৩০. বিজয়
কখনো কখনো জীবনে এমন একটা দুর্বিষহ মুহূর্ত আসে, যখন মনে হয় বাঁচার চাইতে মরাটা বুঝি অনেক সহজ। এই বোধটা সাধারণত জন্ম নেয় নিঃসীম একটা হতাশার মধ্যে থেকে। অথচ কোনো শহীদ যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়, দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও অনুভব করে চিরন্তন একটা গৌরবের জন্মলগ্ন।
ঠিক তেমনিভাবে টমও যখন তার জল্লাদের সামনে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে ছিল, স্পষ্টই অনুভব করতে পারছিল তার অন্তিমলগ্ন ঘনিয়ে এসেছে, দুঃসাহসী একটা গৌরবে তার বুকটা ফুলে উঠছিল, মনে হয়েছিল করুণাঘন যিশুর উজ্জ্বল মুখখানা স্মরণ করতে করতে সে যেকোনো অত্যাচার আর আঘাত সহ্য করতে পারবে। কিন্তু জল্লাদের ছায়াটা দূরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই টমের সেই আবেগ বিহ্বল মুহূর্তটাও কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেল, ফিরে এল দুর্বিষহ যন্ত্রণা আর ক্লান্তি। অর্ধঅচেতন, নিঃসঙ্গ একটা হতাশার মধ্যে সে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগল।
ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসতে না আসতেই লেগ্রি তাকে নিয়মিত তুলা তোলার কাজে লাগিয়ে দিল। দিনের পর দিন পরিশ্রম আর ক্লান্তি ছাড়াও বিদ্বেষ ভরা নীচমনা ইতরটার যতরকম অন্যায় আর অশুভ ইচ্ছা টমকে কেবলই উত্যক্ত করে তুলতো, ভেঙে দিত তার ধৈর্যের বাঁধ। চারপাশে হীন রুক্ষতার মাঝে বাইবেলটাই ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা। আগে অবসর সময়ে যাওবা আগুনের সামনে বসে একটু আধটু পড়তে পারত, সেরে ওঠার পর এখন আর তাও পারে না। অবসর কোথায়? তুলো তোলার এই মরশুমে লেগ্রি কাউকে একটা মুহূর্তও ফুরসৎ দেয় না। ওদের জীবনে রবিবার বা ছুটি বলে কিছু নেই। এখন সারাটা দিন অমানুষিক পরিশ্রম আর নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করার পর যখন কাজ থেকে ফিরে আসে, নিজেকে মনে হয় যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। একটু পড়ার চেষ্টা করলেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে, মাথাটা ঝিমঝিম করে, ইচ্ছে করে অন্যদের মতো নিজের দেহটাকেও একেবারে টানটান করে মেলে দিতে।
এইরকম অদ্ভুত একটা মুহূর্তে টমের ধর্মীয় বিশ্বাস, তার নিবিড় আত্মপ্রত্যয়ও বুঝি দুলে ওঠে। চোখের সামনে প্রতিদিনই সে দেখে, প্রতিটা সত্তা অবদমিত হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে, আর জয়ী হচ্ছে যা কিছু অশুভ; ঈশ্বর কিন্তু একটা প্রতিবাদও করছেন না! দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই যে দুঃখ, এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে সে একাই নিজের সত্তার সঙ্গে সংগ্রাম করে আর চোখ বুজে ভাবে মিসেস শেলবিকে পাঠানো মিসেস ওফেলিয়ার লেখা চিঠিটার কথা, ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাকে উদ্ধার করার জন্যে কাউকে না কাউকে পাঠাবেন। মাসের পর মাস সে ব্যাকুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কাউকে আসতে না দেখে তার বুকের ভেতরটা আরো গাঢ় বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে, কখনো কখনো মনে হয় ঈশ্বর বোধহয় সত্যিই তাকে ভুলে গেছেন! সেই ঘটনার পর আরো দু-একবার সে কেসিকে দেখেছে, কখনো বা এমিলিনের সঙ্গেও চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু সে শুধু মাত্র কয়েক পলকের জন্যে, কথা বলার কোনো সুযোগ ঘটে নি।
একদিন সন্ধ্যেবেলায়, ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে কাজ থেকে ফিরে টম পোড়া কিছু কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে খাবার তৈরি করছিল আর চিহ্নিত জায়গায় বাইবেলখানা খুলে বারবার পড়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অল্প আলোয় প্রায় কিছুই দেখতে পারছিল না বলে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইবেলটা মুড়ে সে আবার পকেটে রেখে দিল।
ঠিক তখনই তার পেছন থেকে কে যেন কর্কশ গলায় হেসে উঠল। চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই টম দেখতে পেল দরজার সামনে লেগ্রি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘তাহলে বুঝতেই পারছিস, ওটাতে এখন আর কোনো কাজ হবে না? দে দে, ওই জঞ্জালটাকে বরং ছুড়ে ফেলে দে!’
লেগ্রির বিদ্রূপের ভঙ্গিটা ক্ষুধা, শীত বা নগ্নতার চাইতে আরো কুৎসিত, আরো নির্মম হয়ে বিঁধল টমের বুকে! তাই কোনো কথা না বলে সে চুপ করে রইল।
লেগ্রি বলল, ‘তুই সত্যিই বোকা। আমি তোর ভালোই করতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছে করলে তুই সাম্বো আর কুইম্বোর চাইতে অনেক ভালো থাকতে পারতি। মাঠে মাঠে এত পরিশ্রম করতে হতো না, হাতে যেমন প্রচুর সময় পেতে পারতি, তেমনি সবার ওপর খবরদারিও করতে পারতি। ভেবে দেখ, এখনো সময় আছে। নোংরা ওই জঞ্জালটা আগুনের ফেলে দিয়ে তুই বরং আমার গির্জায় যোগ দে।’
‘না স্যার, আমি তা পারি না।’ শান্ত স্বরেই টম জবাব দিল।
‘কেন পারিস না? তুই তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছিস, ঈশ্বর তোকে সাহায্য করছে না। ঈশ্বর যদি থাকত, আমার সঙ্গে তোর কোনোদিনই দেখা হতো না। ধর্ম-টর্ম ওসব বাজে, মিথ্যে একটা অজুহাত। আমিই তোর ঈশ্বর! আমার কথা মেনে চললে তবু বরং তোর জন্যে কিছু একটা করতে পারব।’
‘তা হয় না, স্যার। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করুন বা নাই করুন, আমি তাঁকে কোনোমতেই ত্যাগ করতে পারি না। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস আমি কিছুতেই হারাব না।’
‘আচ্ছা, আমিও দেখব তুই হারাস কি না! মনে রাখিস, সায়েস্তা তোকে আমি করবই, তখন দেখব কোন ঈশ্বর এসে তোকে রক্ষা করে!
টমের গায়ে থুতু ফেলে, বুট দিয়ে মাড়িয়ে লেগ্রি চলে গেল।
অবজ্ঞায় ভরা মনিবের এই নিষ্ঠুর আচরণ টমের অন্তরকে ভারি একটা বোঝার মতো দুর্বিষহ করে তুলল, বিবশ করে দিল তার দুঃখ বেদনা আনন্দ আর সাহসকে। নিভে আসা আগুনের সামনে সে অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে রইল। মনিবের নির্মম বিদ্রূপ তাকে যতই পাঁকের অতলে তলিয়ে দিতে চাইল, মরিয়া হয়ে সে ততই চিরন্তন পথের কাটাটাকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করল। বসে থাকতে থাকতে একসময় তার চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল আর অনেক দূরে স্পষ্ট হয়ে উঠল জ্যোতিময় একটা মূর্তি। মাথায় কাঁটার মুকুট, রক্তাক্ত সারা দেহ, চোখ দুটো অর্ধনিৰ্মিলীত। বিস্ময়ে আনন্দে টম বিস্ফোরিত চোখে অনিন্দ্যসুন্দর উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য করুণ চোখ দুটো যেন টমকে বিপুল উচ্ছাসে একেবারে আপ্লুত করে দিল। গভীর আগ্রহে হাত দুটো বাড়িয়ে সে নতজানু হয়ে বসল। তারপর একটু একটু করে মূর্তিটা মিলিয়ে যাবার পরেও মুকুটের কাঁটাগুলো গনগনে আগুনের মতো অনন্য একটা দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল আর অনিন্দ্যসুন্দর সেই মুখটাকে দেখল করুণ মমতায় তার ওপর ঝুঁকে পড়ে যেন বলছেন, ‘আমার পিতার সিংহাসনে বসবে বলেই আমি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছি, টম!’
