই উমা নাম্নী বারবনিতাটি সম্পর্কেও সেরকম একটি গ্রন্থ রচনা করা উচিত ছিল। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার নেই। শুধু তার একটি-দুটি কবিতা কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করে কোনও পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলাম। সেই পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম ও কবিতা দেখেও উমা বিন্দুমাত্র উচ্ছাস দেখায়নি, সামান্য ফ্যাকাশেভাবে হেসেছিল মাত্র। সে হাসির প্রকৃত মর্মও কি বুঝতে পেরেছি?
পঁয়ত্রিশ
কৃত্তিবাস পত্রিকা দশ বছর পূর্ণ করল তেষট্টি সালে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়—’, কৃত্তিবাসের ক্ষেত্রে সেটা খাটেনি। এই গোষ্ঠীর মধ্যে মাঝে মাঝে মতভেদ ও মনোমালিন্য ঘটেছে অবশ্যই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাদ হয়নি, ভিত্তিটি টলমল করেছে দু’-একবার, কিন্তু ভেঙে পড়েনি অকস্মাৎ, এর পরেও কৃত্তিবাস বেঁচে থেকেছে বহু বছর, নানা রূপে। দু’-একজন আর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখেনি, যেমন দীপক মজুমদার ও আনন্দ বাগচী, আবার কিছু পরে এসে কেউ কেউ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, যেমন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শরৎকুমার তখন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও বিলিতি কোম্পানিতে উঁচু চাকরি করেন, তবু প্রেসে যাওয়া-আসা, এমনকী প্রতিটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকার বান্ডিল ঘাড়ে করে পৌঁছে দিতেন দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন স্টলে। শরৎ দক্ষিণ শহর ভালো চিনতেন। মাঝখানে বিশেষ কোনও ট্রেনিং-এর জন্য শরৎ কয়েক মাসের জন্য চলে গেলেন লন্ডনে, সেই সময়টায় আমিই পত্রিকা নিয়ে গেছি দক্ষিণ কলকাতার স্টলে। একজন স্টল মালিক, আমাকে চেনেন না, জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের অন্য যে একজন আসতেন, তিনি এলেন না কেন? আমি উত্তর দিলাম, তিনি বিলেতে চলে গেছেন। স্টল মালিকটি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন আমি একটা ডাহা মিথুক! ঘাড়ে করে যে পত্রিকা নিয়ে আসে, দশ-পনেরো টাকা আদায়ের জন্য চার-পাঁচবার তাগাদা দেয়, সে কখনও বিলেত যেতে পারে! বিদেশ, বিশেষত ইংল্যান্ড-আমেরিকা যাওয়া তখন ছিল খুবই দুর্লভ ব্যাপার।
শক্তি বিশেষ সাহায্য করত প্রুফ দেখায়, ও বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, প্রুফের বান্ডিল বগলদাবা করে সে উধাও হয়ে যেত মাঝে মাঝে। তখন তাকে খোঁজাখুঁজি করতে হত সারা শহর জুড়ে।
একটা সময় আমরা প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই জড়ো হতাম উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে। সেখানে গ্যাসের আলোর নীচে বসে কবিতা ও গল্প পাঠ হত। বলাই বাহুল্য, শক্তিই কবিতা পড়ত বেশি। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিখ্যাত গল্প ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ ওখানেই প্রথম পড়ে শোনায়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একটি নতুন গল্প লিখে পাণ্ডুলিপিটি ভুল করে ফেলে এল ট্যাক্সিতে। তারপর তার কী হা-হুতাশ! সে সময় কলকাতার অধিকাংশ ট্যাক্সি চালকই পঞ্জাবি, গুরুমুখিতে পত্রিকাও বেরোয়। গল্পটির সন্ধানে সন্দীপন সেই গুরুমুখি পত্রিকাতেও বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তার কোনও ফল হয়েছিল কি না মনে নেই।
ঘণ্টা দু’-এক সাহিত্যের মধ্যে ডুবে থেকে তারপর আমাদের অন্য রকম নিমজ্জনের সাধ হত। রাত্তিরের সাঁতার। পার্কের মধ্যেই একটা পুকুর আছে, সেখানে নেমে পড়তাম দল বেঁধে। সঙ্গে তোয়ালে বা অন্য পোশাক নেই, প্রথম প্রথম প্যান্ট ভিজিয়ে, সেই অবস্থাতেই ফিরতাম বাড়ি। পরের দিকে সব কিছু খুলে ফেলে সাঁতার কাটতেই সুবিধে হত, তখন লোকজন বিশেষ থাকত না, দৈবাত কেউ আমাদের দেখে ফেললে হয়তো ভূত মনে করত। পার্কগুলিতে গুণ্ডা বদমাস-ছিনতাইবাজদের তেমন উপদ্রব ছিল না। ময়দানের অন্ধকারে প্রেমিক-প্রেমিকা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে কিছু গুনাগার দিতে হয় অবশ্য। সেখানে আসে নকল পুলিশ কিংবা আসল পুলিশই নকল সেজে। বিনা দোষে তাদের থানায় নিয়ে যেতে চায়, সেখানে যারা প্রেম করতে এসেছে তারা জানাজানি হবার ভয়ে পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে উদ্ধার পেতে বাধ্য হয়। প্রেমিক বেকার হলে প্রেমিকাই দিয়ে দেয় সেই পয়সা, সব মেয়েই কিছু না কিছু পয়সা জমিয়ে রাখতে পারে।
সে সময় আমাদের জামা কাপড় খুলে ফেলার নেশা ধরে গিয়েছিল। দল বেঁধে বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে, নারীবর্জিত অবস্থায়, রাত্তিরের দিকে আলো না জ্বেলে আমরা নগ্ন অবস্থায় আড্ডা দিতাম। জঙ্গলের মধ্যে আদিম মানবের মতন উলঙ্গ হয়ে হেঁটেছি মাইলের পর মাইল।
সমস্ত পোশাক খুলে ফেলার এই যে ইচ্ছে, তার অন্য কোনও তাৎপর্য আছে কি না জানি না। লজ্জা কিংবা অন্য কোনও চিন্তা মাথায় আসত না, যেন পেতাম অপূর্ব মুক্তির স্বাদ।
দুপুরে সরকারি চাকরি, সন্ধেবেলা সংবাদপত্র অফিসে আংশিক কাজ, মধ্যে একটা টিউশানি ও মাঝে মাঝে গ্রন্থ সমালোচনার দক্ষিণা, এইসব মিলিয়েও আমার মাসিক উপার্জন তিনশো-সাড়ে তিনশোর বেশি ছিল না। তা দিয়েই বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, কৃত্তিবাস ও বেড়াতে যাবার বিলাসিতা। বাস ভাড়া বাঁচাবার জন্য কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে শ্যামবাজার যেতাম এগারো নম্বর গাড়িতে, অর্থাৎ পায়ে হেঁটে। অবশ্য এর মধ্যে আমার পরের দুই ভাইও কিছু উপার্জন শুরু করেছে। পুরনো একটা খাতায় লেখা দেখছি, তখন প্রতিদিন বাজার খরচ ছিল দু’টাকা। তখনও টাকা-আনা পয়সার হিসেব ছিল, ওজন ছিল মন-সের-ছটাক। যুদ্ধের আমলে তামা বাঁচাবার জন্য পয়সাগুলোর মাঝখানটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল, নামই ছিল ফুটো পয়সা। এক পয়সাতেও পাওয়া যেত কলমি শাক, কিংবা কাঁচা লঙ্কা, যোলো পয়সা বা এক সিকিতে এক সের আলু (এক কিলোর চেয়ে কিছুটা কম), এক জোড়া ডিম চব্বিশ পয়সা, সেই ডিমের জোড়া আঠাশ পয়সা হওয়ায় লোকে রাগারাগি করেছিল, দায়ী করেছিল চিন দেশকে, কারণ চিনের সঙ্গে যুদ্ধের পর জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। ইলিশ মাছের সের চার টাকায় লাফিয়ে ওঠায়, একজন চিৎকার করে বলেছিল, এর পর কি দশ টাকা দরে ইলিশ খেতে হবে! আমাদের অবশ্য একটা সুবিধে ছিল, বোয়াল, আড়, শোল, মাগুর, বাঁশ পাতা, বেলে, এই ধরনের মাছগুলি ছিল কলকাতার লোকদের কাছে অস্পৃশ্য, তাই দাম সস্তা, দেড় টাকা-দু’টাকা সের, আমাদের মতন বাঙালদের কাছে এইসব মাছই বেশি প্রিয়, আমি ওগুলিই কিনতাম। শক্তি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার খাস ঘটি, আমাদের বাড়িতে এসে প্রথম বোয়াল মাছ খেয়ে তার এতই ভালো লেগে যায়, যে আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করত, তোমাদের বাড়িতে কি আজ বোয়াল রান্না হয়েছে, তা হলে আমি খেতে যাব।
ইলিশ ছাড়া আর কোনও সামুদ্রিক মাছ বাঙালিরা একেবারেই পছন্দ করে না। এক সময় শঙ্কর মাছ, সার্ডিন ইত্যাদি চালাবার চেষ্টা হয়েছিল, সেগুলি বাজারের এক কোণে পড়ে থাকত অনাদরে, এমনকী পমফ্রেট পর্যন্ত। তেলাপিয়া আসবার আগে পমফ্রেটই ছিল সব চেয়ে সস্তা মাছ, দাম একেবারে নগণ্য। আমি সব রকম নতুন ও অচেনা মাছ চেখে দেখার পক্ষপাতী। লইট্টা বা লটকা নামে এক প্রকার বিশ্রী হড়হড়ে চেহারার মাছ আছে, মনে হয় যেন এক দলা শিক্নি, সে মাছ বাজারে বিক্রি হত মুরগির খাদ্য হিসেবে। সে মাছ যে মানুষের জিভেও অতি সুস্বাদ হতে পারে তা বুঝেছিলাম কোনারকের অতি সস্তার হোটেলে একবার চেখে দেখে। কলকাতায় ফিরেই বাজার থেকে কিনে আনলাম সে মাছ, তা দেখে বাড়ির সবাই ঘেন্নায় মুখ শিটকালো, কেউ ছুঁতেই চায় না। অগত্যা রান্না করলাম আমিই, আলু-পেঁয়াজ কুচিয়ে সামান্য ভেজে তার মধ্যে ওই মাছ ফেলে দিলেই একটু বাদে একেবারে গলে যায়, কাঁটা ফাঁটা কিছু থাকে না। তারপর থেকে সে মাছ আমাদের বাড়িতে চালু হয়ে গেছে।
আমি কিছু কিছু পারিবারিক সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
তখন সব বাড়িতে ব্যবহার করা হত টিনের বালতি। সব সময় কলে জল থাকে না, তাই একাধিক বালতিতে জল ধরে রাখা হয়। জল ভর্তি বড় বড় বালতিগুলি দারুণ ভারী, তুলে নিয়ে যাবার সময় কখনও না কখনও পায়ে আঘাত লাগবেই। বাজারে তখন সদ্য পলিথিনের বালতি আসতে শুরু করেছে কিন্তু বাঙালিরা সেগুলি ব্যবহারের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ। কিন্তু আমি দক্ষিণ ভারতে সেগুলি চালু হতে দেখে এসেছি, সেখানে মাটির হাঁড়ি-কলসির বদলেও অভঙ্গুর পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে ঘরে ঘরে। একদিন আমি টিউশনির মাইনে পেয়ে দু’ খানা করে রঙিন পলিথিনের বালতি ও মগ কিনে নিয়ে এলাম বাড়িতে। বালতি-মগ হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরা ঠিক কবিজনোচিত কাজ না হতে পারে, কিন্তু অন্তত নাগের বাজার অঞ্চলে টিনের বালতি বিদায় করা ও পলিথিন বালতির প্রচলনের পথিকৃতের কৃতিত্ব নিশ্চয়ই দাবি করতে পারি।
তখনও পর্যন্ত আমাদের মতন অনেক বাড়িতেই প্রথা ছিল মাটিতে বসে খাওয়া। সব বাড়িতে থাকত খান কতক পিঁড়ি (কাঁঠাল কাঠের) এবং আসন। সেইসব আসনে বাড়ির মেয়েদের নানারকম সূচিশিল্পের নিদর্শন। তবে আসনগুলি সংরক্ষিত বিশেষ অতিথিদের জন্য আর পিঁড়ি প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য। বড় বড় কাঁসার থালায় ভাতের পাশে শাক-তরকারি-আলু ভাজা সাজানো। বিয়ে বাড়িতে, শ্রাদ্ধ বাড়িতে পঙ্ক্তিভোজ হত মাটিতে বসে।
এইসব পিঁড়ি, আসন, কাঁসার থালা, বাটি আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত হলেও যুগের সঙ্গে পরিবর্তিত হতেও বাধ্য। গ্রামীণ সমাজের যৌথ পরিবারেই এসব মানায়। ছোট ছোট সংসারের পক্ষে এই ঐতিহ্য রক্ষা করা ব্যয়বহুল। অত থালা বাসন রোজ মাজামাজি করাই ঝক্কির ব্যাপার, পিঁড়ি ও আসনে এক কণা ভাত পড়লেও ধুতে হবে, এঁটো কাঁটার বিচার ছিল কুসংস্কারের মতন। বামুন বাড়িতে আবার জলের গেলাসটা বাঁ হাতে ধরা নিষিদ্ধ, ভাত খেতে খেতে জল তেষ্টা পেলে ডান হাতেই গেলাস ধরতে হবে। খাওয়ার পর থালা-বাটি সরিয়ে নেবার পর মেঝেটা ভালো করে ধুয়ে মুছে নিতে হয়, নইলে জায়গাটা শকড়ি হয়ে থাকে। বাড়ির মেয়েদেরই এ কাজ করতে হয়। যেসব পরিবারে দাস-দাসী নেই, সেসব পরিবারেও পুরুষরা বাসন মাজছে, এ দৃশ্য অকল্পনীয়।
আমি একদিন আগে থেকে কারওকে কিছু না জানিয়ে ফুটপাথের দোকান থেকে একটা সস্তার টেবিল ও চারখানা চেয়ার কিনে ঠেলা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এলাম বাড়িতে। বাবার অবর্তমানে পরিবারের প্রধান হিসেবে আমি নির্দেশ জারি করলাম, এখন থেকে আর মেঝেতে বসা চলবে না, খাওয়া হবে টেবিলে এবং কাঁসার থালার বদলে কাচের প্লেটে, যা ধুয়ে ফেলা খুবই সুবিধেজনক। এবং খাবার সময় জলের গেলাস ডান হাতে ধরা অস্বাস্থ্যকর।
এখন ভাবতে মজা লাগছে যে এইসব ব্যবস্থা অনেকদিনই চালু হয়ে গেছে শহরতলিতে। পিঁড়ি ও সাধের আসন অদৃশ্য, এঁটোকাঁটার বাছবিচারও কম। লোহার বালতিও দেখা যায় না। কিন্তু সেই ষাটের দশকের গোড়ায় আমাকে এইসব জোর করে প্রবর্তন করতে হয়েছিল।
আংটি-তাবিজ-মাদুলির বিরুদ্ধেও আমার কড়া অভিমত ছিল। অলঙ্কার বা শোভা বর্ধনের জন্য মেয়েরা তবু আংটি ও কানের দুল পরতে পারে, কিন্তু পুরুষদের হাতে আংটি উপহাসযোগ্য। কোনও পরিচিত পুরুষের হাতে আংটি দেখলেই আমি সরলভাবে জিজ্ঞেস করতাম, তুমি কানে দুল পরো না কেন? কৃত্তিবাস পত্রিকায় নতুন কোনও কবি লেখা জমা দিতে এলে লক্ষ করতাম, তার বাহুতে তাবিজ কিংবা মাদুলি আছে কি না। যদি থাকত, তবে তার কবিতার বিচার করতাম প্রাথমিক অবজ্ঞার সঙ্গে।
পুরুষ মানুষের গোঁফ সম্পর্কেও আমার সংশয় ছিল। কৈশোর ছাড়াবার পর নবীন যুবা হিসেবে আমারও নাকের নীচে গোঁফের রেখা ছিল। গোঁফ ওঠাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার লক্ষণ। তখন কেউ গোঁফ কামালে বলা হত যাত্রার দলের সখি। কিন্তু সাতাশ-আঠাশ বছর বয়েসে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পর মনে হল, গোঁফ রাখার মধ্যে একটা দেখানেপনা আছে। এক একজনের গোঁফ এক এক রকম, ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।কারও মাছি গোঁফ, কারও আশু মুখুজ্যের মতন, কারও হিটলারি, কারও ডগলাসি (ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস জুনিয়ার হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা, তাঁর প্রায় ছবিতেই থাকত তলোয়ার নিয়ে মারামারি, তাঁর গোঁফও তলোয়ারের মতন), অর্থাৎ কে কী রকম গোঁফ রাখবে, সে সেব্যাপারে সচেতন। নিজের চেহারা সম্পর্কে এই সচেতনতাই প্রকটভাবে জাহির করা পুরুষ মানুষের যোগ্য নয়। কফি হাউসে আড্ডা দিতে দিতে একদিন আমি বন্ধুদের বললাম, চলো, সবাই মিলে একটা সেলুনে গিয়ে গোঁফ কামিয়ে ফেলি! কয়েকজন রাজি হল, কয়েকজন হেসে উড়িয়ে দিল।
শক্তি তখন দাড়ি রাখে, সুতরাং তার গোঁফ কামাবার প্রশ্ন নেই। শক্তি চিরতরে দাড়ি কামিয়ে ফেলেছিল আরও পরে, অন্য কারণে। এবং আমি প্রস্তাব করেছিলাম বলেই প্রতিবাদ স্বরূপ সে কখনও গোঁফ কামায়নি।
এগুলিকে কি ছোটখাটো সমাজ সংস্কার বলা যায়? কবিতা রচনা ছাড়াও এইসব দিকে ঝোঁক ছিল আমার। বন্ধুদের প্রায়ই বলতাম, আমি বিয়ে করব কোনও বিধবা কিংবা কোনও মুসলমান মেয়েকে। আমার দুর্ভাগ্য, কোনও বিবাহযোগ্য হিন্দু বিধবা কিংবা কোনও মুসলমান যুবতী আমার দিকে কৃপার দৃষ্টিতে দেখেনি।
রাত্তিরবেলা বাড়ি ফেরার পথে মাঝে মাঝেই মনে হত, জীবনটা কি এইভাবেই কাটবে? সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সব কিছুই যেন রুটিন হয়ে গেছে, এমনকী আড্ডাও রুটিন। সরকারি অফিসে অন্য সহকর্মীরা আলোচনা করত, কী পদ্ধতিতে এবং কবে পদোন্নতি হবে। পদোন্নতি হলেও এই অফিসে আমাকে সারাজীবন কাটাতে হবে! ভাবলেই শিউরে উঠতাম। অন্য কোনও জীবিকার পথ খোঁজার যোগ্যতাও তো নেই আমার। মনের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠত প্রতিবাদ, কিন্তু তা কীসের বিরুদ্ধে তা স্পষ্ট ছিল না। নিজের জীবনটা দেখতে পেতাম না বেশি দূর পর্যন্ত। এই পরিবেশ ছাড়িয়ে ওপরে উঠতেই হবে, কিন্তু কী করে?
