৩০. ভয়টা সত্যি হল

ত্রিশ

ভয়টা সত্যি হল। কোম্পানির স্পেশাল ক্যুরিয়ার এসেছিল চিঠি নিয়ে। আমার চাকরি সত্যিই গেল। মানে আমার কনট্রাকট ওঁরা আর রিনিউ করলেন না। অবশ্য রিনিউ করবেনই যে, এমন কোনও কথা ওঁরা দেননি, তবু না করার কোনও কারণ ছিল না। যদি না আমি যশোয়ন্তের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে ঘোষদার কুনজরে পড়তাম। চাকরি যাওয়ার জন্যে দুঃখ নেই, দুঃখটা অন্য কারণে।

পনেরো দিন পর কলকাতা থেকে আমার উত্তরসূরি আসবেন। তাঁকে কাজ বুঝিয়ে আমার ছুটি। ভাবতে পারি না। সত্যিই ছুটি হবে এখান থেকে। বরাবরের মতো।

ঘোষদার কথা মনে হয়। জানতে ইচ্ছে হয়, কী অন্যায় করেছিলাম ভদ্রলোকের কাছে।

এ ক’দিন কিছু আর ভাল লাগে না। সারাদিন কাজকর্ম দেখে বিকেলে চান সেরে বাংলোর হাতায় চেয়ার পেতে বসে থাকি। আমার চোখের সামনে একটা আশাবাহী সূর্য করুণ বিষণ্ণ ব্যথাবাহী সুর ছড়িয়ে বাগুং পাহাড়ের আড়ালে ডুবে যায়। শান্ত সরোদের স্বর হাওয়ায়, শুকনো পাতার মচমচানিতে ভেসে বেড়ায়। বড় বিষণ্ণ লাগে।

একটি শুকনো খয়েরি শালপাতার মতো মনে হয় নিজেকে নিজের কোনও ভার নেই, কোনও গন্তব্য নেই। কিছু বক্তব্য নেই। পাগলা হাওয়ায় যেখানে ঠেলে নিয়ে যায়, সেখানেই যাই। যেখানে আছড়ে ফেলে, সেখানে আছাড় খাই।

বড় ভালবেসে ফেলেছি এই রুমান্ডিকে। এই নইহার, শিরিণবুরুকে। পালামৌর এই পাহাড়, বন, গাছপালা, ফুল প্রজাপতিকে। ভালবেসে ফেলেছি যবটুলিয়ার গমভাঙা কলের পুপ-পুপানিকে, ভালবেসে ফেলেছি ওঁরাও ছেলের উন্মত্ততাকে—পাচন তাড়িত কাঠের ঘণ্টা-দোলানো কালো কালো মোষগুলোকে। যা কিছু দেখি, যা কিছু শুনি, যা কিছুর সুবাস পাই, সব কিছুকেই ভালবেসে ফেলেছি। নিরুপায়ভাবে, অপারগভাবে।

কী করব জানি না। পেটের ভাতের জন্যে তেমন ভাবিনি। তোরঙ্গের কোনায় একটা পাকানো কাগজ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিল-মারা। কেবলমাত্র ভাত জোটানোর পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। মাত্র ভাত জোটানোর জন্যেই বা কেন? হয়তো বা আরও অনেক কিছুর জন্যে। হয়তো বা বালিগঞ্জ পাড়ায় একটি ফ্ল্যাট, সেকেণ্ডহ্যাণ্ড একটি গাড়ি, হায়ার পারচেজে কেনা একটি রেফ্রিজারেটর, একটি রেডিওগ্রাম, একটি লোক দেখানো, চোখ ঝলসানো বসবার ঘর এবং তদুপরি স্লিভলেস ব্লাউজপরা অন্তঃসারশূন্য একটি দেহসর্বস্ব—সব কিছুই এই কাগজটি ভাঙিয়ে পেতে পারি।

কিন্তু আজ যা পেয়েছি—এই রুমান্ডির জীবন, যশোয়ন্তের ভালবাসা, মারিয়ানার বন্ধুত্ব, জুম্মানের সেবা, রামধানিয়া, টাবড়, সকলের বাধ্যতা—এসবের সঙ্গে তুলনা করি এমন কিছু কলকাতায় আছে বলে ভাবতে পারি না।