ওইভাবে টম কতক্ষণ বসেছিল, তার খেয়াল নেই। যখন চেতনা ফিরল, আগুনটা নিভে গেছে, বাইরের ঠাণ্ডা আর শিশিরে ভিজে গেছে তার পোশাক। কিন্তু তার অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে আনন্দের বন্যায়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বেদনা, হতাশা এখন আর কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। উদ্দীপ্ত বিশ্বাসে সে তখন এমনই এক নতুন মানুষ, সে পৌঁছে গেছে তার ঈপ্সিত আনন্দলোকে।
পরের দিন ভোরের আলো ফুটে উঠতে না উঠতেই অন্যান্যদের সঙ্গে টমও মাঠের দিকে এগিয়ে চলল, কিন্তু আজ তার পায়ের নিচের মাটি অনেক বেশি শক্ত মনে হচ্ছে। নিবিড় একটা প্রশান্তিতে ঝলমল করছে সারা মুখ, যেন পার্থিব যা কিছু তুচ্ছ সে তার অনেক ঊর্ধ্বে।
সবাই তার পরিবর্তন লক্ষ করে অবাক হয়ে গেল, সব চাইতে বেশি অবাক হলো লেগ্রি। ঘোড়া থেকে নেমে সে সাম্বোকে বলল, ‘কী ব্যাপার, আজ শয়তানটার হয়েছে কী? কাল দেখলাম একেবারে ভেঙে পড়েছে, এখন আবার গঙ্গাফড়িং-এর মতো ছটফট করছে!
‘আমি ঠিক জানি না, স্যার। মনে মনে হয়তো পালানোর মতলব এঁটেছে।’
‘ও, আচ্ছা!’ দাঁতে দাঁত চেপে লেগ্রি বলল। ‘ওর পালানোর মতলব আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি!’
চাবুক দোলাতে দোলাতে লেগ্রি টমের দিকে এগিয়ে গেল। ‘কি রে কুকুর, কাল তো নড়তেই পারছিলি না, আজ যে দেখছি একেবারে সোজা হয়ে হাঁটছিস?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
টমের উল্লসিত কণ্ঠস্বর লেগ্রিকে ক্রুদ্ধ করে তুলল এবং হাতের চাবুকটা দিয়ে সে টমকে নির্মমভাবে চাবুক মারতে লাগল।
কিন্তু টম আজ সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বিনীতভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো আঘাতই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসার পথে এই দৃশ্যটা বারবার লেগ্রিকে বিব্রত করে তুলতে লাগল। তার নিষ্ঠুর, অশুভ মনের গহনে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একটা সম্ভাবনার কথা। তার আর টমের মাঝে ঈশ্বর নিজে এমন আড়াল সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যেখানে কোনো চাবুক-আঘাত কিংবা নিষ্ঠুরতা দিয়ে সে আর ওই বিনীত মানুষটাকে কিছুতেই সায়েস্তা করতে পারবে না।
সেদিন রাত্রে, টমের ঘরের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে আর টম একা চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, হঠাৎ অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দেখল জানালায় কার যেন ছায়া পড়েছে। প্রথমটায় সে খুব অবাক হয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই কেসিকে চিনতে তার কোনো অসুবিধে হলো না। কেসি হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে বাইরে আসার কথা বলল।
টম বেরিয়ে এল। তখন গভীর রাত। চারদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সবকিছুকেই কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে, সব চাইতে রহস্যময় মনে হচ্ছে কেসির টানা টানা সুন্দর চোখ দুটোকে।
‘কী ব্যাপার মিসিস, এত রাতে?’
‘আস্তে টম চাচা, কেউ হয়তো শুনতে পাবে!’ ঠোঁটে আঙুল রেখে কেসি সতর্ক করে দিল, তারপর টমের হাত ধরে টানতে টানতে বলল তোমার সঙ্গে কয়েকটা জরুরি কথা আছে। এদিকে এসো, মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেসিকে অনুসরণ করে ওরা ঝাঁকড়া একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়াল।
‘আচ্ছা, তুমি স্বাধীনতা চাও না, টম চাচা?’
‘নিশ্চয়ই, চাই বইকি মিসিস। কিন্তু ঈশ্বরের কবে মর্জি হবে একমাত্র তিনিই জানেন।‘
‘ইচ্ছে করলে আজ রাতেই তুমি তা পেতে পার, টম চাচা।’ অদ্ভুত একটা দীপ্তিতে কেসির চোখ দুটো ঝিকমিক করতে থাকে। ‘এসো আমার সঙ্গে।’
টম ইতস্তত করল।
‘একি, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এসো।’ অপলক চোখে টমের দিকে তাকিয়ে কেসি চাপাগলায় বলল, ‘এখন ও গভীর ঘুমে একেবারে অচেতন। আমি ওর সুরার সঙ্গে খুব ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খিড়কির দরজাটা খুলে রেখে এসেছি। সেখানে একটা ধারালো কুড়ালও রাখা আছে। ওর শোবার ঘরের দরজাটাও খোলা। আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব। আমার হাত দুটো দুর্বল বলে তাই, নইলে কাজটা আমি একাই করতাম। এসো, টম চাচা।’
‘না মিসিস, না! কোনো শর্তেই আমি তা পারি না।’ কথাটা বলে টম অনড় একটা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
‘আমি শুধু তোমার বা আমার জন্যে বলি নি, টম চাচা। ইচ্ছে করলে আমরা সবাইকেই মুক্তি দিতে পারি। আমি শুনেছি এই জলাভূমি দিয়ে অনেকটা গেলে জঙ্গলে ভরা ছোট ছোট কতকগুলো নির্জন দ্বীপ আছে। সেখানে আমরা সবাই মিলে বাস করতে পারব। অন্তত এখানকার এই জীবনের চাইতে তা আদৌ খারাপ হবে না।’
‘না মিসিস, না!’ দৃঢ়স্বরে টম বলে উঠল। ‘অশুভ কিছু দিয়ে ভালো কাজ কখনো করা যায় না।’ বেশ, তাহলে আমি একাই করব।’
চলে যাবে কেসি, সবে পা বাড়িয়েছে, টম ওর পথ আগলে দাঁড়াল।
‘ঈশ্বরের দোহাই, মিসিস, আমার একটা কথা শোনো। তুমি ও কাজ কখনো কোরো না। শয়তানের অশুভ ইচ্ছার কাছে তোমার অমন মূল্যবান হৃদটাকে বিক্রি করে দিও না। তাতে ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু হবে না, হতে পারে না। সময় না আসা পর্যন্ত আমাদের প্রত্যেকেরই অপেক্ষা করা উচিত।’
‘অপেক্ষা!’ বিদ্রূপে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কেসির কণ্ঠস্বর। ‘আমি কি দীর্ঘ বিশটা বছর অপেক্ষা করে থাকি নি? অপেক্ষা করতে করতে কি আমার বুকের ভেতরটা জমে পাথর হয়ে যায় নি?’
‘আমি অস্বীকার করছি না, মিসিস।
‘তাহলে তুমি আমাকে আবার কিসের জন্যে অপেক্ষা করতে বলছ? ও কি আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে নির্যাতন করে নি? ও কি শত শত হতভাগ্য নিগ্রোদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে নি? ও কি তোমার দেহ থেকে প্রতিটা রক্তবিন্দু শুষে নেয় নি? এবার আমি ওর বুকের রক্ত দুহাতে মাখব।’
‘না, না, না মিসিস, না!’ কেসির নরম হাত দুটো নিজের শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরে টম আর্তস্বরে করুণ মিনতি করল। ‘তোমার কখনো এ কাজ করা উচিত নয়। যাতে তাঁর সন্তানদের কখনোও রক্ত ঝরাতে না হয়, সেই জন্যে ঈশ্বর নিজে তাঁর রক্ত ঝরিয়েছেন। উনি চান না আমরা নিজেরা নিজেদের রক্ত ঝরাই। আমরা যদি ওঁকে অনুসরণ করি, যারা আমাদের শত্রু তাদেরকেও যদি ভালোবাসি, উনি আমাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন।’
‘ওর মতো শত্রুকে ভালোবাসব!’ কেসি ঢেউ খেলিয়ে হেসে উঠল, অদ্ভুত সেই দীপ্তিতে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ দুটো।
গাঢ়স্বরে টম বলল, ‘হ্যাঁ মিসিস, উনি আমাদের সেই কথাই বলেছেন। আমরা যদি সবাই সবাইকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারি, এ পৃথিবীতে তাহলে আর কোনো যুদ্ধ, কোনো বিদ্বেষ, কোনো হানাহানি থাকবে না এবং সেটাই হবে প্রকৃত জয়, ঈশ্বরের প্রতি আমাদের গৌরবময় বিজয়!’