এর মধ্যে শক্তি একটা কাণ্ড করে ফেলল। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে গিয়ে সেও চেপে বসল ট্রেনে। তারপর আর পাত্তাই নেই। কয়েক সপ্তাহ বাদে জানা গেল সে আছে চাইবাসায়, সমীর রায়চৌধুরীর কাছে। সমীর আমার সিটি কলেজের বন্ধু, আমার সূত্রেই শক্তির সঙ্গে তার পরিচয় এবং সে তখন বিহার সরকারের অধীনে চাকরি করে, চাইবাসায় থাকে একা।
সমীর কিছুদিনের জন্য হরবোলাতেও যোগ দিয়েছিল এবং বি এ পরীক্ষার পর আমি যখন দীর্ঘদিনের বেকার, তখন একটা ব্যবসায়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আমাকে। দু’জন অংশীদারের মধ্যে সমীর দেবে মূলধন, আমি খাটাখাটনি করব। যেহেতু ছাপাখানার কাজ শিখে গেছি, তাই পুস্তক প্রকাশনার ব্যবসা। আমাদের শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতে রীতিমতো অফিস খোলা হল, সহজ নাম, সাহিত্য প্রকাশক। সমীরেরই আগ্রহ-আতিশয্যে প্রথম প্রকাশ আমারই কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। আমি মনে করতাম, কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদে ছবি থাকা উচিত নয়, তাই গেরুয়া রঙের কাপড়ে বাঁধানো মলাটের ওপর সিল্ক স্ক্রিনে ছাপা শুধু গ্রন্থের নাম ও রচয়িতার নাম, খুবই সুদৃশ্য হয়েছিল কিন্তু ভেতরের কবিতাগুলি এতই দুর্বল যে পরে সেই বইটির দিকে তাকালেই আমার লজ্জা হত। পরবর্তীকালে সে বইটি পুনর্মুদ্রণের কথা আর মনেও স্থান দিইনি, বরং সে বালখিল্য প্রয়াসটিকে চাপা দেবার জন্য ওই নামেই একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। সে বই ক’কপি বিক্রি হয়েছিল তা মনে নেই, কিন্তু উপহার দিয়েছিলাম অনেককে। এক দুপরে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে উপহার দিতে গিয়েছিলাম বিষ্ণু দে-কে, তিনি তখন ক্লাসে পড়াচ্ছেন, ওই সময় যে বিরক্ত করতে নেই সে জ্ঞানও আমার ছিল না। আকাট গ্রাম্য গর্ধভের মতন আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম বইটি হাতে নিয়ে। বিষ্ণু দে যদি দারোয়ান ডেকে আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দিতে বলতেন, সেটা মোটেই অন্যায্য হত না, কিন্তু সেই অগ্রজ কবি নিজেই উঠে এসে সস্নেহে এক কম্পিতবক্ষ তরুণের হাত থেকে বইটি নিয়ে তাকে ধন্য করেছিলেন।
বইটির এক কপি দিয়েছিলাম, চাকরি পাবার পর আমার সেই সরকারি অফিসের এক তরুণী সহকর্মীকে। মেয়েটি সব সময় নতমুখী, কারও সঙ্গে কথাই বলে না। সরকারি অফিসে পুরুষদের তুলনায় মেয়ে কর্মীর সংখ্যা দশ শতাংশেরও কম ছিল তখন, এবং পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কেউই, প্রকাশ্যে অফিসের মধ্যে অন্তত, হেসে কথা বলত না। একমাত্র এক টেলিফোন-অপারেটর যুবতী ছিল প্রগলভা। আমার টেবিলের কাছাকাছি বসা সেই নতমুখী, ছিপছিপে তরুণীটি রোজ একটি করে বই নিয়ে আসত এবং টিফিনে একা একা পড়ত। একদিন একটি বইয়ের মলাট দেখতে পাই, সমর সেনের কবিতা। তাকে কবিতা-পাঠিকা জেনে, ভরসা করে একদিন গোপনে অফিসের বাইরে বাস স্টপে তাকে আমার কাব্যগ্রন্থটি উপহার দিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরে কোনও তরুণীর হাতে তাঁর কাব্যগ্রন্থ থাকার কথা কল্পনা করে গিয়েছিলেন, আমি জীবিত অবস্থাতেই কোনও তরুণী আমার কাব্যগ্রন্থের অন্তত পাতা উল্টে দেখবে, এটুকু তো চাইতেই পারি। মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করেনি, হাত পেতেই নিয়েছিল এবং প্রায় অদৃশ্য একটু খুশির ছায়াও দেখা গিয়েছিল তার মুখে। সেই বইয়ের সূত্রে অবশ্য তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়নি এবং সে কোনও মতামতও জানায়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই সে অফিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘুচে যায়, তারও কিছুদিন পর সেখানকার এক সহকর্মী বরুণ বক্সীর কাছে জেনেছিলাম যে সেই নতমুখী তরুণীটি হঠাৎ কোনও কারণে আত্মহত্যা করেছে। শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব, সে আমার প্রেমিকা ছিল না, কিন্তু আমার কবিতার বইটি তো তার করতল স্পর্শ পেয়েছিল! এ কাহিনী উত্থাপনের কারণ, আরও কয়েকবছর পর কলেজ স্ট্রিটের রেলিঙে পুরনো বইয়ের দোকানে অকস্মাৎ একদিন চোখে পড়ে সেই কাব্যগ্রন্থের এক কপি, পাতা উল্টে দেখি, তাতে সেই মেয়েটির নাম লেখা। তার মুখটা মনে পড়ে গেল। আমার সেই দুর্বল, অকিঞ্চিৎকর কাব্যগ্রন্থটি যে পুরনো বইয়ের দোকানে প্রদর্শনের মর্যাদা পেয়েছে, সেটুকুই তার সার্থকতা।
যাই হোক, সমীরেরও দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল, ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’ এবং ‘আমার ভিয়েৎনাম’, কিন্তু আমাদের সেই প্রকাশনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অতি শৈশব অবস্থাতেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে।
শক্তি চলে গেল সমীরের কাছে চাইবাসায়, আমি কিন্তু তখনও চাইবাসা কোথায় তা জানিই মাসের পর মাস আর শক্তির পাত্তা নেই। শক্তিও অল্প বয়সে পিতৃহীন, কিন্তু বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুবই আলগা, কোনও দায়িত্ব নেয়নি, তাই হঠাৎ হঠাৎ সে বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য যেখানে সেখানে চলে যেতে পারত, আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। শক্তি ফিরে আসছে না, কিন্তু অনেক রকম গুজব ভেসে আসে। একবার শোনা গেল, সমীর চাইবাসা থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছে, শক্তি বন্দি হয়ে আছে সেখানকার জেলে। এটা সত্যি বলে মনে হল, কারণ ওরা চিঠি লেখে না কেন?
শক্তিকে উদ্ধার করার জন্য যাত্রা করলাম সন্দীপন ও আমি। জেলের খাবার খুব খারাপ, সিগারেট পাওয়া যায় না, তাই আমরা শক্তির জন্য কয়েক প্যাকেট সিগারেট, বিস্কুট ও টিনের চিজ নিলাম সঙ্গে, ট্রেন বদল করে চাইবাসায় পৌঁছে উঠলাম ডাকবাংলোয়। আঃ কী আরামের দিন ছিল তখন, রিজার্ভেশন না নিয়েও ট্রেনে বসবার জায়গা পাওয়া যেত, ডাকবাংলোয় গিয়ে চাইলেই পাওয়া যেত ঘর। চাইবাসায় সমীর কোথায় থাকে জানি না, সেখানে কাউকে চিনি না, জেলখানার উঁচু পাঁচিলটা আসবার সময়ই চোখে পড়েছে। পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেছে, পরদিন সকালে সব খোঁজখবর নেওয়া যাবে ভেবে, আমরা দু’জনে বেড়াতে বেরোলাম এবং যে কোনও জায়গায় গিয়ে প্রথমেই আমার কাছাকাছি নদীটি দেখতে ইচ্ছে করে বলে, আমরা হাঁটতে লাগলাম রোরো নদীর দিকে। নির্জন রাস্তা, দু’জনেই গলা মিলিয়েছি এক গানে, হঠাৎ এক বাড়ি থেকে কেউ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, এখানে আমি ছাড়া আর কে রবীন্দ্রসংগীত গায়? এবং বেরিয়ে এল এক দাড়িওয়ালা যুবক। আর কে, শক্তি!
জেলখানার গুজব যে ছড়িয়েছিল, তার মতন সুরসিক আর হয় না। হ্যাঁ জেলখানাই বটে, তবে একেবারে স্বর্গীয় ও রমণীয়। সমীর কিছুদিনের জন্য সরকারি কাজে অন্যত্র গেছে, তাই তার এক পরিচিত বাঙালি পরিবারে রেখে গেছে শক্তিকে। সে পরিবারের সকলেরই ব্যবহার মধুর ও আন্তরিক, শক্তির খাতিরযত্নের শেষ নেই। বিশেষত কিশোরী থেকে তরুণী বয়সের ছ-সাতটি বোন শক্তির মতন একজন মানুষকে পেয়ে গানে-গল্পে মশগুল হয়ে আছে। সন্দীপন ও আমি শক্তির জন্য রেসকিউ পার্টি হয়ে এসেছি শুনে শক্তি মোটেই খুশি হল না। এ বন্দিত্ব থেকে কে উদ্ধার পেতে চায়! এমনকী বন্ধুত্বের টানও এর কাছে তুচ্ছ।
সমীরের বাড়িটা একটা ছোট টিলার ওপরে। ভারী মনোরম পশ্চাৎপট। কিন্তু সকালবেলা আমরা দু’জনে ঘুম ভেঙে উঠতে না উঠতেই দেখি যে তার আগেই সমীর ও শক্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সেই স্বর্গধামেই কাটায় পরিদের সন্নিধানে। সে বাড়িতে আমরা পরে দু’-একবার গেছি বটে, কিন্তু আঁচ পেয়েছিলাম সেটা সমীর-শক্তির ঠিক পছন্দ নয়, ওরা আর এখানে ভিড় বাড়াতে চায় না। সন্দীপন ও আমি ওদের ওপর অভিমান করে সেই টিলার ওপরের নির্জন বাড়িতে বসে সকালবেলাতেই এক কেরোসিনের টিন ভর্তি হাঁড়িয়া পান করে টপ ভুজঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম। মশারির ওপর জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে একটা অগ্নিকাণ্ড বাধাবারও উপক্রম হয়েছিল মনে পড়ছে!
এর পর আরও কয়েকবার আমরা চাইবাসাকে কেন্দ্র করে চক্রধরপুর রাঁচির রাস্তায় পাহাড়ি-জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন ডাকবাংলোয় মাতামাতি করতে গেছি। কিন্তু ওদিকের দীর্ঘপ্রবাস ও অভিজ্ঞতা শক্তিরই সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে। ওর কবিতায় বেশ একটা পরিবর্তন আসে, অনেক বিশুদ্ধ সরল লিরিক লিখতে শুরু করে, যার অধিকাংশই অবিস্মরণীয়। প্রমথ চৌধুরী যাকে বলেছেন মন্ত্রশক্তি, সে রকম একটা কিছু যেন ভর করেছিল শক্তির ওপর। সন্দীপনেরও কিছু রচনায়, বিশেষত ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী’তে ওখানকার ছাপ পড়েছে। কিন্তু ওসব অভিজ্ঞতা আমার ওপর বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। কিংবা আমি লেখায় কাজে লাগাতে পারিনি।
সমীর চাইবাসা থেকে বদলি হয়ে যায় ডালটনগঞ্জে, সেখানেও আমরা গেছি বারবার। ততদিনে সে চাইবাসার পূর্বোক্ত স্বর্গধামের এক বোন বেলাকে বিয়ে করেছে এবং বড় অফিসার। আমাদের মধ্যে সমীরই অনেক আগে বিবাহিত এবং বেলা তার স্বামীর দামাল বন্ধুদের আতিথ্য দিতে কখনও কার্পণ্য করেনি। তার স্বভাবের স্নিগ্ধতায় আমরাও বোধহয় ক্রমশ খানিকটা শান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম।
একবার ডালটনগঞ্জে থাকার সময় খবর পেলাম কাছাকাছি কয়েকটা পাহাড় নিলাম হচ্ছে। ছুটে গেলাম সেই নিলাম দেখতে। তিন-চার হাজারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এক একটা ছোট পাহাড়। তা লিজ না জন্মস্বত্ব তা জানি না, প্রায় ন্যাড়া ন্যাড়া পাহাড় লোকে কেন কিনছে তাও বুঝিনি, কিন্তু খুবই উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। তখনকার লেখক বন্ধুদের মধ্যে আমিই একমাত্র বাস্তুহারা পরিবারের সন্তান, কোথাও আমাদের এক টুকরো জমি নেই। মনে হয়েছিল, ওরকম একটা পাহাড়ের মালিক হতে পারলে পৃথিবীতে আর কিছু চাই না। নিলামের দর চড়ছে, হঠাৎ আমার এক সময় ডাক দিতে ইচ্ছে হয়েছিল, অতি কষ্টে সামলাচ্ছি নিজেকে। পকেটে তিরিশ টাকাও নেই, তিন হাজার টাকার ডাক দিলে কী হয়? লোকে মারবে বোধহয়।
তারপর বেশ কিছুদিন আমি মনে মনে একটা নিজস্ব নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস করেছি।
ছত্রিশ
স্কুল বয়েস থেকেই আমার চিঠি লেখার অভ্যেস এবং আমি চিঠি পেতে অভ্যস্ত। চিঠি লেখার জন্য হাত নিশপিশ করত, গ্রীষ্ম বা পুজোর ছুটিতে বন্ধুরা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেই চিঠি লিখতাম, উত্তর প্রাপ্তির আশা না করেই। জ্বরে কয়েকদিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকলে একটা আনন্দের ব্যাপার, চিঠি লেখার ছুতো পাওয়া গেল! এ তো শুধু ছেলে বন্ধুদের কাছে চিঠি, প্রথম প্রেমপত্র লেখার পর চিঠির স্রোতে প্রবল জোয়ার এসেছিল!
তখন পেন ফ্রেন্ডশিপ বা পত্র মিতালি খুব চালু ছিল। পত্রপত্রিকায় দেশের অন্য রাজ্যের, বাইরের নানান দেশের পত্রবন্ধুদের ঠিকানা ছাপা হত। আমি যৎপরনাস্তি ভুলভাল ইংরেজিতে এবং আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে বিদেশি ছেলেমেয়েদেরও লিখেছি। আন্তর্জাতিক চিঠির ডাক খরচ ছিল যৎসামান্য। সেইসব চিঠির উত্তর আসত সুদৃশ্য খামে আর নয়ন অভিরাম ডাকটিকিটে। এই বিদেশি পত্রমৈত্রীর আর একটা দারুণ মজা ছিল, একটা চিঠির উত্তর পাওয়া যেত সাত-আটখানা। তার রহস্যটা এই রকম: আমি চিঠি লিখলাম জাপানের একটি মেয়েকে, সে আমার নাম-ঠিকানা জানিয়ে দিল তার অন্যান্য বন্ধুদের, তারাও পাঠাতে লাগল চিঠি। সে সব চিঠির উত্তর না দিলেও ক্ষতি নেই, কারণ, তারা আবার এর মধ্যে এই ভারতীয় ছেলেটির ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে অন্য দেশের অদেখা বন্ধুদের, সে সব জায়গা থেকেও চিঠি আসতে শুরু করেছে। অর্থাৎ একটা চিঠি লিখে আমি অনেক সময় পনেরো কুড়িখানা খাম পেয়েছি।
চিঠির সঙ্গে আত্মপরিচয় দিতে হত কিছু কিছু, যেমন শিল্পের কোন শাখায় আমার উৎসাহ, জীবনের প্রধান শখ কী, ইত্যাদি। প্রধান শখ হিসেবে আমি সব সময়ই লিখতাম ভ্রমণ। তার ফলে অবধারিতভাবে পত্রবন্ধুরা আমন্ত্রণ জানাত তাদের দেশে, চলে এসো, আমাদের বাড়িতে থাকবে, তোমাদের নিয়ে সব দর্শনীয় স্থানে যাব, আমার মায়ের রান্না খাওয়াব! একটি জাপানি মেয়ে লিখেছিল, তুমি কি কোনও আগ্নেয়গিরি দেখেছ? তুমি এলে তোমাকে ফুজি আগ্নেয়গিরিতে নিয়ে যাব, আমার বাবা বলেছেন, সেখানে পিকনিক হবে।
এইসব চিঠি পড়ে শুরু হত কল্পনার উদ্দাম খেলা। সত্যি সত্যি যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। খুদে পত্রবন্ধুরা না হয় আতিথ্য দেবে, কিন্তু সাগর পাড়ি দেবার যানবাহনের ভাড়া দেবে কে? এ পর্যন্ত আমি ভারতের মধ্যে দিল্লি-সিমলা-হায়দরাবাদ-গোয়া ঘুরে এসেছি এক বন্ধুর রেলের পাশ নিয়ে। নিজের পয়সায় টিকিট কেটে গেছি বড়জোর শান্তিনিকেতন বা চাইবাসা, বিদেশে পাড়ি দেওয়া বামন হয়ে চাঁদ স্পর্শ করার দিবাস্বপ্নের মতন। তবু, আমি প্রায়ই তীব্রভাবে আকাঙক্ষা করতাম, জাহাজে আলু কাটা কিংবা ইঞ্জিনে কয়লা দেবার চাকরিও যদি পাই, তা হলে নিয়ে নেব তৎক্ষণাৎ! মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেছি, এই পৃথিবীটা পুরোপুরি দেখব না?
পত্র বন্ধুবান্ধবীরা প্রত্যেকেই নিজেদের ছবি পাঠিয়ে অনুরোধ জানাত আমার একটি ছবির জন্য। ছবিটা দেখলে তবু অন্তত বোঝা যায়, কাকে লিখছি, কে আমার কথা মনে করছে। কিন্তু তখন আমাদের এখানে ছবি তেমন সুলভ ছিল না, এখনকার মতন ঘরে ঘরে ক্যামেরা ছিল না। কুমারী মেয়েদের পাড়ার ফটোগ্রাফি স্টুডিয়োতে নিয়ে গিয়ে ছবি তোলানো হত, বিয়ের সম্বন্ধের সময় প্রয়োজন হবে বলে। ছেলেদের ছবির আবার কী দরকার? আমার বাবা, স্ত্রীর কোলে তাঁর প্রথম শিশুপুত্রের ছবি তুলিয়েছিলেন ওই রকম এক স্টুডিয়োতে নিয়ে গিয়ে। স্টুডিয়োগুলি ছিল বেশ মজার। তখনও অন্ধকার ঘরে প্লেট ক্যামেরার যুগ শেষ হয়নি, পেছনদিকে নানান রকম দৃশ্য আঁকা পরদা ঝোলানো থাকত, কলকাতায় বসেই বরফ-ঢাকা পাহাড়ের পটভূমিকায় নবদম্পতির ছবি ভোলা হত বিশ্বাসযোগ্যভাবে। আমার বাবার একটা ছেলেমানুষি শখের ছবিও দেখেছি আমি, তিনি পাইলটের মতন কালো চশমা চোখে এক বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন একটা টু সিটার প্লেনের সামনে। ওটাও স্টুডিয়োতে পর্দায় আঁকা একটা প্লেনের ছবি, সত্যিকারের কোনও প্লেনের কাছাকাছি সম্ভবত তিনি ইহজীবনে যাবার সুযোগ পাননি, আরোহণ করা দূরে থাক।
আমার বন্ধু আর সৌজন্যে অবশ্য আমার ফটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি হয়েছিল অল্পবয়সেই। বনেদি বাড়ির সন্তান হিসেবে আশুর নানা রকম শখের মধ্যে অন্যতম ছিল ক্যামেরা-বিলাসিতা, ওদের পারিবারিক সংগ্রহে লাইকা, নিক্কন এইসব দুর্লভ ও বহুমূল্য কিছু ক্যামেরা ছিল। একটা সাধারণ বক্স ক্যামেরা সে আমাকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার জন্য দিত মাঝে মাঝে। সেটা নিয়ে আমি সন্ধেবেলার আলোকোজ্জ্বল চৌরঙ্গি, দুপুরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ইত্যাদির ছবি তুলে হাত পাকিয়েছি। নিয়ম না জেনে, সূর্যের দিকে লেন্স ফিরিয়ে ছবি তুললে সেগুলি অবধারিতভাবে সিলুয়েট হবেই এবং সেই আকস্মিক-সিলুয়েট ছবিই আমার বেশি পছন্দের হত। যাই হোক, আশুর ভোলা আমার একটি আবক্ষ ছবি আমি পাঠিয়েছিলাম কয়েকজন পত্রবন্ধুকে, তা পেয়ে সুইডেনের একটি মেয়ে লিখেছিল, আই লাইক্ড ইওর অলিভ-কালার ফেস। আমার মুখমণ্ডলটি যে জলপাই বর্ণের, তা আমার জানা ছিল না! কেউ কেউ ইংরেজির বদলে লিখত নিজেদের ভাষায়, হাঙ্গেরি থেকে একটি চিঠি পেয়ে আমি তার একটি শব্দার্থও বুঝতে পারিনি, তাকে উত্তর দিয়েছিলাম বাংলায়।
কলেজ-জীবনে এসে কৃত্তিবাসের সম্পাদক হয়ে বসবার পর প্রত্যেকদিনই আমার নামে খাম আসত নব্য কবি-যশঃপ্রার্থীদের কাছ থেকে। সঙ্গে ডাকটিকিট থাকলে উত্তর দিতাম অবশ্যই, এ শিক্ষা পেয়েছি বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে। তাঁর পত্রিকায় কবিতা পাঠালে উত্তর পেতাম এত দ্রুত, যেন একই দিনের মধ্যে। চিঠি পেতাম অনেক, শুধু বহু প্রত্যাশিত চাকরির চিঠি পাবার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেশ কয়েক বছর।
চাইবাসা কিংবা হেডির ডাকবাংলোয় হুল্লোড় করে ফিরে আসার পর একদিন দেখি, চিঠির বাক্সে আমার জন্য একটি সুদৃশ্য বিদেশি খাম অপেক্ষা করছে। চিঠিটি এসেছে ফিলিপিনস থেকে, লিখেছেন পল এঙ্গেল। যাকে বলে, নিজের চোখেও বিশ্বাস করা যায় না, সেই রকমই ব্যাপার। এসব কী লেখা আছে চিঠিতে, এ কী সত্যি, না মস্করা? পল এঙ্গেল আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমেরিকার আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অন্তর্গত রাইটার্স ওয়ার্কশপে যোগ দেবার জন্য। যাওয়া-আসার বিমান ভাড়া দেওয়া হবে, এবং মাসিক স্কলারশিপ দু’শো ডলার।
বারবার পড়েও চিঠিখানার বক্তব্য যেন বিশ্বাস হতে চায় না। পল এঙ্গেল যে-ক’দিন কলকাতায় ছিলেন, তখন এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কোনও ইঙ্গিত দেননি। তিনি অনেক কবি ও লেখকদের সঙ্গে মিশেছেন, আমার সঙ্গে আলাদাভাবে কোনও কথা হয়নি, তাঁর ওপরে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করার মতন কোনও যোগ্যতাও আমার নেই। আমি ইংরেজির ছাত্র নই, ভালোভাবে ইংরেজি বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। আমার তুলনায় অনেক তুখোড ইংরেজি-জানা যুবকদের তিনি দেখেছেন, তবু তিনি আমাকেই বেছে নিলেন কেন? পরবর্তীকালে অনেকেই আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন। এর উত্তর কি আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব? বারবার এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত আমি উত্তর দিতাম, বোধহয় আমার এই গোল মুখখানা দেখেই সাহেবের পছন্দ হয়েছে, তা ছাড়া আর তো কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না!