এখানের এক-একটি ভরন্ত সুরেলা সোনালি দিনকে মুঠি ভরে প্রতিদিন আমি কারও মসৃণ স্তনের মতো ধরেছিলাম। পরিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ ও নির্বিবাদ মালিকানায় ভোগ করেছিলাম। কলকাতার সমস্ত জীবনের বিনিময়ে আমি এখানের একটি দিনও দিতে রাজি নই। এখন আমাকে এখান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মানে নবজাত শিশুরই মতো প্রকৃতি মায়ের নাড়ি থেকে সভ্যতার ছুরি দিয়ে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে সভ্য ও ভণ্ড কলকাতার আবর্জনার স্তুপে আমাকে নিক্ষেপ করা। ভাবতে পারি না, ভাবতে পারি না।

এই মুহূর্তে আমি আমার অন্তরের অন্তরতমে বিশ্বাস করি, এই প্রকৃতিই আদি। আমাদের একমাত্র আশা। আমাদের শেষ অবলম্বন। আমাদের আশ্লেষ আশ্রয়। কী ঐকান্তিকতায় যে বিশ্বাস করি, তা বোঝাবার মতো ভাষা আমার নেই। এর চেয়ে গভীরভাবে আমার এই অল্প বয়সের জীবনে আর কিছুই বিশ্বাস করিনি।

গতকাল ঘোষদা এসেছিলেন। অনেক কুমিরের কান্না কাঁদলেন আমার চাকরির একসটেনশান না হওয়ার দুঃখে।

হাসি পাচ্ছিল। যশোয়ন্তের সঙ্গে থেকে থেকে, মাঝে মাঝে আমি রাগ করতেও শিখেছি। ইচ্ছে হল, বন্দুকটা এনে, দিই ভুড়ি ফাঁসিয়ে। তারপর আবার হাসি পেল। ভাবলাম, এসব ‘বন্ধু ভাগ্যে পুত্ৰপ্ৰাপ্ত’ লোক এতখানি পুরুষোচিত শাস্তির যোগ্য নয়।

এই বসন্ত বনের রাত যেন মাতাল করে। কী যে সুগন্ধ ছড়ায় হাওয়াটা, কী বলব। কেরাউঞ্জা, মহুয়া, পিলাবিবি, জীর-হুল, ফুলদাওয়াই, সফেদীয়া, আরও কত শত নাম-না জানা ফুলের বাস। জ্যোৎস্না রাতের তো কোনও তুলনাই নেই।

গাছে গাছে পাতা ঝরে গেছে। জঙ্গলের নিচটা বহুদূর অবধি দেখা যায়। এখন জন্তু-জানোয়ারের ঘাড়ে গিয়ে পড়ার আশঙ্কাও কম। রাতচরা পাখিগুলো সুনীল সুগন্ধি চাঁদমাখা আকাশের পটভূমিতে উড়ে উড়ে চিপ চিপ করে ডেকে বেড়ায়। দূর থেকে পরিচিত খাপু পাখি ডাকে, খাপু-খাপু-খাপু-খাপু। টি-টি পাখিরা সুহাগী নদীর উপরে সারারাত দখিনা হাওয়ায় সাঁতার কাটে—টিটির-টি—টিটির-টি—টিটির-টি।

এ ক’দিন রোজ সন্ধে হলেই বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। শিকারে নয়। আর শিকার নয়। যা যা শিকার করেছি, তার জন্যেই দুঃখ লাগে, অপরাধী লাগে নিজেকে। অবশ্য যশোয়ন্তের মতানুসারে এটা সত্যি যে, যে শিকারি, একমাত্র তার পক্ষেই বনের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে নিসর্গসৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব। এটা একটা প্রয়োজন। প্রকৃতিকেও অন্য যে কোন সুন্দরী ব্যক্তিত্বসম্পন্না মেয়ের মতো আগে জয় করতে হয়, তারপরই সে উজাড় করে দেয়। সংশয় নিয়ে, ভয় নিয়ে, প্রকৃতিকে দেখলে তার কিছুই জানা যায় না। দেখা হয় না।