আকাশের দিকে চোখ দুটোকে মেলে দিয়ে এমন গভীর অথচ কোমলস্বরে টম কথাগুলো বলল যে তা কেসির বিক্ষুব্ধ হৃদয়কেও স্পর্শ না করে পারল না, মনে হলো ওর অবদমিত মনের গভীর ক্ষতে কে যেন শিশিরভেজা একটা হিমেল স্পর্শ বুলিয়ে গেল, নমিত হয়ে এল চোখের পাতা দুটো। নিজের মুঠোর মধ্যে টম স্পষ্টই অনুভব করতে পারল ওর নরম মাংসপেশি তখন অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে।
‘তুমি জানো না, টম চাচা’, বেদনাহত স্বরে কেসি বলল, ‘মাঝে মাঝে আমার বুকের মধ্যে কী যে কষ্ট হয় তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না।’
‘কিন্তু আমি তোমার জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করি মিসিস, তুমি বিশ্বাস করো। আবেগদীপ্ত স্বরে টম বলল। তার চোখের কোল বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা। ‘আমি জানি, তুমি যদি একবার তাঁকে স্মরণ করো, উনি তোমাকে সাহায্য করবেন, তুমি যদি নতজানু হয়ে একবার প্রার্থনা করো, উনি তোমাকে বুকে তুলে নেবেন।
সেই মুহূর্তে কেসি কোনো কথা বলতে পারল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আর আনত চোখের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
বেশ খানিকটা নীরবতার পর দ্বিধা জড়ানো স্বরে টম বলল, ‘আচ্ছা মিসিস, যদি সম্ভব হয়, এমিলিনকে সঙ্গে নিয়ে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যায় না? অর্থাৎ আমি কিন্তু কোনোমতেই রক্তপাত না ঘটিয়ে যাওয়ার কথা বলছি।’
কেসি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। ‘তাহলে তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে, টম চাচা?’
‘না, মিসিস। ঈশ্বর আমাকে এইসব হতভাগ্য মানুষদের মধ্যে পাঠিয়েছেন, আমি এদের মধ্যেই থাকব। শেষদিনটা ঘনিয়ে না আসা পর্যন্ত আমি এদেরই সঙ্গে ক্রুশকাঠটা বয়ে বেড়াব। কিন্তু তোমাদের কথা আলাদা, তোমাদের পক্ষে এ জায়গাটা নিঃসন্দেহে কুৎসিত। এমিলিনকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারলে সত্যিই খুব ভালো হতো।’
‘কবর ছাড়া আর কোথায় যাওয়া সম্ভব আমি নিজেই জানি না। এ পৃথিবীতে পশু পাখিদেরও একটা নিজস্ব আস্তানা আছে। এমন কী সাপ-কুমিরদেরও এমন একটা জায়গা আছে যেখানে ওরা দুদণ্ড শান্তিতে ঘুমাতে পারে। কিন্তু এ পৃথিবীতে কেবল আমাদের মাথা গোঁজবার কোনো ঠাঁই নেই। এমন কী অন্ধকার জলাতেও যদি পালিয়ে যাই, কুকুরগুলো আমাদের ঠিক খুঁজে বার করবে। এ পৃথিবীর সবাই, সবকিছুই আমাদের বিরুদ্ধে। এমন কী ওরই কুকুরগুলো পর্যন্তও আমাদের বিরুদ্ধে।’
‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আন্তরিক চেষ্টা করলে ঈশ্বর আমাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন।’
‘তুমি ঠিক বলছ, টম চাচা?’
‘হ্যাঁ, মিসিস। তোমাদের হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। আর একটা কথা, তোমাদের পক্ষে পালানোটা কিন্তু কিছু কঠিন নয় … যদি সঙ্গে কিছু টাকা থাকে।’
‘আমার বেশ কিছু জমানো টাকা আছে, টম চাচা।’
‘তাহলে তো খুব ভালোই হবে। তুমি জানো না মিসিস, প্রথম দিন তোমাকে দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর তোমাকে আমার কাছে না পাঠালে আমি তোমাকে কোনোদিনই চিনতে পারতাম না, ভাবতাম তুমি বুঝি সত্যিই কোনো শ্বেতাঙ্গ মহিলা। তাই বলছিলাম, তুমি যদি ফরাসি কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলার ছদ্মবেশে এখান থেকে চলে যাও কেউ তোমাকে ধরতে পারবে না। এমিলিন হবে তোমার পরিচারিকা। তোমার মেয়ে এলিজাও ঠিক এমনিভাবে চলে গিয়েছিল, কেউ ওকে চিনতে পারে নি।’
‘আমার মেয়ে, এলিজা!’ কেসি বিস্মিয়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
‘হ্যাঁ, মিসিস।
‘কেন তুমি ওকে চিনতে নাকি?’
‘শুধু চিনতাম না, ও ছিল আমার নিজের সন্তানের চাইতেও বড়। আমি ছিলাম ওর আদরের টম চাচা। আমার মনিবানি, মিসেস শেলবি, অসীম স্নেহ-যত্নে, শিক্ষা-দীক্ষায় এলিজাকে সেই সাত বছর বয়স থেকে নিজের মেয়ের মতো করেই মানুষ করেছিলেন। বিয়ে দিয়েছিলেন জর্জ নামে অত্যন্ত প্রতিভাবান সুন্দর একটি তরুণের সঙ্গে। হ্যারি নামে ওদের ফুটফুটে একটা বাচ্চাও আছে। আমার মনিবানির মতো মমতাময়ী মহিলা আমি জীবনে আর কখনো দেখি নি, তাই কোনো চাকর-বাকরকে উনি কখনো বিক্রি করতে চান নি। ঋণের দায়ে বাধ্য হয়ে কর্তা যখন হ্যারি আর আমাকে অন্য একটা লোকের কাছে বিক্রি করে দিলেন, জানতে পেরে এলিজা সেই রাতেই বাচ্চাটাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনাটা শুধু জানতাম আমি আর জানতেন মিসেস শেলবি। আমরা দুজনেই ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনা জানিয়েছিলাম যাতে ওরা কখনো ধরা না পড়ে। মাস্টার শেলবির চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম, ধরা ওরা পড়ে নি, ইরি হ্রদ অতিক্রম করে ওরা নির্বিঘ্নেই কানাডায় পৌঁছতে পেরেছিল। এলিজা এখন সুখে স্বামীর ঘর-সংসার করছে। যদি সম্ভব হয় তোমরাও কানাডায় পৌঁছে ওদের সঙ্গে মিলিত হতে পারো।’
ঘটনার আকস্মিকতায় কেসি যেন একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। অথচ এতদিনের যে সুপ্ত বাসনাটা তুচ্ছ একটা নুড়ির মতো পথের ধুলায় কেবলই পদদলিত হচ্ছিল, হঠাৎ তা যেন আবিষ্কৃত রত্নের মতো রাতের অন্ধকারে দ্যুতিময় হয়ে উঠল। পালাবার সমস্তরকম সম্ভাবনা আর সতর্কতার কথা কেসি বহুকাল আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল, কেবল উৎসাহের অভাবেই তা কখনো বাস্তব হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু এই মুহূর্তে অত্যন্ত সহজ, সম্ভাব্য একটা পরিকল্পনা ওর মাথায় এল এবং চকিতে ওর আশাকে উজ্জ্বল একটা আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলল।
হঠাৎ টমের হাত দুটো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে কেসি বলল, ‘তাহলে কি আমি সত্যিই চেষ্টা করব, টম চাচা?’
‘নিশ্চয়ই। ঈশ্বর তোমাদের সাহায্য করুন।’
‘বিদায়, টম চাচা।
‘বিদায় কেসি।’
৩১. শহীদ
কেসি আর এমিলিনের পালিয়ে যাওয়ার খবর সাইমন লেগ্রিকে অসম্ভব ক্রুদ্ধ করে তুলল। পরের দিন দুপুরে ঘুম ভাঙার পরেও প্রথমটায় সে কিছু আঁচ করতে পারে নি। কিন্তু প্রতিটা ঘর আর বাড়ির আশেপাশে বেশ খানিকক্ষণ খোঁজাখুজির পর যখন তার টনক নড়ল, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। প্রথমে সে খুব অবাক হলো, পরক্ষণেই প্রচণ্ড রাগে যেন টগবগ করে ফুটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে আবাদভূমিতে খোঁজ করল। যদি কোনো কারণে এখানে এসে থাকে। সেখানেও ওদের কোনো হদিশ পাওয়া গেল না।
ইতিমধ্যে কেসি আর এমিলিনের পালিয়ে যাওয়ার খবরটা সবাই জেনে ফেলেছে, চারদিকে শুরু হয়ে গেছে হইচই আর স্বতঃস্ফূর্তভাবেই খোঁজাখুজির পালা। দূর থেকে লেগ্রি লক্ষ করল, খবরটা শোনামাত্র টমের চোখ দুটো যেন খুশিতে ঝিকমিক করে উঠল, হাত দুটো ওপরে তুলে কার কাছে করুণা ভিক্ষে চাইল। খুঁজে বার করার কাজে যে-সব ক্রীতদাস নিজে থেকেই লেগ্রির দলে যোগ দিয়েছে, তাদের মধ্যেও সে টমকে দেখতে পায় নি। লেগ্রির ইচ্ছে হলো এক্ষুনি গিয়ে শয়তানটার কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে, কিন্তু গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা তাকে যেন সতর্ক করে দিয়ে বলল ওকে দিয়ে একাজ করানো যাবে না। তাই অহেতুক আর নতুন কোনো ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে সে দলবল নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল।
সুতরাং টম আর অল্প কয়েকজন, যাদের টম প্রার্থনা করতে শিখিয়েছিল, তারা নিজেদের আস্তানায় ফিরে এসে পলাতকরা যাতে ধরা না পড়ে তার জন্যে প্রার্থনা জানানোর অবকাশ পেল।
সন্ধ্যের পর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে লেগ্রি যখন ফিরে এল, হতাশার চাইতে টমের প্রতি ঘৃণায় তার সমস্ত অন্তর ভরে উঠল। টমের নিঃশব্দ প্রতিরোধই তাকে সব চাইতে বেশি উত্তেজিত করে তুলেছে। রাতে বিছানায় শুতে যাবার সময়ও সে নিজের মনে বলল, ‘আমি ওই কালো কুকুরটাকে ঘৃণা করি! ও আমার। আমি কি ওকে বারো শো ডলার দিয়ে কিনি নি? ওকে দিয়ে কি আমি যা খুশি তাই করাতে পারি না?’ লেগ্রি এমনভাবে হাতের মুঠো পাকালো যেন তার হাতে কিছু একটা আছে, যেটাকে সে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চায়। অবশ্য এ কথা ঠিক, মনে মনে টমকে ঘৃণা করলেও, লোকটা কিন্তু বিশ্বস্ত, কর্মী হিসেবে সত্যিই তার কোনো তুলনা হয় না। যেমন করে হোক তাকে নতজানু করাতেই হবে!