পরের চিঠিতে পল এঙ্গেল জানিয়েছিলেন, নিজেদের মাতৃভাষায় যারা লেখে, এরকম কিছু তরুণ কবিকে তিনি আয়ওয়া’র রাইটাস ওয়ার্কশপে জড়ো করতে চান, যারা ইংরেজিতে লেখে তাদের নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই, তাদের অন্য অনেক রকম সুযোগ আছে। আমার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ পড়ে এবং আমি তরুণদের জন্য পত্রিকা সম্পাদনা করি জেনে তিনি মনোনীত করেছেন আমাকে। গরিব দেশের এক কবি নিজের কষ্টার্জিত অর্থে একটি কবিতার পত্রিকার খরচ চালিয়ে যাচ্ছে, এটা পশ্চিমি দেশের মানুষের কাছে অভাবনীয়।
এমন একটা প্রস্তাব পাবার পরেও তা গ্রহণ করা যাবে কি না, তা নিয়ে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছিল। এখানকার সংসার চালাবার দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে। এক ডলারের দাম চার টাকা আশি পয়সা, অর্থাৎ একশো ডলারে চারশো আশি টাকা। আমার এখানকার মাসিক উপার্জন এরকমই। স্কলারশিপের অর্ধেক টাকা প্রতি মাসে দেশে পাঠিয়ে দিলে আর সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমেরিকার জীবনযাত্রার মান আমার জানা নেই। বাকি একশো ডলারে কি ওখানকার বাড়ি ভাড়া, খাওয়া-পরা কুলোবে? অবশ্য মনে মনে আমি প্রথম থেকেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, যতই অসুবিধে হোক, ওদেশে গিয়ে যদি আধপেটা খেয়েও থাকতে হয়, তবু আমি যাবই! পরিচিতদের মধ্যে আমারই ভ্রমণের বাসনা সব থেকে প্রবল, এবং সেই তীব্র ইচ্ছাশক্তিতেই যেন এই সুযোগটি এসে পড়েছে আমার কাছে৷
এর পরেও অনেক বাধা। সবচেয়ে দুস্তর বাধা একটি পাসপোর্ট সংগ্রহ করা। স্বাধীন দেশে প্রত্যেক নাগরিকেরই পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আছে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলিতে সেই অধিকার ছিল না, সেই দেখাদেখি জওহরলাল নেহরুর অধীনে ভারত সরকারেরও দারুণ কড়াকড়ি নীতি ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় এ দেশ থেকে প্রচুর তরুণ-তরুণী ইওরোপ আমেরিকায় যেতে শুরু করে। আমার যাত্রাকাল তার কিছু আগে, তখনও বিদেশি মুদ্রার দারুণ সংকটের জন্য এ-দেশ থেকে খুব মেধাবী ছাত্রছাত্রী ছাড়া কাউকে যেতেই দেওয়া হয় না। আমার মতন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং লেখাপড়াতেও মাঝারি, বাংলা কবিতা লিখি, তাও এমন কিছু খ্যাতিমান নই, আমাকে পাসপোর্ট দেবার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না রিজিওনাল পার্সপোর্ট অফিসার, তিনি একজন দুঁদে আই এ এস এবং বদমেজাজি। বিদ্রুপের ছলে একদিন সরাসরি বললেন, বাংলা কবিতা লিখে আমেরিকা যাওয়া, এ কী মামার বাড়ি নাকি? তুমি যদি ও-দেশে হঠাৎ মারা যাও, তা হলে তোমার দাহকার্যের খরচ দেবে কে? তখন পাসপোর্টের ফর্মে লেখা থাকত যে বিদেশে কোনও ভারতীয়ের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্ব নেবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি, অর্থাৎ ভারত সরকার খরচ করবেন বটে, কিন্তু দেশ থেকে সেই টাকা আদায় করে নেবে। কিন্তু আমার নামে কোনও বাড়ি জমি নেই, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স নেই, আমার মৃত্যুর পরে সে টাকা আদায় করা হবে কীভাবে? অনেক কাকুতি-মিনতি করে একজন গ্যারান্টার জোগাড় করা হল, তাতেও পাসপোর্ট অফিসার সন্তুষ্ট নন, তিনি আমাকে পাসপোর্ট দেবেনই না, বাংলা কবিতার ব্যাপারটাই তাঁর ঘোর অপছন্দের। আমার যাওয়াটাই বানচাল হওয়ার উপক্রম।
আমার বন্ধু দিলীপ দত্ত কংগ্রেসের খুব প্রভাবশালী নেতা অতুল্য ঘোষের আত্মীয়। ওই পরিবারের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু দিলীপ কখনও রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যুক্ত হয়নি, সেইজন্যই সে আমাদের বন্ধু হয়েছিল, সে ক্রিকেট খেলত আর কবিতা লিখত। বড় বড় নেতারা তাদের বাড়িতে আসে, সবাই তাকে চেনে। বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর প্রফুল্লচন্দ্র সেন তখন সবেমাত্র পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, দিলীপ একদিন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল তাঁর কাছে, ঘরভর্তি লোকের মাঝখানে সে বলে উঠল, ও প্রফুল্লদা, সুনীলকে আমেরিকায় যেতে দিচ্ছে না কেন? আপনারা কী রাজ্য চালাচ্ছেন? প্রফুল্ল সেন কিছুই জানতেন না, সব শুনেটুনে বললেন, ওরা ভাড়া দেবে, ওখানে থাকার জন্য স্কলারশিপ দেবে? দেশে এত বেকার ছেলে, এরকম ক’জন চলে গেলে তো ভালোই, আমি হোম সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তখন স্বরাষ্ট্রসচিব রথীন সেনগুপ্ত, মুখ্যসচিব মৃগাঙ্কমৌলি বসু, এঁদের সঙ্গেও দেখা করলাম, এঁরা সহৃদয়ভাবে চিঠিটিঠি লিখে দিলেন। অন্য অনেক ছেলের পক্ষে এইসব হোমরা-চোমরা আমলা কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, নেহাত আমার দিলীপের মতন বন্ধু ছিল এবং নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এতেও কোনও কাজ হল না, সেই পাসপোর্ট অফিসার বরং আরও রেগে গিয়ে বললেন, আমাকে কি পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাইনে দেয়? আমি মাইনে পাই ভারত সরকারের কাছ থেকে, এঁদের কথা আমি শুনতে যাব কেন?
আমার যাত্রা যখন বাতিলই হতে চলেছে, তখন সঙ্কট মোচনের জন্য এগিয়ে এল তারাপদ রায়। তার মেলোমশাই দেবী রায় তখন লালবাজারে ডিসি ডিডি, খুব নামকরা অফিসার, তারাপদর মুখে সব জেনে তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, দেখছি কী করা যায়। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, তার পরের দিনই অর্থাৎ একেবারে শেষ দিন, যার পর হলে আর আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া সম্ভব হত না, আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট দেওয়া হল। যে আই এ এস অফিসার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছিলেন, তিনি একজন পুলিশ অফিসারের কথায় নে রাতারাতি মত বদলে ফেললেন, সে রহস্য এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি।
সাহেবদের দেশে গেলে একটা অন্তত সুট লাগে, আমার তো তা ছিলই না। আমি তখন পর্যন্ত কোটই গায় দিইনি, সোয়েটার-আলোয়ানে শীতকাল কাটিয়ে দিতাম। একটা সাধারণ সুট বানাতে অন্তত পাঁচশো টাকা লাগে। কোথায় পাব সেই টাকা। ভাস্কর ও শরৎকুমার ভাগাভাগি করে টাকা দিয়ে আমায় একটা সুট বানিয়ে দিল। কেউ একজন পরামর্শ দিয়েছিল, কালো কোট-প্যান্টের সঙ্গে মেরুন টাই পরলে সব রকম জায়গায় যাওয়া যায় এবং পায়ের মোজার রং কালো কিংবা মেরুন হতে হবে। আমি টাইয়ের গিঁট বাঁধতেও শিখিনি, শরৎকুমার একবার বেঁধে দিল, সেটাই একটু আলগা করে খুলে রাখতাম, আবার পরবার সময় আঁট করে নিতাম।
আর একটি বাধা, সরকারি অফিস থেকে অনুমতি ও ছুটি নেওয়া। পরিচিত অন্য সরকারি চাকুরেরা আগেই সাবধান করে বলেছিলেন, অনুমতি নিতে গেলেই লাল ফিতের ফাঁসে আটকে যাবে, যদি পূর্ব জন্মের সুকৃতির ফলে অনুমতি মেলেও, তাতেও সময় লাগবে অন্তত তিন থেকে ছ’ মাস! সুতরাং সবচেয়ে ভালো উপায়, অনুমতি নেবার চেষ্টাই না করা। পাসপোর্ট ফর্মে আমি সরকারি চাকরির কথা উল্লেখই করিনি, এবং অফিসে কাউকে কিছু না জানিয়ে কেটে পড়েছি।
সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি আমার দুই ভাইকে। মা আমার যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানাননি তবে উৎকণ্ঠিত ছিলেন ঠিকই। কৃত্তিবাস পত্রিকার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় তুলে নিলেন শরৎকুমার এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়। এতসব কবি ও লেখকদের মধ্যে শুধু আমিই সুযোগ পেয়েছি বলে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়েছিল? খুশি হয়েছিল প্রায় সকলেই, অনেকে দল বেঁধে বিদায় জানাতে এসেছিল আমাদের নাগেরবাজারের বাড়িতে, এমনকী সুদূর বেহালা থেকে অরবিন্দ গুহ পর্যন্ত, যার সে রাতে আর বাড়ি ফেরার উপায়ই ছিল না। বারান্দায় বসে সবাই খেয়েছিলাম মাগুর মাছের ঝোল আর ভাত। মাগুর মাছ নাকি শুভযাত্রা! শুধু বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মনে, শক্তি ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, এঁরা কিছুদিনের জন্য কথা বন্ধ করে দিয়েছিল আমার সঙ্গে।
অন্তত দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ কবি আমার মনোনয়ন একেবারেই পছন্দ করেননি। তাঁরা আমার অযোগ্যতার বর্ণনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন পল এঙ্গেলকে, তিনি সেই চিঠি দেখিয়েছিলেন আমাকে। ওই দু’জন কবির কিন্তু নিজেদের সুযোগ পাবার কোনও প্রশ্নই ছিল না, কারণ পল এঙ্গেল জানিয়েছিলেন, তিনি শুধু তরুণ-তরুণীদেরই রাইটার্স ওয়ার্কশপে একত্র করতে চান, যাদের বয়েস তিরিশের কাছেপিঠে। আমি তখন উনত্রিশ বছর পূর্ণ করেছি। নিজেদের সুযোগ না থাকলেও ওঁরা যে আমার সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করেছিলেন, তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই, নিষ্কাম বিদ্বেষ তো কিছু মানুষের থাকতেই পারে। তাতে আমার কৌতুকবোধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে উক্ত কবিদ্বয়ের সঙ্গে যখন আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁরা যেমন পূর্ববৎ সস্নেহ ব্যবহার করেছেন, আমিও সশ্রদ্ধ ব্যবহারই করেছি, আচরণের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সত্যিই কি তাই? আন্তরিকতাহীন, কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল নিশ্চিত।
আরও কিছু লোক, যাদের আমি চিনিই না, তারা রটিয়ে দিল যে এটা সি আই এ-র ষড়যন্ত্র, আমি সি আই-এর চর হবার জন্যই আমেরিকা যাচ্ছি। এমনই জোর দিয়ে তারা বলত, যেন এই সব তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে আছে। এমনও মনে হতে পারত, যেন সি আই এ নামক সাঙ্ঘাতিক সংস্থাটি গোপনে গোপনে বামপন্থীদের কাছে এইসব তথ্যপ্রমাণ তুলে দেয়। শুনতে শুনতে এমনকী আমারও খটকা লেগেছিল, সত্যিই কি আমি কিছু না জেনে সি আই এ-র ফাঁদে পা দিচ্ছি? বাংলা কবিতা লেখার জন্য আমেরিকায় স্কলারশিপ পাওয়ার ব্যাপারটা এমনই অভিনব যে এর কোনও সরল ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য হতে চায় না। সি আই এ আমাকে কীভাবে কাজে লাগাবে, তা জানার খুবই কৌতূহল ছিল। কিন্তু আমার মতো নগণ্য চুনোখুঁটিকে শেষ পর্যন্ত বোধহয় সি আই এ পাত্তাই দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের বাইরে একটা পয়সাও তো কেউ দিল না। এবং আমার পরে শঙ্খ ঘোষ যখন ওই একই পরিকল্পনায়, আমেরিকায় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপে যোগ দিতে গেলেন, তখন ওই বামপন্থীরা একেবারে নিশ্চুপ, যেন সি আই এ নামে কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই, আমেরিকাও নির্দোষ হয়ে গেছে।
পল এঙ্গেলের সেই আমন্ত্রণপত্রটি এমনই একটা আকস্মিক ঘটনা যা আমার জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। তখন আমার জীবনযাত্রায় একটা ছক নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেইভাবেই বাকি জীবন চলার কথা ছিল, হঠাৎ সব তছনছ হয়ে গেল। এমনকী এরকমও আমার মনে হচ্ছিল বারবার যে আর হয়তো কোনওদিনই আমি কলকাতার জীবনে ফিরে আসব না।
উনত্রিশ বছরের এক যুবক, যে আগে কখনও সুট-টাই পরেনি, কখনও প্লেনে চাপেনি, সে এক সেপ্টেম্বরের মধ্যরাত্রে প্যান অ্যাম কোম্পানির বিমানে পাড়ি দিল সুদূর বিদেশে। সারাদিন তাকে খুবই দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছে, পাসপোর্ট পেয়েছে শেষ মুহূর্তে, পাসপোর্ট না দেখালে হাতে টিকিট পাওয়া যায় না, টিকিট না দেখালে পাওয়া যায় না ফরেন এক্সচেঞ্জ, তাও মাত্র আট ডলার। (তখন দরিদ্র ভারতমাতা তার সন্তানদের অচেনা বিদেশে পাঠিয়ে দিত মাত্র তিন পাউন্ড বা আট ডলার হাতে দিয়ে।) এতই ক্লান্ত ছিল সে, যে প্লেনে ওঠামাত্র তার ঘুম পায়, তবু সে জোর করে চোখ খুলে রেখে দেখেছিল কলকাতার আলোকোজ্জ্বল আকাশ ছেড়ে বিমানটি চলে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে।
আমেরিকায় এই যুবকটির কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। মাঝপথে কোথাও থামারও উপায় নেই, কারণ আর দু’ দিনের মধ্যে আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম নথিভুক্ত করাতে না পারলে এ বছর আর স্কলারশিপ পাওয়া যাবে না। যদি বিমানযাত্রায় মাঝপথে কোনও ছেদ পড়ে, তা হলে কী হবে? বিমান পাল্টাতে হবে তিনবার। যদি কোনও ভুল হয়? পকেটে আট ডলার সম্বল।
ভোরবেলা বিমানটি প্রথম এক জায়গায় থামার পর একটি দারুণ চমক। এখানে নেমে পায়চারি করতে দেওয়া হবে না, কিন্তু জানলা দিয়ে দেখা গেল, গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা ‘করাচি বিমানবন্দর’। দমদম বিমানবন্দরে বাংলার কোনও চিহ্ন নেই, বাংলা ভাষা দেখা গেল পাকিস্তানে? পূর্ব পাকিস্তানের তীব্র ভাষা আন্দোলনের কাছে ততদিনে নতি স্বীকার করেছে পাকিস্তানের জঙ্গি সরকার, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও তখন সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। করাচিতে সেই বাংলা অক্ষর দেখার রোমাঞ্চ কোনওদিন ভোলা যাবে না।
নিউ ইয়র্কের প্রধান বিমানবন্দরটি এখন সে দেশের ভূতপূর্ব ও নিহত রাষ্ট্রপতি কেনেডির নামে। সেই তেষট্টি সালে কেনেডি জীবিত এবং বিমানবন্দরটির নাম ছিল আইড্ল ওয়াইল্ড। সে এক বিশাল কাণ্ডকারখানা। আমাকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শিকাগো যাওয়ার জন্য প্লেন বদল করতে হবে, যেতে হবে এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে। কী করে সেখানে যাব? কোথায় নির্দেশ লেখা আছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। দিশাহারা হয়ে এক সহযাত্রীকে টিকিটটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী করে শিকাগো যাব? সে একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে বলল, টেক অ্যাল।
সেই প্রথম খাঁটি আমেরিকান ভাষার সঙ্গে পরিচয়। টেক অ্যাল মানে কী? আর দু’-একজনকে জিজ্ঞেস করে, ওই একই উত্তর পাই। সবারই যেন খানিকটা আনুনাসিক উচ্চারণ, আর দু’-এক মুহূর্তের বেশি সময় খরচ করে না। আমেরিকানদের সব কিছুই বড় বড়, যেমন বড় বাড়ি, তেমনই চওড়া রাস্তা, তবু মুখে বলার সময় সব কিছুই ছোট করে নেয়। যেমন বাঘকে বলে ক্যাট আর বিশ্ববিদ্যালয়কে স্কুল। শেষ পর্যন্ত ডুবন্ত ব্যক্তির খড় কুটো চেপে ধরার মতন একটি বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াট ইজ অ্যাল? তখন জানা গেল, অ্যাল হচ্ছে আমেরিকান এয়ারলাইন্স-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, অর্থাৎ যেখানে যেখানে অ্যামেরিকান এয়ারলাইন্স লেখা, সেই নির্দেশ অনুসরণ করে আমায় ছুটতে হবে।
শিকাগোতে রোমাঞ্চকরভাবে রাত্রিযাপন করে পরদিন সকালে আয়ওয়া শহরে পৌঁছনো গেল। ক্রমশই বিমানগুলি ছোট হয়ে আসছিল, আয়ওয়ার যাত্রী বিমান খুবই ছোট, ডাকোটা ধরনের। এই বিমানেই আমি প্রথম বর্ণবৈষম্যের পরিচয় পাই। আমিই একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ যাত্রী, একজন বেশ ঢ্যাঙা বিমানসেবিকা আর সবাইকে কফি দিয়ে গেল, আমাকে বাদ দিয়ে। এটা কি সত্যি সম্ভব? নিশ্চিত ভুল করেছে মেয়েটি। কিন্তু সে সামনের সারির দুই ব্যক্তির সঙ্গে গল্প করতে লাগল এবং অন্যদের কাছ থেকে খালি কাপগুলি ফেরত নিয়ে গেল, আমার দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। আমি তবুও ধরে নিলাম, মেয়েটি অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করেনি আমাকে। এর পরেও আমি স্পষ্ট বর্ণবৈষম্যের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দেখেছি, আবার কিছু কিছু মানুষকে এতই উদার ও মুক্তমনা দেখেছি যে তার থেকেই মনে হয়েছে, কোনও দেশের মানুষকেই জাতিগতভাবে এক শ্রেণীতে ফেলা যায় না। আমেরিকানরা সবাই বর্ণবৈষম্য মানে, এটা যেমন সত্যি নয়, আবার আমেরিকানরা সবাই উদার, এটাও সত্যি নয়। একটা মিশ্র জাতির নানান লক্ষণ এখনও তাদের মধ্যে স্পষ্ট।
যদি কোনও কারণে কেউ এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে না আসে, তা হলে আমার অবস্থা হবে অসহায়ের মতন। ততক্ষণে আট ডলারও নিঃশেষ। এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছবার মতন গাড়ি ভাড়াও আমার নেই। কিন্তু বিমানটি যখন নিচু হয়ে চক্কর দিচ্ছে, তখন আমি রানওয়ের ওপর এক দীর্ঘকায় ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। পল এঙ্গেল। আমি নামতেই তিনি তাঁর চওড়া বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সে বুকে নিশ্চিত আশ্রয় আছে।