রাতে, বনে বনে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াই। পাশের শুকনো পাতায় মচমচানি তুলে কোটরা হরিণ বেগে দৌড়ে যায়। সম্বরের দলের ভারী পায়ের শব্দ শোনা যায় পাথরের উপর। ময়ূর ও মুরগি ফুটফুটে আলোয়-ভরা রাতে বন্দুক কাঁধে আগন্তুককে দেখে, ডানা ঝটপটিয়ে জ্যোৎস্নালোকিত পত্রশূন্য উঁচু ডালে নড়ে-চড়ে বসে। সাপের তাড়া খেয়ে মেঠো ইঁদুর শুকনো পাতায় সড়সড়ানি তুলে দৌড়ে পালায়।

কখনও কখনও সুহাগী নদীর পাশে যশোয়ন্তের প্রিয় সেই বড় পাথরে বসে থাকি। জুম্মান মানা করে, বলে, বাঘে জল খেতে আসে ওখানে। আমার আজকাল ভয় করে না। যখনই রুমান্ডির দিন হাতের আঙুলে গুনি, তখনই মনে হয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাবার আগে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে, আমার সমস্ত সত্তার ঐকান্তিকতা দিয়ে এই ভাললাগায় প্রাণ ভরে নিই।

পাথরটায় বসে বসে অনেক কথাই মনে হয়। যেদিন যশোয়ন্তের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল, সেদিনকার কথা। এই পাথরের পাশে কতবার চড়ুইভাতি হয়েছে। সুমিতাবউদি ‘কা’ ও ‘বা’ দিয়ে হিন্দি বলা শিখিয়েছিলেন আমাকে এখানে। সুমিতাবউদিকেও কখনও ভোলবার নয়। তিনি যে ঘোষদার স্ত্রী, এই কথাটা ভাবলেই কষ্ট হয়। আমার বান্ধবী মারিয়ানা, মারিয়ানার বন্ধু সুগত, সকলের স্মৃতিই নিয়ে যাব। মনে ভাবি, হারাব না কিছুই। মনের কোণে দুমূর্ল্য আতরের মতো এই ভাল লাগা, এই ভালবাসা; এই সুগন্ধ বয়ে বেড়াব অনুক্ষণ; আজীবন। যতদিন বাঁচি।

অথবা জানি না, রুমান্ডির সঙ্গে সব সম্পর্ক—রুমান্ডি ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে কিনা। কলকাতায় গেলেই দোতলা বাসের ঘড়ঘড়ানি—ট্রামের টুংটুং, ফেরিওয়ালার চিৎকার, আত্মম্ভরী শহুরেদের উচ্চগ্রামের কথোপকথনে এই শান্তি, এই আবেশ, এই স্মৃতি, এই পরিচয়, এই ভাল লাগা কিছুই থাকবে না। সবই হয়তো মুছে যাবে, সব মিটে যাবে হয়তো।

একদিন সন্ধের পর ওই পাথরে বসেছিলাম। কতকগুলো জানোয়ারের ভারী পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। বুনো মোষের দল। কোয়েলের পাশের ঘাসী বনে ওদের আস্তানা—বাগেচম্পার দিকে। যশোয়ন্ত একদিন নিয়ে গিয়ে দেখাবে বলেছিল। ভয় করতে লাগল একটু। চুপ করে বসে রইলাম। কী প্রকাণ্ড শরীর। ওঁরাওদের পোষা মোষের দেড়গুণ চেহারা। পুরো কালো নয়—রঙটা যেন কেমন। চাঁদের আলো বিরাট বিরাট শিং-এ পিছলে পড়ে চকচক করছে। দলপতি আমাকে একবার দেখল মাত্র। তারপরে যেমন বাঁ থেকে ডাইনে যাচ্ছিল, তেমনই পাথরে পাথরে ভারী খুরের খটাখট আওয়াজ করতে করতে দূর বনের সায়ান্ধকারে মিশে গেল।

বাগুং পাহাড়ের দিক থেকে একটা হায়েনা ডেকে উঠল—হাঃ হাঃ হাঃ। ওই পাহাড়ের বনদেওতার থান ঘিরে শঙ্খচূড় আর গহুমনেরা এখন কী করছে জানি না।

আজকাল আমাকে জব্দ করার জন্যেই যেন ঘড়ির কাঁটাগুলো অনেক দ্রুত ঘুরছে—শেষ ক’টি দিন যাতে আরও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, সেই চক্রান্ত করছে।