পরের দিন সকালে লেগ্রির নিজের দলবল ছাড়াও, আশেপাশের শহর থেকে প্রতিবেশী কয়েকজন আবাদকারী তাদের চাকর-বাকরদের নিয়ে হাজির হলো। দলের প্রথমেই রইল কয়েকজন ঘোড়সওয়ার। হাতে বন্দুক, সঙ্গে শিকলছাড়া ভয়ঙ্কর সেই কুকুরগুলো। সবাই তখন শিকারের নেশায় একেবারে উন্মাদ। লেগ্রি সাম্বোকে আগে থেকেই হুকুম করে রাখল কেসিকে ধরতে না পারলে যেন সোজা গুলি চালায়। তারপর উল্লাসে চিৎকার করতে করতে সমস্ত দলটা কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে জলার দিকে চলে গেল।
সারাটা দিন ব্যর্থ অনুসন্ধানে কেটে গেল। সন্ধ্যের সময় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে লেগ্রি ফিরে এল।
কবরের মতো থমথম করছে তার মুখটা। ঘোড়া থেকে নেমে সে সোজা বৈঠকখানায় চলে গেল। কুইম্বোকে বলল, ‘টমকে এক্ষুনি এখানে ডেকে নিয়ে আয়! এই ঘটনার মূলে আছে ওই শয়তানটা। আমি জানতে চাই আসল ব্যাপারটা কী।‘
সাম্বো আর কুইম্বো পরস্পরকে ঘৃণা করত, কিন্তু টমকে হিংসে করত ওরা দুজনেই। তাই বিপুল উল্লাসে ওরা টমকে ধরে নিয়ে এল। ‘চলো না বাছাধন, আজ তুমি মজাটা টের পাবে! কর্তা রেগে একেবারে আগুন হয়ে আছে!’
ব্যাপারটা টম আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাই ওদের কোনো উক্তিই তার কানে গেল না। সে তখন একমনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে। একসময় টম স্পষ্ট শুনতে পেল কে যেন বলছে, ‘ওদের কাউকে তুমি ভয় করো না, টম। ওরা কেবল তোমার দেহটাকেই খুন করতে পারে, তারপর ওরা তোমার আর কিছুই করতে পারবে না।’ ঈশ্বরের কোমল স্পর্শের মতো শব্দগুলো তাকে উদ্দীপ্ত করে তুলল, হাজার মানুষের শক্তিতে বলিষ্ঠ করে তুলল তার সত্তাকে। চীনাবীথি অতিক্রম করে আসার সময় এখানকার সবকিছুই তার কাছে কেমন যেন অবাস্তব মনে হলো, মানসচক্ষে নিজের আবাসভূমিটাকে সে পরিষ্কার দেখতে পেল, স্পন্দিত বুকে স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পারল, ঘনিয়ে এসেছে তার মুক্তির অন্তিম লগ্ন।
‘এই কুকুর’, পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে টমের কলারটা চেপে ধরে লেগ্রি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ঠিক করেছি তোকে খুন করে ফেলব।’
শান্তস্বরে টম জবাব দিল, ‘সম্ভবত তাই, স্যার।’ এমন নিস্পৃহতার লেগ্রি প্ৰচণ্ড ক্ষেপে গেল। ‘নিশ্চয়ই তাই করব, যদি না বলিস ওরা কোথায়।’
টম কোনো জবাব দিল না।
‘কি রে কুকুর, কানে শুনতে পাচ্ছিস না?’ আগেরই মতো শান্তস্বরে, খুব ধীরে ধীরে টম উচ্চারণ করল।
‘বল, তুই কিচ্ছু জানিস না?’
টম নীরব।
‘কি রে, জবাব দিচ্ছিস না যে?’ সজোরে চাবুক কষিয়ে লেগ্রি ধমকে উঠল, ‘তুই কিছু জানিস না?’
‘হয়তো কিছু জানি, কিন্তু বলতে পারব না।’
প্রচণ্ড ক্রোধে লেগ্রির শ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে এল। দুহাতে টমকে ধরে নিজের মুখের কাছে এনে, ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, ‘সেবার তোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে কি ভেবেছিস এবারেও তুই পার পেয়ে যাবি? কখনো না! এবার তোকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। হয় আমি জিতব নয় তোকে খুন করে ফেলব, দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা। তোর শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু গুণে গুণে একেবারে নিঃশেষ করে তবে ছাড়ব।’
‘স্যার, আপনি যদি অসুস্থ হতেন, আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যদি আপনার মূল্যবান প্রাণটাকে বাঁচানো সম্ভব হতো, আমি সানন্দে তা দিতাম, যেমন ঈশ্বর স্বেচ্ছায় আমার শরীরে দিয়েছেন তাঁর প্রতিটা রক্তবিন্দু। আমি খুবই তুচ্ছ, তবু আমার অনুরোধ স্যার, আপনি নিজে থেকে এই জঘন্য পাপ কাজটা করবেন না। এতে আমার চাইতে আপনারই বেশি কষ্ট হবে এবং যত দিন না অনুতপ্ত হবেন, আপনি কোনোদিনই মুক্তি পাবেন না।’
টমের কথা বলার ভঙ্গিতে, তার শান্ত সৌম্য মূর্তিতে, তার স্থির চোখের দৃষ্টিতে এমন অলৌকিক একটা কিছু ছিল, যা মুহূর্তের জন্যে লেগ্রিকে বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত করে দিল। নীরবতার সেই মুহূর্তে পুরনো দেওয়ালঘড়ির টিক টিক শব্দটাও স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই লেগ্রির অশুভ আত্মাটা যেন জেগে উঠল আর সাতটা মানুষের ক্রোধ একসঙ্গে ফেটে পড়ল প্রচণ্ড আক্রোশে, বিধ্বস্ত করে দিল টমের সৌম্য মূর্তিটাকে।
তারপর রক্ত আর নিষ্ঠুরতায় যে দৃশ্যের অবতারণা হলো, নিজের চোখে দেখা বা শোনা তো দূরের কথা, কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করে নেওয়াও সম্ভব নয়। আর আমি যদি তোমাদের সে কথা বলি, তোমরা নিশ্চয়ই আতঙ্কে শিউরে উঠবে। তবু এই নিষ্ঠুর বর্বরতাকে আমাদের দেশের আইন তার নিবিড় পক্ষপুটে ঢেকে রাখে, আমাদের দেশের গির্জা নীরবে তাকে সমর্থন করে!
সেই নির্জন রাত্রে, লেগ্রির বৈঠকখানায়, টমকে বাঁচানোর আর কেউ ছিল না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার যন্ত্রণা, তার লজ্জা, তর আত্মঅবমাননা, সে কি শুধু তার একার, আর কারো নয়? নিশ্চয়ই, আর একজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যিনি নিজেও রক্তাক্ত আর নির্যাতিত হচ্ছিলেন, নইলে টমের যন্ত্রণা এমন গৌরবময়, টমের অস্তিত্ব কখনো এমন ভাস্বর হয়ে উঠতে পারত না।
লেগ্রি, সাম্বো আর কুইম্বো, তিন জনে পালা করে চাবকে যাওয়া সত্ত্বেও ঝড় তখনো থামে নি, ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসে উঠছে, আছড়ে পড়ছে, তীক্ষ্ণ স্বননে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে নিষ্পাপ অপরাধীর সর্বাঙ্গ; অথচ দুঃসাহসী মানুষটার প্রকৃত হৃদয় তখনো শক্ত করে আঁকড়ে রয়েছে সেই চিরন্তন পাথরটাকে। যিশুর মতো টমও উপলব্ধি করতে পেরেছে, অন্যদের বাঁচাতে গেলে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
রক্তাপুত, নির্যাতিত মানুষটার ধৈর্য দেখে একসময়ে সাম্বো নিজে বিচলিত হয়ে উঠল, সভয়ে বলল, ‘স্যার, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এবার ছেড়ে দিন!’