দেড় দিন আগে আমি ছিলাম কলকাতা শহরে। সেখান থেকে সরাসরি আমেরিকার মাটিতে। সাধারণত অনেকেই দু’-একদিন ইউরোপে থেমে আসে, তাতে আবহাওয়া ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন খানিকটা সইয়ে নেওয়া যায়। আমার সে সুযোগ হল না, এমনকী এখানে পৌঁছে বিশ্রামের প্রশ্ন নেই, মালপত্র গাড়িতে চাপিয়ে পল এঙ্গেল আমাকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। বিভিন্ন জায়গায়। প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছবি তোলা ও রেজিস্ট্রেশন, তারপর ব্যাঙ্কে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা, তারপর টেলিফোন ও গ্যাস কানেকশনের ব্যবস্থা, তারপর ইউনিয়ন ক্যান্টিনে লাইন দিয়ে খাবার সংগ্রহ করা। এরই ফাঁকে ফাঁকে নানান ব্যবস্থাপনার কথা বুঝিয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন, আমার জন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টও ভাড়া করে রাখা হয়েছে, ভাড়া একটু বেশি, কিন্তু সস্তার ডর্মিটরিতে অনেকের সঙ্গে থাকলে লেখাপড়ার অসুবিধে হতে পারে, নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টই ভালো।
সেই অ্যাপার্টমেন্ট একটি কাঠের বাড়ির দোতলায়। একটাই ঘর, সঙ্গে রান্নার জায়গা ও বাথরুম, বিশেষভাবে ছাত্রদের জন্যই তৈরি বলে বোঝা যায়। পল এঙ্গেল আমাকে সেখানকার সরঞ্জামগুলি বুঝিয়ে দিয়ে, হাতে চাবিটি দিয়ে বললেন, তুমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, আমি বিকেলের দিকে আবার আসব।
টেলিফোন, ফ্রিজ, গ্যাসের কুকিং রেঞ্জ, বাথরুমে শাওয়ার, এসব কোনও কিছুই আমি আগে ব্যবহার করিনি। কলকাতায় ইস্কুল মাস্টার কিংবা কেরানিদের সংসারে এইসব দ্রব্য তখনও প্রবেশের সুযোগ পায়নি। কিন্তু আমার বিশেষ করে চোখে পড়ল একটি আয়না। অত বড় আয়নাও আমাদের বাড়িতে ছিল না। দরজাটা বন্ধ করেই আমি চমকে উঠেছিলাম। দরজায় এদিকে লাগানো রয়েছে একটি প্রমাণ সাইজের আয়না, যাতে আমার আপাদমস্তক দেখা যায়। সেই অচেনা দেশে প্রথমদিনে আয়নার মানুষটিকেও আমার অচেনা মনে হল।
সাঁইত্রিশ
প্রথমেই সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে বুঝে পল এঙ্গেল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাঁর ফার্ম হাউসে, সেটি আয়ওয়া শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে।
দু’পাশে আদিগন্ত হলুদ ফসল, মাঝখান দিয়ে চকচকে মসৃণ কালো রাস্তা। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে এক একটি দুধ-সাদা ছোট গির্জা। গাড়ি যাচ্ছে অনবরত, কিন্তু কোনও শব্দ নেই। পল এঙ্গেল গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতে ভালোবাসেন, প্রখ্যাত নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামস এক সময় আয়ওয়াতে ছিলেন, তাঁর গল্প বলছিলেন। আমি অভ্যেসবশত সিগারেট ধরাতেই তিনি ভ্রূ-কুঞ্চিত করে কয়েক নিমেষ তাকিয়ে রইলেন, তারপর হেসে বললেন, ঠিক আছে, খাও। পরে বুঝেছিলাম, সব কাচ বন্ধ, বাতানুকূল গাড়ির মধ্যে ধূমপান অনুচিত।
আয়ওয়া রাজ্যটিকে অন্য জায়গার আমেরিকানরা মনে করে চাষাভুষোদের দেশ। এ দেশে এক একটি রাজ্য এক একটি নামে চিহ্নিত, যেমন নিউ জার্সিকে বলা হয় উদ্যান রাজ্য, তেমনই আয়ওয়া ফসল রাজ্য বা কর্ন স্টেট। মাইলের পর মাইল গম কিংবা ভুট্টার খেত। তবে, যেহেতু এ দেশে ছোট চাষির অস্তিত্ব নেই, এক একজন শত শত একর জমির মালিক, তাই সেইসব চাষিরা অত্যন্ত ধনী, প্রত্যেকেরই দু’তিনটে গাড়ি, নিজস্ব ছোট প্লেন আছে, এদের বাড়িতে আসল পিকাসো বা সালভাদর দালি’র ছবি ঝোলে। এ রাজ্যে বড় কোনও শহরও নেই, ছোট ছোট শহর অনেকগুলি, বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক। তবু নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলিসের মতন বৃহৎ শহরের বদলে নিরুত্তাপ, শান্ত, খুদে আয়ওয়া শহরের বিশ্ববিদ্যালয়েই কেন আন্তর্জাতিক কবি-লেখকদের সমাবেশ, তা নিয়ে আমেরিকার অনেক বুদ্ধিজীবী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র পল এঙ্গেলের অত্যুৎসাহে। তাঁর ধারণা, পৃথিবীর সব ভাষার কবিরাই পরস্পরের আত্মীয়, তাই তিনি তাদের এক জায়গায় মেলাতে চান। এই কার্যক্রমের খরচ তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। আমেরিকানরা অনবরত এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বাসা বদল করে, তারা বাপ-পিতামহর ভিটে কিংবা ঐতিহ্যের শিকড়ে বিশ্বাসী নয়, কিন্তু পল এঙ্গেল সে ব্যাপারে ব্যতিক্রম, তাঁর জন্ম কর্ম সবই আয়ওয়াতে, তিনি এ রাজ্যের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি এখানকার ধনী চাষিদের কাছে গিয়ে সরাসরি দাবি করেন, তোমরা কবিতার জন্য কিছু টাকা খরচ করো! দাবিটি অনেকের কাছে প্রথমে অদ্ভুত শোনায়। সাধারণ অবস্থা থেকে যারা ধনী হয়, তারা সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে, তারা গির্জা বানায়, হাসপাতাল বা স্কুল কলেজের জন্য দান করে। প্রখ্যাত শিল্পীদের ছবি কিনে ঘর সাজানোও সামাজিক কেতার মধ্যে পড়ে, যাতে নিজেকে ছবির সমঝদার এবং সংস্কৃতিবান হিসেবেও জাহির করা যায়। তা ছাড়া মূল্যবান ছবি-কেনা এক ধরনের ব্যবসায়িক বিনিয়োগও বটে, জমিজমার মতনই, এসব ছবির দাম বাড়তেই থাকে।
কিন্তু কবিতা? তা তো সামাজিক কেতার মধ্যে পড়ে না! বেশির ভাগ নব্য ধনীর কাছে কবিতা জিনিসটাই একদল পাগলের খেয়াল। তবু পল এঙ্গেলের ঝুলোঝুলিতে এক একজন পাঁচ-দশ হাজার ডলার দিয়ে দেয়। রাই কুড়িয়ে বেল, এ রকম পাঁচ-সাতজনের কাছ থেকে আদায় করতে পারলেই হয়ে যায় যথেষ্ট। অর্থাৎ গম ও ভুট্টা চাষিদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে রাইটার্স ওয়ার্কশপ নামে প্রকল্পটি চালু হয়েছে। টাকা আদায়ের নানান বিচিত্র কাহিনী পলই আমাকে শুনিয়েছেন, একবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে এক অতিশয় ধনাঢ্য চাষির বাড়িতেও গিয়েছিলেন।
একর প্রতি ফসল উৎপাদনে সারা বিশ্বে আয়ওয়ার স্থান প্রথম। ষাটের দশকে আমেরিকা সফরে এসে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ আয়ওয়ার এক গমের খেতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করেছিলেন সে কথা। সেই সময়ে আমেরিকান গম সম্পর্কে অনেক বিচিত্র তথ্যও জানা যেত। গমের উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে গেলে বিশ্বের বাজারে দাম পড়ে যাবে। আমেরিকানদের প্রধান ধর্ম হল ব্যবসায়-চিন্তা। এক বছর গমের দাম পড়ে গেলে পরের বছর মূল্যবৃদ্ধি সহজ নয়। সুতরাং অত্যধিক উৎপাদন হলেও তার সবটা বাজারে ছাড়া হবে না, জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি করে প্রচুর গমের বস্তা ডুবিয়ে দেওয়া হত সমুদ্রে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ অনাহারে বা অর্ধভুক্ত অবস্থায় থাকে, অথচ এভাবে গম নষ্ট করা হয়? পৃথিবীর সব মানুষকে খাওয়াবার দায়িত্ব আমেরিকানরা নেবে কেন? কিছু কিছু দান-খয়রাত করা হয় অবশ্যই, দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে আমেরিকান সরকার খাদ্য পাঠায়, তার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে, এবং ঢাক ঢোল পিটিয়ে তার প্রচারও হয় অনেক। বাজার চাঙ্গা রাখার জন্য মানুষের ক্ষুধাও জাগিয়ে রাখা দরকার। কয়েক বছর পর আমেরিকান সরকার একটা নতুন বুদ্ধি বার করল। জাহাজ ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে গম ঢালারও বেশ খরচ আছে। তা ছাড়া এর প্রচারের দিকটাও খারাপ, গরিব দেশগুলি আরও আমেরিকান-বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। তাই আমেরিকান সরকার প্রতি বছর কিছু কিছু চাষির কাছে আবেদন জানাতে লাগল, তোমাদের এ বছর আর চাষই করতে হবে না। জমি ফেলে রাখো। গত বছর এই জমি থেকে তোমাদের যা আয় হয়েছিল, সেই টাকা সরকার থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। চাষিরা তো তাতে রাজি হবেই, বিনাশ্রমেও সমান উপার্জন। অর্থাৎ প্রতি বছর সারা দেশে কতখানি উৎপাদন হবে, যা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সীমিত দান-খয়রাত সচল রাখা যায়, তাও পূর্ব কল্পিত ও নির্দিষ্ট।
পল এঙ্গেল আমাকে যে চাষির বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, যাঁর বাড়িতে আমি জীবনে প্রথম পিকাসো ও দেলাক্রোয়ার পাঁচখানি আসল ছবি দেখি, তিনি সে বছর চাষ-বাস থেকে মুক্ত এবং সরকারের কাছ থেকে সমান টাকা পেয়েছেন, তাই মেজাজ বেশ প্রসন্ন, দু’দিন বাদেই সপরিবারে বিশ্ব-ভ্রমণে যাবেন, আমাদের খুব খাতির-যত্ন করলেন এবং পনেরো হাজার ডলারের চেক কেটে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। চাষি মহাশয়ের চারটি ছেলেমেয়ে, তাদের মধ্যে একটি ছেলের গায়ের রং কুচকুচে কালো, জানা গেল, সেই চারজনকেই তিনি দত্তক নিয়েছেন, তাঁর স্ত্রী কোনও সন্তান উপহার দিতে পারেননি।
এসব কয়েক মাস পরের কথা। প্রথম দিন পল এঙ্গেল আমাকে যেখানে নিয়ে গেলেন, সে জায়গাটার নাম স্টোন সিটি, হয়তো কয়েক দশক আগে গ্রামই ছিল। এখন ক্ষুদ্র, পকেট সংস্করণ শহরই বলা উচিত, এ দেশে প্রকৃত গ্রাম আর নেই, আধুনিকতার আর আরামের সব সরঞ্জাম এবং সবরকম খাবারদাবার সর্বত্র পাওয়া যায়। সেখানকার দোকান থেকে কিছু কেনাকাটি সেরে আবার আমরা যেতে লাগলাম ঘন বনের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে রাত্রি নেমে এসেছে। কোথাও আলো নেই। কিছুক্ষণ যাবার পর একটা চমক লাগল। সেই অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে হঠাৎ আলোয় ঝলমল করে উঠল একটি বাড়ি, একটা ছোটখাটো দুর্গের মতন, যেন একটা স্বপ্নপুরী। সে বাড়িতে পল এঙ্গেলের স্ত্রী একলা থাকেন, তাই বুঝি এত আলো জ্বেলে রাখা।
গেট দিয়ে গাড়িটা ঢোকার সময় পল খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থী ভঙ্গিতে বললেন, প্রথম আলাপে আমার স্ত্রী হয়তো তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন, তুমি ঘাবড়ে যেয়ো না। যদি রাগারাগি করেন, তুমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকবে, দু’-একদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরকম কথা শুনলে ঘাবড়াবে না কে?
কিন্তু খারাপ ব্যবহার তো দূরের কথা, প্রথম আলাপের পর থেকেই পলের স্ত্রীর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক হয়ে যায়, এবং তা আমারই চরম বোকামির কারণে। অনেক কিছু জানার বদলে খুব কম জেনেও যে মানুষ কখনও কখনও জিতে যায়, এ তারই এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত।
সে রাতে মহিলার সঙ্গে দেখা হল না, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমরা কয়েকটি স্যান্ডউইচ সহযোগে দু’ পাত্র সুরা পান করে শুতে চলে গেলাম। বলাই বাহুল্য, আমার ঘুম আসার কোনও প্রশ্নই নেই। প্রথমত জেট ল্যাগ, দ্বিতীয়ত, পর পর তালা বন্ধ ঘরের পাশে একটি মাত্র ঘর খুলে আমাকে যে-খাটে শুতে দেওয়া হয়েছে, সেটা খাট তো নয়, পালঙ্ক, এত বড় পালঙ্ক, দুগ্ধ ফেননভি নরম বিছানায়, মখমলের মতন তুলতুলে কম্বলের নীচে জীবনে প্রথমবার শুয়ে নাগেরবাজারের কোনও ভাড়া বাড়ির ছেলের কি ঘুম আসতে পারে? একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, এটা আমেরিকা? আমি সত্যিই আমেরিকায় শুয়ে আছি!
ভোরের আলো ফোঁটার পর আমার আর একটা চিন্তা হল। ঠিক কখন তৈরি হয়ে নিতে হয়? বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা কি ভদ্রতাসম্মত? প্লেনে ওঠার পর থেকেই একটি দুশ্চিন্তা আমাকে কুরকুর করে খাচ্ছে, এদের দেশে এসে আমার আচার ব্যবহারে কোনও ভুল হবে না তো? কেউ আমাকে অসভ্য, বর্বর মনে করবে না তো? ভুল হলেই বা কী আসে যায়, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যবহার করব—এই সাহসিকতা বা দস্তু কিছুতেই জাগাতে পারিনি।
এত বড় বাড়ি, একেবারে নিস্তব্ধ, আর কারও জেগে ওঠার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তবু, দেরি করে ওঠার চেয়ে ভোরে ওঠায় দোষ নেই! তাড়াতাড়ি দাঁত-টাঁত মেজে তৈরি হয়ে, প্যান্ট-শার্ট পরে নেমে এলাম নীচে। কারওকেই দেখা যাচ্ছে না। শব্দ না করে, কাল রাতে যে-দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম সেটা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে, রাত্তিরে কিছু বোঝা যায়নি, বাড়িটির দু’পাশে বিস্তৃত বাগান, খুব একটা যত্নের ছাপ নেই, এলোমেলো ফুলগাছ, একটু দূরেই বেশ বড় বড় গাছ। এত বড় বাড়ি, গেটে দারোয়ান দেখিনি, কাজের লোকও নেই? আমাদের দেশে যাদের এত বড় বাড়ি ও বাগান, তাদের অন্তত চার-পাঁচজন কাজের লোক তো থাকবেই। এখানে ধারেকাছেও কোনও মনুষ্যবসতি নেই।
একটুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পরই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একটি ছোট ওকগাছের সামনে দাঁড়িয়ে ভোমরার ওড়াউড়ি দেখছেন একজন প্রৌঢ়া রমণী। ইনিই নিশ্চিত গৃহকত্রী। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে তিনি মুখ ঘুরিয়ে চেয়ে রইলেন নিপলকভাবে। এদেশে এমন রূপহীনা নারীর অস্তিত্ব আমি কল্পনাই করিনি। তাঁর শরীরে নারীত্বের কোনও চিহ্নই নেই বলতে গেলে। রোগা, ছোটখাটো চেহারা, প্যান্ট পরা, ওপরে ভারী সোয়েটার, নারী-সুলভ বুকের ঢেউ টের পাওয়া যায় না, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, নাকের নীচে পাতলা গোঁফের আভাস, পলের তুলনায় বেশি বয়স্কা মনে হয়, মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে খানিকটা, চোখ দুটি কুতকুতে। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথম দর্শনে তাঁকে ঠিক একটি বানরীর মতন মনে হয়েছিল। আগের রাতে পল যেভাবে তাঁর স্ত্রীর বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, মহিলার মাথার গোলমাল আছে। সকালেই এক পাগলিনীর মুখোমুখি হয়ে ভয়ে আমার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। কেন বিছানা ছাড়তে গেলাম এত তাড়াতাড়ি! পল কাছে থাকলে এতটা বিপদ হত না।
চোখাচোখি হয়েছে, একটা কিছু তো বলতেই হবে। এ দেশে শুধু ‘হাই’ বললেই সব কাজ চলে যায়, সেটা তখনও জানি না। প্রভাতে প্রথম দেখার সময় গুড মর্নিং বলতে হয় তা জানি, কিন্তু সম্বোধন! এখানে সবাই সবার নাম ধরে ডাকে, ছোট-বড়র কোনও ভেদ নেই। কলকাতাতেই পল এঙ্গেল বলে দিয়েছিলেন, তাঁকে মিস্টার এঙ্গেল বলার কোনও দরকার নেই, সবাই পল বলবে। কিন্তু এই মহিলার সঙ্গে তো পরিচয়ই হয়নি, মায়ের বয়সি মহিলাকে প্রথমেই নাম ধরে ডাকব? নামটাও তো জানি না। এখানকার ইংরেজি স্কুলে পড়া স্মার্ট ছেলে হলে নিশ্চয়ই চট করে বলে দিত, হাই আন্টি! কিন্তু আমি জীবনে কখনও আঙ্কল, আন্টি বলিনি কারওকে।
ভদ্রমহিলা কী যেন বললেন বিড়বিড় করে, আমি বুঝতেই পারলাম না। তা হলেও এর পর আমার চুপ করে থাকাটা চরম অসভ্যতা। কী বলব, কী বলব ভেবে দিশাহারা হয়ে আমি বলে ফেললাম, গুড মর্নিং মাদার!
ওর চোখ দুটো আরও কুঁচকে গেল। আমার দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াট? কী বললে, কী বললে তুমি? মাদার? তুমি আমাকে মাদার বললে? আমি তোমার মাদার হলাম কবে? তুমি মাদারই বললে? আবার বলল তো!
আমি নিশ্ৰুপ। নিশ্চিত আমার মুখখানা আমসিবর্ণ হয়ে গেছে।
তিনি একই কথা বলতে লাগলেন, মাদার? আমি তোমার মাদার? হাউ কাম?
পরে যতবারই এই কথাটা ভেবেছি, লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। আমি ব্যবহার করেছি জংলি ভূতের মতন৷ এ দেশে কোনও অনাত্মীয়া মহিলাকে মাদার বলা মানে বয়সের খোঁটা দেওয়া। প্রাপ্তবয়স্কা নারী-পুরুষ যে অন্য সম্বোধনের বদলে শুধু সবাই সকলের নাম ধরে ডাকে, তার কারণ, তাতে বয়সের কোনও উল্লেখ থাকে না। বাবা কাকার বয়সি পুরুষদেরও বলা চলে না আঙ্কেল। প্রৌঢ়ারাও সব সময় যুবতী সেজে থাকতে চায়।
বারবার মাদার, মাদার বলতে বলতে তিনি এক সময় হি হি করে হেসে উঠলেন, সে হাসি আর থামতেই চায় না, হাসতে হাসতে মাথা দোলাতে লাগলেন প্রবলভাবে। এরপর আরও মাস দু’-এক ধরে তিনি যখনই অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, হাসতে হাসতে বলেছেন, জানো, এই এশিয়ান ছেলেটা আমাকে প্রথম কী বলেছিল? মাদার, গুড মর্নিং মাদার! তাঁরাও তা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়েছেন প্রায়। মাদার শব্দটি যে এমন হাস্য উদ্রেককারী, তা কে জানত!