একত্রিশ

ছিপাদোহর স্টেশনে আমার উত্তরসূরিকে নিতে এসেছি। জিপ নিয়ে এসেছি। এক্ষুনি আসবে ট্রেন। মহুয়া-মিলন, চৈটর, হেহেগাড়া, রিচুঘুটা, কুমান্ডি হয়ে ছিপাদোহর।

দেখতে দেখতে লাল ধুলোর ঝড় উড়িয়ে চৌশন এক্সপ্রেস এসে গেল।

যিনি এলেন, তাঁর নাম বিকাশ সেন। বয়সে আমার চেয়েও দু-তিন বছরের ছোট হবেন হয়তো। কপালের উপর চুল শোয়ানো, পাশাপাশি আঁচড়ানো। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। পরনে পাঁচ ইঞ্চি ড্রেইন-পাইপ। তার উপর গোলাপি ভয়েলের পাঞ্জাবি। হাতে শিখদের অনুকরণে পরা স্টেনলেস স্টিলের বালা।

কেতাদুরস্ত নব্য যুবককে দেখেই বুঝলাম যে, ইনিই আমার উত্তরসূরি। ওই স্টেশনে ফার্স্টক্লাস থেকে রোজ রোজ প্যাসেঞ্জার নামেন না। এগিয়ে যেতেই ডানহাত তুলে আমাকে বললেন, ‘হাই’।

অ্যাটেন্ডেন্ট কামরা থেকে উর্দি পরা কোম্পানির ড্রাইভারকাম বেয়ারা নামল। ওকে উনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন।

আলাপ পরিচয় হল। আমি জানালাম যে, ওঁকে কাজ বুঝিয়েই পরদিন ভোরে আমি চলে যাব। পরদিন বিকেলে ঘোষদা এসে ওঁকে আরও ভাল করে বিশদভাবে সব বোঝাবেন।

জিপে আসতে আসতে মিস্টার সেন শুধোলেন, রুমাণ্ডি থেকে নিয়ারেস্ট সিনেমা হল কত দূরে? ভাল ছবি-টবি আসে? আর্ট ফিলম? নিউ-ওয়েভ-এর ছবিটবি?

আমি বললাম, সিনেমা হল ডালটনগঞ্জে। এখন ‘রামভক্ত হনুমান’ হচ্ছে। এরপর ‘যাঁহা সতী উঁহা ভগবান’ আসছে।

উনি উত্তর দিলেন না।

রুমান্ডি পৌঁছে মিস্টার সেন বললেন, গুড লর্ড, আ হেল অফ আ প্লেস।

তারপর চোখ টিপে বললেন, বাট আই বিলিভ, ইউ মাস্ট বি হ্যাভিং প্লেন্টি অব রিয়েল গুড ডেমস হিয়ার।

জবাব দেবার ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার রুমান্ডির মালিকানা চলে যাচ্ছে এই শোকে আমি মুহ্যমান ছিলাম। জবাব দিলাম না।

আমার শেষ দিনটিকে, ভেবেছিলাম, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করব। কিন্তু সেদিন বিকেলে যবটুলিয়া থেকে ভেসে আসা পুপপুপানি গানও আর শোনা হল না। তার কোনও উপায় ছিল না। সূর্যদেব দিগন্তে আমার নৈবেদ্য না নিয়েই ডুবে গেলেন। কিছুতেই রাঙিয়ে রাখতে পারলাম না, বাঁচাতে পারলাম না দিনটিকে। আমার রুমান্ডির দিন।

বিকেল থেকে ব্যাটারি-ড্রিভন রেকর্ড-প্লেয়ারে স্প্যানিশ গিটারের স্টিরিও রেকর্ড চড়িয়ে, ঠোঁটের কোণে অবিরাম সিগারেট গুঁজে, মিঃ সেন পায়ের উপর পা তুলে বেতের চেয়ারে ইনটেলেকচুয়াল পোজে বসে আছেন। রেকর্ডের সেই আর্তনাদ ছাপিয়ে কোনও পাখির ডাক কি হাওয়ার মচমচানি কি কাঁচপোকার গুনগুনানি শুনি এমন সাধ্য কী।