‘চালা, চালা, সোজা চাবুক চালিয়ে যা!’ খ্যাপা ষাঁড়ের মতো লেগ্রি চেঁচিয়ে উঠল। ‘যতক্ষণ না নিজে মুখে স্বীকার করছে, ওর আর নিস্তার নেই। ওর প্রতিটা রক্তবিন্দু আমি নিঙড়ে নিয়ে তবে ছাড়ব।’
ধীরে ধীরে চোখ মেলে টম মনিবের মুখের দিকে তাকাল। ‘সত্যিই আপনি হতভাগ্য! এখন আপনি আমার আর কিছুই করতে পারবেন না। আপনাকে আমি সর্বান্তকরণে ক্ষমা করে গেলাম!’
কথাটা বলেই টম অচৈতন্য হয়ে পড়ল।
‘যাক, এতক্ষণে আপদটা বিদায় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে!’ দুপা এগিয়ে এসে লেগ্রি একটু ঝুঁকে টমের দিকে তাকাল। ‘হুঁ! এবার আর কিছু না হোক, ওর মুখটা অন্তত বন্ধ হবে। সেটাও এক দিক থেকে স্বস্তি!’
হ্যাঁ, একদিক থেকে কথাটা সত্যি হলেও, জীবনে এই যে প্রথম বুকের ভেতরে জ্বলন্ত ক্রোধের লেলিহান শিখাটাকে নেভাতে পারল না, এই পরাজয়ের গ্লানির হাত থেকে তুমি কি সত্যিই কোনোদিন স্বস্তি পাবে, লেগ্রি?
সাময়িকভাবে মনে হলেও, টম কিন্তু সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় নি। তার শেষের কথাগুলো নিষ্ঠুরতার হাতিয়ার হিসেবে যারা এতক্ষণ সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, সেই বর্বর কালো মানুষ দুটোর হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেল। লেগ্রি ওপরে উঠে যেতেই, ওরা টমের অচৈতন্য দেহটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল, যেন টমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়াটা ওদের নিতান্তই প্রয়োজন।
সাম্বো বলল, ‘এর জন্যে সত্যিকারের শাস্তি মনিবেরই পাওয়া উচিত, আমাদের নয়।‘
‘আমরাও অপরাধী। টমের কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।‘
দুজনে মিলে টমের ক্ষতস্থানগুলো ধুইয়ে মুছিয়ে পরিষ্কার করল, তারপর ছেঁড়া ন্যাকড়া আর তুলোর বস্তা দিয়ে শয্যা পেতে ধরাধরি করে তাকে শুইয়ে দিল। তাক থেকে ব্র্যান্ডির বোতলটা পেড়ে জলের সঙ্গে খানকটা মিশিয়ে সাম্বো টমের গলায় ঢেলে দিল।
‘টম, শোনো, টম!’ আস্তে আস্তে কুইম্বো তাকে নাড়া দিল। ‘আমাদের কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ?’
একসময় যেন ঘুমের অতল থেকে টম ধীরে ধীরে চোখ মেলল।
‘আমরা সত্যিই তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি, টম।’
ক্ষীণস্বরে টম বলল, ‘আমি তোমাদের মনেপ্রাণে ক্ষমা করলাম ভাই। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।
‘আগে করতাম না। কিন্তু এখন তোমাকে বিশ্বাস করি।’ আগ্রহভরে সাম্বো বলল।
‘আমি বিশ্বাস করি, তুমি বললে ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করবেন।‘
‘তোমরাও যদি ওঁর কাছে কখনো প্রার্থনা করো, উনি নিজে তোমাদের বুকে টেনে নেবেন।‘
টমের নিষ্কলুষ, বেদনার্ত কণ্ঠস্বরে বন্য মানুষ দুটোরও চোখে জল এসে গেল।
৩২. জর্জ শেলবি
এই ঘটনার দুদিন পর, চীনাবীথির মধ্যে দিয়ে সুন্দর একখানা এক্কা এসে থামল গাড়িবারান্দার নিচে। লাগামজোড়া ঘোড়ার পিঠের ওপর ছুড়ে দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে এল ভারি সুন্দর দেখতে একজন তরুণ। সে প্রথমেই গৃহস্বামীর খোঁজ করতে লাগল।
এই তরুণটি আমাদের পূর্বপরিচিত জর্জ শেলবি। কেমন করে সে এখানে এসে পৌছল, সে কাহিনী শোনাতে গেলে আমাদের কেন্টাকিতে ফিরে যেতে হবে।
মিসেস শেলবিকে লেখা মিস ওফেলিয়ার চিঠিটা দুর্ভাগ্যবশত পাড়াগাঁয়ের কোনো ডাকঘরে মাস দুয়েকের জন্যে আটকে পড়েছিল, তারপর যখন নির্দিষ্ট ঠিকানায় এসে পৌঁছল, টম তখন রেড নদীর জলাভূমি অঞ্চলে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
চিঠিখানা পড়ে মিসেস শেলবি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওঁর কিছু করার ছিল না। মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর শয্যার পাশে ওঁকে প্রায় সারাক্ষণই আটকে থাকতে হতো। ওঁর শুধু একটাই মাত্র সান্ত্বনা। কিশোর জর্জ এখন পরিণত যুবক, মার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত এবং প্রয়োজনে বাবার সবরকম কাজেই ওঁকে সাহায্য করে। মিস ওফেলিয়া সৌভাগ্যবশত সেন্ট ক্লেয়ারের হয়ে যিনি সম্পত্তি দেখাশোনা করছিলেন, তাঁর নাম-ঠিকানাটাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু মিস্টার শেলবির আকস্মিক মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিক এবং সম্পত্তিগত নানান জটিলতায় মিসেস শেলবিকে অসম্ভব ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। কেননা নিপুণ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও মিসেস শেলবি বা জর্জ কেউই দেনার ব্যাপারটাকে আদৌ শোভন চোখে দেখতে পারেন নি। তাই কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে সমস্ত ব্যাপারটাকে আয়ত্তে আনতেও তাঁদের বেশ কিছু সময় লেগেছিল।
ইতিমধ্যে আইনজীবী যে ভদ্রলোক সেন্ট ক্লেয়ারের সম্পত্তি দেখাশোনা করছিলেন, তাঁকে লেখা একটা চিঠির জবাবে জানা গেল, টমের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিছু জানেন না, কেননা সবাইকে একসঙ্গে সরকারি নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনবোধে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয় ভেবে জর্জ নিজেই মার অনুমতি নিয়ে টমের খোঁজে নিউ অর্লিয়েন্সের পথে পাড়ি জমাল। প্রথমে সে শুধু এইটুকু জানতে পারল, নিলাম থেকে বিক্রি হয়ে যাবার পর আমাদের এই কাহিনীর নায়ককে রেড নদীতে স্টিমারে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু কোথায় তা কেউ বলতে পারল না। অবশেষে পয়সা দিয়ে লোক লাগিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর জর্জ শেলবি আজ এখানে এসে পৌছেছে।
অচিরেই তাকে গৃহস্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রায় মাতাল অবস্থায় সাইমন লেগ্রি তখন ঘাড় গুঁজে বসে রয়েছে তার বার-বাড়ির বৈঠকখানায়।
‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনিই মিস্টার সাইমন লেগ্রি?’
আগন্তুককে দেখে লেগ্রি খুবই অবাক হলো।
‘হ্যাঁ। কী চাই বলুন?’
‘আমি শুনেছি নিউ অর্লিয়েন্সের সরকারি নিলাম থেকে আপনি টম নামে একজন ক্রীতদাসকে কিনেছিলেন। একসময় সে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। যদি তাকে কিনে নেওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যেই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
ক্রোধে, বিস্ময়ে লেগ্রির ঝাঁকড়া ভ্রূদুটো আপনা থেকেই বেঁকে একেবারে ধনুক হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে কোনোরকমে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ওকে কিনেছিলাম বটে। রীতিমতো ভালো পয়সা দিয়েই কিনেছিলাম। কিন্তু ওই কালো কুকুরটা এমন পাজির পা- ঝাড়া যে ওর জন্যেই আমার দুটো ক্রীতদাসীকে হারাতে হয়েছে। আজকের দিনে যার দাম খুব কম করেও হাজার ডলার! টম সবকিছু জানত এবং ও-ই ওদের পালাতে সাহায্য করেছে। আমি যখন এ ব্যাপারে ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, শয়তানটা কী বলল জানেন? বলল, আমি জানি, কিন্তু বলব না! তখন আমি রাগের মাথায় এমন চাবকালাম যে বাছাধন এখন আর নড়তেই পারছে না। আমি সাধারণত চাকর-বাকরদের কখনো কিছু বলি না, কিন্তু ওটা এমনই গোঁয়াড় যে …’
ধৈর্য হারিয়ে জর্জ বলে উঠল, ‘ও কোথায়? আমি কি ওকে একবার দেখতে পারি?’
সেই মুহূর্তে লেগ্রি কোনো জবাব দিল না।
আবেগে, উদ্বিগ্নতায় জর্জের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল, তবু মুখে সে কিছু বলল না।
যে ছেলেটি জর্জের ঘোড়া ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, উল্লাসে বলে উঠল, ‘ওই চালা ঘরটাতে রয়েছে।
লেগ্রি ছেলেটাকে লাথি মেরে, গালাগালি দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল। জর্জ কিন্তু অপেক্ষা না করে দ্রুতপায়ে সেই চালা ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল।
রক্তাক্ত সেই ঘটনার পর থেকে দুদিন টম প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় এই চালা ঘরটাতে পড়ে রয়েছে। তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও শক্তিশালী, বলিষ্ঠগঠন দেহের খাঁচা থেকে প্রাণপাখিটা তখনো উড়ে যায় নি। টমের জল্লাদরাই রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি এসে তার সেবা-শুশ্রূষা করেছে, তাকে জল খাইয়েছে। প্রকৃত ভালোবাসার স্পর্শ পেয়ে টম দু-একবার ওদের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি।
চালায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই জর্জের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, হৃদপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। মুমূর্ষু মানুষটার প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতায়, অনুশোচনায় তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। এখানে নাম ছাড়া যে মানুষটার সম্পর্কে কেউ আর প্রায় কিছুই জানে না, তার এই শোচনীয় পরিণতিতে দুঃখ বা কষ্টের চাইতে নিজেকে তার সবচেয়ে বেশি অপরাধী মনে হলো। অনুতাপে বেদনায় জর্জের সংবেদনশীল সুন্দর মুখখানা তখন একেবারে কালো হয়ে গেছে।
‘হা, ঈশ্বর; এও কি সম্ভব!’ টমের পাশে নতজানু হয়ে জর্জ মৃদুভাষে ডাকল, ‘টম চাচা, দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু আমার!’
জর্জের কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার একেবারে মর্মস্থলে গিয়ে বিধল। ধীরে ধীরে মাথাটা একপাশে হেলিয়ে টম ম্লান ঠোঁটে হাসল।
জর্জ একটু ঝুঁকে আসতেই দুফোঁটা উষ্ণ অশ্রু ঝরে পড়ল পৌরুষদ্বীপ্ত, বলিষ্ঠ, কালো মানুষটার বুকের ওপর, যেন ওদুটো তার শেষ সম্মানের প্রতীকচিহ্ন।
‘টম চাচা! প্রিয় টম চাচা আমার! তাকিয়ে দেখ, একবার শুধু কথা বলো! দেখো, আমি তোমার মাস্টার জর্জ … তোমার সেই আদরের ছোট্টো মাস্টার জর্জ! আমায় তুমি চিনতে পারছ না?’
‘মাস্টার জর্জ!’ আস্তে আস্তে চোখ মেলে অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে টম বলল। ‘মাস্টার জর্জ!’
একটু একটু করে বিহ্বলতা কাটিয়ে তার অন্তর যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল, ফিরে এল চোখের দীপ্তি। নির্নিমেষ চোখে জর্জের দিকে তাকাতেই তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চিবুক বেয়ে গাড়িয়ে এল অশ্রুধারা।
‘ঈশ্বরের অসীম কৃপা, উনি আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমি জানতাম আমি জানতাম ওঁরা আমাকে ভোলেন নি! আঃ, এখন যে আমার কী ভালো লাগছে। এবার আমি শান্তিতে মরতে পারব! ঈশ্বর, আমাকে তুমি করুণা করো!’
‘তুমি মরবে না, টম চাচা! আমি তোমাকে কিছুতেই মরতে দেব না। আমি তোমাকে কিনে নেওয়ার জন্যে এসেছি। আমি তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে এসেছি, টম চাচা।’ আবেগদীপ্ত স্বরে জর্জ বলল।
‘ও, মাস্টার জর্জ, তুমি বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছ। ঈশ্বর আমাকে কিনে নিয়েছে। উনিই আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। সেখানে যাবার জন্যে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কেন্টাকির চাইতে স্বর্গ অনেক ভালো।’
‘না টম চাচা, না! তুমি মরো না। তুমি মারা গেলে আমার বুক ভেঙে যাবে। যখনই ভাবব অত্যন্ত সাধারণ একটা চালা ঘরের নিচে, কী নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, হতভাগ্য …’
‘না না, মাস্টার জর্জ, আমাকে হতভাগ্য বলো না!’ শান্তস্বরেই টম বলল। ‘অতীতে এক সময় হতভাগ্য ছিলাম, কিন্তু এখন আমি আর হতভাগ্য নই। এখন আমি পৌঁছে গেছি অনন্তের সেই সিংহতোরণে, মাস্টার জর্জ! স্বর্গ এসেছে আমায় নিতে। আজ আমি জয়ী। ঈশ্বরই আমাকে তা দিয়েছেন।’
কাটা কাটা হলেও, শব্দগুলোর মধ্যে এমন একটা গভীর আবেগ আর শ্রদ্ধা জড়ানো ছিল যা তরুণ শেলবিকে বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত করে দিল। টমের বিশীর্ণ অথচ উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে সে চুপচাপ বসে রইল।
জর্জের একটা হাত আঁকড়ে ধরে টম বলে চলল, ‘আমার এখানকার এই অবস্থার কথা ক্লোকে কিছু বোলো না। ওর বুক ভেঙে যাবে। ওকে শুধু বোলো আমি আর অপেক্ষা করতে পারি নি, তাই চলে গেছি অনন্তের দিকে। আর ওকে বোলো ঈশ্বর সারাক্ষণই আমার পাশে পাশে ছিলেন এবং উনি সবকিছুকেই খুব সহজ আর আলোকিত করে রেখেছিলেন। শুধু মাঝে মাঝে আমার ছেলে-মেয়েগুলোর জন্যে অন্তর কেঁদেছে! ওদের বোলো ওরা যেন আমাকেও কখনো ভুলে না যায়। মাস্টার, মিসিস আর ওখানকার সবাইকে আমার ভালোবাসা জানিও। ওদেরকে বোলো এ পৃথিবীর প্রতিটা মানুষকেই আমি ভালোবাসি।’
‘উঃ, ওই লেগ্রি শয়তানটাকে আমি যদি গলা টিপে শেষ করে দিতে পারতাম!’ দাঁতে দাঁত চেপে জর্জ অস্ফুট স্বরে বলল।
জর্জের হাতটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে টম বলল, ‘না, জর্জ, না। ও কথা বোলো না!’
‘কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি টম চাচা, এর মূল্য ওকে একদিন কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে দিতে হবে!
‘সত্যিই ও খুব হতভাগ্য, জর্জ। একবার অনুতপ্ত হলে ঈশ্বর ওকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে ও কোনোদিনই তা করবে না।’
‘না করাই ভালো’, ক্ষুব্ধস্বরে বলল, ‘আমি ওকে কোনোদিনও স্বর্গে দেখতে চাই না!’
টম ম্লান ঠোঁটে হাসল, ‘ও যে আমার কী উপকার করেছে, তুমি জানো না, জর্জ। ও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি, বরং স্বর্গের দুয়ারটাকে আমার জন্যে আরো তাড়াতাড়ি খুলে দিয়েছে!’
জর্জ শেলবিকে চিনতে পারার মুহূর্ত থেকে ভেতরের যে চাপা দীপ্তিটা এতক্ষণ টমের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ছিল, সহসা তা যেন নিভে গেল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল ম্লানিমার একটা ছায়া, ধীরে ধীরে বুজে গেল চোখের পাতাদুটো। এখন টমকে খুব কষ্ট করে টেনে টেনে শ্বাস নিতে হচ্ছে, অসম্ভব দ্রুত ওঠা-নামা করছে চওড়া বুকটা। একসময় তাও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল খুবই অস্পষ্ট একটা হাসির রেখা। মুখ থেকে ম্লানিমার গাঢ় ছায়াটা সরে গিয়ে ফুটে উঠল সৌম্য একটা প্রশান্তি। আর ঠিক তখনই চোখ দুটোকে পরিপূর্ণভাবে মেলে দিয়ে টম অস্ফুটস্বরে শুধু বলল, ‘হা, ঈশ্বর!
তারপরেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে চিরনিদ্রায় ডুবে গেল।
জর্জ এতক্ষণ টমের হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে স্থাণুর মতো বসেছিল, এবার টমের চোখের পাতাদুটো বন্ধ করে দিয়ে জর্জ উঠে দাঁড়াল। বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে অদূরে লেগ্রির রুক্ষ মূর্তিটা দেখতে পেল। ওকে দেখেই প্রচণ্ড ক্রোধে, ঘৃণায় জর্জের সারা শরীর রি রি করে উঠল। তবু কোনোরকমে নিজেকে সামলে রেখে, তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জর্জ বলল, ‘আপনার যা করার ছিল, সবই তো করা হয়ে গেছে। এখন ওই দেহটার জন্যে কত দিতে হবে? আমি ওকে ভদ্রভাবে কোথাও কবর দিতে চাই।’
‘মরা নিগ্রো আমি বেচি না। আপনি ওকে নিয়ে গিয়ে যেখানে খুশি, যেমন খুশি কবর দিতে পারেন।’
টমের মৃতদেহটাকে ঘিরে তখন দু’তিন জন নিগ্রো দাঁড়িয়ে ছিল। জর্জ সেখানে গিয়ে ওদের বলল, ‘দেহটাকে গাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে একটু সাহায্য করো না, ভাই। আর তোমরা যদি কেউ আমাকে একটা কোদাল দিতে পারো খুব ভালো হয়।’
খুশি হয়ে ওরা জর্জের সঙ্গে ধরাধরি করে টমের দেহটা গাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এল, অন্য একজন ছুটল কোদাল আনতে। জর্জ কোটটা খুলে আসনের ওপর বিছিয়ে দিল, ওরা মৃতদেহটা শুইয়ে দিল তার ওপর।
বৈঠকখানার সামনে এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে লেগ্রি আপন মনে চুরুট ফুঁকছিল, জর্জ ওর দিকে ফিরে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘নৃশংস এই ঘটনার জন্যে আমি এখনো পর্যন্ত আপনাকে একটা কথাও বলি নি, কথা বলার উপযুক্ত জায়গা বা সময়ও এটা নয়। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, নিষ্পাপ, সরল এই মানুষটার রক্ত আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না। খুনের অভিযোগে আমি আপনার নামে আদালতে নালিশ করব। আপনার ভালোমানুষির মুখোশ আমি টেনে খুলে দেব।’
‘আপনার যা খুশি তাই করতে পারেন।’ অবজ্ঞার ভঙ্গিতে লেগ্রি পোড়া চুরুটের শেষ অংশটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল। ‘আদালতে অভিযোগ করে কোনো ফল হবে না। আশেপাশে এমন একজনও শ্বেতাঙ্গকে যোগাড় করতে পারবেন না, যিনি আপনার হয়ে সাক্ষী দেবেন। আর দক্ষিণের এই আদালতগুলোর কোনোটাতেই নিগ্রোদের সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। সুতরাং আপনি আমার কিছু করতে পারবেন না। তাছাড়া মরা একটা কুকুরের জন্যে মিছেমিছি এত হইচই করেই বা আপনার কী লাভ?’
ছোট্ট একটা শব্দ যেন জর্জের চাপা ক্রোধের বারুদে আগুন ধরিয়ে দিল, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল তার শিরার প্রতিটা রক্তবিন্দু। চকিতে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল লেগ্রির চোয়ালে। চরকির মতো একপাক ঘুরে লেগ্রি সজোরে আছড়ে পড়ল মাটিতে 1 অসম্ভব রাগে কাঁপতে কাঁপতে জর্জ বলল, ‘আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করলে আমি জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেব!
আঘাতের তীব্রতায় লেগ্রি সেই মুহূর্তে মাটি ছেড়ে উঠতে পারল না। দু-তিন জন নিগ্রো ক্রীতদাস, যারা খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, তারা কেউই এগিয়ে এসে লেগ্রিকে সাহায্য করল না, বরং বীরের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গিয়ে জর্জ চালকের আসনে বসল। গাড়িটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। নিগ্রো ক্রীতদাসরা নীরবে গাড়িটাকে অনুসরণ করল।
কোট থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সাইমন লেগ্রি যখন উঠে দাঁড়াল, গাড়িটা তখন পথের বাঁকে হারিয়ে গেছে।
আবাদের সীমানা ছাড়িয়ে জর্জ শুকনো বালির ছোট একটা টিলা দেখতে পেল। টিলাটা ঝাঁকড়া কয়েকটা গাছের সুন্দর ছায়া দিয়ে ঘেরা। টমকে কবর দেওয়ার জন্যে জর্জ মনে মনে ওই টিলাটাই বেছে নিল।
নিগ্রো ক্রীতদাসেরা স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে চাওয়া সত্ত্বেও জর্জ নিজে হাতে কবরটা খুঁড়ল। সবকিছু প্রস্তুত করার পর টমকে নিয়ে আসার জন্যে ওরা তাকে সাহায্য করল।
‘কোটটা কী করব, মাস্টার?’
‘না না, ওটা থাকবে! ওটাসহ ওকে কবর দাও। আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারি নি, ওটা তোমার কাছেই থাক, টম চাচা!’
কোটটা জর্জ টমের বুকের ওপর বিছিয়ে দিল, তারপর সবাই মিলে মাটি চাপা দিতে লাগল। সব কাজ সারার পর ওরা সবুজ ডালপালা ভেঙে কবরটার ওপর বিছিয়ে দিল।
ওদের প্রত্যেকের হাতে কয়েকটা নোট গুঁজে দিয়ে জর্জ বলল, ‘তোমাদের বিশ্বস্ততার পুরস্কার।’
‘ঠিক আছে, এবার যাও।’
ওরা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে চলে গেল।
কবরটার সামনে জর্জ নতজানু হয়ে বসল, অশ্রুবিহীন চোখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ‘তোমার জন্যে আমি প্রতিজ্ঞা করছি, দেশ থেকে অভিশপ্ত এই ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদ করার জন্যে একটা মানুষের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব আমি তাই করব।’
আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধুর শেষ বিশ্রামের স্থানটুকু চিহ্নিত করে রাখার জন্যে কোনো স্মৃতি সৌধই গড়ে তোলা হয় নি। তার কোনো প্রয়োজনও ছিল না! ঈশ্বর জানেন সে এখন কোথায় শুয়ে রয়েছে। যখন প্রয়োজন হবে উনি নিজেই এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আর যে মানুষটা সারাজীবন একাই ভারী ক্রুশকাঠিটা বয়ে নিয়ে বেড়াল, তার জন্যে দুঃখ করার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা “তার দুঃখও ঈশ্বরের আশীর্বাদে পরম রমণীয় হয়ে থাকবে।”
৩৩. স্বাধীন
কেবল একটা মাত্র লাইনেই জর্জ শেলবি মাকে চিঠিতে জানিয়েছিল অমুক তারিখে বাড়ি পৌঁছব। টমের আকস্মিক মৃত্যুতে সে এমনই মুষড়ে পড়েছিল যে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও গুছিয়ে কিছু লিখতে পারে নি। তার ওপর চোখের জলেও বেশ কয়েকটা কাগজ তাকে নষ্ট করতে হয়েছে। আসলে মাকে কিছু একটা জানাতে হবে তাই, নইলে কাগজ- কলম নিয়ে বসার কোনো মানসিকতাই তার ছিল না।
এদিকে, শেলবি-ভবনে সারাদিন ব্যস্ততার আর অন্ত নেই। জর্জ শেলবির এসে পৌঁছনোর অপেক্ষায় সবাই উন্মুখ।
মিসেস শেলবি বসে রয়েছেন ওঁর সুন্দর সাজানো ভেতরের বসার ঘরটায়। প্রায় সন্ধ্যে তখন। শেষ শরতের ঠাণ্ডাকে দূর করার জন্যে মনোরম আগুন জ্বালানো হয়েছে। খাবার টেবিলে সাজানো রয়েছে ঝকঝকে বাসনপত্র। ক্লো-চাচি নিজের হাতে সবকিছু সাজিয়ে- গুছিয়ে রেখেছে।
ক্লো-চাচি আজ সাদা ক্যালিকো কাপড়ের নতুন পোশাকটা পরেছে, মাথার চূড়ো করা চুলের ওপর একটা পাগড়ি বেঁধেছে। খুশিতে ঝিকমিক করছে ওর কালো মুখখানা। টেবিলটা সাজানো প্রসঙ্গে মনিবানিকে কিছু জিজ্ঞেস করার সময় স্পষ্টই বোঝা গেল, ভেতরের চাপা উত্তেজনাটাকে ও যেন কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না। বার বার ওর চোখ গিয়ে পড়ছে বাইরের গাড়ি বারান্দার ওপর।
‘মাস্টার জর্জের জন্যে আমি সবচেয়ে ভালো আসনটা সাজিয়ে রেখেছি। আমি জানি বরাবর ওর আগুনের কাছটাই বেশি পছন্দ। কিন্তু স্যালি সবচেয়ে ভালো চায়ের পাত্তরটা কেন বার করল না। যেটা বড়দিনের সময় মাস্টার জর্জ মিসিসের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল? যাই বলেন মিসিস, আমি কিন্তু ওটাই বার করছি।’
মিসেস শেলবি ছোট্ট করে শুধু বললেন, ‘আচ্ছা।’
‘মাস্টার জর্জ আজ আসবে ঠিক বলেছে তো?’