পল এঙ্গেলের স্ত্রী মেরি আমার সেই মাতৃ সম্বোধন শুনে যতই বিদ্রুপ আর কৌতুক বোধ করুন, কিন্তু ওই শব্দটি তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতেও কোনওভাবে স্পর্শ করেছিল নিশ্চিত। সমসাময়িক প্রথা বিরোধী হলেও নারীদের কাছে এই ডাকের একটি চিরকালীন আবেদন আছে। সেই প্রথম দিন থেকেই তিনি আমার সঙ্গে কোনও রকম পাগলামি করেননি, বরং অতিরিক্ত খাতিরযত্ন শুরু করেছিলেন এবং তা ক্রমশ আরও বেড়েছে। তিনি কখনও এই জঙ্গলমহলে থাকেন, কখনও শহরে। শহরে থাকার সময় প্রায়ই আমাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। পল এঙ্গেল কোনও কারণে কাজ উপলক্ষে বাইরে গেলেই মেরি ফোন করে আমাকে বলতেন, আমার একা একা বসে খেতে ভালো লাগে না, তুমি এসে আমার সঙ্গে খাও। আমার একা একা থাকতে ভালো লাগছে না, তুমি রাত্তিরে এ বাড়িতে এসে থাক! পল এঙ্গেল খানিকটা বিস্মিতভাবেই একদিন আমাকে বলেছিলেন, এর আগে কত বিদেশি ছেলেমেয়ে এসেছে। কিন্তু আর কারওকে মেরি এত বেশি পছন্দ করেনি। তুমি কোন ভারতীয় জাদুতে ওকে বশ করেছ?
মেরি আর পল একই বয়সি, একই সঙ্গে স্কুল কলেজে বর্ধিত হয়েছেন, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন প্রথম যৌবনে। মেরি যথেষ্ট বিদূষী এবং বুদ্ধিমতী, হয়তো এককালে সুশ্রীও ছিলেন। পল যখন উচ্চশিক্ষার জন্য সব জীবিকা পরিত্যাগ করেন, তখন মেরি হোটেল-রেস্তোরাঁয় সামান্য কাজ করে সংসার চালিয়েছেন, স্বামীর জন্য অনেক আত্মত্যাগ করেছেন একসময়। এখন তাঁর স্বামী একজন কর্মোদ্যোগী ও ব্যস্ত পুরুষ, এর মধ্যে কোনও কারণে মেরির চেহারাটা গেছে খারাপ হয়ে। পল শক্তসমর্থ পুরুষ, আর মেরির চেহারায় অকালবার্ধক্যের ছাপ। এখন মেরির ধারণা হয়েছে, পল আর তাঁকে ভালোবাসেন না, তাঁর প্রতি মনোযোগ দেন না, অন্য মেয়েদের দিকে ঝুঁকেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী ছাত্রী ও অধ্যাপিকারা তাঁকে ঘিরে থাকে। এই সন্দেহবাতিক থেকেই শুরু হয়েছে তাঁর এক ধরনের পাগলামি, এক এক সময় ভাঙতে শুরু করেন জিনিসপত্র, সে রকম অবস্থা আমিও দেখেছি। মেরি নিঃসন্তান নন, ওদের দুটি মেয়ে আছে, বেশ বড়, প্রথমটি থাকে অনেক দূরের কোনও শহরে, যোগাযোগ নেই-ই বলতে গেলে। ছোট মেয়েটি যেমন রূপসী, তেমনই দুরন্ত, তার সম্পর্কে লোকমুখে শুনেছি সে ঘন ঘন পোশাক পরিবর্তনের মতন বয়ফ্রেন্ড বদল করে। তার অন্য একটি শখ ঘোড়ায় চড়া, নিজস্ব তিনটি ঘোড়া আছে, বাড়িতে প্রায় থাকেই না, মাঝে মাঝে শুধু বাবার সঙ্গে দেখা করে টাকা চাইবার জন্য। বাবার কাছ থেকে সে টাকা ধার নেয়, কোনও এক সময় শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অর্থাৎ মা হয়েও মাতৃ সম্বোধন অনেকদিন শোনেননি মেরি।
প্রায়ই দেখতাম, মেরির মুখখানি গভীর বিষাদ মাখা। কথা বলেন টেনে টেনে, শব্দগুলি জড়ানো। বুঝতে আমার বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল যে মেরির ওই ধরনের জড়ানো কণ্ঠস্বরের কারণ, তিনি প্রায়ই সকাল থেকে জিন পান শুরু করেন। পল টানা কয়েকদিন বাইরে থাকলে মেরির এই মদ্যপান বেড়ে যায়, কয়েকবার তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন শুনেছি। আমার সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক হল, তা কিন্তু বাৎসল্যের নয়, বন্ধুর মতন, আমাকে ডেকে রান্না করে খাওয়াবার সময় তিনি শোনাতেন পলের সঙ্গে তাঁর সুখের দিনের নানান গল্প, কখনও রান্না বন্ধ করে হাপুস নয়নে কাঁদতে বসতেন, পুড়ে কালো হয়ে যেত মাংস। আবার কখনও উচ্ছল হয়ে উঠতেন হাস্যপরিহাসে। প্রতিবার বিদায় নেবার সময় তিনি আমাকে সামনা-সামনি জড়িয়ে ধরে চুম্বন দিতেন ঠোঁটে, একবারই মাত্র। কয়েক মাস পরে যখন আমার নিজস্ব বান্ধবী হয়, যার সঙ্গে সন্ধ্যাযাপনে আমার আগ্রহ অনেক বেশি, তখনও কোনও সন্ধ্যায় মেরি আমাকে টেলিফোনে ডাকাডাকি করলে আমি না গিয়ে পারতাম না। সেই ঝলমলে ফরাসি তরুণীর সাহচর্য ছেড়ে আমি কেন এক কুরূপা প্রৌঢ়ার সঙ্গে সময় কাটাতে রাজি হতাম, তার কোনও ব্যাখা দেওয়া যায় না। পলের অনুপস্থিতিতে সেটা একটা নিরানন্দ বাড়ি, মেরির সঙ্গে আমার বয়সের অনেক তফাত, আমি তেমন বাক্যবাগীশও নই, মেরি একাই কথা বলে, আমি হুঁ হুঁ করা নীরব শ্রোতা, এক এক সময় কেউ কোনও কথাই বলি না, ঘরটা আধো অন্ধকার, কোনও শব্দই নেই। এটা খুব আশ্চর্যের কথা যে, ও বাড়িতে আমি কদাচিৎ কোনও আমেরিকান ছেলেকে দেখেছি, বিদেশিদের মধ্যেও আমিই একমাত্র নিয়মিত অতিথি। পলও আমার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতেন বলে অন্য কয়েকজনের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলাম আমি।
সেই প্রথম দিনটিতে মেরির সঙ্গে আমার সহজ সম্পর্ক দেখে পল খুব স্বস্তি বোধ করেছিলেন। প্রাতরাশের পরই তিনি আমাকে নিয়ে চলে গেলেন জঙ্গলে। সেখানে কাঠ কাটতে হবে, ফায়ারপ্লেসের জন্য। এর মধ্যে ফায়ারপ্লেস অপ্রচলিতই হয়ে গেছে বলতে গেলে, সব জায়গায় সেন্ট্রাল হিটিং, অনেক বাড়িতে সাজানো ফায়ার প্লেসে নকল আগুন জ্বলে। আসল ফায়ারপ্লেসে কাঠ জোগান দেওয়া ও চিমনি পরিষ্কার করার অনেক ঝামেলা। কিন্তু পলের এই পুরনো ধরনের বাড়িটিতে এখনও ফায়ারপ্লেস বজায় রেখেছেন। আমি জীবনে কখনও নবকুমারের মতন জঙ্গলে কাষ্ঠাহরণে যাইনি, এই ইংরেজির অধ্যাপক ও কবিটির কাঠুরের ভূমিকার উদ্যম দেখে আমি হতবাক। গায়ের জামা খুলে ফেলে তিনি একটা আস্ত শুকনো গাছকে পেড়ে ফেললেন কিছুক্ষণের মধ্যে। সাধারণ করাতের বদলে ইলেকট্রিক করাত, সেটি বিষম ভারী, একটু এদিক-ওদিক হলে হাত-পা উড়ে যেতে পারে। আমার ভূমিকা টুকরো করা ডালগুলিকে গুছিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে তোলা। তাতেও পরিশ্রম কম নয়। দু’দিন আগেও যে কলকাতার কফি হাউসে হসন্তকে আধ মাত্রা না এক মাত্রা ধরা হবে সেই তর্কে টেবিল ফাটিয়েছে, সে এখন আমেরিকার জঙ্গলে এক কাঠুরের সহকারী। এই কাষ্ঠবহনের স্মৃতি আমার বিশেষভাবে মনে থাকার একটা কারণ আছে। ওই বাড়িটিতে আমি পরে আরও কয়েকবার গেছি, আমি থাকতে থাকতেই খবর জানা গেল, ফায়ারপ্লেসের আগুন থেকেই কোনওক্রমে আগুন ছড়িয়ে এমন চমৎকার প্রাসাদটি একেবারে ভস্মসাৎ হয়ে যায়। শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল। সে সময় বাড়িতে কেউ ছিল না।
মেরি মাঝে মাঝেই ও বাড়িতে একলা থাকতেন। ওই অগ্নিকাণ্ড ছাড়াও আর একবার তাঁর খুব বিপদের সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। সে সময় ‘ডেসপারেট আওয়ার্স’ নামে একটি আমেরিকান ফিল্ম খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। দারুণ উত্তেজনার ছবি। তিনজন কুখ্যাত খুনি আসামি জেল থেকে পালিয়ে এক গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে বসে থাকে। সে বাড়িতে বাবা, মা, একটি তরুণী মেয়ে ও স্কুল বয়সি ছেলে থাকে। ডাকাতরা সেখানে ঢুকে বলে যে তারা খাবে, থাকবে, কোনও ক্ষতি করবে না, বাবা অফিস যেতে পারে, মেয়ে ও ছেলে যেতে পারে কলেজ-স্কুলে, কিন্তু কারওকে কিছু বলতে পারবে না, যদি পুলিশ নিয়ে আসার চেষ্টা করে তা হলে প্রথমেই মাকে খুন করা হবে। পরিস্থিতি এমনই যেন এর কোনও সমাধান নেই। সিনেমার গল্পে অবশ্য একটা শেষ সমাধান থাকেই। ঠিক সে রকমই একটা বাস্তব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল এখানে। কাছাকাছি জেলখানা থেকে পালিয়েছে তিনটি কয়েদি, তারা লুকিয়েছে জঙ্গলে, যে-কোনও সময়ে যে-কোনও বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়তে পারে। পুলিশ থেকে অনবরত সাবধান করে দেওয়া হতে থাকে রেডিয়ো মারফত। পরের দিনই মেরি জানলা দিয়ে দেখতে পায় এ বাড়ির সামনের বাগানে সেই তিন খুনিকে। দরজা ভেঙে ঢোকা তাদের পক্ষে খুবই সহজ। তারা এসেছিল এ বাড়িতেই ঢোকার জন্য, একেবারে শেষ মুহূর্তে হঠাৎ পুলিশের গাড়িও পৌঁছে যায়।
এ কাহিনী শুনে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এর পরেও তুমি একা এ বাড়িতে থাকতে সাহস করো? আমার প্রশ্ন শুনে মেরি ও পল দুজনেই উচ্চহাস্য করেছিল। আমেরিকানদের ভয় জিনিসটা খুব কম বলেই তো তারা ব্যবহারিক জীবনে এত উন্নতি করেছে। এত ডিভোর্সি মেয়ে একা থাকে, মাঝে মাঝে তাদের দু’-একজন খুন হয় বা ধর্ষিতা হয়, তবু তারা একা থাকার জেদ ছাড়ে না।
দু’দিন পরে পল আমাকে ফিরিয়ে আনলেন আয়ওয়া শহরে আমার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। এটা আমার নিজের সংসার। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পলের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছিল। বিদেশি অতিথিরা অনেকেই রান্নাবান্নার ঝামেলায় যায় না, শহরে অনেক রকম রেস্তোরাঁ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে খেয়ে নিতে পারে। কিন্তু আমাকে পয়সা বাঁচিয়ে দেশে পাঠাতে হবে। নিজের রান্নার চেয়ে সস্তা আর কিছু হতে পারে না। রান্না করতে আমি ভয়ও পাই না, আমি কবিতা রচনা করলেও কবি-কবি তো নই। কিন্তু রান্না করতে গেলে হাঁড়ি-কুড়ি, হাতা-খুন্তি লাগে। চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজের দোকানও চিনতে হবে। পল বললেন, ঘর-গেরস্থালির জিনিস মেয়েরাই ভালো চিনতে পারে। আমি একটি মেয়েকে পাঠাচ্ছি, সে তোমাকে সাহায্য করবে। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, বাসন মাজার সাবান কিনতেও ভুল করো না।
বিকেলের দিকে পলের নির্দেশে একটি আমেরিকান যুবতী এল আমার সঙ্গে দেখা করতে, সুশ্রী ও সমবয়সি, বেশ চটপটে, তার নাম ডোরি ক্যাটজ। সে প্রথমেই আমার অ্যাপার্টমেন্টের আনাচকানাচে ঘুরে দেখল, আমার কী কী দরকার। তালিকা লিখে নিল কাগজে, এমনভাবে, যেন এই কাজ সে আগেও অনেকবার করেছে। তারপর বলল, চলো।
সুপার মার্কেটে সবই পাওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন সুপার মার্কেটে এক একটি বিশেষ দ্রব্য সস্তা কিংবা তুলনামূলকভাবে উত্তম। ঘুরে ঘুরে কেনা গেল সব কিছু। ব্যাঙ্কে আমার নামে অগ্রিম পাঁচশো ডলার জমা পড়েছে, সুতরাং দিলদরিয়া হতে বাধা নেই। এই ভদ্রতাটুকু শেখার দরকার হয় না যে ডোরি ক্যাটজ আমার জন্য এতখানি সময় ও উদ্যম ব্যয় করার পর তাঁকে কোনও রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব আমার অবশ্যই দেওয়া উচিত। সে প্রস্তাব দিতেই সে গ্রহণ করল এবং অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দিতে দিতে এক নিরিবিলি রেস্তোরাঁয় পান-ভোজন করা গেল। ফেরার পথে ডোরির বাড়িই আগে পড়ে। আমি তার অঙ্গ স্পর্শ না করে বললাম, শুভরাত্রি।
ডোরি কয়েক পলক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল, ওহে মহান ভারতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী যুবক, তুমি এদেশে কোনও যুবতীর সঙ্গে যদি বিকেল থেকে এক সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাটাও, দোকানে যাও, রেস্তোরাঁয় ডিনার খাও, তারপর বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় তাকে একটা চুমু খেতে হয়। এবং আবার কবে দেখা হবে জিজ্ঞেস না করলে সে অপমানিত বোধ করে। এসব শিখে নাও।
এবং শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে সে সিঁড়ি থেকে দু’তিন ধাপ নেমে এসে, আমার থুতনিটি এক আঙুলে ধরে ওষ্ঠ চুম্বন করল। এই প্রথম এক শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে আমার ওষ্ঠ স্পর্শ। চুম্বনের অভিজ্ঞতা আমার আগেই দেশে হয়ে গেছে কয়েকবার, ওই ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গিনী-অশ্বেতাঙ্গিনীর ওষ্ঠ-স্বাদে তো কিছু তফাত দেখা গেল না। একই রকম। তবে, এর আগে কোনও মেয়ে আমার থুতনি ধরে নিজে এগিয়ে আসেনি, দেশে উদ্যোগ নিতে হয় পুরুষদেরই। সেই অবস্থায় আমি ডোরিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোতাপাখির মতন, আবার কবে দেখা হবে? সে বলল, টেলিফোন করব।
এই ডোরি কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার বান্ধবী হল না। দু’দিন পরে সে আর একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরবেলা এল আমার খোঁজখবর নিতে। দ্বিতীয় মেয়েটি ফরাসি, সে ফ্রান্স থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এখানে এসেছে পিএইচ ডি করতে। সে আগে কোনও ভারতীয় কবি দেখেনি, তাই ডোরির সঙ্গে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনও ভারতীয় দেখেনি? ডোরি বলল, না, তা নয়, সে ভারতীয় কবি দেখেনি। তার নাম মার্গারিট ম্যাথিউ। আমি ওদের বিয়ারের ক্যান খুলে অভ্যর্থনা জানালাম, কিন্তু মার্গারিট নামে মেয়েটি প্রায় চুপ করেই রইল সর্বক্ষণ। কথাবার্তা চালাল ডোরি।
পরের দিন দুপুরে আমার দরজায় আবার ঠুকঠুক শব্দ। খুলেই দেখি, মার্গারিট নামে মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে। নরম উচ্চারণের ইংরেজিতে প্রচুর ক্ষমা চেয়ে সে বলল, আগের দিন সে একটা বই ফেলে গেছে ভুল করে, সে জন্যই সে আমাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হয়েছে ইত্যাদি। সে ভেতরে আসার পর রয়ে গেল চার-পাঁচ ঘণ্টা, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, তার সঙ্গে যেন আমার জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধুত্ব।
কয়েকদিন পর মার্গারিট দুষ্টুমির হাস্য দিয়ে জানিয়েছিল, সে তার বইটি আমার ঘরে ফেলে গিয়েছিল ইচ্ছে করে, যাতে আমার কাছে একা আসার একটা ছুতো পাওয়া যায়।
আটত্রিশ
ইংরেজরা বলে মার্গারেট, ফরাসিতে মার্গারিট, স্প্যানিশে মার্গারিটা। ফরাসি দেশের গ্রামের মেয়ে মার্গারিট ম্যাথিউ ফরাসি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে আমেরিকা এসেছে কেন? যে-কারণে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে ফরাসি দেশে গিয়েছিলেন, বাংলা নাটক নিয়ে গবেষণা করতে কেউ কেউ বিলেতে যায়, এমনকী আমিও বাংলা কবিতার সংকলনের উদ্দেশ্যে আমেরিকায় এসেছি একই কারণে, স্কলারশিপ পাওয়া যায়। আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন বেশ কিছু ভারতীয় তথা বাঙালি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপের বদলে আমেরিকা ও কানাডার দিকে এ দেশ থেকে দলে দলে ছাত্র, গবেষক ও চাকুরি প্রার্থীরা যেতে শুরু করে। ইউরোপ তখন রক্তাল্পতায় ভুগছে, বহিরাগতদের সম্পর্কে কড়াকড়ি শুরু করেছে, উত্তর আমেরিকায় টাকা ও সুযোগ-সুবিধে অনেক বেশি। ইউরোপের মধ্যে একমাত্র যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জার্মানিতে পুরুষের সংখ্যা এতই কমে গিয়েছিল যে সব ধরনের বহিরাগত কর্মক্ষম ব্যক্তিদের জন্য দরজা খুলে সাদর আহ্বান জানাত। এই জন্যই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতেই আমাদের দেশের যুবকরা গেছে বেশি। কিন্তু উত্তর আমেরিকায় উন্নতির পথ অনেক বেশি প্রশস্ত বলে জার্মানি থেকে, ইংল্যান্ড থেকেও বাঙালিদের ঢল নামে সেদিকে। আমি যখন যাই, তখনও সেই ঢল তেমনভাবে নামেনি, সবে শুরু হয়েছে মাত্র। সেই জন্যই আমেরিকায় বাঙালির সংখ্যা তখন তেমন কিছু ছিল না। এদিকে বাংলা ভাগ হবার জন্য পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যা বেশি, চরিত্রেও তারা অনেক বেশি উদ্যমী ও বেপরোয়া, ভাগ্যানুসন্ধানে তারা ঝুঁকি নিয়েও দেশত্যাগ করতে দ্বিধা করে না, তাই বিদেশে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানিরা কয়েক গুণ সংখ্যাগরিষ্ঠ। আয়ওয়া শহরেও পশ্চিম বাংলার বাঙালির সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়, পূর্ব পাকিস্তানিরা বেশ দলে ভারী, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন, শিল্প-সাহিত্য এবং ভাব বিনিময়ের সব পথ রুদ্ধ, পঁয়ষট্টি সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের নির্বোধ যুদ্ধ হবে, তারই যেন মানসিক মহড়া চলছে। আয়ওয়াতে পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গেই মেলামেশা করে, বাংলা ভাষার সূত্রে তারা আমাদের আত্মীয় মনে করে না, তাদের গান বাজনার আসর বা উৎসবে আমাদের আমন্ত্রণ জানায় না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে (আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচালনায় ছ’পৃষ্ঠার রীতিমতো একটি দৈনিক সংবাদপত্র বেরোয় এবং সেটা আমি পাই বিনামূল্যে, তাতে নানারকম উৎসব-অনুষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি থাকে) আমি পাকিস্তানিদের ইকবাল জয়ন্তী সভায় গেলাম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, সেখানে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে কয়েকজন শুকনো ভদ্রতা দেখিয়েছিল ঠিকই, কেউ সাদর অভ্যর্থনা জানায়নি। লক্ষ করলাম, পূর্ব পাকিস্তানের ছেলেরা দিব্যি উর্দু বলছে, কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিও বলতে পারে ভাঙা ভাঙা বাংলা। মনে হতেই পারে যে, দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাসমস্যা মিটে গেছে। গান হল উর্দু ও বাংলায়। তবে সভা পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি, ভারী সুদর্শন একটি যুবক, সে শুধু ইংরেজি বলে। বক্তৃতা শুনতে শুনতে আমি গুনছিলাম, শ্রোতার সংখ্যা ক’জন। সঠিক বলতে গেলে, পঁয়ত্রিশ এবং এক। আমি অতিরিক্ত। জনচারেক লালফর্সা ছেলেমেয়েও ছিল, আমার তুলনায় তারাও যেন ওদের বেশি আপন। ফেরার সময় বুকটা হু-হু করছিল।
বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য ব্যাকুলতায় আমি প্রথম কিছুদিন বাংলাভাষীদের খোঁজাখুঁজি করেছি, মাসখানেক পরেই সে ঝোঁকটা চলে গেল। মনের মতন কোনও সঙ্গী না পেলে শুধু বাংলায় ভ্যাজর ভ্যাজর করেই বা কী লাভ! পরবর্তীকালের খ্যাতিমতী লেখিকা ভারতী মুখার্জি সে সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন, তাঁর সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু ভারতী উত্তর ভারতের কোথাও আবাল্য পরিবর্ধিত, তাই বাংলা ভালো জানতেন না, বাংলা সাহিত্য তাঁর চিন্তাজগতে স্থান পায়নি।
আমার প্রতিদিনের সঙ্গিনী হয়ে উঠল মার্গারিট নামের মেয়েটি। এমন কবিতা-পাগল নারী বা পুরুষ আমি আগে আর দেখিনি। তার জীবন-যাপনের সব কিছুই কবিতার ঝংকার ও সৌরভময়। বৃষ্টি পড়লে সে কবিতা বলে, ঝড় উঠলে কবিতা বলে, রোদুর দেখলে কবিতা বলে, পয়সা ফুরিয়ে গেলে তা নিয়েও কোনও কবিতা মুখস্থ বলে সে মজা খুঁজে পায়। অথচ নিজে সে লেখে না। তার মতে, পৃথিবীর সমস্ত কবিরা যা লিখে গেছেন ও লিখছেন, সেই সম্পদের উত্তরাধিকারিণী হওয়াই তার জীবনের সার্থকতা।
কয়েকদিন পরেই মার্গারিটকে কোনও বিদেশিনী বা ফরাসিভাষী বলে মনেই হয় না, সে পৃথিবীর যে-কোনও দেশেরই একটি পাগলী মেয়ে হতে পারে। মাথা ভর্তি হুড়ো-কুড়ো চুল, ভালো করে আঁচড়ায় না। পোশাকের কোনও যত্ন নেই, কবিতার আলোচনা শুরু করলে সে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। এমনও হয়েছে, আমি খিচুড়ি চাপিয়েছি, মার্গারিট পড়তে শুরু করল গিয়ম আপলেনিয়ারের বিসতেয়ার নামে পশু-পাখি বিষয়ক ছোট ছোট কবিতা। একটার পর একটা, আগেরটার চেয়ে পরেরটা বেশি ভালো, শোনো, শোনো, এইটা শোনো, এটা প্রজাপতি আর কবি বিষয়ে। এর মধ্যে আমার ডেকচি ভর্তি খিচুড়ি পুড়ে ঝিরকুট্টি কালো হয়ে গেল।
আগে কয়েক জায়গায় লিখেছি, তবু এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করি, গিয়ম আপলেনিয়ারের সূত্রেই তার সঙ্গে আমার প্রথম সখ্য হয়। ওই কবির একটি কবিতায় শকুন্তলার নামের উল্লেখ আছে, তাই সে আমার কাছে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুরো কাহিনীটি শুনতে চেয়েছিল। সংক্ষেপে নয়, সবিস্তারে। তার বিনিময়ে সে আমাকে আপলেনিয়ারের সমগ্র জীবন ও কাব্যকীর্তির কথা জানিয়ে দিল। আমি বাঙালি শুনে সে খুঁজে খুঁজে বার করল, ফরাসি কবিতায় কোথায় কোথায় বাংলা বা বাঙালির উল্লেখ আছে। (অন্তত তিনটি উল্লেখ আমার মনে আছে এখনও।)
মার্গারিট থাকে হস্টেলে, আমার নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছুটা দূরে। মেয়েদের হস্টেলের অভ্যন্তরে ছেলেদের যাওয়ার নিষেধ নেই, রাত দুটো পর্যন্ত সেখানে ছেলেদের থাকার অধিকার আছে। বাকি রাতটুকুর জন্যই বা বাধা থাকে কেন? তাই কিছুদিন পরেই ছেলে ও মেয়েদের হস্টেল একই হয়ে গেল। ছাত্র ও ছাত্রীরা পাশাপাশি ঘরে কিংবা একই ঘরে ভাগাভাগি করে থাকতে পারে। তারা সহবাস করবে কি না, সেটা তাদের ব্যক্তিগত রুচি ও নির্বাচনের ব্যাপার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই নৈতিকতা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। পড়াশুনোয় গাফিলতি না হলেই হল। মার্গারিটের ঘরে আর একটি মেয়ে থাকে, আমি কখনও গেলে সে মেয়েটি কিছু একটা ছুতো করে চলে যায় বাইরে। তাতে আমার খুবই অস্বস্তি বোধ হয়। এর চেয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আড্ডা দেওয়াই তো ভালো। ক্রমশ শুধু আড্ডা নয়, আমরা এক সঙ্গে রান্নাবান্নাও শুরু করে দিলাম। খিচুড়ি মার্গারিটের খুব প্রিয়, ও আমাকে ফরাসি রান্না শে খায়। ডিমের কুসুম ফেটিয়ে ফোঁটা ফোঁটা তেল দিয়ে মাইওনেজ বানাতে আমি দক্ষ হয়ে গেলাম অল্প দিনে। আমি মাশরুম কখনও খাইনি আগে। এবং ব্যাঙের ঠ্যাং ভাজা। ছোটবেলা থেকে আমাদের ধারণা, চিনেরা আরশোলা ভালোবাসে, আর ফরাসিরা ব্যাঙ খেকো। পরবর্তীকালে আমি চিনদেশে গিয়ে কোথাও আরশোলার চর্চা দেখিনি, বরং সাপের মাংস সুলভ। আর মার্গারিট খাস ফরাসিদেশের মেয়ে হয়েও কখনও ব্যাঙ খায়নি। বড় বড় হোটেলে, প্যারিসে, পরিবেশন করা হয়, সে শুনেছে মাত্র। এখানে সুপার মার্কেটে ব্যাঙের পা পাওয়া যায়, একদিন মাখন দিয়ে ভেজে খেতে দিব্যি লাগল।
মার্গারিটের মুখখানা করুণ হয়ে যেত, যে-সব সন্ধেবেলা আমি ওকে একা ফেলে রেখে মেরি কিংবা পল এঙ্গেলের আহ্বানে চলে যেতাম। আমাকে যেতেই হত।
গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে মার্গারিটকে পড়াতেও হয়। ওর ক্লাস ভোরবেলা। আমার বরাবরই বেশি রাতে ঘুমোন আর বেলা করে ওঠা অভ্যেস। একদিন খুব ভোরে টেলিফোন বেজে উঠল। মার্গারিট দারুণ উত্তেজিতভাবে বলল, এখনও ঘুমোচ্ছ? শিগগির উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাও। সরিয়ে দাও সব পর্দা। আমি সা’ড়ে নটার মধ্যে চলে আসছি।
আমার ঘরটিতে তিনখানা বড় বড় জানলা। বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই একটা গ্যাস স্টেশান, (পেট্রোল পাম্প) সেখানে সারা রাত আলো জ্বলে এবং অনবরত গাড়ি আসে, তাই রাত্তিরে সব পর্দা টেনে রাখতে হয়। বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে পর্দা সরিয়ে দেখলাম এক অপরূপ মায়াময় দৃশ্য। আকাশ থেকে দুলতে দুলতে নামছে অসংখ্য সাদা পালক। বছরের প্রথম তুষারপাত। জলের নিজস্ব একটা রং আছে, তার ঠিক বর্ণনা হয় না। তাকে জলরং বলাই ভালো। কিন্তু একটু দানা বাঁধতে শুরু করলেই সাদা রং হতে থাকে। বৃষ্টির রং সাদা নয়, কিন্তু তুষার অতি শুভ্র। আর তুষারপাতের সময় সব দিক যেন বড় বেশি নিস্তব্ধ হয়ে যায়, গাড়ি চলাচলের আওয়াজও শোনা যায় না।
জীবনে প্রথম তুষারপাত দর্শনে বিস্ময়কর উত্তেজনাবোধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। আমার অবশ্য এবারেই প্রথম নয়। বয়েজ স্কাউটদের সঙ্গে কাশ্মীরে গিয়ে সোনমার্গে হঠাৎ তুষারবর্ষণ দেখেছিলাম, তা অবশ্য মিনিট দশেকের জন্য, তখন আমরা একটা উন্মুক্ত স্থানে ছিলাম। এখানে পড়ছে তো পড়ছেই, ক্রমশ রাস্তা-ঘাট সাদা হয়ে গেল, সমস্ত বাড়ির ছাদ ধবল বর্ণ, পত্রহীন গাছগুলিতে থোকা থোকা ফুলের মতন আটকে রইল বরফ। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম জানলার ধারে।
মার্গারিট তো প্রতি বছরই বরফ দেখে। তবু ঠিক সাড়ে ন’টায় এসে বই-খাতা খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে সে শরীর-ভরা চাঞ্চল্য নিয়ে বলল, বছরের প্রথম দিন স্নো পড়ছে, আর তুমি চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে? চলো, আমরা সেলিব্রেট করি। জুতো পরে নাও, জুতো পরে নাও! তারপরই সে বলতে লাগল পল ভের্লেনের একটি কবিতা।
এরপর অনেকক্ষণ আমরা ঘুরলাম পথে পথে। ক্ষীণতনু আয়ওয়া নদীর পাশ দিয়ে, অজস্র ফুলবাগান পেরিয়ে, ছোট ছোট টিলায় উঠে। পেঁজা তুলোর মতন তুষার গায়ে মাথায় পড়লেও পোশাক ভেজে না, বৃষ্টির সঙ্গে এই একটা বড় তফাত। প্রথম তুষারপাত উদ্যাপন করতে আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে এসেছে পথে, দুপুর হতে না-হতেই পাবগুলি ভর্তি, অন্য দিন এ সময় খালি থাকে, একসময় আমরাও বসলাম রাস্তার ধারের একটা পাবে। তুষারপাতের সময় শীত কমে যায়, সবাই বড় বড় জাগে বিয়ার পান করছে। মার্গারিট বিশুদ্ধ ফরাসি ওয়াইন ছাড়া অন্য কোনও অ্যালকোহলিক পানীয় ছোঁয় না, সে বস্তু এখানে বেশ দামি, তবু অর্ডার দেওয়া হল এক বোতল।
আমার ক্লাস করতে যাওয়ার কথা দুপুরবেলা। রাইটার্স ওয়ার্কশপ ইংরেজি এম এ বিভাগের অন্তর্গত। আমাকে এখানে ছাত্র হতে হয়েছে। পল এঙ্গেল অবশ্য প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলেন, আমার ক্লাস করা বাধ্যতামূলক নয়, অন্য লেখকদের সঙ্গে মেলামেশা, চিন্তার আদানপ্রদান, নিজের লেখালেখিই আসল কাজ। এতদিন পর আবার ছাত্র হতে আমার অস্বস্তিবোধ ছিলই, তবু প্রথম কয়েক মাস আমি ইংরেজি বিভাগের বিভিন্ন ক্লাসে হাজিরা দিয়েছি, এখানকার পড়াশুনোর পদ্ধতিটা বোঝার জন্য। প্রথমেই ভালো লেগেছিল, এখানে সিলেবাসের কড়াকড়ি নেই দেখে। অধ্যাপক ক্লাসে এসে একটা বই দেখিয়ে বললেন, গ্রেগরি করসো’র এই কবিতার বইটা এক মাস আগে বেরিয়েছে। তোমরা কেউ পড়েছ নাকি? আমি কয়েকটা লেখা পড়ে শোনাচ্ছি, দেখো তো এগুলো কবিতা পদবাচ্য কি না! তারপর সারাক্ষণ সেই বইটি নিয়েই আলোচনা চলল, দু’একটি ছাত্র-ছাত্রী কড়া সমালোচনা শোনাতেও ছাড়ল না। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস ফাঁকি দেওয়া বা না-দেওয়া নিয়ে মাথাব্যথা নেই, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন খুব বেশি, অধিকাংশ ছেলেমেয়েকেই নিজের পড়ার খরচ নিজেই উপার্জন করতে হয়। রেজাল্ট ভালো না হলে তারই কষ্টার্জিত অর্থ নষ্ট হবে। আর যে অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়ে পারিবারিক টাকাপয়সায় পড়াশুনো চালায়, তারাও জানে, একবার ব্যর্থ হলে আর কিছু পাওয়া যাবে না। খুব মেধাবী না হলে ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার দিকেই যায় না। আমাদের দেশে যেমন বি এ পাস করার পর কিছুই করার নেই, চাকরিও পাওয়া যাচ্ছে না, তাই দলে দলে ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়ে যায় এম এ ক্লাসে। ওদেশে স্কুল ছাড়লেই চাকরির অনেক সুযোগ, বিশেষত সেই ষাটের দশকে আমেরিকার অবস্থা খুবই ভালো। যে হেতু একজন ট্রাক ড্রাইভারের উপার্জন একজন অধ্যাপকের চেয়ে অনেক বেশি, সেই জন্য বেশির ভাগ ছাত্রই আর কষ্ট করে এম এ-টেম এ পড়তে চায় না।
আমার মতন যে সব বিদেশিকে পল এঙ্গেল এনেছেন, তাদের সংখ্যা আট-দশ জন। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার ঠাণ্ডা লড়াই চালু থাকলেও পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া থেকে কবিদের আসতে অসুবিধে হয়নি। খোদ রাশিয়া থেকেও ভজনেসেনস্কি নামে সেই সময়কার খ্যাতনামা তরুণ কবিরও আমাদের সঙ্গে যোগদান করার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে কোনও কারণে সেটা বানচাল হয়ে যায়। বিভিন্ন ভাষার কবিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ও তাদের কাব্যপাঠ শুনে, মোটামুটি বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে খসড়া ধারণা হয়। তাতে একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, বেশির ভাগ ভাষার কবিতায় লিরিক বর্জন করা হয়েছে, কবিতার ভাষা চলে আসছে গদ্যের কাছাকাছি। অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতায় সেটা আগেই দেখেছি। উপন্যাসের অভ্যুত্থান এবং সংবাদপত্রের বহুল প্রচার শুরু হতে কবিতা অনেকখানি সরে যায়, কবিতা থেকে বর্জিত হয় কাহিনীর আভাস। সরে যেতে যেতে কবিতা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ বিমূর্ত, প্রসঙ্গহীন। আমরা সেই পর্যন্তই জেনে এসেছি, কিন্তু চিত্রশিল্প যেমন চুড়ান্ত বিমূর্ততায় পৌঁছে আবার যাত্রা শুরু করেছে উল্টোদিকে, ফিরে আসছে অবয়বে, সেইরকম কবিতাও তাল ঠুকতে আসছে গদ্যের কাছাকাছি, কবিতার মধ্যে একটা কাহিনীর আভাস কিংবা চরিত্রের উকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে সাবলীলভাবে। একটা দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। জিম সিমারমানের একটা কবিতার শুরু এই রকম:
Oops!
Well, as long as you Caught me at it,
You may as well Come in,
You are of Course in a poem
by the talented an acclaimed Poet,
Simmerman.
Now, now, No need for all that.
This way please.
ক্যাথি ক্যালাওয়ে নামে আর একজন কবির রচনার নমুনা :
Phillipe flew out of Paris, Cursing
in his black leather jacket
his one-eyed aviator glasses—
Chasing a Dutch Odalisque, his amazone
all the way to Sudan. He cried
Over the Nubian desert,
Sold her for kief and calvas
in the j’ ma of Khartoum (arguing Celine
with the Blue Nile dealer).
আমাদের বাংলা কবিতায় কিন্তু জীবনানন্দ-উত্তর পর্বেও শব্দঝংকারের দিকে ঝোঁক, ছন্দ-মিলের মধ্যে একটা সুরেলা ভাব এসেই যায় এবং উপমাও বেশি বেশি। প্রত্যেক কবিতায় যেন আর মতো থাকবেই। এখানে এসে আধুনিক ইংরেজি ও অন্য ভাষার কবিতাগুলি পড়তে পড়তে হয়তো আমার নিজের লেখাতেই কিছুটা বদল এসে গিয়েছিল।
কবিতা লিখতাম মাঝরাত্রে, মার্গারিট চলে যাবার পর। একটা মস্ত বড় স্ট্যান্ড ল্যাম্প জোগাড় করেছিলাম (কিনতে হয়নি। এখানে অনেকেই পুরনো আসবাবপত্র পথের মোড়ে রেখে দিয়ে যায়, ভাঙা-চুরো নয়, হয়তো ফ্যাশান বদলে গেছে এমন সব জিনিস, সেকেন্ড হ্যান্ড হিসেবে বিক্রিও হবে না। আমাদের মতন যারা ফ্যাশান নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা সেই বিনা পয়সার জিনিস ঘরে নিয়ে আসে)। স্ট্যান্ড ল্যাম্পটি খুবই সুদৃশ্য, ঘরের অন্য আলো নিভিয়ে দিলে একটা আলো-ছায়ার খেলা হয়, পাশে আমার টেবিলে, আর এক দিকে মানুষ-সমান কাচের জানলা। এই জানলা দিয়েই দেখা যায়, একটু দূরে ছোট্ট নদীটির দুধারের আলো। এতটুকু নদী, তবু তার ওপরে একশো-দু’শো গজ অন্তর অন্তর সেতু, আমি দেখতে পাই পাঁচটা, প্রত্যেকটি সেতুর গড়ন আলাদা আলাদা, এই সৌন্দর্যবোধ তারিফ করার মতন।
ঝিমঝিম করে রাত, আমার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়িও ছোটে অনবরত, আমি একটা-দুটো লাইন লিখি আর থমকে থাকি। যেন হারিয়ে ফেলেছি আত্মবিশ্বাস।
আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে।
দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পুরোহিত কঙ্কালের পাশাখেলা, প্রতি সন্ধেবেলা।
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে…
এইটুকু লিখেই মনে হয়, এটাকে কি কবিতা বলা যায়? গদ্যেরই তো মতন, গদ্যের সীমারেখা কি অতিক্রম করতে পেরেছে? সবটা কেটে বাদ দিতে উদ্যত হয়েও থেমে যাই, বুকের মধ্যে দোলাচল চলতে থাকে।
একদিন খবর পেলাম, সপরিবারে বুদ্ধদেব বসু এসেছেন ইন্ডিয়ানার ব্লুমিংটন শহরে। অতিথি অধ্যাপক হয়ে। ওঁর ছোট মেয়ে দময়ন্তী অর্থাৎ রুমি আগে থেকেই রয়েছে এদেশে, এবারে সঙ্গে এসেছেন প্রতিভা বসু এবং ওঁদের একমাত্র ছেলে শুদ্ধশীল অর্থাৎ পাপ্পা। এ সংবাদ পেয়েই আমার বুকের মধ্যে যেন আকুলি-বিকুলি করতে লাগল। এটা ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না যে কেন, এখানে সব রকম আরাম ও সম্ভোগের উপকরণ পেয়েও কেন এত তীব্র নিঃসঙ্গতাবোধ ঘোচে না! আমার তো মার্গারিটের মতন এত চমৎকার, সরল ও আন্তরিক এক বান্ধবী আছে, আরও অনেকেরই জুটে যায়, কিন্তু মার্গারিট যে সময়টা আমার কাছে থাকে না, আমি ওর কথা তখন ভাবি না, ভাবি কলকাতার কথা। ভাবনানেত্রে যেই কলকাতার দৃশ্য দেখতে পাই, অমনি বুকটা টন টন করে। কেন? কলকাতা আমাকে কী হাতিঘোড়া দিয়েছে? সেটা আমার জন্মস্থানও নয়। তবু কী যে এক অদৃশ্য বন্ধন রয়ে গেছে!
বুদ্ধদেব বসুদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ দেখা করার জন্য ব্যস্ততারই বা কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? ব্লুমিংটন খুব বেশি দূর নয়, বাসে চেপে খুব বেশি পয়সা খরচ না করেও যাওয়া যায়, ঠিক আছে, ধীরেসুস্থে গেলেই তো চলবে। তা নয়, এই শনিবারেই যাওয়া চাই। কেন? বাংলায় কথা বলার জন্য? বুদ্ধদেব বসুর সাহচর্য অবশ্যই কাম্য, প্রতিভা বসু সব সময়ই আমাদের মতন অর্বাচীনদেব সঙ্গে সস্নেহ ব্যবহার করেছেন আর পাপ্পাও সে সময় আমার খুব ভক্ত। একটা টেলিফোন করতেই আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম, আমি টিকিট কেটে চড়ে বসলাম ব্লুমিংটনের বাসে।
সেবারে প্রতিভা বসুর আপ্যায়ন, আদরযত্নে সেই নিঃসঙ্গতার ভাব ঘুচে গিয়েছিল একেবারে। বেশ মজা হয়েছিল ভাঁইফোঁটা নিয়ে। রুমি তার ভাই পাপ্পাকে ফোঁটা দেবে, আমরা সবাই গোল হয়ে দেখছি। নানা রকম রান্না ও মিষ্টান্নও প্রস্তুত, এই উপলক্ষে হবে ভোজ। বুদ্ধদেব বসু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সুনীল বাড়ি ছেড়ে এত দূরে রয়েছে, ওর বোনও নিশ্চয়ই ওর দাদার কথা ভাবছে, রুমিই ওকে ফোঁটা দিক না! প্রতিভা বসুও সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে আমাকে ডাকলেন কাছে। প্রস্তাবটি আমার মোটেই পছন্দ হল না, কিন্তু বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসু সম্পর্কে এমনই গভীর শ্রদ্ধা যে ওঁদের কথার প্রতিবাদ তো করতে পারি না! আসনে বসার পর, রুমি ফোঁটা দেওয়ার জন্য একটা আঙুলে ঘি মাখিয়ে (কিংবা মাখন) আমার কপালের সামনে এনেছে, তখন আমি কাতরভাবে বললাম, আমি ফোঁটা নিতে চাই না! প্রতিভা বসু বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ফোঁটা নিতে চাও না? কেন? আমি আরও কাতর গলায় জানালাম, আমি নিজের বোন ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও মেয়েকেই বোন বা বোনের মতনও মনে করি না! তা হলে আমি রুমির ভাই হব কী করে?
সে কথা শুনে বুদ্ধদেব বসুর সে কী প্রবল হাসি! দরজা-জানলা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।
আর একবার বুদ্ধদেব বসু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভাষা-সংস্কৃতি বিভাগে বক্তৃতা দিতে আসবেন, আমারও তা শুনতে যাওয়ার আগ্রহ। আমি আগে থেকে এসে উঠেছি সস্তার ইয়ুথ হস্টেলে। টেলিফোনে কথা হয়েছিল, বুদ্ধদেব আমাকে ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, সন্ধে সাতটায় সেখানে দেখা করতে। সেদিন বিকেল থেকেই তুষারঝড় বইছে। পায়ে অনেকখানি কানা উঁচু জুতো, হাতে দস্তানা ও মাথায় টুপি থাকলেও শরীরের যেটুকু অংশ খালি, সেখানে যেন সূচ ফুটছে অনবরত। নাকের ডগাটা ঢাকবার তো কোনও উপায় নেই!
ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পৌঁছলাম সে বাড়িতে। বেল বাজাবার পর যিনি দরজা খুললেন, তাঁকে চিনতে কোনও অসুবিধে হল না। অধ্যাপক স্টিফেন হে, কলকাতায় ছিলেন কয়েক মাস, একাধিকবার দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে, খুব সম্ভবত ব্রাহ্ম সমাজ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্ম সমাজ ও ধর্ম আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি আমাকে দেখে হাসলেন না, কী চাই গোছের প্রশ্নের ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে রইলেন। বুদ্ধদেব বসু আমাকে এখানে দেখা করতে বলেছেন শুনে তিনি আমাকে বাইরের বারান্দার একটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে বন্ধ করে দিলেন দরজা। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিলাম, বুদ্ধদেব বসু একটু পরেই বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে একটা খবর জানাবার জন্য ছটফট করছিলাম, সেদিনই বিকেলে শিকাগোর একটি বইয়ের দোকানের বাইরের দিকের শো-কেসে একটি নতুন বইয়ের মলাটে বাংলা অক্ষর দেখে দারুণ চমক লেগেছিল। বইটি এডোয়ার্ড ডিমকের ‘দা থিফ অফ লাভ’, অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের অনুবাদ।
বসে আছি তো বসেই আছি, কেউ আর বাইরে এল না, কেউ আমাকে ভেতরে যেতেও বলল না। হু হু বাতাসে ওভারকোটের মধ্যেও যেন জমে যাচ্ছে শরীর। শীত কাটাতে সিগারেটের পর সিগারেট টেনে যাচ্ছি অনবরত। এক সময় ছুরিকাঁটার টুং-টাং শুনে বোঝা গেল, ভেতরে বেশ কিছু লোক খেতে বসেছে এক সঙ্গে। ওয়াইন ঢালার আওয়াজ, হাস্যপরিহাস শুনতে পারছি স্পষ্ট, চিনতেও পারছি কয়েকটি কণ্ঠস্বর। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার। ভেতরে খাওয়াদাওয়া চলছে, আর অভুক্ত অবস্থায় আমাকে ঠাণ্ডার মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে বাইরে। আমেরিকান ভদ্রতার সঙ্গে এটা একেবারেই মেলে না। আমি একেবারে অজ্ঞাত কুলশীলও নই, ভিক্ষেটিক্ষেও চাইতে আসিনি। ক্রমশ রাগ বাড়তে লাগল, তক্ষুনি আমার স্থানত্যাগ করা উচিত, কিন্তু বুদ্ধদেব বসুকে কিছু না জানিয়ে যাই কী করে? রাগের সঙ্গে সঙ্গে আমার খিদেও বাড়ছে। কাছাকাছি কিছু লোক পানভোজন সারছেন, আর আমি পেটে কিল মেরে বসে আছি! (পরে প্রতিভা বসুর মুখে শুনেছিলাম, অনবদ্য মাছের রোস্ট ছিল!)
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদে সদলবলে বেরিয়ে এলেন বুদ্ধদেব বসু। আমাকে কাচুমাচু অবস্থায় বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হয়ে বললেন, তুমি কখন এলে? আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, তুমি বুঝি আর বাড়ি চিনতে পারলে না! আমি বাংলায় পুরো বৃত্তান্তটি জানাবার পর তিনি স্টিফেন হে’র সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। আবার ফিরে এসে বললেন, সবাই গাড়িতে উঠে পড়ো।
একজন আমেরিকান অধ্যাপকের কাছ থেকে এরকম অভদ্র ব্যবহার সত্যিই আশা করা যায় না। এরকম আচরণের কারণটিও অদ্ভুত। স্টিফেন হে আমাকে চিনতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু পছন্দ করেননি, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করলেও একালের বাঙালি তরুণ কবিদের ওপর তাঁর খুব রাগ। কলকাতায় তাঁর ফ্ল্যাটে এক সন্ধ্যার পার্টিতে কয়েকজন বাঙালি তরুণ কবি মদ্যপানের বাড়াবাড়ি করেছিল, একজন তার বসবার ঘরের বড় পর্দা ধরে দোল খেতে গিয়ে সবসুদ্ধ ছিড়ে ভূপাতিত হয়েছিল। আমি কিন্তু ছিলাম না সেই তরুণ কবিদের দলে, তবু উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে! একদিন এয়ারপোর্টে একজন দৈত্যাকার আমেরিকান অতি ব্যস্ততায় আমার পা মাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমা না চেয়ে চলে গিয়েছিল। তা বলে কি আমি যাবতীয় আমেরিকানকে সেই অভদ্র লোকটির সমান করে দেখব?
যাই হোক, সব কিছুরই একটা উল্টো দিক আছে। স্টিফেন হে’র এই আচরণের ফলে আবার দারুণ লাভও হয়েছিল অন্য দিক দিয়ে। সেদিন গাড়িতে উঠেই প্রতিভা বসু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু খেয়েছ, সুনীল? আমি লম্বা করে হা বললেও তিনি বিশ্বাস করলেন না। এইসব ব্যাপারে মেয়েদের বোধহয় অতিরিক্ত ইনস্টিংক্ট থাকে, তিনি উতলা হয়ে তার স্বামীকে, বললেন, আগে ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করো, আমরা সবাই এত খেয়েছি, ও একা না খেয়ে আছে—
এরপর আমরা গেলাম রাজেশ্বরী দত্তর অ্যাপার্টমেন্টে। বিখ্যাত গায়িকা এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্ত্রী রাজেশ্বরী আমাদের চোখে প্রায় স্বর্গের অপ্সরী। তিনি তখন শিকাগোতে কোনও চাকরি করছেন। সেখানে পৌঁছেই প্রতিভা বসু বললেন, রাজেশ্বরী, তুমি এই ছেলেটিকে কিছু খেতে দাও তো!
আমার কাছে চারমিনার সিগারেট দেখে রাজেশ্বরী স্মৃতিকাতর হয়ে কয়েকটা চেয়ে নিলেন, তারপর গল্প করতে করতে আধঘণ্টার মধ্যে রান্না করে ফেললেন, ভাত, ডাল, কিমার তরকারি আর বেগুনভাজা। একে তো গরম ডাল-ভাত, তার ওপরে রূপসী অপ্সরীর নিজের হাতের রান্না, সে স্বাদ কি জীবনে ভোলা যায়?
উনচল্লিশ
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি যেমন সুপুরুষ, তেমনই চলচ্চিত্রের নায়কোচিত তাঁর চালচলন। তাঁর স্ত্রী জাকলিনও খুব রূপসী, গণতন্ত্রে রাজা-রাজ্ঞীর কোনও স্থান নেই বটে, কিন্তু রাষ্ট্রপতির পত্নীকে ফার্স্ট লেডি আখ্যা দিয়ে প্রায় একটি রানির ভূমিকাই দেওয়া হয়। এঁদের মনে করা হত এক আদর্শ রোমান্টিক দম্পতি, যদিও কেনেডির মৃত্যুর কিছুকাল পরেই সাংবাদিক ও জীবনীলেখকরা নানান সূত্র থেকে চমকপ্রদ সব তথ্য খুঁজে বার করেছেন, স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কেনেডি সাহেব গোপনে দারুণ লাম্পট্যলীলা চালাতেন, হলিউড তথা সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের বুক কাঁপানো নায়িকা মেরিলিন মনরো পর্যন্ত এর মধ্যে জডিত ছিলেন। অনেক পরে, নব্বইয়ের দশকের শেষে আমেরিকার আর এক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন আর এক রকম যৌন ব্যভিচারের পর ধরা পড়ে গিয়ে নাকানি-চোবানি খান, কিন্তু জন কেনেডি জীবৎকালে ধরাটি পড়েননি, আদর্শ স্বামী ও সৎ নাগরিকের ভাবমূর্তিটি অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন।
ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক ঠাণ্ডা লড়াই তখন তুঙ্গে। বাড়ির পাশে কিউবাকে নিয়ে তখন আমেরিকার প্রধান শিরঃপীড়া! কমিউনিজমকে প্রায় জুজুর মতন গণ্য করা হয় আমেরিকার শিশুদের মধ্যে। অনেকেই প্রথম প্রথম ভেবেছিল ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লব বেশিদিন টিকবে না, কিউবা আবার আগের মতনই আমেরিকার প্রায় কলোনি হয়ে থাকবে। কিন্তু কাস্ত্রো দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলেন, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সমেত বিশ্বের সমস্ত বামপন্থী শক্তি কাস্ত্রোর সমর্থনে সঙঘবদ্ধ। কাস্ত্রোকে হত্যা করার অনেক চোরাগোপ্তা চেষ্টাও হয়েছে। একবার কোনও একটা উপলক্ষে কিউবার সরকারকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে আমেরিকা যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্রুশ্চেভের নির্দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও ধেয়ে আসে রণতরী। কয়েকটা দিন বিশ্ববাসী দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে, দু’দেশের যুদ্ধজাহাজগুলি মুখোমুখি হয়ে গোলাগুলি ছোঁড়া শুরু করলেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। প্রায় শেষ মুহূর্তে উভয়পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হয়, অস্ত্র সংবরণ করে জাহাজগুলি বিপরীত দিকে ফেরে।
আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দু’পক্ষের হাতেই তখন প্রচুর পারমাণবিক বোমা। সবগুলি বোমা একসঙ্গে ফাটলে পাঁচটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্যাপিটালিস্ট কিংবা সোশালিস্ট ব্লকের যে কোনও দিক থেকে পারমাণবিক বোমার আক্রমণ শুরু হলে অন্য পক্ষও তার প্রতি-আক্রমণে বাধ্য হবে। এই বিশ্বধ্বংসী অস্ত্রগুলি চালু করার চূড়ান্ত ক্ষমতা দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কদের হাতে। ষাটের দশকে এরকম আশঙ্কা বারবার উত্থাপিত হয়েছে। স্পেস অডিসি ২০০১ খ্যাত চলচ্চিত্রকার স্ট্যানলি কুবরিক সে সময় একটা সিনেমা তুলেছিলেন, সেটির নাম ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ লাভ’, যাতে দেখানো হয়েছিল, আমেরিকা কিংবা রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক কোনওদিন যদি মাতাল হয়ে নেশার ঝোঁকে কিংবা ভুল করে পরমাণু অস্ত্রের বোতাম টিপে আক্রমণ চালু করে দেয়, তা হলে কী হবে? সেটা একেবারে অসম্ভব ছিল না। ডেমোক্লিসের খগের মতন তখন সারা পৃথিবী ধ্বংসের মতন পারমাণবিক অস্ত্রের দণ্ডাজ্ঞা সত্যি সত্যি মাথার ওপর ঝুলে ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে ষাটের দশকের আমেরিকা খুবই সমৃদ্ধিশালী দেশ হলেও বর্ণবিদ্বেষের নানান অমানবিক ঘটনায় কলঙ্কিত। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অত্যাচারের নানান বীভৎস কাহিনী প্রকাশিত হত খবরের কাগজে। একটা সংবাদ ও ছবির কথা উল্লেখ করতে পারি। একটি নিগ্রো যুবককে কয়েকদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, পুলিশ শেষপর্যন্ত তার পচা-গলা লাশ উদ্ধার করে একটা জলাভূমি থেকে। সেই উদ্ধারকার্যের সময় কাছাকাছি একটা রেলিং-এ ভর দিয়ে দাড়িয়েছিল চারজন শ্বেতাঙ্গ যুবক, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে তারা অম্লানবদনে, চরম নির্লজ্জতার সঙ্গে বলেছিল, এই জলাশয়ে মাছের খাদ্য হিসেবে মাঝে মাঝে আমরা এক আধটা নিগারকে মেরে তার দেহটা জলে ছুঁড়ে দিই!
এই ঘটনা ঘটেছিল অ্যালাবামা রাজ্যে। আমেরিকার দক্ষিণের চারটি রাজ্যে তখন এরকম বর্ণবিদ্বেষ ও খুনোখুনি যেন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় কালো মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, অনেক স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কালো ছাত্রদের। এসব নিবারণ করার কোনও আইনও ছিল না, সিভিল রাইটস বিল পাস হয় আরও দু’বছর পরে, তার আগেই নিহত হয়েছিলেন কেনেডি। লড়াইটা প্রধানত আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে, (নিগ্রো শব্দটি তখন অনুচ্চাৰ্য, কিছুদিন শুধু ব্ল্যাকস বলা হত, এখন বলা হয় ব্ল্যাক আমেরিকান) কিন্তু এশিয়ার সব লোকজন, এমনকী জাপানিরাও (তারা তখনও বাণিজ্য দক্ষতায় সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলেনি) ওদের চোখে কালো। ভারতীয় সোসালিস্ট নেতা রামমনোহর লোহিয়া সে সময় আমেরিকা শহরে এসে দক্ষিণের একটি রাজ্যে এক রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে অপমানিত হয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, একদল এরকম কুৎসিত ব্যবহার করলেও এর প্রতিবাদও করে অন্য দল এবং তাদেরই সংখ্যা বেশি, তবু হঠাৎ হঠাৎ কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে যায়। রামমনোহর লোহিয়ার হেনস্থার খবর পড়ে আমি ঠিক করেছিলাম, দক্ষিণের মার্কামারা চারটি রাজ্যে কখনও বেড়াতে বা আমন্ত্রণ পেলেও যাব না।
আমাকে কখনও বর্ণবিদ্বেষ জনিত অপমান সরাসরি সহ্য করতে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা অন্য দেশ থেকে আগত লেখক-লেখিকাদের মধ্যে এরকম মনোভাব আশাই করা যায় না। তবে কারও কারও ব্যবহারে বেশি বেশি বন্ধুত্বের ভাব কৃত্রিম মনে হয়েছে। ট্রেনে কিংবা দূরপাল্লার বাসে দু’-একজন লোকের দৃষ্টিতে যেমন বিরাগভাব দেখেছি, কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলেনি, তাই অভিযোগ করা যায় না। আয়ওয়া শহরে একটি বিদুষী কৃষ্ণাঙ্গিনীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার সঙ্গে কেউ কি খারাপ ব্যবহার করে, তুমি কি বর্ণান্ধতার শিকার হয়েছ কখনও? সে বলেছিল, না, আমার সঙ্গে কেউ কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি, এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় আমাদের প্রবেশে কেউ বাধা দেয় না, দক্ষিণের রাজ্যগুলির মতন, এখানে রাস্তাঘাটে কোনও সাদা লোক আমাদের দিকে অপমানজনক মন্তব্য ছুড়ে দেয় না। কিন্তু আমি গন্ধ পাই। কোনও কোনও পার্টিতে, মিশ্র সাদা আর কালো নারী পুরুষ এক সঙ্গে পানাহার ও হই হল্লা করছে, কোনও অশান্তি নেই, তবু আমি হঠাৎ হঠাৎ একটা গন্ধ পাই, ওরই মধ্যে কেউ কেউ আমাকে অপছন্দ করছে, সেই পছন্দহীনতারও একটা গন্ধ আছে।
মেয়েটি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, তোমাদের দেশে অবস্থা কী রকম?
যদি উত্তর দিতাম, আমেরিকা তো বটেই, দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও অনেক খারাপ, তা হলে সত্যের অপলাপ হত কী? আমাদের দেশে বর্ণবৈষম্য তো আছেই, তার ওপরে আছে ধর্মভেদ, জাতিভেদ। অস্পৃশ্যতা, জল-অচল পর্যন্ত, যা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও দেশে নেই। যে দেশের কাব্য ও দর্শনে রয়েছে যাকে বলে ‘মানবতার সুমহান বাণী’, সেই দেশেই যখন-তখন হয় মানবতার চরমতম অপমান। এক কুয়ো থেকে পানীয় জল নেবার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয় হরিজনদের। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে অগুনতি ফর্সা মেয়ের দাবি। এ সব কথা লুকোবার কোনও মানে হয় না।
মেয়েটি আবার বলল, আমি লক্ষ করেছি, ভারতীয় ছেলেরা আমাদের সঙ্গে ঠিক যেন মিশতে চায় না।
এ অভিযোগও বর্ণে বর্ণে সত্যি। অনেক ভারতীয় ছাত্র শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করে, কিন্তু কেউ কোনও নিগ্রো মেয়েকে বিয়ে করেছে, এমন আমি দেখিনি। দু-একটি ব্যতিক্রম হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয়রা কোথাও নিগ্রোদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে না। ভারতীয়দের গুলতানিতে কখনও নিগ্রোদের প্রসঙ্গ এলে ব্যঙ্গার্থে বলা হয় কালুয়া। অনেক ভারতীয়ই কোনও না কোনও সময়ে শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে বর্ণবিদ্বেষের আঁচ পেয়েছে, তবু তারা নিজেরাও বিদ্রুপ করে কালোদের নিয়ে। আমাদের দেশে যারা ফর্সা এবং রূপবান বলে বিবেচিত, তারাও আমেরিকানদের চোখে কালো হয়ে যায়। সাহেবরা সাদা কালোর বিভিন্ন শেড বুঝতেই পারে না। সবচেয়ে মজার কথা বলেছিল একজন গ্রিক লেখক। গ্রিকরা ইউরোপীয় এবং অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ, এবং গ্রিক পুরুষদের একসময় মনে করা হত যেন সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা, তবু সেই গ্রিক লেখকটি একদিন আমায় কথায় কথায় বলেছিল, তুমি, আমি, আমরা যারা কালো লোক…। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, তুমিও কালো? তার মানে? সে বলেছিল, গরিব, গরিব, তমি আর আমি দু’জনেই গরিব দেশের মানুষ, গরিব মানেই কালো, এদের চোখে! পরে আমি দেখেছি, আমেরিকায় যারা সত্যিকারের উচ্চশ্রেণীর, যাদের বলে WASP, অর্থাৎ হোয়াইট-অ্যাংলো স্যাকশান-প্রটেস্টান্ট, তারা গ্রিক ও ইতালিয়ানদেরও খানিকটা অবজ্ঞার চোখে দেখে। প্রটেস্টান্ট না হলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়াও খুব কঠিন, জন কেনেডিই ক্যাথলিক হয়েও প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
কেনেডি কেন খুন হলেন, তার সঠিক কারণ বোধহয় কোনওদিনই জানা যাবে না। আততায়ী হিসেবে অসওয়াল্ড নামে একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি ধরা পড়ল, কিন্তু খুনটা তার একক প্রচেষ্টার খামখেয়াল, না তার পেছনে কোনও সংগঠিত চক্র আছে তাও বোঝা যায়নি। রাশিয়ান সংযোগ বা কে জি বি-কে জড়ানোর আগে চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণ মেলেনি। সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর টেলিভিশনে সর্বক্ষণ শুধু সেই একই খবর ও ছবি দিনের পর দিন। আমরাও খুনের সূত্র বা খুনির মতলব জানার জন্য টেলিভিশানের সামনেই বসে থাকি, দেখতে দেখতে এমন একটা দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম, যা অতি দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আসামি অসওয়াল্ডকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কড়া পাহারায়, লোকে ভিড় করে তাকে দেখছে, হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মোটা মতন লোক বেরিয়ে এসে রিভলভার বার করে পরপর গুলি চালিয়ে দিল অসওয়ালডের বুকে। সেই লোকটির নাম জ্যাক রুবি, সে ধরা পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই, কিন্তু জেরা বা বিচারের আগেই অসওয়ালড খতম হয়ে যাওয়ায় তার পশ্চাকাহিনীর সব সূত্রও লুপ্ত হয়ে গেল চিরতরে। টিভি-তে নানান সিনেমায় বা ধারাবাহিকে খুনের দৃশ্য দেখা যায়, সেগুলি বানানো, কিন্তু সত্যি সত্যি একটা খুন হচ্ছে এবং সেটা কোটি কোটি দর্শক সেই মুহূর্তেই দেখছে, এমন দৃষ্টান্ত আর নেই বোধহয়। কেনেডি হত্যার পর সে সম্পর্কে কত লোক সংবাদপত্রে বা টিভিতে কত রকম কল্পিত কাহিনী যে প্রচার করতে লাগল, তার ইয়ত্তা নেই। বাক-স্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এমনই চরম যে কেউ ছাপার অক্ষরে প্রলাপ বকলেও তার শাস্তি হয় না। কেনেডি হত্যার পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করতে করতেই খুন হয়ে গেল কয়েকজন, তার মধ্যে এক শ্বশুর ও জামাই উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হত্যার পরপরই প্রকাশিত হল এক প্রহসন, যার খলনায়ক উপরাষ্ট্রপতি লিন্ডন বি জনসন, তিনিই নাকি ক্ষমতা দখলের উন্মত্ততায় খুন করিয়েছেন কেনেডিকে, তাঁর সঙ্গে রূপসী জ্যাকলিনের শারীরিক সম্পর্কও বাদ গেল না। লেডি ম্যাকবেথের সঙ্গে তুলনা করে তাঁকে বলা হল ম্যাকবার্ড। এ রকম বীভৎস, অলীক নাটকও কিন্তু বাজেয়াপ্ত হল না, নাট্যকারের শাস্তি হল না।
অকস্মাৎ নিয়তির প্রতিবন্ধে জনসন রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হলেও জনপ্রিয় হননি, তার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি এই যে তাঁর চেহারাটা বড়ই সাদামাটা, কেনেডির তুলনায় একেবারে এলেবেলে। এ দেশের রাষ্ট্রপতির শারীরিক গঠনও যোগ্যতার কিছুটা অঙ্গ। পল এঙ্গেলের স্ত্রী মেরি প্রায়ই বলতেন, দুর দুর, ও লোকটাকে দেখলে মনে হয় টুপি বিক্রেতা, ওকে রাষ্ট্রপতি বলে মনেই হয় না। কিন্তু এই লিন্ডন বি জনসনের আমলেই স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক সিভিল রাইটস বিল, যার ফলে আমেরিকার সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যজনিত যে কোনও ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই দিনটিতে মার্গারিট আয়ওয়া শহরে ছিল না, সন্ধেবেলা আমি একা একা নিজের ঘরে একটা শ্যাম্পেনের বোতল খুলে নিজস্ব উৎসব করেছিলাম। এই আইন পাস হবার ফলে ও দেশে আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে বর্ণবৈষম্যজনিত নিষ্ঠুরতা কমতে শুরু করে। অনেক জায়গায়, বিশেষত নিউ ইয়র্ক শহরে সাদা ও কালো ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ে করার ধুম পড়ে যায়, তার মধ্যে খানিকটা দেখানেপনা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তন তো বটে!
আমি প্রায়ই আয়ওয়া ছেড়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। আমেরিকা তো দেশ নয়, মহাদেশ, বিশাল তার আয়তন, বিস্ময়কর তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, নিবিড় অরণ্য, মরুভূমি, পাহাড়, সুদীর্ঘ বেলাভূমি ও বর্ণময় মহানগর। পূর্ব দিকে নিউ ইয়র্ক-বোস্টন, পশ্চিমে লস এঞ্জেলিস-সান ফ্রান্সিসকো। আমার স্কলারশিপের টাকার অনেকটাই পাঠিয়ে দিতাম বাড়িতে, তাই বেড়াবার জন্য আমাকে নানারকম আমন্ত্রণ জুটিয়ে নেবার চেষ্টা করতে হত, যাতে ভাড়ার টাকাটা পাওয়া যায়। পূর্ব পরিচিত অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রুথ স্টেফানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলাম, তাঁরা কিছু কিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রুথ স্টেফান যে কত ধনবতী মহিলা তা জেনেছিলাম এ দেশে এসে। তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাকেই তাঁর নাম বলি, তারাই অবাক হয়ে বলে, তুমি ওঁকে চিনলে কী করে? এইসব ধনীরা ধরাছোঁওয়ার বাইরে থাকে। রুথ স্টেফানের দান-ধ্যান ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। অ্যারিজোনার টুসন শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার্স হোম পরিচালিত হয় তাঁরই অর্থানুকূল্যে। রুথ সেখানে আমায় আমন্ত্রণ পাইয়ে দিলেন, যার ফলে অ্যারিজোনার বিচিত্র মরুভূমি দেখার সুযোগও আমার ঘটে গেল। এই মরুভূমিতে প্রচুর ফণিমনসার গাছ, এক একটি দু’তলা, তিনতলা সমান উঁচু, স্প্যানিশ ভাষায় এগুলির নাম স্যায়ুয়ারো, কিছু কিছু বৈজ্ঞানিকের ধারণা, এই বিশাল ক্যাকটাস গুলির সঙ্গে বহু দূরের অন্য গ্রহের যোগাযোগ আছে। এখনও তা নিয়ে পরীক্ষা চলছে।
টুসন শহরে গিয়ে আমার টাউন স্কুলের সহপাঠী সুবোধ সেনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। সে তার বাড়িতে একদিন নিয়ে গিয়ে খুবই খাতিরযত্ন করে খাওয়াল। আমার ধারণা ছিল, আমেরিকায় আমার পরিচিত বাঙালি কেউ নেই। কিন্তু সুবোধের মতন আরও কেউ কেউ যে ছড়িয়ে আছে, তা জানা গেল আস্তে আস্তে। একজনের সূত্রে সন্ধান পাওয়া যায় অন্যদের। এই ভাবেই আমার পরিচয় হয় রমেন পাইন ও মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রমেন পাইন ও তার স্ত্রী জুলি বহুকাল ওয়াশিংটন ডি সি প্রবাসী, ওদের সঙ্গে আমার আজীবন বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আর মদনগোপাল মুখোপাধ্যায় ডাক্তার, তার মতন সংস্কৃতিবান ও সুভদ্র মানুষ অতি দুর্লভ। তার স্ত্রী ডলি লাজুক ও স্বল্পভাষী, কিন্তু তার আতিথেয়তা এমনই আন্তরিক যে এই দম্পতির সান্নিধ্যে প্রথমবার এসেই মনে হয় যেন অনেক দিনের চেনা। পরে বেশ কয়েকবার আমি ওদের ক্যালিফোর্নিয়ার বিস্ময়কর বাসভবনে আতিথ্য নিয়েছি, প্রত্যেকবার মনে হয়েছে, এখানে আমি বিনা আমন্ত্রণেই হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারি। আমার আর এক বন্ধু, শুভেন্দু দত্ত, পরবর্তীকালে আমেরিকায় পদার্থবিদ্যায় খ্যাতনামা অধ্যাপক, তারও সন্ধান পেয়েছিলাম পূর্ব উপকূলে।
নিউ ইয়র্কে প্রথমবারে আমি যাই পল এঙ্গেলের সঙ্গে। পল এঙ্গেল কেন যেন বিদেশ থেকে আগত অন্যান্য কবিদের মধ্যে আমার প্রতিই বেশি পক্ষপাতিত্ব করতেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে এখানে সেখানে যেতেন প্রায়ই৷ তিনি অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন শহরে যেতেন, নিজে গাড়ি চালিয়ে, আমি তাঁর পার্শ্ববর্তী, তিনি বলতেন, সুনীল, তোমাকে যে আমি সঙ্গে নিচ্ছি, তাতে আমার একটা স্বার্থও আছে। একা গাড়ি চালালে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি, তুমি আমার পাশে বসে কথা বলতে বলতে আমাকে জাগিয়ে রাখবে। শুধু কিছু কিছু বকবক করে তার বদলে নতুন নতুন শহর দর্শন, ভালো ভালো হোটেলে থাকা, অভিনব সব আহার্যের স্বাদ, (একবার মার্শাল টাউনে চিংড়িমাছ খেয়েছিলাম, এক একটি মাছ দেড় হাত-দু’হাত লম্বা, অত বড় চিংড়ি যে হয় তা আমার কল্পনাতেও ছিল না) এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! পল এঙ্গেলের বদলে আমার নিজেরই ঘুম পেয়ে যেত মাঝে মাঝে, হাইওয়ে ধরে শত শত মাইল সমান গতিতে ছোটা, একটাও ট্রাফিকের লাল বাতি নেই, লেভেল ক্রশিং নেই, দু’পাশে দৃশ্য-বৈচিত্র্যও নেই, ঘুম পাবে না? পল কনুই দিয়ে আমার পেটে খোঁচা মেরে অট্টহাস্য করে ওঠেন।
সেইভাবেই গিয়েছিলাম নিউ ইয়র্ক, উঠেছিলাম অভিজাত প্লাজা হোটেলে, একেবারে সেন্ট্রাল পার্কের গায়ে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পলের বক্তৃতা ছিল, আমার জন্যও পোয়েট্রি সোসাইটির বার্ষিক ভোজসভার একটি আমন্ত্রণ সংগ্রহ করেছিলেন। এক বিধবা মহিলা তাঁর ইচ্ছাপত্রে এই কবিতা পরিষদকে এক মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন বলে (হায়, আমাদের দেশের কবিদের কেউ এরকম দান করেন না) সেবারের ভোজসভায় দারুণ জাঁকজমক। অন্য একটি বড় হোটেলে সেই পার্টিতে যোগদান করার জন্য জীবনে প্রথম ও শেষবার আমাকে সুটের সঙ্গে বো পরতে হয়েছিল, তাতে আমাকে কী রকম ক্যাবলাকার্তিকের মতন দেখাচ্ছিল কে জানে!
আমাদের হোটেলের সামনে সর্বক্ষণ উৎসুক জনতার ভিড়, কারণ প্রচুর সেলিব্রিটি ওঠেন সেখানে। শুনলাম বিখ্যাত গণগায়ক প্যাট বুন রয়েছেন কোনও ঘরে, আমার সঙ্গে লিফটে একবার দেখা হয়ে গেল অ্যালেক গিনেসের, ‘ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই’ ফিল্মের বিখ্যাত নায়ক, তাঁকে দেখামাত্র চিনেছিলাম, কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এলিজাবেথ টেলারকে খুব কাছ থেকে দেখেও আমি চিনতে পারিনি। মুখখানা এমনই রং করা যে মনে হয়েছিল একটা জ্যান্ত পুতুল। আটবার কিংবা ন’বার বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদের বিশ্ব রেকর্ড করেছেন যে মহিলা, তাঁর সঙ্গে তখন তাঁর তৎকালীন স্বামী রিচার্ড বার্টনের খুব ভাব। রিচার্ড বার্টন সে সময় ব্রডওয়ের একটি নাটকে অভিনয় করছেন, এলিজাবেথ টেলারের তাতে কোনও ভূমিকা নেই, তবু অতিশয় পতিব্রতা পত্নীর মতন তিনি প্রত্যেকদিন স্বামীকে থিয়েটার হলে পৌঁছে দিয়ে আসেন। তবে সবচেয়ে হই চই ও হাঙ্গামা হল এক সকালে, পুলিশ এসে সামলাল ভিড়, ঘরের জানলা দিয়ে দেখলাম, সেই ভিড়ের মধ্যে ছোটাছুটি করছে চারটি অল্প বয়েসি ছেলে, জনতা উন্মত্তের মতন তাদের একবার ছুঁতে চাইছে। এরা বিটলস নামের এক গানের সম্প্রদায়, আমি এদের নাম আগে শুনিনি। ওই সময়েই বিটল্সরা খ্যাতিতে আর সব গানের দলকে ছাড়িয়ে যায়।
এইসব দেখতে দেখতে এক একসময় মনে হত, এরকম একটা দামি হোটেলে আমার মতন ফরিদপুরের অজ পাড়াগাঁর একটা ছেলে এল কী করে? এ কি সত্যি, না প্রহেলিকা? নিজের গালে চিমটি কেটে দেখতাম, ঘোর ভাঙে কি না!
অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতেই সে বলল, আমি তোমাদের ওই হোটেলে যেতে পারব না, তুমি আমার কাছে চলে এসো। সে তখন অস্থায়ীভাবে রয়েছে এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে। নিউ ইয়র্ক শহরটি প্রকাণ্ড হলেও রাস্তাগুলি এমন পরিকল্পিতভাবে সাজানো যে ঠিকানা পেলে ভূগর্ভ ট্রেনে বা বাসে চেপে সেখানে পৌঁছে যাওয়া শক্ত কিছু নয়। গ্রিনিচ ভিলেজে আট নম্বর রাস্তায় একটি বইয়ের দোকানের নাম এইটথ স্ট্রিট বুক শপ, সে দোকানের কাউন্টারে গিয়ে অ্যালেনের কথা জিজ্ঞেস করতেই কর্মচারীটি পাশের একটা সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে বলল, তিন তলায় উঠে যাও। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ বুকে একটা চমক লাগল। একটা বাংলা গান শোনা যাচ্ছে, তাও লোকগীতি, ফান্দেতে পড়িয়া বগা কান্দে রে’! ওপরে এসে দেখি, একটা অ্যাটিকের ছোট ঘরে, খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কিছু লেখালেখি করছে অ্যালেন, একটা রেকর্ড প্লেয়ারে বাজছে এই গান, পাশের একটা স্টোভের ওপর সসপ্যানে টগবগ করে ফুটছে ভাত। আমাকে দেখে তড়াক করে উঠে এসে সে জড়িয়ে ধরল, সে যেন এক অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের স্পর্শ। মাত্র এক বছর আগে কলকাতায় অ্যালেনের সঙ্গে অনেক সন্ধ্যা যাপন করেছি, তখন আমার আমেরিকায় আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না, তখন এদেশ ছিল ভূপৃষ্ঠের অন্য দিকে অতি সুদূর। অ্যালেন বারবার বলতে লাগল, প্লেজান্ট সারপ্রাইজ, প্লেজান্ট সারপ্রাইজ!
অ্যালেনের গায়ে মিলিটারি ধরনের পোশাক দেখে প্রথমে খটকা লেগেছিল। হাসতে হাসতে সে জানাল, বাধ্য হয়ে সে এই পোশাক পরিধান করেছে, কারণ, এখন ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে রাস্তায় বেরোলে ভবঘুরে মনে করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ভবঘুরেদের জন্য সরকার তৈরি করেছে অনেক আস্তানা। নতুন জামা-কাপড় কেনার পয়সা নেই, এক বন্ধু সেনাবাহিনীতে ছিল, সদ্য নিহত হয়েছে, তার স্ত্রীর কাছ থেকে এই পোশাকগুলি চেয়ে নিয়েছে অ্যালেন। পিটার পা-জামা পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সত্যিই ধরা পড়েছিল, কোনওক্রমে দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছে। তখনও হিপিদের যুগ আসেনি। এরপর হিপিরা পোশাকের সব রীতিনীতি তছনছ করে দেয়। আগে অনেক রেস্তোরাঁতেই সূটের সঙ্গে টাই না থাকলে ঢুকতে দিত না। হিপিদের উত্থানের পর অনেক রেস্তোরাঁ নোটিশ দিয়েছে, খালি গায়ে এবং খালি পায়ে প্রবেশ নিষেধ!
অ্যালেনের রান্না করা ভাত, মুসুরির ডাল সেদ্ধ আর ফুলকপি ভাজা খেয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। প্লাজা হোটেলের অত্যন্ত দামি দামি খাবারের সঙ্গে এর তুলনাই হয় না। সেদ্ধ মুসুরির ডাল কতদিন পর খেলাম, ঠিক যেন অমৃত। আমি আয়ওয়াতে মুসুরির ডাল জোগাড় করতেই পারিনি। এর ইংরেজি যে লেনটিল, তা সেদিনই জানলাম অ্যালেনের কাছ থেকে। অ্যালেন খেতে খেতে বলল, তুমি প্লাজা হোটেল থেকে নিউ ইয়র্ক কিছুই দেখতে, বুঝতে, চিনতে পারবে না, তুমি আমাদের সঙ্গে এসে থাকো। আমিও সেটাই চাই, এত বড় হোটেলে থেকেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
সসঙ্কোচে পল এঙ্গেলের কাছে এই অনুমতিটি চাইতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এবং তিনিও খানিকটা সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, তুমি কি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে পারো? ওর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের।
দু’জনেই আমেরিকান, দু’জনেই কবি, তবু তাদের চেনাশুনো নেই, এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেবে একজন বাঙালি কবি? আসলে এই দু’জন দু’দিকের প্রতিনিধি, পল এঙ্গেল অধ্যাপক, অর্থাৎ এস্টাব্লিসমেন্টের অন্তর্গত, আর অ্যালেন গিন্সবার্গ বিদ্রোহীদের নেতা। পল এঙ্গেলের কথা শুনে মনে হল, অ্যালেন বুঝি তাঁকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে দেবে, তাই আমার মতন একজন ঢালের আড়াল দরকার। অ্যালেনকে জানিয়ে পরের সন্ধেতেই পল এঙ্গেলকে নিয়ে গেলাম সেই অষ্টম রাস্তার বইয়ের দোকানের ওপরের তলার ছোট্ট ঘরটিতে। কোনও রকম আক্রমণ বা কটুবাক্য বিনিময় হল না, দু’জনে সহাস্যে হাত মেলালেন। অ্যালেনকে খুশি করার জন্য তার কয়েকটি কবিতার বইয়ের নাম বলে গেলেন পল, সেগুলি তিনি পড়েছেন, এবং কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরম্ অ্যালেনও পলের লেখাটেখা সম্পর্কে খবর রাখে দেখা গেল। পল যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পৃথিবীর নানান দেশ থেকে তরুণ লেখক-লেখিকাদের এনে সম্মিলিত করছেন আয়ওয়া শহরে, তার প্রশংসা করলো অ্যালেন। পল তখন অ্যালেনকে বললেন, আপনিও সেখানে একবার আসুন না। আপনাকে নিজেদের মধ্যে পেলে বিদেশি লেখক-লেখিকারা। উৎসাহিত হবে। অ্যালেন বলল, হ্যাঁ যেতে পারি, অবশ্যই যেতে পারি, একদিন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করুন ওখানে, তার আগে সুনীলকে কিছুদিন ছেড়ে দিন আমাদের কাছে।
পল এঙ্গেল ফিরে গেলেন, আমি কয়েকটা দিনের জন্য রয়ে গেলাম অ্যালেনদের লোয়ার ইস্ট সাইডের এক নতুন আখড়ায়।