ঠিক করেছি লাতেহার থেকে বাসে চাঁদোয়া-টোরী হয়ে রাঁচি যাব, রাঁচি থেকেই ট্রেন ধরব। কোম্পানির ড্রাইভার আমাকে লাতেহার অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে। ইচ্ছে করলে রাঁচি অবধিও যেতে পারতাম। কিন্তু মর্যাদায় বাধল।

ভোরবেলা জুম্মান এক কাপ কফি করে দিল। কফি খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

রুমান্ডির বাংলো থেকে বেরোবার আগে টাবড় এবং সুহাগী ও যবটুলিয়া বস্তির আরও অনেক নাম জানা ও অজানা লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বেচারি ওরা। ওদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। সকলকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে পর্যন্ত পারিনি। একবেলা সকলকে পেট ভরে ভাত খাওয়ানোও হয়ে ওঠেনি। আমার অসামর্থ্যের ত্রুটি ব্যবহার দিয়ে মেটাতে চেয়েছিলাম। জানি না কতটুকু পেরেছি।

পথের পাশে একটা বুনো মোরগ খুঁটে খুঁটে কী খাচ্ছিল। আমাদের দেখেই কঁক-কঁক করে উড়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল। সকালের রোদে গাঢ় সোনালি পাখা ঝিকমিক করে উঠল।

লাতেহার পৌঁছলাম। যে পথ দিয়ে ওঁরাও ছেলেটিকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সে পথ দিয়ে।

লাতেহারে পণ্ডিতের দোকানে বসে চা ও শেঁওই ভাজা খাচ্ছি। বাসের অপেক্ষায় আরও অনেকে বসে আছে। এমন সময় হঠাৎ একটি ঘোড়াক হ্রেষারব কানে এল।

যশোয়ন্ত ভয়ঙ্করকে পণ্ডিতজীর দোকানের পাশের মহুয়া গাছে বেঁধে আমার কাছে এল। বলল, তোমাকে তুলে দিতে এলাম লালসাহেব। জানি না, কেন ভাল লাগছে না। আমার মন আজকাল আর আগের মতো শক্ত নেই ইয়ার। আজকাল দুঃখ হলে দুঃখ লাগে, ভয় পাবার কারণ থাকলে ভয় পাই। তুমি সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছ ভাবতে ভাল লাগছে না।

আমি কোনও কথা বললাম না।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম।

তারপর নীরবতা ভেঙে বললাম, চিঠি লিখলে উত্তর দেবে তো?

যশোয়ন্ত হাসল।

বলল, আমি তো চিঠি লিখতে জানি না লালসাহেব, আমি শুধু কথা বলতে পারি। তাও জঙ্গলের জানোয়ারদের সঙ্গেই বেশি কথা আমার। আমার উত্তর আশা কোরো না। উত্তর পাবে না। তবে, তুমি চিঠি লিখো।

একটু থেমে বলল, সুহাগীতে যখন মাছ ধরা পড়বে, তোমার কথা মনে পড়বে। সুমিতাবউদির সঙ্গে যখন দেখা হবে, গরমের দিনে আবার যখন মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধ ভাসবে হাওয়ায়, যখন জীরহুল আর ফুলদাওয়াই ফুটবে, তোমার কথা মনে হবে। তোমাকে মনে মনে অনেক চিঠি লিখব। চিঠিগুলো শুকনো শালপাতার মতো জঙ্গলে, নদীনালায়, কালো পাথরে, হাওয়ায় হাওয়ায় গড়িবে বেড়াবে। সে চিঠি তো ডাকে যাবে না।

আমি বললাম, যশোয়ন্ত, জগদীশ পাণ্ডের জন্যে আমার রুমান্ডি ছেড়ে যেতে সত্যিই মন খুঁতখুঁত করছে। খুব সাবধানে থেকে যশোয়ন্ত। খুব সাবধানে থেকো।

যশোয়ন্ত উত্তর না দিয়ে বুশ শার্টের নীচে, ডানদিকে বেল্টের সঙ্গে হোলস্টারে বেঁধে রাখা পিস্তলের বাঁটে একবার হাত ছোঁয়াল। তারপর বিড় বিড় করে বলল, মরবে একজন ঠিকই। হয় ল্যাংড়া জগদীশ, নয় এই যশোয়ন্ত। তবে কে যে মরবে, তা বাগুং পাহাড়ের দেওতাই জানেন।

পকেট থেকে একটা চুট্টা বের করে যশোয়ন্ত একগাল হাসল। যেন আমাকে ভোলাবার জন্যেই তারপর হঠাৎ আবৃত্তি করে, হাত নেড়ে নেড়ে বলল,

‘মর্‌নেকে বাদ মেরি ঘর্‌সে কেয়া নিক্‌লি শামান?