‘হ্যাঁ, ক্লো।’
‘আচ্ছা মিসিস, টমের কথা মাস্টার জর্জ কিছু লেখে নি?’
‘না, ক্লো। আমার মনে হয় সময়ের অভাবে ও বেশি কিছু লিখতে পারে নি। শুধু লিখেছে আজ পৌঁছবে। বাড়ি এসে সব বলবে।
‘মাস্টার জর্জ বরাবর ওই একইরকম! সবকিছু সবাইকে নিজে মুখে শোনাতে ভালোবাসে।’
ক্লোর কথা শুনে মিসেস শেলবি মুচকি মুচকি হাসলেন।
‘সারাদিন আমি খালি একটা কথাই ভাবছি, মিসিস, বুড়ো মানুষটা ঘরে ফিরে হয়তো তার নিজের ছেলে-মেয়েদেরই চিনতে পারবে না! পলি তো এখন রীতিমতো বড় হয়ে গেছে, ও এখন আর মুখচোরা সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই। বাবা কেক ভালোবাসে জেনে নিজে হাতে বানিয়ে রেখেছে।’
মিসেস শেলবি মনে মনে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করলেন। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই ওঁর মন বলছিল, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো অঘটন ঘটছে, নইলে এই ধরনের নীরবতার সত্যিই কোনো কারণ ছিল না।
‘আচ্ছা, মিসিস, মাস্টার জর্জ সঙ্গে টাকা নিয়ে গিয়েছিল তো?’
‘হ্যাঁ, ক্লো। তোমার জমানো টাকা ছাড়াও আমি ওর কাছে আরো বেশি টাকা দিয়েছিলাম।’
‘আমি বরং এই বেলা মাস্টার জর্জের জন্যে চায়ের পাত্রটা বার করে রাখি।’
ফিরে যেতে গিয়েও ক্লোর আর যাওয়া হলো না, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেল। ‘ওই তো মাস্টার জর্জ এসে গেছে!
মিসেস শেলবি উঠে গেলেন। পরক্ষণেই ছেলেকে দেখা গেল মার বুকের মধ্যে। খোলা দরজা দিয়ে ক্লো-চাচি উদ্বিগ্ন-চোখে তাকাল অন্ধকারের দিকে।
‘তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ক্লো-চাচি!’ ক্লোর শক্ত হাত দুটো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে জর্জ বলল, ‘সত্যিই আমি টম চাচাকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ও আমাদের চাইতে অনেক সুন্দর একটা দেশে চলে গেছে
মিসেস শেলবি উচ্চকিত স্বরে কেঁদে উঠলেও ক্লো কিন্তু একটা কথাও বলল না।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জর্জ নোটের তোড়াটা রেখে দিল খাবার টেবিলের ওপর। এতদিন যে নোটগুলো সম্পর্কে ক্লোর বুক গর্বে ফুলে উঠত, এখন সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না।
কোনো কথা না বলে ক্লো মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মিসেস শেলবি ওর হাত ধরে টেনে এনে চেয়ারে বসালেন, নিজেও বসলেন ওর পাশের চেয়ারটায়।
‘তোমাকে কী বলে সান্ত্বনা দেব, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ক্লো!’ ওঁর মসৃণ চিবুক বেয়ে তখন অঝোরে ঝরে পড়ছে চোখের জল।
‘আমি জানতাম এমনটা যে ঘটবে আমি জানতাম, মিসিস! আমি জানতাম ওকে আর কোনোদিনও দেখতে পাব না, ওর কথা শুনতে পাব না! কাউকে একবার বিক্রি করা হয়ে গেলে সে আর কোনোদিনও ফিরে আসে না!’
ক্লোর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মিসেস শেলবি বললেন, ‘শোনো, ক্লো …’
‘ও মিসিস, আমি আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না, আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে!’
‘আমি জানি, ক্লো। স্বামী হারানোর ব্যথা আমি বুঝি। অশ্রুসজল চোখে, সমবেদনায় ম্লান হয়ে আসা গলায় মিসেস শেলবি বললেন। কিন্তু যিশু ছাড়া আর কেউই তোমার ভাঙা বুক জোড়া দিতে পারবে না, ক্লো। একমাত্র উনিই পারেন স্বামীহারা শোকের সান্ত্বনা দিতে।’
অনেকক্ষণ ধরে সবাই কাঁদার পর, জর্জ ধীরে ধীরে টম চাচার মৃত্যুর শেষ গৌরবময় দৃশ্যটা বর্ণনা করল এবং সবাইকে কীভাবে তার হৃদয়ের ভালোবাসা জানিয়েছে, সে কথাও বলল।
.
এই ঘটনার প্রায় এক মাস পরে, একদিন জর্জ তাদের ভূসম্পত্তিতে নিয়োজিত সমস্ত ক্রীতদাস-দাসীদের ডেকে বিরাট হলঘরটাতে জড়ো করল। প্রথমটায় ওরা ব্যাপারটার গুরুত্ব কিছুই উপলব্ধি করতে পারে নি, কিন্তু প্রত্যেকের হাতে যখন একটা করে দলিল দিয়ে বলা হলো আজ থেকে ওরা স্বাধীন, এগুলো ওদের মুক্তিপত্র, তখন ওরা সত্যিই খুব অবাক হয়ে গেল। একই সঙ্গে শোনা গেল কান্না আর উল্লাসধ্বনি।
কেউ কেউ অত্যন্ত বিনীতভাবে দলিলটা ফিরিয়ে দিয়ে কাতর স্বরে মিনতি করল স্বাধীনতার চাইতে আমরা এখানে অনেক ভালো আছি, কর্তা। এতদিনের পুরনো মনিব- মনিবানিকে ছেড়ে আমরা কোথাও যেতে চাই না।
ওদের উদ্বিগ্ন-কাতর সরল মুখগুলোর দিকে তাকালে সত্যিই মায়া হয়।
‘বহুদিনের পুরনো বন্ধুরা আমার, এ জায়গা থেকে আমাদের ছেড়ে আমাদের কোথাও চলে যেতে হবে না। জমি আর বাড়ির প্রতিটা জায়গাতেই তোমাদেরকে আমার প্রয়োজন এবং তোমরা যেমন এতদিন কাজ করছিলে, ঠিক তেমনি ভাবেই কাজ করবে। কিন্তু কাজের বিনিময়ে তোমরা মজুরি পাবে, কেননা আজ থেকে তোমরা স্বাধীন। বলা যায় না, যদি আমি কখনো ঋণী হয়ে পড়ি কিংবা মারাই যাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা ঘটে তখন তোমাদের অন্য কোথাও বিক্রি করে দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
‘শুধু তাই নয়, আজ থেকে আমি ঠিক করেছি, তোমাদের প্রত্যেককেই শিক্ষা দেব! হয়তো কিছুটা সময় লাগবে, তবু প্রতিটা স্বাধীন মানুষ হিসেবে তোমাদের কাছে আশা করব তোমরা শেখার আগ্রহ প্রকাশ করবে, তোমরা ভালো হবে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবে। আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন জীবিত থাকব, তোমাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব।’
সমস্ত চুল পেকে সাদা হয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ, আজকাল চোখে যে ভালো দেখতেও পায় না, কাঁপা কাঁপা হাত দুটো ওপরে তুলে বলল, ‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, কর্তা!’
‘আর শুধু একটা কথা, তোমরা আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু, টম চাচাকে কখনো ভুলো না।’
জর্জ তখন টমের মৃত্যুর শেষ দৃশ্যটা সংক্ষেপে বর্ণনা করল এবং এ পৃথিবীর প্রতিটা মানুষকে সে কীভাবে তার হৃদয়ের আন্তরিক ভালোবাসা জানিয়েছে সে-কথাও বলল, ‘বন্ধুরা আমার, তার কবরের সামনে নতজানু হয়ে বসে আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করেছিলাম, আমার নিজের আর একজনও ক্রীতদাস থাকবে না। যদি সম্ভব হয় আমি প্রত্যেককেই মুক্তি দেব। যাতে অন্তত আমার জন্যে ওদের কাউকে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন কোনো আবাদভূমিতে আমার টম চাচার মতো নিঃসঙ্গ অবস্থায় মরতে না হয়। তাই জীবনে তোমরা যদি কখনো মুক্তির স্বাদ অনুভব করো, মনে কোরো সেই মুক্তির জন্যে তোমরা চিরঋণী মহৎ হৃদয় সেই মানুষটার কাছে। যখনই তোমাদের টম চাচার ঘরটার দিকে চোখ পড়বে, মনে মনে স্মরণ করবে সৎ আর বিশ্বস্ত সেই মানুষটাকে, আপ্রাণ চেষ্টা করবে ঠিক তাঁর মতোই অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে উঠতে।’