চাঁদ তস্‌বীর বুতা, চন্দ্ হাসিনোঁকোঁ খাতুত্।’

বললাম, মানে?

মানে আর কী? মরার পর আমার ঘর থেকে আর কী পাওয়া যাবে? কিছু সুন্দরীর ছবি, আর কিছু সুন্দরীদের লেখা চিঠি।

বলেই, হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগল।

আমিও হাসতে লাগলাম, ওর কথা শুনে।

ডালটনগঞ্জ থেকে বাসটা এসে গেল।

আমার হাঁটুর উপরে রাখা যশোয়ন্তের চওড়া কবজিতে হাত রাখলাম। যশোয়ন্ত কিছু বলল না।

বাসে উঠে বসলাম আমি।

অনেকক্ষণ চলার পর টোরীতে এসে মোড় নিল বাস। বাঁয়ে জাবরা মোড় হয়ে—সীমারীয়া হয়ে যশোয়ন্ত-এর টুটীলাওয়ার রাস্তা। হাজারিবাগ জেলাতে। আর ডানদিকে পথ চলে গেছে কুরুতে।

আমঝারীয়ার বাংলোটির পথ দেখা গেল এক ঝিলিক। দুদিকে সারা পথ কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। পাহাড় আর পাহাড়। নিমলা বস্তির দিকে পথ বেরিয়ে গেছে এ পথ থেকে। যশোয়ন্তের সঙ্গে শিকারে এসেছিলাম একবার।

বেশ গরম গরম লাগছে এখন।

আরও একমাস পর যখন গরম আরও জোর পড়বে, তখন সন্ধ্যার পর পাহাড়ে পাহাড়ে আলোর মালা জ্বলবে। কালো পাহাড়ের পটভূমিতে প্রকৃতির নিজের হাতেই দীপান্বিতা হবে প্রকৃতি। হাওয়াটা ফিসফিসিয়ে কোনও গান্ধারী আলাপ বয়ে বেড়াবে। খরগোশ আর কোটরা হরিণগুলো পথের উপর আগুনের ভয়ে দৌড়োদৌড়ি করবে।

মনের চোখে সব দেখতে পাচ্ছি, সব দেখতে পাচ্ছি। দাবানলে পোড়া জঙ্গলের গন্ধ পাচ্ছি নাকে।

যেন হঠাৎই কুরুতে পৌঁছেই জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। এবার রাঁচির রাস্তা। সোজা।

দু’পাশে চষা জমি। মাঝে মাঝে দুটি একটি গাছ। সামনেই মান্দার। পথের পাশে হাট বসেছে। ওঁরাও ছেলে-মেয়েরা ভিড় করেছে।

বাসটা দাঁড়াল। ধানিঘাসের ঝাঁটা। ওঁরাওদের হাতে বোনা দোহর। পেতলের গয়না। মাটির বাসনপত্র, আরও কত কী।

আকাশে রোদ ঝকঝক করছে।

একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে একটি ওঁরাও মেয়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। চুলে ফুল গুঁজেছে। একটি ছেলে মোষের পিঠে চড়ে হাটে এসেছে। কী যেন বলছে ছেলেটি মেয়েটিকে। মেয়েটির দু’ চোখে মিষ্টি হাসি। ছেলেটি দুষ্টুমিভরা চোখে চেয়ে আছে।

মোষটা একবার মাথা ঝাঁকাল। কান দুটো পট পট করে নড়ে উঠল। গলার কাঠের ঘণ্টাটা ডুঙডুঙিয়ে বাজল। একটা নীল মাছি উড়তে লাগল শিং দুটোর মধ্যে।

ছেলেটি কী বলছে মেয়েটিকে—কানে কানে?

‘হালফিলের মেয়েরা

প্রজাপতির মতো নরম

ইস্‌স্ হাত ছুঁইয়ে দেখো

প্রজাপতির মতো নরম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *